ভূতুড়ে ঘড়ি : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ষষ্ঠ আখ্যান

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

পরপর দু’বার হতাশ হতে হলেও ছ’নম্বর উপন্যাসে এসে ফেরত পাওয়া গেল অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সেই আইকনিক টোন— ভরপুর মজা, খানিক মনকেমনিয়া, আর একচিমটে ভূত ভূত গন্ধ। ১৯৮৪তে প্রকাশিত হল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূতুড়ে ঘড়ি’, ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত কুড়িবছরে প্রায় পনেরোহাজার কপি ছাপা হয়েছে।

২০২৪ সালে বসে ও গল্প পড়তে গিয়ে প্রথমেই এক কাঁচুমাচু দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। গল্পের শুরুই যে হচ্ছে, ‘দাদুর ঘড়ি চুরি গেছে’ দিয়ে। যেদিকে দু’চোখ যায়, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বাড়বাড়ন্ত। দাদু, ঠাকুমা, কাকু, জেঠু সবাই একসাথে হেসেখেলে একছাদের তলায় আছে, গুটিকতক ভাগ্যবানের বাড়ি ছাড়া এমন দৃশ্য এখন শুধু বাংলা সিরিয়ালেই দেখা যায়। গল্পে একজন ভারী মিষ্টি দাদু আছেন, যিনি এটা সেটা হারানোয় পিএইচডি করে ফেলেছেন। ঠাকুমাটি দাদুকে বকেঝকে হয়রান। আছে তিনটে কুচো নাতি নাতনি— লাটু, কদম আর ছানু। আর দাদু হারানচন্দ্রের আছে তিনটি ছেলে, একজন বাদে বাকিরা বিয়ে থা করেননি। লাটু কোথাও বেরোলে সে মা’কে বলে যায়। কিন্তু মা বলেন, দাদু ঠাকুমা-র পারমিশন আগে নিতে। স্পষ্টই বোঝা যায়, ও বাড়িতে দাদু-ঠাকুমাই এখনও পরিবারের মাথা। ১৯৮৪-র সমাজে এমনটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তখন ইয়ং জেনারেশনের সঙ্গে পুরনো মাইন্ডসেটের ক্ল্যাশ তুলনামূলকভাবে কম হত। গল্পে আর একজন মজার মানুষ আছেন— জটাইদাদু বা জটাইতান্ত্রিক। ইনি লাটুদের দাদুর বন্ধু। মড়ার খুলিতে করে চা খান। সেও যার তার খুলি নয়, সাক্ষাৎ হরি ডোমের মাথার খুলি। সে নাকি ছিল বিশাল বড় তান্ত্রিক। জটাইদাদু ভূতও পুষেছেন, নাম তার বাঞ্ছারাম।

দাদু হারানচন্দ্র আজীবন তাঁর নামটাকে ভালোমতো ট্রিবিউট দিয়ে এসেছেন। তিনি তিনশো বাইশটা ঘড়ি হারিয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি পেনসিল হারাতেন। বুড়োবেলায় ঘড়ির সাথে সাথে বাঁধানো দাঁত, চশমা, চটিজুতো হারাচ্ছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো আমরা সবাই এক একটি হারানচন্দ্র। সারাজীবনে একটিবারও ছাতা হারায়নি, চশমা হারায়নি, দরকারি ফোননম্বর হারায়নি এমন মানুষ খুঁজলে একটিও মিলবে না, এ হলফ করে বলা যায়। হারানচন্দ্র নিজে অবশ্য ভারী সাবধানী মানুষ, ঘড়ি যাতে না হারায় তারজন্য ঘড়িটা রেখেছিলেন পুরনো রেডিওর ব্যাটারির খোলের ভেতর। চোর যদি আস্ত রেডিওখানাই তুলে নিয়ে যায়, তাঁর আর কী করার থাকতে পারে? ঝুটমুট বউয়ের কাছে চাট্টি গাল খেতে হল তাঁকে।

“ঘড়িটা যে রেডিওর মধ্যে ছিল তা কেউ টের পায়নি, দাদুও সেকথা তোলেননি। তবে ঠাকুমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব মুশকিল। তিনি সব দেখেশুনে হঠাৎ গিয়ে দাদুকে ধরলেন,শ

"তোমার ঘড়ি কোথায়?"

দাদু প্রথমটায় আকাশ থেকে পড়ে বললেন, "ঘড়ি! ঘড়ি নিশ্চয়ই কোথাও আছে। নিশ্চয়ই চুরি যায়নি। নিশ্চয়ই খুঁজে পায়নি ব্যাটা।"

ঠাকুমা গম্ভীর গলায় বললেন, "তবে বের করো। দেখাও।"

দাদু মাথাটাথা চুলকে বললেন, "ঘড়িটাকে চুরির মধ্যে ধরা যায় না। চোর নিয়েছে রেডিওটা। সে তো আর ঘড়ি নিতে আসেনি। তবে চুরির মধ্যে পড়বে কী করে?"

"তার মানে কী? ঘড়ি কি তুমি রেডিওর মধ্যে রেখেছিলে?"

"হ্যাঁ, কিন্তু সেটা চোরের জানা ছিল না। ফলে ঘড়িটা চুরি গেছে, এ কথাটা লজিক্যাল নয়।"

"রাখো তোমার লজিক। ফের ঘড়ি গেল, এটা নিয়ে কটা হারাল তা জানো?"

দাদু মিনমিন করে বললেন, "হারিয়েছে এমন কথাও বলা যায় না। বরং বলা যেতে পরে ঘড়িটা নিখোঁজ।”

কিছুক্ষণ এই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হল। দাদু কিন্তু বারবারই বললেন, "চুরি গেছে আসলে রেডিওটা। ঘড়িটা চোরের হাতে চলে গেছে বাই চান্স। ক্রেডিটটা চোরকে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”

তারপর তো তাঁর ছেলে শহর থেকে এনে দিল একটা সুন্দরমতো আশ্চর্য ঘড়ি! এই হল তাঁর তিনশো তেইশ নম্বর ঘড়ি। তাতে একটা নয়, তিন তিনটে ডায়াল। শকপ্রুফ, ওয়াটারপ্রুফ, অটোমেটিক। হারানচন্দ্র নিজে হাতে আছাড় মেরে জলে চুবিয়ে যাচাইও করে নিলেন। রাতে তো ঘড়ি বালিশের তলায় নিয়ে শুলেন। আর তারপরেই শুরু হল ভূতুড়ে কারবার! কারা যেন হাসে, অদ্ভুতুড়ে ভাষায় বকবক করে। হারানচন্দ্র তাঁর তান্ত্রিক বন্ধুটিকে বুজরুকির মাস্টার বলে কম হ্যাটা করেন না। কিন্তু তাঁর নিজেরই বিশ্বাসের ভিতটা যে ছিল বড় ঠুনকো। সকাল হতে না হতে হারানচন্দ্র ঘড়ি নিয়ে হাজির জটাই তান্ত্রিকের ডেরায়। ঘড়ি দিয়ে এলেন তাঁর জিম্মায়, বন্ধু যদি ঘড়ির ভূতটাকে কোনওভাবে ভাগাতে পারে! এদিকে হারানচন্দ্রের হাতে ঘড়ি নেই দেখে বাড়িতে তো আরেকপ্রস্থ বকুনি জুটল তাঁর। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না, ঘড়িটা হারানচন্দ্র সত্যিই সারাতে দিয়েছেন। এদিকে হারানচন্দ্র ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। কিছুতেই তিনি বলতে চান না ঘড়িতে ভূত আছে, তাই ঘড়ি গেছে জটাই তান্ত্রিকের জিম্মায়। অদ্ভুতুড়ে ঘড়ি কিন্তু তার খেল দেখানো শুরু করে দিয়েছে। তার সঙ্গদোষে বাড়ির সব ঘড়ির কাঁটা উলটোবাগে দৌড়চ্ছে।

ওদিকে জটাই তান্ত্রিকের ডেরায় গিয়ে ঘড়ি পাকিয়েছে আজব কান্ড। তান্ত্রিক হওয়ার সুবাদে জটাই ঘোর কালীভক্ত। তার ডেরায় মাঝে মাঝে আসে নিত্য দাস, সে আবার রাধাভক্ত। সেই যে বলে না, রতনে রতন চেনে? জটাই তান্ত্রিক আর নিত্য দাসের ব্যাপারখানা খানিক সেরকমই। দুজনেই জানে তারা মহা ধড়িবাজ,  তাই কেউ কাউকে তেমন ঘাঁটায় না। একজন ‘জয়ক্কালী’ হুংকার ছাড়ে, অন্যজন ধূর্তচোখে বিনীত সুরে ‘জয় নিতাই’  বলে। এক অদ্ভুত সখ্য গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে। ঘড়ি থেকে আওয়াজ বেরলো ‘খুচ খ্রাচ রামরাহা’— অর্থহীন আজব শব্দগুলো শুনে জটাই গেল ভড়কে। নিত্যদাসকে দেখে সে আর অন্যদিনের মতো ‘জয়ক্কালী’ বলে হুংকারটি ছাড়ল না। মনের ভুলে মাথাটাথা চুলকে বলে ফেলল, ‘জয় নিতাই, ভাল আছ তো নিত্য দাস?’ তা শুনে নিত্যদাস তো নেচেগেয়ে আহ্লাদে আটখানা। তবে সেও ব্যোমকে গেল যখন শুনল অশরীরী কেউ বলছে, ‘রামরাহা, রাডাকালী’! এ যে জটাই তান্ত্রিকের পোষাভূত বাঞ্ছারাম ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ভূতের মুখে রামনাম শুনে নিত্যদাসেরও সব গেল গুলিয়ে। সেও বলতে শুরু করল, ‘জয় কালী! জয় শিবশম্ভো!’

ছোটদের মধ্যে একমাত্র লাটু দাদুর একনিষ্ঠ ভক্ত। সে দাদুকে বড় ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। তবে ছানু আর কদম একটু ঠাকুমাপন্থী। তারা নিশ্চিত, দাদু ঘড়িটা হারিয়েই এসেছে। তিনজনে রীতিমতো ফেলুদা স্টাইলে জেরা শুরু করে।

“লাটু খুব মিঠে গলায় ডাকল, "দাদু!"

“ই।”

"আজ সকালে তুমি কি উত্তরদিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?"

"উত্তরদিক! তা হবে বোধহয়।"

"ঠিক করে বলো।"

"কেন রে? দিক দিয়ে কী করবি?"

"আমাদের একটা বাজি হয়েছে। বলো না।"

"হ্যাঁ। উত্তরদিকেই।"

"বেড়ানোর সময় তোমার সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল?"

"হয়েছিল বোধহয়।"

"বলো না।"

"আঃ, বড্ড জ্বালাচ্ছিস। এখন যা।"

ছানু বলল, "তাহলে কিন্তু পায়ের আঙুল টানব না।"

কদম বলল, "আমিও মাথা চুলকোব না।"

দাদু তিনজনকে আর একবার দেখে বলেন, "মতলবখান কী তোদের? অ্যাঁ!"

"আগে বলো।” লাটু বলে।

হারানচন্দ্র বলেন, "হয়েছিল দেখা।"

"কার সঙ্গে?”

"অনেকের সঙ্গে। সব কি মনে থাকে?"

"মনে করে বলো।"

মাথা চুলকোনো আর পায়ের আঙুল টানার আরামে চোখ বুজে হারানচন্দ্র বললেন, "একটা বেঁটে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ক'টা বাজে। তা আমি একটু লক্ষ করে দেখলাম লোকটার মাথায় দুটো শিং আছে।”

শেষমেশ তারা গিয়ে পৌঁছয় জটাইদাদুর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জটাইতান্ত্রিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে জটাইয়ের জ্ঞান ফিরলে সে অনবরত বলতে থাকে ‘খুচ খ্রাচ! লুলু! রামরাহা!’ ওদিকে হারানচন্দ্র কিন্তু ঘড়ির খোঁজ ছাড়েন না। গন্ধে গন্ধে তিনি গিয়ে পড়েন গর্ডন সাহেবের ল্যাবে। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ছটা উপন্যাস মিলিয়ে এই নিয়ে চার চারজন আধখ্যাপা সায়েন্টিস্টের খোঁজ মিলল। এমন আরও আসবে একে একে। গর্ডন সাহেব এটা ওটা বানান বটে, তবে সবই একটুর জন্য আধখ্যাঁচড়া হয়ে থেকে গেছে। সেই ল্যাবেই মিলল ঘড়ি, আর গর্ডনসাহেবের অচৈতন্য দেহ। জ্ঞান ফিরতে গর্ডনসাহেবও সেই ‘খুচখ্রাচ রামরাহা’ বকতে থাকলেন জটাই পাগলার সাথে।

এরমধ্যে সুখের কথা হল, ঘড়ি ফিরে এসেছে। তিনশো তেইশ নম্বর ঘড়ি যে হারানচন্দ্র হারাননি, এইটি প্রমাণ করেই তিনি ভারী খুশি। ঘড়ি গিয়ে ঢুকল সোজা ঠাকুমার জিম্মায়। ঠাকুমা বাসবনলিনী ঘড়ির ভেতর থেকে বেরনো ঘুমপাড়ানি গানে মজে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছেন। হারানচন্দ্র ঘড়ির মতিগতি ভাল বুঝলেন না। মানে মানে তাকে কয়েদ করলেন সিন্দুকে। তবে তাঁর তো ভুলো মন, আলমারির চাবি ভুলে ফেলে রাখলেন। লাটু গিয়ে ঘড়িটি নিল হাতিয়ে। ঘড়ির রহস্য সে উদ্ধার করেই ছাড়বে।

ঘড়ির ডায়ালে মুন্ডু ফুটে উঠল একজনের। তার নাম খ্রাচ খ্রাচ। লোকটার বর্ণনা পড়েই কেমন যেন মনে হয় এ লোক বদ না হয়ে যায় না— ‘খুব লম্বা, গালভাঙা, কর্কশ একটা মুখ। চোখদুটো গর্তের মধ্যে। মাথায় একটা হুডওলা টুপি কপাল ঢেকে আছে। মানুষেরই মুখ, তবে এরকম মুখ সচরাচর দেখা যায় না। অনেকটা আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো। তবে আরও ধারালো, আরও বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু মুখটার মধ্যে একটা অমানুষিকতাও আছে।’ অদ্ভুতুড়ে সিরিজের খানপাঁচেক উপন্যাস পড়ার পরে শীর্ষেন্দুর ভাবগতিকের সঙ্গে খানিক পরিচয় হয়েই গেছে। ওই যে লাটু দেখল ‘অমানুষিকতাও আছে’, ধরে নেওয়াই যায় এই ব্যাটাই হচ্ছে ভিলেন। লাটু অবশ্য এখনও অত বোঝেনি। খ্রাচ খ্রাচের নির্দেশমতো বাড়িতে মিথ্যে বলে ঘড়ি নিয়ে সে ঢোকে গর্ডনের ল্যাবে। খ্রাচ খ্রাচ তাকে বলেছে একটা দুষ্টু লোক ঘড়িটা হাতাতে আসছে, সে ঘড়ি পেলে প্রলয়কান্ড ঘটে যেতে পারে, পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ঘড়িটা আসলে ভিনগ্রহের একটা অত্যাধুনিক যন্ত্র। এ ঘড়ি দিয়ে হয় না এমন কাজ নেই। ঘড়ির সাথে ভাল দোস্তি জমল লাটুর। ঘড়ি যে সব কাজের কাজি, তাই তার নামও কাজি। ঘড়ির টিপস্ নিয়ে সে গর্ডনের আধখ্যাঁচড়া আবিষ্কারগুলো ঠিক ঠিক করে বানিয়ে ফেলল। এই সে উড়ুক্কু মোটরবাইকে উড়ছে তো পরক্ষণেই রোবট বানিয়ে তাকে হুকুমের পর হুকুম দিচ্ছে। তবে কি এবারের অদ্ভুতুড়েতে শুধুই অদ্ভুত বিজ্ঞান? ভূত নেই? উঁহু, তারাও আছে!

‘‘তারপর ঘরের চালের কাছ থেকে একটা স্প্রিঙের মতো জিনিসকে ঝুল খেতে দেখে।

"বাবা গো! ওটা কী কাজি?"

"প্যাঁচ-খাওয়া চেহারা দেখে বুঝতে পারছ না?"

"না।"

"ভূত হল মানুষের মানসিক-আত্মিক একটা অস্তিত্ব। মানুষের মন আর চরিত্র জ্যান্ত অবস্থায় যেমন ছিল মরার পর তার ভূতের চেহারাটা ঠিক সেরকম হয়ে যায়। ওই ভূতটা জ্যান্ত অবস্থায় ছিল ভারী প্যাঁচালো স্বভাবের, খুব কুটিল আর ধূর্ত।”

"বুঝেছি। আর ওই যে একটা লালমতো জোঁক তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে!"

"ওটা ছিল এক ঝগড়াটি মহিলা।"

নানান চেহারার অজস্র ভূত ঘরে বিচরণ করছে। কেউ কেউ টুপটাপ করে চাল থেকে খসে পড়ছে, কেউ বাতাসে সাঁতার কাটছে, কেউ মেঝেয় পড়ে বলের মতো লাফিয়ে উঠছে। নানান চেহারা, হরেক রং তাদের। একখানা ভূতকে দেখল লাটু, অবিকল একখানা বই। কাজি বলল, "এ লোকটা নাকি ছিল বইয়ের পোকা আর ভারী পণ্ডিত। বই পড়তে পড়তে বই হয়ে গেছে।"

ভূতের দৌরাত্ম্য এ উপন্যাসে ক্যামিও রোলের মতো। একটুখানি গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়েই তারা গায়েব।

এরপরে সামনে আসে রামরাহা। সে ছ’ফুটের ওপর লম্বা, দারুণ সুপুরুষ। চলন্ত ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে ছিনতাইবাজকে শায়েস্তা করে, ডাকাতদলকে নিকেশ করে। এভারেস্টের ইয়েতিরা তাকে দেখে সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়। পড়ন্ত পর্বতারোহীকে সে বাঁচিয়ে দেয়। সে একজন সুপারহিরো। তবু লাটু ভোগে দোটানায়। খ্রাচ খ্রাচ না রামরাহা? কে ভালো? কে মন্দ? মনে মনে যদিও সে রামরাহাকে তারিফ না করে পারছে না। তবু সংশয় তার যায় না। ভালো আর খারাপের মধ্যে বেছে নিতে গিয়ে আমরা বড়রাই ছড়িয়ে একশা করি, আর ও তো একজন খুদে।

“ইয়েতিরা পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। রামচন্দ্র রাহা পৃথিবীর সব থেকে উঁচু গিরিশৃঙ্গ এভারেস্টে উঠতে থাকে। শিস দিতে দিতে, পকেটে হাত ভরে।

দৃশ্যটা গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে বসে কাজির পর্দায় দেখতে পাচ্ছিল লাটু। সুপারম্যান, টারজান, ম্যানড্রেক সব যেন রামরাহার কাছে ছেলেমানুষ। যত সে দেখে, তত সম্মোহিত হয়ে যেতে থাকে।

কাজি প্রশ্ন করে, "রামরাহাকে কী রকম মনে হচ্ছে তোমার?”

"দারুণ।"

"ওর সঙ্গেই তোমার লড়াই কিন্তু। খ্রাচ থ্রাচের কথা ভুলে যেও না।"

এ-কথা শুনে কেন কে জানে লাটুর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।”

রামরাহার পাঠানো বার্তায় জানা যায়, ঘড়িটা তৈরি করেছিল রামরাহাই। কিন্তু খ্রাচ খ্রাচ তাকে লাগাতে চায় খারাপ কাজে। দুজনেই সমান শক্তিশালী। রামরাহার আগে যদি খ্রাচ খ্রাচ এসে পড়ে? ঘড়ি লাটুকে ভালোবাসে। লাটুর ক্ষতি সে চায় না। তাই নিজে মরে গিয়ে বানিয়ে রাখল প্রতিবস্তুতে তৈরি আরেকটা কাজি, সেটা যে ছোঁবে সেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বস্তু-প্রতিবস্তু বা ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটারের  কনসেপ্ট নিয়ে একাধিক সায়েন্স ফিকশন লেখা হয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকে চলে আসা টিভি সিরিজ স্টার ট্রেকেও আছে এমন একটি ব্যাপার।

“খ্রাচ খ্রাচ গম্ভীর বজ্রনিনাদে বলল, "শোনো খুদে মূর্খ মানুষ, রামরাহা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কাজি নিরাপদ নয়। তাকে ধ্বংস করতেই হবে। যদি সত্যি কথা না বলো, তা হলে পৃথিবীকে ধ্বংস করা ছাড়া আমার উপায় থাকবে না।"

ভয়ে লাটুর হাত পা হিম হয়ে যাচ্ছিল, সে কোনও জবাব দিতে পারল না। খ্রাচ খ্রাচ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, "রামরাহা এখনও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারেনি, আমি জানি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে বের করার মতো সময় আমার নেই। আমি কাজিকে নিয়ে যাচ্ছি। মহাকাশযানে ফিরে গিয়েই আমি সুপারচার্জার দিয়ে পৃথিবীকে একেবারে ধুলো করে দেব। তুমি আমার মস্ত উপকার করেছ, তবু আমার কিছু করার নেই।”

লাটু মনে মনে চেয়েছিল রামরাহাই জিতুক। তবু সে নিজে একবারও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রামরাহাকে বেছে নেয়নি। কেমন যেন ঘটনাচক্রেই খ্রাচখ্রাচ এসে ছুঁয়ে ফেলে ঘড়ির অ্যান্টিম্যাটার এবং দুটোই একসাথে ধ্বংস হয়ে যায়।

গল্পে সঠিক জায়গায় নাটকীয় মোচড়, কমিক রিলিফের যথাযথ ব্যবহার, ক্লাইম্যাক্সের টানটান উত্তেজনা সবই মজুত। আছে হাসিখুশি আটপৌরে বাঙালি যৌথ পরিবারের ছবি। অল্প পরিসরে হলেও ভূতও হাজির। অদ্ভুত তো আছেই। আর একটা নতুন এক্সপেরিমেন্টের গন্ধ এ উপন্যাসে আছে, তা হল ভালো আর মন্দকে বিচার করার ভারটুকু লেখক পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। এর আগের উপন্যাসগুলোয় যেমন চোখে আঙুল দিয়ে ‘ওই লোকটা খারাপ, ওটাই ভিলেন’ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, এখানে তেমনটা হয়নি। অ্যাকশন স্পিকস লাউডার।  রামরাহা যে শুভবোধসম্পন্ন, তা তার কাজেই মালুম হয়। অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এ এক নতুন পদক্ষেপ।