মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে কথা

— ‘এটা কি তাহলে রূপকথা?’

— ‘আসলে রূপকথা বলে তো তেমন কিছু হয় না। যদি ভালো করে ভেবে দ্যাখো মনোজ, তাহলে দেখবে রূপকথাও আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই মানুষেরই কথা।’
— ‘তাহলে রাজা রাণী রাজপুত্র?’
— ‘হ্যাঁ, রাজা রাণী একসময়ে ছিল, এখন নেই। কিন্তু এদের খুব দূরের মানুষ বলে ভাববার কোনও কারণ নেই। আমাদের আশেপাশে যারা আছে, মা-বাবা-ভাই-বোন-পিসি-মাসি এদের মধ্যেই খুঁজলে তুমি সেই রাজা রাণীদের ঠিক পেয়ে যাবে।’
প্রশ্নগুলো করছে মনোজ, আর শান্তমুখে স্মিতহাস্যে উত্তরগুলো দিচ্ছেন স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মনোজ, সেই মনোজ যার বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল হরিণগড়ের হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারের ছবি! সেই মনোজ, যার কাকা হারাধন গরিলা আর হনুমানের যুগলবন্দি গোরিমানের আবিষ্কর্তা। যাদের বাড়ির গরুর নাম হারিকেন! যার পিসি আদ্যাশক্তি দেব্যার হবি আছাড় খাওয়া! তার আরেক কাকা ভজ বাজাড়ুকে মনে আছে তো? সেই যে পিস্তল হাতে ডাকাতদলের সর্দার সেজে গান গাইতে গাইতে রাজবাড়ি লুটতে গিয়েছিল? আর মনোজদের সেই মাস্টারমশাই দুঃখহরণবাবু? উবু হয়ে না বসলে যিনি ‘হলঘর ভরিয়া গিয়াছে’-র ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতেন ‘দি হল’স্ ফুলফিলমেন্ট ওয়াজ অ্যাচিভড বাই দেন’! গানের মাস্টার গণেশ ঘোষাল ভুলসুরে গান গেয়ে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিতে গোয়াল থেকে গরুর দড়ি চুরি করে ফাঁসি যাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। সে গল্পে রাজা ভোগেন ডায়াবেটিসে, শসা তাঁর নিত্যপথ্য। রাণীমা দেন ঘুঁটে। আর হারিয়ে যাওয়া রাজকুমার ডাকাতদলে ভিড়ে একদিন ডাকাতি করতে আসে নিজেরই বাড়িতে.. 
কিশোরসাহিত্যের ইতিহাসে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ নিঃসন্দেহে একটি মাইলস্টোন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের প্রথম গল্প ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’, ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। দেখতে দেখতে কেটে গেছে কতগুলো বছর। অদ্ভুতুড়ে সিরিজ আড়েবহরে বেড়েছে, সিরিজের গল্পের সংখ্যা হাফসেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। কয়েকটি গল্প নিয়ে বানানো হয়েছে দূর্দান্ত কিছু সিনেমা, ইদানীং ইউটিউবেও এসেছে অডিওস্টোরির আকারে। ২০১৮ সাল নাগাদ ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র কাহিনী অবলম্বনে অনিন্দ্য চ্যাটার্জির পরিচালনায় তৈরি হচ্ছে সিনেমা। অভিনয়ে রজতাভ দত্ত, ব্রাত্য বসু, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, সন্ধ্যা রায়,  শিলাজিৎ মজুমদার, আবীর চ্যাটার্জি ও আরও অনেকে। বইয়ের পাতায় পড়া গল্প আর সে গল্প নিয়ে তৈরি সিনেমা— এ দুইয়ের মধ্যে সঙ্গত কারণেই ফারাক থাকে বিস্তর। সিনেমা আর সাহিত্য— দুটো তো দুই আলাদা মাধ্যম। তাই হুবহু বইয়ের কাহিনী সিনেমায় দেখানো সম্ভব নয় এবং বাণিজ্যিক কারণবশত তা উচিতও নয়। অতএব, এ গল্প তো পড়েই ফেলেছি, তাই সিনেমা দেখে আর কী হবে, এমন প্রশ্নের অবকাশই থাকে না। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বাকি গল্পগুলোর মতো ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’টিকেও একটি মিনি উপন্যাস বলা যেতে পারে। তবে এই গল্পে আলাদা করে কোনও পরিচ্ছেদ ভাগ করা নেই। একটানা গল্প এগিয়েছে, সিনেমার মতোই ঘনঘন দৃশ্যপট বদলেছে, আর সঙ্গে বোনাস দেবাশিস দেবের নজরকাড়া অলংকরণ। 


গল্পের শুরু সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারের ফটোর সূত্র ধরেই। ছোট্ট রাজকুমার সিঁড়িতে বসে আছে, পাশে দুধের গেলাস থেকে বেড়াল চুরি করে দুধ খেয়ে যাচ্ছে, পেছনে একজন হাসিমুখে উঁকি দিয়ে সবটুকু দেখছে— সবমিলিয়ে ছবিটি যেন আস্ত একখানা রহস্যগল্পের ঝাঁপি। সিনেমাতেও তার অন্যথা হয়নি। পরিচালকমশাই ঠিক খুঁজে খুঁজে জোগাড় করে ফেলেছেন গল্পে বলে দেওয়া অমনই এক গোলগাল মিষ্টি খুদে-কে। বইয়ের পাতায় গল্প এগোয়। মনোজদের এই অদ্ভুত বাড়িতে কে কে আছে, তারা লোক কেমন, আর কে কতবেশি ‘অদ্ভুত’ তার এক লম্বা ফিরিস্তি। পড়তে পড়তে পেট গুলিয়ে হাসি উঠে আসবেই আসবে। সিনেমার পরদার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিল, চরিত্রগুলো যেন বইয়ের পাতা থেকেই উঠে এসেছে। ভুল পাওয়ারের চশমা পরা ভোজপুরী চাকর চোখে কিচ্ছুটি দেখতে পায় না। মূলো আনতে বলে গাজর আনে, গরু ভেবে মোষ ধরে আনে। সিনেমায় তার এই সমস্যাটি আরও হাস্যকর হয়ে উঠেছে। পুজোয় বসে ঠাকুমা চাইলেন কোষাকুষি, সে খাটের তলা থেকে বের করে আনল বেডপ্যান! 
ভজ বাজাড়ু হিসেবে রজতাভ দত্ত নিখুঁত নির্বাচন, কি সাবলীল তাঁর অভিনয়! গল্পের ভজ বাজাড়ু মানে মনোজের কাকা ভজহরি আমার মায়ের ভারী পছন্দের চরিত্র। কারণ ভজ বাজাড়ু দরদাম করায় খোদ তেন্ডুলকার। ভজ বাজাড়ুকে দেখলে তে-এঁটে সবজিওলা দেড়টাকার ফুলকপি পাঁচসিকেয় ছেড়ে দেয়। আমার মা’ও যখন গড়িয়াহাটে যান, দেড়হাজাটাকার কাপ-প্লেট সেটের দর নেমে আসে তিনশো টাকায়। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র গল্প এই এক ভজ বাজাড়ুর খাতিরেই আমার মায়ের মনে গেঁথে গেছে। 


আজ মার্ভেল কমিকসের দৌলতে ‘ক্রসওভার’ শব্দবন্ধটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। হাল্ক, স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান, থর, ব্ল্যাক উইডোদের নিয়ে আলাদা আলাদা ‘সোলো’ মুভি রয়েছে। আবার অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজে এই সমস্ত সুপারহিরোদের একসাথে দেখা যায়। এই ব্যাপারটাকেই বলা হয় ক্রসওভার। বলিউডেও একাধিক পরিচালক এখন ক্রসওভার টেকনিকটি রপ্ত করে ফেলেছেন। তবে, বাংলা সাহিত্য আরও একধাপ এগিয়ৈ। সেই ১৯৭৮ সালেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একটি ক্রসওভার ঘটিয়ে ফেলেছেন। তাঁর এক গোয়েন্দা বরদাচরণ ও তার ভাগ্নে চাক্কু, এই দুজনকে নিয়ে তিনি লিখেছেন অজস্র ছোটগল্প। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’তেও দেখা মিলছে এই দুই চরিত্রের। অন্যান্য গল্পে বরদাচরণ যদিও বেশ ডাকাবুকো একজন ডিটেকটিভ, কিন্তু এখানে বরদাচরণ যেন অনেকটা কমিক রিলিফের কাজে নেমেছে। এই বরদাচরণ পাঁচিল টপকাতে গিয়ে কুমড়ো গড়াগড়ি খায়। তার পিস্তল গায়েব হয়ে যায়। ক্রিকেট মাঠে তাকে গরুতে গুঁতোয়। আর তার গোয়েন্দাবুদ্ধিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানায় মনোজ, হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারের রহস্য সেই একরকম সমাধান করে ফেলে। সিনেমায় গোয়েন্দা বরদাচরণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রাত্য বসু। সিনেমার চিত্রনাট্য অনুসারে বরদাচরণের কাজের চেয়ে হাঁকডাকই বেশি। সে নকল ঝোলাগোঁফ রাখে। টেলিফোনে কখনও ফেলুদা, কখনও ব্যোমকেশদা-র সঙ্গে গালগল্প দেয়। শার্লক হোমস তার বড়দা। এরকুল পোয়ারো তার মেজদা। এদিকে সে নিজে আজ পর্যন্ত সলভ করেছে গুটিকতক গরুচুরির কেস। 


হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারের বাবা গোবিন্দনারায়ণ পেটরোগা মানুষ, ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। দু’বেলা তাঁর বরাদ্দ একমাত্র খাবার শসা। হাড়কিপটে হিসেবে তাঁর সুনাম সর্বজনবিদিত। ভাগনে কৌস্তভনারায়ণ তাঁর সামনে ‘গাওয়া ঘিয়ের লুচি’ উচ্চারণ করলে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দুঃখ ভুলতে তিনি চোরকুঠুরিতে ঢুকে রাশি রাশি টাকা গুণতে বসেন। লোকে মন ভালো করতে কাশ্মীর যায়, কন্যাকুমারিকা যায়। কিপটে গোবিন্দনারায়ণের টাকাই সব, টাকা গুনেই তাঁর কুলু-দার্জিলিং দেখার সমান আনন্দ হয়। এদিকে বছরের পর বছর এভাবে টাকা গুণে আসছেন, অথচ তাঁর একবারও খেয়াল হয়নি ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সরকার বদল হয়েছে, এই পুরনো টাকা এখন অচল বাজে কাগজের পর্যায়ে পড়ে। সিনেমায় অবশ্য এই প্রসঙ্গে ডিমনিটাইজেশনের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এসেছে। তবে কিপটে গোবিন্দনারায়ণের উদাহরণ পেশ করে ছোটবেলায় বাবাকে আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কিনে দেওয়ার জন্য কম ম্যানিপুলেট করিনি। 
উপন্যাসের শেষের দিকে ভজ বাজাড়ু যখন ডাকাতদল নিয়ে রাজবাড়ি লুঠতে চলেছেন, তখন তাঁর মুখে কিছু গান রয়েছে। ‘বিঘ্ন বন্ধ, খানা ও খন্দ ডিঙিয়ে চল্ সবাই’.. কিংবা ‘সামনে রাজার বাড়ি, চল্ যাই তাড়াতাড়ি, বিবাদ-বিসম্বাদ থামা রে’ সেই গানগুলি লিখেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সিনেমায় অবশ্য এই গানগুলি নেই। সেখানে ডাকাতদলের সর্দারের ভূমিকায় স্বয়ং গায়ক শিলাজিৎ। তাঁর লেখা ‘ডাকাত হব আস্তে আস্তে’ গানটিই গাওয়া হয়েছে তাঁরই দেওয়া সুরে। আনন্দবাজার পত্রিকার পুরনো আর্কাইভ ঘেঁটে জানা গেল, প্রথমে নাকি পেশাদার গায়কদের দিয়েই গানটা রেকর্ড করানোর কথা ভাবা হয়েছিল। পরে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক হয়, সিকোয়েন্সের মজাটা ধরে রাখতে অভিনেতারা গাইলেই নাকি স্বাদটা ফুটবে আরও ভালো। তাই সিনেমায় দেখা গেছে হারানো রাজকুমার ও ভজ বাজাড়ু একসাথে ডুয়েট গাইতে গাইতে রাজবাড়ির দিকে চলেছেন। বলাই বাহুল্য, এতে গল্পের স্বাদ বেড়েছে বই কমেনি। 


গল্পে ভজ বাজাড়ু যখন গোয়েন্দা বরদাচরণের বন্দুক হাতে পেলেন, তিনি হানা দিয়েছিলেন এলাকার সুদখোর মহাজন চোট্টা গোবিন্দের ঘরে। সে বিশাল ধনী, কিন্তু কোনওদিন ভালো খায়নি, ভালো পরেনি। সে বুড়ো শকুনের মতো বাজার ঘুরে ঘুরে সবচেয়ে ওঁচা জিনিসটি সস্তায় কিনে নিয়ে যায়। এ ধরনের মানুষ ভজবাজাড়ুর দু’চোখের বিষ। আর একজন হলেন শার্দূল চৌধুরী। সে নামকরা শিকারী, এককালে তারও ছিল প্রচুর টাকাকড়ি। কিন্তু সে চোট্টা গোবিন্দের ঠিক উলটোরকম মানুষ। শার্দূল চৌধুরী ভয়ানক রকমের অমিতব্যয়ী। সে দরদাম করে না। জিনিসপত্তর বন্ধক রেখে বাড়িতে জলসা বসায়। এমন লোককেও ভজ বাজাড়ু পছন্দ করেন না। পিস্তলের ভয় দেখিয়ে দুজনকেই তিনি ওঠবোস করিয়েছিলেন। কিন্তু সিনেমায় কেন যে এই চরিত্রদুটি মিসিং, বোঝা গেল না। উলটে শার্দূলের বলা জলসার কায়দাতেই আসর বসানো হয়েছে রাজা গোবিন্দনারায়ণের বাড়িতে। রাজা সেখানে শসা খাচ্ছেন। অতিথিদের মধ্যে গোয়েন্দা বরদাচরণ, তার ভাগনে চাক্কু উপস্থিত। তারা খাচ্ছে রাশি রাশি ফুলকো লুচি। আর লখনৌয়ের ওস্তাদ নয়, সেখানে আসর মাতাতে হাজির বাইজীর ভূমিকায় অপরাজিতা আঢ্য। রাজা গোবিন্দনারায়ণও কম কিপটে নন, তিনি কেন বাড়িতে বাইজীর আসর বসাবেন, সেইটি বোধগম্য হল না। তাছাড়া একমাত্র সন্তান যাঁর নিখোঁজ, সেই বাবা বাইজীর আখড়ায় বসে থাকছেন, এটিও গোবিন্দনারায়ণের চরিত্রের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। তবে অপরাজিতা আঢ্যের এই ক্যামিও বড় ভালো লেগেছে। পৃথুলা শরীরে বাইজী বেচারি রাজার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত। অথচ রাজার কিছুতেই পোষাচ্ছে না। তাঁর চাই আরও ‘স্বাদু’ পারফর্ম্যান্স। খুঁতখুঁতে পেটরোগা রাজাকে ঢিট করতেই বাইজী গলা ছেড়ে ধরলেন ‘স্বাদু’ গান, ‘ওগো লুচিইইইই’! আর রাজার সহ্য হল না। তাঁর যে লুচি খাওয়া বারণ! গুটিগুটি পায়ে আসর ছেড়ে তিনি কেটে পড়লেন। বাইজীও হাঁপ ছেড়ে ধপাস করে বসল ফরাসে, বাকি গানটুকু আর তাকে জোর করে নেচে নেচে গাইতে হল না। 
হরিণগড়ের নিশিদারোগা ভারী কড়া মেজাজের দারোগা। বউ গোঁসা করে বাপের বাড়ি গেলে বউয়ের নামেই ওয়ারেন্ট বের করেন তিনি। তাঁর দুই ছেলে মারামারি করে একজন অন্যজনের মাথা ফাটিয়েছিল বলে তাদের দুদিন করে হাজতবাস করিয়েছিলেন। তিনি আবার বাড়াবাড়ি রকমের কালীভক্ত। যদিও উপন্যাসে তাঁর এই কালীভক্তির তেমন কোনও প্রসঙ্গ আসেনি। তবে সিনেমায় ব্যাপারটি বেশ সুন্দর করে দেখানো হয়েছে। থানায় বসে আছেন নিশিদারোগা। একটা চোর তাঁর কাঁধ টিপে দিচ্ছে। মনোজদের বাড়ির রামু চোখে দেখতে না পেয়ে গরু ভেবে যার মোষ তুলে এনেছিল, সেই মোষের মালিক হরশঙ্কর গোয়ালা থানায় এসেছে তার ‘ভঁইস’চুরির নালিশ জানাতে। বিরক্ত নিশিদারোগা চাইলেন তার পাসপোর্ট সাইজ ছবি!
— ‘দো পহর থেকে আমার ভঁইসটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না হুজুর।’
— ‘ফটো আছে? পাসপোর্ট সাইজ হলেও চলবে।’
— ‘আমার নিজেরই কোনও ফট্টো নেই হুজুর, তা আমার ভঁইসের ফট্টো কোত্থেকে পাব হুজুর?’
— ‘তাহলে হারামজাদা আমি চিনব কী করে? তোর ভঁইস কি দেশের ভঁইস প্রেসিডেন্ট? নাকি উত্তমকুমার?কালীকেত্তন জানা আছে?’
— ‘কাল্লি? কাল্লিগানা একঠা জানা ছে হুজুর। ফুল কাল্লি রে ফুল কাল্লি, বোল্ তো এঠা কউন গাল্লি..’
তেড়েমেড়ে উঠে নিশিদারোগা হুঙ্কার ছাড়েন ‘অ্যায় থামবাল্লি!’ হরশঙ্করের গান তো থামেই, সঙ্গে থেমে যায় নিশিদারোগার কাঁধের ওপর মালিশ করতে থাকা হাতদুটিও। তাকে আবার বলতে হয়, ‘আহা তুই থামলি ক্যান?’
উপন্যাসে হারানো রাজকুমার কন্দর্পনারায়ণের খুব বেশি ভূমিকা নেই। তাতে কোনও অসুবিধেও হয়নি পাঠকের। তবে সিনেমার পর্দায় কন্দর্পনারায়ণের চরিত্রে রয়েছেন আবীর চ্যাটার্জি। টলিউডের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তাই স্বাভাবিকভাবেই দর্শক হিসেবে মুখিয়ে বসে থাকতে হয় কখন আবীর চ্যাটার্জি মুখটি খুলবেন! মুভিতে তাঁর হাতেগোনা গুটিকতক সংলাপ। তবে পরিচালক জানতেন পরিচিত হিরো আবীর চ্যাটার্জির স্ক্রিনে উপস্থিতির সময় না বাড়ালে দর্শকমহলের একাংশ (পড়ুন, মহিলাবৃন্দ) ভারী ক্ষুণ্ণ হবেন। তাই হয়তো আলাদা করে একটি দৃশ্যের সংযোজন হয়েছে, যা মূল উপন্যাসে ছিল না। মনোজ আর সরোজ ঘুরতে ঘুরতে ডাকাতদের আস্তানায় হাজির। রাজকুমার ডাকাতিতে যাবেন। তিনি এবং পুরুতমশাই কালীঠাকুরের সামনে রাতের পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাচ্চা ছেলেদুটিকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তারা কে, কেন এসেছে এদিকপানে। মনোজ ধরা পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে জানায় কাটা ঘুড়ি ধরতে এসেছে তারা। 
— ‘ঘুড়ি? হুঁ! টেনে খেলিস না লেটে?’
— ‘টেনে’
— ‘যা তাহলে এখান থেকে টেনে দৌড় লাগা। আর কক্ষণও যেন এখানে না দেখি।’
গল্পের শেষ ভারী মধুর। ডাকাতি করতে গিয়ে রাজকুমারের আবছা আবছা মনে পড়তে থাকে ছেলেবেলার স্মৃতি। পূর্বপুরুষদের ছবির সূত্র ধরে চোরকুঠুরীর রাস্তাও সে বলে দেয় অনায়াসে। তবে সিনেমায় একটি অতিরিক্ত সংযোজন রয়েছে। ছোট্ট রাজকুমারকে গোবিন্দনারায়ণ একটি সিক্রেট ছড়া শিখিয়েছিলেন। রাজকুমার হারিয়ে যেতে অনেকবার ভুল ছেলেকে রাজকুমার সাজিয়ে এনেছে বহুলোকে। প্রত্যেককেই রাজা জিজ্ঞেস করেছেন ছড়ার পরের লাইন, কেউই পারেনি বলতে। পারল একমাত্র আসল রাজকুমারই। তখন আর সংশয় থাকে না রাজার। রাজকুমারকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। উপন্যাসে অবশ্য এত ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে যাননি লেখক। সেখানে রাজকুমারকে কোনও অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়নি। রাণীমা শুধু মুখটি দেখেই তাকে কোলের কাছে বসিয়ে লুচি খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। 
ভালো গল্প পড়লেই বারবার মনে হয় তারপর কী হল? তারপর কী হল? ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ পড়ে শেষ করার পরেও মনে হয়েছিল, আচ্ছা এরপর কী হল? ডাকাতগুলো জঙ্গলে ফিরে গেল? মনোজেরই বা কী হল? আর রাজকুমার? সে পারল ডাকাতি ছেড়ে নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে? সিনেমাটা দেখার পর বুঝেছি এ প্রশ্নগুলো শুধু আমার একার নয়। আরও অনেককেই ভাবিয়েছে। তাই হয়তো পরিচালক চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে উত্তরগুলো সাজিয়ে নিতে। ডাকাতির হাঙ্গামার শেষে মনোজ ছবিটি চেয়ে নেয় স্বয়ং রাজকুমারের কাছ থেকেই, বলে ‘ওটা আমার অনেকদিনের চেনা’। রাজকুমার হেসে ছবিটি দিয়ে দেয় আর বলে, ‘ঘুড়িটা কিন্তু টেনেই খেলো।’ বড় সর্দার আর তার দলবল ডাকাতি ছেড়ে রাণীমার ঘুঁটের ব্যবসায় যোগ দেয়, হলদে ব্যানারে বড় বড় করে লেখা হয় ‘বিদঘুটে— ঘুঁটে তৈরির বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।’ রাজপুত্রের ঝলমলে পোশাকে রাজকুমারের নতুন করে ছবি তোলা হয়। নিশিদারোগার বদলি হয়ে যায় ধুকপুকি থানায়, তবে দরকারে অদরকারে হরিণগড়ে দুম করে ভিজিট দিতে আসতে তিনি ভোলেন না। হারাধনের গোরিমান সহজপাঠ পড়া শুরু করেছে, যদিও হিসহিসের বাইরে একটুও এগোতে পারেনি। ম্যাট্রিকে গোল্ড মেডেল পেয়ে মনোজ চলে গেছে দুর্গাপুরে। সেখানে তার পড়ার টেবিলে এখনও ছোট্ট রাজকুমারের ছবিটা রাখা। ছবিটা এখন একা একাই থাকে, আর কেউ কথা বলে না তার সঙ্গে। কারণ আমাদের সবার মতো মনোজও যে এখন বড় হয়ে গেছে। 
শেষে.. আবারও মনোজের বকলমে আমরা সবাই আর লেখক শীর্ষেন্দু মুখোমুখি। 
— ‘তাহলে গুপ্তধন বলে কিছু নেই?’
— ‘গুপ্তধন? তাও আছে। মাটির নীচে লুকোনো গুপ্তধন নয় বা দেওয়ালের ভেতরে গেঁথে রাখা স্বর্ণপেটিকা নয়। গুপ্তধন থাকে মানুষের মনের মধ্যে। মানুষের অন্তরের যে সম্পদ তাকেই বলি গুপ্তধন। সে গুপ্তধন আবিষ্কারের মধ্যে এত আনন্দ আর কোনওকিছুতে নেই।’