চক্রপুরের চক্করে : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের পঞ্চদশ আখ্যান

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

 

অভয় সরকার। সে ভারী ভীতু, গোবেচারা, নাদুশ নুদুশ সুখী সুখী মানুষ। খুনের মামলার সাক্ষী হতেই চারটে মহাপাজী গুন্ডা তাকে ধাওয়া করতে শুরু করেছে। প্রাণের ভয়ে অভয় সরকার পালিয়ে এসেছে চক্রপুর, সেখানে নাকি তার পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল। চক্রপুরে এসে তার আরেক বিপদ। সবাই তাকে হয় চোর নয় ডাকাত ভাবছে। ভয়ের চোটে তার বুদ্ধিসুদ্ধিও গেছে গুলিয়ে। শান্ত হয়ে সবকথা খুলে বললেই যেখানে কাজ হত, অভয় সরকার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্টেশন থেকে পালিয়ে গেল রেলভাড়া ফাঁকি দেওয়ার ফাইন না দিয়েই।

“মাঠ পেরিয়েই একটা বাগানওলা পাকাবাড়ি দেখে লোকটা সটান ঢুকে পড়ল। বারান্দায় বসে এক পাকাচুলের বুড়ো মানুষ হুঁকো খাচ্ছেন। লোকটাকে দেখে তিনি হঠাৎ আঁতকে উঠে চেঁচাতে লাগলেন, "ও বাবা, এ যে মস্ত এক কেলে গোরু ঢুকে পড়েছে বাগানে! ওরে পল্টু, তাড়া শিগগির গোরুটাকে, সব গাছ খেয়ে ফেলবে...!"

লোকটা আতঙ্কিত হয়ে হাতজোড় করে বলে, "আজ্ঞে আমি গোরু নই। বড় বিপদে পড়ে এসেছি, যদি একটু আশ্রয় দেন।"

বৃদ্ধ হুঁকোটি রেখে ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, "অ, তা ভাল কথা। কিন্তু বাপু, আমার কোদালখানা কি করলে?"

লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, "কোদাল! কোদালের কথা উঠছে কেন?"

বুড়ো খ্যাঁক করে উঠলেন, "কোদালের কথা কি আর এমনি ওঠে বাপু! ন্যাকামি কোরো না। পরশুদিন এসে সক্কালবেলায় তুমি আমার কোদালখানা চালাকি করে নিয়ে যাওনি? খুব তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছিলে, জ্যাঠামশাই, আমি হরি সামন্ত, কোদালখানা একটু দেবেন, ও-বেলা দিয়ে যাব। তা আমিও হরি সামন্ত মনে করে কোদালখানা দিয়ে দিলুম। পরে হরি এসে বলল, সে পরশুদিন এখানে ছিলই না।"

লোকটা হাতজোড় করেই বলল, "আজ্ঞে আমিও ছিলুম না। আজ সকালেই আমার এখানে প্রথম আগমন হল।"

"বিপদে পড়লে লোকে কত কী বলে, ওসব বিশ্বাস করে আহাম্মকেরা। তোমাকে ঠিকই চিনেছি বাপু, চোখে কম দেখি বলে যে আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে তার জো নেই। পরশু কোদাল নিয়েছ, আজ আবার আশ্রয় না কী যেন নিতে এসেছ, তুমি তো মহা ধুরন্ধর হে! ওরে পল্টু, শুনছিস! বল্লমখানা নিয়ে আয়, এই কোদালচোর সাঙ্ঘাতিক লোক।"

সবার কাছ থেকে পালাতে পালাতে অভয় সরকার হাঁপিয়ে উঠেছে। এমন সময় একজন এসে যত্নআত্তি করে বাড়ি নিয়ে গেল। কে জানত, ততক্ষণে গাঁয়ে রটে গেছে, দিনকতক আগে কুঞ্জবুড়োর বাড়িতে যারা ডাকাতি করতে এসেছিল সেই ডাকাতদের একজন গ্রামে ঢুকেছে। কুঞ্জবুড়ো ডাকাত ধরে দেবার জন্য লাখটাকা পুরস্কারের কথাও বলেছে। গোটা গ্রামের লোক হামলে পড়ে অভয় সরকারকে পিটিয়ে আধমরা করে বেঁধে রাখল।

গ্রামের নাপিতটাই ছিল ডাকাতদলের আড়কাঠি। স্যাঙাত ধরা পড়লে যদি তারও নাম পাছে বেরিয়ে পড়ে, তাই সে অভয় সরকারকে পালানোর সুযোগ করে দিল। অভয় সরকার পালাতে গিয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। চক্রপুরের জঙ্গলেই অভয়ের পূর্বপুরুষের ভিটে। শুখানালার দিকে ছিল তার ঘরবাড়ি। গ্রামের লোকেরা ভয়ে ও জঙ্গলে ঢোকে না। জঙ্গলে একজন ইউরোপীয় সাধু ব্রহ্মদৈত্য সেজে রয়েছেন। পোচারদের হাত থেকে বনের জন্তুগুলোকে বাঁচান, বেআইনি গাছ কাটতে দেন না। যে জঙ্গলের ধারেকাছে আসে, তাঁর চেলা কালু ভূতের ভয় দেখিয়ে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়।

আধমরা অভয় সরকারকে ব্রহ্মদৈত্য কড়া কড়া পাঁচন খাইয়ে সুস্থ করল কয়েকঘন্টার মধ্যেই। দারুণ সব পেপ টক দিল। এর মধ্যেই সেই দুষ্টু চারটে গুন্ডা ঢুকে পড়েছে জঙ্গলে। তাদের ভূতের ভয় দেখিয়ে তাড়ানো ব্রহ্মদৈত্যের কম্মো নয়। সুতরাং অভয় আবার পালালো। এবার সে যাচ্ছে শুখানালার দিকে।

শুখানালা জায়গাটা ভারী রহস্যময়। হঠাৎ হঠাৎ জলের স্রোতের শব্দ শোনা যায় অথচ কিছু দেখা যায় না। অভয় সরকার ভীম সরকারের বংশধর বলে তার ক্ষতি হয়নি। তবে সেই দুর্ধর্ষ  গুন্ডা চারটে ভেসে গেছে রহস্যময় জলের স্রোতে।

অভয় সরকার পাঁচন খেয়েই হোক বা ব্রহ্মদৈত্যের মোটিভেশনাল স্পিচ শুনেই হোক, সে আর ভীতু গোবেচারাটি রইল না। এত কষ্টেসৃষ্টে শুখানালা পর্যন্ত পৌঁছে সে বেশ কনফিডেন্ট ডাকাবুকো লোক হয়ে গেল। আর উপরি পাওনা, হঠাৎই তার পায়ের কাছে এসে পড়ল একটা পাথরের পরীর মূর্তি। তার ভেতরে কী ছিল লেখক আর ভেঙে বললেন না। গল্পের শেষ এখানেই। শুখানালার রহস্য রহস্যই রয়ে গেল।

গল্প হিসেবে চক্রপুরের চক্করে মোটেই আহামরি কিছু নয়। অথচ শুরুটুকু হয়েছিল বেশ ভালো। সাবলীল গতিতে গল্প এগোতে এগোতে খেই হারিয়ে ফেলল। একশো পাতার মধ্যে গল্প শেষ করার তাড়াহুড়োতে লেখক কী যে করে ফেললেন, গল্পের নাটকীয় মেজাজটাই গেল ভ্যানিশ হয়ে। এ গল্প পূজাবার্ষিকীর পাতা ছেড়ে যখন বই হয়ে বেরোলো, তখন কি আর একটু ভেবেচিন্তে আরও কয়েকখানা পাতা জুড়ে দেওয়া যেত না?

একখানি সার্থক অদ্ভুতুড়ের মালমশলার কমতি ছিল না এ গল্পে। ছিলেন দারোগা সুদর্শনবাবু, যাঁকে পুরী কচুরি মন্ডা মিঠাই ঘুষ না দিলে তিনি পুলিশি কর্তব্যগুলি সারতে বেজায় গড়িমসি করেন।

“রসময় হালুইকরের গরম-গরম ক'খানা জিবেগজা এনেছিলুম বাবু। একটু ইচ্ছে করুন।"

"জিবেগজা!” বলে দারোগাবাবু ঈষৎ প্রসন্ন মুখে বলেন, "ওই একটাই যা সুখ এখনও আছে রে! দুনিয়াটা পচে গেছে বটে, কিন্তু এখনও যে এ-দুনিয়ায় জিবেগজা হয়, জিলিপি হয়, এটাই যা ভরসার কথা। নিয়ে আয় এখানে।"

রেমো বিগলিত মুখে এগিয়ে এসে হাঁড়িটা টেবিলে রেখে মুখের সরাখানা সরিয়ে নিল। দারোগাবাবু গন্ধটা শুঁকে বললেন, "আঃ, এ একেবারে স্বর্গের জিনিস। দেবভোগ্য।"

"হেঁ-হেঁ, আপনি ছাড়া ভাল জিনিসের কদর আর কে বুঝবে বলুন! সমঝদার কই? তিরিশখানা আছে, আজ্ঞে। আপনার কাছে অবশ্য কিছুই নয়, তিন মিনিটে উড়ে যাবে।"

দারোগাবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, "হালকা-পলকা জিনিস, এ ত্রিশখানাও যা, তিনশোখানাও তাই।” এই বলে একখানা মুখে দিয়ে চিবোতে-চিবোতে চোখ আধবোজা করে বললেন, "মন্দ নয়।"

অক্ষয় রেমোর পেছন থেকে বলে উঠল, "আজ্ঞে, রসময় এ গজার নামই দিয়েছে দারোগাভোগ।"

রেমো বলল, "আর তার জিলিপির নাম শুনলে আপনি হাসবেন। জিলিপি হল গিয়ে সুদর্শনচক্র। খুব বিকোচ্ছে।"

সুদর্শনবাবু গোটা দশেক জিবেগজা উড়িয়ে দিয়ে কথা বলার ফুরসত পেলেন, "হ্যাঁ, এবার বল তোদের সমস্যাটা কী?"

আর সব অদ্ভুতুড়ে দারোগার মতো এ দারোগারও খুব ভূতের ভয়। কিন্তু বাকি দারোগাদের গ্রামের লোক মান্যিগণ্যি করত। দারোগারা সব ভূতের ভয়ে মুচ্ছো গেলেও, তাঁদের বোলবোলাও কিছু কম ছিল না। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র  নিশিকান্ত দারোগা, ‘হেতমগড়ের গুপ্তধন’এর দারোগা নবতারণ, ‘নৃসিংহ রহস্য’র বজ্রাঙ্গ দারোগা— এঁরা সব্বাই মুখেন মারিতং জগৎ। তবু লোকাল লোকজন দারোগার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেখাতে কসুর করত না। কিন্তু এ গল্পের সুদর্শন দারোগাকে গাঁয়ের লোক মিষ্টিকথায় ভালোই উপহাস করে যায়।

“অক্ষয় হাতজোড় করে বলে, "আজ্ঞে, তাতে কোনও ভুল নেই। তবে কিনা বেহ্মদত্যিটার আবার জিভের খুব তার। যাকেতাকে খায় না। এই তো শ্রীপদ, হারু মল্লিক এরাও সব তেনার খপ্পরে পড়েছিল কিনা, মাথায় মুগুর মেরে ফেলে দিয়ে চেটে দেখেছে, সব ক'টা অখাদ্য। তারপর জঙ্গলের বাইরে টেনে ফেলে দিয়ে গেছে।"

দারোগাবাবু কৌতূহলী হয়ে বলেন, "তা হলে খায় কাকে?"

নেতাই হাতজোড় করে বলে, "অভয় দেন তো বলি। হুজুরের মতো নাদুস-নুদুস লোক পেলে বেহ্মদত্যি ব্যাটা চেটেপুটে খাবে। ছিবড়েটুকু অবধি ফেলবে না। আর ভগবানের দয়ায় হুজুর, আপনার শরীরে ছিবড়ের আঁশটুকু অবধি নেই। একেবারে নধরকান্তি জিনিস, সবটুকুই একেবারে থলথল করছে। কপাকপ খেলেই হল।"

"মুখ সামলে!” বলে একটা বাঘা হুঙ্কার দিয়ে সুদর্শনবাবু রুমালে কপালের ঘাম মুছে বললেন, "নজর দিয়ে-দিয়েই ব্যাটারা আমার বারোটা বাজাল। তাই তো পিসি আমাকে এখনও কাজলের ফোঁটা দিয়ে তবে বেরোতে দেয়। আর ওরে আহাম্মক, ব্রহ্মদৈত্য আমাকে খেলে তোর কিছু সুবিধে হবে?"

নেতাই নাক-কান মলে জিভ কেটে হাতজোড় করে বলে, "আপনি গেলে আমরা অনাথ হয়ে যাব। ও-কথা বলবেন না, শুনলেও পাপ হয়। বাড়ি গিয়ে কানে একটু গঙ্গাজল দেব। বলছিলাম কি, হুজুর, বেহ্মদত্যির নজর খুব উঁচু। যেমন-তেমন লোক মুখে রোচে না। হুজুরের মতো মান্যগণ্য উঁচু থাকের লোক হলে তবেই সে একটু খায়।"

সুদর্শনবাবু দু' চোখে নেতাইকে ভস্ম করার চেষ্টা করতে-করতে বললেন, "ফের যদি ওরকম অলক্ষুনে কথা বলবি তো তিনশো দুই ধারায় ফাটকে পুরে রাখব।”

দারোগা যেমন, তাঁর সেপাইরাও তেমন। অভয় সরকারকে ধরতে মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকতে হবে। তাই সে কাজ একরকম প্রাণ দেওয়ার সামিল। কিন্তু প্রাণটুকু কুরবান করার আগে সেপাইদের হাজারও বায়নাক্কা।

“মোট চারজন নির্ভরযোগ্য সেপাইকে ডেকে লাইন আপ করিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, "তোমরা কে কে দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত?"

সেপাই লালারাম এই কথায় বুক ফুলিয়ে বলল, "দেশের জন্য হুজুর, জান তো জান, এক মাহিনার তলব ভি দিয়ে দিব।"

সেপাই মগন বলল, "দো মাহিনাকা তলব আর জান ভি।"

কিচলু বলল, "হাঁ হাঁ জরুর, কিঁউ নেহি। জান লিবেন সো তো আচ্ছা বাত। আউর হামার তিন মাহিনাকা তনখা আর দোটো ভৈঁস ভি দিয়ে দিব মালিক।"

রামু বলল, “আজ্ঞে, আমার ছেলেবেলা থেকেই ক্ষুদিরামের মতো দেশের জন্য ফাঁসিতে ঝোলার বড় শখ। তা হুজুরের দয়ায় সেরকমটা হলে বড় ভাল হয়। আর ফাঁসিতে যেতে-যেতে ওই গানটাও কিন্তু আমাকে গাইতে দিতে হবে, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী..."

লালারাম বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, "হজৌর, জান কখুন দিতে হোবে? জারা আগারি বললে থোড়া বহুত রোটি আর মূলি কি সব্জী খায়ে লিব। আউর এক লোটা দুধ।”

মগন বলল, "হামি জারা রামজিকি ভজন ভি কোরে লিব। আউর এক দফে পূজা চড়িয়ে দিব বজরঙ্গবলী কি মন্দিরমে।"

কিচলু মাথা চুলকে বলে, "এক দফে হরদোয়ার ঘুমে আসলে দেশকা লিয়ে জান দেনে সে কোই হরজা নেহি।"

রামু বলল, "আমার ওসব নয় বাবা। কলকাতার রায়ট রেস্টুরেন্টের কবিরাজি কাটলেট আর মোগলাই পরোটা একবারটি খেয়ে নিলেই হবে। আর একটা হিন্দি সিনেমা।"

গল্প যতই যেমন তেমন করে শেষ করুন লেখক, এই কমিক রিলিফগুলির জন্যই এ গল্প মনে রয়ে যাবে। আর সেই শেষ দৃশ্যটুকু—

“ঝোপের আড়াল থেকে দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ এক মানুষও অভয়কে দেখছিলেন। তিনি ব্রহ্মদৈত্য। অভয়কে চিনতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়নি। তবু তিনি দেখছিলেন, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে একটা মানুষ কত বদলে যায়। কালকেও এ-লোকটা ছিল অসহায়, দুর্বল, ভিতু। আর আজ!

জঙ্গলের ওপর দিয়ে একটা ঝটকা হাওয়া বয়ে গেল। একটা সবুজ পাতা খসে পড়ল অভয়ের ন্যাড়া মাথায়। যেন এইমাত্র কেউ সবুজ একটা রাজমুকুট পরিয়ে দিল তার মাথায়। ক্লান্ত দেখাচ্ছিল অভয়কে। তবু মনে হল, রণক্লান্ত এক দিগ্বিজয়ী রাজা।

গৌরবর্ণ পুরুষটি স্মিত হাসলেন। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, "দুঃখী মানুষ, তোমার ভাল হোক।"

অভয়ের দুঃখে পাঠকের দুঃখী হবার মতো এমন কিছু ফ্যাক্ট গল্পে ছিল না। সে বোকাহাবা, অনেকটা নিজের দোষে এবং অল্প কিছুটা কপালের দোষেই সে বারবার বিপদ ডেকে এনেছে। সুখী সুখী নাদুসনুদুস মানুষের যেচে ডেকে আনা বিপদের কথা পড়লে মোটেই সহানুভূতি জাগে না। আর অভয় কিই বা এমন করল? প্রাণের দায়ে সে ভয় পেতে ভুলে গেছে, হাঁচোড়পাঁচোড় করে শুখানালা পেরিয়ে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটের ধংসস্তূপটায় উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র। তার যত দুঃখ দুর্দশা হয়রানি সব মোটে একরাতের। দুঃখী মানুষের তকমা পেতে গেলে, পাঠকের সহানুভূতি আদায় করতে গেলে তাকে আরও কিছুদিন ধরে আরও বেশি বেশি দুঃখ দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু ওই যে, একশোপাতার মধ্যে গল্প শেষ করতে হবে। অভয়ের দুঃখের কোয়ান্টিটি কম কোয়ালিটিও যাচ্ছেতাই, তবু শীর্ষেন্দুর ওই যে ‘দুঃখী মানুষ, তোমার ভাল হোক’— এ যেন বড় আদুরে বড় বেশি মায়ার মলম লাগানো কথা। এটুকুর জন্যই যেন গল্পের শেষটুকু শেষ ওভারে গোটাকতক সিক্সার মেরে দরকচা মারা পুরো গল্পটাকে জিতিয়ে দিয়ে যায়।