পাতালঘর : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের একুশতম আখ্যান

এ পর্যন্ত পড়া একুশখানা অদ্ভুতুড়ের মধ্যে সেরা পাঁচটা যদি বেছে নিতে বলা হয়, অবশ্যই সেই সেরা পাঁচের একটা হবে ‘পাতালঘর’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অন্যসব জঁরের লেখাগুলো নিয়ে যত না বেশি আলোচনা হয়, তার চেয়ে ঢেরগুণ কম আলোচনা হয় সায়েন্স ফিকশন বা সায়েন্স ফ্যান্টাসিগুলি নিয়ে। অদ্ভুতুড়ে সিরিজেই গুটিকতক এমন ঘরানার লেখা রয়েছে, ‘পাতালঘর’ তার মধ্যে একটি।

মিলিটারি থেকে জলদি অবসর নিলেন সুবুদ্ধি রায়। ভাগ্নে কার্তিককে নিয়ে নন্দপুরে এসে আস্তানা গাড়লেন। পুরনো একখানা বাড়ি কিনে ফেলে থাকতে শুরু করলেন। নিঝুম রাতে শোনা গেল আবছা সুরে কে বুঝি ডাকছে। নন্দপুরে হঠাৎই একজন মারকুটে লোকের উদয় হয়েছে। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে অঘোর সেনের বাড়ি। মুখের ওপর কেউ কিছু বললে দুমদাম ঘা কতক বসিয়েও দিচ্ছে। সুবুদ্ধি রায়ের বাড়িতেও এক রাতে তার পায়ের ধুলোটি পড়ল। বাড়ি একেই পুরনো ঝুরঝুরে, তার ওপর মিস্তিরিদের ভুলে সে বাড়িতে বড় গর্তও হয়ে আছে। মারকুটে গুন্ডাগোছের লোকটি সুবুদ্ধি রায়কে ফেলে দিয়ে গেল গর্তের ভেতর।

গর্তে পড়ে সুবুদ্ধি রায় তালেগোলে খুঁজে বের করে ফেললেন চোরাসুড়ঙ্গ, গুপ্তঘর। ও বাড়িই আসলে অঘোর সেনের বাড়ি। দেড়শো বছর আগে এক আধপাগলা বৈজ্ঞানিক অঘোর সেন মানুষকে লম্বা সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখার পদ্ধতিটি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। সাহায্য করেছিল ভিনগ্রহী হিকসাহেব। খুঁজেপেতে গ্রামের সবচেয়ে অপয়া মানুষ সনাতন বিশ্বাসকে বানিয়ে নেন এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ। সনাতন ঘুমিয়ে পড়ে দেড়শো বছরের জন্য।

সনাতনের ঘুম ভাঙে।

"এখন রাত কত হল বল তো।"

"তা শেষরাত্তিরই হবে মনে হয়।"

"বলিস কী? সেই সকালবেলাটায় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াল এর মধ্যেই শেষ রাত্তির! আজব কাণ্ড।"

মাঝখানে যে দেড়শো বছর কেটে গেছে সেটা আর ভাঙল না সুবুদ্ধি।

"ওরে, আমাকে একটু ধরে তোল তো, শরীরটা জুত লাগছে না। মাথাটাও ঘুরছে। আরও একটু শুয়ে থাকতে পারলে হত, কিন্তু তার জো নেই। গোরুগুলোকে জাবনা দিয়ে মাঠে ছেড়ে আসতে হবে। তারপর গঞ্জে আজ আবার হাটবার। মেলা কাজ জমে আছে।"

"আজ্ঞে এই তুলছি।" বলে সুবুদ্ধি সনাতনকে ধরে তুলে

বসাল। একটু নড়বড় করলেও সনাতন বসতে পারল। চারদিকটা প্রদীপের আলোয় চেয়ে দেখে বলল, "বড্ড ধুলো ময়লা পড়েছে দেখছি। সকালবেলাটায় তো বেশ পরিস্কার ছিল।"

"আজ্ঞে, ধুলোময়লার স্বভাবই ওই, ফাঁক পেলেই ফাঁকা জায়গায় চেপে বসে। আর ফাঁকটা অনেকটাই পেয়েছে কি না।"

সনাতন বিরক্ত হয়ে বলল, "ধরে ধরে একটু নামা তো বাপু, একটু দাঁড়িয়ে মাজাটা ছাড়াই। এই বিচ্ছিরি বাক্স থেকে বেরনোও তো ঝামেলার ব্যাপার দেখছি "

সুবদ্ধি সনাতনকে পাঁজা-কোলে তুলে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতেই সনাতন হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, "ও বাবা, হাঁটুতে যে জোর নেই দেখছি!'

"ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেড়শো বছরের পাল্লাটার কথাও তো ভাববেন।"

সনাতন অবাক হয়ে বলল, "দেড়শো বছর। কিসের দেড়শো

বছর রে পাজি?"

"মুখ ফসকে একটা বাজে কথা বেরিয়ে গেছে। জিরিয়ে নিন, পারবেন।”

হিকসাহেব অবশ্য বলে গিয়েছিল, যেদিন সনাতনের ঘুম ভাঙবে, সেদিন সে তার যন্ত্রপাতি ফেরত নিয়ে যাবে এবং সঙ্গে নিয়ে যাবে সনাতনকেও। সনাতনকে পেলে যদি পৃথিবীর মানুষ ঘুমিয়ে পড়ার ম্যাজিকটা শিখে ফেলে!

ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সনাতন দেড়শো বছর ধরে ডেকে গেছে ‘অঘোরবাবু, অঘোরবাবু, আপনি কোথায়?’ মাঝরাতে এমন সরুগলায় কথা শুনলে ভয় তো লোকে পাবেই। বাড়ির নাম হয়ে যায় ভূতের বাড়ি। সুবুদ্ধি রায় নতুন মানুষ, ভূতুড়ে বাড়ি তাঁকে গছিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়েছে দালাল।

"আচ্ছা, ও বাড়িতে কি ভূত আছে মশাই?"

নরহরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, "ভূত! বাড়ির সঙ্গে আবার ভূতও চাই নাকি আপনার? আচ্ছা আবদার তো মশাই! শস্তায় বাড়িটা পাচ্ছেন, সেই ঢের, তার সঙ্গে আবার ভূত চাইলে পারব না মশাই। ভূত চাইলে অন্য বাড়ি দেখুন। ওই নরেন বক্সির বাড়ি কিনুন, মেলা ভূত পাবেন।"

সুবুদ্ধি জিভ কেটে বলল, "আরে ছিঃ ছিঃ, ভূত চাইব কেন? ওটা কি চাইবার জিনিস? বলছিলাম কি পুরনো বাড়ি তো, অনেক সময়ে পুরনো বাড়িতেই তাঁরা থাকেন কিনা।"

নরহরিবাবু এ-কথাটা শুনেও বিশেষ খুশি হলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, "পুরনো বাড়ি হলেই ভূত থাকবে এমন কোনও কথা নেই। ভূত অত শস্তা নয়। ভূত যদি থাকত তা হলে আরও লাখদুয়েক টাকা বেশি দর হাঁকতে পারতুম।”

গর্ভগৃহে পৌঁছে সনাতনের ঘুম ভাঙায় সুবুদ্ধি রায়। সনাতনের ঘুম ভেঙেছে খবর পেয়ে সেই মারকুটে গুন্ডা তাকে নিতে আসে। সে হল ভিনগ্রহী হিকসাহেবের ছেলে ভিক। কিন্তু বাধা দেয় গ্রামের মানুষজন। অঘোর সেনের ভূত এসে ভূতবিশেষজ্ঞ ভূতনাথকে টিপস দিয়ে যায় ভিকের ব্যাপারে।

"শোনো বাপু, গতিক আমি সুবিধের বুঝছি না। হিকের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল সনাতনের যেদিন ঘুম ভাঙবে সেদিনই সে তার 'রেসপিরেটর' আর 'রিভাইভার' যন্ত্র সমেত সনাতনকেও নিয়ে যাবে।"

"বটে! তা হলে আমরা আপনার এত বড় আবিষ্কারের কোনও ফলই পাব না?"

"পেয়ে করবেটা কী? লোকে জানতে পারলেই সব ঘুমোতে চাইবে। মরার চেয়ে ঘুম যে অনেক ভাল বলে মনে করে সবাই।"

ভূতনাথ মাথা চুলকে বললেন, "তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আবিষ্কারটা যে মাঠে মারা যাবে।"

"তা যাবে। হিক সাহেব ছাড়বার পাত্র নন। সনাতন যে জেগেছে সে-খবর তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। তাই ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।"

"তা হলে কী করা যায় বলুন তো!"

"ভাল করে শোনো।"

"শুনছি।"

"সনাতন খুব পাজি লোক, তা জানিস?"

"আজ্ঞে না। কীরকম পাজি?"

"কীরকম পাজি তা বলা মুশকিল। আমিও জানি না, তবে গাঁয়ের লোক ওকে ভয় পেত।"

"যে আজ্ঞে।"

"তোমরা ওকেই কাজে লাগাও।"

অপয়া সনাতনের মুখ দেখে ভিকের কার্যসিদ্ধি আর হয় না, ছুটে পালাতে হয় তাকে।

মোটামুটি এই হল স্টোরিলাইন। অন্যসব অদ্ভুতুড়ের মতো এতেও রয়েছে ভূত, হাসি, মজা, ইয়ার্কি। রয়েছে মজার কথোপকথন। আর একটি নতুন জিনিস দেখা যাচ্ছে— সেইটি হল ‘অপয়া’র কনসেপ্টখানি। সক্কাল সক্কাল কোনও মানুষের মুখ দেখলে যদি দিন খারাপ যায়, তবে সেই মানুষটিকে অপয়া বলা হয়। গল্পে সুবুদ্ধি রায়ের পাশের বাড়িতেই থাকেন গোবিন্দ বিশ্বাস। তিনি নন্দপুরের নামকরা অপয়া। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে লোকে চোখ বুজে হাঁটে।

“আচ্ছা মশাই, এখানে কি খুব চোখের রোগ হয়?"

লোকটা ভ্রু কুঁচকে বলল, "চোখের রোগ? না তো?"

"তা হলে এত অন্ধ কোথা থেকে এল?"

লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হাসল, "অন্ধ কে বলল? ওরা তো সব চোখ বুজে হাঁটছে।"

"চোখ বুজে হাঁটছে! কেন মশাই, চোখ বুজে হাঁটছে কেন?"

"বাঃ, আমি দাঁড়িয়ে আছি না?"

অপয়া হওয়ার জন্য তাঁর মোটেই দুঃখ নেই, বরং এইটিই তাঁর রুটিরুজি। প্রাতঃভ্রমণে যাতে তিনি না বেরোন, তাই অন্যান্য প্রাতঃভ্রমণকারীরা তাঁকে মাসোহারা দেয়। বাজারের লোকজন বাড়িতে বিনামূল্যে বাজার পৌঁছে দিয়ে যায়। কোর্টকাছারির ব্যাপার থাকলে অন্যপক্ষের কেস গুবলেট করে দেওয়ার জন্য গোবিন্দ বিশ্বাসকে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, ২০০৩-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য কুলার’ মুভিটির কথা। একজন লোক অ্যায়সা অপয়া ছিল, বড় বড় ক্যাসিনোর মালিকেরা তাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত। সে আশেপাশে থাকলে খেলতে আসা সব লোকের ভাগ্যের জোর যেত কমে, সবাই হারতো, লাভ হত ক্যাসিনোর।

এই অপয়া গোবিন্দ সেনের পূর্বপুরুষই হল তস্য অপয়া সনাতন বিশ্বাস। অপয়া মানুষের অপয়াত্ব কাটিয়ে দেওয়ারও চমৎকার একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন লেখক। পরপর দুই অপয়ার মুখ দেখে নিলে অপয়ার দোষ কেটে যাবে। গোবিন্দ অপয়ার মুখ দেখার পর যদি কেউ সনাতন অপয়াকে দেখে, তাহলে নাকি তার কোনও ক্ষতিই হবে না।

দুই অপয়া মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সে এক দৃশ্য বটে!

"নাঃ, স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, তুমি বড় রসিক মানুষ। পুবপাড়ার বিশ্বাসবাড়িটাও যে তোমার বাড়ি, জেনে বড্ড খুশি হলুম।"

সনাতন একটু ভ্যাবলা হয়ে বলল, "এ তো বড় মুশকিল দেখছি! সেই বাড়িতে জন্ম হল, এইটুকু থেকে এতবড়টি হলুম, আর আপনি বলছেন রসিকতা? হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, অত একরারে কাজ কী? গিয়েই দেখাচ্ছি। এখনই শরীরটা একটু টালমাটাল করছিল বলে জিরিয়ে নিচ্ছিলুম একটু, নইলে অঘোর সেনের বাড়িতে বসে আছি কি সাধে?"

"অঘোর সেনের বাড়ি? হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ... বাপু হে, শরীর তোমার টালমাটাল করছে কি সাধে? এই বয়সেই নেশাভাঙ ধরে ফেলেছ বুঝি? এই বুড়ো মানুষটার কথা যদি শোনো তবে বলি ও-পথে আর হেঁটো না। শুনেছি নেশাভাঙ করলে পরের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে হয়, নর্দমাকে মনে হয় শোওয়ার ঘর, বাঘকে মনে হয় বেড়াল। আর হরকালী বিশ্বাসের কথা কী বলছিলে যেন?"

"কেন, তিনি আমার পিতাঠাকুর।"

"হাঃ হাঃ হাঃ...হোঃ হোঃ হোঃ...হরকালী বিশ্বাস যদি তোমার পিতাই হন, তা হলে তোমার বয়সটা কত দাঁড়ায় জানো?"

"কেন, আঠাশ বছর।"

"আঠাশ বছর। হাসতে-হাসতে পেটে যে খিল ধরিয়ে দিলে ভায়া! আঠাশের আগে যে আরও একশো বা দেড়শো বছর জুড়তে হবে, সে-খেয়াল আছে? হরকালী বিশ্বাস, জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস কবেকার লোক তা জানো? এঁরা সব আমারই নমস্য পূর্বপুরুষ। তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি নয়। সেইজন্যই তো বলি, নেশাভাঙ করলে এরকম যত গণ্ডগোল হয়।"

সনাতন বিশ্বাস দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে 'বলে উঠল, “খবরদার বলছি, নেশাভাঙের কথা তুলে খোঁটা দেবেন না! আমি জন্মে কখনও তামাকটা অবধি খাইনি! আমাদের বংশে নেশাভাঙের চলন নেই। কেউ বলতে পারবে না যে, সনাতন বিশ্বাস কখনও সুপুরিটা অবধি খেয়েছে!"

গোবিন্দ বিশ্বাস হঠাৎ হেঁকে উঠে বললেন, "কে? কার নাম করলে? সনাতন বিশ্বাস!"

"যে আজ্ঞে। এই অধমের নামই সনাতন বিশ্বাস, পিতা হরকালী, পিতামহ জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস। আরও শুনবেন? প্রপিতামহ তারাপ্রণব বিশ্বাস। বৃদ্ধ প্রপিতামহ অক্ষয়চন্দ্র বিশ্বাস।"

সতিটা জানার পর আধবুড়ো গোবিন্দ বিশ্বাস, তার থুত্থুড়ে বিরানব্বই বছরের বুড়ো বাবা এসে বছর আঠাশের সনাতন বিশ্বাসকে প্রণাম করছে!

“তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল, গলা ধরে এল, গলবস্ত্র হয়ে একেবারে উপুড় হয়ে পড়লেন সনাতনের পায়ে, "এও কি সম্ভব? এই চর্মচক্ষে আপনার দেখা পাব-এ যে স্বপ্নেও ভাবিনি। আপনি হলেন আমার ঠাকুর্দার ঠাকুরদার ঠাকুর্দা... না, একটা ঠাকুর্দা বোধ হয় কম হল!"

সনাতন বড় আদরে গোবিন্দর মুখখানা তুলে দু' হাতে ধরে নিরীক্ষণ করতে-করতে গদগদ হয়ে বললেন, "তা হোকগে, একটা ঠাকুর্দার কম বা বেশি হলে কিছু না। আহা, এ তো দেখছি আমার নিত্যানন্দের মুখ একেবারে কেটে বসানো? নাকখানা অবশ্য সত্যানন্দের মতো। আহা, খোকাটিকে দেখে বুক জুড়িয়ে গেল। তা হ্যাঁ রে দুষ্টু, তোর বাপ বেঁচে নেই?"

চোখের জল মুছতে-মুছতে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, "আজ্ঞে আছেন। বিরানব্বই চলছে।"

"ডাক, ডাক তাকে। বিরানব্বই আবার একটা বয়স নাকি! দুধের শিশুই বলতে হয়।"

তা বিরানব্বই বছরের বাপও এসে সব শুনে ভেউ ভেউ করে কেঁদে সনাতনের পা জড়িয়ে ধরলেন। সনাতন তাঁকে আদরটাদর করে, গালে ঠোনা মেরে খুব চনমনে হয়ে উঠলেন।”

দেড়শো বছর একটানা ঘুমিয়ে থাকা মোটেই সহজ কথা নয়। গোটা পরিবারটাকে ফেলে রেখে একজন লোক দুম করে ‘নেই’ হয়ে গেল, সময়ের নিয়মে সবই সয়ে যায়। কিন্তু সেই ‘নেই’ হয়ে যাওয়া মানুষ যদি আবার ফিরে আসে? ফিরে এসে যদি দেখে, তার ‘নিজের’ বলতে আর কেউ নেই। কিচ্ছুটি নেই। সনাতনের সেই শকটির কথাও রয়েছে।

"তা হলে আমার বাড়ি! আমার বাপ-মা ছেলেপুলে সব? তাদের কী হল?"

"আজ্ঞে, দেড়শো বছরে কি কিছু থাকে? তবে পুত্রপৌত্রাদি এবং তস্য তস্য পুত্রপৌত্রাদি নিশ্চয়ই আছে।”

"তার মানে কেউ বেঁচে নেই বলছিস নাকি?"

"বেঁচে থাকলে কি ভাল হত মশাই? তবে সবাই বেশ দীর্ঘজীবী হয়েই সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন।"

"এ-হো-হো....!" বলে সনাতন ডুকরে কেঁদে উঠল।”

গল্পের ভূত অঘোর সেন। বিজ্ঞানী হয়ে সে নিজে এখন ভূত। তাই ভৌতিক ব্যাপারস্যাপারগুলোকেও সে লজিকে বেঁধে ফেলেছে।

“ভয় পাচ্ছ নাকি?"

"ওই একটু।"

"তা ভয়ের কী আছে বলো তো! টেপরেকর্ডারে, গ্রামোফোনে অন্যের গলা শোনো না? তখন কি ভয় পাও? অনেক মৃত গায়কের গানও তো শোনো। তখন তো ভিরমি খাও না!"

"আজ্ঞে, সে তো যন্ত্রে রেকর্ড করা থাকে।"

"কিন্তু সেও তো ভূত, নাকি? সেও তো অতীত, যা নাকি এখন নেই। ঠিক তো!"

"আজ্ঞে।"

"ফোটো দেখো না? ফোটোতে কত শতায়ু মানুষের ছবিও তো দেখো, তখন ভয় পাও?"

"আজ্ঞে, সে তো ইমপ্রেশন।"

"ভাল করে বিজ্ঞানটা রপ্ত করো, তা হলে ভূতপ্রেতও বুঝতে পারবে, বুঝেছ? এসবও ইমপ্রেশন, এসবও সূক্ষ্ম অস্তিত্ব, তবে কিনা বিজ্ঞান এখনও নাগাল পায়নি এই রহস্যের।"

২০০৩ সালেই এই গল্প অবলম্বনে তৈরি হয় ‘পাতালঘর’ সিনেমা। সিনেমা হিসেবে তা বড়ই উপাদেয়, তবে তার সাথে শীর্ষেন্দুর লেখা গল্পটির মিলের চেয়ে অমিল বেশি। যে অদ্ভুতুড়েগুলো নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলা হয়েছে, সেগুলো দেখতে দেখতে বারবার এমনটাই মনে হয় যে, লেখক বুঝি স্রেফ খসড়া লিখেছিলেন, সিনেমার ডিরেক্টররা তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপটি দিয়েছেন। আসলে পূজাবার্ষিকীর পাতায় হাত খুলে লেখার স্বাধীনতা তো থাকে না। শব্দসীমা হয়তো ধরে বেঁধে দেওয়া হয়। অন্যান্য আরও অনেক অদ্ভুতুড়ের মতো ‘পাতালঘর’ও পড়তে বসে মনে হয়েছে, শেষদিকটায় যেন লেখক বড় বেশি তাড়াহুড়ো করলেন। পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশ হওয়ার পরে যখন একই গল্প বইয়ের আকারে ছাপা হল, তখন কেন যে আরেকটু যত্ন নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন না লেখক, এ প্রশ্ন থেকেই গেল।

সিনেমার গল্পটা অনেকটা বেশি সময় নিয়ে লেখা হয়েছে। এসেছে নতুন অনেক চরিত্র। ভূত বিশেষজ্ঞ ভূতনাথকে একটি ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং জোরজবরদস্তি কাজে লাগিয়েছে অঘোর সেনের যন্ত্রটা খুঁজে বের করার জন্য। সেই গ্যাংয়ের লিডার বেগম নামে এক জাঁহাবাজ মহিলা। গ্যাংয়ের মেম্বারদের কীর্তিকলাপ দেখলে দিব্যি যেন অদ্ভুতুড়ে অদ্ভুতুড়ে গন্ধ পাওয়া যায়। সিনেমাটা বানানোর সময় লেখক কি নিজেই এই নতুন চরিত্রগুলো যোগ করিয়েছিলেন নাকি এরা পরিচালকেরই মস্তিষ্কপ্রসূত? বেগমের দলের লোকজনও এক একটি খাঁটি অদ্ভুতুড়ে চরিত্র। ভূতনাথকে ধমকি দিতে এসে দলের একজন ভিডিয়ো গেমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বইয়ের গল্পে সুবুদ্ধি রায় মিলিটারি ফেরত মানুষ। সভ্যভব্য, ডিসিপ্লিনড। ভাগ্নে কার্তিক তার মা-বাবার অনেকগুলি সন্তানের একজন। তাই তাকে মামার কাছে পাঠিয়ে দিতে তার বাড়ির লোকের কোনও অসুবিধে হয়নি।

সিনেমার গল্পে সুুবুদ্ধি রায় একজন নিষ্কর্মা, অলস মানুষ। উত্তর কলকাতার কোনও এক বাড়ির নোংরা ঘিঞ্জি পরিবেশে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বেলা দশটায় ঘুম থেকে উঠে লুঙ্গি সামলে ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে হাই তোলে, তার হাবভাব চূড়ান্তই অমার্জিত। মাসের পর মাস ভাড়া বাকি ফেলে রাখে। ভাড়ার তাগাদায় বাড়িওলা এলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে আর ভাগ্নে কার্তিককে বলে দিতে বলে সে বাড়িতে নেই। ভাগ্নে কার্তিক অনাথ। সে টুকটাক রেডিও সারাইপাতি করে কোনওমতে সংসার এবং তার মামাটিকে চালায়।

তবে বইয়ের তুলনায় সিনেমার চরিত্রগুলি বড় বেশি রঙিন। বড় বেশি জীবন্ত। মিলিটারি ফেরত সুশিক্ষিত মার্জিত ভদ্রলোক সুবুদ্ধি রায়ের চেয়ে সিনেমার হাসিখুশি, এটিকেটের ধার ধারে না, থিয়েটার পাগল সুবুদ্ধি রায়-কে আরও বেশি পছন্দ হয়ে যায়।

লেখক তাঁর গল্পে বলেননি ঠিক কোন উপায়ে সনাতনকে দেড়শো বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। লম্বা বাক্সের যন্ত্রপাতি চলছিল ঘুমন্ত সনাতনের শরীরটা সচল রাখার জন্য। সিনেমার গল্পে বেশ গুছিয়ে বলা হয়েছে যন্ত্রের কথা। যন্ত্রটা একটা গ্রামোফোনের মতো দেখতে, বন্দুকের মতো কারওর দিকে তাক করলে অদ্ভুত সুরেলা আওয়াজ বেরোয় আর সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

ওই যে গোড়ায় বলেছিলাম, পাতালঘর গল্পটা যেন এক খসড়া, তাকে পরিপূর্ণ রূপটি দিয়েছে ‘পাতালঘর’ সিনেমা। গল্পের সঙ্গে তাই অতি অবশ্যই সিনেমাটাও দেখে নেওয়া দরকার।

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক