
মোহন রায়ের বাঁশি - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ত্রিশতম আখ্যান
- 22 June, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
গল্পটা বলছেন ছোটদের, কিন্তু আসলে নিশানায় রয়েছে ছোট বড় সক্কলে— অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এই তিরিশ নম্বরটি একটি বর্ণচোরা আম। সিরিজে এর আগের কিছু গল্পে শীর্ষেন্দু বেশ রয়েসয়েই রাজনীতি, সিস্টেমের গলদ, বাঙালির মজ্জাগত কিছু বাতিকের প্রসঙ্গগুলো এনেছেন, যা অনেকটা যেন কুটুস কুটুস কামড়ের মতোই লাগে। কিন্তু এই ‘মোহন রায়ের বাঁশি’তে সেসব আর ‘subtle’ নয়, এক্কেবারে খোলাখুলিই হুল ফুটিয়েছেন। গল্পের নিষ্কর্মা দারোগা, অশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতার চরিত্ররা আমাদের খুব খুব চেনা। আর অজস্র রেফারেন্স। রবিঠাকুর, নজরুল তো আছেনই, শক্তি চাটুজ্যের ‘অবনী বাড়ি আছ’, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, এমনকি নটি বিনোদিনী, শ্রীরাধিকার অভিসারও গল্পে ঘাপটি মেরে আছে। এইভাবে ‘বড়দের সাহিত্য’ থেকে রেফারেন্স তুলে আনার কাজটি ছোটদের ছোট্ট মগজের জন্য মোটেই করা হয়নি।
গল্প শুরু হয় বটেশ্বর চরিত্রটি দিয়ে। একজন বুড়ো ফেরিওয়ালার থেকে বউকে লুকিয়ে সে একটি সুন্দর বাঁশি কিনেছে। বাঁশি সে বাজাতে জানে না। কিন্তু বাঁশিটি এমনই আশ্চর্য সুন্দর, ওইটি নিজের করে না পাওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি হচ্ছিল না।
বটেশ্বর একজন দুঃখী মানুষ। খুবই জটিল চরিত্র।
বটেশ্বরের সব থেকেও কিচ্ছুটি নেই। সুকুমার রায় ‘কিম্ভূত’ কবিতাটা মনে আছে?
“এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না
কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায় না।
কোকিলের মত তার কন্ঠেতে সুর চাই, গলা শুনে আপনার, বলে, 'উঁহু, দূর ছাই!'
আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই।
তাই দেখে মরে কেঁদে
তার কেন ডানা নেই।
হাতিটার কি বাহার দাঁতে আর শুণ্ডে
ও-রকম জুড়ে তার দিতে হবে মুণ্ডে!
ক্যাঙ্গারুর লাফ দেখে হয় তার হিংসে
ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢেঙে চিমসে!
সিংহের কেশরের মত তার তেজ কই?
পিছে খাসা গোসাপের খাঁজকাটা লেজ কই?”
বটেশ্বর হল ঠিক এইরকম একজন মানুষ। সে নিজেকে নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নয়—
“কিন্তু হায়, বটেশ্বর বাঁশিতে ফুঁ দিতেও জানে না।
নিজের অপদার্থতার কথা ভেবে তার চোখে জল আসছিল।
জীবনে সে কিছুই তেমন পেরে ওঠেনি। ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল হাঁদু মল্লিকের মতো বড়লোক হবে। হতে পারল কি? হরিপদ কানুনগোর মতো ফুটফুটে চেহারাও তো ভগবান তাকে দেননি। ব্রজকিশোর দাসের পেল্লায় স্বাস্থ্যের ওপর কি কম লোভ ছিল তার? কিছুদিন ব্যায়াম ট্যায়াম করে শেষে হাল ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তারক রায়ের মতো সুরেলা গলা কি তার হতে পারত না? আর কিছু না হোক গোটা মহকুমা যাকে এক ডাকে চেনে সেই শাজাহান, সিরাজদ্দৌলা বা টিপু সুলতানের ভূমিকায় দুনিয়া কাঁপানো অভিনেতা রাজেন হালদারের মতো হতেই বা দোষ কী ছিল? কিংবা লেখাপড়ায় সোনার মেডেল পেয়ে গরিবের ছেলে পাঁচুগোপাল যে ধাঁ করে বিলেত চলে গেল। সেরকমটা কি একেবারেই হতে পারত না তার? পাঁচুগোপাল যে স্কুলে পড়েছে সে-ই নরেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে তো সেও পড়ত। জামা নেই, জুতো নেই, খাবার জুটত না, তবু পাঁচু সোনার মেডেল পেল। আর বটেশ্বর? এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে উঠতে যেন দম বেরিয়ে যেত তার। মনে হত পরের ক্লাসটা কত উঁচুতে রে বাপ! পেটে বিদ্যে নেই, গলায় গান নেই, শরীরে স্বাস্থ্য নেই, মুখে রূপ নেই, বেঁচে থাকাটার ওপরেই ভারী ঘেন্না হয় তার।”
অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এমন জটিল মনস্তত্ত্বের উদাহরণ নেহাত কম নেই।
গল্পে রহস্য ঘনিয়ে আসে, যখন জানা যায় এই বাঁশির খোঁজেই দুজন মানুষ গোটা গ্রাম তোলপাড় করছে। তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছে কেতুগড়ের রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হিসেবে। তারা বলছে, এই বাঁশিটি মোহন রায়ের, রাজবাড়ির বাঁশুরিয়া ছিলেন তিনি। কোনও এক চোর নাকি রাজবাড়ি থেকে অনেক কিছু চুরি করে গাঁয়ে অল্প দামে বিলি করে বেড়াচ্ছে। সে চোরাই মালের মধ্যে এই বাঁশিটিও ছিল। তারা বাঁশিটা ফেরত পেতে চায়।
ময়নাগড় গ্রামের মানুষ এমনিই সাদাসিধা, যে যা বোঝাবে তাই তারা মেনে নেয়। তার ওপর স্বয়ং রাজামশাই এসে বাঁশি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাঁর আঙুল ভর্তি দামী আংটি, পায়ে দামী জুতো, পরণে দামী কাপড়— গ্রামের লোক তাতেই ভুলেছে। তারা কেউ তলিয়ে ভাবছে না, কে কী কেন-গুলো।
গল্পে অনেক অনেক চরিত্র। খুবই যত্ন নিয়ে প্রত্যেককে এঁকেছেন লেখক।
একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ কালীপদ সমাদ্দার। তার মনে হয়, সর্বক্ষণই তার শরীরে কোথাও না কোথাও ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা ছাড়া জীবনে একটা দিনও কাটায়নি সে। “একদিন দাঁতব্যথায় কাতরায় তো পরদিন কান কটকটানির চোটে বাপ রে মা রে করে চেঁচায়। পরদিনই হয়তো কানের বদলে হাঁটু কামড়ে ধরে একটা কেঁদো বাঘ যেন হাড়মাস চিবোতে থাকে। দু'দিন পর মাজায় যেন কুণ্ডুলের কোপ পড়ার মতো ঝলকে ঝলকে ব্যথা শানিয়ে ওঠে। কোমর সারল তো মাথায় যেন কেউটের ছোবলের মতো ব্যথার বিষ তাকে কাহিল করে ফেলে। যেদিন আর কোনও ব্যথা না থাকে সেদিন পেটের মধ্যে পুরনো আমাশার ব্যথাটা চাগিয়ে উঠে তাকে পাগল করে তোলে। ব্রজ কবরেজ অনেক নিরখ পরখ করে বলেছে, 'আসলে ব্যথা তোমার একটাই, তবে সেটা বানরের মতো এ ডালে ও ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। ও ব্যথা যেমন চালাক তেমনি বজ্জাত। হাঁটুর ব্যথার ওষুধ দিলে ও গিয়ে মাজায় ঘাপটি মেরে থাকে। মাজায় ওষুধ পড়লেই লম্ফ দিয়ে দাঁতের গোড়ায় গিয়ে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে তাড়া খেলে গিয়ে কানের মধ্যে সেঁধোয়। ওর নাগাল পাওয়াই ভার, তাই বাগে আনাও শক্ত।"
সুদের কারবারী হাঁদু মল্লিক মাঝে মাঝে সোজা হিসেব গুলিয়ে ফেলে। ছত্রিশের কত নামবে আর কত হাতে থাকবে তা ভেবে বের করতে হিমশিম খায়। ফেরিওয়ালার থেকে খানদুই মোহর সে কিনে ফেলেছে মাত্র তিরিশ টাকায়। প্রথমে ভেবেছিল ওগুলো রূপোর জল করা টাকা, কিন্তু পরে বিধু স্যাকরা যখন যাচাই করে দেখালো রূপোর মোড়কের ভেতরে সোনার মোহর, হাঁদু মল্লিকের মাথায় হাত! পঁচিশখানা মোহর সে ফিরিয়ে দিয়েছে। দুঃখে শোকে তার পাগল পাগল দশা, রাতে ঘুম হচ্ছে না, পেটে গ্যাস হচ্ছে।
হাঁদুর কাছে ধার চাইতে আসা বিশুর মেজাজ ভারী চড়াসুরে বাঁধা থাকে। তার দাবি খুব বেশি নয়। সে একটু কাদা চিংড়ি দিয়ে চচ্চড়ি খেতে চায়, তাই দশটা টাকা ধার করতে এসেছে।
সেখানে আরেকজন বসে আছে, সে রাখাল মোদক। তার নেশা হল টাকার গন্ধ শোঁকা। তাই সে হাঁদুর গদিতে এসে বসে থাকে। তাকে সবাই বোকা বলে, তাই তারও ধারণা সে একজন বোকা লোক। শুধু মুশকিল একটাই, মাঝেমাঝে সে চালাকের মতো কাজ করে ফেলে। তাই তার ধারণা হয়েছে তার বোকামিতে ভেজাল আছে! “কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে মাঝরাতে চোর ঢুকেছিল। রাখাল ঘুম ভেঙে চোরকে দেখে বলে উঠল, "আহা, করো কী, করো কী, আমি যে বড্ড বোকা মানুষ। আমার বাড়িতে কি চুরি করতে আছে?” চোরটা খুব বিরক্ত হয়ে বলল, "কে বলল আপনি বোকা? আপনাকে তো বেশ সেয়ানা লোক বলেই মনে হচ্ছে। চোরকে ভড়কে দিতে চান বুঝি?” রাখাল বেশ বুক ফুলিয়ে বলল, "মোটেই সেয়ানা নই হে, ময়নাগড় ছুঁড়লেও তুমি আমার মতো বোকা লোক পাবে না," চোরটা একটা ফুৎকারে তার দাবি নস্যাৎ করে বলল, "ওই আনন্দেই থাকুন। পদ্মলোচন আঢ্যকে চেনেন? যে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বটপাতা দিয়ে সাজা পান খেয়ে তারিফ করেছিল? আর হরেন পাড়ই কি কম যায় নাকি? পাশের নন্দরামের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, হরেন পাড়ই গিয়ে সর্দারের হাতে পায়ে ধরে বলে কি, আমার বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো না দিলেই যে নয়। নন্দরামের বাড়িতে ডাকাতি হল আর আমার বাড়িতে যদি না হয় তা হলে কি শ্বশুরবাড়িতে আমার প্রেস্টিজ থাকবে? তা আপনি কি তাদের চেয়ে বেশি বোকা? বোকা হলেও আপনি মোটেই এক নম্বর নন, তিন চার বা পাঁচ নম্বর।" রাখাল এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক ওই সময়ে তার বউ উঠে ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়া করায় চোরটা পালিয়ে যায়। উপরন্তু মাঝরাতে চোরের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বউয়ের ঘুম ভাঙানোয় বউ রেগে গিয়ে রাখালকে উস্তম কুস্তম বকাঝকা করে। আজকাল তাই নিজের বোকামি সম্পর্কে রাখালের একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। হয়তো সে নিরেট বোকা নয়, তার বোকামিতে হয়তো ফুটোফাটা আছে। চোরটা কত বাড়িতে ঘোরে, কত অভিজ্ঞতা!”
এই তিন মক্কেলের সামনে যখন বাঁশি খুঁজতে আসা লোকদুটো উদয় হল, তিনজনেরই অভিব্যক্তি একইরকম। তারা বাইরের চাকচিক্য দেখেই মজেছে। সত্যিকারের ‘রাজামশাই’ ভেবে নিয়ে তৈলাক্ত তোষামুদে কথাবার্তা বলেছে। একটিবারও প্রশ্ন করেনি, সব ছেড়ে বাঁশিই কেন চাই!
এরপরেই আসে সত্যগোপালের কথা। ছেলেটি পড়াশোনায় বড়ই খারাপ ছিল। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে দুটো বছর, সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে তিন বছর, সেভেন থেকে এইটে উঠতে আরও তিন এবং বছর চারেকের চেষ্টায় সে একদিন মাধ্যমিক পাশও করে ফেলল। স্কুলের হেডস্যার থেকে বাকি সকলেই ধরে নিয়েছিল সত্যগোপালের ভবিষ্যত ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু, না! সে এখন গোটা তল্লাটের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। সে হয়েছে নেতা! এলাকার যত স্কুল কলেজ আছে সে সবকটারই গভর্নিং বডির মেম্বার কিংবা প্রেসিডেন্ট, সব কটা ক্লাবের সে চেয়ারম্যান কিংবা সেক্রেটারি, পঞ্চায়েতের চাঁই, গরিব গুর্বোর নেতা। তল্লাটে যত সভা সমিতি হয় সব জায়গায় তার ডাক পড়ে। হয় সভাপতি, নয় প্রধান অতিথি, কিংবা বিশেষ অতিথি। গল্পের এই সত্যগোপালের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা কাদের মিল, সে না হয় উহ্যই থাক।
তবে সত্যগোপালের একটি বিশেষ গুণ আছে, যার জোরে সে আজ ময়নাগড় হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। তার আছে কমনসেন্স, নানারকম ফিচেল বুদ্ধি, বোকাহাবা জনতা জনার্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার অজস্র ফন্দিফিকির তার আয়ত্তে রয়েছে। এদিকে সে কম্পিউটারকে ‘কম্পাউন্ডার’ বলে! বৃক্ষকে বলে ‘বিক্ষ’! ‘তিরোধান’ ‘অন্তর্ধান’এর ফারাক বোঝে না। কিন্তু সে মাথামুন্ডুহীন যাই বক্তৃতা দিয়ে আসে, হাততালির বন্যা বয়ে যায়। কি ভাগ্যিস, এ গল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সেই ২০০৩ সাল নাগাদ। আর বছরকুড়ি পরে লিখলে কেউ বা কারা হয়তো নিজের সাথে মিল খুঁজে পেয়ে ভারী রাগ করত!
“সত্যগোপাল হাসি-হাসি মুখে বলল, "বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অবদান হল ওই কম্পাউন্ডার।"
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সচ্চিদানন্দবাবু পাশ থেকে সসম্ভ্রমে চাপা গলায় বললেন, "ওটাকে কেউ কেউ কম্পিউটারও বলে থাকে।”
সত্যগোপাল একটু অবাক হয়ে বলে, "বলে নাকি?"
কলেজের ফিজিক্স ল্যাবরেটারির জন্য দু'লাখ টাকার একটা সরকারি অনুদান কিছুদিন আগে এই সত্যগোপালই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। তা ছাড়া সচ্চিদানন্দবাবুর সেজো মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধও হচ্ছে আবার সত্যগোপালের শালার সঙ্গে। তাই সচ্চিদানন্দবাবু খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, "বললেও হয়। কম্পাউন্ডারও যে চলে না তা নয়, তবে কম্পিউটার কথাটারই চল একটু বেশি আর কী।"
প্রবল হাততালির শব্দে অবশ্য সচ্চিদানন্দবাবুর কথা শোনা গেল না।”
মিছিমিছি এক ষাঁড়ের ভয়ে নেতা দৌড়ে পালাচ্ছে। দেখাদেখি বাকি সবাই কিছু না জেনে বুঝেই দৌড়ে পালাচ্ছে নেতার পিছু পিছু। এ গল্প তার অঙ্গে অঙ্গে যে কি সাংঘাতিক রাজনৈতিক স্যাটায়ারের গয়না পরে রয়েছে, গল্প যত এগিয়েছে জৌলুষ তত খোলতাই হয়েছে।
সত্যগোপাল দাঁড়িয়ে খানিক দম নিল। ছিঃ ছিঃ, এখন ভারী লজ্জা করছে তার। পাবলিকের সামনে ওরকম কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি। তার ভাবমূর্তিটা যে একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল!
বাড়ি ফেরার সময় প্যাংলা অবশ্য বলল, তার ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। পরিস্থিতির চাপে মাঝে-মাঝে নেতাদের ভাবমূর্তি টলোমলো হয় বটে, কিন্তু দু-চারদিনের মধ্যেই আবার আঁট হয়ে বসে যায়। তার কারণ, পাবলিক কোনও ঘটনাই বেশিদিন মনে রাখতে পারে না।
সত্যগোপাল দুঃখ করে বলল, "মাছের ওপর বারোটা কোটেশন মুখস্থ ছিল রে, সেগুলো যে জলে গেল।"
"তাতে কী, বক্তৃতা তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। এই তো কাল কালীতলায় নবীন সঙ্ঘের সঙ্গে ভবতারিণী বিদ্যাপীঠের বিন্ধ্যবাসিনী স্মৃতি শিল্ডের ফাইনাল ফুটবল ম্যাচেও আপনি সভাপতি। কোটেশনগুলো সেখানেই ঝেড়ে দেবেন।"
"দূর! ফুটবলের সঙ্গে কি মাছ যায়!"
"আহা, লোকে অত খতিয়ে দেখে না। এই তো সেদিন তাঁতিপাড়ায় অষ্টপ্রহর মহানাম সংকীর্তনের উদ্বোধনী ভাষণে আপনি পাটচাষিদের দুঃখ আর চিংড়ির ফলন বাড়ানোর কথা বললেন, কেউ কিছু আপত্তি করেছে কি? লোকে তো হাততালিও দিল। বললুম না, লোকে অত তলিয়ে বোঝে না। আপনার বক্তৃতার ডেল্থ বোঝার এলেমই নেই ওদের।"
কিন্তু এই সত্যগোপালই একমাত্র প্রশ্ন তুলেছিল, সব ছেড়ে বাঁশির খোঁজ পড়েছে কেন! হবে না? রতনেই তো রতন চেনে। সত্যগোপালের নিজের বেশ বোলবোলাও আছে ময়নাগড়ে, সে কেন রাজত্বহীন রাজাকে দেখামাত্রই ভক্তি শ্রদ্ধায় নুইয়ে পড়বে? সত্যগোপাল আর তার চেলা প্যাংলা দুজনেই বেশ পোড় খাওয়া ধুরন্ধর, তারা গোটা ময়নাগড়কে বোকা বানাতে পারে, তাই তাদের গুলতাপ্পি দিয়ে বশ করা দুজন এলেবেলে ফ্রডের কম্মো নয়।
"রাজা! আপনি কি রাজপুত্তর নাকি মশাই! আগে বলতে হয়! এঃ হেঃ, আপনার এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা তো ঠিক হচ্ছে না! কী বলিস প্যাংলা?"
প্যাংলা বিগলিত হয়ে বলল, 'সর-ননী খাওয়া শরীর তো, ঘ্যাচাং করে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।"
লোকটা মৃদু হেসে বলল, "আরে না না। রাজত্বই নেই তো রাজা। রাজাগজা নই। ওই পৈতৃক বাড়িটাই যা আছে। ঠাটবাট বজায় রাখাই কঠিন।"
প্যাংলা বলল, 'কিন্তু আপনার ঠাটবাট তো কিছু কম দেখছি না। আঙুলে আংটি ঝিলিক মারছে, তা ধরুন দু-চার হাজার টাকা তো হবেই! পায়ের জুতোজোড়াও চমকাচ্ছে, তা ধরুন এক দেড়শো টাকা হেসেখেলে দাম হবে না?"
রাজার ভেক ধরে আসা লোকটি বুঝে গেছে এরা সোজা মানুষ নয়। তাই এদের সঙ্গে কথাও বলেছে অন্য সুরে। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে কথা বলেছে বেশ রাজোচিত গাম্ভীর্য বজায় রেখে, কিন্তু সত্যগোপালকে সে ‘আপনি আজ্ঞে’ করেছে। বাঁশির যা হোক একটা বৃত্তান্তও রেখেঢেকে বলেছে তাদের। কিন্তু পালটা প্রশ্ন আসে তক্ষুণি।
সত্যগোপাল অবাক হয়ে বলল, "বাঁশি?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ। বহু পুরনো জিনিস। শ'দেড়েক বছর আগে কেতুগড় রাজবাড়ির দরবারে মোহন রায় নামে একজন বাঁশুরে ছিলেন। ভবঘুরে আর ক্ষ্যাপাটে গোছের লোক। মাঝে মাঝে কোথায় উধাও হয়ে যেতেন। কেউ বলত লোকটা মস্ত সাধক, কেউ বলত জাদুকর। তাঁকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। চুরি যাওয়া বাঁশিটা তাঁরই। আমরা সেটা উদ্ধার করতে এসেছি। হাজার টাকা পুরস্কার। আপনি তো গণ্যমান্য লোক, সবাই আপনাকে ভারী ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়।"
"বাঁশিটাই খুঁজছেন কেন বলুন তো?"
"আজ্ঞে, পুরনো জিনিস তো, একটা স্মৃতিচিহ্ন। তা ছাড়া লোকে বলে, ও বাঁশি আর কেউ বাজাতে পারে না। যদিও বা কেউ বাজাতে পারে তা হলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বে। আমরা আসলে কথাটা বিশ্বাস করি না। গুজবই হবে। তবু বলাও তো যায় না। আমরা চাই না বেঘোরে একটা লোকের প্রাণ যাক। আপনি একটু চেষ্টা করলে বাঁশিটা উদ্ধার হয়। একটা লোকের প্রাণও বাঁচে।"
এরপরের চরিত্রটি হল পরাণ চোর। সে জাতে চোর বটে, কিন্তু চুরির বেলা অষ্টরম্ভা। তার বউটি একজন নামী চোরের মেয়ে। বাকি চোরেরা নেকলেস আনে, দোতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলে। কিন্তু পরাণের দৌড় ফুলদানি পর্যন্ত। অগত্যা চব্বিশঘন্টা বউয়ের গাল খেতে হয় তাকে। পরাণের জীবনে তাই বড্ড দুঃখ। চুরিটুরি তার তেমন আসে না। এমনকি পুলিশের খাতায় তার নামটুকু পর্যন্ত ওঠেনি, এতটাই এলেবেলে চোর সে। কিন্তু সে যে করে হোক, একদিন নামীদামী চোর হবে, তার বউ তাকে নিয়ে গর্ব করে একদিন বলবে যে সে পরাণচোরের বউ— এটুকুই তার স্বপ্ন, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
গভীর রাতে পরাণচোরের বাড়িতে এল সেই ফেরিওয়ালা, যে সামান্য দামে রাজবাড়ির জিনিস বেচে বেড়িয়েছে গোটা গ্রামে। সে ফেরিওয়ালা আর কেউ নয়, একসময়ের বিখ্যাত চোর শ্রীনিবাস। চুরিটা তার পেশা নয়, নেশা। কখনও সে নিজের জন্য চুরি করেনি। চুরি করার যে থ্রিল, অ্যাড্রিনালিন রাশ সেটুকুই সে উপভোগ করত মাত্র। চোরাই মাল বিলিয়ে দিত। সে কোচিং ক্লাস খুলে চোর তৈরি করত, আর দারুণ বাঁশি বাজাতো। এখন সে বুড়ো হয়েছে, রিটায়ার করেছে।
কিন্তু শ্রীনিবাস চোরের ডাক পড়ল একদিন কেতুগড়ের রাজবাড়িতে। অনেক অনেক বছর আগে কেতুগড় রাজবাড়ির বাঁশুরিয়া মোহন রায় বানিয়েছিলেন আশ্চর্য এক বাঁশি। সে বাঁশি বাজালে প্রথম ফুঁয়ে যে শুনবে তার মনটা ভারী খুশি খুশি হবে, দ্বিতীয় ফুঁয়ে সে ঘুমিয়ে পড়বে, তৃতীয় ফুঁয়ে ভূমিকম্প প্রলয়কান্ড বাধবে। বাঁশি বাজানোর মন্ত্রগুপ্তি বংশপরম্পরায় শুধুমাত্র রায়বংশের উত্তরাধিকারীরাই জানত। আর হালকা আঁচ পেত রাজপরিবারটি। কেতুগড়ের শেষ বুড়ো রাজা ভারী পেটপাতলা। তিনি একদিন মোহন রায়ের উত্তরাধিকারীর হাতে লেখা কাগজে পড়লেন, ছেলেপিলে ছিল না বলে তিনি বাঁশির বিদ্যে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন শ্রীনিবাস চোরকে। ব্যস্, আর যায় কোথা! গোপন কথাটি কাউকে না বলা পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই। বলে বসলেন পোষা কাকাতুয়াটিকে। কাকাতুয়ার মুখে খোঁজ পেয়ে চড়াও হল নায়েবের বজ্জাত গুন্ডা ছেলেটি। রাজা প্রাণের ভয়ে সব ফাঁস করে দিলেন। তারপর কুটকুট করে বিবেকের কামড় খেতে ডাকলেন শ্রীনিবাস চোরকে। তাকে দিয়ে বাঁশি, জাপানি পুতুল, বিলিতি ফুলদানি, মোহর, রেকাব ও আরও অনেক কিছু চুরি করালেন। সেগুলিই শ্রীনিবাস ফেরিওয়ালা সেজে গ্রামে বিলি করে বেড়িয়েছে। আসলে ওগুলো সে গাঁয়ের লোকের কাছে গচ্ছিত রেখেছে মাত্র। সুযোগ বুঝে ফের একদিন চুরি করে সব সে রাজবাড়িতেই ফেরত দিয়ে আসবে।
বাঁশির ইতিবৃত্ত শোনাতক পরাণচোরের স্বপ্ন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছিল!
“বড্ড আশায় আশায় ছিলাম, বাঁশিটা পেলে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে নিশ্চিন্তে কাজকারবার বাগিয়ে নেব। বেশি কিছু নয় ওস্তাদ, একখানা পাকা দোতলা বাড়ি, পনের-বিশ বিঘে ধানী জমি, দুটো দুধেল গাই, বউয়ের গায়ে দু-চারখানা সোনার গয়না, আর ধরুন আমার একখানা আলপাকার কোট আর সাহেবি টুপির বড় শখ। দজ্জাল বউটার মুখের মতো একখানা জবাব দিতে পারতুম তা হলে। মুখনাড়া দিতে এলেই এক বান্ডিল নোট ছুঁড়ে দিতুম পায়ের কাছে, তা হলেই মুখে কুলুপ। তা সেই আশায় কি লাল সিগন্যাল পড়ে গেল ওস্তাদ? লেভেল ক্রসিং-এর গেট কি বন্ধ হয়ে গেল? নটী বিনোদিনীর পার্ট করতে করতে কি হিরোইনের বাঁধানো দাঁত খসে পড়ে গেল? নাকি শ্রীরাধিকার অভিসারের পথে আয়ান ঘোষ গদা ঘোরাতে ঘোরাতে মুলোর মতো দাঁত বের করে বুক চিতিয়ে এসে দাঁড়াল?"
আগের গল্পেই বলা হয়েছে, ঝড়তিপড়তি রাজবাড়ির ওপর লেখকের অদ্ভুত টান রয়েছে। সিরিজে এমন অনেক হা-ঘরে রাজাদের কথা রয়েছে। এই গল্পের রাজাও বড্ড গরিব।
‘‘রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের বাপমশাই রাজা ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ গরম ভাতে দু'হাতা করে ঘি খেতেন, তাঁর এক্কা গাড়ির ঘোড়ার লেজে দামি আতর মাখানো হত যাতে ঘোড়া ছুটলে এক্কা গাড়িতে বসে রাজামশাই ভুরভুরে গন্ধ পান, আসল পাকা সোনার সুতো দিয়ে রাজার নাগরায় নকশা করা হত, তিনদিনের বেশি এক জোড়া নাগরা পরতেন না, চাকরবাকরদের দান করে দিতেন। সেসব দিন তো আর নেই। দিগিন্দ্রনারায়ণের তো এখন পোলাও খেতে ইচ্ছে হলে রানিমা সর্ষের তেলে ভাত ভেজে দেন, রাজবাড়িতে এখন ছেঁড়া গামছাখানাও সেলাই করে ব্যবহার করা হয়, রাজমাতা মিতব্যয়িনী দেবীকে আর আলাদা করে একাদশী করতে হয় না, রোজই তাঁর একাদশী।"
গল্প এগোয়। আরেক নতুন চরিত্র আসে। বিষ্ণুরাম দারোগা। নতুন নতুন মোহনগড়ে এসেই সে শক্তি চাটুজ্যে, জীবনানন্দ, রবিঠাকুর, নজরুল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পাঞ্চ করে একখানা জবরদস্ত বক্তৃতা দিয়েছিল!
"ভাইসব, এলাকার শান্তি যেন বজায় থাকে। আমি জানি, চোর ভারতবাসী, ডাকাত ভারতবাসী, খুনি ভারতবাসী, জোচ্চোর এবং ঘুষখোর ভারতবাসী আমার ভাই। তাদের ধমনীতে যে রক্ত বইছে, আমার ধমনীতেও সেই রক্তই বইছে। তাদের শরীরের এক ফোঁটা রক্তপাত হলে সেটা হবে আমারই রক্তপাত। তাদের দণ্ডদান করা মানে আমাকেই দণ্ডদান করা। তাই কবি বলেছেন, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতাও যখন কাঁদেন তখন সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। সুতরাং কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, আজ থেকে যেন ময়নাগড় এবং আশপাশের অঞ্চলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাই আমি বলি, এসো চোরগণ, শুচি করি মন, ধরো ডাকাতের হাত, মোর অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, অকারণে কেউ পোড়ো না কো ধরা, সবার হরষে হরষিত মোরা দুঃখ কী রে? আমি তাদের কবির অমোঘ বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট, রক্তজমাট শিকলপুজার পাষাণবেদী। আমি জানি অনেকেই পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে আমাকে প্রশ্ন করবেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি তাদের বলব, তোমার মিলন লাগি আমি আসছি কবে থেকে। বাউলের গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আজ আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমি আইলাম রে, খাটাইশ্যা বৈরাগী, রূপে গুণে ষোলো আনা ওজনে ভারী। আমি জানি এই হানাহানি, কানাকানি এবং টানাটানির যুগে শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। তবু ভাইসব, শত্রুপক্ষ আচমকা যদি ছোঁড়ে কামান, বলব বৎস, সভ্যতা যেন থাকে বজায়, চোখ বুজে কোনও কোকিলের দিকে ফেরাব কান। বিশদ করে বলতে গেলে বলতে হয়, ধরুন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, হঠাৎ শুনলেন রাতের কড়া নাড়া। হেঁড়ে গলায় কেউ ডেকে উঠল, অবনী বাড়ি আছ? খবর্দার জবাব দেবেন না কিন্তু, দরজাও খুলবেন না। তবে যদি সে নিতান্তই দরজা ভেঙে টেঙে ফেলে তা হলে চটবেন না। হেসে বলবেন, ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়।"
এরপর গাঁয়ের লোক ঘটিচুরি গরুচুরির নালিশ লেখাতে এলে তার একমাত্র দাওয়াই, ‘ক্ষমা’!
বিষ্ণুরাম হাসিহাসি মুখ করে বলল, "মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কী জানো?"
"আজ্ঞে! জানি, তবে ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।"
"মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল ক্ষমা। সারাদিন যত পারো ক্ষমা করে যাও। যাকে সুমুখে পাবে তাকেই ক্ষমা করে দেবে।"
"যে আজ্ঞে, সে না হয় করলুম, কিন্তু এই ঘটিচুরির বৃত্তান্তটা
একটু শুনুন।"
"যিশু খ্রিষ্ট কী বলেছিলেন?"
"আজ্ঞে, জানতুম, তবে এখন ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। ইংরিজিতে বলতেন তো!"
"যিশু বলেছিলেন, কেউ তোমাকে এক গালে চড় মারলে আর এক গাল এগিয়ে দাও। সে গালেও যদি চড় মারে তবে ফের আগের গালটা এগিয়ে দাও। যদি সে গালেও মারে তবে ফের দ্বিতীয় গাল এগিয়ে দাও। সেও চড় মেরে যাবে তুমিও গালের পর গাল এগিয়ে দিতে থাকবে। এইভাবে মারতে মারতে আর কত পারবে সেই চড়বাজ! দেখবে সে একটা সময়ে চড় মারতে মারতে হেদিয়ে পড়ে মাটিতে বসে হ্যা-হ্যা করে হাঁফাচ্ছে। বুঝলে?”
"আজ্ঞে, জলের মতো। তবে কিনা ঘটিচোর আমাকে চড় মারেনি, তাকে জাপটে ধরেছিলুম বলে সে আমাকে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।"
"একটা টেট ভ্যাক ইনজেকশন নিয়ে নাও। আর ঘটিচোর তোমার একটা ঘটি নিয়ে গেছে, তাতে কী? তাকে পেলে আর একটা ঘটি দিও। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছেন?”
"আজ্ঞে, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।"
"শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, নমো হে নমো, ক্ষমো হে ক্ষমো, পিত্তরসে চিত্ত মম.... আর কী সব আছে যেন। মোট কথা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ হল, ক্ষমা। মনে থাকবে তো!"
"আজ্ঞে, মৃত্যুর দিন অবধি মনে থাকবে। ঘটিচুরির শোক কি সহজে ভোলা যায়! যতবার ঘটিচুরির কথা মনে পড়বে ততবার আপনার কথাও মনে পড়বে।"
গাঁয়ের লোক বিষ্ণুরামের মতিগতি বুঝে ফেলেছে। কেউ আর থানায় আসে না। বিষ্ণুরাম বউয়ের বানানো ঢাকাই পরোটা আর মাংসের ঘুগনি খেয়ে থানার চেয়ারে বসে ঘুমান, সেপাইরা ঝিমোয়। খোচর নবু এটা সেটা খবর এনে দেয়। বিষ্ণুরাম সেসব এককান দিয়ে ঢোকান, আরেক কান দিয়ে বের করে দেন। নবুও বোঝে বিষ্ণুরাম অকম্মার ঢেঁকি, সে অন্নদামঙ্গলের স্টাইলে দারুণ দারুণ ব্যজস্তূতি করে থাকে দারোগাবাবুকে। স্বয়ং দারোগা গিন্নি যে ফেরিওয়ালার থেকে মাত্র দেড়শো টাকায় পঞ্চাশ ভরি ওজনের তিনটে সোনার রেকাবি আর দুটো হীরের আংটি কিনে লুকিয়ে রেখেছেন, সে খবরও নবু রাখে। ময়নাগড়ে দুজন সন্দেহজনক লোক এসব জিনিসের তল্লাশি নিয়ে বেড়াচ্ছে তাও তার নজর এড়ায়নি।
থানায় ঢুকল সেই দুই মূর্তিমান। বিষ্ণুরাম এমনই গবেট তাদের আগ বাড়িয়ে বলে বসলেন নবুর কাছে সদ্যশোনা রেকাব আর আংটির খবরগুলো!
বিষ্ণুরাম রিভলভার উঁচিয়ে বিকট গলায় বলে, "কীসের খোঁজ খবর, অ্যাঁ! কীসের খোঁজখবর? সোনার রেকাবি চাই? নাকি হিরের আংটি চাই? অ্যাঁ! মামাবাড়ির আবদার! ওসব এখানে নেই, বুঝলে! নেই! এখন বিদেয় হও তো দেখি! নইলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব, এই বলে রাখলাম!"
নরেন্দ্রনারায়ণ আর তার সঙ্গী একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল। তারপর নরেন্দ্রনারায়ণ মুচকি একটু হেসে বলল, "আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখানে নেই তো কী হয়েছে? অন্য কোথাও আছে হয়তো।"
বিষ্ণুরামের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ লালবর্ণ ধারণ করল, সে গর্জন করতে গিয়ে দেখল গলা ফেঁসে ফ্যাঁস ফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। সে সেই গলাতেই বলল, "ভেবেছ আমার গিন্নির কাছে আছে? অ্যাঁ! আমার গিন্নির কাছে আছে? খবর্দার ওসব ভুলেও মনে এনো না। তা হলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। আমার গিন্নি মোটেই তিনটে সোনার রেকাবি দেড়শো টাকা দিয়ে কেনেনি, মোটেই একশো টাকা দিয়ে এক জোড়া হিরের আংটি কেনেনি। কী রে নবু, কিনেছে? বল না হেঁকে।"
নবু হাত কচলে বলল, "কী যে বলেন! গিন্নিমা কোত্থেকে কিনবেন? উনি তো তখন বাপের বাড়িতে।"
বিষ্ণুরাম রিভলভার আপসাতে আপসাতে বলল, "শুনলে তো! ওসব জিনিস এখানে নেই। এবার তোমরা বিদেয় হও। ফের কোনওদিন থানার ত্রিসীমানায় দেখলে গুলি চালিয়ে দেব। বুঝলে?"
নরেন্দ্রনারায়ণ ঘাড় কাত করে বলল, "আজ্ঞে, বুঝেছি। কিন্তু জিনিসগুলো গেল কোথায় বলুন তো দারোগাবাবু! তিন তিনটে সোনার রেকাবি-র ওজন-"
বিষ্ণুরাম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, "পঞ্চাশ ভরি, বলবে তো! ওসব চালাকি আমি জানি। হুঁ হুঁ বাবা, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দ্যাখোনি। যতই চালাকি করে পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করো না কেন, লাভ কিছু হবে না। তোমাদের মতো বদমাশ চরিয়েই আমি খাই। এখন মানে মানে বিদেয় হও।"
নরেন্দ্রনারায়ণ স্মিতহাস্য করে বলল, "আচ্ছা না হয় পঞ্চাশ ভরিই হল, তাতেই বা কী যায় আসে বলুন!"
বিষ্ণুরাম অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, "সন্দেহ করছ বুঝি! ভেবেছ, কালোবরণ স্যাঁকরা মিথ্যে কথা বলে গেছে? দারোগার বাড়িতে এসে মিছে কথা কইবে, তার ঘাড়ে কটা মাথা? কথার প্যাঁচে ফেলে রেকাবির ওজন জেনে যাবে সেটি হবে না। বুঝলে!"
"আজ্ঞে, বুঝলাম।"
"কী বুঝলে?"
"বুঝলাম যে, আপনার গিন্নি মোটেই পঞ্চাশ ভরির তিনটে সোনার রেকাবি আর দুটো হিরের আংটি মোট আড়াইশো টাকায় কেনেননি। তিনি তখন বাপের বাড়িতে ছিলেন, আর কালোবরণ স্যাঁকরা মোটেই রেকাবির ওজন কমিয়ে বা বাড়িয়ে বলেনি। ঠিক তো?"
বিষ্ণুরাম রিভলভারটা ফের খাপে ভরে বলল, "হ্যাঁ। কথাটা মনে থাকে যেন! আমি ভাল থাকলে গঙ্গাজল, রাগলে মুচির কুকুর, বুঝেছ?"
গল্পের পরের চরিত্র ইরফান গাজী। আরেকজন প্রতিভাবান বাঁশুরিয়া। বুড়ো মানুষ। ডায়াবেটিসে ভুগছে। কিন্তু রসোগোল্লা পেলে সে নোনতা রসোগোল্লা বলে খেয়েও ফ্যালে। মোহন রায়ের বাঁশির গুণ তার অজানা নেই। বটেশ্বরের কাছে বাঁশি আছে জেনে সে বুঝে নেয়, এরপর সেই দুই গুন্ডা বটেশ্বরকেই ঘায়েল করতে আসবে। লাঠি পিটিয়ে গুন্ডা ভাগিয়ে কোনওমতে বটেশ্বরকে বাঁচায়।
এরপর ময়নাগড়ে জমায়েত বসে। মোটামু্টি সবাই জেনে গেছে ব্যাপার বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট দল বেঁধে সবাই গ্রাম পাহারার সিদ্ধান্ত নেয়। বিষ্ণুরাম দারোগা অবশ্য ঘোষণা করে দেয়, তার ভালো থাকা মানে সরকারের ভালো থাকা, অতএব সে বাড়ি যাচ্ছে! বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে সোনার রেকাবি পাহারা দেবে।
দল বেঁধে পাহারা দেওয়ার প্ল্যান ভেস্তে যেতে দেরি হল না। ময়নাগড়ের বাসিন্দারা সবাই ভীতু, অপদার্থ। গুন্ডারাও দল বেঁধে এসেছে। ভয়ের চোটে মিছিমিছি সম্মান দেখিয়ে সবাই তাদের পথ ছেড়ে দিল।
গুন্ডারা গিয়ে ঢুকল পরাণ চোরের বাড়ি। সেখানেই আছে শ্রীনিবাস, যে জানে বাঁশির মন্ত্রগুপ্তি।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজে ভূত না থাকলে যে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এতক্ষণে ক্লাইম্যাক্সে এসে ভূতের দেখা মিলল। খোদ মোহন রায়ের ভূত বিষ্ণুরামকে দিয়ে গুলি করিয়ে খুলি উড়িয়ে দিলেন দুষ্কৃতির।
গল্প ভারী সুন্দর। স্যাটায়ার, কমিক রিলিফ সবই মজুত। আর একটা অদ্ভুত মজার জিনিস চোখে পড়ল। গল্পের সব চরিত্রই খুব উপমা দিয়ে কথা বলছে।
কালীপদকে প্রভঞ্জন ডাক্তার বলেছিল, ‘‘বাতিকও আমি সারাতে পারি বটে, কিন্তু ভয় কী জানিস? ভয় হল, উটের যেমন কুঁজ, গোরুর যেমন গলকম্বল, হাতির যেমন শুঁড়, তোরও তেমনি ওই বাতিক। বাতিক সারালে তুই কি বাঁচবি?"
হাঁদুর ঘরে গুণ্ডা দু’জন ঢুকতে “হাঁদু বিগলিত হয়ে বলল, "কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! এ যে ভাঙা ঘরে চাঁদের উদয়! এ যে ইঁদুরের গর্তে বেড়াল! এ যে এঁদো পুকুরে গাদাবোট! আরও কী যেন... ওহে বিশু, বলো না!"
বিশু কিছু বলার আগেই রাখাল বিশ্বাস বিগলিত হয়ে বলে ফেলল, "এ যেন পায়েসের বাটিতে পরমান্ন! এ যেন গদাহস্তে ভীমের প্রবেশ..." এইখানে অবশ্য লেখক ছোট্ট একটু ভুল করে ফেলেছেন। রাখাল বিশ্বাস নয়, রাখাল মোদক!
পরাণ চোরও কম যায় না।
"হুটপাট করে কাজ পণ্ড করার চেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করা ভাল। কাজের পিছনে চিন্তা হল ছেলের পিছনে মা।"
একগাল হেসে পরাণ বলল, "এবার বুঝেছি। যেমন ডালের পিছনে শুকতো, দুইয়ের পিছনে এক, হাতের পিছনে বগল, রামের পিছনে রামায়ণ, মুর্গির পিছনে ডিম, সওদার পিছনে পয়সা, কাশীর পিছনে গয়া, দইয়ের পিছনে দুধ, ঢেঁকুরের পিছনে ভোজ....।"
গল্পের শেষটুকু ভারী মায়ায় ভরা।
শ্রীনিবাস ঝোলা খুলে কয়েকটা মোহর, সোনার রেকাবি, রুপোর বাসন বের করে দিয়ে বলল, "এগুলো বেচে যা পাবি তাই দিয়ে একটা দোকান দে। চুরির ধাত তোর নয়, ও তোর হবে না।"
জিনিসগুলো দেখে পরাণ ভারী আহ্লাদিত হয়ে বলল, "এ থেকে আপনাকে কত ভাগ দিতে হবে বাবা?"
শ্রীনিবাস মৃদু হেসে বলে, "ভাগ দিবি? ভাগ করলে সব জিনিসই তো ছোট হয়ে যায় রে। আমার কি অল্পে হয়? অল্পে আমার মন ভরে না বলে ভগবান যে আমাকে গোটা বিশ্ব সংসারটাই দিয়ে রেখেছেন! ভাগ নিয়ে তোরা থাক।"
ভবঘুরে ফেরিওয়ালা চরিত্রটি অদ্ভুতুড়ে সিরিজের পাকাপাকিভাবে আইকনিক চরিত্র হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।