‘অদ্ভুতুড়ে’ এবং শীর্ষেন্দু

ভূত আছে কি নেই, সে তর্ক পণ্ডিত মানুষেরা যত পারেন করুন। আমার মতো অপণ্ডিত মানুষ কিন্তু ভূত-প্রেত, দত্যি-দানো সব্বাই এ ধরাধামে বহাল তবিয়তে বিরাজমান ভেবে নিয়েই ভারী সন্তুষ্ট। টাপুরটুপুর বৃষ্টি দুপুরে ঝুপসি বেলগাছটার ফাঁকে ফোকরে ব্রহ্মদৈত্যরা এক এক পাত্তর হুইস্কি নিয়ে যে বসেন না, তা কে হলফ করে বলতে পারে? কিংবা সান্যালকাকুদের যে পোড়োবাড়িটা ফ্ল্যাট হতে হতে আধখ্যাঁচড়া অবস্থায় থমকে রয়েছে, সেইখানে মাঝরাতে শাঁখচুন্নিরা যে কিটিপার্টি করে না, তাই বা কীকরে বলা যায়? আমার স্কুল ছিল বেথুন, ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ সব্বাই জানে শীতের বিকেলে আলো ফুরোলেই বেথুনসাহেবের নট নড়নচড়ন ধুলোমাখা গাড়িটায় কে বা কারা এসে বসে পড়ে আর গাড়িও থেকে থেকে ভূতুড়ে গর্জন করে ওঠে। বছরখানেক আগে এই ভূতের টানেই গিয়ে পড়েছিলাম পারমাদানের জঙ্গলে। সেখানে নীলসাহেবের পোড়ো কুঠি, সামনে বয়ে চলেছে ইছামতী। মাঝরাতে একজন এসে পুরো দলটাকে নিয়ে চললেন ইছামতীর তীরে। সে লোকের সর্বাঙ্গ ঢাকা ছায়া ছায়া রঙ চাদরে, মাথায় তার মাঙ্কিটুপি, একহাতে লাঠি, আরেকহাতে হ্যারিকেন। শীতের রাতে কুয়াশার আলোয়ানে মোড়া ইছামতীর ঘাটে গিয়ে বসতেই গল্প হল শুরু। অনেক অনেক বছর আগে নাকি দুষ্টু নীলকরের ধড়টা মুণ্ডু থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তারপর থেকেই কুঠিতে নাকি.. গল্প আরও জমত যদি গল্পের কথকটি হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন আর ঘাটের সিঁড়িতে গড়াগড়ি খেত তাঁর ফেলে যাওয়া লাঠি আর হ্যারিকেন। সেসব কিছু হয়নি। ভূতেরা আসলে বড্ড লাজুক, বাস্তবের মাটিতে তাদের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। অগত্যা শরণাপন্ন  হতে হয় গল্পেরই। আর সে অদ্ভুতুড়ে দুনিয়ার একচ্ছত্র সম্রাট শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৮ থেকে ২০২২— টানা চুয়াল্লিশটা বছর ধরে একনাগাড়ে লিখে গিয়েছেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। টার্গেট অডিয়েন্স কিশোররা হলেও আট থেকে আশি সব্বাই মজে আছে এই সিরিজে। আপাতত এ সিরিজে আছে পঞ্চাশটা উপন্যাস, যার শুরুটা হয়েছিল ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ দিয়ে, আর শেষতম সংযোজন ‘এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা’। কুড়িনম্বর উপন্যাসটির নাম সিরিজের নামেই রাখা ‘অদ্ভুতুড়ে’।

শীর্ষেন্দুর নিজেই ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলেছেন,—“ ‘অদ্ভুতুড়ে’ নামটা যেমন, লেখাটাও তেমন। আসলে আমার ছোটদের সব উপন্যাসেরই নাম অদ্ভুতুড়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, নানারকম অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা তাতে দেদার থাকে। একই উপন্যাসে কল্পবিজ্ঞান আর ভূত মিলেমিশে গেছে হয়তো। আর যাবে না-ই বা কেন? মানুষের মনই তো এক আশ্চর্য আর আজগুবি জায়গা, সেখানে কত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কত অস্তি-নাস্তি, কত আলো আর অন্ধকার একাকার হয়ে বাস করে।”

‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মফস্বলের একটি আজব পরিবার, যার প্রতিটি সদস্য কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। ছিটের দিক থেকে পরিবারের কর্তা ভুবনবাবুটি সবচেয়ে সরেস। বয়েস পঁচাশি হলেও বুড়ো তিনি হননি। অলিম্পিকে ওয়েটলিফটিং করে এসেছেন। কম্পিটিশনের দিন একরাশ মাংস আর ডিম খেয়ে ওজন বাড়িয়ে ফেলায় তাঁকে লাইটওয়েটের বদলে হেভিওয়েটে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং বলাবাহুল্য তিনি কুটোটি নাড়তে পারেননি। মিলিটারিতে উঁচুপোস্টের অফিসার ছিলেন। বড় শখ ছিল যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়ার, তাই দেশ স্বাধীন হওয়াটা মোটেই মন থেকে মানতে পারেননি। যুদ্ধের উসকানি দিয়ে চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীকে, ফলাফলস্বরূপ কোর্ট মার্শাল হওয়ার জোগাড়। নেহাত তৎকালীন সরকার দয়ার অবতার, তাই ক্ষমাঘেন্না করে দেওয়া হল। কিন্তু ভুবন রায় তো ক্ষমার ধার ধারেন না, নাক সিঁটকে চাকরি দিলেন ছেড়ে। আর্মিক্যাম্প ছেড়ে গঞ্জের বাড়িতে ফিরে দুধের ব্যবসা শুরু করলেন। গাঁ-গঞ্জের মানুষ কত আর দুধ খাবে, তাঁরা ধার-বাকিতে দুধ কিনে  ভুবনবাবুর ব্যবসা লাটে তুলে দিলেন। এরপর ভুবনবাবুর নিউ ভেঞ্চার জুতোর কারবার, সেটিও ফেল মারল। তারপর চাষবাসে মন দিলেন, ভাগ্যের চাকা ঘুরল, এখন তাঁর পরিবার এলাকার সম্পন্ন স্বচ্ছল পরিবারগুলির একটি। ইদানীং তাঁর কাজের কাজ বড় বেশি নেই। শখ মেটানোর টাকার অভাব নেই। কাজেই ভুবনবাবুর মাথায় নিত্যি নতুন শখের চাষ হয়। আপাতত তিনি বিজ্ঞানের সাধনায় ব্রতী হওয়ার তালে আছেন। ছাদে বেড়াতে বেড়াতে দেখেছেন ছাদটা আয়তক্ষেত্র, চাঁদটা বৃত্ত, সুপুরি গাছ সরলরেখা— অতএব দুনিয়ার সবকিছু জ্যামিতিতে ভরা। দুধ,কলা,খই মেখে ফলার করতে বসে বুঝলেন এইটি আসলে কেমিক্যাল ইক্যুয়েশন! আড়াই টাকা করে সের হলে সাতাশ পোয়া দুধের দাম কত তার হিসেব তিনি কিচ্ছুটি বোঝেন না, কিন্তু বোঝে তাঁর গয়লা। তাই দুপুরবেলা ভুবনবাবু চুপিচুপি নাতি-নাতনিদের অঙ্কের বই নিয়ে আঁক কষা চালু করলেন। এই ভুবনবাবু অনেকটা আমার বন্ধুদের মতো। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, এমবিএ করে, গোটাতিনেক স্টার্টআপের ব্যবসা ডুবিয়ে এখন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। আরেকজন কমার্স পড়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে ইনস্টাগ্রামে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। আরেকজন আছেন, তিনি যে ঠিক কোন প্রজাতির সাপ, ব্যাং অথবা বিচ্চু সেইটি আজ পর্যন্ত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। পিওর সায়েন্সে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্টে আধাডিগ্রি নিয়ে হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে সাহিত্যে অনার্স নিলেন, তারপর লোকসাহিত্যে মাস্টার্স করে, লোকপ্রযুক্তির মতো ‘খায় না মাথায় দেয়’ টাইপ বিষয়ে এমফিল করে এখন কথাসাহিত্যে পিএইচডি করার ধান্দায় আছেন। ভারী বৈপরীত্যে ভরা একটি চরিত্র। শখ তাঁর কার্টুন আঁকা, গল্প লেখা। এই হয়তো নামকরা সাহিত্যিকদের মনোজ্ঞ আলোচনায় তাঁকে গম্ভীর মুখে চশমা চোখে বসে থাকতে দেখা গেল। আবার হয়তো পরের উইকেন্ডেই দেখা যাবে এ মুলুক সে মুলুকের গাঁজাখোর গুলিখোরদের জুটিয়ে গোয়ায় বসে বিকিনি পরে একমনে হুঁকো টানছেন। সত্যি তো, বেচারি রাঁধে বলে কি আর সে চুলও বাঁধবে না? আশেপাশে চোখ মেললেই এইরকম সব জলজ্যান্ত সাক্ষাৎ ভুবনবাবুদের মতো নমুনা মেলে। গল্পের ভুবনবাবুর মস্ত মস্ত গুণ। তাঁর এখন অঢেল পয়সা। তিনি মা-কে ছাড়া কাউকে ভয় পান না। তাঁর সুপুত্রদের বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, তবু ভুবনবাবুর দাপটে সবাই তটস্থ। এক ছেলে রামলাল ফিজিক্সের অধ্যাপক। আরেক ছেলে নন্দলাল ঠিক কী করেন, তা লেখকও জানেন না। নন্দলাল ভূতধরা সমিতির মেম্বার, তার কাজ বলতে সমিতিতে গিয়ে ভূত নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং বাড়ি ফিরে সাত্ত্বিক আহার।  ভুবনবাবুর আরও একজোড়া ছেলের হিসেব আছে, তবে উপন্যাসে তাদের দেখা মেলেনি। ভুবনবাবুর মা হরমোহিনী দেবী একশো পার করেছেন। তবু এ বয়েসেও তাঁর ভয়ে  ভুবনবাবুর মতো লোকও থরহরি কম্পমান। হরমোহিনী দেবীর মুখে মুখে তর্ক করার সাহস একমাত্র তাঁর ঝি মোক্ষদার আছে। ভুবনবাবুর নষ্ট করার মতো অঢেল টাকা, তিনি বাড়ির গোয়ালঘরটার ভোল পালটে বানিয়ে ফেলেছেন এক অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি। রামলাল ফিজিক্সের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী হওয়ার সাধ্য বা সাধ কোনওটাই তার নেই। তবু জেদী ভুবনবাবুকে রোখে কে? তর্জন গর্জন করে রামলালকে হুকুম দিলেন যাহোক কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলতে। নিজেও রোজ রোজ হাবিজাবি গবেষণা চালিয়ে এমন সব জিনিসপত্তর বানাতে থাকলেন, যার কার্যকারিতা বুঝে উঠতে গেলে আরও একদল বিজ্ঞানী দরকার।

বাড়িতে একরাশ ছেলেপিলে, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মতো একজনই আছে, সে হল ভূতো। ভূতো এ পরিবারের কেউ না। মন্বন্তরের সময়ে তার বাবা তাকে গাছতলায় ফেলে উধাও হয়, রামলাল দেখতে পেয়ে তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। ভূতোর মাথায় নাকি পরিরা ভর করে। ভূতোর কাছে পরিদের দেওয়া যন্ত্রও আছে। এ গল্পে ভূত, গ্রহান্তরের জীব সবারই যাওয়া আসা অবাধ। তবু ভূতো চরিত্রটি যেন নিরুচ্চারে অন্য এক অজানা গল্প বলতে থাকে। পরিরা তার বন্ধু। বাবা যখন তাকে ফেলে রেখে চলে যায়, এই পরিরাই নাকি তাকে আদরে যত্নে ভুলিয়ে রেখেছিল। প্রসঙ্গত মনে পড়েছিল, সদ্য দেখা একটি আমেরিকান সিরিজের গল্প। ‘ডেসপারেট হাউসওয়াইভস’ নামের এই সিরিজটি চারজন গৃহবধূর গল্প। এদের একজন যখন পরিবারের স্বার্থেই নিজের ফেলে আসা কেরিয়ারের পথে আবার এগোয়, তার জার্নিটি খুব একটা মসৃণ হয়নি। তার ছোট ছেলেটি হঠাৎ তার মায়ের দূরে সরে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনে পাশে মা নেই, রাতে যখন সে ঘুমাতে যাচ্ছে মায়ের তখন নাইট শিফট। মায়ের অভাব দূর করতেই সে মনে মনে বানিয়ে ফেলে একজন বন্ধু অথবা গার্ডিয়ান এঞ্জেল, মিসেস মালবেরি। একটি কালো ছাতা-কে সে সর্বক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকে। ওই ছাতা নাকি মিসেস মালবেরি-র প্রতীক। সে যেখানেই যাচ্ছে সঙ্গে যাচ্ছে মিসেস মালবেরি। স্কুলে মিসেস মালবেরির জন্য আলাদা ডেস্কের দাবিও জানায়। ব্যাপারটি ক্রমে ঘোরালো হতে থাকে। শীর্ষেন্দুর গল্পের ভূতো চরিত্রটিও বাবার হঠাৎ অন্তর্ধানে আহত হয়েছিল। আহত, অভিমানী, ক্ষুব্ধ শৈশবমন জন্ম দেয় এই পরির কাহিনির। যে আদর, ভালোবাসার প্রত্যাশাগুলো তার বাবা মেটাতে পারেননি, ঠিক সেগুলোই পরিরা তাকে দিয়েছে। পরিরা তাকে খেলনা দিয়েছে, মজার গল্প বলেছে, গান শুনিয়েছে। আর সবচেয়ে বড়কথা, পরিরা তাকে দিয়েছে ভ্যালিডেশন। একটা অতি আধুনিক হেলমেট, যা মাথায় পরলে সব সমস্যার সমাধান নিমেষে ওই হেলমেট বাতলে দেয়, সেইটি পরিরা তাকে বেশি ব্যবহার করতে বারণ করেছে। ‘ওটা বেশি ব্যবহার করলে তুমি আর নিজের মাথা খাটাতে চাইবে না। সেটা কিন্তু ভীষণ খারাপ। তোমার নিজের মস্তিষ্কও যে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সেটা তুমি বুঝতেও পারবে না কোনওদিন।’ একজন সন্তান তার মা-বাবার মুখ থেকে এটুকুই তো শুনতে চায়, যে ‘তুমি পারো, তুমি সব পারো’! ভূতো পড়াশোনায় ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। ছোটদাদু অর্থাৎ  সেজো ভাই ত্রিভুবন রায়ের ধারেকাছে ঘুরে ঘুরে সে হোমিওপ্যাথি ভালোমতোই শিখে ফেলেছে। ত্রিভুবন রায় ভুলভাল ওষুধ দিলে ভূতো ঠিক ওষুধটা বেছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর এই সবই সে মনে করে পরিদের দয়ায় হচ্ছে, আদতে তা নয়, ভূতো নিজেই একটি জিনিয়াস বাচ্চা। গল্পে সবটুকুই অলৌকিকের মোড়কে ঢাকা, কিন্তু বেশ বোঝা যায় ভূতোর ব্যাপারস্যাপারে মোটেই কোনও জিনপরি-র হাত নেই।

গল্পের আরও একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র দুলাল সেন। তিনি হাইস্কুলের শিক্ষক। ভুবনবাবু তাঁকে ধরে আনেন ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য। অবশ্য তাতে গোবেচারা দুলাল সেনের খুব একটা আপত্তি ছিল না। একদিন ল্যাবরেটরিতে বাচ্চারা নেহাত খেলার ছলে এটার সাথে সেটা মিশিয়ে বানিয়ে ফেলেছিল এক অত্যাশ্চর্য দ্রবণ, যার ধোঁয়ায় রোগাভোগা, নিস্তেজ, বুড়োটে দুলাল সেন রাতারাতি পালটে পরিণত হন ছটফটে, তারুণ্যের জেল্লায় ঝকমক করা এক উদ্যমী পুরুষে। সদ্য জন্ম নেওয়া এই নতুন দুলাল সেন তখন এক কাদামাটির তাল মাত্র। নতুন জীবনের গোড়াতেই সে হাতে পড়ল পাঁচু চোরের। পাঁচু চোরের শিক্ষায় ও অনুপ্রেরণায় দুলাল সেনের সব সুপারপাওয়ার চ্যানেলাইজড হল ভুলপথে। সে চুরি করতে শিখল, লোক ঠকাতে শিখল। ক্রমে পাঁচুকেও গেল ছাড়িয়ে। মারদাঙ্গা, খুনজখমের মোহ তাকে পেয়ে বসল। আগের সেই নিরীহ দুলালকে যারা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি, তাদের ওপর চড়াও হয়ে একের পর এক বদলা নিতে থাকল নতুন দুলাল সেন। এর সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া তার ঝকঝকে শাণিত বুদ্ধি। ভালো কাজে মাথা লাগালে হয়তো এই হঠাৎ পাওয়া অলৌকিক শক্তি অনেক কল্যাণকর কাজে ব্যবহার হতে পারত। কিন্তু পাঁচু চোরের বদান্যতায় হাইস্কুলের শিক্ষক দুলাল সেন একটি নামকাটা বদমাশে পরিণত হয়েছেন। সে মিথ্যে কথা বলতে পারে অনায়াসে, সোনার দোকানে ভোজপুরী গুন্ডাদের মেরে পাট পাট করে দিতে পারে, ছলচাতুরির পথে টাকা আদায়ের খেলা তার কাছে জলভাত। ক্রমে পাঁচু নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে। না জেনেই সে যেন তৈরি করে ফেলেছে এক আস্ত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। গল্পের শেষে অবশ্য পরিদের বলে দেওয়া সুপারন্যাচারাল পথ ধরেই ভূতো সারিয়ে তোলে দুলাল সেন-কে। আবার সে হয়ে যায় নিরীহ গোবেচারা জবুথবু মানুষটি। কিন্তু সেইসঙ্গে হারিয়ে যায় দুলাল সেনের সপাটে রূঢ় সত্যি বলার ক্ষমতাও। শক্তিশালী দুলাল সেন কারওর পরোয়া করত না। একমাত্র সেই ভুবনবাবুকে মুখের ওপর বলতে পেরেছিল, ‘ভুবনবাবু, আমি সারা শহর ঘুরে দেখলুম, আপনার মাথাতেই বুদ্ধিটা সবচেয়ে কম।’ যখন সে আবার আগের গোবেচারা দুলাল হয়ে গেল, ভুবনবাবু এলেন পরখ করতে। সরাসরি দুলালকে যখন জিজ্ঞেস করলেন তিনি কেমন লোক, সে উত্তর দিল, ‘আমি সামান্য মানুষ, বড় বড় মানুষেরা কে কেমন তার কী জানি।’ সাধারণ মানুষের এই গা-বাঁচানো মানসিকতার জন্যই হয়তো ভুবনবাবুদের মতো অনেক মানুষ সমাজের ওপরতলায় বসে স্রেফ টাকা আর পদমর্যাদার জোরে যা খুশি করার স্পর্ধা দেখাতে পারেন।

                                                  

কিশোর সাহিত্যই হোক বা শিশুসাহিত্য, ছোটদের জন্য লেখেন তো আসলে বড়রাই। তাই বড়দেরই সোচ্চারে না বলতে পারা কথাগুলো রূপকের আড়ালে বেরিয়ে আসে ছোটদের লেখায়। সে কারণেই টুনটুনির গল্পে টুনটুনি শোনায় মার্কসবাদের তত্ত্ব, পঞ্চতন্ত্র-ঠাকুমার ঝুলি বলে সমাজের শোষণের গল্প, সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল-এর ছড়াগুলোয় লুকিয়ে থাকে বিশ্ব রাজনীতির প্যাঁচালো সূক্ষ্ম খোঁচা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই মিনি উপন্যাসগুলো খুঁটিয়ে দেখলে এমন অনেক বকলমে বড়দের কথাই চোখে পড়ে। যদিও তাঁর গল্প বলার গুণে প্রতিটি লেখাই অত্যন্ত স্বাদু, সমস্ত বয়সের মানুষের কাছেই মুখরোচক। একশো বছরের বৃদ্ধা হরমোহিনী দেবীর বাঁ-হাঁটুতে ব্যথা।  মনের ভুলে তিনি ডানহাঁটু এগিয়ে দেন মোক্ষদাকে। মোক্ষদাও বৃদ্ধা হয়েছে, সেও মাঝেমাঝে গুলিয়ে ফেলে ডান-বাঁ। অতএব, দুই অশীতিপর বৃদ্ধার মধ্যে লেগে যায় ধুন্ধুমার। এ ধরনের অনেক মিষ্টি, মজার চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে গোটা গল্প জুড়ে। নিতান্তই কোনও জন্ম গোমড়াথেরিয়াম-কেও যদি এ গল্প পড়তে বলা হয়, তার ঠোঁটেও হাসি ফুটবেই ফুটবে। এই মিনি উপন্যাসগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ছোট ছোট বইয়ের আকারে বের হয়, তাতে অনেক ঘটনার মজার মজার ছবি আঁকা থাকে। সেই ছবিগুলিও বেশ আকর্ষণীয়। টলিউড ইতিমধ্যে শীর্ষেন্দুর অনেক উপন্যাস থেকেই ছবি বানিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ‘বনি’, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ গল্পগুলি নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে। আশা রাখি, এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ গল্পটিও একদিন রূপোলী পর্দায় আসবে। বইপত্তর যারা মোটে পড়তে চায় না, তারাও ভিড় জমাবে সিনেমা হলে। চিনে নেবে ভুবনবাবু, পাঁচু চোর, দুলাল সেনদের মতো অবিস্মরণীয় চরিত্রগুলিকে।