‘অদ্ভুতুড়ে’ : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বিশতম আখ্যান

"প্রতি মিল দু'টাকা করে যদি দেন তো কলম-টলম সব মিলিয়ে দেব। ও-নিয়ে আর ভাবতে হবে না।"

"আপনি কে?"

"আজ্ঞে, আমি এ-কারবারই করি। মিল বেচি, ছন্দ বেচি, কবিতাও বেচি। তবে গোটা কবিতার দাম কিছু বেশি পড়বে। চতুর্দশপদী, হাইকু, দীর্ঘ কবিতা, ছড়া কাহিনী কাব্য, মহাকাব্য- সব আছে। ফ্যলো কড়ি, মাখো তেল।"

ভুবনবাবু বুকটা একটু চিতিয়ে বললেন, "এ যে মায়ের কাছে মাসির গল্প হয়ে যাচ্ছে মশাই। আমাকে আর কবিতা শেখাতে হবে না। আমার মধ্যে কবিতার সমুদ্র রয়েছে। তবে ইয়ে, ওই মাঝে-মাঝে মিলটিল নিয়ে একটু ভাবতে হয় আর কি। তা মিল কত করে বললেন?"

দু'টাকা। খুবই শস্তা। জলের দর। বছরের এই সময়টায়, অর্থাৎ বসন্তকালে আমরা একটা সেল দিই তো। নইলে তিন টাকার একটি পয়সা কম হত না।"

"বটে! তা কলমের সঙ্গে কী মেলানো যায় বলুন তো?"

"ও-নিয়ে ভাববেন না। আমরা হিমালয়ের সঙ্গে মেলাচ্ছি, তুচ্ছ কলম আর এমন কী! টাকাটা ফেলুন আগে।"

ভুবনবাবু বিরক্ত মুখে দু'টো টাকা লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, "এবার বলুন।"

লোকটা ভারি বিগলিত হয়ে বলল, "বছরের চুক্তি করে নিলে কিন্তু আরও শস্তা হয়ে যাবে। এই ধরুন দেড়-টাকার মতো। আর মিলও পাবেন জব্বর।"

ভুবনবাবু হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "কিন্তু কলমের সঙ্গে মেলানো শব্দটার কী হলো?"

লোকটা বিগলিত মুখেই বলল, "আজ্ঞে, বলম বলম বাহু বলম।"

"তার মানে?"

"কলমের সঙ্গে মেলালেই বুঝবেন কী জিনিস। কবিতার লাইনে ফেলে দেখুন।"

ভুবনবাবু আপনমনে কিছুক্ষণ বাহু বলম, বাহু বলম, করলেন। তারপর লোকটাকে একেবারে জাপটে ধরে 'আপনি' থেকে 'তুমি'-তে বলে উঠলেন, "তাই তো হে, তোমার তো দারুণ মাথা! মিলে গেছে, এক্কেবারে মিলে গেছে।"

লেখকের নাম ছাড়াও যদি এ অংশটুকু কোথাও লেখা হয়, পাঠকের চিনতে মোটেই দেরি হবে এ লেখা তো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের, সিরিজের নাম অদ্ভুতুড়ে!

১৯৭৮ থেকে ২০২২— টানা চুয়াল্লিশটা বছর ধরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একনাগাড়ে লিখে গিয়েছেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। টার্গেট অডিয়েন্স কিশোররা হলেও আট থেকে আশি সব্বাই মজে আছে এই সিরিজে। আপাতত এ সিরিজে আছে পঞ্চাশটা উপন্যাস, যার শুরুটা হয়েছিল ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ দিয়ে, আর শেষতম সংযোজন ‘এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালা’। কুড়িনম্বর উপন্যাসটির নাম সিরিজের নামেই রাখা ‘অদ্ভুতুড়ে’। অদ্ভুতুড়ের সিগনেচার টোন হাসি-মজা-ঠাট্টা-ইয়ার্কির সবটুকুই এ গল্পের পরতে পরতে হাজির। রয়েছে ভূত আর তাদের চেয়েও অদ্ভুত কিছু মানুষজন।

শীর্ষেন্দু নিজেই ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলেছেন,—“ ‘অদ্ভুতুড়ে’ নামটা যেমন, লেখাটাও তেমন। আসলে আমার ছোটদের সব উপন্যাসেরই নাম অদ্ভুতুড়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, নানারকম অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা তাতে দেদার থাকে। একই উপন্যাসে কল্পবিজ্ঞান আর ভূত মিলেমিশে গেছে হয়তো। আর যাবে না-ই বা কেন? মানুষের মনই তো এক আশ্চর্য আর আজগুবি জায়গা, সেখানে কত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কত অস্তি-নাস্তি, কত আলো আর অন্ধকার একাকার হয়ে বাস করে।”

‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মফস্বলের একটি আজব পরিবার, যার প্রতিটি সদস্য কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। ছিটের দিক থেকে পরিবারের কর্তা ভুবনবাবুটি সবচেয়ে সরেস। বয়েস পঁচাশি হলেও বুড়ো তিনি হননি। অলিম্পিকে ওয়েটলিফটিং করে এসেছেন। কম্পিটিশনের দিন একরাশ মাংস আর ডিম খেয়ে ওজন বাড়িয়ে ফেলায় তাঁকে লাইটওয়েটের বদলে হেভিওয়েটে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং বলাবাহুল্য তিনি কুটোটি নাড়তে পারেননি।

ভুবনবাবু মিলিটারিতে উঁচুপোস্টের অফিসার ছিলেন। বড় শখ ছিল যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দেওয়ার, তাই দেশ স্বাধীন হওয়াটা মোটেই মন থেকে মানতে পারেননি। যুদ্ধের উসকানি দিয়ে চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীকে, ফলাফলস্বরূপ কোর্ট মার্শাল হওয়ার জোগাড়। নেহাত তৎকালীন সরকার দয়ার অবতার, তাই ক্ষমাঘেন্না করে দেওয়া হল। কিন্তু ভুবন রায় তো ক্ষমার ধার ধারেন না, নাক সিঁটকে চাকরি দিলেন ছেড়ে।

আর্মিক্যাম্প ছেড়ে গঞ্জের বাড়িতে ফিরে ভুবনবাবু দুধের ব্যবসা শুরু করলেন। গাঁ-গঞ্জের মানুষ কত আর দুধ খাবে, তাঁরা ধার-বাকিতে দুধ কিনে ভুবনবাবুর ব্যবসা লাটে তুলে দিলেন। এরপর ভুবনবাবুর নিউ ভেঞ্চার জুতোর কারবার, সেটিও ফেল মারল। তারপর চাষবাসে মন দিলেন, ভাগ্যের চাকা ঘুরল, এখন তাঁর পরিবার এলাকার সম্পন্ন স্বচ্ছল পরিবারগুলির একটি।

ইদানীং তাঁর কাজের কাজ বড় বেশি নেই। শখ মেটানোর টাকার অভাব নেই। কাজেই ভুবনবাবুর মাথায় নিত্যি নতুন শখের চাষ হয়। আপাতত তিনি বিজ্ঞানের সাধনায় ব্রতী হওয়ার তালে আছেন। ছাদে বেড়াতে বেড়াতে দেখেছেন ছাদটা আয়তক্ষেত্র, চাঁদটা বৃত্ত, সুপুরি গাছ সরলরেখা— অতএব দুনিয়ার সবকিছু জ্যামিতিতে ভরা। দুধ,কলা,খই মেখে ফলার করতে বসে বুঝলেন এইটি আসলে কেমিক্যাল ইক্যুয়েশন! আড়াই টাকা করে সের হলে সাতাশ পোয়া দুধের দাম কত তার হিসেব তিনি কিচ্ছুটি বোঝেন না, কিন্তু বোঝে তাঁর গয়লা। তাই দুপুরবেলা ভুবনবাবু চুপিচুপি নাতি-নাতনিদের অঙ্কের বই নিয়ে আঁক কষা চালু করলেন। আশেপাশে চোখ মেললেই এইরকম সব জলজ্যান্ত সাক্ষাৎ ভুবনবাবুদের মতো নমুনা মেলে। তারা জানেই না জীবনটাকে নিয়ে তারা আসলে ঠিক কী করতে চায়।

গল্পের ভুবনবাবুর মস্ত মস্ত গুণ। তাঁর এখন অঢেল পয়সা। তিনি মা-কে ছাড়া কাউকে ভয় পান না। ভুবনবাবুর সুপুত্রদের বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, তবু ভুবনবাবুর দাপটে সবাই তটস্থ। এক ছেলে রামলাল ফিজিক্সের অধ্যাপক। আরেক ছেলে নন্দলাল ঠিক কী করেন, তা লেখকও জানেন না। নন্দলাল ভূতধরা সমিতির মেম্বার, তার কাজ বলতে সমিতিতে গিয়ে ভূত নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং বাড়ি ফিরে সাত্ত্বিক আহার। ভুবনবাবুর আরও একজোড়া ছেলের হিসেব আছে, তবে উপন্যাসে তাদের দেখা মেলেনি। ভুবনবাবুর মা হরমোহিনী দেবী একশো পার করেছেন। তবু এ বয়েসেও তাঁর ভয়ে  ভুবনবাবুর মতো লোকও থরহরি কম্পমান। হরমোহিনী দেবীর মুখে মুখে তর্ক করার সাহস একমাত্র তাঁর ঝি মোক্ষদার আছে।

ভুবনবাবুর নষ্ট করার মতো অঢেল টাকা, তিনি বাড়ির গোয়ালঘরটার ভোল পালটে বানিয়ে ফেলেছেন এক অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি। রামলাল ফিজিক্সের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী হওয়ার সাধ্য বা সাধ কোনওটাই তার নেই। তবু জেদী ভুবনবাবুকে রোখে কে? তর্জন গর্জন করে রামলালকে হুকুম দিলেন যাহোক কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলতে। নিজেও রোজ রোজ হাবিজাবি গবেষণা চালিয়ে এমন সব জিনিসপত্তর বানাতে থাকলেন, যার কার্যকারিতা বুঝে উঠতে গেলে আরও একদল বিজ্ঞানী দরকার। 

“একদিন হাতে একটা কাচের বাটি নিয়ে 'ইউরেকা! ইউরেকা!' বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এলেন ভুবন রায়। সবাইকে বাটির মধ্যে একটা কাদার মতো থকথকে জিনিস দেখাতে লাগলেন।

সবাই জিজ্ঞেস করল, "জিনিসটা কী?"

ভুবন রায় মাথা নেড়ে বললেন, "এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আর দুটো এক্সপেরিমেন্টের পরেই বোঝা যাবে।"

সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

পরদিনই ভুবন রায় ফের 'ইউরেকা! ইউরেকা!' করে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা টেস্ট টিউবের মধ্যে সবুজ তরল পদার্থ।

সবাই জানতে চাইল, জিনিসটা কী?

ভুবন রায় মৃদু হেসে বললেন, "বুঝতে পারবে হে, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে

পারবে।"

কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, ভুবন রায় অনেকগুলো জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। একটা কাচের গোলকের মধ্যে তিনটে কাচের গুলি, একটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দেখতে যন্ত্র, বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল। কিন্তু এগুলো দিয়ে কী হবে, তা আর কেউ জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না।”

করছেন তিনি বিজ্ঞানের সাধনা, বানাতে বসলেন ভূতদেখা যন্ত্র!

“যন্ত্রটা চোখে দিয়ে ভুবন রায় নানা আকৃতির অজস্র ভূত দেখতে পান বটে, এবং তার ধারাবিবরণীও দিতে থাকেন, "ওই যে একটা শুঁটকো ভূত পান্তা ভাত খাচ্ছে... ওই যে একটা পেত্নি আকাশে চুল ছড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে... ওই তো শিবচন্দ্র কামারের ভূত হরিহর পালের ভূতকে ধরে ঠ্যাঙাচ্ছে..." ইত্যাদি, কিন্তু সেই যন্ত্র দিয়ে আর কেউ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু সে-কথা ভুবন রায়কে বলে, এমন সাহস কার?

রামলালকেও স্বীকার করতে হল যে, যন্ত্রটা দিয়ে আবছা আবছা ভৌতিক কিছু দেখা যায় বটে।

ভুবন রায় চটে উঠে বললেন, "আবছা-আবছা মানে, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ভাল করে দ্যাখো।"

রামলাল আমতা-আমতা করে বললেন, "আজ্ঞে স্পষ্টই।"

"কী দেখছ বলো।"

অগত্যা রামলাল বানিয়ে বলতে লাগলেন, "আজ্ঞে একটা রোগা আর একটা মোটা ভূত কুস্তি করছে... আর একটা পেত্নি ডালের বড়ি দিচ্ছে..."।

"তবে?" বলে খুব হাসলেন ভুবন রায়। তারপর ছেলেকে বললেন, "কিন্তু তুমি কী করছ? এখনও তো একটাও কিছু আবিষ্কার করতে পারলে না।"

"আজ্ঞে না।"

"সাত দিন সময় দিলাম। কিছু একটা করে দেখাও। দীর্ঘদিন মাস্টারি করে মাথার বারোটা বাজিয়েছে। মাথাটা এবার খাটাও।"

বিজ্ঞানসাধনাতেও বেশিদিন টিকে থাকেননি ভুবনবাবু। ভূতদেখা যন্ত্র বানিয়ে খোদ ভূতের হাতেই নাস্তানাবুদ হবার পরে তিনি বিজ্ঞান ছেড়ে কবিতা লিখতে বসলেন। বিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কার করেই যেমন আর্কিমিডিসির মতো 'ইউরেকা' বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে বেরিয়ে আসতেন, কবিতায় তেমনই আদি কবি বাল্মীকির মতো এক লাইন লিখেই তিনি বার কয়েক বলে ফেলেছেন "কিমিদং কিমিদং!" আর কবিতারও সে কি ছিরি! “কলার কাঁদির মতো কবিতা ঝুলিছে গাছে-গাছে। পোষা বেড়ালের মতো কবিতা ফিরিছে পাছে-পাছে।”

বাড়িতে একরাশ ছেলেপিলে, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মতো একজন আছে, সে হল ভূতো। ভূতো এ পরিবারের কেউ না। মন্বন্তরের সময়ে তার বাবা তাকে গাছতলায় ফেলে উধাও হয়, রামলাল দেখতে পেয়ে তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে।

ভূতোর মাথায় নাকি পরিরা ভর করে। এ গল্পে ভূত, গ্রহান্তরের জীব সবারই যাওয়া আসা অবাধ। তবু ভূতো চরিত্রটি যেন নিরুচ্চারে অন্য এক অজানা গল্প বলতে থাকে। পরিরা তার বন্ধু। বাবা যখন তাকে ফেলে রেখে চলে যায়, এই পরিরাই নাকি তাকে আদরে যত্নে ভুলিয়ে রেখেছিল। প্রসঙ্গত মনে পড়েছিল, সদ্য দেখা একটি আমেরিকান সিরিজের গল্প। ‘ডেসপারেট হাউসওয়াইভস’ নামের এই সিরিজটি চারজন গৃহবধূর গল্প। এদের একজন যখন পরিবারের স্বার্থেই নিজের ফেলে আসা কেরিয়ারের পথে আবার এগোয়, তার জার্নিটি খুব একটা মসৃণ হয়নি। তার ছোট ছেলেটি হঠাৎ তার মায়ের দূরে সরে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তার প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনে পাশে মা নেই, রাতে যখন সে ঘুমাতে যাচ্ছে মায়ের তখন নাইট শিফট। মায়ের অভাব দূর করতেই সে মনে মনে বানিয়ে ফেলে একজন বন্ধু অথবা গার্ডিয়ান এঞ্জেল, মিসেস মালবেরি। একটি কালো ছাতা-কে সে সর্বক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকে। ওই ছাতা নাকি মিসেস মালবেরি-র প্রতীক। সে যেখানেই যাচ্ছে সঙ্গে যাচ্ছে মিসেস মালবেরি। স্কুলে মিসেস মালবেরির জন্য আলাদা ডেস্কের দাবিও জানায়। ব্যাপারটি ক্রমে ঘোরালো হতে থাকে। শীর্ষেন্দুর গল্পের ভূতো চরিত্রটিও বাবার হঠাৎ অন্তর্ধানে আহত হয়েছিল। আহত, অভিমানী, ক্ষুব্ধ শৈশবমন জন্ম দেয় এই পরির কাহিনির। যে আদর, ভালোবাসার প্রত্যাশাগুলো তার বাবা মেটাতে পারেননি, ঠিক সেগুলোই পরিরা তাকে দিয়েছে। পরিরা তাকে খেলনা দিয়েছে, মজার গল্প বলেছে, গান শুনিয়েছে। আর সবচেয়ে বড়কথা, পরিরা তাকে দিয়েছে ভ্যালিডেশন।

একটা অতি আধুনিক হেলমেট, যা মাথায় পরলে সব সমস্যার সমাধান নিমেষে ওই হেলমেট বাতলে দেয়, সেইটি পরিরা তাকে বেশি ব্যবহার করতে বারণ করেছে। ‘ওটা বেশি ব্যবহার করলে তুমি আর নিজের মাথা খাটাতে চাইবে না। সেটা কিন্তু ভীষণ খারাপ। তোমার নিজের মস্তিষ্কও যে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সেটা তুমি বুঝতেও পারবে না কোনওদিন।’ একজন সন্তান তার মা-বাবার মুখ থেকে এটুকুই তো শুনতে চায়, যে ‘তুমি পারো, তুমি সব পারো’!

ভূতো পড়াশোনায় ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। ছোটদাদু অর্থাৎ সেজো ভাই ত্রিভুবন রায়ের ধারেকাছে ঘুরে ঘুরে সে হোমিওপ্যাথি ভালোমতোই শিখে ফেলেছে। ত্রিভুবন রায় ভুলভাল ওষুধ দিলে ভূতো ঠিক ওষুধটা বেছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর এই সবই সে মনে করে পরিদের দয়ায় হচ্ছে, আদতে তা নয়, ভূতো নিজেই একটি জিনিয়াস বাচ্চা। গল্পে সবটুকুই অলৌকিকের মোড়কে ঢাকা, কিন্তু বেশ বোঝা যায় ভূতোর ব্যাপারস্যাপারে মোটেই কোনও জিনপরি-র হাত নেই। 

উল্লেখযোগ্য, অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এর আগের কিছু গল্পে এমন কয়েকজন ছোট বাচ্চার দেখা মিলেছে। কেউ বাড়িতে বকা খেয়ে সার্কাসে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবে। কেউ অঙ্কে তেরো পেয়ে একলাটি ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যেতে গিয়ে ভূতের খপ্পরে পড়ে। বড়রাই যেখানে ঠিকমতো অ্যাপ্রিশিয়েশন না পেলে মুষড়ে পড়েন, শিশুমন তো চাইবেই বড়রা একটু বাহবা দিক।

গল্পের আরও একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র দুলাল সেন। তিনি হাইস্কুলের শিক্ষক। ভুবনবাবু তাঁকে ধরে আনেন ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য। অবশ্য তাতে গোবেচারা দুলাল সেনের খুব একটা আপত্তি ছিল না। একদিন ল্যাবরেটরিতে বাচ্চারা নেহাত খেলার ছলে এটার সাথে সেটা মিশিয়ে বানিয়ে ফেলেছিল এক অত্যাশ্চর্য দ্রবণ, যার ধোঁয়ায় রোগাভোগা, নিস্তেজ, বুড়োটে দুলাল সেন রাতারাতি পালটে পরিণত হন ছটফটে, তারুণ্যের জেল্লায় ঝকমক করা এক উদ্যমী পুরুষে। সদ্য জন্ম নেওয়া এই নতুন দুলাল সেন তখন এক কাদামাটির তাল মাত্র। নতুন জীবনের গোড়াতেই সে হাতে পড়ল পাঁচু চোরের।

পাঁচু চোরের শিক্ষায় ও অনুপ্রেরণায় দুলাল সেনের সব সুপারপাওয়ার চ্যানেলাইজড হল ভুলপথে। সে চুরি করতে শিখল, লোক ঠকাতে শিখল। ক্রমে পাঁচুকেও গেল ছাড়িয়ে। মারদাঙ্গা, খুনজখমের মোহ তাকে পেয়ে বসল। আগের সেই নিরীহ দুলালকে যারা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি, তাদের ওপর চড়াও হয়ে একের পর এক বদলা নিতে থাকল নতুন দুলাল সেন। এর সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া তার ঝকঝকে শাণিত বুদ্ধি। ভালো কাজে মাথা লাগালে হয়তো এই হঠাৎ পাওয়া অলৌকিক শক্তি অনেক কল্যাণকর কাজে ব্যবহার হতে পারত। কিন্তু পাঁচু চোরের বদান্যতায় হাইস্কুলের শিক্ষক দুলাল সেন একটি নামকাটা বদমাশে পরিণত হয়েছেন। সে মিথ্যে কথা বলতে পারে অনায়াসে, সোনার দোকানে ভোজপুরী গুন্ডাদের মেরে পাট পাট করে দিতে পারে, ছলচাতুরির পথে টাকা আদায়ের খেলা তার কাছে জলভাত।

ক্রমে পাঁচু নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে। না জেনেই সে যেন তৈরি করে ফেলেছে এক আস্ত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। গল্পের শেষে অবশ্য পরিদের বলে দেওয়া সুপারন্যাচারাল পথ ধরেই ভূতো সারিয়ে তোলে দুলাল সেন-কে। আবার সে হয়ে যায় নিরীহ গোবেচারা জবুথবু মানুষটি। কিন্তু সেইসঙ্গে হারিয়ে যায় দুলাল সেনের সপাটে রূঢ় সত্যি বলার ক্ষমতাও। শক্তিশালী দুলাল সেন কারওর পরোয়া করত না। একমাত্র সেই ভুবনবাবুকে মুখের ওপর বলতে পেরেছিল, ‘ভুবনবাবু, আমি সারা শহর ঘুরে দেখলুম, আপনার মাথাতেই বুদ্ধিটা সবচেয়ে কম।’ যখন সে আবার আগের গোবেচারা দুলাল হয়ে গেল, ভুবনবাবু এলেন পরখ করতে। সরাসরি দুলালকে যখন জিজ্ঞেস করলেন তিনি কেমন লোক, সে উত্তর দিল, ‘আমি সামান্য মানুষ, বড় বড় মানুষেরা কে কেমন তার কী জানি।’ সাধারণ মানুষের এই গা-বাঁচানো মানসিকতার জন্যই হয়তো ভুবনবাবুদের মতো অনেক মানুষ সমাজের ওপরতলায় বসে স্রেফ টাকা আর পদমর্যাদার জোরে যা খুশি করার স্পর্ধা দেখাতে পারেন।

কিশোর সাহিত্যই হোক বা শিশুসাহিত্য, ছোটদের জন্য লেখেন তো আসলে বড়রাই। তাই বড়দেরই সোচ্চারে না বলতে পারা কথাগুলো রূপকের আড়ালে বেরিয়ে আসে ছোটদের লেখায়। সে কারণেই টুনটুনির গল্পে টুনটুনি শোনায় মার্কসবাদের তত্ত্ব, পঞ্চতন্ত্র-ঠাকুমার ঝুলি বলে সমাজের শোষণের গল্প, সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল-এর ছড়াগুলোয় লুকিয়ে থাকে বিশ্ব রাজনীতির প্যাঁচালো সূক্ষ্ম খোঁচা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই মিনি উপন্যাসগুলো খুঁটিয়ে দেখলে এমন অনেক বকলমে বড়দের কথাই চোখে পড়ে। যদিও তাঁর গল্প বলার গুণে প্রতিটি লেখাই অত্যন্ত স্বাদু, সমস্ত বয়সের মানুষের কাছেই মুখরোচক। একশো বছরের বৃদ্ধা হরমোহিনী দেবীর বাঁ-হাঁটুতে ব্যথা।  মনের ভুলে তিনি ডানহাঁটু এগিয়ে দেন মোক্ষদাকে। মোক্ষদাও বৃদ্ধা হয়েছে, সেও মাঝেমাঝে গুলিয়ে ফেলে ডান-বাঁ। অতএব, দুই অশীতিপর বৃদ্ধার মধ্যে লেগে যায় ধুন্ধুমার।

'ওলো ভালমানুষের বেটি লো, আমাকে উনি হাঁটু চেনাতে এলেন। পাঁচ কুড়ি এক বয়সে কত হাঁটু দেখেছি তা জানিস? হাঁটুর তুই কী জানিস লা? আমার হাঁটু, আমার ব্যথা, আর উনি এলেন আমাকে হাঁটু চেনাতে!"

"তা বেশ বাপু, ঘাট মানছি। স্বীকার করছি হাঁটুও তোমার, ব্যথাও তোমার। কিন্তু কোন্ আক্কেলে তুমি তোমার বাঁ হাটুকে ডান হাঁটু বলে চালানোর চেষ্টা করছ বলো তো! তুমি যে দেখছি দিনকে রাত করতে পারো।"

"কখন আবার বাঁ হাঁটুকে ডান হাঁটু বললুম বল তো! ও-ম্মা, কী মিথ্যেবাদী রে! আমি তোকে বলিনি, ব্যথা আমার বাঁ হাঁটুতে। আর তুই মালিশ করছিস ডান হাঁটুতে?"

"বলেছ। আমিও কানে কালা নই যে শুনিনি। তুমি হাঁটুটা লেপের তলা থেকে ঠেলে বের করে দিলে, আমিও মালিশ করতে লাগলুম। এটা তোমার বাঁ হাঁটু না ডান, তা নিয়ে আমার কোন্ মাথাব্যথাটা শুনি! তোমার হাঁটু তুমি বুঝবে, আমার মালিশ করার কাজ মালিশ করে যাব।"

"তাই যদি হবে তা হলে বড় গলা করে আমাকে আমার হাঁটু চেনাচ্ছিস কেন?" "নিজের হাঁটু যদি নিজেই না চেনো তা হলে লোকে আর কী করবে? তাও বলি বাপু, ভীমরতি ধরেছে সে-কথা স্বীকার করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।"

"ভীমরতি আমাকে ধরবে কেন র‍্যা, ভীমরতি ধরেছে তোকে। নইলে কি আর ডান হাঁটুতে মালিশ করিস? আজ বেশ বুঝতে পারছি, কেন রসুন তেল নিত্যি মালিশ করেও আমার বাঁ হাঁটুর ব্যথাটা কমছে না। কী বুদ্ধিই না তোকে ভগবান দিয়েছেন! রোজ সন্ধেবেলা আমি একটু ঝিমোই, আর তুই মুখপুড়ি, এসে বাঁ হাঁটুর বদলে চুপিচুপি আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করে যাস!"

"ভীমরতি নয় গো, তোমার মাথায় জিন-পরি কিছু ভর করেছে। তখন থেকে বলছি, এ-তোমার ডান হাঁটু নয়, এটা বাঁ হাঁটুই, তাও কেন যে টিকির-টিকির করে যাচ্ছ!"

"ওরে আবাগির বেটি, এটা বাঁ হলে, আমার অন্য হাঁটুটা তা হলে কী? সেটাও কি বাঁ হাঁটু? তুই কি তা হলে বলতে চাস, বিধাতা আমাকে দু-দুটো হাঁটু দিলেন আর দুটোই বাঁ হাঁটু? আর তাই যদি হবে তা হলে এতকাল আমি সেটা জানতে পারতুম না? তুই আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি, এটা বাঁ হলে আমার অন্য হাঁটুটা কী হয়?"

ভাইপোর লাল হেলমেট দেখে সর্বত্যাগী নন্দবাবুর ভারী ইচ্ছে হয়েছে মাথায় পরার। মানুষটি বড় একা। কী করলে ভালো হয়, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, গোপন কথা ভাগ করে নেওয়ার মতো একটিও মানুষ নেই তাঁর জীবনে।  অগত্যা যেকোনও কাজ করার আগে আলোচনা সেরে নেন নিজেরই মনের সঙ্গে।

"ওরে মন!"

"বলে ফ্যালো।"

"কী করব বল।"

"এ-সুযোগ ছেড়ো না হে। মানিক রাত দশটার আগে ফিরবে না।”

"কাজটা অন্যায় হবে না তো?"

"আরে না। কত লোক কত বড়-বড় অন্যায় করে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।"

"তা বটে। তা হলে পরি?"

"পরো। তবে তোমার ওই ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে তো হেলমেট মানাবে না হে। বাক্স খুলে স্যুট বের করো!"

নন্দবাবু আঁতকে উঠে বললেন, "স্যুট! বলিস কী রে মন? ওই ম্লেচ্ছ পোশাক যে আমি ছেড়ে দিয়েছি।"

"ছেড়েই যখন দিয়েছ, তখন আর পরতে দোষ কী? কথায় আছে না, 'তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা'; তার মানে হল, 'ত্যাগ করে ভোগ করো'। যাও, পোশাকটা পরে ফ্যালো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।"

নিজের মনের সাথে বকবক করার ব্যাপারটি এ পর্যন্ত লেখা উনিশটি অদ্ভুতুড়ের কোথাও ছিল না।

এখনও পর্যন্ত লেখা বেশ কয়েকটি অদ্ভুতুড়েতে কানে খাটো মানুষদের কিছু মজার কথোপকথন পাওয়া গেছে। এ অদ্ভুতুড়েতেও তেমনটা দেখা যাচ্ছে। দুলাল স্যার হাফ কালা।

“মন্টু খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, "স্যার, আপনার কিন্তু লাফালাফি করা উচিত নয়।"

দুলাল-স্যার শুনলেন, 'হারাকিরি করা উচিত হয়।'

তিনি সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, "খুব খারাপ। হারাকিরি করা খুব খারাপ।"

এতগুলো বাচ্চাকে পেয়ে দুলাল-স্যার খুবই খুশি হয়ে উঠে পড়লেন।

সবাই চেঁচাতে লাগল, "স্যার আমরা বেলুন নেব।"

"বেগুন খাবে? তা এই অসময়ে বেগুন কোথায় পাব? তার চেয়ে বরং একটা করে বেলুন নাও সবাই।"

গোটা গল্প জুড়ে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক মিষ্টি, মজার চিত্রকল্প। নিতান্তই কোনও জন্ম গোমড়াথেরিয়াম-কেও যদি এ গল্প পড়তে বলা হয়, তার ঠোঁটেও হাসি ফুটবেই ফুটবে। এই মিনি উপন্যাসগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ছোট ছোট বইয়ের আকারে বের হতে শুরু করেছে নব্বইয়ের দশক থেকে, অ্যাডেড বোনাস হিসেবে তাতে থাকে অনেক ঘটনার মজার মজার ছবি। সেই ছবিগুলিও বেশ আকর্ষণীয়।

টলিউড ইতিমধ্যে শীর্ষেন্দুর অনেক উপন্যাস থেকেই ছবি বানিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ‘বনি’, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ গল্পগুলি নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে। আশা রাখি, এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ গল্পটিও একদিন রূপোলী পর্দায় আসবে। বইপত্তর যারা মোটে পড়তে চায় না, তারাও ভিড় জমাবে সিনেমা হলে। চিনে নেবে ভুবনবাবু, পাঁচু চোর, দুলাল সেনদের মতো অবিস্মরণীয় চরিত্রগুলিকে।

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক