
ডাকাতের ভাইপো - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের তেত্রিশতম আখ্যান
- 12 July, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
এইবারে আর গেঁয়ো চোর ছ্যাঁচোর নয়, সোজাসুজি আন্তর্জাতিক মানের টেক স্যাভি ডাকাতকে বেছে নিয়েছেন শীর্ষেন্দু তাঁর ৩৩ নম্বর অদ্ভুতুড়েতে। হবে না? সময়টাও যে হুপহাপ এগিয়ে ২০০৭ এ এসে ঠেকেছে। গল্পের ডাকাত রাখালহরি চীন থেকে ডাকাতির প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। সে অত্যাধুনিক সব গ্যাজেট ব্যবহার করে। তার জুনিয়র চ্যালারা পর্যন্ত গুচির গগলস পরে, হাই টেক ফোন হাতে নিয়ে ঘোরে। পঞ্চাশ পেরিয়েও রাখালহরির সাংঘাতিক ফিটনেস। সে বড় বড় ডাকাতদের ওপর ডাকাতি করে বেড়ায়। শুধু মুশকিল হয়েছে একটা জায়গায়। বিয়েটিয়ে করেনি, ছেলেপিলে নেই। এত সম্পত্তি সে কাকে দিয়ে যাবে? সে ম’লে এতবড় দলের হালটাই বা ধরবে কে?
গল্প শুরু হয় কাশীবাবুকে দিয়েই। তিনি বাগানে কাজ করছেন, সাহায্য করছে মালী নরহরি। এমন সময় কাশীবাবু দেখলেন, ফটকের বাইরে একটা উটকো লোক দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। নেহাত হাঘরে চেহারা। রোগামতো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একখানা চেক লুঙ্গি, গায়ে সবুজ রঙের একখানা কামিজ, কাঁধে লাল গামছা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল আছে বটে, কিন্তু চেহারা মোটেই ভয়ংকর নয়।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এমন উলোঝুলো রহস্যময় আগন্তুকদের দেখা অনেক মিলেছে।
লোকটি নিজের পরিচয় দেয়, সে নাকি বিখ্যাত ডাকাত রাখালহরি গড়াইয়ের আপন ভাইপো খাঁদু গড়াই। খুড়োর একমাত্র ওয়ারিশ। রাখালহরি নাকি আজকাল বড় খাঁদু খাঁদু করে কাঁদাকাটা করেন, তাই খুড়োকে খুঁজতে বেরিয়েছে খাঁদু।
খাঁদু কিন্তু ঘড়েল লোক। একথা সেকথায় ভুলিয়ে সে চাইছে ঘরে ঢুকে জুত করে বসতে। কথোপকথন চলতে থাকে একটানা। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়েগুলোর এই একটা আশ্চর্য গুণ, কথাগুলো এমন মজার, লম্বা লম্বা কথোপকথনে গল্প এতটুকু ঝুল খেয়ে যায় না।
“বাপ বিবাগী হওয়ার সময় বলেছিলেন, 'ওরে খাঁদু, তোর যে কী হবে কে জানে। যদি পারিস, তবে তোর খুড়োকে খুঁজে দেখিস। তাকে পেলে তোর একটা হিল্লে হবে।' তা মশাই সেই থেকে খুড়োকে কিছু কম খুঁজলুম না।"
"পেলে না বুঝি?"
"একেবারে পাইনি তা বললে ভুল হবে। কখনও অর্ধেকটা, কখনও সিকিটা পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু গোটাগুটি খুড়োমশাইকে নাগালে পেলুম কই?"
"তাজ্জব কথা! খুড়োর আবার সিকি-আধুলিও হয় নাকি হে? তোমার খুড়োমশাইয়ের তো একটা ঠিকানা আছে নাকি?"
মাথা নেড়ে খাঁদু বলে, "তা তো আছেই। থাকবারই কথা। ঠিকানা না থাকার জো নেই। কিন্তু মুশকিল হল সেটা আমার বাবা আমাকে বলেননি। তাই তো গোরুখোঁজা খুঁজতে হচ্ছে মশাই। মেহনত বড় কম যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এত মেহনতে ভগবানকে পাওয়া যায়, তো খুড়োমশাই কোন ছার।"
"ঠিকানা না থাকলেও নাম তো একটা আছে রে বাপু?"
একগাল হেসে খাঁদু বলল, "তা আর নেই! খুব আছে। দিব্যি নাম মশাই। রাখালহরি গড়াই। নবগ্রামে রাখাল গড়াইকে পেলুম বটে খুঁজে, কিন্তু তিনি কালীর দিব্যি কেটে বললেন যে, তিনি নিকষ্যি রাখাল। রাখালের সঙ্গে হরি নেই মোটেই। তারপর ধরুন, শীতলাপুরের হরিপদ গড়াই, তাঁকে পাকড়াও করতেই তিনি ভারী রেগে গিয়ে বললেন, 'কেন হে বাপু, হরিপদ হয়ে কি আমি খারাপ আছি? আমাকে আবার একটা রাখাল গছাতে চাইছ কেন, তোমার মতলবটা কী হে?' তারপর ধরুন, মদনপুরে খুড়োমশাইকে প্রায় পেয়েই গিয়েছিলুম। রাখালহরি গড়গড়ি। যতই বলি গড়গড়ি নয়, ওটা আসলে গড়াই, ততই তিনি গরগর করে গর্জাতে থাকেন। ঘণ্টা দুই যুঝেও তাঁকে কিছুতেই মানাতে পারলুম না যে, তিনি গড়গড়ি না-ও হতে পারেন এবং গড়াই কিছু খারাপ কথাও নয়।"
"তা হলে তো মুশকিল হল হে। তা তোমার খুড়োমশাই কি বেশ পয়সাওলা লোক?"
খাঁদু চোখ বড় বড় করে বলে, "তা তো বটেই। কুঠিবাড়ি লুট করে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন যে। তারপর ডাকাত হিসেবে তাঁর আরও নামডাক হয়।"
"ডাকাত!” বলে কাশীবাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
"যে আজ্ঞে। তেমন চুনোপুঁটি ডাকাতও নন। তাঁর মাথার দাম এখন লাখ টাকা।"
"ওরে বাবা! শুনেই যে আমার হৃৎকম্প হচ্ছে! তুমি তো সাংঘাতিক লোক হে। ডাকাতের ভাইপো!"
"আজ্ঞে, ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল! ডাকাতের ভাইপো শুনে লোকে বড্ড ঘাবড়ে যায়! অনেকে সন্দেহ করে, ভয় পায়, ঘটিবাটি সামলে রাখে। অনেকে আবার পুলিশেও খবর দেওয়ার উদ্যোগ করে। কী ফ্যাসাদ বলুন দিকি। আমি মশাই, নিতান্তই নিরীহ ধর্মভীরু লোক। খুড়োমশাই হাতে মাথা কাটেন বটে, কিন্তু আমার তো মশা-মাছি মারতেও হাত সরে না!"
কাশীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, "তা হলে বাপু, তুমি বরং অন্য কারও ভাইপো হলেই ভাল করতে। এই ধরো উকিল-মোক্তার বা ডাক্তার। ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ভাল কথা নয়।"
"আজ্ঞে, সে কথাও খুব ভাবি। আমার যা স্বভাব, তাতে ওরকম একজন ডাকসাইটে ডাকাতের ভাইপো হওয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। তিনি লাখো লাখো টাকা লুটছেন বটে, কিন্তু আমি মরছি বিবেক দংশনের জ্বালায়। এই তো দেখুন না, দিনদুই আগে নারানপুর গাঁয়ের হাটখোলায় একছড়া সোনার হার কুড়িয়ে পেলুম। তা ভরিটাক ওজন তো হবেই। কিন্তু যেই হাতে নিয়েছি অমনই যেন বিছুটি পাতার জ্বালা। সে কী জ্বলুনি মশাই, কী বলব! তারপর সারা গাঁ তোলপাড় করে যার হার হারিয়েছিল সেই খুকিটিকে খুঁজে বের করে তার হাতে হারছড়া তুলে দিয়ে তবে নিষ্কৃতি।”
"তা হলে তো বাপু, তুমি বেশ দোটানার মধ্যেই পড়েছ। একদিকে ডাকাতখুড়ো, অন্যদিকে বিবেকবুড়ো?"
"যথার্থই বলেছেন মশাই। দু'দিকের টানাহ্যাঁচড়ায় বড্ড জেরবার হচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কী, বিবেক দংশন যেমন আছে তেমনই খিদের জ্বালাও তো আছে। বাইরে থেকে দেখলে ঠিক বুঝবেন না, আমার ভিতরে বিবেক আর খিদের কেমন সাংঘাতিক লড়াই চলছে। ওফ, সে যেন সুন্দ-উপসুন্দের যুদ্ধ। কখনও বিবেককে ধরে খিদে এমন আছাড় মারে যে, বিবেকের অক্কা পাওয়ার দশা। কখনও আবার বিবেক তেড়েফুঁড়ে উঠে খিদেকে এমন চেপে ধরে যে, খিদের তখন দম আটকে মরার অবস্থা। তা এই খিদে যখন মাঝে মাঝে চাগাড দিয়ে ওঠে, তখন কখনও-সখনও চুরি-ডাকাতি করতে যে ইচ্ছে যায় না তা নয়। তখন যেন খুড়োমশাই আমার ঘাড়ে ভর করেন। এই তো গেল হপ্তায় গোলোকগঞ্জে দিনদুই উপোসের পর দুর্বল শরীরে একটু ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ দেখি, একটা বাড়ির বাগানের বেড়ার ধারে একটা পেঁপে গাছে একেবারে হাতের নাগালে একখানা হলুদ বরণ পাকা পেঁপে ঝুলে আছে। যেই না দেখা, অমনিই আমার খিদে লাফিয়ে উঠে বিবেককে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে পাঁইপাঁই করে ছুটল।"
কাশীবাবু চোখ গোল গোল করে বললেন, "বটে! তারপ হল!"
"আজ্ঞে, খিদে প্রায় জিতেই গিয়েছিল আর কী! আর-একটু হলেই মহাপাপটা করেই ফেলছিলুম প্রায়। কিন্তু হাত বাড়িয়ে পেঁপেটা যখন সাপটে ধরেছি, তখনই ভিতর থেকে বাঘের মতো বিবেক গর্জন করে উঠল, 'খবরদার, খাঁদু! এখনও পৃথিবীতে চন্দ্র-সূর্য উঠছে, এখনও গঙ্গায় জোয়ার-ভাঁটা খেলছে, এখনও গোরুর দুধে সর পড়ে, এখনও দধিমন্থন করলে মাখন ওঠে, এখনও পাটালি গুড় দিয়ে পায়েস হয়। তাই বলছি, এ-পাপ তোর ধর্মে সইবে না।' বুঝলেন মশাই, কী বলব, বিবেকের সেই বাঘা গর্জনে শরীরে যেন ভূমিকম্প হতে লাগল। মনস্তাপে মনটা ভরে গেল। হাত সরিয়ে নিলুম, পেঁপেটা যেমন ঝুলছিল তেমনই ঝুলে রইল।"
কাশীবাবু একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, "যাক বাবা! পেঁপেটার জন্য ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার।"
"যে আজ্ঞে, হওয়ারই কথা। তবে পেঁপে বাঁচলেও এই খাঁদু গড়াইয়ের যে মরার দশা হয়েছিল মশাই! বিবেকের মার খেয়ে খিদে হার মানল বটে, কিন্তু আমার পেটে এমন কুইকুই করে ঘুরে বেড়াতে লাগল, কিছুতেই বাগ মানে না। ধর্ম রাখতে গিয়ে প্রাণ যায় আর কী? আচ্ছা মশাই, এটা কলিযুগ বলেই কি ধর্মভীরু মানুষরাই শুধু কষ্ট পায়, আর পাপীতাপী, খুনে-গুন্ডারা দিব্যি হেসে-খেলে বেড়ায়?"
"তা বাপু, কথাটা মন্দ বলোনি। আমিও শুনেছি, কলিযুগে সব উলটো নিয়ম।"
সিস্টেমের ওপর ক্ষোভ শীর্ষেন্দু অনেক অদ্ভুতুড়েতেই প্রকাশ করেছেন। কোথাও রয়েসয়ে, কোথাও বা খুল্লামখুল্লা। অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা, ঘুষখোর পুলিশ, লোভী মানুষ, খুনে মানুষ, মেরুদণ্ডহীন মানুষ, বুদ্ধিসুদ্ধি বন্ধক রেখে আসা মানুষ এরা সব্বাই অদ্ভুতুড়ে সিরিজে মিলেমিশে রয়েছে। এই তেত্রিশ নম্বর অদ্ভুতুড়েতে একটু যেন অন্যরকম সুর। নিষ্কর্মা ঘুষখোর দারোগার চেয়ে রবিনহুড গোছের ডাকাত রাখালহরি ঢের ভালো— এমন একটা স্টেটমেন্ট যেন আলতো করে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে।
“আচ্ছা মশাই, আপনি কি 'সধবার দীর্ঘশ্বাস' বা 'ডাকাতের দয়া' যাত্রাপালা দেখেছেন?"
"না বাপু, যাত্রাটাত্রা আমি বড় একটা দেখি না।"
পিছন থেকে নরহরি বলে, "আমি দেখেছি, বড্ড ভাল পালা, চোখের জল রাখা যায় না।"
খাঁদু একগাল হেসে বলল, "তবেই বুঝুন, এ কলিযুগ না হয়ে যায় না।"
কাশীবাবু অবাক হয়ে বলেন, "কেন বাপু, যাত্রাপালার সঙ্গে কলিযুগের সম্পর্ক কী?"
"বুঝলেন না! ও দুটো পালাই আমার খুড়োমশাইকে নিয়ে লেখা।
আর শুধু কি পালা? তাঁকে নিয়ে কত গান বাঁধা হয়েছে জানেন? শোনেননি? সেই যে, মিছেই করো দৌড়াদৌড়ি, হাতে নিয়ে দড়াদড়ি, পরাবে যে হাতকড়ি হে কোথায় পাবে হাত, বাপের ব্যাটা রাখালহরি, তারই দয়ায় বাঁচি মরি, তার হাঁকেডাকে দাপে খাপে সবাই কুপোকাত... হবে সবাই কুপোকাত। শোনেননি?"
"না হে বাপু।”
নরহরি বলল, "আমি শুনেছি।"
খাঁদু দেঁতো হাসি হেসে বলে, "তবেই বুঝুন, কলিযুগে পাপীতাপীরা কেমন তোফা আছে। খুনখারাপি, লুটমার করে দোহাত্তা কামাচ্ছে, তার উপর তাদের নিয়ে পালা হচ্ছে, গান বাঁধা হচ্ছে। এসব কি অশৈলী কাণ্ড নয় মশাই?"
গোটা গল্প জুড়ে রাখালহরির যত গুণগান গাওয়া হয়েছে, রাখালহরিকে ভিলেন ভাবতে এতটুকু মন চায় না। এতদিন পর্যন্ত গ্রামের চোরগুলোকে নিয়ে নোনতা মিষ্টি গল্প বুনে তাদের একরকম প্রায় ভালোবাসিয়েই ছেড়েছেন লেখক। এইবার বুঝি ডাকাতের পালা!
“এই আমাকে দেখুন, গোবেচারা, ধর্মভীরু মানুষ। কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। খুন-জখম, চুরি-ডাকাতির ছায়াও মাড়াই না। তা কে দাম দিচ্ছে বলুন! সেই সাতসকালে বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে হাঁটা দিয়ে তিন মাইল ঠেঙিয়ে আসছি, খিদের চোটে পেট খোঁদল হয়ে আছে, তেষ্টায় বুক অবধি ঝামা, তবু কোনও ভালমানুষ কি একবারও ডেকে বলল, 'ওরে বাপু খাঁদু, আয় বাবা, এই ঠান্ডার সকালটাতে এক পাত্তর গরম চা আর দু'খানা বাসি রুটি খেয়ে আত্মারামটা একটু ঠান্ডা কর বাবা।' কিন্তু মশাই, আজ যদি আমার শ্রদ্ধাস্পদ খুড়োমশাই রাখালহরি গড়াই হাতে একখানা রাম-দা বাগিয়ে এসে দাঁড়াতেন, তা হলে দেখতেন, খাতির কাকে বলে! এতক্ষণে গরম গরম ফুলকো লুচি আর মোহনভোগ, সঙ্গে রসগোল্লা-পাওয়ার গাদি লেগে যেত। গাঁ ঝেঁটিয়ে পিলপিল করে লোক ধেয়ে আসত একবার চোখের দেখা দেখতে।"
কাশীবাবু তটস্থ হয়ে লজ্জিত মুখে বললেন, "আহা, তুমি চা-রুটি খেতে চাও, সে-কথা আগে বলতে হয়! খিদে-তেষ্টা কার নেই বলো!"
পিছন থেকে নরহরি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে চাপা স্বরে বলল, "কর্তা, খাল কেটে কুমির আনছেন কিন্তু। এ লোক মোটেই সুবিধের নয়। কেমন চোর-চোর চেহারা, দেখছেন না! তার উপর ডাকাতের ভাইপো! ডাকাতের ভাইপোরা কিন্তু ভাল লোক হয় না।"
কাশীবাবু মুখ ফিরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলেন, "তুই ক'টা ডাকাতের ভাইপো দেখেছিস?"
"কেন, আমাদের কেষ্টপুরের পটল দাস! আমার বুড়ি ঠাকুরমা সারা সকাল কত কষ্ট করে গোবর কুড়িয়ে এনে ঘুঁটে দিতেন, আর বেবাক ঘুঁটে চুরি করে নিয়ে যেত ওই পটলা। মুদির দোকানে বাকি ফেলে জন্মে শোধ দিত না। আর নরেনবাবুর পোষা বিড়ালটা একখানা মাছের কাঁটা চুরি করেছিল বলে কী ঠ্যাঙার বাড়িটাই না মারল। এই পটলা হল কালু ডাকাতের সাক্ষাৎ ভাগনে।"
"তবে! ভাইপো আর ভাগনে কি এক হল? তুই যে মুড়ি আর মিছরির এক দর করে ফেললি? কালিয়া আর কোপ্তা কি আর এক জিনিস রে বাপু! ব্যাটবল আর বটব্যালে কি তফাত নেই? কিন্তু তোকে বলে কী লাভ, তুই তো সেদিনও সিন্নি খেয়ে বললি, 'পায়েসটা বড় জম্পেশ হয়েছে!' ভাগনে আর ভাইপোর তফাত তুই কী বুঝবি?"
"আজ্ঞে, ভাগনে পছন্দ না হলে হাতের কাছে ভাইপোও মজুত রয়েছে। আমাদের গাঁয়ের গিরিধারীর কথাই ধরুন! গিরিধারী হচ্ছে যেমন ষণ্ডা, তেমনই গুন্ডা, তার অত্যাচারে কত লোক যে গাঁ ছেড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। একে ধাঁই করে ঘুসি মারছে, তাকে ঠাস করে চড় মারছে, রামহরি কবরেজের চুল ধরে এমন টান মারল যে, চুলের গোড়াসুদ্ধ উঠে আসার কথা। তা ভাগ্যিস রামহরি কবরেজ পরচুলো পরত, তাই পরচুলার উপর দিয়েই গেল। রামহরির যে টাক ছিল, তা কেউ জানত না। পরচুলা খসে যাওয়ায় জানাজানি হতে রামহরিও লজ্জায় গাঁ ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেল। তা সেই গিরিধারী হল নবকেষ্ট চোরের সাক্ষাৎ ভাইপো।"
"চোর!” বলে নাক সিঁটকোলেন কাশীবাবু। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, "তোর বড় ছোট নজর। কথা হচ্ছে ডাকাতের ভাইপো নিয়ে, তুই ফট করে চোরের ভাইপোকে এনে ফেললি। ওরে, আদার সঙ্গে কি কাঁচকলা মেলে! নাকি আমের দামে আমড়া বিকোয়!"
এইবার বলা যাক, কাশীবাবুর কথা। কাশীবাবু লম্বা চওড়া মানুষ, ওকালতি পাশ করেছেন। কিন্তু তিনি এখনও তেমন ‘বড়’ হননি। তাঁর বাবা ঠাকুরদা বেশ লম্বাচওড়া তেজি ডাকাবুকো মানুষ। ডনবৈঠক দেন নিয়মিত। বাবা নসিরাম এক্স মিলিটারিম্যান, মানুষটি ভারী জাঁদরেল। দাদু শশীরাম রিটায়ার্ড দারোগা, তেজের দিক থেকে তিনিও কিছু কম যান না। কিন্তু কাশীবাবু এক্কেবারে উলটোরকম মানুষ। মা ঠাকুমার অত্যধিক আদরে তিনি একটি গোবরগণেশ হয়েছেন। বাবা ঠাকুরদার মতো ভারী ভারী ব্যক্তিত্বের চাপে তিনি ব্যক্তিত্বহীন একজন নামনাত্র মানুষ হয়ে টিকে রয়েছেন। ঘি দুধ খাওয়া ননীর শরীর তাঁর, বিশ কদম হাঁটতে তাঁর জিভ বেরিয়ে পড়ে। অষ্টপ্রহর বাবা ঠাকুদার মুখে ‘কুলাঙ্গার’ ‘অপদার্থ’ সম্বোধন শুনতে শুনতে তাঁর আত্মবিশ্বাস তলানিতে। রাতে বেড়াল ডাকলে তিনি ভয়ে কেঁপে ওঠেন। বাবা দাদুর চোখে চোখ রেখে কথাটি পর্যন্ত বলতে পারেন না।
নসিরাম যখন দেখলেন খাঁদুকে, সে আরেক মজার কাণ্ড।
“নসিরাম গর্জন করে উঠলেন, "ডাকাত! কোথায় ডাকাত?"
নরহরি তাড়াতাড়ি খাঁদুকে দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল, "আজ্ঞে, এই যে, ইনিই!"
"বটে! যা তো, দৌড়ে গিয়ে কোদালটা নিয়ে আয়।"
নরহরি অবাক হয়ে বলে, "কোদাল। কোদাল দিয়ে কী হবে কর্তাবাবা?"
বাঘা চোখে চেয়ে নসিরাম বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, "কোদাল দিয়ে বাগানের উত্তর-পূব কোণে একটা তিন হাত লম্বা দেড় হাত চওড়া গর্ত খুঁড়ে ফ্যাল শিগগির। এই ডাকাতটাকে আজ জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।"
কাশীরাম তটস্থ হয়ে বললেন, "বাবামশাই, এই প্রাতঃকালেই খুনখারাপি কি ভাল দেখাবে?"
নসিরাম গর্জে উঠলেন, "কেন, প্রাতঃকালে ডাকাতকে জ্যান্ত পুঁতলে দোষ হচ্ছে কোথায়?"
"আজ্ঞে, এ ঠিক ডাকাত নয়। ডাকাতের ভাইপো!"
"ওই একই হল। যা, যা, তাড়াতাড়ি কোদাল এনে গর্তটা করে ফ্যাল তো নরহরি!"
খাঁদু গড়াই কিন্তু মোটেই ঘাবড়াল না। হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মিঠে এবং মোলায়েম গলায় বলল, "পেন্নাম হই কর্তাবাবু। এই এতক্ষণ এঁদের সঙ্গে কথা কয়ে ঠিক সুবিধে হচ্ছিল না। এই আপনার গলাটা শুনে পিলেটা এমন চমকাল যে, শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। পুরুষ-সিংহ বলে কথা! দেশে পুরুষ-সিংহের বড়ই অনটন কর্তাবাবা। ওঃ, যেমন গামা পালোয়ানের মতো চেহারা আপনার, তেমনই রাজাগজার মতো ভাবভঙ্গি। দেখে বুকটা ভরে গেল। তা আপনি মারতে চাইলে মরেও সুখ। শিয়াল-কুকুরের হাতে মরার চেয়ে বাঘ-সিংহের হাতে মরাই ভাল, কী বলেন? বুক ফুলিয়ে পাঁচজনকে বলা যায়।"
নসিরাম প্রশস্তি শুনে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, "তবে!"
খাঁদু গদগদ হয়ে বলে, "উচিত কথাই কইছি কর্তা। মরণকালে মিছে কথা কয়ে লাভ কী বলুন। পাপের বোঝা আরও ভারী হবে বই তো নয়। আমার খুড়ো রাখালহরি গড়াই ডাকাত বটে, কিন্তু আপনার কাছে নস্যি। আমাদের গাঁয়ের হরু পালোয়ান একসঙ্গে চার-চারজন পালোয়ানকে চিত করত বটে, কিন্তু তাকে দেখলেও এমন ভক্তিছেদ্ধা হয় না, কিংবা হরগোবিন্দপুরের বিশ্বেশ্বরের কথাই যদি ওঠে, পাগলা হাতির শুঁড় ধরে টেনে জিলিপির মতো শুঁড়টাকে পাকিয়ে এমন কাণ্ড করেছিল যে, হাতির ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! তা সেই হাতিবীর বিশ্বেশ্বরও আপনার ধারেকাছে আসতে পারে না। এই যে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে, আসলে মানুষ তো নয়, যেন বরফ-মাখানো পাহাড়!"
নসিরাম সায় দিয়ে ঘনঘন মাথা নাড়লেন। তারপর ভ্রূ কুঁচকে খাঁদুকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, "এঃ, এই চেহারা নিয়ে ডাকাতি করিস? ছ্যাঃ ছ্যাঃ। তোর তো বুকের ছাতি তেত্রিশ ইঞ্চির বেশি নয়, অমন প্যাকাটির মতো সরু হাত দিয়ে সড়কি-তলোয়ার চালাবি কী করে? আর অমন মিহিন গলায় হা-রে-রে-রে বলে হাঁকাড় ছাড়লে যে শিয়ালের ডাকের মতো শোনাবে! সব জিনিসেরই একটা প্রশিক্ষণ আছে, বুঝলি!"
খাঁদু ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, "দুনিয়ায় কত কী শেখার আছে কর্তাবাবা, কিন্তু শেখায় কে বলুন! অমন রাখালহরির ভাইপো হয়ে আজ অবধি হাতেখড়িটাও হয়ে উঠল না। তেমন শিক্ষকই বা দেশে কোথায় বলুন?"
"তার আর ভাবনা কী? আমার কাছে থাক, দু'মাসে তৈরি করে দেব।"
খাঁদু তাড়াতাড়ি নসিরামের পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে আর মাথায় ঠেকাল, ধরা গলায় বলল, "আজ্ঞে, আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম!"
নরহরি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, "কর্তাবাবা, এই যে কোদাল এনেছি!"
নসিরাম ভারী অবাক হয়ে বললেন, "কোদাল! কোদাল দিয়ে কী হবে রে?"
"ডাকাতটাকে জ্যান্ত পুঁতবেন বলে গর্ত করতে বললেন যে!"
নসিরাম নাক কুঁচকে বললেন, "আরে দুর! এটাকে ডাকাত বললে ডাকাতের অপমান হয়। আগে এটাকে তাগড়াই একটা ডাকাত বানাই, তবে তো জ্যান্ত পুঁতবার কথা ওঠে। এরকম একটা হাড়জিরজিরে সিড়িঙ্গে চেহারার ডাকাতকে পুঁতে কি জুত হয় রে? লোকে যে ছ্যা-ছ্যা করবে, তুই বরং এর জন্য একগোছা রুটি আর একবাটি গরম ডালের ব্যবস্থা কর। দুপুরে মুরগির সুরুয়া, রাতে পাঁঠার মাংস। লাঠি-সড়কি-বল্লমগুলো বের করে ঘষেমেজে সাফ কর তো! আজ থেকেই এর ট্রেনিং শুরু।"
খাঁদু তো গিয়ে ঢুকল নসিরামের কবজায়। ট্রেনিং দেওয়ার জন্য নসিরাম ডেকে পাঠালেন নামকরা কুস্তিগীর বটেশ্বর আর বিশ্বেশ্বরকে। কিন্তু তারা খাঁদুকে ট্রেনিং দেবে কি, খাঁদুই তাদের একহাত নিয়ে ফেলল।
“নসিরাম বললেন, "ওরে বিশু, ওরে বটু, দ্যাখ তো বাবা, এই টিঙটিঙে ডাকাতটাকে মানুষ করতে পারবি কিনা।"
ডাকাত শুনে একটু ভড়কে গিয়ে বটেশ্বর বলে উঠল, "ওরে বাবা! ডাকাত তো সর্বনেশে ব্যাপার কর্তা! বাঘা কুকুর পুষুন, দুষ্টু গোরু পুষুন, এমনকী বাঘ-সিংহ পুষুন, তাও ভাল। কিন্তু ডাকাত পোষাটা আপনার ঠিক হচ্ছে না।"
নসিরাম গম্ভীর হয়ে বললেন, "আহা, ওসব তো সবাই পোষে। ওতে মজা নেই। ডাকাত পোষা একটা নতুন ব্যাপার তো!"
বিশ্বেশ্বর নীরবে খাঁদু গড়াইকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, "কত দর পড়ল কর্তা? তা যাই দর দিয়ে থাকুন, বড্ড ঠকে গেছেন। এই অচল ডাকাত কে আপনাকে গছিয়ে গেল? এ ডাকাত এ পরগনায় চলবে না।"
নসিরাম অবাক হয়ে বলেন, "বলিস কী রে? এক্কেবারে অচল নাকি?"
"দরকচা মারা চেহারা দেখছেন না? এরকম পাকানো শরীরে কি মাংস লাগে? লাগলেও খরচা মেলা পড়ে যাবে। তারপর ধরুন, এ-পরগনার সব ডাকাতই হল রীতিমতো পালোয়ান। প্রহ্লাদ ডাকাত এখনও বেঁচে। লোকে বলে, প্রহ্লাদ না জল্লাদ। ওই নামে একখানা পালাও বেঁধেছিল হরিহর নিয়োগী। সেই পালা বিষ্টুপুরে সাত দিন ধরে ডবল শো হাউসফুল গিয়েছে। স্বয়ং প্রহ্লাদ সেই পালা দেখে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল। আর শুধু প্রহ্লাদই বা কেন, মোটকা মল্লিক, টেকো টগরকুমার, গুঁফো গণেশ, হাড়ভাঙা হারাধন, লেঠেল ললিত, মারকুটে মহেশ, চাকু চপল, সড়কি সতীশ, বাঘা বগলা, কার পাশে একে দাঁড় করাবেন বলুন তো!"
নসিরাম একটু দমে গিয়ে বলেন, "না রে, যতটা ভাবছিস ততটা নয়। এলেম আছে। এই তো বারোখানা রুটি আর একবাটি ডাল সেঁটে দিল। সঙ্গে এক খাবলা বেগুনপোড়া। তার উপর গায়ে ডাকাতের রক্তও আছে তো। ওর খুড়ো নাকি মস্ত ডাকাত!"
বিশ্বেশ্বর অবাক হয়ে বলে, "নাকি? তা তোমার খুড়োর নাম কী হে?"
খাঁদু বিনয়ের সঙ্গেই বলল, "আজ্ঞে, রাখালহরি গড়াই।"
বিশ্বেশ্বর একটু ভেবে মাথা নেড়ে বলল, "না, এ-পরগনার নয়।"
নসিবাবু একটু তোয়াজ করে বললেন, "একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখ না বাবা। ডলাইমলাই করলেই দেখবি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। আমার তো দেখেই মনে হয়েছিল, এর ভিতরে ডাকাতির জীবাণু একেবারে বিজবিজ করছে।"
"আপনি যখন বলছেন কর্তা, তখন দেখাই যাক। ওহে বাপু, একটু উঠে দাঁড়াও তো!"
খাঁদু উঠবার আগেই দুই পালোয়ান দু'দিক থেকে এসে তার নড়া ধরে হ্যাঁচকা টানে খাড়া করে দিল। বটু বলল, "প্রথমটায় একটু হাল্কা কাজই দিচ্ছি। দুশো বৈঠক মারো তো বাপু!"
খাঁদুর চোখ কপালে উঠল, "দুশো। বলেন কী মশাই! ইসকুলে অবধি দশবারের বেশি ওঠবস করায় না! এই ভরা পেটে বেশি নড়াচড়া করলে বদহজম হবে যে! অম্বল হয়ে যাবে।"
বিশু নসিবাবুর দিকে চেয়ে বলে, "শুনলেন, কর্তা? ডাকাতের অম্বল হয় কখনও শুনেছেন?"
নসিবাবু হেঁকে বললেন, "ওরে, ঠিকই বৈঠক মারবে। একটু কোঁতকা-টোঁতকা দিয়ে দ্যাখ না? আড় ভাঙতেই যা সময় লাগে।"
বিশু পট করে খাঁদুর বাঁ পাঁজরে দু'আঙুলে একটা খোঁচা মারতেই খাঁদু 'বাপ রে' বলে লাফিয়ে উঠল।
বিশু মাথা নেড়ে বলল, "এঃ, এ যে এক্কেবারে ভুসিমাল গছিয়ে গিয়েছে আপনাকে কর্তা। পাঁজরার হাড় তো প্যাকাটির মতো মুড়মুড় করছে।"
বটুও খুব চিন্তিত মুখে বলল, "দাবনায় তো মাংসই নেই কর্তা!" নসিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, "শোন বাপু, একটা গ্যাট্টাগোট্টা চেহারার লোক পেলে তাকে তৈরি করা তো সোজা কাজ। তাতে কি মজা আছে কিছু? এই তালপাতার সেপাইকে যদি পালোয়ান না বানাতে পারলি তবে কীসের মুরোদ তোদের?"
বিশু লজ্জিত মুখে বলল, "তা কর্তা যখন বলছেন, মেহনত করলে অচল পয়সাও যখন চালানো যায়, তখন আমরাও চেষ্টা করে দেখব। আপনার একটু খরচাপাতি যাবে, এই যা!"
বটু খাঁদুর দিকে চেয়ে বলল, "কী হে বাপু, বৈঠক মারবে, নাকি ফের খোঁচাখুঁচি করতে হবে।"
খাঁদু পিটপিট করে দু'জনের দিকেই ভয়ে ভয়ে চাইল। তারপর বলল, "যে খোঁচা মেরেছেন মশাই, তাতেই তো শরীর ঝনঝন করছে। বৈঠক যে মারব, হাঁটুতে যে জোর পাচ্ছি না মোটে। তা জোরাজুরি যখন করছেন তখন অগত্যা মারতেই হয়।"
বলে খাঁদু টপাটপ বৈঠক মারতে শুরু করল।
নসিবাবু কড় গুণে হিসেব রাখতে রাখতে মাঝে মাঝে তারিফ করে উঠতে লাগলেন, "বাহবা!... বহোত আচ্ছা!... চালিয়ে যা বাবা!... বাঃ বাঃ, এই তো দিব্যি হচ্ছে।"
তা হলও। বটু আর বিশুও হাঁ করে দেখল, খাঁদু গড়াই দিব্যি দুশোটা বৈঠক মেরে একটু হ্যাঁদাতে হ্যাঁদাতে বলল, "হল তো মশাই! এবার খ্যামা দিন।"
দুশো বৈঠক মারা যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা বটু আর বিশু ভালই জানে। ছোঁড়া যে অত বৈঠক একবারে মেরে দেবে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি।
বিস্ময়টা চেপে রেখে বটু বলল, "মন্দ নয়। তবে এ তো অল্পের উপর দিয়ে গেল। এবার তোমার পাঞ্জার জোরটা যে একটু দেখাতে হচ্ছে বাপ। এই যে আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে দিলুম, তুমিও তোমার পাঁচ আঙুল দিয়ে কষে ধরো। যে যার ডান দিকে মোচড় দিতে হবে। বুঝলে?"
নসিবাবু বিশুকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, "ওরে, তুই একটু হিসেব করে মোচড় দিস। তোর তো হাত নয়, বাঘের থাবা, বেচারার কবজিটা আবার মট করে ভেঙে দিস না বাবা!"
"না, কর্তা! হিসেব করেই দিচ্ছি।"
কিন্তু বিশুর হিসেব একটু উলটে গেল। কারণ, খাঁদু গড়াইয়ের রোগাপানা হাতখানাকে যত দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর কথা, ততটা দেখায়নি বিশু। সে বেশ বাঘা হাতে চেপে ধরে পেল্লায় একটা মোচড় মেরেছে। কিন্তু এ কী! খাঁদু গড়াইয়ের দুবলা হাতখানা মোটেই পাক খেয়ে গেল না। বরং তার সরু আঙুলগুলো লোহার আআঁকশির মতো বেশ বাগিয়ে ধরে আছে বিশুর মোটা মোটা আঙুল। কবজি টসকাল না, বরং যেন একটু একটু করে ডান দিকে ঘুরে যেতে লাগল। মিনিটখানেক একভাবে থাকার পর আচমকাই একটা রাম মোচড়ে বিশুর হাতখানা উলটে দিল খাঁদু। বিশু 'বাপ রে' বলে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে অ্যাই বড় বড় চোখ করে খাঁদুর দিকে চেয়ে রইল।
নসিবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, "শাবাশ!"
কিন্তু ব্যাপারটা বিশ্বাস্যই নয়। বটু বা বিশু কেউ বিশ্বাস করতেই পারছিল না যে, এই রোগাপটকা লোকটা বিশুকে গোহারান হারিয়ে দিয়েছে।
নসিবাবু বললেন, "বলি ব্যাপারটা কী হল বল তো? ইচ্ছে করে হেরে গেলি নাকি?"
বিশু গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, "না, কর্তা, এর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে।"
"কী ব্যাপার?"
"এ-লোকটা মন্তরতন্তর জানে। বোধহয় পিশাচসিদ্ধ।"
নসিবাবু হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, "দুর, দূর! মন্তরতন্তর সব কুসংস্কার। মস্তরে কাজ হলে আর লোকে এত কসরত করত না। বোমা-বন্দুকও রাখত না। ওসব নয় রে। এই খাঁদু গড়াইয়ের ভিতরে খাঁদু ডাকাত ফুঁসছে। ও আমি দেখেই চিনেছিলাম। তোরাই কেবল তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিলি।"
অপমানটা বটুর ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। সেও মন্তরতন্তরে বিশ্বাসী নয়, ডাকাবুকো লোক। সে হাতে হাত ঘষে দন্ত কিড়মিড় করে বলল, "কর্তা, যদি অনুমতি দেন আমি এ-ব্যাটাকে একটু যাচাই করি।"
খাঁদু ককিয়ে উঠে বলল, "আর না, আর না। আমি হেরে গিয়েছি বলেই ধরে নিন না কেন।"
নসিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, "ওরে, জীবনে কি পরীক্ষার শেষ আছে? সীতার অগ্নিপরীক্ষার পরও কি বনবাস হয়নি? হারার আগেই হেরে যাবি কেন? তোর রক্তে যে এক ডাকু ডাকহাঁক করছে, শুনতে পাস না আহাম্মক। যা, এটাকেও হারিয়ে দে।"
বটু বলল, "শোনো বাপু, এবার আর পাঞ্জার লড়াই নয়। আমরা দু'জনেই দু'জনকে চেপে ধরব। যে চেপে অন্যের দম বের করে দিতে পারবে তার জিত। বুঝলে?"
খাঁদু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, "বুঝেছি। আজ বুঝি আমার প্রাণরক্ষা হল না। অপঘাতে মরলে কী গতি হবে কে জানে!"
নসিবাবু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, "ওরে, গতি নিয়ে ভাবিসনি। নিতান্তই যদি মরিস তবে তোর বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করব। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন করাব। চাস তো গয়ায় গিয়ে পিন্ডিও দিয়ে আসব। সে এমন শ্রাদ্ধ হবে যে, তার ঠেলায় একেবারে স্বর্গের সিংহদরজায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বি। দেখে নিস।"
খাঁদু ঘাড় নেড়ে বলল, "যে আজ্ঞে, তবে আর কথা কী? কিন্তু, দুঃখের কথা কী জানেন, শ্রাদ্ধের ভোজটা যে আমার ফাঁক যাচ্ছে! লোকে যখন ঢেঁড়েমুশে সাপটে ভোজ খাবে তখন যে আমার কপালে হাওয়া ছাড়া কিছুই জুটবে না।"
নসিবাবু মোলায়েম গলায় বলেন, "তা তুই চাস কী?"
"আজ্ঞে, বলছিলাম, ভোজের আগাম বাবদ যদি কিছু মূল্য ধরে দিতেন তা হলে বুকটা ঠান্ডা হত।"
"সে আর বেশি কথা কী? এই যে, পঞ্চাশটা টাকা রাখ। তুই যে
এত ঘোড়েল তা এতক্ষণ বুঝতে পারিনি।"
টাকাটা ট্যাঁকে গুঁজে খাঁদু একগাল হেসে বলল, "আজ্ঞে কর্তাবাবা, ট্যাঁকে টাকাপয়সা থাকলে মানুষের একটু জোর হয়। সত্যি কথা বলতে কী, এখন যেন হাত-পায়ে একটু সাড় ফিরেছে।"
বটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে মিনমিন করে বলল, "কর্তা, একটা কথা..."
"তোর আবার কী কথা?"
"আজ্ঞে, বলছিলাম কী, আমাদেরও তো বাঁচা-মরা আছে, শ্রাদ্ধের ব্যাপার আছে। আমাদেরও তো নিজের শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে ইচ্ছে হতে পারে, নাকি? তাই বলছিলাম যে..."
নসিবাবু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, "তোর মতো জাম্বুবান যদি এই টিঙটিঙে তালপাতার সেপাইয়ের হাতে মরে, তা হলে এ-গাঁয়ে কেউ আর তোর মুখ দেখবে ভেবেছিস? শ্রাদ্ধ তো দূরের কথা, তোকে শ্মশানে নেওয়ারও লোক জুটবে না। নিজেকেই হেঁটে শ্মশানে গিয়ে নিজের মড়া নিজেকেই পোড়াতে হবে। বুঝেছিস?"
বটু মাথাটাথা চুলকে ঘাড় নেড়ে বলল, "বুঝেছি।"
"আরও ভাল করে বুঝে দ্যাখ। যদি প্রাণের ভয় থাকে তো মানে মানে বিদেয় হ। আমি গাঁয়ে রটিয়ে দেব যে, তুই একটা রোগা-দুবলা লোকের ভয়ে ন্যাজ দেখিয়েছিস। তা হলে কি গাঁয়ে তোর মান থাকবে, নাকি তোর কুস্তির আখড়ায় আর কেউ কোনওদিন যাবে?"
বটু একথায় ফুঁসে উঠে বলল, "এই ছারপোকাটাকে ভয়! হাঃ হাঃ। কর্তা কী যে বলেন। এক্ষুনি এর দম বের করে দিচ্ছি।"
বলেই তেড়ে এসে খাঁদুকে জাপটে ধরল বটু। ঠিক যেমন লৌহ-ভীম চূর্ণ করতে ধৃতরাষ্ট্র জাপটে ধরেছিলেন। খাঁদু সেই ভৈমী চাপে কোঁক করে উঠল। তারপর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সেও সাপটে ধরল বটুকে। তারপর বিশালদেহী বটু খ্যাংরাকাঠির মতো খাঁদুকে পিষে ফেলতে লাগল আসুরিক হাতে। প্রথমটায় মনে হচ্ছিল বটে যে, এ বড় অন্যায্য লড়াই হচ্ছে। হেভিওয়েটের সঙ্গে মসকুইটোওয়েট। খাঁদুর হাড়-পাঁজর মড়মড় করে ভেঙে বুকের খাঁচাটাই যাবে গুঁড়িয়ে। ওই চাপে দম বেরিয়ে গেলেই শেষ। কিন্তু দেখা গেল, খাঁদু পেষাই হয়েও দমখানা ঠিক ধরে রেখেছে। মোটেই টসকাচ্ছে না।
মিনিট পাঁচেক গলদঘর্ম হওয়ার পর বটু যখন একটু দম নিয়ে ফের কষন দিতে যাচ্ছে, তখন খাঁদু একটা গা-ঝাড়া দিয়ে টুক করে বটুর নাগাল থেকে বেরিয়ে এল।
বটু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ কপালে তুলে বলল, "এ কার পাল্লায় পড়েছেন কর্তা? এ তো মনিষ্যিই নয়।"
"বলিস কী? দিব্যি দেখতে পাচ্ছি দুটো হাত, দুটো পা, ধড়ের উপর মুন্ডু, মানুষ বলেই তো মনে হচ্ছে!"
বটু মাথা নেড়ে বলে, "না কর্তা, যে কষন দিয়েছিলাম তাতে যে-কোনও পালোয়ানেরই দম বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ যেন পাঁকাল মাছ। কেমন পিছলে বেরিয়ে গেল দেখলেন না! মনিষ্যি হলে পারত?"
"মানুষ নয়! তা হলে কি ভূত?"
বটু ফের মাথা নাড়া দিয়ে বলে, "তা জানি না কর্তা। বরং একবার পালান ওঝাকে ডেকে একটু যাচাই করে নেবেন। পেন্নাম হই, আমরা তা হলে আসি..."
বেশ বোঝা যায়, খাঁদু যে সে লোক নয়।
সব এলাকাতেই একজন সব কাজের কাজী গোছের মানুষ থাকে। দ্বিজপদ তেমন মানুষ। সে একাধারে এই গাঁয়ের ইঞ্জিনিয়ার, সায়েন্টিস্ট, ডাক্তার, দার্শনিক, ভবিষ্যদ্বক্তা, ডিটেকটিভ এবং পরামর্শদাতা। সে ম্যাজিক জানে, কুংফু ক্যারাটে জানে, লাঠি বা তরোয়ালও চালাতে পারে বলে শোনা যায়। দ্বিজপদ কাশীবাবুকে বলে খাঁদুর ওপর নজরদারি করতে। কাশীবাবু কি আর সহজে রাজি হন!
“শক্ত কাজ করলে যে আপনার অম্বল হয়, এ-কথা কে না জানে! কাজটা শক্ত তো নয়ই, বরং কাজ বললেও বাড়াবাড়ি হয়। কাজ না বলে বরং বলা ভাল, এই একজনকে একটু চোখে-চোখে রাখা আর কী।"
"আহা, সে আর শক্ত কী? নড়াচড়া বেশি না করতে হলেই হল, হুড়যুদ্ধ যে আমার সয় না, এ তো তুমি ভালই জানো!"
"তা আর জানি না! আপনার হল আদরের শরীর, সেবার আপনার দাদু শশীরামের হাম হওয়ায় তিনি হাটে যেতে পারেননি, তাই হাটবারে আপনাকে মোট আড়াই কেজি আলু বয়ে আনতে হয়েছিল বলে আপনি এক হপ্তা শয্যাশায়ী ছিলেন, সে কথা কি ভোলা যায়? তারপর সেই যে আপনার বাবামশাই নসিরাম একখানা ছোট তোশক ছাদে নিয়ে রোদে দিতে বলায় আপনার কম্প দিয়ে জ্বর এসেছিল, সে-কথা কি বিস্মরণ হওয়ার? তারপর ধরুন, গত বছর যে আপনি গোরুর গাড়ির ধর্মঘটের দরুন দেড় মাইল হেঁটে মাসির বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে দেড় ডজন রসগোল্লা খেয়েই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, সে-কথা বলে যে মাসি আজও হা-হুতাশ করেন, এ-কথা কে না জানে বলুন! আপনাকে শক্ত কাজ দিলে ভগবান কি আমাকে ছেড়ে কথা কইবেন?"
"আরে, ওসব পুরনো কথা আবার কেন? কাজের কথাটাই হোক না! কার উপর নজর রাখতে হবে?"
"আজ্ঞে, লোকটার নাম খাঁদু গড়াই।"
"ওরে বাবা! শুনেই বুকটা কেমন করছে! তা ছাড়া উঁকিঝুঁকি মারা খুব খারাপ। উঁকিঝুঁকি মারলে আমার বড় গা শিরশির করে।"
দ্বিজপদ খুব চিন্তিত মুখে ছাদের দিকে চেয়ে গলা চুলকোতে চুলকোতে বলল, "তাই তো কাশীদা, বড় মুশকিলে ফেলে দিলেন। ভাবছি, বিজয়বাবুকে এখন কী বলি! সম্বন্ধটা যখন আমিই করেছি, তখন আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। তিনি বড় আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন যে!"
কাশীবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, "আহা, বিজয়বাবুকে আবার এর মধ্যে টানা কেন?"
"তিনি সাতবেড়ের শিকারি বিশ্বজয় রায়ের নাতি। বাবা ভুবনজয়ও ছিলেন পক-প্রণালী জয়ী বিখ্যাত সাঁতারু, কামট, কুমির, হাঙরকেও ডরাতেন না। আপনি যে এত ভিতু, সেটা পাঁচকান হলে বিজয়বাবু তাঁর মেয়ে কুঁচির সঙ্গে আপনার বিয়ে দেওয়ার কথা আর কখনও উচ্চারণ করবেন কি? তাঁর তো ধারণা শশীরামের নাতি, নসিরামের ছেলে কাশীরামও বাপ-দাদার মতোই ডাকাবুকো লোক।"
"আচ্ছা, আচ্ছা, না হয় খাঁদু গড়াইয়ের উপর নজর রাখব'খন। ও আর এমন কী শক্ত কাজ?"
"কাজ খুবই সোজা। খাঁদু কখন খায়, কখন ঘুমোয়, বাঁ ধারে কাত হয়ে ঘুমোয়, না ডান ধারে, হাঁ করে ঘুমোয় কিনা, নাক ডাকে কিনা, এই সব আর কী! তারপর ধরুন, দুপুরে বা নিশুতরাতে কোনও সন্দেহজনক লোক তার কাছে যাতায়াত করে কিনা বা সে কাউকে কোনও ইশারা ইঙ্গিত করে কিনা। কিংবা তার ঝোলায় কোনও অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা। পারবেন না?"
কাশীবাবু আমতা আমতা করে বললেন, "তা পারা যাবে বোধহয়।"
"খুব পারা যাবে, খুব পারা যাবে। তারপর শুধু নজর রাখাই নয়, মাঝে মাঝে তার কাছে গিয়ে একটু খেজুরে আলাপও জুড়ে দেবেন। এই জিজ্ঞেস করলেন, 'বাপু হে, তুমি কি মিষ্টি পছন্দ করো, না ঝাল? লাল রং ভালবাসো, নাকি বেগুনি? ঠান্ডা ভাল না গরম?' এরকম আগড়ম-বাগড়ম যা খুশি বলে গেলেই হল, দেখবেন কথার ফাঁকে হয়তো টক করে আসল কথাটা বেরিয়ে আসবে।"
কাশীবাবুর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নিয়ে বললেন, "সে তো বুঝলুম, কিন্তু আসল কথাটা কী?"
"সে কি আমিই জানি। এ হল ছিপ ফেলে বসে থাকার মতো ব্যাপার, মাছ উঠবে কিনা তার ঠিক নেই।"
ওদিকে এলাকার বাকি সব চোর ডাকাত ছিনতাইবাজেরা পড়েছে মহা ফাঁপরে। রীতিমতো মিটিং ডেকে ভোট নিয়ে তারা ঠিক করল, রাখালহরির ভাইপোকে তারা কিডন্যাপ করবে। বলা হবে, রাখালহরি যদি ভাইপোকে ফেরত পেতে চায়, তবে তাকে এলাকার চোর ডাকাতদের শর্ত মেনে তাদের ওপর ডাকাতি করার মতলব ছাড়তে হবে। রাখালহরির নেটওয়র্ক লা-জবাব। সে মিটিংয়ের একজনের ফোন হ্যাক করে সবটুকুই শুনে ফেলেছে এবং ভাইপো উদ্ধারে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে। ভাইপোকে সে দেখেছে খুব ছোট বয়েসে। কানের ওপর ঘুড়ির সুতোয় কেটে যাওয়ার দাগ থাকবে এটুকুই সে শুধু বলতে পেরেছে।
নজরে রাখার কাজ কিন্তু কাশীবাবুকে দিয়ে তেমন হল না। খাঁদু ভারী চালাক চোস্ত লোক, ইচ্ছে করে সে আরোই ঘেঁটে দিল কাশীবাবুর মাথাটা।
“খাঁদু মাথা নেড়ে বলে, "ভাল লোক তো কারও গায়ে লেখা থাকে না মশাই। চোখে চোখে রাখাই বিচক্ষণতার কাজ। উঁকিঝুঁকি মারারও কোনও দরকার নেই। সোজা এসে আমার নাকের ডগায় গেড়ে বসে বলবেন, 'তোমার উপর নজর রাখছি হে।'"
কাশীবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, "সেটা কি ভাল দেখাবে? তুমি তো কিছু মনে করতেও পারো!"
"না, মশাই না। আনাড়ি লোকদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে আমি বড় ভালবাসি। গোলমেলে লোকদের উপর কী করে নজর রাখতে হয়, কী করে তাদের পেটের কথা টেনে বের করতে হয়, তার দু'-চারটে কায়দা আপনাকে শিখিয়ে দেব'খন।"
কাশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্বিজপদও এরকমই কী যেন বলছিল।"
"পাকা মাথার লোক তো বলবেই। তবে কিনা নজর রাখাও বড় চাট্টিখানি কথা নয়। আপনি হয়তো উঁকি দিয়ে দেখলেন, আমি বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে হাঁ করে ঘুমোচ্ছি। ভাবলেন, আহা, খাঁদু ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোক, আমিও গিয়ে তা হলে একটু গড়িয়ে নিই। ব্যস, ওইখানে মস্ত ভুল করে ফেললেন। ওই যে বাঁ দিকে কাত হয়ে শোওয়া, হাঁ করে থাকা, ও-সবই হচ্ছে নানারকম সংকেত, ওর ভিতর দিয়েই কথা চালাচালি হয়ে যাচ্ছে, আপনি ধরতেও পারলেন না।"
"অ্যাঁ!" বলে মস্ত হাঁ করলেন কাশীবাবু।
"হ্যাঁ মশাই, শুধু কি তাই, যদি নাক ডাকে তা হলে জানবেন ওই সঙ্গে আরও মেসেজ চলে গেল। নাক ডাকারও আলাদা অর্থ আছে, যা আপনার জানা নেই। তারপর ধরুন, আমি হয়তো বসে বসে হাই তুলছি বা আঙুল মটকাচ্ছি বা আড়মোড়া ভাঙছি, ভুলেও ভাববেন না যে, আলসেমি করছি। ও সবই হল নানারকম ইশারা ইঙ্গিত। আপনি যেমন আমার উপর নজর রাখছেন, তেমনই বাইরে ওই পাঁচিলের উপর বা ঝুপসি আমগাছের ডালপালার ভিতর থেকে দূরবিন কষে আর কেউও আমার দিকে নজর রাখছে। আর সব টুকে নিচ্ছে।"
খাঁদুর ঘর থেকে বেরিয়ে কাশীবাবু বাগানে বসে সদ্যশেখা নজরদারির এবিসিডি নিয়ে আকাশপাতাল ভাবতে ব্যস্ত। এমন সময় পুলিশ সেজে রাখালহরির লোকেরা হাজির। যদিও চর্বির পরত জমেছে, তবু কাশীবাবুর চেহারা বেশ তাগড়াই। আবার তিনিও ছেলেবেলায় ঘুড়ির সুতোয় কান কেটে ফেলেছিলেন। পুলিশরা তাঁকে ঝটপট দড়ি পড়িয়ে গাড়িতে তোলার তোড়জোড় করতে লাগল। এমন সময় দাদু শশীরাম এসে হাজির।
“বাজখাঁই গলায় বললেন, "আমার বাড়িতে পুলিশ কেন হে? কী হয়েছে?"
কর্তাগোছের লোকটা বিনয়ের সঙ্গেই বলল, "আমরা এঁকে অ্যারেস্ট করতে এসেছি। এই যে ওয়ারেন্ট।”
শশীরাম ওয়ারেন্টের কাগজখানাকে মোটে গ্রাহ্যই করলেন না। গলাটা নামিয়ে বললেন, "ওরে বাপু, চার্জটা কীসের সেটা বললেই তো হয়।"
"আজ্ঞে, ডাকাতির। তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিক ডাকাতি।"
শশীরাম বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, "বলো কী হে? সত্যি নাকি? না মশকরা করছ?"
"আজ্ঞে, মশকরা নয়।"
শশীরাম ভারী আহ্লাদের সঙ্গে একগাল হেসে বললেন, "ডাকাতির কেস, ঠিক তো!"
"আজ্ঞে, ডাকাতির কেসই।"
শশীরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে লাঠিসুদ্ধু দু'হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, "জয় মা কালী! জয় করালবদনী! এত দিনে মুখ তুলে চাইলে মা! ওরে ও নসে! ও গিন্নি! ও বউমা! আরে তোমরা সব ছুটে এসো। দ্যাখো, আমাদের কেশো কী কাণ্ড করেছে। আগেই জানতুম, এই বীরের বংশে কাপুরুষ জন্মাতেই পারে না!"
হাঁকডাকে নসিরাম ছুটে এলেন। পিছু পিছু কাশীবাবুর ঠাকুরমা কমলেকামিনী দেবী, মা নবদুর্গা।
নাতির অবস্থা দেখে কমলেকামিনী দেবী ডুকরে উঠলেন, "ওরে এই অলপ্পেয়ে মিনসেগুলো কে রে, আমার কেশোকে অমন করে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধেছে! আঁশবঁটিটা নিয়ে আয় তো রে মালতী, দেখি ওদের মুরোদ!"
শশীরাম গর্জে উঠে বললেন, “খবরদার, ওসব কোরো না। ওরা আইনমাফিক কাজ করছে। যাও বরং, শাঁখটা নিয়ে এসো। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি করো সবাই। এত দিনে ব্যাটা বুকের পাটা দেখিয়েছে!"
কমলেকামিনী দেবী আকাশ থেকে পড়ে বললেন, "শাঁখ বাজাব! উলু দেব! কেন, কোন মোচ্ছব লেগেছে শুনি! আমার দুধের বাছাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ! আজ কোথায় তোমার বীরত্ব? হাতের লাঠিগাছা দিয়ে দাও না ঘা কতক।"
শশীরাম মাথা নেড়ে বললেন, "না, না, ও তুমি বুঝবে না। স্নেহে অন্ধ হলে কি এসব বোঝা যায়! এত দিনে তোমার কেশো মানুষের মতো মানুষ হল, বুঝলে! ওই ম্যাদামারা, নাদুসনুদুস, অপদার্থ, কাপুরুষ ছেলে কি এ-বংশে মানায়! আজ ছাইচাপা আগুন বেরিয়ে পড়েছে গিন্নি, আজ দুঃখের দিন নয়, আনন্দের দিন।"
নসিরাম প্রথমটায় ব্যাপার বুঝতে পারেননি। এখন খানিকটা বুঝে তিনিও গোঁফ চুমরে বললেন, "ডাকাতি করেছে নাকি ব্যাটা?"
শশীরাম বুক চিতিয়ে বললেন, "তবে! ডাকাতি বলে ডাকাতি? তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি। এই তো পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে দ্যাখো না।"
নসিরাম পুলিশের সর্দারকে বললেন, "সত্যি নাকি?"
"যে আজ্ঞে।"
কাশীরাম এতক্ষণে ফাঁক পেয়ে বললেন, "না, না, এসব বানানো গল্প।"
নসিরাম গর্জন করে বললেন, "চোপ! ডাকাতি করেছিস তো করেছিস। তার জন্য অত মিনমিন করে কাঁদুনি গাওয়ার কী আছে! বুকের পাটা আছে বলেই করেছিস। মাথা উঁচু করে জেল খেটে আয় তো দেখি!"
নসিরাম আহ্লাদে ফেটে পড়ে বললেন, "আহা, ডাকাতি তেমন খারাপ জিনিসই বা হতে যাবে কেন? চেঙ্গিস খাঁ থেকে আলেকজান্ডার, সুলতান মামুদ থেকে ভাস্কো ডা গামা, কে ডাকাত নয় রে বাপু? আগেকার রাজারাজড়ারাও তো বাপু, বকলমে ডাকাত ছাড়া কিছু নয়। রবিন হুডকে নিয়ে তবে নাচানাচি হয় কেন? ও গিন্নি, ওকে বরং একটা চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দাও। ওরে তোরা শাঁখ বাজা, উলু দে, পাঁচজনে জানুক।"
নবদুর্গা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, "ও যে রাতে দুধভাত খায়, নরম বিছানা ছাড়া শুতে পারে না, ভূতের ভয়ে একলাটি থাকতে পারে না, জেলখানায় গেলে কি ও আর বাঁচবে! সেখানে লপ্সি খাওয়ায়, কুটকুটে কম্বলের উপর শুতে দেয়, মারধর করে। খবর রটলে যে বিনয়বাবু কুঁচির সঙ্গে ওর বিয়ে ভেঙে দেবেন।"
শশীরাম মোলায়েম গলায় বললেন, "বীরের জননী হয়ে কি তোমার এসব বিলাপ মানায় বউমা? আপাতদৃষ্টিতে ডাকাতি জিনিসটা ভাল নয় বটে, কিন্তু এ তো ভেড়ুয়াদের কাজ নয় বউমা। পুরুষকার লাগে। কেশোর ভিতরে যে পুরুষকার জেগেছে তা কি টের পাচ্ছ? আহা, আজ যে আনন্দে আমার চোখে জল আসছে!"
বলে শশীরাম ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন।
নসিরাম পুলিশের দিকে চেয়ে বললেন, "ওহে বাপু, তোমাকে তো ঠিক চেনা চেনা ঠেকছে না!"
"আজ্ঞে, এই সবে নতুন বদলি হয়ে এসেছি।"
"আর তোমাদের কানাইদারোগা! সে এল না?"
"আজ্ঞে, তিনি আর-একটা থানায় বদলি হয়ে গেছেন।"
শশীরাম বললেন, "খুব ভাল হয়েছে। কানাইদারোগা কোনও কম্মের নয়। ওরে বাপু, তোর নাকের ডগায় একটা লোক তিন-তিনটে ডাকাতি করে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তোর হুঁশই নেই! ওহে বাপু, তোমাদের একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়ছি না। ওরে নরহরি, যা তো, দৌড়ে গিয়ে হারুময়রার দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে আয়।"
নরহরি পড়ি-কি-মরি করে ছুটল।
শশীরাম পুলিশ অফিসারটিকে ভারী বন্ধুর মতো বললেন, "শোনো বাবারা, জাঁতা পেষাই করাবে, পাথর ভাঙাবে, ঘানিগাছে ঘোরাবে। কোনওটা যেন ফাঁক না যায়। একেবারে মজবুত করে গড়ে দাও তো বাবা ছেলেটাকে।"
ছোকরা মুচকি হেসে বলল, "ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমাদের হাতে পড়লে দু'দিন পরেই এঁর ভোল পালটে যাবে।"
"খুব ভাল, খুব ভাল, তা তোমরা দুর্গা দুর্গা বলে এসো গিয়ে। দেরি করে কাজ নেই। শুভ কাজে কখন কী বাধা এসে পড়ে, বলা তো যায় না।"
নরহরিও হাঁপাতে হাঁপাতে রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়ে গেল। চারজন পুলিশ টপাটপ রসগোল্লা সাফ করে দিল কয়েক মিনিটেই। তারপর জিপে উঠে কাশীবাবুকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
কমলেকামিনী দেবী এবং নবদুর্গা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
ওদিকে অন্য সব চোর ডাকাতের দ্বিতীয় দলটি কীর্তনীয়া সেজে খাঁদুকে তুলে নিয়ে গেছে।
গল্পের দারোগা কানাইবাবু। তিনি ঘুষখোর। তিনি অলস। তাঁর এলাকায় চোর ডাকাতরা মিটিং করে, বিরিয়ানি রেঁধে ভোজ দেয়, এতে তাঁর কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু সম্প্রতি এলাকার জঙ্গলে থানা গেড়েছে রাখালহরি ডাকাত। ওপরমহল থেকে অনবরত চাপ আসছে। ফলে কানাইদারোগার ভুঁড়ি গেছে কমে। ঘুমের সঙ্গে সঙ্গে খিদেও উধাও। মাংস-পোলাওয়ের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করে না, এতই অরুচি। ফলে তাঁর শরীর শুকোতে শুকোতে একেবারে দরকচা মেরে সিকিভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেকার জামা-প্যান্ট সব ঢলঢলে হচ্ছে বলে দরজিকে দিয়ে ছোট করাতে হয়েছে। ঘনঘন জলতেষ্টা আর বাথরুম পাচ্ছে। যতই ভাবেন ততই মাথা ঝিমঝিম করে। ডাক্তার বলেছে, রক্তচাপ খুব বেশি, উত্তেজনা একদম বারণ। আগে একজোড়া বেশ পুরুষ্টু গোঁফ ছিল কানাইবাবুর। অনেকটা ঝাঁটার মতো। রোগা হয়ে যাওয়ায় মুখে গোঁফটা মানাচ্ছে না দেখে ছেঁটে ছোট করে ফেলেছেন।
পুলিশরা তুলে নিয়ে গেছে কাশীবাবুকে। বাবা নসিবাবু থানায় এসেছেন খোঁজ নিতে। তিনি তো আর জানেন না ও পুলিশগুলো আসলে ডাকাত ছিল।
“বিশাল চেহারার নসিবাবু ভারী হাসি হাসি মুখ করে ঘরে ঢুকে বললেন, “নমস্কার দারোগাবাবু! তা আপনিই এ থানার নতুন দারোগা বুঝি। বেশ বেশ! কানাইদারোগাটা কোনও কাজের ছিল না মশাই! তার আমলেই এ তল্লাটে চুরি-ডাকাতির একেবারে মোচ্ছব লেগে গিয়েছিল। কী বলব মশাই, আমার ছেলে কাশীরাম তো তিন-তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করার পরও দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কানাইদারোগা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এই আপনি এসে তাকে পাকড়াও করলেন। তা তাকে কি সদরে চালান করা হয়েছে নাকি দারোগাবাবু? চালান করাই উচিত। সে অতি বিপজ্জনক লোক।"
কানাইদারোগা নাক কুঁচকে একটা তাচ্ছিল্যের ফুঃ দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো হাতের ভঙ্গি করে বললেন, "হুঁ, কাশীরাম করবে ডাকাতি! এ যে বানরে সংগীত গায়, শিলা জলে ভাসি যায়, মশাই! যে রাতে বিড়াল ডাকলে ভয় পায়, দু'কেজি মাল টানতে হাঁপিয়ে পড়ে, বিশ কদম হাঁটতে গিয়ে টাল্লা খায়, সে করবে ডাকাতি! তাও একটা-দুটো নয়, তিনটে! সত্যযুগ এসে গেল নাকি মশাই?"
নসিবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, "আহা, কার ভিতরে কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা কি বাইরে থেকে টপ করে বোঝা যায়? কিন্তু আপনি নতুন মানুষ, কাশীরাম সম্পর্কে এত কথা জানলেন কী করে?"
কানাইবাবু খ্যাঁক করে উঠে বললেন, "কে বলেছে আমি নতুন মানুষ? আমিই কানাইদারোগা। আপনি চোখের ডাক্তার দেখান।"
নিষ্কর্মা অযোগ্য দারোগাদের বড়ই খোরাক বানিয়ে ছেড়েছেন শীর্ষেন্দু তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে। শুধু দারোগাগুলোকে নিয়েই একটা আস্ত প্রবন্ধ লিখে ফেলা যায়।
কাশীবাবু কিন্তু ভারী আহত হয়েছিলেন। বাবা দাদু যেমন করে ঠেলেগুঁজে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তিনি ভীষণরকম শক পেলেন। আপনজনেরাই যদি এমন করে দূরে ঠেলে দেন, পর কে তবে আপনজন ভেবে নিতে কিই বা যায় আসে। রাখালহরি ডাকাতকে খুড়ো বলে ভেবে নিতে তাঁর একটুও আপত্তি হয়নি। নাদুসনুদুস কাশীবাবুকে তাঁর বাবা ঠাকুরদা অ্যাকসেপ্ট করেননি। কাশীবাবু যখন ওজন ঝরিয়ে ডাকাতদলের শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ডাকাত হয়ে নিজের বাড়ি লুটতে এলেন, তখন সেই পরিবর্তিত কাশীকে দেখে বাড়ির লোকজন চমকে উঠল। কাশীবাবুর বীরত্বের পরিচয় পেয়ে বুঁচিও বলে দিল, সে কাশীবাবুকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।
এতসবের মাঝে দেখা গেল, খাঁদু আসলে কানাইদারোগার চেয়ে ঢের ওপরের একজন মানুষ। তারই আদেশ পেয়ে কানাইদারোগা ছুটল ঘুমের স্প্রেতে অজ্ঞান হয়ে থাকা ডাকাতদলকে তুলে আনতে। ভালোয় ভালোয় কাশীবাবুও ঘরে ফিরলেন। কিন্তু এই কাশীবাবু আর আগের কাশীবাবু রইলেন না। তিনি যেমনটি ছিলেন, তেমনটি তো তাঁর আপনজনেরা পছন্দ করেননি। আহত মন নিয়ে বরাবরের জন্যই তাঁর ব্যক্তিত্বটি গেল আমূল বদলে।
বরাবরই এক জিনিস লক্ষ্য করেছি। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলি যেন সবই এক একটি সিনেমা। হাসি, মজায়, সারকাজমে ভরপুর। পরিচালকেরা গল্পগুলি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে পারেন।