ঝিকড়গাছায় ঝঞ্ঝাট - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের আঠাশতম আখ্যান

একে একে এতগুলি গল্প পেরিয়ে আসার পরে এ একরকম প্রতিষ্ঠিত সত্য— অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ব্যাকড্রপ হিসেবে গাঁ-গঞ্জ গোছের এলাকাই লেখক শীর্ষেন্দু বেশি পছন্দ করেন। আঠাশ নম্বর অদ্ভুতুড়ের গল্প শুরুই হয়েছে গ্রামের হাট থেকে।

ঝিকরগাছার হাট। আর পাঁচটা গ্রামের হাটের মতোই জমজমাট, পাওয়া যায় না এমন জিনিস নেই, আশপাশের এলাকা তো বটেই দূরদূরান্ত থেকে এ হাটে বেচাকেনা করতে আসে মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সিলেবাসে যারা পড়াশোনা করেছে, তাদের মনে থাকতে পারে ছোটবেলায় বাংলা বইতে এমন কিছু গ্রামের হাটের টুকরো ছবি থাকতো। সহজপাঠের একটা খুব চেনা কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়— ‘হাট বসেছে শুক্রবারে বকশিগঞ্জের পদ্মাপারে’। লেখক বোঝেন তাঁর টার্গেট অডিয়েন্সের আবেগী মনস্তত্ত্ব। ঝিকরগাছার হাটের বর্ণনা গল্পের শুরুতেই এমন করে দিয়ে দিয়েছেন, পড়লে ‘কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি’র কথা মনে পড়তে বাধ্য। সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ভেবে ফেলে, আরে, এই তো আমার চেনা গ্রাম, এমন হাটের কথা তো আমি কত পড়েছি ছোটবেলায়।

এতগুলি অদ্ভুতুড়ে পড়ার পরে এটুকু তো ভালোমতো বুঝে নেওয়া গেছে, লেখক গেঁয়ো চোরেদের ভারী স্নেহের চোখে দেখেন। ঝিকরগাছা হাটের ইনট্রো শুরু হতে না হতেই দেখা যাচ্ছে, হাটে চোর গিজগিজ করছে।

“তা বলে সবাই যে এসে ঝিকরগাছার হাটে পয়সা কামিয়ে নিয়ে যায় বা জিনিসপত্র কিনতে পারে তা নয়। ওই যে নবগ্রামের রসো পান্তি মুখখানা হাসি হাসি করে গন্ধবণিকদের দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করছে আর চতুর চোখে চারদিকে চাইছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছে না। হরিহরপুরের প্রসন্ন হালদারের কোমরের গেঁজেতে না হোক আজ তিন-চার হাজার টাকা আছে। হালদারের পো-র পাটের দড়ির কারখানা। ঝিকরগাছার হাটে ফি হাটবারে শস্তায় পাটের গুছি কিনতে আসে। তা সেই গেঁজেটাই তাক করে অনেকক্ষণ ধরে তক্কে তক্কে ঘুরছে রসো। সঙ্গে চেলা হাঁদু। গেঁজেটা গস্ত না করলে চেলার কাছে মান থাকবে না।”

রসোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হাঁদুর নজর গিয়ে পড়ে জমিদারি সাজ সেজে আসা একজন লোকের ওপরে। দামি ঘড়ি আংটি চেন নগদ ক্যাশ— সবমিলিয়ে এটি বেশ উপযুক্ত শিকার। বারকয়েক আগুপিছু করে যেই না তারা সেদিকে এগোতে গেছে, সাতহাটির দুর্গা মালো হাজির। সেও আরেক চোর। তবে সে সূক্ষ্ম কাজের কারবারি নয়, সে ছিনতাইবাজ। তার কেরিয়ার প্ল্যান হল, সে একদিন নিজের ডাকাতদল খুলবে।

“পেছন থেকে একটি সরু গলা রসোর কানের কাছে বলে উঠল, “খবরদার! ওটির দিকে নজর দিয়ো না। গত আধ ঘণ্টা ধরে আমি ওটাকে তাক করে রেখেছি। যদি ভাল চাও তো সরে পড়ো।"

ঘাড় ঘুরিয়ে রসো যাকে দেখল তাকে দেখে অনেকেরই রক্ত জল হয়ে যায়। সাতহাটির দুর্গা মালো। খুনজখম দুর্গার কাছে জলভাত। লাঠি সড়কিতে পাকা হাত, গায়ে অসুরের জোর। তার ওপর তার দলবলও আছে।

রসো দেঁতো হাসি হেসে বিনয়ের সঙ্গে বলল, "তা আগে বলতে হয় রে ভাই। তোমার জিনিস জানলে কি আর ওদিকপানে তাকাই?"

হাঁদু উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিতান্তই নির্লজ্জের মতো হাত কচলে দুর্গাকে বলল, "ওস্তাদজি, কতদিন ধরে আপনার পায়ে একটু ঠাঁই পাব বলে বসে আছি। অধমকে যদি একটু ঠাঁই দেন..."

দুর্গা মালো চাপা একটা ফুঁ দিয়ে বলল, “যাঃ ব্যাটা তিনফুটিয়া, আমার দলে ঢুকতে হলে আগে বুকের ছাতি আর হাতের গুলি চাই, বুঝলি! এসব তোর কম্ম নয়। রসোর শাগরেদি করছিস তাই কর।"

হাঁদুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল রসো। আড়ালে এসে চুপিচুপি বলল, “ছিঃ হাঁদু, এত অল্পেই হাল ছেড়ে দিলি? হুট করে গুরু বদলালে পাপ হয়, তা জানিস?"

হাঁদু হেঁদানো গলায় বলে, "তা কী করব মশাই, আপনার কাছে থেকে যে আমার কোনও উন্নতিই হচ্ছে না! আমাকে তো আখেরটা নিয়ে ভাবতে হবে নাকি?"

গ্রামের হাটে বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে। ভজহরি ম্যাজিশিয়ান ঝিকরগাছার হাটে ত্রিশবছর যাবৎ ম্যাজিক দেখিয়ে আসছে। তবে এখন সে বুড়ো হয়েছে। বেশি কসরতের ম্যাজিক সে এখন আর দেখাতে পারে না। রসো চোরের মতো তার চেলারাও তাকে আড়ালে দুচ্ছাই করে। তবে একবার নাকি সে ম্যাজিকের মতো ম্যাজিক দেখিয়েছিল। গঙ্গাধরপুরের রাজবাড়িতে গিয়েছিল ম্যাজিক দেখতে। কোনও এক ভূতুড়ে শক্তি নাকি তাকে দিয়ে তার জীবনের সেরা ম্যাজিকগুলো দেখিয়ে নিয়েছিল।

ভজহরির জীবনে একটু রহস্যের ব্যাপার আছে, এইটুকু মাত্র আভাস দিয়ে লেখক আবার মন দিলেন হাটের গল্পে। দেখা যায়, রসো চোর দুর্গা চোরদের দেগে রাখা সেই বাবুমতো লোকটি ভজহরির ম্যাজিক শো দেখতে আসছে। গন্ধে গন্ধে এসে পড়ে হাটের সবকটা চোর, সবাই মিলে শোয়ের টিকিট কিনে হাউস ফুল করে দেয়। কিন্তু বাজি মাৎ করে দুর্গা চোর। সবাই তো জানেই, এমনকি সে নিজেও একটু একটু বোঝে তার হাত সূক্ষ্ম কাজে দড় নয়। তবু কীভাবে যেন বাবু মতো লোকটির ওপর হাতসাফাই চালাতে এতটুকু বাধা পড়ে না, ঠিক যেন লোকটি ইচ্ছে করেই পকেটমার হতে দিচ্ছেন।

“দুর্গা খুব নরম হাতে কাটারটা ধরে লোকটার গলার চেনটা কট করে কেটে ফেলে টেনে নিল। এ কাজটা অবশ্য খুব সূক্ষ্ম হল না। দুর্গার মনে হল হারটা কাটবার সময় কাটারটার একটা খোঁচা লেগেছে লোকটার গলায়। কিন্তু খেলা দেখে লোকটা এতই মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছিল যে, খোঁচাটা খেয়ালই করল না। এরকম ক্ষণজন্মা পুরুষ না হলে কি কাজ করে সুখ!

লোকটা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছে। দেখতে দেখতে আনমনে হাতের আংটিগুলো একটা একটা করে খুলছে আর পরছে, খুলছে আর পরছে। অনেকের এরকম চঞ্চল স্বভাব আছে বটে। দুর্গা খুব ঠাহর করে ব্যাপারটা লক্ষ করতে লাগল। শেষ অবধি লোকটা আংটিগুলো খুলেই ফেলল। তারপর অবহেলাভরে পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে রেখে দিল।

আহা, দেশটায় যে কেন এরকম লোক আরও অনেক জন্মায় না কে জানে! দুর্গা ফের ওস্তাদজিকে স্মরণ করে খুব মোলায়েম হাতে আংটিগুলো বের করে নিল। এত চমৎকার ভাবে কাজ হাসিল হয়ে যাচ্ছে দেখে দুর্গা নিজেও অবাক।

আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে ভেবে দুর্গা উঠে পড়তে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময়ে ভজহরি তার পরের খেলা শুরু করেছে। তার এক শাগরেদকে একটা কাঠের তক্তার গায়ে দাঁড় করিয়ে ভজহরি চোখ বেঁধে একের পর এক ছোরা ছুড়ে মারতে লাগল আর সেগুলো সাঁত সাঁত করে গিয়ে শাগরেদের শরীর ঘেঁষে তক্তায় গেঁথে যেতে লাগল।

এই খেলা দেখে লোকটা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, "উঃ বড় গরম লাগছে তো,” বলে গা থেকে পাঞ্জাবিটা খুলে পাশের খালি জায়গাটায় রেখে দিল।

ভগবান যখন দেন তখন এভাবেই দেন। দিয়ে যেন আশ মেটে না। দিতে দিতে যেন ভগবানের একেবারে খুন চেপে যায়। নিতে না চাইলেও জোর করে যেন গছাবেনই। ভগবানকে চটাতে যাবে কোন আহাম্মক? দুর্গা তাই পাঞ্জাবি থেকে চটপট বোতাম খুলে নিল।”

রহস্য আরও দানা বেধে ওঠে। হাটে তখন আরেক জায়গায় ঘটছে আরও এক অদ্ভুতুড়ে কান্ড। সনাতন রায়, মামুলি মনোহারি দোকানি। কিন্তু তার শখটি ভারী অদ্ভুত। সে বিটকেল জিনিস কেনে। চিনেলণ্ঠন, ভাঙা পুরনো শেজবাতি, পুরনো পেতলের পিলসুজ, বহু পুরনো আবছা-হয়ে-আসা অয়েল পেন্টিং, তুলোট কাগজ আর তালপাতার কিছু পুঁথি, ব্রিটিশ আমলের পুরনো সেন্টের খালি শিশি, নাগাদের তির-ধনুক, দোয়াতদানি, অচল পয়সা কী নেই তার ঘরে! কেন এসব সে জমায়, জিজ্ঞেস করলে সনাতন কেবল লজ্জার হাসি হাসে। বিটকেল জিনিস কেনা ছাড়া তার আর কোনও শখ-আহ্লাদ নেই। এরকম একজন চরিত্রকে পাওয়া গিয়েছিল ষোলো নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘ছায়াময়’ গল্পে। সে ছিল এক ছোট্ট ছেলে, অলঙ্কার। সেও অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসপাতি কুড়িয়ে এনে জমাতে ভালোবাসত। আঠাশনম্বর অদ্ভুতুড়ের সনাতন যেন সেই অলঙ্কারেরই অ্যাডাল্ট ভার্সন।

সনাতন এসেছে তার চেনা দোকানি দানুর কাছে। দানু এককালে চুরি ডাকাতি, চোরাই মালের ব্যবসা করেছে। এখন সে বুড়ো হয়েছে। হাটে বসে পুরনো জিনিস বেচে দেয়। ‘সশরীরে অদৃশ্য হইবার কৌশল’, ‘শূন্যে ভাসিয়া থাকিবার সহজ উপায়’— সেই যে হোক্স বইগুলো পড়ে পথের পাঁচালির অপু শকুনের ডিম খুঁজতে বেরিয়েছিল, তেমন সব বই দানুর কাছেও আছে। এদিক সেদিক থেকে চুরি করে আনা পুথি, ছবি, রাজবাড়ি জমিদারবাড়ির ফেলে দেওয়া জিনিস— সব দানুর দোকানে মজুত। পছন্দমতো আজব জিনিস খুঁজতে খুঁজতে সনাতনের চোখ আটকায় ইঞ্চিদশেক লম্বা ভারী একটা কাঠের বাক্সে। তার চাবিটি নিরুদ্দেশ। দরকষাকষি করে হাজারটি টাকায় সনাতন বাক্স কিনল।

কিন্তু বাক্স যেই না বেরল দানুর জিম্মা থেকে, হাটের চতুর্দিকে অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানার যেন মেলা বসে গেল। ওই বাক্সের পেছনে গোটাদুয়েক খদ্দের ছিনে জোঁকের মতো লেগে পড়েছে। তাদের ঝেড়ে ফেলে কার সাধ্যি। ভুজুংভাজুং দিয়ে, ভয় দেখিয়ে সনাতনের থেকে বাক্স কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে।

ফের গল্পে লেখক ব্যবহার করেন সেই চেনা ট্রিক, লোভনীয় খাবারদাবারের সুস্বাদু বর্ণনা।

“রামগোপালের রাবড়ি হল সরে দুধে মাখামাখি, ওপরে ননি ভেসে থাকে। মুখে দিলেই মনে হয়, স্বর্গে উঠে গেলাম। লোকটা দিলদরিয়া আছে। একপো রাবড়ি আর দশখানা ছানাবড়া হুকুম দিয়ে বসল।

ভারী লজ্জায় লজ্জায় খাচ্ছিল সনাতন। তবে রামগোপালের রাবড়ি আর ছানাবড়া এতই ভাল জিনিস যে, লজ্জা সংকোচ বজায় রাখা কঠিন।

সনাতন খাচ্ছে আর নটবর সামনে বসে 'আহা, উহু' করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বলছে, "আহা, বেশ রসিয়ে রসিয়ে খান তো মশাই, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বেশ গুছিয়ে ধীরেসুস্থে জিবে টাগরায় মাখিয়ে নিয়ে খেতে থাকুন।"

সনাতন বলল, "সেই চেষ্টাই তো করছি মশাই, কিন্তু রাবড়িটা যে জিবে গিয়েই হড়কে যাচ্ছে।"

"তা হলে আর একপো দিতে বলে দিই।"

নটবর এসেছে বাক্স হাতানোর ধান্দায়। সনাতনের রাবড়ি শেষ হতে না হতেই আরেক মুশকো চেহারার লোক এসে পড়ে। তাদের গরম গরম বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়, ওই বাক্সের জন্য নাকি ইতিমধ্যেই অনেক খুনখারাপি হয়ে গেছে। বাক্সের ওপর নাকি জনৈক কুমার বাহাদুরের চোখ পড়েছে। গল্পে সাসপেন্স ঘনীভূত হয়। কে এই কুমার বাহাদুর? বাক্সেই বা কী আছে?

সাসপেন্স বজায় রেখেই লেখক সরে আসেন হাটের অন্যপ্রান্তে, আলো ফেলেন অন্য চরিত্রের ওপর। নবকান্ত। তার শখ ঝুটঝামেলা দেখা, তারিয়ে তারিয়ে অন্য লোকের দুর্দশা উপভোগ করা। হাটে গণ্ডগোল বাধলে সে মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। এই নবকান্ত আমাদের বড্ড চেনা লোক। পাড়ায় পাড়ায় এমন কত নবকান্তরা ছড়িয়ে আছে, ইয়ত্তা নেই। ঝিকরগাছার হাটে চৈত্রমাসে আগুন লেগেছিল, নবকান্ত দু’চোখ ভরে আগুনের বাহার দেখে নিয়েছিল। বৈশাখে ক্ষ্যাপা ষাঁড় ঢুকে হাট লণ্ডভণ্ড করেছিল, নবকান্ত ভারী মজা পেয়েছিল। শ্রাবণমাসে হাটে দাঙ্গা বাধল, নবকান্ত দেখে চক্ষু সার্থক করল। কার্তিকমাসে পুলিশ এসে নেলো ডাকাত ভেবে দেড়শো লম্বাচওড়া লোককে তুলে নিয়ে গেল, তাদের নাকাল হতে দেখে নবকান্ত আহ্লাদে আটখানা।

“তারপর অগ্রহায়ণ গিয়ে এই পৌষ চলছে। কিন্তু গা গরম হওয়ার মতো ঘটনাই ঘটছে না মোটে। গত হপ্তায় নরেন ঘোষের সঙ্গে সাতকড়ি নন্দীর একখানা ঝগড়া হয়েছিল বটে। সাতকড়ি ঝগড়ায় বড্ড ভাল। এমন মোক্ষম কথা কইবে যে, কান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু নরেন ঘোষটা কাজের নয়। রেগে গেলে তোতলাতে থাকে, চোখমুখ রাঙা হয়ে যায়। ওরে বাপু, ঝগড়াও তো একটা আর্ট, না কি! মাথাটি ঠান্ডা রেখে পাটে পাটে কথা কইতে হয়, তার মধ্যেই হুল দিতে হয় মিষ্টি করে। গলার ওঠাপড়াও এক এক জায়গায় এক এক রকমের হওয়া চাই। তা দেখা গেল নরেন ঘোষের ঝগড়ায় এখনও অন্নপ্রাশনটাই হয়নি। দু-চার কথার পরই রণে ভঙ্গ দিল। ধুস! ভাল ভাল চর্চা সবই উঠে যাচ্ছে দেশ থেকে!”

নবকান্ত লোকের বিপদ দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু বিপদ যখন তার নিজের ঘাড়ে চেপে বসে? উঁহুঁ, সেইটি নবকান্তর মোটেই পছন্দ নয়।

“হঠাৎ উদ্‌ভ্রান্ত চেহারার অল্পবয়সি একটা ছোকরা ঝড়ের বেগে এসে তার পথ আটকে বলল, "মশাই, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন? আমার বড় বিপদ।"

বিপদের কথায় ভারী খুশি হয়ে নবকান্ত বলল, "বাঃ, বাঃ, এ তো খুব ভাল কথা! তা কী বিপদ বেশ খোলসা করে বলো তো!"

সনাতন বাক্স বিদেয় করতে পারলে বাঁচে, তার পেছনে গুন্ডা লেগেছে। প্রাণের দায়ে সে বাক্স দিয়ে দেয় নবকান্তকে, সঙ্গে নিজের নাম আর গ্রামের নামও বলে যায়, হয়তো গুন্ডারা পিছু ছাড়লে বাক্স ফেরত নিয়ে যাবে সেই আশায়।

“গোরা ময়রার বোঁদের চেহারা যেমন মুক্তোর মতো, স্বাদেও তেমনই। কিন্তু আজ নবকান্ত তেমন স্বাদ পাচ্ছিল না। আনমনে খেয়ে যাচ্ছিল মাত্র। কোলে চাদর ঢাকা দেওয়া কাঠের ভারী বাক্সটা। দুশ্চিন্তা সেটা নিয়েই। ছোকরা বলছিল যে, তার বড় বিপদ। তা বিপদ যদি এই বাক্সখানার জন্যই হয়, তা হলে সেই বিপদ আবার নবকান্তকেও তাড়া করতে পারে। চোখের সামনে ঘটনা ঘটতে দেখলে নবকান্ত খুশি হয় বটে, কিন্তু তা বলে ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে সে মোটেই ভালবাসে না।”

নবকান্তর আশঙ্কা সত্যি হয়। গুন্ডারা তার পিছু ধাওয়া করতে শুরু করে।

এরপর আবারও সাসপেন্সের পরিবেশটি অক্ষত রেখেই লেখক গল্পের মোড় ঘুরিয়ে পাঠককে এনে ফেলেন এক রাজবাড়িতে। নামেই সে রাজবাড়ি, আজ তার দৈন্যদশা। রাজার সিংহাসনে ছারপোকা, গদি ছিঁড়ে ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে, তাতেই বুড়ো রাজা গুটিসুটি মেরে বসে ঝিমোন। রানিমা এসে বলে যান সরষের তেল বাড়ন্ত, গয়লার টাকা বাকি, মুদির দোকানে তিনশো টাকার ওপর ধার, দক্ষিণের ঘরে দেওয়ালের চাপড়া খসে পড়ছে।

অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এমন ‘রাজবাড়ি’র সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রথম অদ্ভুতুড়ে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ গল্পের রাজবাড়িতে রানীমা ঘুঁটে দিতেন! আঠেরো নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘নবীগঞ্জের দৈত্য’ গল্পের রাজবাড়িরও ছিল হতশ্রী দশা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে গ্র্যাঞ্জার বস্তুটি গোড়া থেকেই নেই। ‘বনি’ ছাড়া আর কোনও গল্পে এখনও পর্যন্ত ঝাঁ চকচকে জীবনযাপনের হদিশ মেলেনি। গ্রাম্য মধ্যবিত্ত গেরস্থ, ছিঁচকে চোর, গুটিকতক অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানা ভূতপ্রেত নিয়েই গোটা সিরিজ এগিয়ে চলেছে। এখানে এক একজন এমন সব চরিত্র এসেছে, যাদের জীবনের অ্যাম্বিশনগুলি শুনলে আমাদের ঘোর মেটিরিয়ালিস্টিক আত্মা লজ্জায় মুখ ঢাকে। এক ছিঁচকে চোর ঘটিটা বাটিটা চুরি করে পেট চালায়। সে রাতে শুয়ে রোজ ভাবে, সে যদি হঠাৎ একদিন অনেক টাকা পেয়ে যায়, তাহলে লাল গামছা কিনবে বারোটা! কারওর স্বপ্ন কচুর লতি দিয়ে রোজ পুঁইশাক খাওয়ার। কেউ চায় রোজ জিলিপি খেতে। ছোট ছোট মানুষগুলোর আরও ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলোর মাঝে হয়তো আলিসান রাজবাড়ি, কেতাদুরস্ত ফ্যাশনেবল শহুরে চরিত্রগুলো কিঞ্চিৎ বেমানানই লাগত। রাজার সিংহাসনের গদিটি থেকে নারকেলের ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে, রাণীমা ঘুঁটে দিয়ে সংসার চালান— মনের অজান্তেই সেই দীনহীন রাজবাড়িগুলোর ওপর অনেকখানি স্নেহ, মায়া গিয়ে পড়ে। ঠিক যেমন করে ডানাছেঁড়া প্রজাপতি, পা ভাঙা নেড়ি, ঝড়ে পড়ে যাওয়া পাখির ছানাদের ওপর একটা মায়া জন্মে যায়।

এ গল্পের রাজবাড়ির রাজকুমারও বহুদিন নিরুদ্দেশ। বছরদশেক আগে কালীমাস্টারের কানমলা খেয়ে রাজকুমার বিবাগী হয়ে যান। সম্প্রতি একজন এসেছে বটে, তবে সে নকল রাজকুমার। কথাটা আবার রাজা রাণী দুজনেই বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু তাঁদের কাছে ‘নেই মামার চাইতে কানা মামা ভালো’। অতএব, দুজনেই মুখ বন্ধ রেখেছেন।

নকল রাজপুত্র বাড়ি এসেই চতুর্দিকে জুলুমবাজি করে রাজস্বের নামে তোলা আদায় করে বেড়াচ্ছেন। তবে তাঁর নজর অন্যদিকে। এই রাজবাড়িতেই বহুবছর আগে ভজহরি ম্যাজিশিয়ান খেলা দেখিয়েছিল। খেলায় ভুলচুক ঘটেছিল বিস্তর, কিন্তু খেলা দেখতে এসেছিলেন বারোজন ভূত। তাঁরা এ রাজবাড়ির পুরনো মহারাজা। ভূতেদের দয়ায় ভজহরির ভুলগুলো থেকে সাংঘাতিক কোনও বিপদ হয়নি, উলটে সে আশ্চর্য রকম ম্যাজিক দেখিয়ে ভূতেদের থেকে সোনার মোহর নজরানা পায়।

রাজবাড়ির একজন পাগলাটে বুড়ো চাকর তাকে চুপিচুপি বলে, তার কাছে বাক্সভর্তি আরও মোহর আছে। সবই নাকি রাজবাড়ির ভূতেরা দিয়েছে। তখনের মতো ফিরে গেলেও লোভের বশে ভজহরি ফের রাজবাড়িতে আসে, বুড়ো চাকরকে খুন করে মোহরভর্তি কাঠের বাক্স নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে বাক্স তার কাছে থাকেনি। বিভিন্ন ডাকাতদল আক্রমণ করতে থাকে। বাক্স বারবার হাতবদল হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়। সেই বাক্সই হঠাৎ মিলেছে ঝিকরগাছার হাটে দানুর কাছে।

ভজহরি পেটপাতলা মানুষ। রাজবাড়ির ভূত, সোনার মোহরের কথা সে বিশ্বাস করে তার এক ছোকরা চেলাকে বলে দেয়। সে চেলা দল ছেড়ে চলে যায়। সেই চেলাই আজ নকল রাজকুমার সেজে হাজির হয়েছে ভূতেদের ঘরে ঢুকে মোহর আদায়ের লোভে।

গল্প সবটুকুই ‘কাকতালীয়’ কথাটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাক্স যে দানুর কাছে আছে, কী করে জানা গেল? দানুর কাছে বাক্স যখন এল, নকল রাজকুমারও তখনই ঢুকল হাটে। নকল রাজকুমার বেশ দস্যুগোছের লোক, সে তো চাইলেই দানুর থেকে স্রেফ ছিনিয়ে নিতে পারত বাক্সটা। এতগুলো লোক লাগিয়ে একে মিষ্টি খাইয়ে তার সাথে খেজুরে আলাপ জুড়ে বাক্স হাতানোর কী দরকার ছিল? আবার এতকিছু যখন ঘটছে, আসল রাজকুমারও কীভাবে যেন হাওয়ায় গন্ধ পেয়ে নিজের বাড়ির কাছে হাজির! গল্পের ক্লাইম্যাক্সও কেমন যেন তড়িঘড়ি করে এসে পড়ল। হঠাৎই রহস্য সব ফাঁস হয়ে গেল। হঠাৎই আসল রাজকুমার গটগটিয়ে বাড়ি ঢুকলেন আর নকল রাজকুমার সাঙ্গোপাঙ্গোসহ ভূতের ঘরে ঢুকে চিরদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। আরও একটু রইয়ে সইয়ে গল্পটা বলা যেত না?

তবে একটা ব্যাপার বেশ চোখে পড়ার মতো। যত সিরিজ এগোচ্ছে, মারদাঙ্গা খুনজখম বাড়ছে। এইটি নিয়ে সিনেমা বানালে বেশ ভালো কিছু অ্যাকশন সিন দেখতে পাওয়া যাবে।