বনি : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের চতুর্দশ আখ্যান

‘বনি’ একটি সুপারন্যাচারাল বেবি, মায়ের পেটে এমব্রায়ো অবস্থায় থাকার সময় কয়েকজন দুষ্টু বিজ্ঞানী তার মধ্যে একটা মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারা চেয়েছিল বনি বড় হয়ে ওই বিজ্ঞানীদের আধা মানুষ আধা রোবট গোছের আজ্ঞাবহ দাস হবে। শুধু বনি না, এমন আরও অনেক আনবর্ন বেবিদের ওপর এইরকম কিম্ভূত এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছিল দলটা। সাকসেস রেট ছিল শূন্য। এক্সপেরিমেন্টে মৃত্যুই ছিল এই বেবিগুলোর ভবিতব্য। শুধু গল্প যাকে নিয়ে, সেই বনি-ই একমাত্র ব্যতিক্রম। কোনও এক অজানা কারণে বনির মাইক্রোচিপ ঠিকমতো কাজ করেনি। ফলে বনি বেঁচে থাকে কিন্তু সে প্যারালাইজড হয়ে যায়। বিপদে, খুশিতে তার চোখের রং বদলায়। সে নিজের ব্রেনের ওয়েভলেংথ কম্পিউটারের পর্দায় অক্ষর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। দেখতে সে খুদে কয়েকমাসের ছোট্ট বেবি, কিন্তু আদতে সে একখানা রোবট যার মস্তিষ্ক কাজ করছে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতো। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের চোদ্দনম্বর উপন্যাসের এইটিই হল স্টোরিলাইন।

‘বনি’ পড়ার আগে দেখেছিলাম ‘দি মিডউইচ কাক্কুস’ (The Midwich Cuckoos) নামে একটি টিভিসিরিজ, যার স্টোরিলাইনের সঙ্গে বনি-র অদ্ভুত মিল। ১৯৫৭তে জন উইন্ডহ্যাম লেখেন মিডউইচ কাক্কুস। আর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘বনি’ লিখেছেন ১৯৯০তে। মিডউইচ কাক্কুস শীর্ষেন্দুকে ইনফ্লুয়েন্স করেছিল কিনা, তা জানা নেই। হতেও পারে, এমন মিল নেহাতই কাকতালীয়।

একটি গ্রাম মিডউইচ, উইনশায়ার। সেখানে ঢোকার  পথে একদিন ঘটে দুটি রোড অ্যাক্সিডেন্ট।  অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা যখন সেই গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে, তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হয় যে, হয়তো কোনও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়েছে গ্রামের ভেতর। বিদেশী শত্রুপক্ষের কারসাজিও হতে পারে, তাই ঝটিতি খবর দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তারা খাঁচাবন্দি একটা ক্যানারি পাখিকে ঢোকালো গ্রামের বাউন্ডারির মধ্যে। সেটিও অজ্ঞান হয়ে পড়ল, কিন্তু বাইরে নিয়ে এলেই পাখিটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সেনাবাহিনীর বিজ্ঞানীরা রাতভোর গবেষণা চালাতে থাকলেন। জানা গেল, গ্রামের সব্বাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। যতটা এরিয়া জুড়ে এই ব্যাপারটি ঘটছে, সেইটি একটি নিটোল গোলাকার এলাকা যার ব্যাসার্ধ ৩.২ কিমি এবং এই বৃত্তের কেন্দ্রে পড়ে রয়েছে একটি রহস্যময় রূপালী বস্তু।

পুরো একটা দিন পর গ্রামবাসীরা জ্ঞান ফিরে পায় এবং সেই রহস্যময় রূপালী বস্তুটিও ভ্যানিশ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা এই লম্বা ঘুমিয়ে থাকার সময়টির নাম দিলেন ‘ডে আউট’। প্রথম প্রথম কারওর মধ্যে কোনওরকম অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। কিন্তু কিছু মাস পর দেখা গেল, গ্রামের সমস্ত প্রজননক্ষম মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে। হিসেব করে দেখা গেল, এই প্রেগন্যান্সিগুলি সবই ওই ‘ডে আউট’এর সময়টায় ঘটেছে।

ন’টা মাস পর জন্মালো ৩১টি ছেলে ও ৩০টি মেয়ে। তারা দেখতে মোটামুটি সবাই স্বাভাবিক, তবে তাদের চোখের রঙ সোনালি, চুল ব্লন্ড, এবং ত্বকের রং কিছুটা রূপালী। এই বাচ্চাগুলির মধ্যে তাদের মায়েদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের কোনও ছাপ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, তারা কেউ পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষ নয়। তাদের মধ্যে টেলিপ্যাথির ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা মানুষের মন ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাত্র ন’বছর বয়সেই তারা ষোলো বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর মতো দেখতে হয়।

এই বাচ্চাগুলির কিছু সহজাত রিফ্লেক্স আছে, নিজেদের রক্ষা করার জন্য এরা অন্যের মন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটি যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারে। যেমন, এক তরুণ অনিচ্ছাকৃতভাবে এদের একজনকে ধাক্কা দিলে, বাচ্চাটি তাকে নিজের গাড়ি দেয়ালে ধাক্কা মেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। ষাঁড় তেড়ে এলে, তারা ষাঁড়টিকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলার ক্ষমতাও রাখে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাকি গ্রামবাসীরা এদের ভয় পেতে শুরু করে। একসাথে সবাই মিলে চড়াও হয় বাচ্চাগুলির ওপর। তাদের থাকার জায়গা মিডউইচ গ্র্যাঞ্জটি পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। তখন বাচ্চাগুলো লোকগুলোর মাইন্ড কন্ট্রোলে এনে তাদের নিজেদের মধ্যেই মারামারি বাধিয়ে দেয়।

সামরিক গোয়েন্দারা চুপ করে বসে ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে তারা জানতে পারে যে, একই ঘটনা বিশ্বের চারটি ভিন্ন অঞ্চলে ঘটেছে— কানাডার এক ইনুইট বসতি, অস্ট্রেলিয়ার একটি ছোট শহর, মঙ্গোলিয়ার একটি গ্রাম এবং রাশিয়ার গিজিনস্ক শহরে। ইনুইটরা এই নবজাতকদের নিজেদের সন্তান বলে মানতেই চায়নি, এতটুকু মায়া দেখায়নি তারা। বাচ্চাগুলিকে তারা মেরে ফেলেছে। মঙ্গোলিয়ার লোকেরা আরও নির্দয়, বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মায়েদেরও মেরে ফেলেছে। অস্ট্রেলিয়ার বাচ্চাগুলি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা গিয়েছে, হয়তো সেখানে এই  মাস প্রেগন্যান্সির প্রোসিডিওরে কিছু ভুলভ্রান্তি রয়ে গিয়েছিল। রাশিয়ার শহরটি সোভিয়েত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে একটি পরমাণু কামান দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।

মিডউইচের বাচ্চাগুলি নিজেদের বিপদের কথা বুঝতে পারে এবং নিজেদের বাঁচাতে সবরকম ক্ষমতা ব্যবহার করতে তৎপর হয়। গ্রামে বাইরে থেকে কোনও উড়োজাহাজ তারা ঢুকতে দেয় না। নেগোশিয়েশনে নামে সামরিক গোয়েন্দারা।  তাদেরই একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। বাচ্চারা জানায় যে, তারা বুঝতে পারছে পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য তারা বিপজ্জনক। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান একটাই— তাদের মরে যেতে হবে। তবে,গোটা গ্রাম বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে নিরীহ গ্রামবাসীরাও মারা যাবে। তারা কাউকে মারতেও চায় না, নিজেরাও বাঁচতে চায়। তারা দূরে কোনও নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে চায় এবং সরকারের কাছ থেকে একটা উড়োজাহাজ চায়।

মিডউইচের একজন বৃদ্ধ শিক্ষিত বাসিন্দা গর্ডন জেলাবি। তিনি বুঝতে পারেন যে এই বাচ্চাদের যত দ্রুত সম্ভব ধ্বংস করা দরকার। নয়তো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাঁর রয়েছে হার্টের সমস্যা। তিনি জানেন, তাঁর হাতে সময় বড্ড কম। এই বাচ্চাগুলো তাঁকে তাদের মেন্টরের মতো দেখতো। একমাত্র জেলাবিই এই বাচ্চাদের ধারেকাছে আসতে পারতেন। এক সন্ধ্যায়, তিনি বাচ্চাগুলির জন্য নিয়ে আসেন গ্রিক আইল্যান্ড নিয়ে বানানো একটা ডকুমেন্টারি। প্রোজেকশন মেশিনে লুকিয়ে রাখা ছিল বোমা। যথাসময়ে বিস্ফোরণ ঘটে। জেলাবি এবং এই সুপারন্যাচারাল বাচ্চাদের সবাই মারা যায়।

এই গল্পটি নিয়ে পরে তৈরি হয়েছে অজস্র মুভি, টিভি সিরিজ। ১৯৬০এ উলফ্ রিলা-র ডিরেকশনে তৈরি হয় ‘ভিলেজ অফ দি ড্যামড’, ১৯৬৪-তে আন্তন লিডার তৈরি করেন এর সিক্যুয়েল ‘চিলড্রেন অফ দি ড্যামড’। হালের মার্ভেল কমিকসের এক্স মেন সিরিজেও এই গল্পের ছায়া দেখা যায়।

মিউউইচ কাক্কুসে এইসব কাণ্ডকারখানা করেছিল এলিয়েনরা। তবে, শীর্ষেন্দুর ‘বনি’তে ভিনগ্রহীরা নেই, এদেশেরই কিছু মতিচ্ছন্ন বিজ্ঞানী সুপার সোলজার বানানোর চেষ্টা করছিল। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে গল্পটি বেরিয়েছিল, তাই ধরেই নেওয়া যায় এবারও লেখককে আয়তন বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে ফের তাড়াহুড়ো, যেমন তেমন ভাবে গল্প শেষ করার তাগিদ। গল্প লেখা হয়েছে ১৯৯০তে। জয়েন্ট ফ্যামিলির কনসেপ্ট যে ভাঙছে, আগের অদ্ভুতুড়েতে দেখা গেছে।  এইবার দেখা যাচ্ছে, বাঙালি মধ্যবিত্তরা বিদেশে সেটল করতে শুরু করেছেন। বাবুরাম আমেরিকায় প্রবাসী।  তিনি ইঞ্জিনিয়র। তাঁর স্ত্রী প্রতিভাও চাকরি করেন। এর আগের কোনও অদ্ভুতুড়েতে বাড়ির গিন্নি আপিসে যাচ্ছেন, এমনটা দেখা যায়নি। তবে এ গল্পের পটভূমিতে রাখতে হয়েছে বিদেশ, ভারতবর্ষ নয়। পশ্চিমবঙ্গের গেরস্থঘরে তখনও হয়তো এমন ছবি চোখ-সওয়া হয়ে ওঠেনি।

বাবুরাম এবং প্রতিভার কথা দিয়েই শুরু হয়েছে গল্প। তাদের দশবছর বিয়ে হয়েছে, কিন্তু তখনও কোনও বেবি হয়নি। দুজনেরই মনে তা নিয়ে একটু খারাপ লাগা রয়েছে। একদিন উইকেন্ডে তাঁরা যাচ্ছিলেন রোড ট্রিপে। গাড়িটি অ্যাক্সিডেন্ট করে। দু’দুটো দিন দুজনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। জেগে উঠে দেখেন দুজনে রয়েছেন একটি পোড়োবাড়িতে। কারা কীভাবে তাঁদের আনল, কিছুই তাঁরা বুঝতে পারেন না। ঘটনার এগারোমাস পর তাঁদের একটি বেবি হল, বনি। বাকি গল্পে বারবার বলা হয়েছে, প্রতিভার গর্ভে থাকা এমব্রায়োর ওপরেই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে দুষ্টু বিজ্ঞানীরা। তারা নাকি প্রেগন্যান্ট মা’দের ট্র্যাক করতো, সুবিধেমতো ক্যান্ডিডেট বেছে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করত। তাহলে হিসেব অনুযায়ী, ওই রোড অ্যাকসিডেন্টের সময়েই প্রতিভার প্রেগন্যান্ট থাকার কথা। কিন্তু তিনি তো তখন প্রেগন্যান্ট ছিলেন না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, ওটা আর্লি প্রেগন্যান্সি ছিল, প্রতিভা বুঝতে পারেননি। তাহলে বেবি ডেলিভার্ড হতে এগারোমাস সময় লাগে কীভাবে?প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত খুব বেশি জ্ঞান হয়নি, তবু এই হিসেবটা একটু গোলমেলেই লাগল।

এবারের গল্পে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হাতেগোণা কয়েকজন। শুভবোধসম্পন্ন চীনা বিজ্ঞানী ওয়াং আর তার বানানো রোবট চি চেং। ওয়াং চায় বনি এবং বনিদের মতো বাচ্চাদের ওপর যেভাবে এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে, তা বন্ধ হোক। বনিদের ওপর নজরদারি শুরু হলে বাবুরাম-প্রতিভা বনিকে নিয়ে পালিয়ে যান। সাহায্য করেন ওয়াং। চি চেং একটি রোবট, তালেগোলে সে গিয়ে পৌঁছে গেছে কলকাতার ছাপোষা গেরস্থ গদাইবাবুর বাড়ি। চি চেং চায় ওয়াং বা বনির মা বাবা তাকে যেন খুঁজে পায়। চি চেং নিজের ক্ষমতা কাছে লাগিয়ে গদাইবাবুর কালো সাদা টিভিতে বিদেশি রঙিন চ্যানেল চালাতে থাকে। ওয়াংয়ের নিউজ, বনির নিউজ দেখতে থাকেন গদাইবাবু। বনিকে নিয়ে বাবুরাম-প্রতিভা কলকাতা পালিয়ে আসেন। কাকতালীয়ভাবে জানা যায় গদাইবাবু হলেন বাবুরামের আত্মীয়ের প্রতিবেশী। বাবুরামের সঙ্গে মোলাকাত হয় চি চিংয়ের। রোবট চি চিং বলে, সে নাকি ‘ভালোমানুষ’!

সুপারন্যাচারাল প্রসঙ্গ না থাকলেও অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার কমতি নেই এ গল্পে। তবে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সেই চেনা হাসি মজা ঠাট্টা ইয়ার্কি এখানে লেশমাত্র নেই।

২০২১-এ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় তৈরি হয় ‘বনি’ সিনেমাটি। শীর্ষেন্দু গল্প যেমন লিখেছেন, সিনেমাটিও তেমন তেমন বানানো হয়েছে। সঙ্গত কারণেই কাহিনিতে কিছু হালকা অদলবদল ঘটেছে, তবে তাতে গল্পের স্বাদের হেরফের ঘটেনি।

শীর্ষেন্দুর ১৪নম্বর অদ্ভুতুড়েটিকে সায়েন্স ফিকশন বলা যায় নাকি সায়েন্স ফ্যান্টাসি, সেসব পণ্ডিতি তর্ক থাক। গল্প ভারী উপভোগ্য। শুধু আফশোস একটাই, এ জিনিস লেখককে লিখতে হয়েছিল পূজাবার্ষিকীর পাতায়। এ যদি ফরমায়েসী লেখা না হত, লেখক আরও একটু হাত খুলে লিখতে পারতেন।