হারানো কাকাতুয়া - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের দশম আখ্যান

রূপকথার গল্পে যেমন একটা মোটিফের প্রায়ই দেখা পাওয়া যায়— এক যে ছিল রাজা, একদিন তার কাছে হাজির হল এক হীরামন তোতা। তোতা বলল অমুক পাহাড়ের তমুক প্রাসাদে অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যে বন্দি আছেন। তোতা বড় বাচাল। তোতার মুখে খবর পেয়ে একপাল রাজা হাজির সুন্দরী রাজকন্যে আর রাজত্ব কবজা করতে। তোতা সুন্দর ডিরেকশন দেবে এইদিকে চোরাগলি, ওইদিকে কানাগলি। তারপর রূপকথার হিরো পৌঁছে যাবে রাজকন্যার ঘরে। সব্বাইকে ধুমধাড়াক্কা পিটিয়ে সে রাজকন্যে উদ্ধার করবে।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই দশনম্বর উপন্যাস ‘হারানো কাকাতুয়া’ অনেকটা যেন ছেলেবেলায় শোনা রূপকথার আমেজ এনে দেয়। একটা কাকাতুয়া জানতো গুপ্তধনের খবর। সে পাখির পেছনেই পড়ে গেছে একগাদা দুষ্টু লোক। আছে ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা। রয়েছে শিশু মনস্তত্ব। আর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের মার্কামারা টিউন সেই নির্ভেজাল হাসি-ঠাট্টা-মজা। আপাতত পড়া অদ্ভুতুড়েগুলির মধ্যে এই দশনম্বর অদ্ভুতুড়েই কিঞ্চিৎ বড়, একশোচব্বিশ পাতা— আয়তনের টানাটানিজনিত কারণে উপন্যাস শেষ করতে লেখককে হুটোপাটি লাগাতে হয়েছে, এমন অভিযোগ এখানে তোলার অবকাশ রাখেননি। মাথা ঘুরে যাবার মতো প্লট ট্যুইস্ট আছে। তবে লেখক হয়তো ইচ্ছে করেই উপন্যাসের শেষে কে কী কেন, তার সবটা খোলসা করেননি। পাঠক নিজের মতো বুঝে নেবে। এও এক নতুন এক্সপেরিমেন্ট।

গল্পে কাকাতুয়ার আসল মালকিনকে খুন করা হয়।  খুনের সময় বুড়িমানুষটি যা যা বলেছিলেন, কাকাতুয়া সব মনে রেখে দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই সে পুরনো স্মৃতি ঝালিয়ে নেয় ‘বিশু আমাকে মারিস না’ বলে। পাখি এখন উদ্ধব উকিলের কাছে, তিনি ওটা কিনেছেন ছোটছেলে রামুর অ্যালার্ম ক্লক হিসেবে। পাখিকে নতুন বুলি শেখানোর চেষ্টার কমতি নেই।

“কাকাতুয়াটা প্রথম দিনই নিজে থেকে বলে উঠল, "আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বিশু বাতিটা নিভিয়ে দাও। ওঃ, কী মশা! কী মশা!"

 

ধৈর্য ধরে উদ্ধববাবু পরদিন তাকে আবার রামু-শাসন শেখাতে বসলেন। কাকাতুয়াটা গম্ভীরভাবে শুনল। তারপর বলল, "বিশু, আমার খাবারে খুব ঝাল দিও।” উদ্ধববাবু কটমট করে পাখির দিকে চেয়ে বললেন, "ইয়ার্কি হচ্ছে?" কাকাতুয়াটা এ-কথায় খক-খক করে হেসে বলল, "আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। খকখক।"

 

উদ্ধববাবু পরদিন আবার পাখিকে পড়াতে বসালেন। পাখি তাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ লক্ষ্য করে বলল, "বালিশের তলায় কী খুঁজছ বিশু? আলমারির চাবি?"

 

উদ্ধববাবু বললেন, "আহা, বলো, রামু এখন ঘুম থেকে ওঠো।” পাখি বলল, "বিশু, আমার ঘুম পাচ্ছে। আলমারিতে টাকা নেই। অন্য

 

জায়গায় আছে।"

 

উদ্ধববাবু বললেন, "হোপলেস।"

 

কাকাতুয়াকে শেখাতে গিয়ে উদ্ধববাবু ঘেমে ওঠেন। রেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকেন, "ইয়ার্কি হচ্ছে? অ্যা! ইয়ার্কি?" কাকাতুয়াটা একথাটা খুব টক করে শিখে নেয়। ঘাড় কাত করে উদ্ধববাবুর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে, "ইয়ার্কি হচ্ছে?

 

অ্যাঁ! ইয়ার্কি?"

 

"নাঃ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। টাকাটাই জলে গেল দেখছি।" উদ্ধববাবু হতাশভাবে এই কথা বলে উঠে পড়লেন। নেয়ে খেয়ে আদালতে যেতে হবে।

 

কাকাতুয়াটা পিছন থেকে বলল, "টাকাটাই জলে গেল দেখছি।"

কি সুন্দর একখানা মজার দৃশ্য। উপন্যাসের গাঁটে গাঁটে এমন অনায়াস ভঙ্গীতে আঁকা মজারু মোমেন্টস ছড়িয়ে আছে।

উপন্যাসে কোনও কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। একসাথে গোটা দশ বারো গুরূত্বপূর্ণ অদ্ভুতুড়ে চরিত্র ভিড় জমিয়েছে, আর শীর্ষেন্দু মনোযোগ সহকারে প্রত্যেকের ওপর টর্চবাতির আলোটি ফেলেছেন। এমনই একটি চরিত্র ছোট্ট ছেলে রামু। কাকাতুয়াটা আসলে উদ্ধববাবু কিনেছিলেন তারই জন্য।

“তাঁর ইচ্ছে ছিল, কাকাতুয়াটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এমন তৈরি করবেন যাতে সেটা তাঁর গবেট ছোট ছেলে রামুটাকে উঠতে-বসতে ডিসিপ্লিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। উদ্ধববাবুর ছোট ছেলেটাই হয়েছে সবেচেয়ে সৃষ্টিছাড়া। শাসনে থাকে, দুষ্টুমিও বেশি করতে পারে না বটে, কিন্তু সে এই বাড়ির আবহাওয়া ঠিক মেনেও চলে না। আকাশে রামধনু উঠলে রামু হয়তো বাইরে গিয়ে দুহাত তুলে খানিক নেচে আসে। ঘুড়ি কাটা গেল দৌড়ে যায় ধরতে। অঙ্কের খাতায় একদিন লিখে রেখেছিল, 'কে যায় রে ভোঁ-গাড়িতে উড়িয়ে ধুলো? যা না ব্যাটা............ দেখে শিউরে উঠেছিলেন উদ্ধববাবু। ঐটুকু ছেলে কবিতা লিখবে কী? কিন্তু কতই বা আর একটা ছেলের পিছনে লেগে থাকবেন তিনি? তাঁর তো কাজকর্ম আছে! মস্ত উকিল, দারুণ নামডাক, ব্যস্ত মানুষ। তাই ঠিক করেছিলেন, কাকাতুয়াটাকে রামুর পিছনে লাগিয়ে দেবেন। সে বলবে, "রামু পড়তে বোসো। রামু এবার স্নান করতে যাও। রামু, আজ আধ ঘন্টা বেশী খেলেছ। রামু রামধনু দেখতে যেওনা। রামু, কাটাঘুড়ি ধরতে নেই...... ইত্যাদি।"

আর রামুর পয়েন্ট অফ ভিউ? তাও আছে!

ডাকাতেরা যখন কাকাতুয়াসুদ্ধু রামুকে তুলে নিয়ে যায়, রামুর তাতে খুব একটা দুশ্চিন্তা হয়নি। রামুকে ভয় দেখাতে সাতনা ডাকাত যখন বলে, তাকে মেরে ফেলা হবে, রামু ধরে যাওয়া গলায় জানায় তাকে মেরে ফেললেও তার জন্য কেউ কাঁদার নেই, তাকে কেউ ভালোবাসে না। বয়ঃসন্ধির এই সমস্যায় কমবেশি আমরা সবাই ভুগেছি। রামু দুষ্টু ছেলে, পড়াশোনায় মন বসাতে পারে না। তার শরীরে সর্বক্ষণ কাতুকাতুর মতো কিছে একটা হতে থাকে, যার জন্য দুষ্টুমি না করে সে থাকতে পারে না। আর তার দুষ্টুমিগুলোও কি সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভ! রামুর মেজদাদুর মাথায় পাকাচুল খুব বেশি ছিল না, কিন্তু তিনি যেই বললেন পাকাচুল তুলতে পারলে প্রতি চুল পিছু রামু চারআনা পয়সা পাবে, দেখা গেল রাতারাতি মেজদাদুর মাথা থেকে শ’খানেক পাকা চুল বেরিয়ে এসেছে! ব্যাপারটা আর কিছুই না, রামু পাশের বাড়ির সাদা বিলিতি কুকুরটার পিঠ ন্যাড়া করে সাদা লোম ছেঁটে এনেছিল কাঁচি দিয়ে! বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় যতই রাখালকে নিয়ে চোখ রাঙাক না কেন, ইতিহাস সাক্ষী আছে, দুষ্টু ছেলেগুলোই সবচেয়ে বেশি আদর, ভালোবাসা পায়। কিন্তু মুশকিল হল রামুর তো বয়স বাড়েনি, বুদ্ধি পাকেনি। শাসনের আড়ালে চোরাগোপ্তা ভালোবাসার সুর সে চিনতে শেখেনি। উদ্ধববাবু তাঁর এই দুষ্টু ছেলেটিকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, কিন্তু কখনও কোনওদিন মুখ ফুটে বলেননি। সবসময় শাসন করেছেন, তর্জন গর্জন করেছেন। রামুর অঙ্ক কষতে ইচ্ছে করেনি, সে মাস্টারমশাইয়ের সাথে কাটাকুটি খেলেছে। খেলেছে, বেশ করেছে। কিন্তু তাই বলে বাবা কেন বলবেন, যাদের আর ভালোছেলে হবার কোনও আশা নেই তাদের সাথেই মাস্টারমশাইরা কাটাকুটি খেলেন? রামু তাই ভাবে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, সার্কাসের দলে ভিড়বে, দেশ বিদেশ ঘুরবে আর ভয়ংকর ভয়ংকর খেলা দেখাবে। দোসর তার বন্ধু গান্টু। সেও রামুর মতো বাড়ি ছাড়তে চায়, জাহাজের নাবিক হতে চায়। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে ছোট ছোট খুদের দেখা এর আগেও মিলেছে। কিন্তু রামু সবচেয়ে বেশি মন কেড়ে নিয়েছে। ডাকাতরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারে, বাড়ির চাকর নয়নকাজল ডাকাতদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাকাতুয়া আর রামুকে কিডন্যাপ করিয়েছে। নয়নকাজল ডাকাতদলে ভিড়ে হালে পানি পাচ্ছে না, অমন নিষ্ঠুর সে নয়। মারধোর খেয়েও রামুর জন্য সে দুধ এনে দেয়, চোখের জল ফেলে। রামুও অবশ্য ক্ষমা করতে দেরি করেনি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও সে নয়নকাজলকে নিয়ে ডাকাতের ডেরা থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে।

আর একজন আছেন, গবাপাগলা। পরনে তার আলপাকার কোট, ময়লা পাতলুন, গালে দাড়ি। নামেই পাগল, আসলে কিন্তু এঁর মতো সেয়ানা লোক আর দুটি নেই। সে সব কাজের কাজি। সায়েন্সে তুখোড় জ্ঞান। সে একজন বুদ্ধিমান ইনফর্মার। কাকাতুয়া নিয়ে উপন্যাসে যে রহস্যের জালটা ধীরে ধীরে বুনে তোলা হয়েছে, তার একটা কোণা আগাগোড়াই ছিল গবাপাগলার হাতে। কাকাতুয়ার জন্য খুন হয়েছে, আরও হবে এমন তথ্য তার কাছে ছিল। উপন্যাসের এতগুলো চরিত্রের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি সুস্থমস্তিষ্কের মানুষ।

“গবা মাথা নেড়ে বলে, ভাল মানুষদের তো ঐ একটাই দোষ। তারা পাগলকে ভাবে পাগল। পাগলরা যে সত্যিই পাগল তা কি পাগলরা জানে না? আর তারা যে পাগল সেইটে বোঝানোর জন্য কোনো পাগল কি পাগল ছাড়া অন্য কোনো পাগলের কাছে যায়? বলুন!"

 

সামন্ত জ্বালাতন হয়ে বলে, "তাও বুঝলাম। কিন্তু বাপু হে, আজ আমার মনটা ভাল নেই।"

 

"মন ভাল করার ওষুধ আমি জানি।"

 

"বটে! কী ওষুধ?”

 

"একদম পাগল হয়ে যান। ভাল মানুষরা যদি পাগল না হয়, তাহলে পাগলরা যে পাগল তা বুঝবে কী করে? আর একবার যদি পাগল হয়ে পাগলামির মজা টের পায়, তবে কি আর মন খারাপ থাকে?" "

 

ওঃ!" বলে সামন্ত নিজের মাথা চেপে ধরল।

 

গবা বলল, "এই কথাটাই বলতে আসা মশাই। তবে যাওয়ার আগে, দুচারটে আজে-বাজে কথাও বলে যাই। কথাটা হল, গোবিন্দ মাস্টার খড়ের গাদায় পৌঁছেছে। রাত্রে স্পাই আসবে। রামু নামে একটা ছেলে আসতে পারে খেয়াল রাখবেন।"

সে কে, কোথা থেকে এসেছে, কেনই বা পাগল সেজে থাকে— তার কিছুই জানা যায়নি। রামু অনেক করে জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিল, সে ভিনগ্রহ থেকে এসেছে।

“আলফা সেনটরের একটা গ্রহের নাম হচ্ছে নয়নতারা। কিংকর হল আসলে সেই গ্রহের লোক। ডাকাতদের সঙ্গে যখন আমরা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলুম না, তখন আমি টেলিপ্যাথিতে নয়নতারায় খবর পাঠাই। খবর পেয়ে কিংকর একদিন একটা মহাকাশযানে চেপে চলে এল। তারপর সব ঠিকঠাক করে দিয়ে সামলে-সুমলে দিয়ে ঘটনার সেই রাত্রে আবার নয়নতারায় ফিরে গেছে।"

 

"আর তুমি কে গবাদা?"

 

"আমি? ও বাবা, ও আবার কেমনধারা কথা! আমি হচ্ছি আমি, গবগবাগব পাগলা খুড়ো, উলিঝুলি ফোকলাটেকো নাংলাবুড়ো। ঝুলদাড়ি আর ঝোলা গোঁফে গুমসো ছিরি, নালে-ঝোলে চোখের জলে জড়াজড়ি!""

 

"তুমি কিন্তু মোটেই বুড়ো নও। বুড়োদের চামড়া এত টান থাকে না।"

 

"থাকে থাকে। এ কি তোমাদের এই নোংরা জায়গার আধমরা বুড়ো নাকি! এসব মেড ইন অ্যানাদার ওয়ার্লড।"

 

"তার মানে?"

 

"কথাটা কিন্তু খুব গুহ্য। গোপন রেখো।"

 

"রাখব। কিন্তু ফের গুল দিলে!"

 

"আহা, আগে শোনোই না। কাউকে বেলো না। আমিও আসলে ওই নয়নতারার লোক। সেখানে জল-হাওয়ার এমন গুণ যে, দেড়শো দুশো বছর বয়সে মানুষের যৌবন আসে।"

 

"ফের গুল?"

 

"গুল নয় গো। শুনলে প্রত্যয় যাবে না, সেখানে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের লোকেরা হামা দেয়। ত্রিশ-চল্লিশে গিয়ে হাঁটতে শেখে। আধো-আধো বোল ফোটে তখন। সত্তর বছর বয়সে আমাদের হাতেখড়ি। পঁচাত্তর বছর বয়সে ইসকুলের পাঠ শুরু। সেখানে গেলে দেখবে আশি নব্বুই বছরের লোকরা ঢিল মেরে আম পাড়ছে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে।"

 

"সেখানে কি কিংকরদার গাঁয়েই তোমার বাড়ি?"

 

"হ্যাঁ, তা বলতে পারো একরকম। পাশাপাশি গাঁ। ওর গাঁয়ের নাম বাঘমারি, আমার গাঁ হল কুমিরগড়। দু গাঁয়ের মধ্যে দূরত্ব মাত্র শ-পাঁচেক মাইল, একই থানা আমাদের।"

 

"বলো কী! পাঁচশো মাইল দূরের গাঁ কি পাশের গাঁ হল নাকি?"

 

গবা খুব হাসে। বলে, "তোমাদের এখানকার মতো তো নয়। আমাদের গ্রহটাও যে বিশাল। আমাদের একটা জেলা তোমাদের গোটা ভারতবর্ষের সমান। চলো একবার তোমাদের নিয়ে যার। জামবাটি ভর্তি সরদুধ আর সবরিকলা আর নতুন গুড় দিয়ে মেখে চিঁড়ের এমন ফলার খাওয়াব না। আর সেই জামবাটির সাইজ কী! ঠিক তোমার ওই পড়ার ঘরখানার মতো....."

 

"গুল! গুল!"

 

"আহা, শোনোই না...."

 

পরদিনই গবা আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। নয়নতারাতেই ফিরে গেল কিনা কে জানে!”

 

ডাকাত সাতনার ছোট্ট মেয়েটি চুরি গিয়েছিল। সে শুনতে পায়, মেয়েটির জিভ কেটে অন্ধ করে তাকে দিয়ে ভিক্ষে করানো হচ্ছে। অনেক খুঁজেও সে তার মেয়েকে ফিরে পায়নি। মা মরা ওই একরত্তিই ছিল তার অবলম্বন। সাতনা সার্কাসে খেলা দেখাতো। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়েই ঘুরতো। মেয়ে চুরি যেতে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে সে। যে চুরি করেছিল, সেই হরিহর পাড়ুইকে সে খুন করে। ওদিকে হরিহরের পিসি জানতেন এক গুপ্তধনের খবর, পথনির্দেশ শিখিয়ে রাখেন কাকাতুয়াকে। লোভে পড়ে হরিহরের সঙ্গে যোগ দেয় সার্কাসের আরেকটি খেলোয়াড় গোবিন্দ মাস্টার। তারা দুজনে যখন কাশিমের চরে পৌঁছয় গুপ্তধনের পিছু ধাওয়া করে, সাতনা এসে খুন করে যায় হরিহরকে। খুনের দোষ গিয়ে পড়ে গোবিন্দর ওপর। গোবিন্দর ফাঁসির হুকুম হয়। কিন্তু সে জেলের ভিতর বলে ফেলেছিল গুপ্তধনের খবর। এলাকার পুলিশ অফিসার কুন্দকুসুম গোপনে ডাকাতদল চালান। গুপ্তধনের লোভে তিনি গোবিন্দকে পালিয়ে যেতে দেন, সাতনাকে কাজে লাগিয়ে কাকাতুয়া তুলে আনেন। কাকাতুয়ার জন্য উদ্ধববাবু যাতে গোল না পাকান, তাই রামুকেও তুলে আনা হয়। কুন্দকুসুমের দুই ছেলে আন্দামান নিকোবর গল্পের মাঝে আলগা কিছু হিন্ট দিয়েছিল, কিন্তু কুন্দকুসুমই যে পালের গোদা সেইটি সত্যিই বিশাল বড় চমক এ উপন্যাসের। ট্যুইস্টের শেষ এখানেই নয়। মৃত হরিহরের ছেলে যুধিষ্ঠির সাহসী ভালোমানুষ। বাবা অন্যায় করেছেন, শাস্তি পেয়েছেন— এর চেয়ে বেশিকিছু সে ভাবে না। সে ছদ্মবেশে ঢুকেছে উদ্ধববাবুর বাড়িতে গৃহশিক্ষক হয়ে। যে কাকাতুয়া নিয়ে এত কাণ্ড, তাকে চোখে চোখে রাখাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তবে ক্লাইম্যাক্সে ডাকাতদলের সঙ্গে ফাইট করতে যে কিঙ্কর নামে নতুন এক চরিত্রের উদয় হল, শীর্ষেন্দু তার পরিচয়টা খোলসা না করলেও বেশ বোঝা যায়, এই কিঙ্করই হল যুধিষ্ঠির!

সব ভালো যার, শেষ ভালো তার— অদ্ভুতুড়ে সিরিজে লেখক এই আপ্তবাক্যটি সর্বদা মাথায় রাখেন। উপন্যাসের শেষে দারোগা কুন্দকুসুম চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যান। গোবিন্দ মাস্টারের মাথার ওপর থেকে ফাঁসির সাজা সরে যায়। আর সাতনা? সেও ক্ষমা পেয়ে যায়। যুধিষ্ঠির খবর দিয়েছিল তার মেয়েটি সুস্থ আছে, ভালো আছে। সে আজ কিশোরী। সাতনা মুখ লুকিয়েই তার মেয়েটিকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। সাতনাকে গবা বা যুধিষ্ঠির কেউই পুলিশে ধরিয়ে দেয়নি। সাতনা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে

“গবা মৃদু হেসে বলল, শাস্তি কাকে বলো তুমি? কত চোর-ছ্যাঁচোড় খুনে-জালিয়াতকে তো পুলিশ গারদে ভরে। জেল খেটে কি আর তাদের শুদ্ধি হয়। বাপু হে, আমি বুঝি অনুতাপের আগুন না জ্বললে মানুষের পাপ পোড়ে না। অনুতাপ কাকে বলে জানো? কোনো কাজ করে বিচার দ্বারা তার ভালমন্দ অনুভব করে যে তাপের দরুন মন্দে বিরতি আসে তাই হল অনুতাপ। সেই অনুশোচনায় নিজের মেয়েটার সামনে গিয়ে পর্যন্ত তুমি দাঁড়াতে পারছ না। এর চেয়ে বেশি সাজা তোমাকে আর কে দেবে?”

প্লট হিসেবে বেশ জটিল, তবে দুর্বোধ্য নয়। এর আগের কিছু অদ্ভুতুড়ে পড়তে গিয়ে যে অভিযোগটা বারবার উঠে আসছিল, তা হল লেখক চরিত্রগুলোর যেন শুধুমাত্র খসড়া বানিয়েছেন, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেননি। এ উপন্যাসে তেমনটা দেখা যায়নি। চরিত্রগুলো আর নিছক কেঠোপুতুল নেই, বেশ খানিকটা মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। এই যেমন, উদ্ধববাবু! তাঁর মতে, তিনি দারুণ সুন্দর গান জানেন। মাঝরাতে হঠাৎ তাঁর গান পায়, পাড়া প্রতিবেশী এসে ভিড় জমায়। তিনি বুঝেই উঠতে পারেননি, তিনি যেটাকে গান ভাবছেন সেইটি আসলে গান নয় বিকট চিৎকার! আছে গোবিন্দ মাস্টারের নিজের কথা। পুলিশ আর ডাকাতদের থেকে বাঁচতে সে রাখাল সেজে গরু চরাতো কিছুদিন। আর তখন ‘‘সারকাসের জন্য প্রাণটা বড় কাঁদে গোবিন্দর। চারদিক থেকে আলো এসে পড়ে, শূন্যে মাটিতে তার বা দড়ির ওপর হরেক রকম খেলা চলে, সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাণ্ডের আওয়াজ-সে যেন এক স্বপ্নের জগৎ। তা ছাড়া সারকাস হল এক বৃহৎ পরিবার। সকলের জন্য সকলে। সেই সারকাসে আর ফিরে যাওয়া হবে কিনা কে জানে!’’ চরিত্রগুলির এই নিজস্ব ভাবনাটুকুর পরিচয় না পেলে তাদের মনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারতো না পাঠক।

সবমিলিয়ে ‘হারানো কাকাতুয়া’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের একটি মনে রাখার মতো মাইলস্টোন। এখনও পর্যন্ত এ গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র কেন বানানো হল না, তা সত্যিই ভেবে দেখার প্রশ্ন।