ছায়াময় : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ষোড়শ আখ্যান

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

“মহারাজ, মোহরের মধ্যে মোহ শব্দটাও লক্ষ করবেন। এই মোহে পড়ে আপনি যথোপযুক্ত প্রজানুরঞ্জন করেননি, বহু নিরীহ মানুষের প্রাণনাশ করেছেন, আমাকেও হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ওই মোহরের মধ্যে কোন মঙ্গল নিহিত আছে?”

এক যে ছিল অত্যাচারী মহারাজা। একে ধরে, তাকে মেরে টাকা আদায় করে সেই টাকায় দেশবিদেশের দুষ্পাপ্র্য মোহর কিনে জমাতেন তিনি। কোন মোহর ভালো, কোনটাই বা খারাপ উপদেশ দিতেন তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী চন্দ্রকুমার। মহারাজের আরেকটি নেশা ছিল, যখ দেওয়া। নিরীহ দাসদাসীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে মাটির নীচের গুপ্তঘরে নিয়ে যেতেন তারপর দরজা বন্ধ করে চলে আসতেন। অজস্র অলিগলি, চোরাগলি থেকে উপরে আসার রাস্তাখানা খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। হতভাগ্য মানুষগুলো সেখানেই মরে পড়ে থাকত। রাজা ভাবতেন, ওরা যখ হয়ে তাঁর মোহর পাহারা দিয়ে যাবে অনন্তকাল। একমাত্র চন্দ্রকুমার জানতেন এই গুপ্তঘরের হদিশ।

চন্দ্রকুমার বুদ্ধিমান। রাজার মতিগতির আঁচ পেয়েই তিনি গুপ্তধনের সংকেত কায়দা করে লিখে রাখেন রাজার স্তূতিকাব্যটির মধ্যে। একদিন রাজা সত্যিই চন্দ্রকুমারকে গুপ্তগৃহের গহ্বরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাইলেন। চন্দ্রকুমার নিজেকে বাঁচাতে রাজাকে খুন করে গুপ্তগৃহে ফেলে দেন। তবে চন্দ্রকুমার গুপ্তধনের একটি কপর্দকও নেননি, গুপ্তধনের সংকেত লেখা পুথিটি তিনি তুলে দেন রাজার পরবর্তী উত্তরাধিকারীর হাতে।

এরপর সময় এগোয় নিজের ছন্দে। চন্দ্রকুমারও একদিন বুড়ো হলেন, মারা গেলেন। মারা যাবার পর চন্দ্রকুমার হলেন ভূত, তাঁর নতুন নাম হল ‘ছায়াময়’। ছায়াময় ভারী উপকারী ভূত, শিমূলগড় গ্রামটাকে ছায়াময় খুব ভালোবাসেন। সুযোগমতো ভালোমানুষদের পাশে দাঁড়ান। তিনি শিমূলগড়ের গার্ডিয়ান এঞ্জেল।

ইতিমধ্যে রাজার ছ’ছটি প্রজন্ম পার হয়েছে। ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ ইন্দ্রজিৎপ্রতাপ রায় লন্ডনে থাকে, নামী একটি মিউজিয়ামে কাজ করে, পুরনো পুথি-মুদ্রা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। একদিন ছায়াময় তার হাতের নাগালে এগিয়ে দেয় গুপ্তধনের সংকেত লেখা পুথিটি। ইন্দ্র শিক্ষিত বুদ্ধিমান ছেলে। গুপ্তধনের সংকেত সে বুঝে ফেলে। পিতৃপুরুষের ভিটেয় এসে গুপ্তধন উদ্ধাও করে।

গোলমাল বাধে যখন গ্রামের কালী কাপালিক দেখে ফেলে ইন্দ্রের থলেতে আছে দুশো এগারোটা মোহর। কালীর হাত থেকে বাঁচতে ইন্দ্র ছুট লাগায়। গ্রামের হালচাল সম্পর্কে সে একেবারেই অনভিজ্ঞ। সুদখোর মহাজন গগন সাঁপুইয়ের খড়ের গাদায় রাত কাটাবে ভেবে সে গাছের ডাল ধরে নীচে নামে। চোর ভেবে তাকে ধরে ফেলে গগনের লোকজন। অতঃপর চলে চোরের মার। তার মোহরভরা থলিটিও গাপ করে ফেলে গগন সাঁপুই এবং গগনের হুকুমে লক্ষ্মণ পাইক আধমরা অবস্থায় ইন্দ্রকে ফেলে আসে জঙ্গলে।

ছায়াময় আচ্ছা করে ধমকে দেয় লক্ষ্মণ পাইককে। ভীতু লক্ষ্মণ পাইক ঘাবড়ে গিয়ে পরদিনই ছুটে আসে হাত দেখাতে। গ্রামের লোকজন সবাই তো আর বোকাসোকা নয়, কায়দা করে ঠিকই লক্ষ্মণের পেটের গুহ্যকথা জেনে নেওয়া হয়।

লক্ষ্মণ যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। মুখখানা ফ্যাকাসেপানা দেখাচ্ছে। আমতা-আমতা করে বলে, "চোর যে ফ্যালনা জিনিস নয় তা এখানে এসেই শিখলাম মশাই। নাক মলছি, কান মলছি, আর ইহজীবনে চোরকে হেলাফেলা করব না। রাতের তিনিও সে-কথাই বলছিলেন কিনা!"

গৌরগোবিন্দ একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, "তা এই তেনাকে কেমন দেখলে বলো তো! পুরনো ভূত সব ক'জনকেই চিনি। বলি তিনুকে দ্যাখোনি তো! তিনুর গায়েও সাঙ্ঘাতিক জোর ছিল, মুগুরের বদলে রোজ সকালে দু' খানা আস্ত ঢেঁকি দু' হাতে নিয়ে বনবন করে ঘুরিয়ে মুগুর ভাঁজত। তবে বড্ড গবেট ছিল, খুব ভিতুও। গায়ে জোর থাকলে কী হয়, কেউ চোখ রাঙালেই লেজ গুটোত।"

লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বলে, "তা হলে ইনি তিনি নন। চুরি নিয়ে যখন আমাকে জেরা করছিলেন, তখনই বুঝেছিলাম এঁর খুব বুদ্ধি।"

নটবর বলল, "চুরি নিয়ে কী জেরা করল হে?"

লক্ষ্মণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, "তিনিই আমার চোখ খুলে দিলেন। তবে সে মশাই অনেক কথা। আমি বড্ড ভয় পেয়েছি। লক্ষ্মণ পাইকের বুকে ভয় বলে বস্তু ছিল না কখনও। কাল রাত থেকে হল। এখানে আমার আর পোষাবে না মশাই। রামবাবুর কাছে তাই হাতটা গোনাতে এসেছি।"

ওদিকে কালী কাপালিকও চুপ করে বসে নেই। সে হচ্ছে জাত ব্ল্যাকমেলার। গগন সাঁপুইকে ব্ল্যাকমেইল করে রোজ তার কেলেগরুর দুধের বন্দোবস্তটি সে পাকা করে নিতে চায়, সঙ্গে তার দাবি সাধনপীঠখানাও বাঁধিয়ে দেবার। গগন সাঁপুই মহাকিপটে, তার ওপর সুদখোর মহাজন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা বের করা ভণ্ড কালী কাপালিকের কম্মো নয়। গগন সাঁপুই কালী কাপালিককে সোজা হাঁকিয়ে দিয়েছে। কালী কাপালিকের তাই বড্ড রাগ। একগ্লাস দুধ ঘুষ দিয়ে সবটুকু পেটের কথা জেনে নেন গ্রামের অতিবৃদ্ধ গৌরগোবিন্দবাবু।

কালীকে দুধটা খানিক খাওয়ার সময় দিয়ে গৌরগোবিন্দ গলাটা খাটো করে বললেন, "তা হলে কথাটা আসলে এই! মানে গগন সাঁপুই একখানা দাঁও মেরেছে!"

কালী নিমীলিত নয়নে চেয়ে বলে, "দুধটি বড্ড খাসা ঠাকুরদা, এর যা দাম দিতে হবে তাও আমি জানি। শোনো, কথাটা পাঁচকান কোরো না। ও-ছোকরা মোটেই চোর নয়। থলির মধ্যে দুশো এগারোখানা মোহর ছিল। গগন সেটিই গাপ করেছে। ছোঁড়ার কী মতিচ্ছন্ন হয়েছিল, কেন যে গগনের বাড়ি সেঁধোতে গেল।"

গৌরগোবিন্দ চোখ কপালে তুলে বলেন, "দুশো এগারোখানা! দেখলি থলি খুলে?"

"থলি খুলতে হবে কেন ঠাকুরদা! আমার কি অন্তর্দৃষ্টি নেই? বাইরে থেকেই দেখলুম, থলির ভেতর মোহর। দুশো এগারোখানা। তবে ভোগে লাগল না।"

"তার মানে?"

"ছোকরাকে রাতেই মেরে লাশ গুম করে দিয়েছে কিনা। কাল রাতেই ছোকরার প্রেতাত্মা এসে বলে গেল।"

ওদিকে ছায়াময় ছোট্ট ছেলে অলঙ্কারের স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। ছায়াময়ের নির্দেশমতো জঙ্গলে গিয়ে অলঙ্কার খুঁজে বের করেছে ইন্দ্রকে। ইন্দ্র আসে অলঙ্কারের বাড়ি। নিজের কথা খুলে বলে। অলঙ্কারের বাবা হরিপদ স্বর্ণকার। তাকে ডেকে পাঠায় গগন সাঁপুই। কিন্তু হরিপদ এরমধ্যেই জেনে ফেলেছে ও মোহরের ঐতিহাসিক মূল্য। সে কিছুতেই ওই সোনা গলাবে না কথা দিয়েছে ইন্দ্রকে। হরিপদও কম সেয়ানা নয়। কোটিটাকার লোভে ফেলে গগন সাঁপুইকে। টাকার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ। গগন সাঁপুই কোটি কোটি টাকার লোভে মোহর না গলানোর পক্ষেই সায় দেয়। মাঝখান থেকে কথা চেপে রাখার জন্য হরিপদ পেয়ে যায় তিরিশটিহাজার টাকা, উপরি পাওনা গগনের কাছে তার সমস্ত ধার মাপ।

কালী কাপালিক তার কেলেগরুর দুধ আর বাঁধানো মন্দিরচাতালের আশা ছাড়েনি। ব্ল্যাকমেলে অতিষ্ঠ হয়ে গগন সাঁপুই ডেকে পাঠায় দুইটি ভাড়াটে গুন্ডা কালু আর পীতাম্বরকে। অনেক দরাদরির পর পঁচিশটাকায় রফা হল, কালু-পীতাম্বর গিয়ে কালীকে গোটাআষ্টেক চড় লাগাবে আর দাঁত কিড়মিড় করে হুমকিটুমকি দিয়ে আসবে।

“পীতাম্বর একটু গুম হয়ে থেকে বলে, "ওই চড়পিছু চারটে করে টাকা ফেলে দেবেন, আর চোখ রাঙানোর জন্য কুড়িটি টাকা। এর নীচে আর হচ্ছে না। আর চড়চাপড় অত হিসাব করে দেওয়া যায় না, দু-চারটে এদিক-ওদিক হতে পারে। ধরুন দুই চড়েই যদি কাজ হয়ে যায় তা হলে আট চড়ের কোনও দরকার নেই। আবার আটে কাজ না হলে দশ-বারোটাও চালাতে হতে পারে। তা কম-বেশি আমরা ধরছি না। ওই আট চড়ের বাবদ বত্রিশটা টাকা ধরে দেবেন। যদি রাজি থাকেন তো চিড়ে-দই আনতে বলুন, আমাদের তাড়া আছে। সেই আবার গঙ্গানগরে এক বাড়িতে আগুন দিতে হবে আজ রাতেই। আপনার কাজটা সেরেই গঙ্গানগর রওনা হতে হবে। অনেকটা পথ।"

কালী তার বরাদ্দ চড়চাপড় খেল। কিন্তু মাত্র পঁচিশটা টাকায় কতই বা আর গা ঘামাবে কালু-পীতাম্বর! কালীও কম বিচ্চু নয়। সে ফাঁস করে দিল গগনের গুপ্তকথাটি।

“কালী ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বড়-বড় চোখে চেয়ে বলল, "কী বললে পীতাম্বরদাদা! কানে কি ভুল শুনলুম আমি! বাহান্ন টাকা! মোটে বাহান্ন টাকায় তোমাদের মতো রুস্তম আজকাল হাত নোংরা করছে! এ যে ঘোর কলিকাল পড়ে গেল গো! এতে যে আমারও বেজায় অপমান হয়ে গেল! মাত্র বাহান্ন টাকায় আমার গায়ে হাত তুললে তোমরা!"

পীতাম্বর একটা হুঙ্কার দিয়ে বলে, "বেশি বুকনি দিলে মুখ তুবড়ে দেব বলছি!"

কালু বলে ওঠে, “উহু উহুঁ, আর নয়। টাকা উশুল হয়ে এখন কিন্তু বেজায় লোকসান যাচ্ছে আমাদের।"

পীতাম্বর সঙ্গে-সঙ্গে নরম হয়ে বলে, "তা বটে, ওরে কালী, বাহান্ন টাকার কথা তুলে আর আঁতে ঘা দিস না। ওই হাড়কেপ্পনটার সঙ্গে দরাদরিতে যাওয়াই ভুল হয়েছে। এখন সুদে-আসলে লোকসানটা তুলতে হবে।"

কালী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "সে আর তোমরা পারবে না। সকলের চোখের সামনে দু'শো এগারোখানা মোহর যে-মানুষ হাতিয়ে নিতে পারে, তার সঙ্গে এঁটে ওঠা তোমাদের মতো ভালমানুষদের কর্ম নয়।”

কালী কাপালিক বেপাড়ার গুন্ডার হাতে মারধোর খাচ্ছে সে খবর পেয়ে ছুটে এলেন গৌরগোবিন্দ। কালী যে তাঁর রাজসাক্ষী, একমাত্র কালীই জানে গগন সাঁপুইয়ের বাটপাড়ির খবর। কালু-পীতাম্বর জীবনে কখনও মার খায়নি। কাজেই গৌরগোবিন্দর লাঠির বাড়ি খেয়ে তাদের ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাবার দশা হল।

ইতিমধ্যে লক্ষ্মণ পাইকও অকুস্থলে হাজির। গ্রামের জ্যোতিষী বলেছেন তার জীবনের দুর্দশার মূলে রয়েছে দুটি লোক, একজনের নামের আদ্যাক্ষর ‘ন’, অন্যজনের নাকি দুটো হাতই বাঁ-হাত। এই জ্যোতিষীটি নাকি নিজের কুষ্ঠী বিচার করে দেখেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যত অন্ধকার। তারপর থেকেই তাঁর মাথাটি যায় বিগড়ে। তবু কালেভদ্রে এক একটা ভবিষ্যতবাণী করে বসেন, যা মিলেও যায়।

লক্ষ্মণকে দেখে কালী কাপালিক সটকান দিয়েছে। জঙ্গলে গিয়ে তার মোলাকাত দুইটি জলজ্যান্ত ভূতের সাথে। সেই অত্যাচারী রাজা আর ছায়াময়ের তুমুল  ডিবেট চলছে।

“মহারাজ আর্তনাদ করে উঠলেন, "বলো কী হে চন্দ্রকুমার! কত কষ্ট করে, কত অধ্যবসায়ে, কত ধৈর্যে, কত অর্থব্যয়ে আমি সারা পৃথিবী থেকে মোহর সংগ্রহ করেছি। ওই মোহরের জন্য তোমার হাতে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছি। পর-পর দেড়শো বছর যখ হয়ে মোহর পাহারা দিয়েছি, এসব করেছি কি মোহরের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য?"

"মহারাজ, মোহরের মধ্যে মোহ শব্দটাও লক্ষ করবেন। এই মোহে পড়ে আপনি যথোপযুক্ত প্রজানুরঞ্জন করেননি, বহু নিরীহ মানুষের প্রাণনাশ করেছেন, আমাকেও হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ওই মোহরের মধ্যে কোন মঙ্গল নিহিত আছে? আপনার উত্তরপুরুষ যা খুশি করুক, আপনি চোখ বুজে থাকুন।"

মহারাজ হাহাকার করে উঠে বললেন, "তোমার কথায় যে আমার আবার মরে যেতে ইচ্ছে করছে চন্দ্রকুমার! মরার আগে তোমাকেও হত্যা করতে ইচ্ছে করছে! আমার মোহর... আমার মোহর..."

ঠিক এই সময়ে কালী কাপালিক আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রক্তাম্বরের খুঁটে দুটি চোখ মুছে নিয়ে বলল, "আহা, এ-জায়গাটায় যা পার্ট করলেন মশাই, চোখের জল রাখতে পারলুম না। পালাটিও বেঁধেছেন ভারী চমৎকার। কোন অপেরা বলুন তো! কবে নাগাদ নামছে পালাটা?"

দুই ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে কালীর দিয়ে চেয়ে রইল।

কালী বিগলিত মুখে বলে, "আমিও এককালে পার্ট-টার্ট করতুম। অনেকদিন আর সাধন-ভজনে মেতে গিয়ে ওসব হয়নি। তা এ যা পালা দেখছি, একটা কাপালিকের পার্ট অনায়াসে ঢোকানো যায়। আর আমাকে তো দেখছেন, মেকআপও নিতে হবে না। আড়াল থেকে শুনছিলুম মশাই, তখনই ভেবে ফেললুম এ-পালায় যদি একখানা চান্স পাই তা হলে কাপালিকের কেরামতি দেখিয়ে দেব। কিন্তু বড্ড হালফিলের ঘটনা মশাই, এত তাড়াতাড়ি পালাটা বাঁধল কে?"

মিষ্টির দোকানে জল খেয়ে ‘থ্যাংঙ্ক ইউ’ বলতে শুনে গ্রামের লোক ধরে ফেলে ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে। চোরকে পাওয়া গেছে ভেবে আরেকদফা চোরের মার পড়ে। তারপর হরিপদ, কালী কাপালিকেরা এসে ইন্দ্রের আসল পরিচয়টি খোলসা করতে তবে বেচারার কপালে জুটল ‘আপনি-আজ্ঞে’ ‘রাজাবাবু, মাফ করে দ্যান’!

কালু-পীতাম্বরকে এবার গগন সাঁপুই দিলেন সোজাসুজি খুনের সুপারি। ইন্দ্রকে খুন করতে হবে। কালু-পীতাম্বর দ্বিতীয়বার গোকখুরি করেনি। দিব্যি মোটা টাকা ট্যাঁকে গুঁজে তবেই তারা অর্ডার হাতে নিয়েছে। ইন্দ্রকে মারতে গিয়ে আবারও তারা খেল গৌরগোবিন্দের লাঠির বাড়ি। আর তাদের ট্যাঁকের বারোহাজার টাকাটি গায়েব করল কালী কাপালিক।

ওদিকে গগন সাঁপুই ঘরে বসে মোহর পাহারা দিচ্ছিলেন। ঘরেই উদয় হল রাজার ভূত আর ছায়াময়। খাঁড়াহাতে গগন ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে নিজেই নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে বসলেন। তারপর ছায়াময় দিল আচ্ছারকম বকুনি।

"ওহে গগন!"

গগন দু'খানা হাত জোড় করে বলে, "যে আজ্ঞে।"

"কেমন বুঝছ?"

"আজ্ঞে, আপনাদের সঙ্গে এঁটে উঠব না।"

"মোহরের থলিটা যে এবার বের করতে হবে ভায়া।"

গগন খুব অবাক গলায় বলে, "মোহর! হুজুর, মোহরটা আবার কোথায় দেখলেন? কু-লোকে কু-কথা রটায়।"

"তোমার চেয়ে কু-লোক আর কে আছে বাপু? একটু আগে তুমি মহারাজের ষষ্ঠ উত্তরপুরুষকে খুন করতে দুটো খুনিকে পাঠিয়েছ। তুমি অন্যায়ভাবে পরস্বাপহরণ করেছ।"

"আজ্ঞে না হুজুর, আমি পরের অপকার করিনি। আর সেই চোর যে

মহারাজের কেউ হন, তাও জানতুম না কিনা!"

"কিন্তু মোহর!"

গগন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, "আজ্ঞে, ভগবান দিয়েছেন। তাই..."

"এই যে মহারাজকে দেখছ, ইনি মোহরের খপ্পরে পড়ে দেড়শো বছর পাতাল-ঘরে মাটিচাপা ছিলেন।"

গগন ডুকরে উঠল, "ওরে বাবা, আমি মোটে বন্ধ জায়গা সইতে পারি না। ছেলেবেলায় একবার পাতকুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলুম, সেই থেকে বেজায় ভয়।"

"তা হলে উঠে পড়ো গগন! মোহর বের করে ফ্যালো।"

গগন হাতজোড় করে বলে, "বড্ড লোকসান হয়ে যাবে যে!”

"মোহর তো আলমারি খুলে আমিই বের করতে পারি। কিন্তু তাতে তো তোমার প্রায়শ্চিত্ত হবে না গগন। ওঠো। আর দেরি নয়। তারা আসছে।"

"হুজুর, বড্ড গরিব হয়ে যাব যে। কোটি-কোটি টাকা থেকে একেবারে পপাতধরণীতলে! দু-চারখানা যদি রাখতে দেন।"

"দু'শো এগারোখানা মোহর গুনে দিতে হবে। ওঠো।"

"আজ্ঞে, মাজায় বড় ব্যথা। দাঁড়াতে পারছি না।"

"তা হলে হামাগুড়ি দাও। তুমি দুর্বিনীত, হামাগুড়ি দিলে কিছু বিনয় প্রকাশ পাবে।”

হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ডানহাত উঁচিয়ে গগন সাঁপুই মোহরভরা থলিটি তুলে দিচ্ছেন ইন্দ্রকে। লক্ষ্মণ পাইক এসে ঘোষণা করল, “গগনবাবু, দুটো বাঁ হাতওলা লোক এই এতক্ষণে খুঁজে পেলাম। কথাটা সারাদিন মাথায় চক্কর দিচ্ছিল। আপনারই মশাই, দুটোই রাঁ হাত। ডান হাতেও তো আপনি অশুদ্ধি কাজই করেন। কাজেই ওটাও বাঁ হাতই।" বলে লক্ষ্মণ পাইক চারদিকে একবার চাইল, "আর ন দিয়ে নামের আদ্যক্ষর..."

নটবর ঘোষ টপ করে মাথাটা নামিয়ে ফেলায় লক্ষ্মণ বলে উঠল, "আপনিও খারাপ লোক নটবরবাবু। তবে এ-আদ্যক্ষর আপনার নামের নয়। নামটা আমারই। আমার পিতৃদত্ত নাম নরহরি। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।"

এ যাবৎ লেখা ষোলোটি অদ্ভুতুড়ের মধ্যে সম্ভবত এইটিই সবথেকে বেশি গুছিয়ে লেখা। গল্পের আয়তন ছোট, তবু কোথাও এতটুকু খামতি রাখেননি শীর্ষেন্দু। প্লটহোল নেই। সমস্ত উল্লেখযোগ্য চরিত্রের ওপর ঠিকমতো স্পটলাইট ফেলা হয়েছে। অদ্ভুতুড়ের আইকনিক সিগনেচার টোন উপস্থিত। হাসি মজা ঠাট্টা ইয়ার্কিতে ভরপুর। নির্দোষ সাদাসিধে সারকাজম, উপভোগ্য কমিক রিলিফ সবই আছে। আর আছে ভূত! শেষ কয়েকটি গল্পে ভূতের দেখা ছিল না। এ গল্পের নামভূমিকাতেই ভূত। সে ভূত ছায়াময়।

২০১৩ সালে হরনাথ চক্রবর্তীর পরিচালনায় তৈরি হয় ‘ছায়াময়’ সিনেমাটি। দৃশ্যসজ্জায়, সংলাপে কোথাও এতটুকু বদল নেই। ‘ছায়াময়’এর ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী, গৌরগোবিন্দর ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গগন সাঁপুইয়ের ভূমিকায় দীপঙ্কর দে, কালী কাপালিকের ভূমিকায় শান্তিলাল মুখার্জির অভিনয় দুর্ধর্ষ। বাকি গ্রামবাসীরাও অল্পবিস্তর চেনামুখ। কালু-পীতাম্বরের মুখে খাঁটি গ্রাম্যভাষার সুর ভারী মিঠে। ছোট ছোট কিছু দৃশ্য দেখে বেশ বোঝা যায়, অনেক যত্নে ভেবেচিন্তে সিনেমার জন্য গল্পটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। যেমন, গৌরগোবিন্দের বাড়িতে বসে কালী কাপালিকের দুধ খাওয়ার দৃশ্যটি। গল্পে আছে, কালী দুধ খেতে খুব ভালোবাসে। দুধ খাওয়ার জন্যই সে গগন সাঁপুইকে ব্ল্যাকমেল করছিল। সিনেমায় দেখা যাচ্ছে, কালীর জন্য দুধ এসেছে। প্লেটে চলকে পড়া সামান্য দুধটুকুও সে গ্লাসে ঢেলে নিচ্ছে। তারপর আঙুলে করে কয়েকফোঁটা দুধ হাওয়ায় ছিটিয়ে উৎসর্গও করছে, ঠিক যেমন জাত মাতালরা করে।

অলঙ্কারের মায়ের পরনের ব্লাউজের স্লিভ অত্যন্ত ঢিলে হয়ে এসেছে। তারা যে গরিব, না খেতে পেয়ে অধরা রোগা হয়ে গেছেন, ওই হাতা ঢিলে ব্লাউজই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। গগন সাঁপুইয়ের ঘর। সেখানে রয়েছে দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই প্রপস। গ্রামের ঘরদোর যেমনটি হয়, একদম তেমনটিই সবকিছু। বেল লন্ঠন, পুরনো দেরাজ, কাঠের টেবিল। সে সুদখোর মহাজন, দেওয়ালে তাই ঝুলছে টাকার প্রশস্তি লেখা সূচের সেলাইয়ের কাজ। গল্পে আছে, গগনের ঘরে হরিপদ এসেছে। গগন হরিপদকে আশ্বস্ত করতে বন্ধকি তমসুকের দলিল ছিঁড়ে দিয়েছে। সিনেমায় দেখি, ছেঁড়া দলিলের টুকরোগুলো সন্তর্পণে পকেটে পুরে নিচ্ছে হরিপদ। এইটি কিন্তু গল্পে লেখা ছিল না। সিনেমার পর্দায় এমন আরও অনেক ছোট ছোট দৃশ্যের সংযোজন হয়েছে, যেগুলো গোটা গল্পটাকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।

আর গান। আড়াইঘন্টার সিনেমায় গান না থাকলে চলে? এ সিনেমায় তিনটে গান রয়েছে। প্রথম গানটা হচ্ছে ইন্দ্র আর অলঙ্কার একসাথে ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখার সময়, পেছনে ছায়াময় ছায়া হয়ে তাদের আগলে আগলে রাখছে। দ্বিতীয় গানটা বেশ মজার, কালী কাপালিকের আখড়ায় কালী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা গাইছে। শেষগানটি হচ্ছে যখন গগন সাঁপুই মোহরের থলি কোলে নিয়ে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছেন। গগনের স্বপ্নে গগন একজন জমিদার। জমিদারের সামনে বাইজি নাচছেন। এ দৃশ্যে বাইজির ভূমিকায় ক্যামিও দিয়েছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

সিনেমার শেষে ভেসে ওঠে দুটি ছোট্ট বাক্য— ‘মানুষের পাশে থাকো। মানুষ তোমার পাশে থাকবে।’

ছোট্ট একটা ব্যাপার শুধু চোখে লাগল। লন্ডন থেকে আসা ইন্দ্র গ্রামে খোঁড়াখুঁড়ি করছে। তার পায়ে সাধারণ স্নিকার্স কেন? হান্টিং বুট পরানো যেত না? মাটির নীচে নামছে, জঙ্গল আছে, সাপখোপ আছে। সিনেমার ইন্দ্রের পায়ের জুতোটা আরেকটু ভালো হতেই পারতো। আর, ইন্দ্র এমন একজন মানুষ, যে পেশাগতভাবেই পুরনো পুথি, মুদ্রা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে থাকে। খন্তা দিয়ে মাটি খুঁড়ে ছ’শো বছর আগের পেতলের কলসি বের করছে, হাতে গ্লাভস নেই কেন?

পুরো সিনেমা এতটাই ভালোমানের, এইসব তুচ্ছ দিকে নজর যায় না। আপাতত আলোচনা করা ষোলটি অদ্ভুতুড়ের মধ্যে শীর্ষেন্দুর গল্প নিয়ে সিনেমা হয়েছে মোট চারটি গল্প নিয়ে। সবগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত সেরা ‘ছায়াময়’।