
‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজ এবং শীর্ষেন্দু - সূচনাকথা
- 31 October, 2024
- লেখক: মনীষা নস্কর
ভূত আছে কি নেই, সে তর্ক পণ্ডিত মানুষেরা যত পারেন করুন। আমার মতো অপণ্ডিত মানুষ কিন্তু ভূত-প্রেত, দত্যি-দানো সব্বাই এ ধরাধামে বহাল তবিয়তে বিরাজমান ভেবে নিয়েই ভারী সন্তুষ্ট। টাপুরটুপুর বৃষ্টি দুপুরে ঝুপসি বেলগাছটার ফাঁকে ফোকরে ব্রহ্মদৈত্যরা এক এক পাত্তর হুইস্কি নিয়ে যে বসেন না, তা কে হলফ করে বলতে পারে? কিংবা সান্যালকাকুদের যে পোড়োবাড়িটা ফ্ল্যাট হতে হতে আধখ্যাঁচড়া অবস্থায় থমকে রয়েছে, সেইখানে মাঝরাতে শাঁখচুন্নিরা যে কিটিপার্টি করে না, তাই বা কীকরে বলা যায়? আমার স্কুল ছিল বেথুন, ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ সব্বাই জানে শীতের বিকেলে আলো ফুরোলেই বেথুনসাহেবের নট নড়নচড়ন ধুলোমাখা গাড়িটায় কে বা কারা এসে বসে পড়ে আর গাড়িও থেকে থেকে ভূতুড়ে গর্জন করে ওঠে। বছরখানেক আগে এই ভূতের টানেই গিয়ে পড়েছিলাম পারমাদানের জঙ্গলে। সেখানে নীলসাহেবের পোড়ো কুঠি, সামনে বয়ে চলেছে ইছামতী। মাঝরাতে একজন এসে পুরো দলটাকে নিয়ে চললেন ইছামতীর তীরে। সে লোকের সর্বাঙ্গ ঢাকা ছায়া ছায়া রঙ চাদরে, মাথায় তার মাঙ্কিটুপি, একহাতে লাঠি, আরেকহাতে হ্যারিকেন। শীতের রাতে কুয়াশার আলোয়ানে মোড়া ইছামতীর ঘাটে গিয়ে বসতেই গল্প হল শুরু। অনেক অনেক বছর আগে নাকি দুষ্টু নীলকরের ধড়টা মুণ্ডু থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তারপর থেকেই কুঠিতে নাকি.. গল্প আরও জমত যদি গল্পের কথকটি হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন আর ঘাটের সিঁড়িতে গড়াগড়ি খেত তাঁর ফেলে যাওয়া লাঠি আর হ্যারিকেন। সেসব কিছু হয়নি। ভূতেরা আসলে বড্ড লাজুক, বাস্তবের মাটিতে তাদের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। অগত্যা শরণাপন্ন হতে হয় গল্পেরই। আর সে অদ্ভুতুড়ে দুনিয়ার একচ্ছত্র সম্রাট শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৮ থেকে ২০২২— টানা চুয়াল্লিশটা বছর ধরে একনাগাড়ে লিখে গিয়েছেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। টার্গেট অডিয়েন্স কিশোররা হলেও আট থেকে আশি সব্বাই মজে আছে এই সিরিজে। আপাতত এ সিরিজে আছে পঞ্চাশটা উপন্যাস, যার শুরুটা হয়েছিল ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ দিয়ে, আর শেষতম সংযোজন ‘এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা’। কুড়িনম্বর উপন্যাসটির নাম সিরিজের নামেই রাখা ‘অদ্ভুতুড়ে’।
শীর্ষেন্দুর নিজেই ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলেছেন,—“ ‘অদ্ভুতুড়ে’ নামটা যেমন, লেখাটাও তেমন। আসলে আমার ছোটদের সব উপন্যাসেরই নাম অদ্ভুতুড়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, নানারকম অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা তাতে দেদার থাকে। একই উপন্যাসে কল্পবিজ্ঞান আর ভূত মিলেমিশে গেছে হয়তো। আর যাবে না-ই বা কেন? মানুষের মনই তো এক আশ্চর্য আর আজগুবি জায়গা, সেখানে কত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কত অস্তি-নাস্তি, কত আলো আর অন্ধকার একাকার হয়ে বাস করে।”
কিশোর সাহিত্যই হোক বা শিশুসাহিত্য, ছোটদের জন্য লেখেন তো আসলে বড়রাই। তাই বড়দেরই সোচ্চারে না বলতে পারা কথাগুলো রূপকের আড়ালে বেরিয়ে আসে ছোটদের লেখায়। সে কারণেই টুনটুনির গল্পে টুনটুনি শোনায় মার্কসবাদের তত্ত্ব, পঞ্চতন্ত্র-ঠাকুমার ঝুলি বলে সমাজের শোষণের গল্প, সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল-এর ছড়াগুলোয় লুকিয়ে থাকে বিশ্ব রাজনীতির প্যাঁচালো সূক্ষ্ম খোঁচা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই মিনি উপন্যাসগুলো খুঁটিয়ে দেখলে এমন অনেক বকলমে বড়দের কথাই চোখে পড়ে। যদিও তাঁর গল্প বলার গুণে প্রতিটি লেখাই অত্যন্ত স্বাদু, সমস্ত বয়সের মানুষের কাছেই মুখরোচক। একশো বছরের বৃদ্ধা হরমোহিনী দেবীর বাঁ-হাঁটুতে ব্যথা। মনের ভুলে তিনি ডানহাঁটু এগিয়ে দেন মোক্ষদাকে। মোক্ষদাও বৃদ্ধা হয়েছে, সেও মাঝেমাঝে গুলিয়ে ফেলে ডান-বাঁ। অতএব, দুই অশীতিপর বৃদ্ধার মধ্যে লেগে যায় ধুন্ধুমার। এ ধরনের অনেক মিষ্টি, মজার চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে গোটা গল্প জুড়ে। নিতান্তই কোনও জন্ম গোমড়াথেরিয়াম-কেও যদি এ গল্প পড়তে বলা হয়, তার ঠোঁটেও হাসি ফুটবেই ফুটবে। এই মিনি উপন্যাসগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ছোট ছোট বইয়ের আকারে বের হয়, তাতে অনেক ঘটনার মজার মজার ছবি আঁকা থাকে। সেই ছবিগুলিও বেশ আকর্ষণীয়। টলিউড ইতিমধ্যে শীর্ষেন্দুর অনেক উপন্যাস থেকেই ছবি বানিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ‘বনি’, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ গল্পগুলি নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে। আশা রাখি, এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ গল্পটিও একদিন রূপোলী পর্দায় আসবে। বইপত্তর যারা মোটে পড়তে চায় না, তারাও ভিড় জমাবে সিনেমা হলে। চিনে নেবে ভুবনবাবু, পাঁচু চোর, দুলাল সেনদের মতো অবিস্মরণীয় চরিত্রগুলিকে।
পরের পর্ব থেকে এক একটি লেখায় এক একটি উপন্যাস নিয়ে আলাদাভাবে আলচনা থাকবে। এখানে থাকল অদ্ভুতুড়ে সিরিজ এ এতাবৎ প্রকাশিত আখ্যানগুলির একটি কালানুক্রমিক তালিকা।
. মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - ১৯৭৮
. গোঁসাইবাগানের ভূত - ১৯৭৯
. হেতমগড়ের গুপ্তধন - ১৯৮১
. নৃসিংহ রহস্য - ১৯৮৪
. বক্সার রতন - ১৯৮৪
. ভুতুড়ে ঘড়ি - ১৯৮৪
. গৌরের কবচ - ১৯৮৬
. হিরের আংটি - ১৯৮৬
. পাগলা সাহেবের কবর - ১৯৮৭
. হারানো কাকাতুয়া - ১৯৮৭
. ঝিলের ধারে বাড়ি - ১৯৮৮
. পটাশগড়ের জঙ্গলে - ১৯৮৯
. গোলমাল - ১৯৮৯
. বনি - ১৯৯০
. চক্রপুরের চক্করে - ১৯৯০
. ছায়াময় - ১৯৯২
. সোনার মেডেল - ১৯৯৩
. নবিগঞ্জের দৈত্য - ১৯৯৪
. কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - ১৯৯৫
. অদ্ভুতুড়ে - ১৯৯৬
. পাতালঘর - ১৯৯৬
. হরিপুরের হরেক কাণ্ড - ১৯৯৭
. দুধসায়রের দ্বীপ - ১৯৯৭
. বিপিনবাবুর বিপদ - ১৯৯৮
. নবাবগঞ্জের আগন্তুক – ১৯৯৯
. ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ - ২০০০
. গজাননের কৌটো - ২০০১
. ঝিকরগাছায় ঝঞ্ঝাট - ২০০২
. রাঘববাবুর বাড়ি - ২০০৩
. মোহন রায়ের বাঁশি - ২০০৪
. সাধুবাবার লাঠি - ২০০৫
. ঘোরপ্যাঁচে প্রাণগোবিন্দ - ২০০৫
. ডাকাতের ভাইপো - ২০০৭
. অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার - ২০০৮
. উঁহু - ২০০৯
. গোলমেলে লোক - ২০১০
. বটুকবুড়োর চশমা - ২০১১
. ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত - ২০১১
. অষ্টপুরের বৃত্তান্ত - ২০১২
. মদন তপাদারের বাক্স - ২০১২
. সর্বনেশে ভুল অঙ্ক - ২০১৪
. ভলু যখন রাজা হল - ২০১৫
. হাবু ভুঁইমালির পুতুল - ২০১৬
. নন্দীবাড়ির শাঁখ - ২০১৭
. জং বাহাদুর সিংহের নাতি - ২০১৭
. আসমানির চর - ২০১৮
. গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি - ২০১৯
. হিরণগড়ের ব্যাপারস্যাপার - ২০২০
. আশুবাবুর টেলিস্কোপ - ২০২১
. এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা - ২০২২