সাধুবাবার লাঠি - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের একত্রিশতম আখ্যান

অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলোয় এমন অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসপাতি দেখা গেছে, বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ঘড়ি, আংটি, কবচ, বাঁশি, লাঠি— নেহাতই আটপৌরে তুচ্ছ জিনিসগুলো হঠাৎই হয়ে বসে দামী কিছু, যাদের ঘিরে রহস্য দানা বাঁধে, একপাল দুষ্টু লোক তাদের কবজা করতে উঠেপড়ে লাগে, শেষমেশ দুষ্টু লোকদের হারিয়ে সেগুলো ভালো লোকদের হাতেই গিয়ে পড়ে। ৩১ নম্বর অদ্ভুতুড়েতে একটা সাধারণ লম্বা পাকা বাঁশের লাঠিকে ঘিরেই গল্প বুনেছেন শীর্ষেন্দু।

নবীন, মোটামুটিরকম বড়লোকের ছেলে। তার পরিবারের ধান, চাল, গম, আলুর চালান দেওয়ার ব্যবসা আছে। নবীন তার গ্রাম হরিপুর থেকে এসেছে মহাজনের কাছে তার পাওনা টাকা আদায় করতে। মহাজনটি হলেন হরিবোলজ্যাঠা। এমন অদ্ভুত মজার নাম দেখে একবারটি মনে হয়েছিল, নির্ঘাত লেখক এঁকে নিয়ে দুটি চারটি মজারু কথা বলবেন, তবে সে আশায় গুড়ে বালি। হরিবোল জ্যাঠা তেমন রগুড়ে মানুষ নন। অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এর আগে যত মহাজনদের দেখা মিলেছে, সকলেই হাড় বজ্জাত, সুদখোর, লোভী, খুনজখম করতেও তাদের হাতটি কাঁপে না। হরিবোলজ্যাঠা সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম।

হরিবোল জ্যাঠার কাছে একবার একজন হিমালয়-ফেরত সাধু এসেছিলেন। সাধুর পায়ে ঘা হয়েছিল। কবরেজ ডেকে অসুস্থ সাধুটিকে সারিয়ে তোলেন হরিবোলজ্যাঠা। সাধু চলে যাওয়ার আগে নিজের লাঠিটি উপহার দিয়ে যান হরিবোলজ্যাঠাকে।

নবীন একলাটি ফিরবে হরিপুর। পথে পড়বে কুখ্যাত ভুরফুনের মাঠ। হরিবোলজ্যাঠা তাকে দিলেন সাধুবাবার লাঠি। যদিও আজকাল গেঁয়ো ডাকাতরাও বন্দুক-পিস্তল ছাড়া কথাটি কয় না, তবু হাতে যা-হোক কিছু একটা থাকলে কিঞ্চিৎ বলভরসা আসে, এই ভেবে নবীন লাঠিটি সঙ্গে নিল।

এরপর আবার সেই পুরনো ট্রিক। লেখকমশাই সুস্বাদু শিঙাড়া-জিলিপির দোকানে এনে ফেললেন নবীনকে। পাঠক পেটুক হোক না হোক, শীতের বিকেলে ফুলকপি আলু কিশমিশে ভরা শিঙারা আর সাড়ে সাতপ্যাঁচের গরম জিলিপির কথা স্রেফ ভাবলেই যে জিভে জল চলে আসে। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, মনের সঙ্গে জিভের বন্ধুত্বটি খুব পাকাপোক্ত। গল্পে চেনা সুস্বাদু খাবারদাবারের উল্লেখ পেলে মনের অবচেতনে সেই খাবারগুলিকে ঘিরে হাজারো স্মৃতি ভিড় জমায়। তাই নিজেদের অজান্তেই আমরা গল্পে আরও বেশি করে ঢুকে পড়ি, একাত্ম হয়ে যাই গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে।

ভেলুর তেলেভাজার দোকানে নবীন যখন শিঙারা জিলিপি খেতে ব্যস্ত, তখন তার সাথে যেচে আলাপ করল একজন লোক। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গল্প এগোলে যে লোকগুলোকে মহা বদ বলে চেনা যাবে, তাদের সম্পর্কে যে ধরনের বিশেষণগুলো লেখক ব্যবহার করেন, তা খুব একটা সম্মানজনক না। এই যেমন, যেচে আলাপ করতে আসা লোকটি। একে লেখক বলছেন, ‘ঢ্যাঙা’, ‘রোগা সুড়ুঙ্গে চেহারা’, ‘খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা’। ও হল নিমাই। চোর ডাকাত খুনে ছিনতাইবাজদের শিকার পাইয়ে দিয়ে কমিশন নেয়। গল্পে গল্পে সে নবীনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেতে চায় ভুরফুনের মাঠে, সেখানে পুরনো কেল্লার ভেতর লুকিয়ে আছে ডাকাত দল।

“ঢ্যাঙা লোকটা একটা কচুরিতে কামড় দিয়ে বলল, "সনাতন ওস্তাদের নাম শুনেছ?"

নবীন নির্বিকার মুখে বলল, "আজ্ঞে না।"

"সেকী হে! লাঠিবাজি করো আর ওস্তাদ সনাতনের নাম জানো না?"

"তিনি কে বটেন?"

আলুর ঝোল সাপটানো কচুরিটা মুখে পুরে কাঁধের গামছায় হাত পুঁছে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে লোকটা বলল, "নমস্য ব্যক্তি হে, নমস্য ব্যক্তি। আমিও কিছুদিন তাঁর শাগরেদি করেছিলুম। তা পেটের ধান্দায় বেরিয়ে পড়তে হল বলে বিদ্যেটা শেখাই হল না। বলি পটাশপুরের নাম জানা আছে?"

শিঙাড়া চিবোতে-চিবোতে আরামে নিমীলিত চোখে চেয়ে নবীন বলল, "আজ্ঞে না।"

"ভূগোলে তো দেখছি তুমি খুবই কাঁচা হে।"

"আজ্ঞে, বেজায় কাঁচা।"

"এখান থেকে যদি পুবমুখো রাস্তাটা ধরো তা হলে মাইলপাঁচেক গেলে বিষ্টুপুর গাঁ। সেখান থেকে বাঁ হাতে যে রাস্তাটা গড়সীতারামপুর গেছে সেটা ধরে ক্রোশ দুই গেলে শ্মশানেশ্বরী কালীমন্দির। ভারী জাগ্রত দেবী, একসময়ে নরবলি হত। সেখান থেকে ডানহাতি কাঁচা রাস্তা ধরে আরও ক্রোশ দুই গেলে বাতাসপুর। বলি বাতাসপুরের নাম শুনেছ?"

"কস্মিনকালেও না।"

"সেখানকার যজ্ঞেশ্বরের মন্দিরের লাগোয়া পুকুরে পাঁচশো হাজার বছর বয়সি ইয়া বড় বড় কাছিম গিজগিজ করছে। এক-দেড় মন ওজন, বাতাসপুরের গুড়ের বাতাসা বিখ্যাত জিনিস, আড়ে-দিঘে এক বিঘত করে, ওজনদার জিনিস।"

"কথাটা হচ্ছিল পটাশপুর নিয়ে।"

"আহা বাতাসপুরে পৌঁছোলে, আর পটাশপুর তো এসেই গেল প্রায়।"

"পৌঁছে গেছি! বাঃ।"

"না হে, পৌঁছোওনি। ওখানে একটি বাধক আছে। বাতাসপুরের ধারেই একটা পাজি নদী আছে। ধলেশ্বরী। চোত-বোশেখে তেমন তেজি নয়, কিন্তু জষ্টি থেকে মাঘ-ফাল্গুন অবধি একেবারে ভৈরবী। খেয়া পার হওয়াই কঠিন। তা ধলেশ্বরী পেরোলেই নয়াগঞ্জ। দিব্যি জায়গা। রোজ বাজার বসে, বুধবারে হাট, পয়সাওলা লোকের অভাব নেই। নয়াগঞ্জের বেগুন খেয়েছ কখনও? মনে হবে বেগুন তো নয়, মাখন। লোকে বলেও তাই, মাখনি বেগুন।"

"তা বেগুনের পরেই কি পটাশপুর?"

"আরে, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? চারদিক দেখতে-দেখতে চাখতে-চাখতে যাওয়াই তো ভাল। নয়াগঞ্জে আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি যে হে। বিশাল তেলের কারবার। মাস গেলে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার। পেল্লায় দোতলা বাড়ি, সঙ্গে আমবাগান। সেখানে দু'দিন বডি ফেলে দিলে দিব্যি তাজা লাগবে। যত্নআত্তি করে খুব। দু'বেলা গরম ভাতে ঘি, শেষপাতে ঘন দুধ আর মর্তমান কলা বাঁধা। নয়াগঞ্জ থেকে ভোর-ভোর বেরিয়ে পড়লে দুপুর নাগাদ দুধসাগরে পৌঁছে যাবে। দুধসাগরের রাজবাড়ি তো দ্যাখোনি! দেখার মতোই বাড়ি। সাত-সাতটা মহাল। তবে এখন সবই ভগ্নদশা। বুড়ো রাজা এখনও বেঁচে আছেন। মাথায় একটু গণ্ডগোল, সারাদিন বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান আর বিড়বিড় করেন। ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকফোকর দিয়ে রাজ্যের গোরু-ছাগল ঢুকে রাজবাড়ির বাগানে ঘাস খায়।"

"তা হলে পটাশপুরে আর পৌঁছোনো হল না আজ! আমাকে

উঠতে হবে মশাই, একটু তাড়া আছে।"

"আহা, পটাশপুর তো এসেই গেছে হে। দুপুরটা দুধসাগরে জিরিয়ে নাও, তারপর পড়ন্তবেলায় যদি হাঁটা ধরো তা হলে পদ্মপুকুরে পৌঁছোতে সন্ধে। রাতটা জিরেন নাও। পদ্মপুকুর বিরাট গঞ্জ জায়গা। আগরওয়ালাদের ধর্মশালায় দিব্যি ব্যবস্থা। তিন টাকায় শতরঞ্চি আর কম্বল পাওয়া যাবে, সঙ্গে খাটিয়া। রাতে তিনটি টাকা ট্যাঁক থেকে খসালে তেওয়ারির হোটেলে চারখানা ঘি মাখানো গরম রুটি আর ঘ্যাঁট পাওয়া যাবে। আর একখানা আধুলি যদি খসাও তা হলে ঘন অড়হরের ডাল। আর চাই কী? তারপর ঘুমখানা যা হবে না, একশো ছারপোকার কামড়ও টের পাবে না।"

"আচ্ছা আচ্ছা মশাই, বাকিটা পরেরবার শুনব'খন। আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে।"

"ওরে বাপু, আমিও কি এই অখদ্দে মাধবগঞ্জে পড়ে থাকব নাকি? আমাকে তো উঠতে হবে হে। এখনও তো দেড়খানা জিলিপি তোমার পাতে পড়ে আছে। ওটুকু খেতে-খেতেই আমার কথা ফুরিয়ে যাবে। পদ্মপুকুরের কথা যা বলছিলাম, ওখান থেকে সকালে বেরিয়ে পড়লে পটাশপুর আর কতদূর? মাঝখানে শুধু দোহাটা আর মুগবেড়ে। দোহাটার কথা না হয় আজ থাক। তবে মুগবেড়ে কিন্তু খুব ভূতুড়ে জায়গা। চারদিকে বাঁশবন আর একশো-দেড়শো বছরের বট-অশ্বত্থ গাছ। দিনের বেলাতেও গা-ছমছম করে। মেলা তান্ত্রিক আর যোগী পুরুষের বাস। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না তাদের যদি একবার টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারো, তা হলে দেখবে 'রাম রাম' করে পালাবার পথ পাবে না। সন্ধের পর তো ভূতের একেবারে মোচ্ছব লেগে যায়। চারদিকে ভাম-ভাম গন্ধ, চিমসে গন্ধ, প্রাণ জল করা হি-হি হাসি, খোনা সুরের ফিসফাস। বাপ রে, হাজারে বিজারে অশরীরী।"

"আমার জিলিপি কিন্তু আর আধখানা আছে।"

"ওতেই হবে। একটু চিবিয়ে খাও। মুগবেড়েতে রাতে থাকার সুবিধে নেই, দরকারও নেই। বরং একটু জোর পায়ে হেঁটে জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে এক ক্রোশ দক্ষিণে ছোট পিশুনিয়া গ্রামে দিঘির ধারে গোবিন্দর তেলেভাজার দোকানে বসে একপেট মুড়ি-বেগুনি সাঁটিয়ে নাও। ঘুগনিটাও বড্ড ভাল বানায়। ছোট পিশুনিয়ায় যা খাবে নির্ভয়ে খেতে পারো। শুধু খাওয়ার পর একঘটি জল খেয়ে নিয়ো, ঘণ্টাটাক বাদে পেট খিদের চোটে হাঁচোড়পাঁচোড় করবে।"

"এই যে, জিলিপির শেষ টুকরোটা মুখে দিলাম কিন্তু।"

"আহা, গিলে তো খাবে না হে বাপু। চিবোতে একটু সময় তো লাগবে। তারিয়ে-তারিয়ে খাও। বলছিলুম ছোট পিশুনিয়া থেকে চারদিকে চারটে পথ গেছে। পশ্চিমের পথ ধরে নাক বরাবর দু'ক্রোশ গিয়ে লতাবেড়ের জঙ্গল। ঘাবড়িয়ো না, আজকাল আর বাঘ-ভালুক নেই। কয়েকটা শেয়াল আর এক-আধটা নেকড়ে থাকতে পারে। নির্ভয়ে ঢুকে যাও জঙ্গলে। ঘণ্টাদুই হেঁটে জঙ্গল থেকে বেরিয়েই দেখবে পটাশপুর তোমার জন্য কোল পেতে বসে আছে।"

"যাক বাবা, পৌঁছোনো গেল তা হলে।"

"সবুরে মেওয়া ফলে হে বাপু। এই যে পথটা চিনিয়ে দিলুম, এখন চোখ বুজেও যেতে পারবে।"

"চেষ্টা করে দেখব'খন। তা হলে আজ আসি।"

"ওরে বাপু, এত কষ্ট করে পটাশপুরে যে পৌঁছোলে তাতে লাভটা কী হল সেটা তো জানা থাকা চাই।"

"লাভ-লোকসান ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথা ঘুরছে।"

"ওহে বাপু, ওখানেই তো সনাতন ওস্তাদের বাস।"

নবীন অবাক হয়ে বলল, "সনাতন ওস্তাদ! সে আবার কে?"

"তুমি দেখছি বড্ড আহাম্মক হে! সনাতন লেঠেলের কথাতেই তো

পটাশপুরের কথা উঠল।"

"তা বটে। কিন্তু কথাটা উঠছে কেন?"

"উঠবে না! যেখানেই লাঠি সেখানেই সনাতন ওস্তাদের কথা। ভূ-ভারতে ওরকম লাঠিয়াল পাবে না। যদি লাঠিবাজিই করতে চাও তবে একবার পটাশপুরে গিয়ে সনাতন ওস্তাদের আখড়ায় তালিম নিয়ে এসো। লাঠি কীভাবে ধরতে হয়, সেটা শিখতেই ছ'মাস লাগে। লাঠি দেখতে নিরীহ ঠ্যাঙা, কিন্তু ওনার হাতে পড়লে বন্দুকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। তাই বলছিলুম - 

নবীন উঠে পড়ল। বলল, "কে বলেছে মশাই, যে আমি লাঠিখেলা শিখতে চাই? আমার পটাশপুরে যাওয়ারও ইচ্ছে নেই, সনাতন ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়ারও দরকার নেই। ঝুঠমুট আমার খানিকটা সময় নষ্ট করলেন।"

এই যে এত্ত লম্বা একটা কথোপকথন, এই জিনিসটি হল ‘Tall Talk’ technique— গল্প বলার একটি রীতি যেখানে ইচ্ছাকৃত অতিশয়োক্তি, বাড়িয়ে বলা বা কোনও অবিশ্বাস্য দাবি করা হয় হাস্যরস বা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। এই ধরনের গল্পগুলো সাধারণত এমনভাবে সিরিয়াস মুখে বলা হয় যেন তা একেবারে সত্যি, অথচ গল্পের ঘটনা এতটাই বাড়াবাড়ি রকমের অবাস্তব, যে শুনলেই মজা লাগে। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এই বিশেষ টেকনিকটির ব্যবহার বারেবারে দেখা গেছে।

শেষমেশ নবীনের সঙ্গে নিমাইয়ের ডিল হল, নিমাই তাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। বিনিময়ে তার চাই ফুলকপির পোরের ভাজা, কড়াইশুঁটি দিয়ে সোনামুগের ডাল, গরম ভাতে ঘি কাঁচালঙ্কা, রুইমাছের কালিয়া। এ যেন জোর জবরদস্তি নেমন্তন্ন আদায় করে নেওয়া।

এবার গল্পের অন্য দুই বিশেষ চরিত্র আসে। জগাই মাধাই। তারা দু’জন দুজনের প্রাণের বন্ধু। বড্ড গরিব। একটু বোকা। সরল সাদাসিধে ভালোমানুষ। এত বেশি ভালোমানুষ বলেই মাঝেমাঝে ভাগ্য তাদের ওপর বিরূপ হয়ে ওঠে। দুজনে মিলে তেলেভাজার দোকান খুলেছিল, অল্পদিনেই দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। তোলাবাজ পানু দলবল নিয়ে রোজ এসে ফ্রি-তে তেলেভাজা খেয়ে খেয়ে ব্যবসা লাটে তুলে দিল। এরপর তারা খুলল মনিহারি দোকান। পানু ততদিনে বুঝে গেছে জগাই মাধাই বোকার হদ্দ। সে আবার তার সাঙ্গোপাঙ্গো এনে দোকান থেকে ফ্রি-তে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে চলে গেল। দোকান উঠে গেল, জগাই মাধাই পথে বসল।

গঞ্জের ফাঁকা হাটের চালার নীচে বসে দুজনে মিলে দুঃখটি ভাগ করে নিচ্ছিল। সেইসময় শোনা গেল কন্ঠস্বর। তাকে দেখা যায় না, স্রেফ শোনা যায়। সে ভূত কিনা লেখক স্পষ্ট করে বলে দেননি। তবে রকমসকম ভূতুড়েই বটে।

মাধাই তটস্থ হয়ে বলে, "আপনি কে আজ্ঞে? দেখতে পাচ্ছি না কেন?"

গলাটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, "দেখাদেখির দরকারটা কী? চাই তো বুদ্ধি-পরামর্শ? দেখে হবে কোন কচুপোড়া?"

"আজ্ঞে, ভয়ডরেরও তো ব্যাপার আছে।"

গলাটা ফের খিঁচিয়ে উঠে বলল, "কেন, ভয়ের আছেটা কী? ব্যবসাপত্তর তো লাটে উঠেছে, ভিটেমাটি ছাড়ার জো, এখন আর ভয়টা কীসের শুনি! কথায় বলে 'ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়।"

"কিন্তু আমার যে বেজায় ভয় করছে। ওরে জগাই, তোরও করছে তো!"

"দাঁড়াও, ভেবে দেখি। হ্যাঁ গো মাধাইদা, আমার গা-টা বেশ শিরশির করছে, হাত-পায়ে যেন একটা খিল-ধরা ভাব, গলাটাও কেমন শুকনো-শুকনো। এ তো ভয়েরই লক্ষণ মনে হচ্ছে!"

গলাটা বেজায় খাপ্পা হয়ে বলল, "ওসব মোটেই ভয়ের লক্ষণ নয়। আজ দুপুরে ভাত খাওনি বলেই ওসব হচ্ছে।"

জগাই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, "দুশ্চিন্তায় খাওয়াদাওয়া যে মাথায় উঠেছে মশাই, খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি।"

"ওসব খবর আমার জানা, তাই তো বলছি, ওসব মোটেও ভয়ের লক্ষণ নয়। তবে ভয় পাওয়ার সুবিধেও আছে। ভয় থেকে নানা ফিকির মাথায় আসে।"

জগাই একগাল হেসে বলল, "আপনি বেশ বলেন তো! তা আপনি কে বলুন তো! ভূতপ্রেত নাকি?”

"ওসব পুরনো বস্তাপচা কথা যে কেন তোমাদের মাথায় আসে তা কে জানে বাবা। ভূতপ্রেত মনে করার দরকারটাই বা কী? একজন বন্ধুলোক বলে ভাবলেই তো হয়!"

"তা নামটা?"

"কণ্ঠস্বর হলে কেমন হয়? ভাল না?"

জগাই গদগদ হয়ে বলে, "চমৎকার নাম।"

মাধাই তাড়াতাড়ি বলল, "তা কণ্ঠস্বরের কণ্ঠ লাগে। আপনার কণ্ঠটাও তো দেখা যাচ্ছে না মশাই।"

কণ্ঠস্বর এবার খ্যাক করে একটু হেসে বলল, "বলিহারি বাপু তোকে, বলি কণ্ঠ কি একটা দেখবার মতো জিনিস! জন্মে শুনিনি বাপু কেউ কারও গলা দেখতে চায়।"

কন্ঠস্বর তাদের দিল গুপ্তধনের সন্ধান। সেও একরকম Tall talk— ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পাকিয়ে রসিয়ে সে যা বলল, ভুরফুনের মাঠে পুরনো কেল্লার ভেতর সাতধাপ নামলে মিলবে রাশি রাশি ঐশ্বর্য। জগাই মাধাই সাচ্চা মানুষ। কন্ঠস্বরের জোরাজুরিতে শাবল নিয়ে রওনা দিল বটে, মন তাদের সায় দিচ্ছিল না। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ এই আপ্তবাক্যটি তারা যে কখনও ভোলে না।

এইবার তারা শুনল দ্বিতীয় কন্ঠস্বর। সেইটি হল কুঁড়োরাম রায়ের ভূত। বেঁচে থাকতে সবার উপকার করে বেড়াত। মরেও তার উপকার করার বাতিকটি যায় নি।

“পরোপকারী হিসেবে একসময়ে খুব নাম ছিল হে আমার। সারাদিন কেবল পরোপকার করে বেড়াতুম। এমন নেশা যে, নাওয়া-খাওয়ার সময় জুটত না। এই কারও কাঠ কেটে দিলুম, কাউকে জল তুলে দিয়ে এলুম, কারও বেড়া বেঁধে দিলুম, কারও মড়া পুড়িয়ে এলুম, কারও গাছ থেকে নারকোল পেড়ে দিলুম, কাউকে পাঁচটাকা ধার বা কাউকে দু'-চার পয়সা ভিক্ষে দিলুম, কারও বাড়িতে ডাকাত পড়লে হাউড় দিয়ে গিয়ে পড়লুম। ওঃ, সে কী পরোপকারের নেশা! তাতে অবশ্য মাঝে-মাঝে বিপদেও পড়তে হয়েছে। যেদিন পরোপকারের কিছু খুঁজে পেতাম না সেদিন ভারী পাগল-পাগল লাগত। একদিন তো গণেশ পুতিতুণ্ডর পিঠ চুলকোতে বসে গেলুম। গণেশ তখন খুব মন দিয়ে সেলাই মেশিনের সুচে সুতো পরাচ্ছিল। বাধা পড়ায় এই মারে কি সেই মারে। আর একদিন কাজ না পেয়ে নদীয়া দাসের দাওয়ায় একটা বুড়ো মানুষ শুয়ে আছে দেখে ভাবলুম বুড়ো বয়সে তো লোকের পায়ে ব্যথাট্যথা হয়, তা দিই লোকটার পা টিপে। বসেও গেলাম পা টিপতে। লোকটা প্রথমটায় উচ্চবাচ্য করল না, একটু বাদে বেজার মুখে বলল, 'ঝুটমুট মেহনত করছেন বাবু, ওটা আমার কাঠের পা।"

কুঁড়োরাম তাদের বলল, ভাঙা কেল্লায় গুপ্তধন আছে কিনা সে জানে না, তবে এটুকু জানে যে ওখানে গ্যানা ডাকাতের দল ঘাপটি মেরে বসে আছে। নবীনকে নিয়ে নিমাই ভুরফুনের মাঠ পেরিয়ে সেদিকেই আসছে। কুঁড়োরাম এখন ভূত, নিজে গিয়ে ডাকাত ভাগাতে পারবে না। তাই জগাই মাধাই যদি কাজটা করে দেয়, নিরীহ নবীনটা বেঁচে যাবে।

বিপদের কথা শুনে জগাই মাধাই ঘাবড়ালেও তারা ঠিকই এগিয়ে যায় নবীনকে বাঁচাতে। জীবন তাদের বড্ড বেশি কোণঠাসা করে ফেলেছে। এখন মরলেই কি আর বাঁচলেই কি!

“জগাইয়ের মনটা খারাপ, দুর্বল গলায় বলল, "তা বলে ছেলেটা বেঘোরে প্রাণটা দেবে নাকি মাধাইদা? আমাদের প্রাণের আর কী দাম বলো! ডাকাত-বদমাশের হাতে না মরলেও না-খেয়ে মরা তো কপালে লেখাই আছে। জীবনে কখনও একটা সাহসের কাজ করলুম না। আজ চোখ বুজে একটা করেই ফেলব নাকি মাধাইদা?"

মাধাই অনিচ্ছুক গলায় বলল, "কখনও ডাব-চিংড়ি খেয়েছিস রে জগাই?"

"না তো! কীরকম জিনিস সেটা?"

"আমিও খাইনি। ডাবের মধ্যে চিংড়ি মাছ দিয়ে করে। খেতে নাকি অমৃত, বড় সাধ ছিল মরার আগে একবার ডাব-চিংড়ি খেয়ে মরি। তারপর ধর, সেবার শিবরাত্রির মেলায় কী একটা সিনেমা যেন দেখলুম, তাতে দেখি, ভোরবেলা কাশীর ঘাটে লোকেরা ডনবৈঠক দিচ্ছে। দেখে বড় ইচ্ছে ছিল কাশীতে গিয়ে আমিও একবার ভোরবেলা ওরকম ডনবৈঠক দেব। তারপর ধর, হেঁটো ধুতি পরেই তো জীবনটা কাটল, জীবনে একবার একখানা আশি সুতোর কাপড় পরার বড় ইচ্ছে ছিল রে! দিব্যি কুঁচিয়ে কোঁচা দোলাব, আগাটা আবার ময়ূরের পেখমের মতো একটু ছড়িয়ে পিরানের পকেট থেকে উকি মারবে। তা সেসব আর হয়ে উঠল না। সে যাক গে। চল, আজ মরেই দেখি বরং।"

জগাই বিরক্ত হয়ে বলল, "দ্যাখো দিকি কাণ্ড! ওসব কথা কয়ে তুমি যে আমাকে কাহিল করে দিলে। আমারও যে বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল হতে লেগেছে!"

"কেন রে, তোর আবার কী হল?"

"তোমার মতো বড়-বড় আশা নেই আমার, কিন্তু ছোটখাটো কয়েকটা সাধ যে আমারও ছিল। ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু এখন সেগুলো চাগাড় মারতে লেগেছে যে! কেষ্টনগরের সরভাজা খেয়েছ কখনও? লোকে বলে সে নাকি একবার খেলে মরণ অবধি তার স্বাদ জিভে জড়িয়ে থাকে। তারপর ধরো, ওই যে মাউথ অর্গান না কী যেন বলে, ঠোঁটে সাঁটিয়ে প্যাঁপোর-প্যাঁপোর বাজায়, খুব ইচ্ছে ছিল পয়সা হলে ওর একটা কিনে মনের সুখে হিন্দি গান বাজাব। আর একটা সাধও ছিল, কিন্তু বলতে লজ্জা করছে!"

"আর লজ্জা কীসের রে? একটু বাদেই যাদের মরতে হবে তাদের কি লজ্জা-ঘেন্না-ভয় থাকতে আছে?"

"তা হলে বলেই ফেলি! সেই যে বাজপুরের সত্যেনবাবু কী একটা সুগন্ধী মেখে মাঝে-মাঝে গঞ্জে আসে, শুঁকেছ কখনও? আহা, গন্ধটা নাকে এলে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়, মনটা গ্যাস বেলুনের মতো উপর দিকে উঠে যায়। ইচ্ছে ছিল ওরকম এক শিশি সুগন্ধী কিনে কয়েকদিন কষে মেখে নেব। তা সেসব ভাবতে গেলে তো আর মরাই হবে না আমাদের।"

"যা বলেছিস। বেঁচে থাকলেও ওসব কি আর জুটত রে? তার চেয়ে চল, মরে ফিরে-যাত্রা করে আসি। বীরের মতো মরলে নাকি পরের জন্মটা দুধে-ভাতে কাটানো যায়।"

শীর্ষেন্দুর গল্পের এই তো ম্যাজিক। ছোট ছোট মানুষগুলোর ছোট ছোট স্বপ্নে কী যে এক মায়া জড়ানো থাকে! সরভাজা, ডাবচিংড়ি, আশি সুতোর কাপড়, মাউথ-অর্গান— পাঠকের স্নেহ মায়া মমতা আদায় করে নিতে এই অদ্ভুতুড়ে চরিত্রগুলোর জুড়ি নেই।

ভুরফুনের মাঠে তখন চলছে অন্য খেলা। নবীনের লাঠিটি ছিল নিমাইয়ের কাঁধে। হঠাৎ সে শুনল, লাঠির ভেতর থেকে সংস্কৃত মন্ত্রের আওয়াজ আসছে। "মা ম্রিয়স্ব মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমঅবলোপয়। যেনাত্মস্তথান্বেষাং জীবনং বর্দ্ধনং চ অপি প্রিয়তে সঃ ধর্মঃ। দদাতু জীবনবৃদ্ধি নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে।” লাঠি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

এরপর হল তুমুল অ্যাকশন। গ্যানা ডাকাতের দল হাজির। নবীনকে বাঁচাতে জগাই মাধাই হাজির। নবীন কখনও লাঠি ধরেনি। তবু কোন এক জাদুতে সাধুবাবার লাঠি নবীনের হাতে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ডাকাতদলকে পিটিয়ে ছাতু করে দিল সেই লাঠি।

বিপদের ঝুঁকি নিয়ে জগাই মাধাই এসেছে নবীনকে বাঁচাতে। নবীন অকৃতজ্ঞ নয়। দুষ্টু নিমাই গায়ে পড়ে যা যা খেতে চেয়েছিল, সেই সবকিছুই সে জগাই মাধাইকে খাওয়াতে চাইল।

জগাই মাধাই এল নবীনের গ্রামে তার বাড়িতে। গ্যানা ডাকাতরাও বুঝে ফেলেছে লাঠির মাহাত্ম্য। পাঠিয়েছে নিমাইকে লাঠি চুরি করে আনতে। চোর বদমাশদের নেটওয়র্ক খুব স্ট্রং হয়। লাঠির ভেলকির খবর চলে গিয়েছে তোলাবাজ পানুর কাছেও। সেও ঘুরছে নবীনের বাড়ির কাছে। এসে পড়েছে ডাকাত হিরু গায়েনও। গন্ধে গন্ধে হাজির হয়েছে গগনদারোগা। সবাই যে যার মতো নিমাইকে বকে মেরে ধমকে হুকুম দিয়েছে সাধুবাবার লাঠি চুরি করে তাকেই দিতে হবে। ওদিকে নিমাই আরেক সেয়ানা। সে চুরিটা করছে নিজের জন্যই। লাঠির দৌলতে সে হবে এলাকার হর্তাকর্তা বিধাতা, ঠিক যেমনটি ভেবেছিল ১৯ নম্বর অদ্ভুতুড়ের দিনুচোর। দিনুও অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন একটা হাতের জোরে এলাকার রাজা হয়ে বসেছিল। নিমাইও সে পথেই এগিয়েছে। কিন্তু বাদ সেধেছে স্বয়ং লাঠিই।

নিমাই বুদ্ধি খাটিয়ে লাঠি চুরি করে ভুরফুনের মাঠ পেরোচ্ছিল। হিরু গায়েন এসে মেরেধরে লাঠি নিল কেড়ে। আশ্চর্য এই যে, লাঠি চিনে গেছে নিমাইকে, বদ মতলবে লাঠি ধরেছে বলে লাঠি তাকে বাঁচায়নি। হিরু গায়েনও যে সুবিধের নয়, তাও বুঝে ফেলেছে লাঠি। গ্যানা যখন লাঠি নিতে এল, হিরুর হাত গেল অবশ হয়ে। লাঠির জন্য মারামারি করে হিরু গ্যানা-রা মুখে ফেনা তুলে মাঠে পড়ে রইল। পানু এসে লাঠির দখল নিল।

এইবারে হাজির হল লাঠির যোগ্য দাবীদার। নবীন আর জগাই মাধাই। পানুর দলকে ঠান্ডা করতে বেশি সময় লাগল না।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই লড়াই শেষ। শুধু পানুবাবু ভারী হতবাক আর স্তম্ভিত হয়ে সেই যে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন আর নড়েননি।

"এ কী রে জগাই, পানুবাবু এখনও দাঁড়িয়ে যে!"

জগাই কাছে গিয়ে পানুবাবুর মুখখানা ভাল করে দেখে বলল, "তাই তো! এ তো পানুবাবুই মনে হচ্ছে মাধাইদা! নাঃ, পানুবাবুর সাহস আছে। এত কাণ্ড দেখেও পালাননি কিন্তু।"

"ওরে ভাল করে দ্যাখ, মূর্ছা গেছে কিনা!"

জগাই মাথা চুলকে বলল, "কিছু একটা হয়েছে। হ্যাঁ, মাধাইদা, পানুবাবুকে তুমি মারোনি তো!"

জিভ কেটে মাধাই বলে, "ছিঃ ছিঃ, অত বড় মানী লোকের গায়ে হাত তুলতে আছে? একটু ঠেলা দিয়ে দ্যাখ তো।”

"সেটা কি ভাল হবে মাধাইদা? পড়েটড়ে গেলে যে জামাকাপড় নোংরা হবে।"

"কিন্তু সবাই যেখানে শুয়েটুয়ে আছে সেখানে পানুবাবুর এই একা খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা কি ভাল দেখাচ্ছে?"

"বলছ! তা হলে ঠেলব?"

একটু ঠেলতেই পানুবাবু ধড়াস করে চিতপাত হয়ে পড়ে গেলেন।

"আহা, ভদ্রলোকদের কি ওভাবে ঠেলতে আছে রে জগাই! মেরে ফেলিসনি তো!"

জগাই পানুবাবুর নাকের সামনে হাত দিয়ে বলল, "না গো মাধাইদা, দিব্যি শ্বাস চলছে।"

এবার আসে গল্পের তিননম্বর ও শেষ ভূতটি। সে হল সাধুবাবার সেবাইত। সাধুবাবার সমাধি পাহারা দেয়। তার নির্দেশমতো লাঠিটা রাখা হল সমাধির শিয়রে।

সেবাইতের কণ্ঠস্বর বলল, "আর দু'-চার দিনের মধ্যেই ওই লাঠির গায়ে পাতা গজাবে। ডালপালা বেরোবে... লাঠিটা গাছ হয়ে যাবে।... তারপর কুঁড়ি আসবে... ফুল ফুটবে। সাদা সুগন্ধি ফুল। গাছ কেঁপে ফুল ফুটবে ... আর সাধুবাবার সমাধির উপর টুপটাপ করে সারাদিন সারারাত ধরে ঝরে পড়বে সাদা সুগন্ধি ফুল। ... আর সাধুবাবা সমাধিতে বড় শান্তিতে ঘুমোবেন তখন... বড় শান্তি...।"

তিনজনেই সমাধির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে নবীন বলল, "তবে তাই হোক। তবে তাই হোক।"

জগাই আর মাধাইও ফিসফিস করে বলল, "তাই হোক, তাই হোক।"

এই গল্পটির মূল ভাবনা — একটি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন কাঠের লাঠি, যা কিনা একজন সন্ন্যাসীর সম্পত্তি ছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পরে লাঠিটি তাঁর সমাধির উপর রেখে দেওয়া হয়, সেখান থেকে এক গাছ জন্মায় ও তাতে সাদা ফুল ফোটে— এর সাথে কিন্তু জাপানি ঐতিহ্য ও দর্শনের অত্যন্ত বেশিরকম মিল পাওয়া যায়।

জাপানি লোককথায় এ ধরনের বেশ কিছু কাহিনি পাওয়া যায়।

১. চেরি ফুলের গাছ ও আত্মা (Sakura Tree Legend)

জাপানে একটি বিশ্বাস আছে যে চেরি গাছের মধ্যে আত্মা বাস করে। কিছু কাহিনিতে বলা হয়, সামুরাই বা সন্ন্যাসীরা মৃত্যুর পর গাছ হয়ে যান, যেগুলো পরে সুন্দরভাবে ফোটে — যা অস্থায়ী জীবনের সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক রূপান্তরের প্রতীক।

শীর্ষেন্দুর গল্পের সাধুবাবার সমাধিতে গাছ জন্মানো এবং তাতে সাদা ফুল ফোটা শিন্তো ধর্মীয় ভাবনাটির সঙ্গে মিলে যায়।

২. কুবো-দাইশি (কুকাই) এবং তাঁর লাঠির কাহিনি

কুকাই ছিলেন একজন বিখ্যাত সন্ন্যাসী ও শিংগন বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সম্পর্কে একটি লোককথায় বলা হয়, তিনি তাঁর তীর্থযাত্রার লাঠি পূর্বদিকে ছুঁড়ে দেন এবং যেখানে তা পড়ে, সেখানেই তিনি সাধনা শুরু করেন। প্রচলিত লোকবিশ্বাস, তাঁর সমাধিতে আজও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। লাঠিতেই নাকি সন্ন্যাসীর আত্মা রয়েছেন। নখ আর চুল বেড়ে যাওয়ার কিংবদন্তিও শোনা যায়।

শীর্ষেন্দুর গল্পতেও সাধুবাবার লাঠিটি একটি পবিত্র উদ্দেশ্য পূরণ করে ও মরণোত্তর উপস্থিতির প্রতীক হয়ে ওঠে।

৩. জিজো বসাতসু ও লাঠির কাহিনি

জিজো হলেন একজন জাপানি দেবতা, যিনি জাপানের সমস্ত শিশু ও মৃতদের আত্মাকে সুরক্ষিত রাখেন। তাঁকে প্রায়শই একটি লাঠি সহ দেখা যায়, যেটি নাকি অশুভ শক্তিদের দূরে হঠিয়ে দেয়। জাপানে তাই অনেক সময় সমাধির পাশে জিজোর লাঠিহাতে মূর্তি রাখা হয়।

সমাধির পাশে পবিত্র লাঠির অস্তিত্ব ও তার থেকে আধ্যাত্মিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার এই ভাবনাটি জাপানে বহুল প্রচলিত। শীর্ষেন্দুর গল্পেও এইটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

৪. কোডামা ও পবিত্র গাছের কাহিনি

জাপানি লোককথায় কোডামা হলো এমন এক ধরনের আত্মা, যারা গাছের মধ্যে বাস করে। জাপানের পবিত্র স্থান বা সমাধিতে যদি কোনও গাছ জন্মায় ও তাতে সাদা ফুল ফোটে, তাকে অলৌকিক বা দেবতুল্য মনে করা হয়। এধরনের গাছ কাটা জাপানে নিষিদ্ধ।

সুতরাং, ধরে নেওয়া যেতেই পারে শীর্ষেন্দু গল্পে সাধুবাবার সমাধিতে লাঠি থেকে জন্ম নেওয়া একটি সাদা ফুলে ভরা গাছ একেবারে এই ভাবনারই অংশ।

কিছুদিন আগে নজরে পড়ে একজন বই ব্যবসায়ী ফেসবুকের পাতায় লিখেছেন, শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাস সমগ্র, কিশোর গল্প সমগ্রগুলির নাকি বিক্রিবাটা কমে গিয়েছে। পোস্টের কমেন্টবক্সে রিল দেখার অপকারিতা থেকে ‘আজকাল ক্লাসিক সাহিত্য পড়ার মানুষ কমেছে’ শীর্ষক গুটিকতক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ চোখে পড়ল।

আসলে শীর্ষেন্দুর বইগুলো নিয়ে তেমন করে ‘মার্কেটিং’ করার প্রয়োজন হয়নি কারণ তখন লোকে এমনিই বই কিনতো। সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব ছিল না, সুতরাং ছবি তুলে ‘আমি খুব পড়ুয়া মানুষ’ এমনটা জাহির করারও কোনও peer pressure ছিল না।

এখন যে কোনও কিছু কেনার আগে যাচাই করার প্রবণতা বেড়েছে। বই হোক বা জামা জুতো ইলেকট্রনিক্স, আমরা সেটাই কিনি যেটার দারুণ রকম আকর্ষণীয় রংচঙে মনভোলানো অ্যাড নজরে আসে।আঁটোসাঁটো প্লট, প্রচুর ট্যুইস্ট, থ্রিল, কিছুমিছু অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট না থাকলে সে বই এই প্রজন্মের অধিকাংশ পাঠকদের মন ছুঁতে পারে না। হরর তান্ত্রিক জঁর, স্পাই থ্রিলার জঁরগুলি তাই অনেক বেশি পরিমাণে ‘ব্যবসা’ এনে দিতে পারছে।

একটানা বই পড়ে যাওয়ার ধৈর্য কমছে। এই রিল দেখার যুগে এখন এক বা দেড় মিনিটের বেশি রিলও মানুষ অধৈর্য হয়ে স্কিপ করে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ছাপার অক্ষরের পক্ষে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখাটা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ঘিরে শেষ পাঁচবছরে অজস্র অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। অভিযোগগুলির বেশিরভাগই আসত সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলিতে। কেউ হয়তো আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কিনলেন, সূচীপত্রের ছবি দিয়ে কোন গল্প বা কোন উপন্যাস কেমন তা আলোচনা করলেন। ভালো লাগা মন্দ লাগা নিতান্তই ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স, কিন্তু মুশকিল হল এইধরনের ‘রিভিউ’ ভীষণভাবে মানুষকে ইনফ্লুয়েন্স করতে থাকে। অমুকের এই বিশেষ গল্পটা খুব খারাপ লেগেছে, তমুক সেই খারাপ লাগাটুকুর কথা মাথায় রেখে যখন গল্পটা পড়তে শুরু করবে, মনের অজান্তেই সেও গল্পের মান নিয়ে নাক কুঁচকাতে থাকবে। ড্রয়িংবুকের ছবির মতো গ্রাম, যৌথ পরিবার, উপকারী ভূত, গেঁয়ো চোর, বোকা দারোগা, গরিব রাজা, একটা দুটো এলিয়েন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় গোছের বিজ্ঞানী— এগুলোই শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ের সিরিজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে। এই দিয়েই তিনি আগাগোড়া সিরিজটি বানিয়েছেন। একেবারে গোড়ার পর্বের কিছু অদ্ভুতুড়ে নেহাতই হাতমকশো করার মতো এলেবেলে ধরনের লেখা, কিন্তু সিরিজ যত এগিয়েছে, সিরিজ তত খোলতাই হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা অভিযোগগুলির সারবক্তব্য ছিল, পূজাবার্ষিকীর পাতায় তারা নতুন কিছু দেখতে চায়, শীর্ষেন্দুর গল্প নাকি বড় একঘেয়ে।

আজ যদি নতুন করে শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের মার্কেটিং শুরু করা যায়? যদি কোনও সুদর্শন ইনফ্লুয়েন্সার সুললিত কন্ঠে সিরিজের গল্পগুলি নিয়ে বেশ ভালো মানের ছোট ছোট রিল বানান? যদি অদ্ভুতুড়ে সিরিজের মজার মজার চরিত্রদের ছবি অথবা আইকনিক কিছু ডায়লগ আঁকা টি-শার্ট, কফি মাগ, বুকমার্ক বাজারে আনা হয়? যদি ভালো কোনও চিত্রপরিচালক সিরিজ ধরে একের পর এক সিনেমা অথবা ওটিটি-তে ওয়েব সিরিজ বানাতে থাকেন? যদি কোনও নামজাদা সুরকার অদ্ভুতুড়ে সিরিজের জন্য আইকনিক একটি সুর তৈরি করে দেন? যদি সেইটি জিও, এয়ারটেলের নম্বরগুলিতে কলার টিউন হিসেবে সেট করার ব্যবস্থা করা হয়? ‘ব্যবসা’ এনে দিতে পারার যোগ্যতা এই সিরিজটির রয়েছে, শুধু যোগ্য ব্যবসাদারেরই যা অভাব।