গৌরের কবচ : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সপ্তম আখ্যান

গৌরের কবচ— অদ্ভুতুড়ে ৭

‘ফকিরবাবা, আমি বোধহয় বেশিদিন আর বাঁচব না।’

ফকিরসাহেব মোলায়েম গলায় বললেন, "বেঁচে থেকে হবেটা কী? বেঁচে থাকলেই খিদে পায়, খাটতে হয়, লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগে। তার চেয়ে মরে ভূত হয়ে আমার আরশিতে ঢুকে পড়, সুখে থাকবি।"

"তা না হয় থাকব ফকিরবাবা, কিন্তু বেঁচে থাকার দু-একটা সুখ না করে আমি মরতে পারব না।"

ফকিরসাহেব ভ্রূ কুঁচকে বলেন, "বেঁচে থাকায় আবার সুখ কী রে! মরলেই সুখ।"

"কিন্তু আমি যে জীবনে কখনও পোলাউ খাইনি, চন্দ্রপুলি খাইনি, লুচি দিয়ে পায়েস খাইনি, মোটরগাড়িতে চাপিনি, ঢেউপুরের রথের মেলায় সার্কাসের খেলা দেখিনি। আগে এ-সব হোক, তারপর মরব।"

শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বাকি উপন্যাসের তুলনায় ‘গৌরের কবচ’ যেন বড্ড বেশিরকম আলাদা। অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপারের কমতি নেই, তবে নির্ভেজাল হাস্যরসের বড়ই অভাব এ গল্পে। আছে কিছু সাদামাটা জীবনদর্শন, অলৌকিক অদ্ভুত আজব কান্ডকারখানা, আছে এক্কেবারে আঙুল তুলে দুষ্টু লোক চিনিয়ে দেওয়া, আর আছে একটি আদ্যন্ত ন্যাকা ছেলের গল্প। হ্যাঁ, ‘ন্যাকা’ই বলতে হচ্ছে, গৌর ছেলেটিকে ডেসক্রাইব করার জন্য একমাত্র এই শব্দটিই সবচেয়ে উপযুক্ত।

গৌরগোপাল, তার মা নেই, বাবা নেই। আছে দাদা-বউদি। দাদাটি বউয়ের ভারী বাধ্য। দুইটি অপোগণ্ড মারকুটে শ্যালকবাবাজি মাউ আর খাউ-কে পুষছেন তিনি। গৌরকে কেউ দু’চোখে দেখতে পারে না। ঠিকমতো খেতে পরতে দেয় না, যত পারে খাটিয়ে নেয়। গৌর তার জন্মভিটে ছেড়ে নড়বেও না। সুতরাং তার দুর্দশার একশেষ। মাউ খাউ ভারী বজ্জাত। গৌরের শিরদাঁড়াটি ভারী নমনীয় বুঝে ফেলেছে তারা। গৌরকে তারা জলে চোবায়, মারধোর করে সর্ষেফুলটি দেখিয়ে দেয়। গৌর সঅঅঅব সয়ে নেয়।

“হঠাৎ খাউ-মাউ দুই ভাইয়ের মজা উসকে উঠল। হঠাৎ দুজনে মিলে গৌরকে ধরে জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখল। দুষ্টু বাচ্চারা এ-রকম একটু-আধটু করে, কিন্তু এ-খেলায় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে জীবন সংশয়। মাউ আর খাউয়ের সেই কাণ্ডজ্ঞান নেই। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে যে তিন মিনিটের বেশি কিছুতেই শ্বাস বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়, এটা বোধহয় তাদের জানাও ছিল না। দুই ভাই গৌরকে জলের তলায় চেপে রেখে হিহি করে হাসছিল।

ওদিকে জলের মধ্যে গৌর তখন আস্তে-আস্তে এলিয়ে পড়ছে। শ্বাস নিতে গিয়ে ঘাঁতঘাঁত করে জল গিলে ফেলছে। চেতনা আস্তে-আস্তে মুছে যাচ্ছে।

কাঠ কেটে, মাটি কুপিয়ে গৌরের গায়ে জোর কিছু কম হয়নি। তা ছাড়া জলে সাঁতার কেটে কেটে তার দমও হয়েছে অফুরন্ত। ইচ্ছে করলে সে খাউ আর মাউয়ের থাবা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারত। কিন্তু ভালমানুষ গৌর মরতে মরতেও ভাবছে, 'যদি গায়ের জোর খাটাই তা হলে কুটুম-মানুষদের অপমান করা হবে। ওরা তো আমাকে নিয়ে একটু মজাই করছে। তার বেশি তো কিছু নয়। মজাটা যদি করতে না দিই তা হলে দাদা-বউদি বোধহয় রেগে গিয়ে তাড়িয়েই দেবে বাড়ি থেকে।' এই সব ভেবে গৌর আর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না। খুব বিনয়ের সঙ্গে মরার জন্য চোখ বুজে ফেলল।”

এই মানসিকতাকে ‘ন্যাকামি’ ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে!

গল্পে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আছে ফকিরসাহেব, কবরেজমশাই, গোবিন্দ চোর, সুবল বুড়ো। এরা সবাই গৌরকে মনে মনে ভারী স্নেহের চোখে দেখে। উত্তরাধিকারসূত্রে গৌরের হাতে আসে একটা কবচ। সেইটি নাকি জ্যান্ত হবে একদিন, যেদিন সাংঘাতিক বিপদ আসবে। কী বিপদ, কেন বিপদ, কার কবচ, কীসের কবচ কিছুই কেউ পরিষ্কার করে বলে না গৌরকে। গৌর যতদিনে জানল সবটা, ততদিনে ও বই পড়ে শেষ করার আগ্রহ মাথায় উঠেছে। গল্পে ভিলেন হল রাজা রাঘব, লম্বা চওড়া নিষ্ঠুর একটি মানুষ।

“রাঘবের পূর্বপুরুষেরা ছিল সাংঘাতিক অত্যাচারী। কেউ সামান্য বেয়াদবি করলেই তার গলা কেটে ফেলে দিত। আসলে ওরা রাজত্ব তৈরি করেছিল ডাকাতি করে। রাজা হয়েও সেই ডাকাতির ভাবটা যায়নি। প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগে একদল প্রজা খেপে গিয়ে মরিয়া হয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করে। প্রাণভয়ে রাজা আর তার আত্মীয়রা পালায়। বিদ্রোহী প্রজার হাতে কয়েকজন মারাও পড়ে। তখন যে রাজা ছিল তার নাম মাধব। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই বেয়াদবির শোধ সে নেবেই। সে না পারলেও তার বংশের কেউ-না-কেউ ফিরে এসে এখানে আবার রক্তগঙ্গা বইয়ে রাজ্য স্থাপন করবে।” একজন ছায়ামূর্তি এসে গড়গড়িয়ে রাঘবের ঠিকুজি-কুলুজি বলে যায় গৌরকে। ওদিকে রাঘব এত শক্তিশালী, এত ভয়ংকর লেভেলের সম্মোহিনী বিদ্যেয় পারদর্শী! সে কিনা রাতদুপুরে চুপিচুপি আসে দুটো বেয়াড়া অকালপক্ক বাচ্চা মাউ খাউয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে! তাদের বাড়ির নীচেয় নাকি রাঘবের পূর্বপুরুষের গুপ্তধনে ভরপুর তোষাখানাটি রয়েছে। রাঘব যদি এতই পাওয়ারফুল, সে তো চাইলেই গৌরের ঘরদোর ভেঙে উড়িয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করে নিতে পারত। গৌরের কবচ তো হিসেবমতো তখনও ঘুমন্তই ছিল। যাক গে, সিরিজের নামই অদ্ভুতুড়ে, সেখানে অত লজিক খুঁজে কি লাভ!

রাঘব চাইল গৌরকে খুন করতে। তার জন্য সে গাঁটের কড়ি খরচা করে কবাডি কম্পিটিশন অ্যারেঞ্জ করল। দেদার খানাপিনা, সোনার মেডেল রইল প্রাইজ হিসেবে। আবারও প্রশ্ন জাগে, কেন? রাঘব চাইলেই দুটো সুপারি কিলার পাঠিয়ে গৌরকে সাবাড় করে ফেলতেই পারতো। গৌর অবশ্য একটি ছুপা সুপারম্যান গোছের প্রাণী। অমন তাবড় তাবড় গুন্ডাদের কুপোকাত করে ফেলল ঘুমন্ত কবচ ট্যাঁকে গুঁজে। “গৌর পড়ে গেল না, ঘাবড়াল না। সাবধানে দমটা ধরে রেখে সে শরীরে একটা ঘূর্ণি তুলল আবার। চরকির মতো বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খেতে লাগল সে। আর ঘূর্ণাবেগে ন'পাড়ার বিশালদেহী খেলোয়াড়রা ছিটকে ছিটকে যেতে লাগল এদিক-সেদিক। দু'জন গিয়ে পড়ল কোর্টের বাইরে, একজন দর্শকদের মধ্যে। গৌর সবাইকে আউট করে নিজের কোর্টে ফিরে আসতেই এমন তুমুল হাততালি আর হর্ষধ্বনি উঠল যে, কানে তালা ধরার উপক্রম।” 

রাঘব এই হিপনোটাইজ করে গৌরের কবচ গেঁড়িয়ে নিল, ওই কটা দুবলা পাতলা গুন্ডা পাঠিয়ে গৌরকে ঠ্যাঙানি দিল, আবার নিজেই এসে তাকে দলে ভর্তি করে নিল। গল্পের মাথামুন্ডু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গল্পে এতটুকু কমিক রিলিফ নেই। আগাগোড়া গুরুগম্ভীর সিরিয়াস টোনে একখানা আজগুবি গল্প বলার চেষ্টা— শেষপাতা পর্যন্ত পৌঁছতে হাঁফ ধরে যায়। কবাডি খেলার খুঁটিনাটি প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা হয়েছে। মড়া জাগানো, কালো আকাশ জুড়ে অশরীরী কীর্তিকলাপ, জোব্বা পরা ভিলেনের উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণ বিলিতি হরর ঘরানার মুভির দৃশ্যের সঙ্গে বড় মিল। রাঘবের সঙ্গে যুদ্ধে গৌর যেমন ক্লান্ত, পড়তে পড়তে পাঠকও ক্লান্ত। হয়তো বা লেখকের কলমখানাও বিদ্রোহ করে বসেছিল। তাই কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ কেমন অদ্ভুত হাস্যকর ক্লাইম্যাক্স ঘটে যায়—

“রাঘব যে সাংঘাতিক শক্তিশালী পুরুষ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আসল শক্তি হল সম্মোহন। তার চোখের দিকে তাকালেই প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে বশ মেনে নেয়। সেই সম্মোহনের জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে গৌর। রাঘবের গায়ে যত জোরই থাক, গৌরও তো ভেড়া নয়।

দুজনের তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলতে লাগল। কখনও রাঘব তার গলা টিপে ধরে, কখনও গৌর তার কোমর ধরে প্যাঁচ মেরে ফেলে দেয়। কখনও রাঘব তার ঘাড়ে রদ্দা চালায়, কখনও গৌর তার ঠ্যাং ধরে উলটে ফেলে দেয়।

মড়া দুটো ঘাপটি মেরে বসে সবই দেখছিল। একজন মাথা নেড়ে বলল, "হচ্ছে না।"

আর-একজন বলল, "তা হলে মুষ্টিযোগ দিই?"

"দাও।"

তখন একজন মড়া খুব চিকন সুরে বলে উঠল, "রাঘবের চুলে আরশোলা।"

এই শুনে রাঘব বেখেয়ালে নিজের চুলে হাত দিল।

গৌর অবাক হয়ে দেখল, নিজের চুলে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাঘব চোখ উলটে গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

বেকুবের মতো কিছুক্ষণ রাঘবের দিকে চেয়ে রইল গৌর। তারপর তার নজর পড়ল, মড়া দুটোর ওপর। সেইরকম ঘাপটি মেরে বসে তাকে জুলজুল করে দেখছে।

"তবে রে? এবার তোদেরও ব্যবস্থা করছি!" বলে গৌর তাদের দিকে তেড়ে যেতেই মড়া দুটো ভয়ে সিটিয়ে গেল।

একটা মড়া বলে, "উহু উহু, ছুঁসনি রে হতভাগা! তফাত থাক! আমরা মড়া নই!"

"তবে কী?"

দাঁত খিঁচিয়ে মড়াটা বলল, "আমি ফটিক। তুই আমার নাতির নাতি। আমাদের দেবদেহ, ওই এঁটোকাঁটা নরদেহ নিয়ে আমাদের ছুঁলে মহাপাতক হবে।"

ফটিক! গৌর হাঁ হয়ে গেল।

মড়া দুটো উঠে দাঁড়িয়ে গা-ঝাড়া দিল। ফটিক বলল, "সারাজীবন লড়াই করেও রাঘবকে কাবু করতে পারবি না। ক্রমে-ক্রমে তোকে হাফসে-হাফসে মেরে ফেলত। তাই মুষ্টিযোগটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলাম।"

গৌর অবাক হয়ে বলল, "মুষ্টিযোগ কী?”

"রাঘবের নিয়তি ওর চুলে। চুলে হাত দিলেই ওর পতন। তা এমনিতে কিছুতেই চুলে হাত দেওয়ার লোক নয় রাঘব। তোর সঙ্গে লড়াই করতে করতে যখন আনমনা হয়ে গিয়েছিল, তখনই কৌশলটা কাজে লাগালুম। এখন আমরা চলে যাচ্ছি। আর দেখা পাবি না।"

অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই সাতনম্বর উপন্যাস আদৌ মনে রাখার মতো নয়। এতটা দুর্বল প্লট, এত লুপহোল— এ পড়ে যেন মনে হয় গানপয়েন্টে লেখককে রেখে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে! খুবই অগোছালো, তড়িঘড়ি করে লেখা। ফ্যান্টাসি ফিকশন গোত্রে এই ধরনের লেখা শীর্ষেন্দু আরও লিখেছেন। কুসংস্কার, গ্রাম্য মিথ কতকিছুই কত সুন্দরভাবে গল্পে এনেছেন। কিন্তু এ গল্পে এমনটা কেন হল, তার উত্তর অজানা।