হরিপুরের হরেক কান্ড : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বাইশতম আখ্যান

শীর্ষেন্দুর বাইশনম্বর অদ্ভুতুড়েটি আরও সরেস। আয়তনেও কিঞ্চিৎ বড়। ভূতপ্রেত না থাকুক, অদ্ভুতুড়ের আইকনিক টোন হাসি-ঠাট্টা তো আছে। আর রয়েছে ক্লাসিক হু-ডান-ইট ঘরানার ছাঁদ। তবে নামখানা লেখক দিলেন ‘হরিপুরের হরেক কান্ড’। এত জমাটি, টানটান উত্তেজনা, সাসপেন্সে ভরপুর একটা উপন্যাসের নাম এমন জেনেরিক কেন?

বারবার দেখেছি, লেখক শহরের চেয়ে গ্রামের ব্যাকগ্রাউন্ডেই অদ্ভুতুড়ে চরিত্রগুলোকে এনে ফেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁর তৈরি চোর, পুলিশ, বোকা লোক, চালাক লোক, দুষ্টু লোক, ভূতদের যেন ঝাঁ চকচকে শহুরে পরিবেশে ঠিক মানায় না। সেই সতেরো নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘সোনার মেডেল’-এ কলকাতার ব্যাকড্রপ যতক্ষণ ছিল লেখকের গল্প ছিল কেমন আড়ষ্ট, যেই না গল্পের নাও ঘুরতে ঘুরতে সুন্দরবনের গ্রামটিতে এসে ভিড়ল, লেখক হাত খুলে লিখতে শুরু করলেন। অজ পাড়াগাঁয়ের নিশুতিরাতে ঝিঁঝির ডাক, অবস্থা পড়ে আসা রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি, বাঁশবাগানের ভূতের দল, চাঁদের আলোয় চুরি করতে বেরনো চোর, গ্রামের প্রান্তে শ্মশানে বসে থাকা কাপালিক, নাটমন্দিরের বুড়োদের আড্ডা, মুদির দোকানে গুজব কারখানা, গরম জিলিপির লাইনে পকেটমারি, গ্রামের মেলা-যাত্রা-পুজো — এইসব এলিমেন্টগুলো না থাকলে যেন অদ্ভুতুড়ে গল্প ঠিকমতো জমেই ওঠে না।

এ গল্পের হরিপুর গ্রামও লেখকের অদ্ভুতুড়ে চরিত্রগুলোর জন্য যুতসই এক্কেবারে মনের মতো একটা গ্রাম। হরেক কিসিমের লোক থাকে এখানে। কি সব বৈপরীত্যে ভরা চরিত্র! জমিদার মহেন্দ্র আর রাজদ্রোহী পবনকুমারের মধ্যে তিরিশবছর আগে ছিল দুর্দান্ত রেষারেষি। দুজনেই দুজনের মাথা কেটে নিতে ভারী উৎসাহী ছিলেন। এখন রাজ্যপাট নেই। রাজদ্রোহী পবনকুমারও স্কুলমাস্টারি থেকে রিটায়ার করেছেন। দুজনে আজ সন্ধেবেলা বসে আড্ডা দেন।

 নগেন দারোগা রিটায়ার করেছেন, তাঁর চাকরিজীবনের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ শত্রু গদাই ডাকাত আজ তাঁর দাবাখেলার সঙ্গী।

অ্যালোপ্যাথ শহিদলাল, হোমিওপ্যাথ বিশু দত্ত, কবরেজ রামহরি তিনজনেই এককালে ছিলেন তিনজনের জন্মশত্রু। আজ তিনজনেই বন্ধু। শহিদলাল হোমিওপ্যাথি ওষুধ খান, রামহরি অ্যালোপ্যাথি খান, বিশ দত্তেরও কোনও কিছুতে না নেই।

এককালের শত্রু মল্লবীর নয়ন আর ব্যায়ামবীর বজ্র আজ হরিহর আত্মা, হ্যারিকেনের আলোয় শ্লেটে কাটাকুটি খেলেন।

তান্ত্রিক জটেশ্বর আর বৈষ্ণব গোপেশ্বর সাধনপথের দূরত্ব ঘুচিয়ে একসাথেই রোজ বাড়ি ফেরেন।

গল্পের শুরুতেই এই ব্যাপারখানি দেখে মনে হয়, এ গ্রাম বুঝি স্বর্গ। এখানে কোনও অশান্তি থাকতে পারে না। সুখ এ তল্লাটে উপচে পড়ছে। সেইটি বোঝানোর জন্যই এমন সুন্দর করে গ্রামটার ইন্ট্রোডাকশন দিলেন লেখক।

কিন্তু একদিন সেই সুখের স্বর্গে হল বেনিয়ম। শূলপানি রাত আটটায় হাসল না। আসলে ত্রিশবছর আগে শূলপাণি আসে এই হরিপুরে। গ্রামের শেষপ্রান্তে সরলাবুড়ির ঘরে থাকতে শুরু করে। সরলাবুড়িটিও অদ্ভুত চরিত্র। একা থাকতেন। রাত জাগতেন। আর রাতবিরেতে বেরনো রাজ্যের চোর-ছ্যাঁচোড়দের সাথে গল্প করতেন, পান্তাভাতের ট্রিট দিতেন। শূলপাণি হল ছদ্মবেশী ফেরারি আসামি, চোরাচালানের ব্যবসার জন্য হরিপুরের মতো শান্ত গ্রাম তার দরকার ছিল। আর সরলাবুড়ির দরকার ছিল এমনই একজন ভয়ডরহীন বুদ্ধিমান চোরকে। তিনি মারা যাবার সময় শূলপাণিকে নিজের বসতবাড়ি গিফ্ট দিয়ে যান। শূলপাণির একটা বাতিক ছিল। রোজ রাত আটটা বাজলেই সে অট্টহাসি হাসবে। হয়তো তার স্যাঙাতদের জন্য ওইটিই ছিল কোনও সিগন্যাল, সেইটি লেখক খোলসা করে বলেননি।

গ্রামের লোক ঘড়ি না দেখে স্রেফ শূলপাণির হাসি শুনেই বুঝে নিত আটটা বেজেছে। যেদিন শূলপাণি হাসল না, সেদিন সবাই হতবাক। হয়তো শূলপাণির অসুখ হয়েছে ভেবে গ্রামের সবাই এসে ভিড় জমালো শূলপাণির ঘরের বাইরে। গল্পের ঘটনাস্থল গ্রাম কেন, এও তার আরও একটা কারণ হিসেবে দেখা যায়। এই যে গল্পের রহস্যের সূত্রপাতের অকুস্থলে সমস্ত চরিত্রদের নিজে থেকেই এসে যাওয়া— এইটি কিন্তু শহরের ব্যাকড্রপ থাকলে হত না। গ্রামে একটু কিছু হলে সবাই সবার খবর নিতে যায়, পড়শির বিপদে আপদে সবাই দল বেঁধে এগিয়ে আসে।

গ্রামে দুটো চারটে গুজব রটেই থাকে। হরিপুরেও সবাই জানতো সরলাবুড়ির গুপ্তধন আছে। সে মরার আগে হদিশ দিয়ে গিয়েছিল শূলপাণিকে।

শূলপাণির ঘরে এসে দেখা গেল শূলপাণি গায়েব। জিনিসপত্র ছত্রখান। ঘরের তল্লাশি করে দেখা গেল একটা অদ্ভুত বিলিতি তালা লাগানো বাক্স আছে ঘরে, তাতে রয়েছে সাতটি কড়ি আর সাতটি পয়সা। এমন তুচ্ছ জিনিস কেন অত যত্নে রাখা? প্রশ্ন উঠতে না উঠতেই বাক্স গায়েব!

এইবার গল্পের গতি এগিয়েছে ঠিক যেন সিনেমার মতো। আগেই বলা হয়েছে, অন্যসব অদ্ভুতুড়ের তুলনায় এ গল্পে চরিত্রসংখ্যা অনেক বেশি। একই সাথে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলেছে নানা ঘটনা। তাই দ্রুত বদলেছে দৃশ্যপট। কে বাক্স নিল, কেন বাক্স নিল, বাক্সের মাহাত্ম্য কী— রহস্যের জাল বিছিয়ে অল্প অল্প করে খোসা ছাড়ানোর মতো একটি একটি করে ক্লু দিয়েছেন লেখক। সব চরিত্রই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদূর ঘটনা এগোনোর পর বোঝা যায় শূলপাণির কাছে যাতায়াত ছিল সবকটি চরিত্রেরই। গুপ্তধনের গুজব যা রটেছে, তা কিছুটা নয় সবটুকুই সত্যি। সন্দেহ গিয়ে পড়তে থাকে গ্রামের সবকটি মানুষের ওপরেই। বিলেতফেরত বিজ্ঞানী সুজন বোস পৈতৃক ভিটেয় বাকি জীবন কাটানোর ইচ্ছেয় ফিরে এসেছেন গ্রামে। গ্রামের এলেবেলে চোর পাগলু, জগাদের সঙ্গে তাঁর খাতির। গোলমেলে লোক নিতাই পালও তাঁর পরিচিত। অবশ্যই কয়েকটা পরিচ্ছেদের পর তিনিও আর সন্দেহের বাইরে থাকেন না। গল্প এগোনোর সাথে সাথে এই যে চমৎকার মাথা খাটাবার সুযোগ, এই ব্যাপারটি অদ্ভুতুড়ে সিরিজে প্রথমবার দেখা গেল। রহস্যগল্প এ সিরিজে শীর্ষেন্দু আগেও লেখার চেষ্টা করেছেন। ‘নৃসিংহ রহস্য’, ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’— বলাই বাহুল্য, রহস্য সেখানে তেমন দানা বাঁধেনি।

একটানা রহস্যের বেড়াজাল নেই, কমিক রিলিফও প্রচুর। জগাচোর চুরি করতে গেছে গাঁয়ে নতুন আসা জামাইয়ের ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখে খাটের তলায় অলরেডি আরেক ভিনগাঁয়ের চোর মজুত!

“তুমি যেমন রামপ্রসাদ, আমিও তেমনি জগা। তুম ভি মিলিটারি হাম ভি মিলিটারি। ভাগেকা কাহে? মাল উল সরাতে আমিও জানি।

হাঁ হ্যাঁ উ বাত তো ঠিক আছে রে জগুয়া লেকিন কুছ কানুন ভি তো আছে রে। এক ঘর মে দো চোর কভি ঘুষতা হ্যায়? আশমানমে কি দোঠো চাঁদ হোয় রে পাগল, যৌন আগে ঘুসিয়েছে সেই সব লিবে।

জগার মাথাটা একটু গরম হয়েছিল, এবার আরও এক ডিগ্রি চড়ল।

সে বলল, এঃ, আমাকে আইন শেখাতে এলেন! আইন আমিও কিন্তু কম জানি না। আমি এ গাঁয়ের চোর, আমার হক অনেক বেশি। তুমি তো বাইরের চোর গাঁয়ে ঢুকে অন্যায় করেছ।

তুকে কে বলল হামি বাহারের লোক আছি? তুহার উমর কতো রে বদমাশ? হামি বহৎ আগে ই গেরামে কত কাম কাজ করিয়েছি সো জানিস? জগাইবাবু নগেনবাবু জমিদারবাবু সব আমাকে চিনে, তু তো দো দিন কা ছোকরা।'

আমি দু দিনের ছোকরা?

না তো কি আছিস? আভি তো তুহার হাত ভি তন্দরুস্ত হোয়নি, ওইভাবে জানালা ভেঙে কেউ ঢোকে? এইসাব আওয়াজ কিয়া যে মালুম হুয়া চোর নেহি ডাকু গিরা।

এঃ আমাকে বিদ্যে শেখাচ্ছে! তা তুমি কী করে ঢুকলে?

হামি তুহার মতো থোড়াই আছি, আমি যখন কুনও বাড়িতে ঘুসব তো অ্যায়সা চুপচাপ ঘুসে যাবে যে কুত্তা ভি ডাকবে না।”

এর আগের অদ্ভুতুড়েগুলোয় এ ধরনের কথোপকথন একটানা লিখে যেতেন লেখক। কিন্তু এইবার দেখা যাচ্ছে, একটানা কথোপকথনের মাঝে ছেদ পড়ছে— ‘জগার মাথাটা একটু গরম হয়েছিল’, ‘জগা ফ্যাচ করে উঠল’— এধরনের বাক্যাংশ থাকছে। তাতে মজার কথোপকথনগুলো আরও বেশি সরস হয়ে উঠেছে।

‘‘জগাকে চেঁচাতে হল না, তাদের কথাবার্তা বে-খেয়ালে এত উঁচু গ্রামে উঠে গিয়েছিল যে জামাইবাবাজি উঠে পড়লেন ধড়মড় করে।

কে? কে রে ঘরের মধ্যে কথা কয়? অ্যাঁ! চোর নাকি? চোর নাকি হে? এ তো ভারি আস্পদা দেখছি হরিপুরের চোরদের! আমি হলুম হারু রায়, আমার ঘরে চোর ঢোকে কোন সাহসে শুনি? জানিস শ্বশুরবাড়ির গাঁ না হয়ে আমার গাঁ মল্লিকপুরে হলে এতক্ষণে তোদের থামে বেঁধে জলবিচুটি দেওয়াতাম?

রামপ্রসাদ চাপা গলায় বলল, সত্যনাস কিয়া রে জাগুয়া! হামার নাগরা জুতিজোড়া কুথা রাখিয়েছি ইয়াদে আসছে না।

ওঃ এই তো মুরোদ, চোর নিজের জুতো খুঁজে পায় না, সে আবার আমাকে চুরি শেখাতে আসেন!

বলে গদগদ হয়ে জগা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জামাইবাবুর কাঁচা ঘুমটা ভাঙাতে হল-বড় দুঃখের কথা।

পট করে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে মুখের ওপর পড়ল।

তুই কে?

আজ্ঞে আমরা পাড়া-পড়শির মধ্যেই পড়ি।”

ভিনগাঁয়ের চোর রামপ্রসাদের ভোজপুরী হিন্দি বুলি ভারী মজার। 

গল্প এগোতে এগোতে রহস্যের জট ছাড়ানোর পালা যখন আসে, তখন বোঝা যায় বাক্স আসলে সরলাবুড়িরও ছিল না। সে দূর মুলুক থেকে চোর ভাড়া করে বাক্স চুরি করিয়ে এনে রেখেছিল নিজের কাছে। বাক্সের সাতটা কড়ি মানে একজন লোক, তার নাম সাতকড়ি। সাতটা পয়সা মানে হরিপুরের কাছাকাছি একটা গ্রামের পুরনো নাম ‘সাত পয়সার হাট’। হরিপুরের জমিদার মহেন্দ্রর পূর্বপুরুষ সাতকড়ির কাছে কিছু টাকা গচ্ছিত রেখেছিলেন। তিনি রহস্য ভালোবাসতেন। তাই ইচ্ছে করে এমন একটি ধাঁধা তৈরি করেছিলেন। সাতকড়ির সঙ্গে চুক্তি ছিল, যেদিন জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী এই নিখুঁত নকশা তোলা সাতটা কড়ি আর নির্দিষ্ট সাল লেখা সাতটা পয়সা নিয়ে আসবে সেদিনই সাতকড়ি তাকে গচ্ছিত টাকা সুদে আসলে ফেরত দেবে। হিসেবমতো ও টাকার হকদার মহেন্দ্র। তবে গ্রামের লোক এত কথা জানতো না। গুপ্তধনের গুজব ভেসে বেড়াতে থাকে। কড়ি-পয়সা সুদ্ধ বাক্সখানা বারবার চুরি হতে থাকে, হাতবদল হতে থাকে।

দেখা যায়, গুপ্তধনের লোভে সবাই লোভী। এমনকি বিলেতফেরত বিজ্ঞানী সুজয় বোসও। তিনি তাঁর অর্জিত শিক্ষাদীক্ষা ভুলে যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠলেন। একে কিডন্যাপ করছেন, তাকে গুম করছেন। গল্পের শেষদিকে গুলি চালিয়ে জখমও করেছেন কয়েকজনকে।

“জগা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, "আজ্ঞে, সঠিক ওয়ারিশটা কে সেটা জানা দরকার।"

"কেন বলো তো!"

জগা বলল, "আজ্ঞে, আমরা তো দাগি চোর, আপনারা তো তা নন।

রাক্সটা নিয়ে ভদ্রলোকেরা যা করছেন তাতে বড় ঘেন্না ধরে গেল মশাই। চোরে আর ভদ্রলোকে তফাত রইল না দেখছি।"

সুজনবাবু একথা শুনে একটু হাসলেন, তারপর ঠান্ডা গলাতেই বললেন, "কথাটা একেবারে খারাপ বলোনি। বাক্সটা কার তা আমাদের ভেবে দেখা উচিত ছিল। যতদূর শুনেছি, বাক্সটা বার-বার এর-ওর কাছ থেকে চুরি হয়েছে বা চুরি করানো হয়েছে। ওয়ারিশও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তা বলা কঠিন।"

জগা অভিমানী গলায় বলে "খুঁজলে তো পাবেন! কেউ তো ভাল করে খোঁজই করল না।"

সুজনবাবু একটু থমকে গেলেও ভালমানুষের মতো বললেন, "কিন্তু এখন সেসব ভেবে লাভ নেই। এখন কাজ হল রহস্যটা ভেদ করা। এবং তা থেকে যদি কিছু টাকাকড়ি পাওয়া যায় তবে তা সৎ কাজে লাগানো।"

জগা ফস করে উঠল, "সৎ কাজটা কীরকম?"

সুজনবাবু এবারও একটু থতমত খেয়ে বললেন, "আমার একটা পরিকল্পনা হল-একটা ভাল গবেষণাগার তৈরি করা।"

"তা গাঁয়ের লোকের কী উপকার হবে সুজনবাবু?"

"গবেষণায় সকলেরই উপকার।"

"আমরা গরিব চোর-ছ্যাঁচোড় মানুষ। আমাদের কাছে পেটের চিন্তার বড় চিন্তা নেই। গবেষণা-টবেষণা আমরা বুঝি না। আমাদের অর্ধেক হিস্যা দেবেন বলেছেন তো!"

"হ্যাঁ বলেছি।"

"এখন বলুন তো বাবু আমরা এই তিনজনে যদি টাকাপয়সা বা গুপ্তধন উদ্ধার করি, তা হলে আপনাকে অর্ধেক বখরা দেব কেন? আপনি কিসের হিস্যাদার?"

টাকার লোভে চোরে আর ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ভদ্রলোকে যে মাঝেমাঝে তফাত থাকে না, তার উদাহরণ তো আমাদের সমাজের আশেপাশে একটু চোখ চালালেই নজরে আসে। জগাচোর একজন এলেবেলে চোর। চুরি করার মতো কিছু না পেলে সে খাটের তলা থেকে পাকা তেঁতুলের আচার চুরি করে নিয়ে আসে। জগার স্যাঙাত পাগলুও চোর, কিন্তু সাতকড়িকে খুনের বরাত এলে সে জগাকে সাবধান করে মানুষ খুন তাদের ধর্মে সইবে না।

“একটা শ্বাস ফেলে পাগলু বলল, "তার মানে লোকটা তোকে খুনের কাজে লাগাতে চাইছে।"

"আহা, খুনটুন বললে ভাল শোনায় না পাগলুদাদা।"

"কেমন শোনায় জানি না। কিন্তু কাজটা খুনই, শোন, তোর সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক। তোকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। কিন্তু তোর মাথায় যদি এসব পাপের চিন্তা ঢোকে তা হলে আর তোর ছায়াও মাড়াব না।"

জগা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, "তা হলে কি চিরটা কাল ছিঁচকে চোরই থেকে যাবো পাগলুদাদা? জীবনে উন্নতি করতে পারব না?"

"চোর থেকে খুনি হওয়া কি উন্নতি রে পাগল? তোর ধর্মে কী বলে?"

"ফস করে ধর্মের কথা তোলো কেন বলো তো!"

"ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে, তাই বলি, চুরিও অধর্ম কিন্তু জীবহত্যা

ওরে বাপ রে!"

"হাসালে পাগলুদাদা। জীবহত্যা যদি পাপ হবে তবে পাঁঠা কাটলে, মাছ মারলে, মশা মারলে যা পাপ মানুষ মারলেও তার বেশি পাপ হওয়ার কথা নয়।"

পাগলু কাহিল মুখে একটু হেসে বলল, "তোর বুদ্ধি খুব খুলেছে রে জগা। বেশ বলেছিস। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই। তোকে বলি, তুইও থাকিস না। মশা মারলে ফাঁসি হয় না। কিন্তু মানুষ মারলে হয়, এটা তো মানিস!"

রামপ্রসাদও চোর। কিন্তু খুনজখমের দিকে সেও নেই।

“জগা একটু উজ্জ্বল হয়ে বলে, একটা বড় কাজ হাতে আছে, বুঝলে রামপ্রসাদদাদা? কাজটা করতে পারলে নগদ বিশ হাজার টাকা।

কী কাম রে জগুয়া?

একজন বুড়ো মানুষকে খুন করতে হবে।

আরে রাম রাম! খুন উন খারাপ কাজ আছে। চোর কা ভি কুছ ধরম

হ্যায় রে বুরবক। খুন কাহে করবি?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগা বলল, করতে আমারও মন চাইছে না, বুঝলে? কিন্তু দিনু গুন্ডা কি ছাড়বে ভেবেছো? আগাম ধরিয়ে দিয়ে গেছে, কাজটা করতে না পারলে ব্যাটা আমার মুণ্ডু না নামিয়ে দেয়।

ছিয়া, ছিয়া, খুন খারাবি কি কোই মরদকা কাম আছে রে?

কী করব বলো তো! দিনু ব্যাটা কবে এসে হাজির হয় তার ঠিক নেই।

তু হিয়াঁসে ভাগ যা জগুয়া।”

এই গরিব গেঁয়ো অশিক্ষিত চোরদের মধ্যেও ‘ইমান’ ‘ধরম’ বোধজ্ঞানগুলো রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষিত সুজনবাবুর ছিল না।

এবারের গল্পে ক্লাইম্যাক্সে তাড়াহুড়ো লাগাননি লেখক। টানটান উত্তেজনা গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জিইয়ে রেখেছিলেন। এত কম আয়তনের মধ্যে এমন সুন্দর নিটোল রহস্যগল্প, অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এ এক আশ্চর্য মাইলস্টোন। গল্পে এমন অনেক সিনেম্যাটিক উপাদান মজুত আছে, ভবিষ্যতে চিত্র পরিচালকেরা যদি এ গল্প অবলম্বনে সিনেমা তৈরি করেন, সেটিও নিঃসন্দেহে বড়ই উপভোগ্য হবে।

গল্পের শেষে অবশ্য গুপ্তধনের সাতলক্ষ টাকা যোগ্য উত্তরাধিকারী মহেন্দ্রর হাতেই আসে।

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২১ - পাতালঘর -আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২২ - হরিপুরের হরেক কাণ্ড -আলোচনার লিংক