নৃসিংহ রহস্য : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের চতুর্থ আখ্যান

— ‘‘আচ্ছা, আলোকবর্ষ কথাটার মানে কী বলুন তো।” — ‘‘আমাদের আমলে সায়েন্সে রবিঠাকুর পাঠ্য ছিল না।’

— “এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসছে কোত্থেকে? আলোকবর্ষ কথাটার মানে জানতে চাইছি।”

— ‘‘ডিকশনারিটা দেখলে হয়। তবে মনে হচ্ছে যে বছরটায় বেশ আলো-টালো হয় আর কি, আই মিন গুড ইয়ার।” 

— “আলোর গতি নাকি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল.. ’’

— “আমাদের আমলে বিরাশি ছিল। এখন তাহলে বেড়েছে।”

— “তা বাড়তেই পারে। চাল-ডালের দাম বাড়ছে, মানুষের নির্বুদ্ধিতা বাড়ছে, আলোর গতি বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের চারনম্বর উপন্যাস ‘নৃসিংহ রহস্য’ এমনই সব মজার কথোপকথনে ভরা। এ উপন্যাসে ভূত না থাকলেও আছে অদ্ভুত এক রহস্য। সক্কাল সক্কাল গোটা এলাকায় হুলুস্থুল, পাড়ার গয়েশবাবু নাকি খুন হয়েছেন! ছেলে থেকে বুড়ো, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির খবরে উৎসাহ সব্বার! রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে সকলের আগে খবরটা ফাঁস করবে! চতুর্দিকে রটে গেল, গয়েশবাবুর লাশ ভাসছে নদীতে, মুন্ডু ঝুলছে সতুবাবুদের পোড়োবাড়ির পেছনের শিমুলগাছে। রামরিখ গোয়ালার মতে, ও গাছে নাকি আগে থেকেই দুজন ভূত থাকে, যারা রোজ রামরিখের দুটো গরু আর একটা মোষের দুধ খেয়ে যায়। তাই জন্যই বেচারা রামরিখকে দুধে জল মেশাতে হয়। এখন গয়েশবাবু জুটতে ভূতের সংখ্যা হল তিন। সুতরাং, এবার থেকে দুধে জল আরও বাড়বে! এ গল্পে স্যাটায়ারের ব্যবহার যাচ্ছেতাই রকমের ভালো— ‘সান্টুর মা কুমুদিনী দেবী দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে দেখলেন, দুধে আজ জলটা কিছু বেশিই। গয়েশবাবুর ভূত এখনও দুধ খেতে শুরু করেনি বোধহয়। কিন্তু রামরিখ আগাম সাবধান হচ্ছে।”

অ্যাসটেরিক্স কমিকসের সেই চারণকবি কলরবিক্সকে মনে আছে তো? যে মুখ খুললেই লোকে ত্রাহি ত্রাহি রব তোলে! তার গান তো গান নয়, সে মেশিন‘গান’। তেমনই একজন চরিত্র ঢুকে পড়েছে শীর্ষেন্দুর এই উপন্যাসে, কবি সদানন্দ মহলানবিশ। সে দেখতে মোটেই ‘কবি-কবি এই গরু সরে দাঁড়াবি’ টাইপ নয়। রীতিমতো কুস্তি-পালোয়ানি করা ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা। তার কবিতা কেউ ছাপে না। কেউ পড়ে না। তাই সদানন্দ লোক দেখলেই জোর করে ধরেবেঁধে কবিতা শুনিয়ে দেয়। আর তার কবিতাও আরেক জিনিস! সদানন্দ অত পড়াশোনা করা মানুষ নয়। ‘আলোকবর্ষ’ শব্দটা ভাল্লেগেছে, মানে-টানে না বুঝেই দিয়েছে গুঁজে কবিতার লাইনে— ‘শত আলোকবর্ষ পরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল হে বিধাতা’! শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এমন সব বাঁধিয়ে রাখার মতো মানুষজনের কমতি নেই। ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসে একজন স্বঘোষিত বিজ্ঞানী আছেন, যিনি না বুঝে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যা সব জিনিসপাতি আবিষ্কার করেন, সেইগুলোর কার্যকারিতা বোঝার জন্য আরও একদল বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হয়। তেমনই এই কবি সদানন্দ মহলানবিশ, তার কবিতার মানে বুঝতে হলে নতুন করে ব্যাকরণ বই লিখতে হবে। আশেপাশে চোখ ঘোরালেই এমন কত স্বঘোষিত কবি-চিত্রকরদের নজরে পড়বে! তাঁরা যে মিলের পর মিল বসিয়ে কি মাথামুন্ডু ছড়া লেখেন, আনাড়ি হাতে তুলি চালিয়ে কি যে কাগের ঠ্যাং-বগের ঠ্যাং-ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র আঁকেন, তা শুধু তাঁরাই জানেন। অবশ্য মর্ডার্ন আর্টের কদর কি আর সবাই বোঝে?

গল্পের শুরু হয়েছিল গয়েশবাবুর ধড় আর মুন্ডু দিয়ে। গল্পের মাঝপথে এসে দেখা গেল নদীতে ভাসতে থাকা গয়েশবাবুর ধড় আসলে কলাগাছের গুঁড়ি। আর শিমুলগাছে ঝুলতে থাকা মুন্ডুখানা হল একটি নিটোল মৌচাক। তাহলে গয়েশবাবুটি গেলেন কোথায়? এইবার দ্রুতবেগে নানা গুজব ছড়াতে শুরু করল। কেউ বলে গয়েশবাবুর একটি লেজ আছে, তিনি মিসিং লিংক, সেইজন্যই তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। কেউ বলে, গয়েশবাবুকে নাকি কারা পাঞ্জাব থেকে ধাওয়া করেছিল। গয়েশবাবু নাকি বেমক্কা এটাসেটা বলে দেন। যেমন, পুজোর সময় ঠাকুরের গয়না গেল খোয়া। গয়েশবাবু ঢাকিকে বললেন ‘ঢাকেই যত ঢাকগুড়গুড়’, ঢুলিকে বললেন ‘ঢোলের মধ্যেই গোল হে’। সে দুজনের মুখ গোমড়া হয়ে গেল আর কিছুক্ষণ পরেই গয়না ফিরে এল যথাস্থানে! মোটকথা, গয়েশবাবুটি অত্যন্ত রহস্যময় চরিত্র। রহস্য আরও ঘনীভূত হল যখন পুলিশের কাছে পল্টু বলল, সে একজন নয়, একজোড়া গয়েশবাবুকে হাওয়ায় ভেসে যেতে দেখেছে!

শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে সব দারোগাই অদ্ভুত কিসিমের। এ গল্পের দারোগা বজ্রাঙ্গ বোস-ও ব্যতিক্রম নন। তিনি আরশোলা দেখলে মুচ্ছো যান, ভূতের নাম শুনলে হার্টঅ্যাটাক হব হব করে। এমন ‘সাহসী’ পুলিশ এসেছে খুনের তদন্তে। তবে তা এখন আর খুনের তদন্ত নয়, স্রেফ নিরুদ্দেশের— এতেই তাঁর কিঞ্চিৎ স্বস্তি। অবশ্য মুখে হম্বিতম্বি করতে ভোলেন না। একে ওকে ধমকে উর্দির গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টায় তাঁর খামতি নেই। ‘‘বজ্রাঙ্গ কটমট করে লোকগুলোর দিকে চেয়ে বললেন, ‘নিরুদ্দেশ হলেই হল? দেশে আইন নেই? সরকার নেই? যে যার খুশিমতো খবরবার্তা না দিয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেই হল? এই আপনাদের বলে দিচ্ছি, এরপর থানায় ইনফরমেশন না দিয়ে কারও নিরুদ্দেশ হওয়া চলবে না। বুঝেছেন?’’ এ সময়ে দাঁড়িয়ে কথার সুরটা বড় চেনা চেনা লাগে না? এমন সিরিয়াস মুখ করে বোকা বোকা মন্তব্য করা মানুষজনেরাই তো আজকের দিনের মিম মেটেরিয়াল।

পল্টু কলকাতার ছেলে, বেশ চালাকচতুর। আসলে নিরুদ্দেশ হবার আগে গয়েশবাবু তার কাছে কাগজে মোড়া ভারী একখানা প্যাকেজ গচ্ছিত রেখে যান। পল্টু জানে, গয়েশবাবুর ভারী বিপদ। তাই পুলিশকে ভুলপথে চালিয়ে সে গয়েশবাবুকে বিপদ সামলে ওঠার সুযোগ দিতে চেয়েছিল। গেঁয়ো পুলিশকে জব্বর বোকা বানিয়েছে, এই ভেবে গর্বে বুক ফুলিয়ে সে হেসে আসতে গেল গয়েশবাবুর বাড়ির পেছনে জলার দিকে। সেখানে ঘন হোগলার বন। বরফের মতো ঠান্ডা জল। অগুনতি জোঁক। পল্টু সেখানে পথ হারিয়ে ফেলল। এমন সময় ডিঙি চড়ে এল একজন লোক, মুখে তার সিংহের মুখোশ। পল্টুর জারিজুরি ততক্ষণে শেষ, সে ভূতের ভয়ে আর ঠান্ডায় কেঁপেঝেঁপেই একশা। এই নৃসিংহ তাকে করে ফেলল কিডন্যাপ। ফেলে এল জলার মধ্যে একটা নির্জন দ্বীপে।

ওদিকে পাড়ায় এরমধ্যেই রটে গেছে পল্টুকে নাকি একপাল পরী এসে ধরে নিয়ে গেছে। সান্টুর বাবা সুমন্তবাবুর ভেতর একটি ছুপা শার্লক হোমস বাস করে। যেই না সুমন্তবাবু শুনলেন পল্টুর নিখোঁজ হওয়ার খবর, তিনি পায়ে গামবুট আর মাথায় টোকলা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ক্লু খুঁজতে। সবাই এর মধ্যেই জেনে ফেলেছে, জলার ধার থেকে পল্টুকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ বজ্রাঙ্গ বোস চেয়ার পেতে বসে পড়েছেন। জলার সামনে পাড়াসুদ্ধু লোক ঝেঁটিয়ে চলে এসেছে। সবাই শার্লক হোমস, সবাই ফেলুদা। এত লোকের জমায়েত যেখানে, সেখানে ফুচকাওলা তো আসবেই! ফুচকা আছে, চিনেবাদামওলা আছে, হরিদাসের বুলবুলভাজাও বিক্রি হচ্ছে। বেশ একখানা মেলা মেলা ব্যাপার।

এই ফাঁকে সুমন্তবাবু সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লেন গয়েশবাবুর বাড়িতে ক্লু খুঁজতে। পেয়ে গেলেন তাঁর ছোটবেলায় পড়া ‘গুপ্তহিরা রহস্য’ সিরিজের পরের পার্ট। গোয়েন্দাগিরি চুলোয় দিয়ে তিনি রহস্যগল্পে বুঁদ হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আরও একজন লোক ঢুকেছে সেই বাড়িতে। তিনি কলেজের অধ্যাপক মৃদঙ্গবাবু। মৃদঙ্গবাবুর ধারণা, গয়েশবাবুর একটি লেজ আছে, তিনিই মিসিং লিংক। তাঁর লেজ সর্বসমক্ষে আনবেন মৃদঙ্গবাবু আর টুকুস করে নোবেল প্রাইজটি এসে যাবে হাতের মুঠোয়। দুই ক্লু সন্ধানীর মোলাকাতটা সুখের হল না, এর ওপর হঠাৎ এসে হাজির বজ্রাঙ্গ দারোগা। এরপর দুজনকেই তিনি করলেন ধাওয়া।

ঠিক এর পর থেকেই গল্পটা কেমন যেন ভজকট পাকিয়ে গেছে। এতক্ষণে বেশ বোঝা গেছে এ গল্পে ভূত নেই, আছে রহস্য। রহস্যগল্পের নিয়মমতো দ্রুতগতিতে এগিয়েছে কাহিনি। কিন্তু এলোমেলো কিছু আলগা সুতো যে পড়ে রইল, সেইটি বোধহয় ঠাহর করে দেখেননি লেখক। পুলিশ তাড়া করেছিল সুমন্তবাবু ও মৃদঙ্গবাবু দুজনকেই। এঁদের মধ্যে মৃদঙ্গবাবু প্রথমে ধরা পড়লেন নৃসিংহের হাতে। সেই নৃসিংহ তাঁকে অজ্ঞান করে পকেট থেকে একটা কিছু হাতিয়ে নেয়। সেইটা কী, তা কিন্তু পরে আর বলা হয়নি। ওই পকেটের বস্তুটি মৃদঙ্গবাবু গয়েশবাবুর বাড়ি থেকে চুরি করেছিলেন। কিন্তু গল্পে সে উল্লেখ কোথাও নেই। এরপর মৃদঙ্গবাবুকে ফেলে রেখেই নৃসিংহ চড়াও হয় সুমন্তবাবুর ওপর। তাঁকেও সে ফেলে রেখে আসে নির্জন দ্বীপে। গল্প আরও ঘোরালো হয়। পল্টু যে দ্বীপে আছে, সেখানে থাকে কাঠুরিয়া। সে পুলিশগোছের কেউ একজন। স্মাগলার গয়েশবাবুকে ধরার ফাঁদ পেতে বসে আছে। তার সঙ্গী হল বিনয়, যে সিংহের মুখোশ পরে ঘোরে। একই মুখোশ গয়েশবাবুও পরেছেন এদের চোখে ধুলো দিতে। তিনি জলার পথ ধরেই এটা সেটা স্মাগল করে থাকেন। বিজাপুরের বিষ্ণুমূর্তি গচ্ছিত রেখে আসেন পল্টুর কাছে (কে জানে, কেন!), নিজেই নিজের খুনের গুজব রটিয়ে লোকজনকে পাঠালেন জলার ধারে। তারপর নৃসিংহ সেজে পল্টুকে গুম করলেন কখন, তার বাড়ি থেকে মূর্তিই বা কখন সরালেন, একইসাথে মৃদঙ্গ সুমন্তদের ধাওয়া করলেন কীভাবে— সময়ের সমস্ত হিসেব ঘেঁটে ঘ! আর আন্তর্জাতিক মানের দুই অফিসার বাড়তি টিম ছাড়া জলার দ্বীপে বসে আছে কখন স্মাগলার গয়েশবাবু যাবেন, তাঁকে ধরার জন্য! এও কি সম্ভব? আবার নিজেদের পিঠ বাঁচাতে কাজের গুরুদায়িত্ব সঁপে দিচ্ছেন বাচ্চা ছেলে পল্টু আর আনাড়ির একশেষ সুমন্তবাবুর হাতে! নাহ্, এর চেয়ে গল্পে ভূতপ্রেত এলেই জমত ভালো। রহস্যগল্প হিসেবে শীর্ষেন্দুর ‘নৃসিংহ রহস্য’ মোটেই পাতে দেওয়ার যুগ্যি নয়। রহস্যগল্পে থাকবে ডগা থেকে মুড়ো রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, বুদ্ধির প্যাঁচ। প্রতিটি ক্লু থাকবে চোখের সামনেই অথচ পাঠক ধরেও ধরতে পারবে না। থাকবে রেড হেরিং, মানে আসল অপরাধীকে ছেড়ে এক্কেবারে ভুল লোকটিকেই অপরাধী ধরে বসে পাঠক নিজের মনে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাবে। শেষমেশ যখন আসল অপরাধীর মুখোশ খুলবে, তখন পাঠকের একগাল মাছি! আরেহ্, তাই তো, এই লোকটাই তো নাটের গুরু, একদম বুঝতে পারিনি তো! আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত্তো আলটপকা ক্লু ছড়িয়ে ছিল, সব দিব্যি গুটিয়ে এনে ধরে ধরে এক্সপ্লেন করা থাকবে। এ সবের কিচ্ছুটি নেই ‘নৃসিংহ রহস্য’ গল্পে। ভরপুর মজাটাই এই অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ইউএসপি। প্রচুর কমিক রিলিফ থাকে। দারোগাবাবুরা সব সাক্ষাৎ কার্টুন ক্যারেক্টার। গুচ্ছ গুচ্ছ আধক্ষ্যাপা মানুষজন থাকে। আর হাসিমজার মাঝেই লুকিয়ে থাকে এক মনকেমনিয়া সুর, যে সুরের টানে দশকের পর দশক পেরিয়ে যায় অথচ গল্পগুলো পুরনো হয় না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ গল্প কিঞ্চিৎ এলেবেলে-ই।