পটাশগড়ের জঙ্গলে : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের দ্বাদশ আখ্যান
- 25 January, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক
জঙ্গলের মধ্যে এক রহস্যময় কেল্লা, চারদিকে তার চোরাবালি। কে বা কারা কীভাবে এ কেল্লা বানিয়েছিল, সে ইতিহাস আজ অধরা। কখনও কখনও গোটা কেল্লা উধাও হয়ে যায়, কখনও বা চাঁদনী রাতে চোখে পড়ে এক ধ্বংসস্তূপ, আবার কখনও কেল্লা সেজে ওঠে আলোর রোশনাইয়ে।
এগারোটি অদ্ভুতুড়ের পর বারোনম্বর অদ্ভুতুড়ের স্বাদ কিঞ্চিৎ অন্যরকম। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বারোনম্বর উপন্যাস ‘পটাশগড়ের জঙ্গলে’ অনায়াসে পুচকে সায়েন্স ফিকশনের তকমা নিতে পারে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এ উপন্যাস লিখেছেন ১৯৮৯ সালে। ততদিনে সায়েন্স ফিকশন জঁরের মার্কেট বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। আশির দশকে ব্লেড রানার, ইটি, এলিয়েন, টার্মিনেটরের মতো দুনিয়া কাঁপানো সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলি এসে পড়েছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কঠিন তত্ত্বকথা সবার অতটা বোধগম্য না হলেও জিনিসটা কী, খায় না মাথায় দেয় তা মোটামুটি জেনে ফেলা গেছে। টাইম ট্রাভেলিংয়ের কনসেপ্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক মুভি। স্টার ট্রেক তার মধ্যে অন্যতম। আঠেরো শতকে এইচ জি ওয়েলসের ‘দি টাইম মেশিন’ উপন্যাসের কনসেপ্ট কতরকমভাবে যে পরবর্তী সময়ের লেখায়, সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে, তার হিসেব নেই। টাইম বেরিয়ার, টাইম ল্যুপ এসব শব্দবন্ধগুলি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। লিখতে বসে মার্কেট-চাহিদার কথা লেখকদের মাথায় রাখতেই হয়। পড়াশোনা করতে হয় ট্রেন্ডি কনসেপ্টগুলি সম্পর্কেও। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও এ নিয়মের অন্যথা করেননি। তাঁর ‘পটাশগড়ের জঙ্গলে’র স্টোরিলাইনই বলে দেয়, উপন্যাসটির পেছনে কম পরিশ্রম লুকিয়ে নেই।
গল্পের শুরু হয় অঙ্কস্যার জয়পতাকাবাবু ও একটি ষাঁড়ের লড়াই দিয়ে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায়, অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সর্বপ্রথম উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র একটি দৃশ্য। মনোজদের স্কুলের মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন তাদের বাড়ির গরু হারিকেন ঢুকে পড়েছিল। গোয়েন্দা বরদাচরণ লালশাল নিয়ে স্প্যানিশ বুলফাইটারের স্টাইলে হারিকেনকে কবজা করতে গিয়ে নাকাল হন। হুবহু একই দৃশ্যপট দিয়ে শুরু হচ্ছে বারোনম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘পটাশগড়ের জঙ্গলে’। শুধু বদলেছে চরিত্রগুলি। বরদাচরণের বদলে আছেন অঙ্কস্যার জয়পতাকাবাবু। হারিকেনের জায়গায় আছে শহরের সবচেয়ে তেজী ষাঁড় কালু। আর ম্যাচ চলছে, ক্রিকেট নয়, ফুটবল। কালুকে লালসালু দেখিয়ে ভালোই নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছিলেন জয়পতাকাবাবু। কিন্তু হঠাৎ বেকায়দায় পড়ে তাঁকে চড়ে বসতে হল কালুর পিঠে। কালু ভ্যাবাচাকা খেয়ে জয়পতাকাকে পিঠে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ফেলে রেখে এল পটাশগড়ের জঙ্গলে। জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন জয়পতাকাবাবু।
ওদিকে জয়পতাকাবাবু হারিয়ে যেতে হরেক কিসিমের রিঅ্যাকশন হচ্ছে শহর জুড়ে। অদ্ভুতুড়ের সিরিজের মজ্জাগত মজারু মোমেন্টস তথা কমিক রিলিফের যথাযোগ্য ব্যবহার হয়েছে এ সূত্রে। তবে, এ উপন্যাসে বেশ সূক্ষভাবে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ঠেস দিয়ে বলা কিছু লুজ কমেন্টস। জয়পতাকাবাবু হারিয়েছেন শুনে শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ব্যোমকেশবাবু। গল্পে অত চোরাবালির প্রসঙ্গ দেখে অজান্তেই শরদিন্দুর ব্যোমকেশ সিরিজের সেই সাংঘাতিক উপন্যাসখানা মনে বুড়বুড়ি কাটছিল। এ গল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নামও আবার ব্যোমকেশ! সে যাক, এই ব্যোমকেশ লোকটি কিন্তু তুখোড় রাজনীতিবিদ।
“ঘটনার সময় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ব্যস্তবাগীশ ব্যোমকেশবাবু শহরে ছিলেন না। নিখিল জগদীশপুর মাছধরা প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন ঈশানগঞ্জ গণ-শৌচাগারের উদ্বোধন করতে। শহরে ফিরে খবরটা পেয়েই একটা রিকশা নিয়ে স্কুলে এসে হাজির।
"এই যে বিষ্টুবাবু, এ সব কী শুনছি? এ তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড মশাই। সেই যে বাঘা যতীন হাত দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন তারপর থেকে ইনফ্যাক্ট বাঙালির তো আর তেমন বীরত্বের রেকর্ড নেই? অ্যাঁ, কী বলেন? ইনফ্যাক্ট আমি তো ভাবছি জয়পরাজয়বাবুকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেব।"
বিষ্ণুবাবু সসম্ভ্রমে বললেন, "ওঁর নাম জয়পতাকা, জয়পরাজয় নয়।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ ভুল হয়েছিল। নাগরিক সংবর্ধনটা ওঁকে দেওয়াই স্থির করে ফেলি তা হলে! অ্যাঁ, কী বলেন! অবশ্য ইনফ্যাক্ট একইসঙ্গে একটা ধিক্কার সভাও হবে। অনেকে তো সমবেতভাবে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করবে, ইন ফ্যাক্ট আমাকে দুটো সভারই সভাপতি হতে হবে। আফটার অল সকলেই তো ভোটার, আমাকে সকলের দিকই দেখতে হয়।"
বিষ্ণুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "তা তো বটেই।"
ব্যোমকেশবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, "একইদিনে শহরের দু'জায়গায় জয়পরাজয়বাবুর নিন্দা এবং প্রশংসা-এ বেশ ভালই হবে। প্রশংসা করতে গিয়ে তো লোকের মাত্রাজ্ঞান থাকে না, বেশি বেশি বলে ফেলে। নিন্দা করতে গিয়েও ইনফ্যাক্ট তাই-ই হয়। এই একসেস ব্যাপারটা নিন্দা ও প্রশংসায় কাটাকাটি হয়ে যাবে। অ্যা, কী বলেন? তা জয়পরাজয়বাবুকে একটু ডাকুন, আমি ওঁকে একটু অভিনন্দন জানিয়ে যাই।"
কথোপকথনে পরিষ্কার, চেয়ারম্যান জয়পতাকাবাবুর নামটিও ঠিকমতো জানেন না। স্রেফ প্রচারের লোভে আর পাঁচটা শ্যালো পলিটিশিয়ান যা করে থাকেন, ইনিও তাই করতে চাইছেন। সোজাসুজি পলিটিশিয়ানদের আলতো করে ঠুকে দেওয়ার এই ব্যাপারখানা অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এই প্রথমবার দেখা গেল।
জয়পতাকাবাবুর দাদু জয়ধ্বনি। নাতির বীরত্বে তিনি আহ্লাদে আটে আটে চৌষট্টিখানা। চায়ের আড্ডার আর পাঁচটা কূপমণ্ডূক বাঙালি সমাজের তিনি প্রতিনিধি।
"শুধু অঙ্ক? অঙ্ক ম্যাথামেটিক্স অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি, পাটীগণিত, জ্যামিতি, অ্যারিথমেটিক, বীজগণিত কোনটায় নয় বলো! শুনেছি ভূগোল, ইতিহাস এসবও তার মাথায় খুব খেলে। বিজ্ঞান বলো বিজ্ঞান, সায়েন্স বলো সায়েন্স, কোনটায় সে কার চেয়ে কম?"
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর মুখে বললেন, "দ্যাখো জয়ধ্বনি, তুমি সেই যে কাশীর টোলে সংস্কৃত শিখে এসেছিলে, তারপর আর দুনিয়ার কিছুই শেখোনি।"
জয়ধ্বনি ফের খিঁচিয়ে উঠে বললেন, "যে সংস্কৃত শিখেছে তার আবার কিছু শেখার আছে নাকি? সংস্কৃত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, দু'পাতা ইংরেজি, দু'পাতা অঙ্ক শিখলেই বুঝি চতুর্ভুজ হওয়া যায়? এই যে তুমি এত শিখলে, গাদা-গাদা পড়া মুখস্থ করলে, তা পারলে ব্যোমকেশের মতো মুখ্যুর সঙ্গে এঁটে উঠতে? তুমি এত শিখে বুড়ো বয়সে ঘরে বসে-বসে লেজ নাড়ছ, আর ওদিকে ব্যোমকেশ পৌরপিতা হয়ে কত জায়গায় দাবড়ে বক্তৃতা দিয়ে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে।"
কিছু লোকের স্বভাবই হল, মুখেন মারিতং জগৎ! ঘরের কোণায় বসেই এরা নিজেদের সবজান্তা স্বীকৃতিটি দিয়ে ফেলে।
গল্পে শ্যাম লাহিড়ী ছাড়া ঠিকঠাক স্বাভাবিক ভদ্রলোক আর কেউ নেই। শ্যাম লাহিড়ী এককালে শিকার করেছেন। অযথা অজানাকে ভয় পাওয়ার পক্ষপাতী নন। শ্যাম লাহিড়ীর নেতৃত্বেই দুটো মানুষ খুঁজতে বেরোয় জয়পতাকাকে। একজন জয়পতাকার দাদু জয়ধ্বনি, অন্যজন ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশের অবশ্য আলাদা স্বার্থ আছে। সে চায়, জয়পতাকাকে রেসকিউ করার সুবাদে তার ভোটবাক্স আরেকটু ফুলেফেঁপে উঠুক।
গল্পে কিন্তু আরও একজন আছে। আসলে এত ঘটনার নেপথ্যে তারই হাত রয়েছে। সে হল শহরের সেরা বিচ্ছু ছেলে ভুতু। ক্লাসে কাঁকড়াবিছে ছাড়ার শাস্তি হিসেবে সে স্কুলের ফুটবল টিম থেকে বাদ পড়ে। প্রতিশোধ নিতে মাঠে সে-ই ষাঁড়টি লেলিয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে বকাঝকাও খায়। তারপর তার ভারী অনুতাপ হয়। স্যারকে খুঁজতে সে একলাটি চলে আসে জঙ্গলে। প্রায় প্রাণ হাতে করে চোরাবালি ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ে কেল্লায়। সেখানে জয়পতাকা উদ্ধারে আসা বাকি তিনজনও একরকম বন্দী।
এইবারে জানা যায়, কেল্লার রহস্য। গ্রহান্তরের উন্নত জীবের বাসা সেটি। যাতে অন্যরা খুঁজে না পায়, তাই কেল্লায় রয়েছে নানান কারসাজি। প্রত্যেকটি বস্তু একটি প্রাকৃতিক কম্পন ত্বরণে (ফ্রিকোয়েন্সি) কম্পিত হয়। এই কম্পনের ত্বরণ পরিবর্তন করলে তা আলোর বা বস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন বদলাতে পারে, এবং তাত্ত্বিকভাবে বস্তুটি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং রেজোন্যান্সের ধারণার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এ নেহাতই থিওরি। একেই কাজে লাগিয়েছে গ্রহান্তরের উন্নত মস্তিষ্ক। রয়েছে টাইম বেরিয়ার, সময় সেখানে আবদ্ধ। চোরাবালির মধ্যেও আছে পথ, যে পথ ঘড়ির কাঁটার দিক অনুসরণ করে পরিবর্তিত হতে থাকে।
মোদ্দা কথা, এ এক জমাটি সায়েন্স ফ্যান্টাসি। ক্লাইম্যাক্সে অকারণ তাড়াহুড়ো নেই। কম চরিত্র, তাই প্লট একেবারেই অগোছালো হয়নি। আয়তনে ছোট হলেও সবকিছু বেশ যথাযথ। শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এর আগের কিছু গল্পের শেষটুকু ছিল বড় বেশি প্রেডিক্টেবল। যেমন, নৃসিংহ রহস্য। কয়েকপাতা পড়েই মালুম হয়ে যায় কে কী কেন কীভাবে। রহস্য সেখানে দানা বাঁধতে পারেনি। কিছু গল্পে তো রহস্য জমাতে গিয়ে প্লটই যায় গুলিয়ে। যেমন, এর ঠিক আগের উপন্যাস ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’। একরাশ ল্যুপহোল রয়ে গেছে গল্পে। তুলনায় বারো নম্বর অদ্ভুতুড়ে বেশ পরিপাটি ছাঁদে লেখা। চোখে পড়ার মতো ভুল নেই। সবই বেশ ঠিক ঠিক মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ গল্প অবলম্বনে সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি কমিক্সটি বেশ উপভোগ্য। বাংলা কল্পবিজ্ঞান অথবা সায়েন্সফ্যান্টাসি জঁরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কিছু উপন্যাস অবশ্যই আলোচিত হবার যোগ্যতা রাখে।