রাঘববাবুর বাড়ি - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ঊনত্রিশতম আখ্যান

আমাদের চেনা পরিচিত মহলে এক একজন থাকেন না, যিনি সামান্য কথাটুকুও এমন সুন্দর করে চমৎকার এক্সপ্রেশনসহ গুছিয়ে বলতে পারেন, যে তাক লেগে যায়! শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই ঊনত্রিশ নম্বরটি খানিক সেইরকম গল্প। স্টোরিলাইনে আভিনবত্ব একেবারেই নেই। সেই একইরকম অদ্ভুতুড়ে গ্রামের বাড়ি যেখানে ভূতে মানুষে মিলেমিশে থাকে।  খ্যাপা বিজ্ঞানী, গোটাকতক কাছাখোলা গোছের লেঠেল, নিজেকে বিশাল বড় গায়ক ভাবা একজন বেসুরো মানুষ, রুগ্ন ডাকাত, দুষ্টু ডাকাত— চরিত্রগুলোও আমাদের বড় পরিচিত। মুক্তিপণের দাবিতে দুজন খুদেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়ার চেষ্টা হয় এবং বাড়ির অন্য সদস্যরা সদলবলে গিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনেন। কিডন্যাপিংয়ের অ্যাঙ্গলটি অদ্ভুতুড়ে সিরিজে বেশ কয়েকবার এসে পড়েছে। তবে শুরুর দিকের গল্পগুলোয় বড্ড তাড়াহুড়ো, খানিক অগোছালো ভাব থাকতো। এখনের গল্পগুলো অনেক বেশি যত্ন করে লেখা, তা পড়লেই মালুম হয়। ছক চেনা হলেও শীর্ষেন্দুর গল্প বলার কায়দাই যেন গোটা গল্পে একটা টাটকা ফ্রেশ হাওয়া বইয়ে দেয়।

শীর্ষেন্দুরই কোনও এক লেখায় পড়েছিলাম, “লোকটা গরিব, বুঝলেন! খুবই গরিব।" কী রকম এবং কতটা গরিব বলুন তো!"যাচ্ছেতাই রকমের গরিব মশাই, বিচ্ছিরি রকমের গরিব। আসলে টাকা ছাড়া লোকটার আর কিছুই নেই।" ছোটদের অদ্ভুতুড়ে সিরিজেও শীর্ষেন্দু বরাবর মানবিক গুণগুলো হাইলাইট করে আসছেন। মায়া, দয়া, মমতা— এ শুধু জ্যান্ত মানুষের একচেটিয়া নয়, সিরিজের ভূতগুলি পর্যন্ত সে জিনিস ভোলেনি। ওহ্ হো, এ গল্পের ভূতেদের তো আবার ‘ভূত’ বলা যায় না, বলতে হবে আবছা মানুষ!

গল্প শুরু হয় রাঘববাবুর বাড়িটিকে ঘিরে। রাঘববাবুর বাড়িই যেন এক আস্ত গ্রাম। বাড়িতে অনেক অনেক সদস্য। রাঘববাবু পাট আর গুণচটের পৈতৃক ব্যবসা করে অঢেল রোজগার করেছেন। রাঘববাবু অদূরদর্শী, খামখেয়ালি মানুষ এবং তার সুযোগ নিতেও ছাড়ে না চালাক মানুষের দল। তাঁর আশ্রিতদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

পালোয়ান হাবু দাস এসেছিল বাড়ির ছেলেদের কুস্তি শেখাতে। কিন্তু তাঁর দুধ-ননী খাওয়া খোকারা পালোয়ানি শেখার জন্য যুতসই শরীর নিয়ে জন্মায়নি। রাঘববাবু নিজেও পালোয়ানিতে খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেননি। অগত্যা হাবু দাস কেবল খায় আর ঘুমায়। তার সুন্দর মাসকুলার চেহারাটি এখন চর্বির পাহাড়। কুস্তি দূরের কথা, দশ পা হাঁটতেই তার হাঁফ ধরে যায়।

কালোয়াতি গায়ক গুণেন সাঁতরা এসেছিল রাঘববাবুর সভাগায়ক হবে বলে। রাঘববাবু কেত্তন শ্যামাসঙ্গীত ছাড়া কিছু শোনেন না, তবু ‘এসে যখন পড়েছেন তখন ফেলতে তো আর পারি না’ বলে তাঁকেও রেখে দেওয়া হল। গুণেনের গান অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় পাড়ার বেরসিক কুকুরদের উপদ্রবে। সে রেওয়াজে বসলেই কুকুরেরাও তাল দেয়। গুণেন এখন তাস, পাশা খেলে টাইম পাস করে।

ভূত বিশারদ ভূতনাথ আরেক আশ্রিত। এ বাড়িতেই পুরনো ভূতেরা আছে শুনে তার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। তবু ফ্রিতে থাকা-খাওয়ার লোভে সেও থেকে গেছে।

বৈজ্ঞানিক হলধর হালদার স্কুলে পড়াতো কিন্তু পড়ানোয় তার মোটেই মন ছিল না। সে চায় গবেষণা করতে। চাকরিটি তার খোয়া যায়। হলধর এসে পড়ে রাঘববাবুর কাছে। থাকে, খায়, ইচ্ছেমতো উদ্ভট গবেষণা করে।

আরও একজন আশ্রিত আছে, গুলবাজ গোলাপ রায়। সে নাকি ভিনগ্রহের মানুষ। মহাকাশযানের ভুলে এসে পড়েছে রাঘববাবুর বাড়ি। বাকিরা যাও বা কোনও একটা কাজের ছুতো ধরে রাঘববাবুর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে, গুলবাজ গোলাপের গুল দেওয়া ছাড়া আর কোনও স্কিলই নেই।

এই যে খানপাঁচেক আশ্রিতের কথা বলেছেন লেখক, এদের সব্বাইকে আমরা চিনি। সিরিজের কোনও না কোনও গল্পে এই ধরনের চরিত্ররা ছিল। যেমন, হাবু পালোয়ান! ঠিক যেন ষোলো নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘ছায়াময়’এর লক্ষ্মণ পাইক ফিরে এসেছে। গুণেন সাঁতরার মতো বেসুরো গায়ক চরিত্র প্রথম অদ্ভুতুড়ে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র গণেশবাবুকে মনে করিয়ে দেয়, যিনি সুরে ভুল হলেই সকাল সকাল আত্মহত্যা করার জন্য গোয়াল থেকে গরুর গলার দড়ি খুলে আনতেন। ভূত বিশারদ ভূতনাথ হালদার তো একুশ নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘পাতালঘর’এর ভূত বিশেষজ্ঞ ভূতনাথ নন্দীর মতোই একটি চরিত্র, কাজেও মিল, নামেও মিল। বৈজ্ঞানিক হলধরের মতো চরিত্র বেশ কয়েকবার এসেছে সিরিজে। ছয় নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘ভূতুড়ে ঘড়ি’র গর্ডন সাহেব, কুড়ি নম্বর ‘অদ্ভুতুড়ে’র ভুবন রায় এঁরা সকলেই হলধরের পূর্বপুরুষ বলা যেতে পারে।

তবে নতুন কী রইল? নতুন আমদানি হল এই বিস্তারিত বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে মজার কিছু কথোপকথনের অংশ। যেমন ভূতনাথ যখন আসে রাঘববাবুর বাড়ি, তখন তার সঙ্গে প্রথমবার আলাপ পরিচয়টির কথা লেখক বলতে শুরু করেছেন বৈঠকী মেজাজে।

“ভূতনাথ নাকি ভূতবিদ্যা গুলে খেয়েছে। তার চারদিকে সর্বদাই ভূতের ভিড়! বছরটাক আগে এসে সেও জুটে গেল এ বাড়িতে। রাঘবকে বলল, "বাবুমশাই, ভূত বড় ত্যাঁদড় জিনিস, এমনিতে টেরটি পাবেন না। কিন্তু ধরুন চিতল মাছের পেটি দিয়ে পরিপাটি ভাত খাবেন বলে মনস্থ করলেন, একটা দুষ্টু ভূত এক খাবলা নুন দিয়ে গেল ঝোলে।"

রাঘব সায় দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম তো হয়ই।"

"তারপর ধরুন শুভকার্যে বেরোচ্ছেন, দুর্গা দুর্গা বলে বেরোতে পা বাড়িয়েছেন, একটা বদমাশ ভূত টক করে খুতির খুঁটটা দিল পায়ে জড়িয়ে। দড়াম করে পড়লেন আর কী। ভূতের কাজ বলে টেরটিও পেলেন না।"

রাঘব সোৎসাহে বললেন, "ঠিক বলেছেন তো! গত বছর আমার তো একবার এরকম হয়েছিল।"

"শুধু কি তাই বাবুমশাই! ধরুন, আপনার শুদ্ধাচারী বিধবা শাশুড়ি একাদশীর পরদিন চারটি ভাত পাথরের থালায় বেড়ে নিয়ে খেতে বসেছেন, একটা শয়তান ভূত টুক করে একখানা মাছের কাঁটা তার পাতে ফেলে গেল। কী সর্বনাশ বলুন তো!"

রাঘব মাথা নেড়ে বললেন, "হ্যাঁ, এরকম তো হতেই পারে। হয়ও।"

"আর চিন্তা নেই মশাই। আজ থেকে এই শর্মা গ্যাঁট হয়ে বসল এই বাড়িতে। ত্রিসীমানায় আর ভূতের উপদ্রব থাকবে না।"

রাঘববাবু তাঁর পুরনো কাজের লোক নবকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন, "কী রে নবু, এরকম একজন লোক বাড়িতে থাকা তো ভালই, কী বলিস?"

নবকৃষ্ণ রাঘববাবুর তামাক সেজে কলকেতে ফুঁ দিতে দিতে গড়গড়ার মাথায় বসাচ্ছিল। খুব নির্বিকার গলায় বলল, "ওঝা-বদ্যি রাখুন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তা হলে পীতাম্বরমশাই, হরুখুড়ো, পঞ্চা বিশ্বেস, আন্নাকালী দেব্যা এদের কী ব্যবস্থা হবে? তেজালো ওঝা দেখলে তাঁরা কি ভড়কে যাবেন না?"

রাঘব খুবই চিন্তিত হয়ে তামাক টানতে টানতে বললেন, "হ্যাঁ, সেটাও তো একটা কথা! ওঝা ঢুকলে তাঁরা যদি যাতায়াত বন্ধ করে দেন তা হলে তো সর্বনাশ!"

ভূতনাথ হাঁ করে দু'জনের কথা শুনছিল। বড় বড় চোখ করে বলল, "আপনারা কাদের কথা কইছেন? এরা সব কারা?"

রাঘব তামাক টানতে টানতে নিমীলিত চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে বললেন, "এঁরা এ বাড়ির পুরনো আমলের মানুষ সব। পীতাম্বরমশাই আর হরুখুড়ো আমারই ঊর্ধ্বতন পঞ্চম আর সপ্তম পুরুষ। পঞ্চা বিশ্বেস এ বাড়িতে দেড়শো বছর আগে কাজ করত, এই নবকৃষ্ণেরই ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ, আন্নাকালী দেব্যা ছিলেন আমার ঠাকুর্দার বিধবা পিসি। আনাচে কানাচে থাকেন, সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করেন।"

নবকৃষ্ণ বলল, "এঁরা তো আছেনই, তা ছাড়া পালে পার্বণে আরও অনেকে এসে জুটে যান। তাই বলছিলাম, ওঝাবদ্যি বসান দিলে এঁরা কুপিত হয়ে যদি তফাত হন তা হলে কি বাড়ির মঙ্গল হবে?"

ভূতনাথ ভারী ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, "ওরে বাবা! তাঁরা কি দেখাটেখাও দেন নাকি গো নবুদাদা?"

"তা দেবেন না কেন? নিত্যিই দেখছি। একটু আগেই তো গোয়ালে সাঁজাল দিতে গিয়ে পীতাম্বরমশাইকে দেখলুম, কেলে গোরুটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন?"

ভূতনাথ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "বাপ রে! এ বাড়িতে তো তা হলে ভূতের মচ্ছব।”

নবকৃষ্ণ বলল, "উঁহু, উঁহুঁ, ভূত বললে এঁদের ভারী অপমান হয়। ছেঁদো ভূত তো নন। দেয়ালা করতেও আসেন না। বাড়ির মঙ্গলামঙ্গলের কথা চিন্তা করেই চারদিকে নজর রাখেন আর কী!"

 

শুনে ভূতনাথ ভিরমি খায় আর কী! মাথায় জলটল দিয়ে তাকে সুস্থ করার পর রাঘববাবু বললেন, "তোমার ভয় নেই হে, আমার বাড়িতে যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই নিপাট ভাল লোক। শুধু ওই আন্নাঠাকুমাই যা একটু খাণ্ডার। তাকে না ঘাঁটালেই হল। যা রে নবু, ওকে ব্যারাকবাড়ির পুবদিকের ঘরখানায় বন্দোবস্ত করে দে।"

এমন করে অজ্ঞাতকুলশীলদের আশ্রয় দিতে দিতে একদিন রাঘববাবু বাড়িতে ঢুকিয়ে ফেললেন আস্ত এক ডাকাতকে। নকুল সর্দার, সে ডাকাতের দলে নরবলি দেয়।

গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলে থাকে ডাকাত ল্যাংড়া শীতল। সে এখন বুড়ো হচ্ছে। হাজারটা রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে। তার একটি বাঁধা জ্যোতিষ আছে। সে কর গুণে নক্ষত্র গুণে নিদান দিয়েছে, নরবলি না দিলে ল্যাংড়া শীতলের রোগ সারবে না। নরবলির জন্য লোক ধরে আনা হয়। আর পুজোর জন্য রাঘববাবুর বাড়ির পুরুতকে তুলে আনা হয়।

পুরুত নন্দলাল এ গল্পের একমাত্র যুক্তিবাদী বিচক্ষণ চরিত্র। বলির জন্য ধরে আনা ছেলেটিকে সে বুদ্ধি খাটিয়ে নাকচ করে দেয়, ‘খুঁতো’ বলি মা নেবেন না বলে। মানুষের জায়গায় মোষবলি হল।

ল্যাংড়া শীতলের রোগ কিন্তু সারে না। তার জ্যোতিষ বলেছে, নরবলি হয়নি বলেই রোগ সারছে না। ল্যাংড়া শীতল তাই এইবারে দু দুটো নরবলি দিতে চায়। রাঘববাবুর দুটি ফুটফুটে খোকা হরতন আর রুইতনকে সে ধরে নিয়ে যাবার জন্য নকুল সর্দারকে পাঠিয়েছে।

নকুল সর্দারের ঠান্ডা খুনে খুনে চাউনি দেখে পুরুত নন্দলালের তাকে চেনা চেনা ঠেকে। তার রকমসকম দেখে বাড়ির বাকি আশ্রিতরা ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কাউকে গুঁতো মারছে, কাউকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে— একটা রাত যেতে না যেতেই দেখা গেল বৈজ্ঞানিকটি বাঁশবাগানে সংসার পেতেছে, ভূত বিশারদ গাছে উঠে বসে আছে, গায়ক বাবার নাম ভুলে গেছে, পালোয়ান সবই ভুলে গেছে আর গুলবাজ পাকাপাকিভাবে এ বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য রাঘববাবুর কাছে হাতখরচা চাইতে গেছে।

হাবু পালোয়ানের জানলার ধারের বিছানাখানা নকুল সর্দারের পছন্দ হয়েছিল। হাবুকে ঘা কতক বসিয়ে সে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। আচমকা মারধোর খেয়ে হাবুর মাথাটা গেছে তালগোল পাকিয়ে। সকালে উঠে দেখে তার আর নিজের নামটাই মনে পড়ছে না। মার খেয়ে স্মৃতিভ্রংশ হওয়া চরিত্র এর আগেও সিরিজে এসেছে, তাদের নিয়ে অঢেল মজার কান্ডকারখানাও ঘটেছে। আঠেরো নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘নবীগঞ্জের দৈত্য’, যেখানে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা কুস্তিগীর ছেলেটিকে গ্রামের সকলে দৈত্য, যমরাজ ইত্যাদি ভেবে ভয়ের চোটে সাংঘাতিক হট্টগোল পাকিয়ে তুলেছিল।

“হাবু লোকটাকে ডেকে বলল, "ওহে বাপু, বলো তো কোন নামটা আমাকে মানাবে! বেশ ভেবেচিন্তে বোলো কিন্তু। সকাল সরকার, কোকিল কাহার, জানালা পাল, ভোরের আলো সেন, বায়স বসু।"

লোকটা অবাক হয়ে বলে, "সে কী গো হাবুদাদা, পিতৃদত্ত নামটা থাকতে আবার নতুন নাম রাখতে যাবে কেন? হাবু নামটা তো খারাপ নয়। দিব্যি নাম।"

হাবু নাক সিঁটকে বলল, "এঃ, আমার নাম হাবু নাকি?"

"তবে! এ নামেই তো সবাই তোমাকে চেনে!"

হাবু ভাবল, এ লোকটা বোধ হয় অনেক খবর রাখে, এর কাছ থেকেই কায়দা করে সব জেনে নিতে হবে।

হাবু চোখ কুঁচকে বলল, "আচ্ছা, আমার নাম যদি হাবু হয়, তা হলে তোমার নামটা কী হবে?"

লোকটা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, "কাল কদম ওস্তাদের অমন আছাড়টা খেয়েও তোমার মশকরা করতে ইচ্ছে যাচ্ছে? ধন্যি মানুষ বটে তুমি? কাল অমন কুরুক্ষেত্তর হল, তায় সারারাত আমাদের কারও চোখে ঘুম নেই। ওই কালাপাহাড় বিভীষণ এখন কাকে ধরে, কাকে খায় সেই চিন্তাতেই ভয়ে মরছি। ৩৫

এ সময়ে কি মশকরা ভাল লাগে গো হাবুদাদা?"

হাবু খিকখিক করে হেসে বলল, "পারলে না তো!"

"কী পারলুম না?”

"বলতে পারলে না তো যে, আমার নাম যদি হাবু হয় তা হলে তোমার নাম কী হবে? বলতে পারলে বুঝব তুমি বাহাদুর বটে।"

"আর বাহাদুর হয়ে কাজ নেই বাপু। যা কাল দেখলুম তাতে বাপের নাম ভুলে যাওয়ার জোগাড় তো নিজের নাম।"

হাবু মিটমিট করে চেয়ে বলল, "ভুলে গেছ তো! তা হলে বাপু, ভাল দেখে নিজের একটা নাম রাখলেই তো হয়। আচ্ছা, পাঁচকড়ি নামটা কেমন বলো তো!"

গুলবাজ গোলাপ রায়ের কান্ডটি অবশ্য আরও সরেস। সে চিনে ফেলেছে নকুল সর্দার যে সে লোক নয়। সে এইবারে পাততাড়ি গোটাতে চায় এ বাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে যা পাওয়া যায় আদায় করে নিতে চায়। তাই সে গেছে রাঘববাবুর কাছে। ঝুটমুট পাথর দেখিয়ে আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে।

‘‘রাঘববাবু পাথরটা সাবধানে একটা বাক্সে রেখে সিন্দুক বন্ধ করে বললেন, "বলি ওহে গোলাপ!"

"বলুন কর্তামশাই।”

"বলছিলাম কী, সত্যিই যদি তুমি মরেটরে যাও, তা হলে তো পাথরটা আমারই হবে, না কি?"

"যে আজ্ঞে। গোলাপ রায়ের কথার কোনও নড়চড় হয় না।"

"কিন্তু বাপু, তা হলে যে আমি তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকব। সেটা কি ভাল দেখাবে?"

"তা কেন কর্তামশাই, আপনার কাছেও তো আমার কিছু ঋণ আছে। ধরুন খাওয়া থাকা বাবদ হিসেব করলে দিনে যদি সাড়ে তেরো টাকাও ধরেন তা হলে গত তেতাল্লিশ দিনে দাঁড়াচ্ছে একুনে পাঁচশো আশি টাকা পঞ্চাশ পয়সা। সেটা কি কম হল কর্তামশাই? তবে আপনার বিবেকের দায়িত্বটা আর আমার ওপর অর্শাচ্ছে না।"

একটু লাজুক মুখে রাঘব কয়েকখানা নোট নিয়ে বললেন, "নাও হে, এ-ক'টা রাখো। দু'হাজার আছে।"

যেন ছ্যাঁকা খেয়ে হাতটা টেনে নিয়ে গোলাপ বলল, "করেন কী কর্তা! ও টাকা আপনি বরং কাঙাল ভিখিরিদের বিলিয়ে দেবেন। আমার অন্তিমকাল তো ধাঁ করে চলেই এল প্রায়। এখন আর টাকাপয়সা দিয়ে হবেই বা কী?"

"আহা, আচ্ছা না হয় পাঁচ হাজারই দিচ্ছি। নাও হে, এ দিয়ে ভাল মন্দ কিছু খেও।”

মাথা নেড়ে গোলাপ বলল, "আর লজ্জা দেবেন না কর্তা। তবে একটা কথা বলি।"

"কী বলবে হে?”

"গন্ধে গন্ধে কদম কোঙার ঠিক জায়গায় এসেছে বটে, কিন্তু এত জনের মধ্যে কোনটা আমি তা কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি। তবে বেশি দিন তো আর ছদ্মবেশ রাখা যাবে না। কিন্তু কতদিন আয়ু আছে তা না বুঝে খোরাকির টাকা নিই কী করে। ধরুন যদি আরও এক মাস বেঁচে থাকতে হয় তা হলে এ-বাজারে পাঁচ হাজারে কি ভালমন্দ খাওয়া চলবে?"

"আচ্ছা আচ্ছা, পুরো দশই দিচ্ছি। দয়া করে নাও ভাই।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোলাপ বলল, "আপনাকে দুঃখও দিতে পারি না কি না। দিচ্ছেন দিন। তবে যদি বেঁচে ফিরে আসি তা হলে এ-টাকার ডবল ফেরত দিয়ে পাথর নিয়ে যাব। ওটা এক মাসের সুদ বলে ধরবেন। দু'মাস হলে ত্রিশ হাজার, তিন মাস হলে চল্লিশ, এরকম রেটেই টাকা আপনার বাড়তে থাকবে।"

এমন করে মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা হাতানোর চেষ্টাটিও নতুন নয়। কুড়ি নম্বর ‘অদ্ভুতুড়ে’তে কবিতার মিল বেচার ফন্দি এঁটে ভুবনবাবুর থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা আর এলাহি খানাপিনা আদায় হয়েছিল।

বেসুরো গায়ক গুণেন মার খেয়ে বাবার নাম ভুলে গেছে বটে, কিন্তু তার ধারণা হঠাৎ গুঁতো খেয়েই তার গানের গলাটি আরও খোলতাই হয়েছে। কোকিল ডাকছে দেখে সে মালীকে ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তার গান শুনেই এমন অসময়ে কোকিলের ডাকার শখ জেগেছে। মালী বেরসিক। সে ঠোঁট উলটে বলে গেল, এ তল্লাটের কোকিলরা অসময়েই ডেকে থাকে। গরু বেশি দুধ দিচ্ছে দেখে গুণেন গোয়ালাকে বলতে গেল, গান শুনে গরুর ভালো লেগেছে তাই দুধ বেশি দিচ্ছে। কিন্তু না, গোয়ালাও বেরসিক।

গোয়ালঘরের উঠোনে গেনু গয়লা দুধ দোয়াচ্ছিল। গুণেন শুনেছে, ভাল গান শোনালে গোরু নাকি বেশি দুধ দেয়। সে গিয়ে কিছুক্ষণ দুধ দোয়ানো দেখল। তারপর মুরুব্বির মতো জিজ্ঞেস করল, "ওরে গেনু, দুধটা যেন একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে!"

"হাঁ হাঁ, কাহে নেহি? গোরুকে ঠিকমতো দেখভাল করলে জেয়াদা দুধ কাহে নাহি দিবে? হামি রোজ গোরুকে ঘাস বিচালি, লালি গুড়, খইল খিলাচ্ছি, উসি লিয়ে তো দুধ ভি জেয়াদা দিচ্ছে।"

"ওরে না। সে-কথা নয়। সেসব তো রোজই খায়। তবু যেন আজ দুধটা একটু বেশিই দিয়ে ফেলছে!"

"র্কিউ নেহি বাবু? মুলতানি গাই আছে, যত খিলাবেন তত দুধ বাড়িয়ে যাবে। কাল রাঘববাবু তো ইসকো দো সের রসগুল্লা ভি খাইয়েছেন। উসি লিয়ে দুধ জেয়াদা দিচ্ছে।”

কথাটা মোটেই মনঃপুত হল না গুণেনের। ও ব্যাটা আসল ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু গুণেন গোরুটাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখল, মুখটা বেশ হাসি-হাসি। আর চোখে কেমন একটা বিভোর ভাব। অবোলা জীব, কথা তো আর কইতে পারে না, কিন্তু গুণমুগ্ধ চোখে গুণেনের দিকে চেয়ে আছে।

"হ্যাঁ রে গেনু, তুই গানবাজনা ভালবাসিস?"

"হাঁ হাঁ, জরুর। গানা বাজনা তো হামার বহুত পসন্দ আছে।

রোজ রাতে তো আমি ঢোল বাজাই আর রামা হো, রামা হো গানা ভি গাই।”

"ও গান নয় রে। এই যে একটু আগে আমি আলাহিয়া বিলাওল গাইলাম, শুনিসনি?”

"কাহে নেহি শুনবে বাবু? জরুর শুনেছে। উ তো বহুৎ উমদা গানা আছে বাবুজী। শুনে হামার দাদিমার কথা ইয়াদ হল।"

"কেন রে, তোর দিদিমার কথা মনে পড়ল কেন? তোর দিদিমা গান গাইত বুঝি?”

"নেহি বাবু, দাদিমা থোড়াই গানা গাইবে। লেকিন হামার দাদিমা রোতা থা। কুছু হলেই দাদিমা কাঁদতে বইসে যেত। গরম পড়লে কাঁদত, শীত পড়লে কাঁদত, বরখ হলে কাঁদত। কাক বক মরলে কাঁদত। এইসন কাঁদত যে আশপাশ গাঁওমে কোই মারাটারা গেলে দাদিমাকে ভাড়া করে কাঁদবার জন্য নিয়ে যেত। আপনার গানা শুনে হামার খুব দাদিমার কথা ইয়াদ হচ্ছে।"

ধুস! ব্যাটা গানের কিছুই বোঝে না। সমঝদার না হলে এইসব উচ্চাঙ্গের জিনিস বুঝবেই বা কে?”

তবে গুণেনের গানের গুঁতোয় একটা ভালো কাজ হয়েছিল। বুড়ো খাজাঞ্চির কানে ঢুকে থাকা জল বেরিয়ে গিয়েছিল, তিনি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন। ঠিক এইরকম ব্যাপার ঘটতে আগেও দেখা গেছে। দশ নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘হারানো কাকাতুয়া’র উদ্ধববাবু যখন বেসুরো গলায় গান গাইতেন, পাড়াপড়শি ত্রাহি ত্রাহি রব তুলতো। সেই সেবার বাড়িতে কাকাতুয়া আর খোকা কিডন্যাপ করতে ডাকাত পড়ল, উদ্ধববাবুর গলা আরও খোলতাই হল, গান শুনে জাফর মিঞার কানের ঝিঁঝি সেরে গেছিল!

সবই যে পুরনো কাসুন্দি, তা নয়। টাটকা জিনিসও আছে। এই যেমন, রাঘববাবুর সাথে হুলোর বাতচিতের ব্যাপারটা, ঠিক যেমন বঙ্কিমের কমলাকান্ত। হয়েছে কি, রাঘববাবুর সিক্সথ সেন্স বেজায় স্ট্রং। বিপদআপদ এলেই তাঁর বাঁ কান কেঁপে ওঠে। কলেরা, ডাকাতি, মামলা, ভুল দাবার চাল চেলে বেয়াইকে চটিয়ে দেওয়া ইত্যাদি গুরুতর বিপদের আগে তাঁর কান কেঁপেছে। সেদিন বাড়ির হুলো কইমাছ চুরি করতে এসে পড়ে গেছে রাঘববাবুর সামনে।

কিন্তু আজকের দিনটা হুলোর ছিল না। বুদ্ধিভ্রংশ না হলে সে চোরকুঠুরিতে ঢুকতে যাবেই বা কেন? একটামাত্র দরজা ছাড়া চোরকুঠুরি থেকে বেরনোর পথ নেই। হুলো সেই কুঠুরিতে ঢুকতেই রাঘববাবু তার পিছু পিছু ঢুকে দরজা সেঁটে দিয়েছিলেন। খুব ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল হুলো। রাঘববাবু তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠ্যাঙা আস্ফালন করে একটু হেসে বললেন, "এবার তোর কী হবে রে হুলো! ঘুঘু দেখেছিস, ফাঁদ দেখিসনি তো! এবার তোর জারিজুরি শেষ। ইষ্টনাম জপ রে ব্যাটা, ইষ্টনাম জপ।”

হুলো তার নিজস্ব ভাষায় যা বলল তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "কেন কর্তাবাবু, মিছিমিছি ঝামেলা করছেন? বেড়াল বলে কি আর মানুষ নই মশাই! ওই যে কতগুলো অপোগণ্ড নিষ্কর্মা দু' পেয়ে জীবকে পুষছেন, কই তাদের তো কিছু বলেন না! আমি তো তবু খেটে খাই। একটা মাছ কি একটু দুধ জোগাড় করতে কত মেহনত বলুন তো, প্রাণের ঝুঁকিও কি কম? এবারটা না হয় মাফ করে দিন।"

কথাগুলো যে রাঘববাবু একেবারেই বুঝতে পারলেন না, তা নয়। কিন্তু বুঝেও তিনি অবিচল গলায় বললেন, "তা হয় না হুলো, লোকে আমাকে কাপুরুষ বলবে।"

"মরতে যদি হয় তবে আমি বীরের মতোই মরব কর্তামশাই। তবে মরার আগে আপনাকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বেড়াল হল মা-ষষ্ঠীর বাহন। বেড়াল মারা মহাপাপ। মারলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, তার অনেক খরচ এবং ঝামেলা।"

বজ্রগম্ভীর স্বরে রাঘববাবু বললেন, "আমি কুসংস্কারে বিশ্বাসী নই রে হুলো। ওসব বলে আমাকে ভড়কে দিতে পারবি না।"

"ভাল করে ভেবে দেখুন কর্তামশাই, মাত্র দুটো কইমাছের জন্য আপনি নরকের পথ পরিষ্কার করবেন কিনা। দুটো কইমাছের দাম মাত্র দেড় টাকা। এই সামান্য টাকার জন্য মহাপাতকী হওয়া কি ভাল? মাত্র দেড় টাকায় নরকের টিকিট?”

রাঘববাবু হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "কে বলেছে দেড় টাকা? তুই কি সত্যযুগে আছিস নাকি রে হুলো? আমার হিসেবমতো ও দুটো কই মাছের দাম সাড়ে ছয় টাকার নীচে নয়।”

"কর্তামশাই, এখন জো পেয়ে যা খুশি বললেই তো হবে না। ঠিক আছে, আপনিও একটু নামুন, আমিও একটু উঠি। মাঝামাঝি একটা রফা হয়ে যাক।"

"কত?"

"সাড়ে তিন।"

"না, সাড়ে চার।"

"তা হলে চারই থাক। আর চাপাচাপি করবেন না। এখন ভেবে দেখুন বছরে যার হেসেখেলে পাঁচ-সাত লাখ টাকা আয়, যার গোয়ালে আটটা দুধেল গাই, বছরে দেড়শো মন ধান, তেজারতির রোজগারের লেখাজোখা নেই, সেই মানুষের কাছে চারটে টাকা কোনও টাকা হল কর্তামশাই? চার টাকায় যে এক পো ডালও হয় না!"

কথোপকথন চলেছে তিন পাতা জুড়ে। এরপরেই হঠাৎ রাঘববাবুর কান কাঁপে, তিনি ভাবতে বসে যান, হুলো রেহাই পায়।

বাড়ির ভূতেরাও ঠিক টের পেয়েছে ঘোর বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। কানা-কে কানা, খোঁড়া-কে বললে রাগ হয়, তেমনই ভূতেদের ‘ভূত’ বললেও তাঁরা বড় অপমানিত বোধ করেন। বলতে হবে ‘আবছা মানুষ’। বাড়ির খোকাদের ডাকাতে তুলে নিয়ে গেছে, তাই রাঘববাবুর দাদুর পিসি এসে দেখা দিয়েছেন বিজ্ঞানী হলধরকে। হলধর হলিউডি উইচদের ব্রুমস্টিক দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে উড়ুক্কু ঝ্যাঁটা বানিয়েছে। সে জিনিসে চেপে দিব্যি উড়ে বেড়ানো যায়।

"আপনি কর্তামশাইয়ের ঠাকুর্দার পিসিমা! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!"

"পায়ের ধুলো নিলি বুঝি! তা ভাল। ভক্তিছেদ্দার পাট তো আজকাল উঠেই গেছে।"

"কিন্তু ঠাকুমা, হিসেবমতো আপনার বয়স তো দেড়শো দাঁড়াচ্ছে।"

"তা হবে।”

"এতদিন যে কারও বেঁচে থাকার কথা নয়!"

"দূর বোকা! তা হলে এতক্ষণ কী শুনলি? বেঁচে আছি কে বলল?"

"তবে কি ভূত নাকি আপনি ঠাকুমা?"

"ভূত কথাটা শুনতে বিচ্ছিরি, বরং 'আবছা মানুষ' বল।"

মাথা চুলকে হলধর বলল, "এঃ! তা হলে তো মুশকিলেই পড়া গেল! সায়েন্সে তো ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না! বড্ড গণ্ডগোলে ফেলে দিলেন ঠাকুমা।"

"বলি, গণ্ডগোলের কি শেষ আছে রে? যেখানে হাত দিবি সেখানেই গণ্ডগোল। তোর সায়েন্সও থাক, আমরাও থাকি। এখন যা বাছা, লোকজন জড়ো করে বেরিয়ে পড়। বাছাগুলোকে যেখানে নিয়ে গেছে সে হল ময়নামতীর জঙ্গল। ভারী দুর্গম জায়গা। তোর ওই উড়ুক্কু কল ছাড়া যাওয়াও যাবে না।"

এরপরের ঘটনা খুবই প্রেডিক্টেবল। ঝাঁটায় চড়ে হাবু পালোয়ান, গুলবাজ গোলাপ, বিজ্ঞানী হলধর গেল খোকাদের উদ্ধার করতে। ভূতেরাও বেশ করিৎকর্মা। তারা ঘূর্ণিঝড় তুলে ডাকাতদলকে কুপোকাত করল।

তারপর আর কী? মধুরেণ সমাপয়েৎ..

“নকুল সর্দার আর আগের মতো নেই। ভারী ভালমানুষ হয়ে গেছে সে। হাবুর গা-হাত-পা টিপে দেয়। তার কাছে কুস্তির প্যাঁচও শেখে, ফাইফরমাশ খাটে। চোখের চাউনিটা একদম গরুর মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

এ-বাড়িতে এখন প্রায়ই আন্নাকালী দেব্যা, পীতাম্বরমশাই, আর পঞ্চা বিশ্বাসকে দেখা যায়। কেউ ভয় পায় না বটে, তবে আন্নাকালী দেব্যার শাসনে এখন আর অনাচার হওয়ার জো নেই। দু'বেলা গোবরছড়া গঙ্গাজল দিতে হয় বাড়িতে, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলে, শাঁখে ফুঁ।

হলধরের উড়ুক্কু ঝাঁটায় চেপে আজকাল রাঘব বিকেলে বেড়াতে বেরোন, নন্দলাল মাঝে মাঝে যজমান বাড়ি যান, রুইতন আর হরতন বন্ধুদের নিয়ে হইচই করে চড়ুইভাতি করতেও যায়।

লোকমুখে শোনা যায়, ল্যাংড়া শীতলের দল ভেঙে গেছে। শীতল সাধু হয়ে গেছে। দু-চারজন বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে মাধুকরী করে বেড়ায়, কেউ চাষবাসে মন দিয়েছে, কেউ যাত্রার দলে নাম লিখিয়েছে।”