
গজাননের কৌটো - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সাতাশতম আখ্যান
- 31 May, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সাতাশনম্বর গল্পটায় কেমন যেন একটু রূপকথার গন্ধ রয়েছে। কৌটোর মধ্যে লুকানো প্রাণভোমরা, রাগী রাজা, তরোয়ালের এক কোপে মুন্ডু নামিয়ে দেওয়া— ঠাকুমার ঝুলির নস্ট্যালজিয়া বয়ে আনে।
অনেক অনেক বছর আগে ছিল এক জাদুকর, নাম তার গজানন। শূন্যে ভেসে বেড়ানো থেকে শুরু করে আঙুল দিয়ে আগুন জ্বালানো, মাটিতে ফোয়ারা বানানো সবরকম আশ্চর্য ম্যাজিকই সে দেখাতে পারত। সে ছিল ধর্মনগর এলাকার সুপারম্যান। ছোট বাচ্চাদের খুব ভালোবাসত। জলে ডুবে যাওয়া বাচ্চাদের বাঁচানো, সাপে কাটা রোগীদের সারানো, সেকেলে দুরারোগ্য ব্যাধি সারানো— সবেতেই সে ছিল সিদ্ধহস্ত। স্বাভাবিকভাবেই জাদুকর গজাননের ফ্যানবেস বাড়তে থাকে। সেইটি সহ্য হয় না রাজা মঙ্গলের। তিনি গজাননের পিণ্ডিটি চটকানোর উপায় খুঁজতে থাকতে থাকেন।
ধর্মনগরের রাজা মঙ্গল যে সে লোক ছিল না। সে ছিল মল্লবীর। মল্লযুদ্ধে তাকে হারাবে এমন লোক সে রাজ্যে ছিল না। এদিকে রাজার প্রত্যেক পনেরো দিন অন্তর একটু খুনখারাপি না করতে পারলে ভারী অস্থির লাগে। ঘোরতর সাইকোপ্যাথ যাকে বলে! জোরজবরদস্তি যাকে তাকে তুলে এনে মল্লযুদ্ধে হারিয়ে নৃশংসভাবে খুন করতেন তিনি লোকগুলোকে।
একদিন মল্লযুদ্ধ বাধল জাদুকর গজাননের সঙ্গে। মল্লযুদ্ধে গজানন তো হারলই। কিন্তু ঝামেলা বাধল তাকে খুন করবার সময়। গলা টিপলেও তার শ্বাস চলে। মুন্ডু কেটে দিলেও সে চোখ পিটপিট করে। শেষমেশ গজাননের কাটা মুন্ডু অ্যাটাক করল রাজাকে, মুন্ডুর আঘাতে রাজা অক্কা পেলেন। জাদুকর গজানন ভ্যানিশ হয়ে যায়। রেখে যায় প্রচুর কিংবদন্তি।
বেশ কয়েকশো বছর পর সেই রাজার বংশের একজনের হঠাৎ ইচ্ছে হয় সে গজাননকে খুন করে তার পূর্বপুরুষের বাকি থেকে যাওয়া কাজ সম্পূর্ণ করবে। সে হল মাণ্ডুক। বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে ফের রূপকথার শুরু হয়। মাণ্ডুক খুঁজতে থাকে জাদুকর গজাননকে।
প্রাচীনকালের সেই ধর্মনগরে থাকত সদাশিব রায়। তার সঙ্গে গজাননের ভালো খাতির ছিল। সদাশিবের কাছে গজানন রেখে গিয়েছিল তার সোনার কৌটো, ওতে আছে জড়িবুটি, যার দৌলতেই গজানন কেটে যাওয়া ধড় মুন্ডু ফের জুড়ে নিতে পারে। এখন সদাশিব নেই, তবে আছে তার রায়বংশ। কুঁড়েঘরের জায়গায় এখন বড়সড় রায়বাড়ি। চার চারটে জেনারেশন একত্রে দাপটের সঙ্গে বেঁচেবর্তে রয়েছেন। শীর্ষেন্দুর বেশিরভাগ অদ্ভুতুড়ে গল্পেই ‘বয়েস স্রেফ সংখ্যামাত্র’ এ আপ্তবাক্যটির যথাযথ ব্যবহার দেখা যায়। নব্বই বছরের থুত্থুড়ে বুড়ো লাঠির বাড়ি মেরে ডাকাত ঘায়েল করেন, একশোবছরের বুড়ো ষাটবছরের ছোকরার মতো হেঁটেচলে বেড়ান। এ গল্পে পঁয়ষট্টি বছরের অঘোরকৃষ্ণ রায় তাঁর নব্বই বছরের বাবা হরিকৃষ্ণ রায়ের ভয়ে থরহরি কম্পমান।
অতি শক্তসমর্থ হরিকৃষ্ণের এখনও মাথা-ভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বত্রিশটা শক্ত দাঁত। পাঁঠার হাড় চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেলতে পারেন। রীতিমত ডনবৈঠক করেন, মুগুর ভাঁজেন, পাঁচ-দশ মাইল টানা হাঁটতে পারেন। দাপটও প্রচণ্ড। রোজ সকালে বাবাকে প্রণাম করতে যান অঘোরকৃষ্ণ, আর প্রতিদিনই হরিকৃষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "কবে যে তুই একটা মানুষের মতো মানুষ হবি, সেটাই বুঝতে পারি না। রাত্রিবেলা বউমা এসে বলল, কালও নাকি তুই বাজার থেকে একটা কানা বেগুন এনেছিস। এখনও তুই নাকি পাতে নিম-বেগুন দিলে থালার নীচে চালান দিয়ে লুকিয়ে ফেলিস। সকালে দুধ খাওয়ার কথা, তা সেটা নাকি বেড়ালের বাটিতে চুপিচুপি ঢেলে দিয়ে আসিস। শুনতে পাই, সেদিন নাকি ব্রজমাস্টারকে বাজারে দেখেও পেন্নাম করিসনি! আর ইদানীং শুনতে পাচ্ছি, তুই নাকি দুপুরবেলায় ছাদে উঠে চারদিকে ঢিল মারিস! হরবাবুর বৈঠকখানার কাচ আর নবকৃষ্ণর মেটে কলসি নাকি তোর ঢিলেই ভেঙেছে!"
অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এমন পিকচার পারফেক্ট মিষ্টি যৌথ পরিবারগুলি নিমেষেই মন কেড়ে নেয়।
মান্ডুক ফিরে এসেছে এলাকায়, সঙ্গে তার শক্তপোক্ত সাঙ্গোপাঙ্গো-রা। মেঘনাদ নামের আড়ালে সে লোকাল উকিলকে বরাত দেয় গজাননকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। প্রায় একই সময়ে পাড়ার এক নকুড়বাবু স্বপ্নে দেখেন গজাননকে, আর পরদিনই দেখা হয়ে যায় গজাননের সঙ্গে।
গল্পের মূল স্টোরিলাইনে হাসি-ঠাট্টার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। আগের একটা দুটো অদ্ভুতুড়েতে এমনটা ঘটেছে, এবং তার জন্য গোটা গল্পের মুডটাই বেশ ডাউন হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো এ গল্পে লেখক প্যারালালি কিছু সাইড ক্যারেক্টারদের নিয়ে মজার পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছেন। যেমন এই গজাননকে স্বপ্নে দেখার ব্যাপারটি। এই দৃশ্য দিয়েই গল্প হয়েছে শুরু। স্বপ্ন দেখছেন নকুড়বাবু, যাঁর সঙ্গে মূল স্টোরিলাইনের তেমন কোনও যোগসূত্র নেই। নকুড়বাবুর একটি হাত নেই, তাঁর ভারী ইচ্ছে কোনও এক ম্যাজিকে তাঁর একটি হাত হয়ে যাক! তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তিনি বসে আছেন মঙ্গলেশ্বরী অস্ত্রোপচার কেন্দ্রে, দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা—"এখানে অতি সুলভে কাটা হাত, পা, মুণ্ডু ইত্যাদি যত্ন সহকারে নিখুঁতভাবে জুড়িয়া দেওয়া হয়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।"
নকুড়বাবুর পাশে একটা লোক নিজের কাটা মুণ্ডুটা দু'হাতে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। মুণ্ডুটা পিটপিট করে চারদিকে চাইছিল। নকুড়বাবুকে বলল, "বুঝলেন মশাই, গজু কারিগরের হাতটি বড় ভাল। কিন্তু খদ্দেরের ভিড়ে লোকটা হিমসিম খাচ্ছে।"
নকুড়বাবু বললেন, "তাই দেখছি। তা আপনার মুণ্ডু কাটা গেল কীভাবে?"
"সে আর বলবেন না। রাতের খাওয়া শেষ করে সবে পায়েসের বাটিতে হাত দিয়েছি, এমন সময় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আমি 'তবে রে' বলে যেই লাফিয়ে উঠেছি অমনি ফ্যাচাং।"
"আচ্ছা।"
"মুণ্ডু কাটা পড়লে বড় অসুবিধে মশাই। খাওয়া দাওয়াই বন্ধ।”
"তা বটে।”
"দেখি, যদি আজকেই গজু জুড়ে দেয়, তবে বিকেলে ভাল খ্যাঁট চালিয়ে দেব।"
ওদিকে একটা লোক খুব চেঁচামেচি লাগিয়েছে, "এটা তোমার কেমন আক্কেল বলো তো গজুদা! ভুল করে আমার মুণ্ডু বাঞ্ছারামের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দিলে! ছিঃ ছিঃ। আমি হলুম ফরসা আর বাঞ্ছারাম হাকুচ কালো। তার ওপর বাঞ্ছারামের কোমরে দাদ আছে। বলি কি, চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?"
গজু ওস্তাদ মোলায়েম গলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "ওরে, অমন চেঁচাসনি, এক হাতে এত কাজ করলে একটু আধটু ভুলচুক কি আর হতে নেই! আজ বাড়ি যা, সামনের সপ্তাহে আসিস, ধড় বদলে দেবখ'ন।"
"না না, সে হবে না, আমার ধড়টাই আমার চাই।"
"আহা, তোর ধড় এখন খুঁজে দেখবে কে? কোন মুণ্ডু তোর ধড়ে চেপে চলে গেছে কে জানে? সে যদি ফেরত দিতে আসে তখন দেখা যাবে। একা হাতে কাজ, সামলানো মুশকিল।"
এরপর দোকানে একজন আসে, যার মুন্ডু ভুল করে উল্টোদিকে লাগিয়ে ফেলা হয়েছে।
লোকটা বলল, "অজ্ঞান করে মুণ্ডু জুড়েছ। তারপর ঢাকাচাপা দিয়ে আমার ছেলেরা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। জ্ঞান হয়ে দেখছি এই কাণ্ড। চোখ পেছনে বলে সামনের দিকে হাঁটতে পারছি না। খেতে গেলে কাঁধের ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে মুখে গরাস দিতে হচ্ছে, তাও ঠিকমতো মুখে যাচ্ছে না। লোকের সঙ্গে পিছু ফিরে কথা কইতে হচ্ছে। ভীমরতি হল নাকি তোমার?"
নকুড়বাবু সঙ্গে করে পছন্দমতো হাত নিয়ে আসেননি। গজু ওস্তাদের কাছে নাকি অঢেল একস্ট্রা হাত রয়েছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। সে হাত ‘হয়তো চোর-ছ্যাঁচড় বা খুনে-গুণ্ডার হাত, কিংবা পকেটমারেরও হতে পারে। তখন দেখবেন হাত সামলানো মুশকিল হবে। আপনি হয়তো চান না তবু আপনার হাত হয়তো কারও জিনিস চুরি করল বা কাউকে হঠাৎ খুন করেই বসল কিংবা কারও পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিল।"
নকুড়বাবুর ঘুমটি ভেঙে যায় এবং পাঠক বুঝতে পারে, ওইটি আসলে স্বপ্ন ছিল। তবে এ গোটা সিরিজে শীর্ষেন্দু অদ্ভুতুড়ে এলিমেন্টের ডোজ এতই দিয়ে ফেলেছেন, এই আজগুবি ড্রিম সিকোয়েন্সও সত্যি সত্যিই ঘটে চলেছে বলে মনে হতে বাধ্য।
এরপরেই নকুড়বাবুর বাড়িতে আসে একজন অদ্ভুতুড়ে ভবঘুরে গোছের লোক। সেই স্বপ্নে দেখা জাদুকর গজানন।
গজানন খুঁজছে সদাশিবের বাড়ি, কারণ সে বাড়িতে যে তার জড়িবুটির কৌটো গচ্ছিত রয়েছে। জড়িবুটি যদি এখনই সে না নেয়, তবে মান্ডুক তাকে কেটে ফেললে গজানন আর নিজেকে জোড়া লাগাতে পারবে না। রায়বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে থাকে জাদুকর গজানন।
আগেও দেখা গেছে অদ্ভুতুড়ে সিরিজে যৌথ পরিবারের ছবি আঁকতে লেখক খুবই ভালোবাসেন। সে পরিবারে খ্যাপাটে, খাপছাড়া কয়েকজন থাকবেনই। আর থাকে খুদে সদস্যরা। ঠাকুমা, কাজের দিদি ছাড়া বয়স্কা মহিলা চরিত্রদের তেমন দেখা পাওয়া যায় না। মায়েদের চরিত্রগুলি কেন জানি না আড়ালে আবডালেই থাকেন। রায়বাড়িতে দাদুর বাবা, দাদু, বাবা, কাকা, আর একপাল খুদে সদস্যর ভিড়। এ অদ্ভুতুড়েতে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের চরিত্রগুলোও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অদ্ভুতুড়ের গল্পগুলো মূলত আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীর খুদে খদ্দেরদের টার্গেট করেই লেখা হয়েছে। তবে লেখক ভালোমতোই জানেন, তাঁর টার্গেট অডিয়েন্সে আট থেকে আশি সব্বাই হাজির থাকেন। তাই বড়দের মনের রসদও ছিটেফোঁটা মজুত থাকে গল্পে। সিরিজের গল্প যত এগিয়েছে, সারকাজমের মাত্রা বেড়েছে। এ গল্পেও সামান্য একটু ঝলক রয়েছে। রায়বাড়ির কর্তা অঘোরকৃষ্ণ ঢিল ছুঁড়ে হনুমান তাড়াতে গিয়ে পাশের বাড়ির জানলার কাচ ভেঙেছেন। তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণ খুব সিরিয়াস মুখ করে বকেঝকে দিলেন। পরদিন দেখা গেল, হরিকৃষ্ণ নিজেই ছাদে গিয়ে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুঁড়ছেন আর বলছেন, ‘"অপদার্থ! অপদার্থ! বুঝলে! অঘোরটা একেবারেই অপদার্থ। হাতে টিপ নেই মোটে, হনুমান মারতে গেছে! গিয়ে কার কাচ ভাঙছে, কার কলসি ভাঙছে। এ যুগের ছেলেদের কি আর সেই সাধনা আছে, না অধ্যবসায়? ঢিল ছুড়তেও তো এলেম দরকার রে বাপু!" আর তাই দেখে অঘোরকৃষ্ণর বকলমে লেখক বলছেন— “অঘোরকৃষ্ণের ভারী রাগ হল। কারণ, তাঁর বাবা হরিকৃষ্ণের হাতেও যে মোটেই টিপ নেই তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। এলোপাতাড়ি ছোড়া ঢিলগুলো একটাও কোনও হনুমানের গায়ে লাগেনি। বরং একটা ঢিল অঘোরকৃষ্ণের কবজি জখম করেছে, আর-একটা আর-একটু হলেই তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিত। কিন্তু এসব কথা হরিকৃষ্ণকে বলার মতো বুকের পাটা কার আছে! পৃথিবীতে চিরকালই অত্যাচারীরা অত্যাচার করে এসেছে, আর অত্যাচারিতরা মুখ বুজে থেকেছে। এই অবিচারের জন্যই তো লোকে কমিউনিস্ট হয়!” সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের উল্লেখ অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এই প্রথমবার দেখা গেল।
লেখকের চোরেদের প্রতি এক আলাদাই মমত্ববোধ আছে, সে এতদিনে ভারী পরিষ্কার। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বাইরেও কিশোরপাঠ্য অনেক মজার গল্প তিনি লিখেছেন, যেখানে মুখ্য চরিত্রই চোর। আগেই বলা হয়েছে, এ গল্পের মূল স্টোরিলাইনে হাস্যরসের অভাব পুষিয়ে নিতেই একাধিক অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদের এনেছেন লেখক। গজানন হঠাৎ উদয় হয়ে এলাকার একে তাকে দেখা দিয়ে বেড়াচ্ছে। নকুড়বাবুর পর সে দেখা দেয় একজন চোরকে। চোর বৃন্দাবনের কাছে গজানধ স্রেফ জানতে চেয়েছিল সে সদাশিবের বাড়ি চেনে কিনা। উত্তরে বৃন্দাবন ‘না’ বলেছে। এখানেই বৃন্দাবন চোরের ভূমিকা শেষ, এরপরে আর তাকে গল্পে দেখা যায়নি। কিন্তু লেখক যে চোরের গল্প বলতে ভারী পছন্দ করেন। তিনি বৃন্দাবনের ছোটখাটো একটা বায়োডেটা দিয়ে দিয়েছেন— “বৃন্দাবনের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। গত সাতদিন তার কোনও রোজগার নেই। সাধুচরণ সাহার বাড়ির জানলার গরাদ ভেঙে চুরি করতে ঢুকেছিল মাঝরাতে। ভুলচুকও কিছু করেনি। আগে মন্তর পড়ে বাড়ির লোকজনের ঘুম গাঢ় করে নিয়েছে। কুকুরের মুখবন্ধন করার মন্তরও পড়ে নিয়েছে। ঠাকুর-দেবতাদের পেন্নাম করতেও ভুল হয়নি। সবই ঠিকঠাক ছিল। গরাদ সরিয়ে ঢুকেও পড়েছিল অর্ধেকটা। এমন সময় তার পায়ে লেগে টুলের ওপর রাখা একটা জলভর্তি মেটে কলসি মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে ভেঙে যাওয়ায় বিপত্তিটা ঘটল। সাধুচরণ তড়াক করে উঠে এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিল কবজিতে। তারপর 'চোর, চোর' বলে চেঁচানি। বৃন্দাবন হাতের চোট নিয়েও যে পালাতে পেরেছে সে ভগবানের আশীর্বাদে। আর অনেকদিনের অভিজ্ঞতা আছে বলে।” চোরেদের ওপর এত প্রগাঢ় ভালোবাসা, মাঝেমধ্যে মনে হয় লেখকের বাড়িতে সত্যিই চোর ঢুকলে হয়তো বা তিনি চোরকে আইসক্রিম খেতে দেবেন আর গপ্পো জুড়ে দেবেন!
গল্পে একটি চরিত্র আছে, শাসন ভট্টাচার্য, সে সাধুভাষায় কথা বলে। ওইটিই নাকি তার বংশের রেওয়াজ। এ সিরিজের কিছু গল্পে লেখক কথ্যভাষার ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। এর আগে ভোজপুরী চোর পাওয়া গেছে, তার মুখের ভাষাটি বেশ মিঠে লেগেছিল। শাসন ভট্টাচার্যের মুখে সাধুভাষা বসানোয় তার কথাগুলো যেন বড় বেশি করে রূপকথার আদল এনে দিয়েছে গল্পে। শাসন ভট্টাচার্য রায় পরিবারের গন্ধর্বকে শুনিয়েছে সদাশিব, রাজা মঙ্গল আর গজাননের ইতিহাস। গন্ধর্ব বলছে চলিত ভাষা, শাসন বলে যাচ্ছে খাঁটি সাধু ভাষা— জায়গায় জায়গায় তা হাস্যকর লাগে বৈকি!
"মহাশয়। ইহাই সেই ইতিহাসবিশ্রুত ধর্মনগর। এখন দেখিলে বিশ্বাস হয় না যে, এই জনবিরল, বসতিবিরল, শ্বাপদসঙ্কুল, আগাছায় পরিপূর্ণ স্থানটিতে সুরম্য হারাজি ছিল, বিশাল দীর্ঘিকাসমূহ, রাজপথ কাননাদিতে সুসজ্জিত এই নগরীর পশ্চিম প্রান্তে পরিখাবেষ্টিত প্রাসাদে রাজা মঙ্গল রায় বাস করিতেন। আজ সবই স্বপ্ন মনে হয়। অনুমান, দুইশতবার্ষিক বৎসর পূর্বের সেই নগর কালের নিয়মেই বিলীন হইয়াছে। আপনার ঊর্ধ্বতন অষ্টম পুরুষ সদাশিব এই নগরীতেই বাস করিতেন।"
গন্ধর্ব হতাশ মুখে সামনের দিকে চেয়ে জায়গাটা দেখছিল। বনবাদাড়, ঢিবি, গর্ত ইত্যাদিতে ভরা এক বিটকেল জায়গা। এখানে ধর্মনগর ছিল বলে বিশ্বাস করা কঠিন। সে একটা হাই তুলল।
শাসন ভট্টাচার্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, "মহাশয় কি জুম্ভন করিলেন?"
গন্ধর্ব জন্তন মানে জানে না। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, "আজ্ঞে না।”
"ভাল। মহাশয়ের বোধ করি আমার বিবরণ বিশ্বাস হইতেছে না।"
এখনও পর্যন্ত অদ্ভুতুড়ে সিরিজে বাঙালভাষায় কথা বলা কোনও চরিত্রের দেখা মেলেনি। কথ্য বাঙালভাষাও বেশ মজাদার।
উকিল বিষাণ দত্তকে কাজে লাগানো হয়েছে গজাননকে খুঁজে আনার জন্য। উকিল সর্বত্র ঢ্যাঁড়া পিটিয়েছেন, যে গজাননকে আনতে পারবে, পাঁচলাখ টাকা পুরস্কার আছে। এ ধরনের পরিস্থিতির সাথে অদ্ভুতুড়ের পাঠকেরা এতদিনে পরিচিত হয়ে গেছে। যথারীতি হুলুস্থূল পড়ে গেছে। কেউ তার খুড়োকে গজানন সাজিয়ে আনছে, কেউ বুড়ো হেডমাস্টারকে তুলে আনছে।
ফটিক দাস তার উলটোদিকে বসা হরেন বৈরাগীকে বলছিল, "বলি হরেন, শেষ অবধি নিজের খুড়োকেই কি জাদুকর গজানন বলে উকিলবাবুকে গছাতে নিয়ে এলে! না হয় তোমার খুড়োর একটু মাথার দোষই আছে, তা বলে এরকম পুকুরচুরি করা কি ভাল?"
হরেন বৈরাগী একটু খিঁচিয়ে উঠে বলল, "তুমিই বা কম যাচ্ছ কিসে ফটিকদা? তোমার পাশে উটি কে তা বুঝি জানি না? ও হল ময়নার হাটের চুড়িওলা নন্দকিশোর। কি বলো হে নন্দভায়া, ঠিক বলেছি?"
নগেন হালদার তার সঙ্গে আসা দাড়িওয়ালা লোকটাকে নিচু স্বরে বোঝাচ্ছিল, "ওরে বাপু, ঘাবড়ানোর কী আছে বলো তো! যদি গজানন বলে পাশ হয়ে যাও তা হলে তো পাঁচ লাখের এক লাখ তোমাকে দেবই।"
"কিন্তু মশাই, ওরা যদি আমাকে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝোলায়?"
"দুর বোকা, ওসব নয়। মনে হচ্ছে মেঘনাদবাবু কোনও গুরুতর কাজের ভার দেবেন বলেই গজাননকে খুঁজছেন। আর ধরো, যদি তোমার ভালমন্দ কিছু হয়েই যায়, তা হলে তোমার বউকে গুনে গুনে এক লাখ দিয়ে আসব কথা দিচ্ছি।"
রাম খাজাঞ্চি হঠাৎ একজনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, "আরে কে ও? শ্যামাপদ নাকি হে? সঙ্গে কে বলো তো! আরে এ তো হরিপুরের সেই কাপালিকটা!"
বীরু মণ্ডল একটু নিচু গলায় হরিপদ ঘোষকে বলল, "এঃ হে হরিপদদা, লোকটার গালে যে নকল দাড়ি সেঁটেছ তা আঠাটা ভাল করে লাগাবে তো! বাঁ দিকের জুলপির নীচে আলগা হয়ে আছে যে!"
হরিপদ শশব্যস্তে সঙ্গী লোকটার দাড়িটা চেপে বসাতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল, "মানুষটা মেকআপের কিছুই জানে না দেখছি, সাতটা টাকা জলে ফেললুম।"
সত্যচরণের সঙ্গে একজন দাড়িওলার একটু তর্কাতর্কি হচ্ছে। দাড়িওলা বলছিল, "মশাই, গজাইয়ের দোকানের গরম রসগোল্লা খাওয়ানোর কড়ার করিয়ে নিয়ে এলেন, তা কোথায় কী? এতক্ষণ বসিয়ে রাখছেন, লোকের খিদেতেষ্টা পায় না নাকি?"
গজাননকে কিন্তু এইভাবে পাওয়া যায় না। গল্পে খুদে সদস্যরা এইবার বেশ সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করেছে। বরাবরই অদ্ভুতুড়ে সিরিজে ছোটদের সাথে গল্পের হিরোর র্যাপো দুর্দান্ত রকমের ভালো থাকে। এ গল্পেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রায়বাড়ির অবু, বিকু, পুতুলরা গজাননকে পেয়ে তাদেরই বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। চুপিচুপি তার কৌটোর জড়িবুটিও এনে দেয়। জড়িবুটি পেয়ে গজানন আবার তার ম্যাজিকাল পাওয়ার ফিরে পেয়েছে। দুষ্টু মান্ডুক তাকে মারতে এলে গজানন তাকে নিকেশ করে ফেলে।
“বিস্মিত মাণ্ডুক ক্ষণেক বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে বিদ্যুৎ-গতিতে গজাননকে খণ্ড খণ্ড করে দিতে তরোয়াল চালাতে লাগল।
কিন্তু কিছুই হল না।
এবার তলোয়ার ফেলে মাণ্ডুক লাফিয়ে পড়ল গজাননের ওপর।
গলা টিপে ধরল। গজানন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু। বিস্মিত মাণ্ডুক তার চোখ উপড়ে নেওয়ার জন্য চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিল।
মুগুরের মতো দুই হাতে অজস্র ঘুসি মারল।
চারদিকের লোক প্রথমে ভয়ে চিৎকার করছিল। কিন্তু তারাও বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেছে।
মাণ্ডুক হাঁফাচ্ছে। তার চোখ বড়-বড়। রাগে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে।
"মরো গজানন, মরো।"
গজানন শান্ত কণ্ঠে বলে, "আমার কি মরণ আছে?"
"তোমাকে মরতেই হবে!"
মাণ্ডুক কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে গজাননকে পরপর দু'বার গুলি করল। কিছুই হল না। গজাননকে ছুঁয়ে গুলিগুলো গিয়ে পেছনের দেয়ালে বিঁধল।
হঠাৎ গজাননের চোখে একটা নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল যেন! একটু দুলে সে শূন্যে ভেসে রইল একটুক্ষণ। তারপর সমস্ত শরীরটা হঠাৎ ঋজু হয়ে একটা বল্লমের মতো তীব্রগতিতে গিয়ে পড়ল মাণ্ডুকের ওপর।
মাত্র একবারই। মাণ্ডুক মাটিতে পড়ে একটু ছটফট করে নিথর হয়ে গেল।”
এও এক নতুন রকম ব্যাপার। গল্পের হিরো এমন নৃশংসভাবে ভিলেনকে খুন করছে, এমনটি অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এর আগে দেখা যায়নি। তাও আবার পুরো ঘটনাটি ঘটছে যেখানে, সেখানে ছোট বড় সকলেই উপস্থিত। অদ্ভুতুড়ে সিরিজ সত্যিই যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণতমনস্ক হয়ে উঠছে।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২১ - পাতালঘর -আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২২ - হরিপুরের হরেক কাণ্ড -আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৩ - দুধসায়রের দ্বীপ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৪ - বিপিনবাবুর বিপদ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৫ - নবাবগঞ্জের আগন্তুক - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৬ - ষোল নম্বর ফটিক ঘোষ - আলোচনার লিংক