বক্সার রতন : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের পঞ্চম আখ্যান

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক

এক যে ছিল আধখ্যাপা বৈজ্ঞানিক, আবিষ্কার করে ফেলেছিল কি না কি এক যুগান্তকারী জিনিস! তাকে ধরে নিয়ে গেল দুষ্টুলোকেরা। তারপর তার ছেলে ঢিশুম ঢিশুম ঘুষি চালাতে চালাতে এসে পড়ল বুড়ো বাবাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। না না, হৃতিক রোশনের ‘ক্রিষ’ (২০০৬)-এর গপ্পো বলছি না! এইটি হল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বক্সার রতন’এর স্টোরিলাইন। একে কাকতালীয় মিল-ই বলা চলে। ১৯৮৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘বক্সার রতন’। তাঁর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের পাঁচনম্বর মিনি উপন্যাস এই ‘বক্সার রতন’। ‘নৃসিংহ রহস্য’-র পর আরও একবার শীর্ষেন্দু ছকভাঙা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। ‘বক্সার রতন’-এও ভূত মিসিং। এমনকি কমিক রিলিফ কোনও দারোগাবাবুও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলোর আইকনিক যে টোন, সেই হাসি-মজা-ইয়ার্কি-মনকেমনিয়া তার কিচ্ছুটি এতে নেই।

তবে গল্পের কেন্দ্রে যেহেতু একজন বক্সার, বক্সিংয়ের কলাকৌশলের নানা সুলুকসন্ধান এ গল্পের পরতে পরতে রয়েছে। ‘‘রতন সরল ঠিকই, তবে একটু খেলিয়ে। সুব্বাকে সে ঘুষিটা তৈরি করতে দেখল। ঘুষিটা আসছে, তাও দেখল। তারপরই টুক করে মাথাটা নামিয়ে ঘুষিটাকে বইয়ে দিল মাথার ওপর দিয়ে। আর তক্ষুণি দেখতে পেল তার ডানহাতের সোজাসুজি সুব্বার থুতনি। অরক্ষিত এবং অসহায়।” স্পষ্টই বোঝা যায়, অনেকটা সময় নিয়ে খুঁটিয়ে বক্সিং ম্যাচগুলো দেখে তারপর লেখা হয়েছে এ গল্প। বক্সিং, ওয়েটলিফটিং এ জাতীয় হুড়ুদ্দুম ধুমধাড়াক্কা গোছের স্পোর্টসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত আগ্রহের কথাটি চাপা নেই। নাকের নীচে ছোট্ট প্রজাপতি গোঁফ, রোগাভোগা, ভালোমানুষ গোছের লেখকটির কলম দিয়েই যে এতসব ডাকাবুকো চরিত্ররা বেরিয়েছে, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় বৈকি! আর সেইসঙ্গে রয়েছে গল্প বলার আশ্চর্য কায়দা। ‘বক্সার রতন’এর স্টোরিলাইন বড় সাদামাটা, শীর্ষেন্দুর গল্প বলার গুণেই এ গল্প উতরে গেছে। তিনি যেন ঠিক গল্প বলেন না, গল্পের মতো করে সিনেমা দেখান। ওই যে রতন বক্সিং রিংয়ে জান-কবুল ফাইটখানা করছে, গল্প পড়তে গিয়ে আমরাও যেন কখন ঢুকে পড়ি রিংয়ের ভেতরে। স্পষ্ট যেন দেখতে পাই, ওই বিরাশি সিক্কার ঘুষিটা এসে লাগল রতনের কপালে, দরদরিয়ে রক্ত পড়ছে! ওই সুব্বার চোয়াল দিল ভেঙে! চতুর্দিকে হাততালির আওয়াজ! রতনের অবাক হওয়া খুশিটুকুর সাথে কোথায় যেন মিলে যায় আমাদের খুশিগুলো। এই তো, হিরো জিতে গেছে! বকলমে আমরাও যেন জিতে গেছি।

সময়টা ১৯৮৪। তখনও পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখা ঠিকঠাক জমাটি আধুনিকমানের থ্রিলারের সংখ্যা বেশ কম। ৬০ থেকে ৮০-র দশকের মধ্যে স্বপনকুমার লিখছেন পাল্প ফিকশন, হট কচুরির মতো বিকিয়েছে ঠিকই কিন্তু অজস্র ভুলভ্রান্তি অতিনাটকীয়তায় ভর্তি— ‘তার দু’হাতে বন্দুক, একহাতে রিভলবার’ গোছের বাক্য থাকত! সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গল্পে থ্রিল আছে ঠিকই, তবে তা কি ঠিকঠিক থ্রিলারের সংজ্ঞা মেনে চলে? কে জানে, ও অনেক ভাবনাচিন্তা তর্কাতর্কির বিষয়। ১৯৮৪-তে সমরেশ বসুর গোগোল সিরিজ, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজ এসে পড়েছে। ১৯৮৪ সালেই পয়লা ফেব্রুয়ারিতে সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজের প্রথম গল্প ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’ বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। বইয়ের নাম ছিল ‘খুনখারাপি’, সে বইতে মোট দুটো মিনি উপন্যাস— ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’ এবং ‘খুনখারাপি’। ১৯৮৪ সালে আনন্দমেলার সম্পাদনার দায়িত্বে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বেশিরভাগটাই সাদাকালোরএই মাসিক আনন্দমেলার পাতায় তখন বেরোতে শুরু করেছে খুনজখম রাহাজানির রোমাঞ্চে ভরা গল্প। যেমন, ১৯৮৪-র অক্টোবরের সংখ্যায় ছিল রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘অভ্রর খুনি ধরা’। মৃতদেহের বর্ণনা হিসেবে আছে, ‘‘ভারী কিছুর আঘাতে সারা মুখখানা থেঁতলানো কাদার মতো হয়ে গেছে। শরীরে ‘রিগার মর্টিস’ শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই।’’ [বানান অপরিবর্তিত] ১৯৮৪ সালের ছোটদের গল্পে এতখানি বীভৎস বর্ণনা, তার ওপর রিগর মর্টিসের মতো শব্দবন্ধের সঙ্গে খুদেদের পরিচয়— এ বড় সহজ কথা নয়।

এইরকম সময়ে দাঁড়িয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও যদি তাঁর ছোটদের লেখায় খুনজখম তুলে আনেন, দোষ দেওয়া যায় না। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এ যাবৎ প্রকাশিত চারটে উপন্যাসে কোথাও কোনও সরাসরি খুনের দৃশ্য আসেনি। কিন্তু ‘বক্সার রতন’ সবদিক থেকেই ব্যতিক্রম। বক্সার রতনে খুন আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, জেমস বন্ডের কায়দায় মারামারি আছে। গল্পের হিরো সঅঅঅব জানে, বক্সিং-জুডো-ক্যারাটে সব! কয়েকযুগ ধরে পাগল হয়ে থাকা অথর্ব রুগ্ন বৃদ্ধ বাবাও হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে গুন্ডাদের ঘা কতক বসিয়েও দেন। তারপর সব মধুরেণ সমাপয়েৎও হয়ে যায়। শোনা যায়, নামীদামী লেখকদের মাঝে মাঝে ফরমায়েশী লেখাও লিখে দিতে হয়। সম্পাদকের তাগাদার পর তাগাদায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ যে বস্তুটি তাঁরা পরিবেশন করেন, তা মোটেই সুস্বাদু সুপাচ্য হয় না। কালের নিয়মে সে লেখা একদিন হারিয়েও যায়। ‘বক্সার রতন’ অতটা অখাদ্য না হলেও অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বাকিসব মণিমুক্তোর তুলনায় ম্যাড়মেড়ে অনুজ্জ্বল।

রতন একজন উঠতি বক্সার। ভদ্র ও একদা সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। কিন্তু এখন সে বড্ড গরীব। মা মারা গেছেন। বাবা নামকরা বৈজ্ঞানিক ছিলেন কিন্তু তাঁর প্রতিভাই তাঁর কাল হল। একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। হিট অ্যামপ্লিফিকেশন। সামান্য মোমবাতির তাপই বাড়িয়ে চাড়িয়ে শতগুণ করে নেওয়া যাবে, ইলেকট্রিসিটির অপচয় বন্ধ হবে, পৃথিবীতে ফুরিয়ে আসা জ্বালানি সমস্যার সমাধান হবে। যে কোনও আবিষ্কারকেই ভালো দিকেও কাজে লাগানো যায় আবার মন্দদিকেও কাজে লাগানো যায়। তাঁর লোভী অ্যাসিস্ট্যান্ট কী একটা খাইয়ে পাগল করে দেয় তাঁকে। কাগজপাতি নিয়ে ভেগে পড়ে। কিন্তু রতনের বাবা বুদ্ধিমান মানুষ। আসল ফর্মুলা, আসল ল্যাবনোট সরিয়ে রেখেছিলেন মাইক্রোফিল্ম বানিয়ে। লোভী অ্যাসিস্ট্যান্ট যা নিয়ে গেছিল, সে সবই ভুল নকল ফর্মুলা। সে বোকারাম ওই ভুল ফর্মুলা দুষ্টু লোকেদের বেচেও দিয়েছে। তারা নাকি ওই ফর্মুলা দিয়ে ভয়ানক সব অস্ত্রশস্ত্র বানাবে। কিন্তু যখন দুষ্টু লোকেরা বুঝল ওইটি আসল ফর্মুলা নয়, তারা পাকড়াও করল তাকে, অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত হতে থাকল সেই লোভী অ্যাসিস্ট্যান্ট। আর সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ পড়ল রতনের বাবার।

সাধারণত শীর্ষেন্দুর এই অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলো প্রকাশিত হত আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকী সংখ্যায়। পুজো আসছে। মা দুগ্গা দুষ্টু অসুরকে বধ করবেন, ভালো-র সঙ্গে মন্দ-র যুদ্ধে ভালো-র জিৎ হবেই। শীর্ষেন্দুর গল্পেও তার রেশ এসে পড়ত। একপাল দুষ্টু লোকের সঙ্গে টক্কর দিতে হাজির দুজন শুভচিন্তক মানুষ। তারা রতনকে সাহায্য করল ওই দুষ্টু লোকদের হারিয়ে দিতে। সেই উনিশ শতক থেকে এমন প্রথা চলে আসছে। বাংলা সাহিত্যের গোড়ার পর্বে তো আলাদা করে ছোটদের জন্য কিছু লেখা হত না। সবই ওই ঠাকুরদেবতার কথা, মঙ্গলকাহিনী, আর তার সাথে ঠারেঠোরে একটু একটু সমসাময়িক ইতিহাস বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির আভাস দেওয়ার চেষ্টা। সেই যবে ইংরেজগুলো এদেশে এসে বুঝল, দেশী লোকগুলোকে দিয়ে চাকরিবাকরি করাতে হলে পেটে একটু বিদ্যে থাকা বড্ড দরকার, তখনই শুরু হল ‘পাঠ্যবই’ লেখা। আদ্যিকালের খটোমটো ভাষায় লেখা পুরাণগুলোর অনুবাদ হল। বিদেশী সাহিত্যও চলে এল এদেশের মানুষগুলোর কাছে। মাসিক পত্রিকা বেরনো শুরু হল। তারপর না ধীরে ধীরে আলাদা করে ছোটদের জন্য লেখালেখি চালু হল। ‘দিগদর্শন’, ‘পশ্বাবলী’, ‘জ্ঞানোদয়’এর মতো শিশুপাঠ্য মাসিক পত্রিকার ভাষা ছিল গুরুগম্ভীর, লক্ষ্য ছিল ছোটদের শিক্ষাদান। ইশপের গল্পই হোক বা বর্ণপরিচয়— সবই ছোটদের তর্জনী উঁচিয়ে বলে দেয় এইটি কোরো না, অমুকটি করলে তুমি খুব খারাপ, তমুকটি করলে ভালো। ভুবন মাসির কান কামড়ালো, শাস্তি ফাঁসি। গোপাল সবার কথা মেনে চলে, সে সুবোধ বালক। রাখাল একটি বেয়াড়া বাচ্চা, সে ভারী খারাপ। বিদ্যাসাগর পইপই করে বললেন কেউ যেন রাখাল না হয়। সাহিত্য যদি স্রেফ নীতিশিক্ষাই হয়, তাহলে আর সে সাহিত্য পড়ায় মজাটা কোথায়? এ সারকথাটি যেদিন বড়রা বুঝলেন, সেদিন থেকেই ছোটরা একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। ‘সখা’, ‘বালক’, ‘মৌচাক’, ‘সন্দেশ’এর যুগ পেরিয়েছে। এসেছে ‘আনন্দমেলা’, ‘কিশোর ভারতী’, ‘আমপাতা জামপাতা’। তবু ১৯৮৪তে তখনও ছোটদের গল্পগুলো ভালো-মন্দর লড়াইয়ে ভালোর জয়, শিষ্টের পালন-দুষ্টের দমন— এই আপ্তবাক্যগুলো থেকে বেরোতে পারেনি। তাই হাজারটা গুলতাপ্পি দিয়ে, গল্পের গরু গাছের মগডালে তুলে লেখক বক্সার রতনকে জিতিয়ে দেন।

রতনের বাবাকে দুষ্টু লোক তুলে নিয়ে যায়। মাঝসমুদ্রে জাহাজের কেবিনে বন্দী করে রাখে। ট্রুথ সিরাম ইনজেকশন ফুটিয়ে জেনে নেয় আসল ফর্মুলা কোথায় আছে। রতনকে হেল্প করছে দুজন বিদেশি, তারা চায় আবিষ্কারটা ভালো কাজেই ব্যবহার করতে। দুষ্টু লোক রতনের বাড়ি এসে ফরমুলা চুরি করে নিয়ে গেল। রতনরাও পিছু পিছু চলল বাবা উদ্ধারে। তারপর তো এক্কেবারে হলিউডি স্টাইলে দুমদাম অ্যাকশন। শেষমেশ সব দুষ্টুলোককে সাফ করা হল। আর সিনেমায় যেমন হয়, শেষে সব জট খুলে যায়, রতনের বাবার মাথার জটটাও খুলে গেল। তাঁর পাগলামি সেরে গেল। এই ২০২৪ সালে এসে আমরা অনেকগুণ বেশি ভালোমানের থ্রিলার পড়ে ফেলেছি। সেগুলোর সাথে এই ১৯৮৪ সালে লেখা গল্পের তুলনা টানতে যাওয়া বোকামি হবে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের থ্রিলার জঁর প্রায় হামা টানা শিশু। তবে শীর্ষেন্দু যে বারবার খোলনলচে বদলে এক্সপেরিমেন্টের সাহস দেখিয়েছেন, সে জন্য অবশ্যই তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য।