ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ছাব্বিশতম আখ্যান

একধরনের আসামি লঙ্কা আছে, নাম তার ভূত জলোকিয়া, সাইজে ছোট্টটি কিন্তু ঝালে সে সেরার সেরা। শীর্ষেন্দুর ছাব্বিশ নম্বর অদ্ভুতুড়ে বেজায় পুচকে, ক্লাইম্যাক্সও বেশ প্রেডিক্টেবল, তবু এ অদ্ভুতুড়ে অনায়াসে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারে সিরিজের গুছিয়ে লেখা বড়সড় জমাটি গল্পগুলোকে।

নিতাই আর ফটিক, দুই বন্ধু। ফটিক একটু ভীতুরাম বোকাসোকা গোছের, নিতাই বেশ সাহসী চালাক চতুর। দুজনেরই আর্থিক সংগতি ‘ওই কোনওমতে চলে যায়’ ধরনের। একদিন ফটিকের বাবার কাছে একটা চিঠি এল। ফটিকের কোনও এক বড়লোক পিসি সব সম্পত্তি ফটিককে দিয়ে দিতে চান। বাবার লেখা উত্তর আর পিসির চিঠি সঙ্গে নিয়ে নিতাই-ফটিক রওনা দিল পিসির বাড়ি দোগেছে-র দিকে। পিসির বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, পিসি পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন যাকে সে ভারী বদ হয়ে উঠেছে বলে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন। তাই খুঁজেপেতে দূরসম্পর্কের ভাইপো ফটিক ঘোষকেই সব সম্পত্তি দিয়ে যেতে চান। এই ত্যাজ্যপুত্রটি অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়। পনেরোজন বিভিন্ন লোককে ‘ফটিক ঘোষ’ সাজিয়ে সে পাঠিয়েছে পিসির কাছে। বেধেছে তুমুল হট্টগোল। পিসি আসল ফটিক ঘোষকে দেখেননি। তিনি ভরসা করে আছেন চিঠির ওপর, আসল যে হবে তার কাছে চিঠি থাকবে। তালেগোলে চিঠি হাতছাড়া হয়েছে ফটিকের কাছ থেকে। ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষকে এখন যেভাবে হোক প্রমাণ করতে হবে সেই আসল ফটিক ঘোষ!

যেসব জায়গাগুলোকে আমরা ‘ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুর’ বলি, গল্পের এই দোগেছে তেমনই একটা জায়গা। রাসপুরের লোকজনের কাছে তারা পথের হদিস জানতে চেয়েছিল। তারা দোগেছে যাবে শুনে লোকগুলো প্রথমটায় এমন ভাব করল যেন নামটাই কখনও শোনেনি। একজন বলল, "দোগেছে! সেখানে কেউ যায়!" আর একজন বলল, "দোগেছে যাওয়ার চেয়ে বরং বাড়ি ফিরে গেলেই তো হয়।”

দোগেছে যেতে হলে রাসপুরের খাল পেরোতে হয়। খালের ওপর বাঁশের সাঁকোখানার জরাজীর্ণ দশা। এ তল্লাটে নতুন মানুষ নিতাই-ফটিক। আর কোনও ঘুরপথ কিংবা শর্টকাট তাদের জানা নেই। সামনে পড়ল চেকলুঙ্গি আর সবুজ জামাপরা একটি লোক। সে মহাদেব দাস। পেশায় সে স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী! আগের বেশ কিছু অদ্ভুতুড়েতে শীর্ষেন্দুর ধারালো সারকাজমের আলগা নিশান দেখা গেছে। ছাব্বিশ নম্বরে এসে সে সুর আরও খোলতাই হয়েছে।

মহাদেব দাস ঝোপ বুঝে কোপ মারায় পারদর্শী। নিতাই-ফটিক খালের ধারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে দেখে সে উঠে আসে।

 

"কী খোকারা, খাল পেরোবে নাকি?”

 

নিতাই বলল, "হ্যাঁ। কিন্তু কী করে পেরোব?"

 

"কেন, ওই তো সাঁকো। সবাই পেরোচ্ছে।”

 

"পেরোচ্ছে! পড়ে যায় না?"

 

"তা দু-চারটে পড়ে। আজ সকালে হর ডাক্তার আর বৃন্দাবন কর্মকার পড়ল। দুপুরে পড়ল নব মণ্ডল, সীতারাম কাহার আর ব্রজ দাস। বরাতজোর থাকলে পেরিয়েও যায় কেউ কেউ।"

 

"না মশাই, আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। সঙ্গে জিনিসপত্তর আছে। আচ্ছা, খালে জল কত?"

 

লোকটা মোলায়েম গলায় বলে, "বেশি না, বড়জোর ছ-সাত হাত হবে। সাঁতার দিয়েও আসতে পারো। তবে-" বলে লোকটা থেমে গেল।

 

নিতাই বলল, "তবে কী? জলে কুমিরটুমির আছে নাকি?"

 

লোকটা অভয় দিয়ে বলল, "আরে না। এইটুকুন খালে কি আর কুমির থাকে? তবে দু-চারটে ঘড়িয়াল আর কামট আছে বটে। তা তারা তো আর তোমাদের খেয়ে ফেলতে পারবে না। বড়জোর হাত বা পায়ের দু-চারটে আঙুল কেটে নেবে, কিংবা ধরো পেট বা পায়ের ডিম থেকে এক খাবলা করে মাংস। অল্পের ওপর দিয়েই যাবে অবশ্য। আজ সকালেই হরবাবুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা গেল কিনা।"

 

ফটিক ফ্যাকাসে মুখে বলল, "বলে কী রে লোকটা!"

 

লোকটা বলল, "জোঁক আর সাপের কথা তো ধরছিই না হে বাপু। রাসপুরের খাল পেরোতে হলে অতসব হিসেব করলে কি চলে?"

 

মহাদেব আসলে খেয়ার মাঝি। ভাবখানা এমন, যেন মাথা খাটিয়ে সে কতই না উপকার করতে এসেছে!  নৌকোয় তুলে নিতাই-ফটিককে পার করে দিয়ে চেয়ে বসল পাঁচটাকা!

নিতাই ফস করে বলে উঠল, "খেয়াপারের জন্য পাঁচ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন! এ তো দিনে ডাকাতি। ওই পুঁচকে খাল পেরোনোর ভাড়া মাথাপিছু পঁচিশ পয়সা হলেই অনেক।"

 

লোকটা অবাক হয়ে বলল, "খেয়াপারের ভাড়া চাইছি কে বলল? ছিঃ ছিঃ, ওইসব ছোটখাটো কাজ করে বেড়াই বলে ভাবলে নাকি? এই মহাদেব দাস ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না হে।"

 

"তবে পাঁচ টাকা নিলেন যে!"

 

"সেটা তো আমার মাথার দাম। এই যে তোমরা খাল পেরোতে পারছিলে না বলে আমাকে ধরে বসলে, আমাকে মাথা খাটাতে হল, বুদ্ধি বের করতে হল, এর দাম কি চার আনা আট আনা? মহাদেব দাসকে কি খেয়ার মাঝি পেয়েছ নাকি? এ-তল্লাটে সবাই আমাকে বুদ্ধিজীবী বলে জানে, বুঝলে! টাকাটা ছাড়ো।”

 

মান্যগণ্য এমন অনেক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেই আমাদের চলতে ফিরতে দেখা হয়ে যায় বটে!

 

ভালো গল্পের সঙ্গে ভালো খাবারদাবারের কোথাও যেন একটা পাতানো সম্পর্ক আছে। গল্পে যদি হরেকরকম লোভনীয় খাবারদাবারের হদিশ থাকে, গল্প পড়াকালীন একধরনের ‘ফুডগ্যাজম’ চলতে থাকে মাথার ভেতর। এ অতি পুরনো ট্রিক। গল্পের মধ্যে স্বাদু খাবারদাবারের বর্ণনা পড়লে পাঠক সেগুলো ভিস্যুয়ালাইজ করতে থাকে। স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি সেন্সগুলো অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠে। এইধরনের sensory engagement এর ফলে পাঠক আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে পারে গল্পের মধ্যে।

এই ছাব্বিশ নম্বর অদ্ভুতুড়েতে এই মজার ব্যাপারটি বারবার দেখা গেছে। নৌকায় বসে মহাদেব দাস বলে চলেছে— ‘নয়ন ময়রার জিবেগজা পছন্দ না হলে সাতকড়ির বেগুনি তো রয়েছে। খাঁটি সর্ষের তেলে ভাজা, ওপরে পোস্ত ছড়ানো, চটিজুতোর সাইজ। তা বলে বেশি খেলে চলবে না, পেটে জায়গা রেখে খেতে হবে। ধরো, দশখানা করে খেয়ে তারপর গিয়ে বসলে রায়মশাইয়ের মণ্ডার দোকানে। ইয়া বড় বড় মণ্ডা। বেগুনির পরই মণ্ডা খেতে যেন অমৃত। তাও যেতে ইচ্ছে করছে না?"

বিভিন্ন খাবারদাবারের সঙ্গে আমাদের ছোটবেলার অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। গল্পে হঠাৎ সেসবের উল্লেখ পেলে মনের গভীরে চাপা পড়ে থাকা এই স্মৃতি, পুরনো আবেগগুলো নাড়া খেয়ে ওঠে। আর অবচেতন মনে আমরা ভীষণভাবে গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্মবোধ করতে থাকি। লেখকরা অনেকসময়েই ইচ্ছে করে এই কাণ্ডটি ঘটিয়ে থাকেন।

খাল পেরিয়ে হরিপুরের জঙ্গলে ঢুকেছে ফটিক-নিতাই। পথে পড়েছে গনা ডাইনির ঘর। সে এখন বুড়ি হয়েছে, মন্ত্রতন্ত্রের জোর নেই। মহাদেব দাস ভয় দেখিয়েছিল, গনা ডাইনি নাকি ও পথে যারাই যায় তাদের গরু ছাগল বানিয়ে রেখে দেয়। নিতাইকে সে সাদাঘোড়া বানাতে চেয়েছিল। পারেনি। সুযোগ পেয়ে নিতাই তাকে ব্ল্যাকমেল করছে। ডাইনি তার ‘বাজার নষ্ট হবে’ এই ভয়ে সবকিছু করতেই রাজি ছিল। কিন্তু নিতাই চাইল কী? চিঁড়ে-মুড়কি, ঝোলাগুড়, পাকা কাঁঠাল, তালের বড়া আর বিচেকলা! এইগুলো হচ্ছে নিতান্তই কমফোর্ট ফুড। সাদামাটা ফলারে তৃপ্তি পাওয়া নিতাই আর পাঁচটা সাধারণ গাঁয়ের ছেলের মতোই একজন, সেইটিই বোঝানো দরকার ছিল। গল্পের উপকারী ভূত গড়াইঠাকুমার দৌলতে গ্রামে যখন তাদের খাতির বাড়ল, লোকজন তাদের সম্মান জানাচ্ছে ভালোমন্দ খাইয়ে— মিষ্টির দোকানে ফ্রিতে গরম কচুরি জিলিপি সন্দেশ, লঙ্গরখানায় পোলাও কষা মাংস! লেখকসমাজ ঠিকই বোঝেন, পাঠককুলের মনের রাস্তাটিতে পেটের পথ ধরেই পৌঁছনো যায়।

আর আছে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স-বাথোসের যথাযথ ব্যবহার। মহাদেব দাসের সঙ্গে দোগেছে যাওয়া নিয়ে কথা বলছিল নিতাই ফটিক। মহাদেব দাস তো বুদ্ধিজীবী। বাড়িয়ে বলাই তার স্বভাব। অবশ্য তারও একটা মোটিভ ছিল, যা পরে স্পষ্ট হয়।

আরও দুটো টাকা ‘কথার দাম’ হিসেবে আদায় করে মহাদেব দাস বলেছিল, পিসির বাড়ি যেতে হলে আগে পড়বে হরিপুরের জঙ্গল। জঙ্গলে আছে নটোরিয়াস কালু ডাকাত আর টাঙ্গি বল্লম হাতে তার শাগরেদরা। জঙ্গল পেরোলে আসবে গনাডাইনির আস্তানা যে মানুষ পেলেই গরু ভেড়া বানিয়ে রেখে দেয়। এরপর আসবে হারু কাপালিকের মন্দির, নধরকান্তি ছেলেদের সে বলি দেয়। তারপর পাওয়া যাবে বাঁশবাগানের কবন্ধ, তাদের সাথে হাডুডু না খেললে ছাড় পাওয়া যাবে না। নেক্সট আসবে খালের মধ্যে রাক্ষুসে কুমির— ‘তাদের পেটে রাবণের খিদে। হাঁ করেই আছে। আর সে এমন বড় হাঁ যে, জাহাজ অবধি সেঁধিয়ে যায়।’ সে খাল পেরোতে হয় কেমন করে? ‘দোগেছের লোকেরা খালের দু'ধারে দুটো উঁচু গাছে আড়া করে দড়ি বেঁধে দিয়েছে। গাছে উঠে ওই দড়িতে ঝুল খেয়ে খেয়ে পেরোতে হয়। কেঁদো কয়েকটা হনুমান ওই সময়ে এসে যদি কাতুকুতু না দেয় বা মাথায় চাঁটি না মারে, আর নীচে উপোসী কুমিরের হাঁ দেখে ভয়ে যদি তোদের হাত পা হিম হয়ে না যায় তা হলে দিব্যি পেরিয়ে যাবি।’

এতসব শুনেও নিতাই ফটিক দমেনি। মহাদেব দাস কায়দা করে ফটিকের চিঠিখানা হাতিয়ে নিতেই নিতাই টের পায়, মহাদেব দাস সুবিধের নয়। তারা এগোয় হরিপুরের জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের সেই সাংঘাতিক কালু ডাকাত লাফিয়ে নামল গাছ থেকে, আর নেমেই— ‘‘ককিয়ে উঠে বলল, উঃ, মাজাটা গেছে বাপ। এই বয়সে কি আর লাফঝাঁপ সয়। বলি হাঁ করে দেখছিস কী আহাম্মকেরা? ধরে একটু তুলবি তো!" কালু ডাকাত এখন বুড়ো হয়েছে। তার শাগরেদরা কেউ বুড়ো হয়ে মরেছে, কেউ ঘরগেরস্থালি চাষবাস নিয়ে আছে। কালু ডাকাত এখন একাই কোনওমতে জঙ্গল ‘সামলাচ্ছে’।

“আজ এখন অবধি বউনিটাই হয়নি যে! বিশ পঞ্চাশটা টাকা হয় কিনা বাক্সপ্যাঁটরা হাতড়ে একটু দেখ দিকি বাপু।”

ফটিক মুখখানা মলিন করে বলে, "বিশ পঞ্চাশ! সে যে অনেক টাকা দাদু!"

কালু করুণ মুখ করে বলল, "আজ মনসাপোঁতায় হাটবার। গিন্নি একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। তা সেসব আর হবে না দেখছি। তা না হোক, অন্তত বউনিটা করিয়ে দে তো বাপ। পাঁচ দশ যা হোক দে দিকি। এই হাত বাড়িয়ে মুখটা ফিরিয়ে রাখছি। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধই হচ্ছে বটে, কিন্তু বউনিটা যে না হলেই নয়।”

নিতাই ট্যাঁক থেকে একখানা সিকি বের করে কালু ডাকাতের হাতে দিতেই হাতটা মুঠো করে কালু বলল, "কী দিলি? কিছু তো টেরই পাচ্ছি না।”

নিতাই ভারী লাজুক গলায় বলল, "ও আর দেখবার দরকার নেই। পকেটে পুরে ফেলুন।"

"কিছু দিয়েছিস তো সত্যিই?”

"দিয়েছি।”

কালু চোখ না খুলেই বলল, "বড্ড ছোট জিনিস দিয়েছিস রে। এ কি সিকি নাকি?"

নিতাই বলল, "আর লজ্জা দেবেন না। সিকি ছোট জিনিস বটে, কিন্তু আমাদের কাছে সিকিও অনেক পয়সা। আপনার বউনি হয়নি বলেই দেওয়া।"

 

কালু সিকিটা পকেটে পুরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "দেশে এত গরিব কোত্থেকে আসছে বল তো! গরিবে গরিবে যে গাঁ-গঞ্জ ভরে গেল! এ তো মোটেই ভাল লক্ষণ নয়।"

এরপর গনাডাইনির আস্তানা। নিতাই ফটিককে দেখেই নিজের পোর্টফোলিও খুলে বসল— ‘ওই যে দেখছিস ধাড়ি ছাগলটা, ও হল নবগ্রামের পটু নস্কর। এক নম্বরের সুদখোর, ছ্যাঁচড়া, পাজি লোক। দেখ তো এখন কেমন দিব্যি আছে। ঘাসপাতা খায়, চরায় বরায় ঘুরে বেড়ায়। আর ওই যে গোরুটা দেখছিস, ছাই-ছাই রঙা, ও হল গোবিন্দপুরের অতসী মণ্ডল। এমন ঝগড়ুটে ছিল যে, পাড়ায় লোক তিষ্ঠোতে পারত না। ওর স্বামীটা সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে। এখন দ্যাখ তো, অতসী কেমন ধীরস্থির ঠাণ্ডা মেরে গেছে। সাত চড়ে রা কাড়বে না। আর ওই কেলে কুকুরটা কে বল তো! ও হল চরণগঙ্গার হরিপদ দাস। সবাই বলত, খুনে হরিপদ। কত খুনখারাপি যে করেছে তার হিসেব নেই। এখন দ্যাখ, কেমন মিলেমিশে আছে সবার সঙ্গে। কারও খারাপ কিছু করেছি কি, তুই-ই বল। আর ওই জলায় যাদের পুঁতে রেখেছি তাদেরও তো প্রাণে মারিনি রে বাপু। ওই দ্যাখ, গদাই নস্কর কেমন চুরি করা ছেড়ে বকুল গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। ওই যে শিমুলগাছটা দেখছিস ও হল হাড়কেপ্পন গণেশ হাওলাদার।’

কিন্তু সেও বুড়ি হয়েছে। নিতাইকে সাদাঘোড়া বানাতে গিয়ে তার ল্যাজেগোবরে দশা!

“গনা ডাইনি গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছিল। এবার ভারী হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, "নাঃ, মন্তরে কাজ হচ্ছে না তো! আর হবেই বা কী করে? পাঁচ কুড়ি সাত বচ্ছর বয়স হল বাপ, মাথাটার কি কিছু আছে! সব কেমন ভুল হয়ে যায়। অর্ধেক মন্তর বলার পর কেমন যেন ঢুলুনি এসে পড়ে, তারপর আর বাকি মন্তরটা মনেই পড়ে না। মাথাটা বেভুল হয়ে পড়েছে বড্ড।”

নিতাই গা-ঝাড়া দিয়ে বসল। তার ভয়ডর কেটে গেছে। সে বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, "তা বললে হবে কেন ঠাকুমা? আমার যে অনেকদিন ধরে ঘোড়া হওয়ার বড্ড শখ! আপনি ঘোড়া বানিয়ে দেবেন বলে কত আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু এ তো দেখছি জোচ্চুরি! অ্যাঁ! এ যে দিনে ডাকাতি! এ যে সাঙ্ঘাতিক লোকঠকানো কারবার!"

গনা ডাইনি আকুল হয়ে বলল, "ওরে চুপ! চুপ! লোকে শুনতে পেলে যে গনা ডাইনির বাজার নষ্ট হবে! চুপ কর ভাই, যা চাস দেব।”

নিতাই মাথা নেড়ে বলল, "না না, আমি কিছু চাই না, আমি শুধু ঘোড়া হতে চাই। ঘোড়া হব বলে সেই কতদূর থেকে আসা! এত নামডাক শুনেছিলুম আপনার, এখন তো দেখছি পুরোটাই ফাঁকিবাজি।”

"চেঁচাসনি বাপ, চেঁচাসনি। লোকে শুনলে দুয়ো দেবে যে আমাকে! তা কী খাবি বাপ, বল তো! ভাল চিঁড়ে, মুড়কি, ঝোলা গুড়, পাকা কাঁঠাল আর তালের বড়া হলে হবে? সঙ্গে বিচেকলাও দেব'খন।"

অষ্টভুজার মন্দিরের কাপালিক অবশ্য এখনও জবরদস্ত চেহারায় আছেন। নিতাই ফটিককে ধরেওছিলেন বলি দেবার জন্য। কিন্তু—

‘ঠাকুরমশাই জলদগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, "জয় মা! এবার ঘ্যাচাং করে দাও হে গদাইচাঁদ।”

"আজ্ঞে বাবা।” বলেই খাঁড়াটা ওপরে তুলল বলাই।

খাঁড়াটা নেমেও এল বটে, তবে বেশ আস্তে। নিতাই ঘাড়ে একটু চিনচিনে ব্যথা টের পেল। তার গলা বেয়ে দু'ফোঁটা রক্তও পড়ল সরায়।

লোকটা খাঁড়াটা ফেলে হাড়িকাঠের খিল খুলে দিয়ে হাত পায়ের বাঁধন আলগা করে নিতাইকে দাঁড় করিয়ে একগাল হেসে বলল, "তোর বড় ভাগ্য, মায়ের কাছে বলি হলি, তোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার পেয়ে গেল।"

ঠাকুরমশাই সরাটা তুলে নিয়ে ভক্তিগদগদ গলায় "জয় মা, এই যে নররক্ত এনেছি মা, নে মা.... নে মা...." বলতে বলতে মন্দিরে ঢুকে গেল।

নিতাই ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, "বলি হয়ে গেলুম নাকি? কিন্তু ঘাড়টা তো আস্তই আছে।”

বলাই একটু হেসে বলল, "এর বেশি বলি দেওয়ার কি উপায় আছে রে? সতীশ দারোগা নিয়ে গিয়ে ফাটকে পুরবে যে। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাবে।’’

বাঁশবনের কবন্ধরাও এখন আর হাডুডু খেলে না।

“নিতাই সভয়ে জিজ্ঞেস করল, "হা-ডু-ডু খেলতে হবে নাকি? শুনেছি, আপনারা মানুষ পেলে হা-ডু-ডু খেলেন।”

"সে খেলতুম রে। মনসাপোতার জয়নাথ পণ্ডিত আমাদের একটা দাবা আর ঘুঁটি কিনে দিয়েছে। খেলাটাও শিখে নিয়েছি। আহা, দাবার মতো খেলা নেই। হা-ডু-ডু আবার একটা খেলা? যা, তোরা, আমার মন্ত্রী এখন ঘোড়ার মুখে পড়েছে।”

আর করালেশ্বরী খালের সেইসব রাক্ষুসে কুমিররা?

খালটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে তখন দেখা গেল একটা লোক উবু হয়ে বসে আছে। তার পায়ের কাছে অনেক গোদা গোদা টিকটিকি, লোকটা একটা খালুই থেকে চুনোমাছ বের করে টিকটিকিদের খাওয়াচ্ছে। আর তারাও মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল দু'জন।

ফটিক বলল, "লোকটার বড্ড দয়ার শরীর, টিকটিকিদের মাছ খাওয়াচ্ছে দ্যাখ।"

লোকটা মুখ তুলে বলল, "টিকটিকি নয় গো, টিকটিকি নয়।”

"তবে?”

"এরা সব হল করালেশ্বরীর বিখ্যাত কুমির। একসময়ে দশ বিশ হাত লম্বা ছিল। আস্ত আস্ত গোরু মোষ ছাগল কপাত কপাত করে গিলে ফেলত। তা করালেশ্বরীর খাল হেজেমজে গেল, আর কুমিরগুলোও না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সব একটুখানি হয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট ছোট হতে লাগল। তস্য বাচ্চাগুলো আরও ছোট হতে লাগল। হতে হতে এই দশা।

"কুমির?” বলে ফটিক এক লাফে উঁচু ডাঙায় উঠে গেল।

লোকটা বলল, "ভয় নেই গো, ওদের কি আর সেই দিন আছে? এখন চুনোমাছের চেয়ে বড় কিছু খেতেই পারে না। আর তা-ই বা ওদের দেয় কে বলো! এই আমারই একটু মায়া হয় বলে বিকেলের দিকে এসে খাইয়ে যাই।"

নিতাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল, "মনে হচ্ছে এ হল কুমিরের বনসাই।"

এই জিনিসটিই হল অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স বা বাথোস।

খুব সাদামাটা ভাষায় বললে, অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স হল একটি সাহিত্যিক কৌশল যেখানে গল্পটি বিশাল উত্তেজনা, ভয়ানক বিপদ বা রোমাঞ্চ তৈরি করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার চেয়ে অনেক কম নাটকীয়তা বা এক্কেবারে এলেবেলে রিয়্যালিটি দেখা যায়।

আর যখন এই অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স ইচ্ছাকৃতভাবে গল্পে  কমিক এফেক্ট তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়, তখন তাকে বাথোস (Bathos) বলা হয়। ভয়ঙ্কর একটা ক্লাইম্যাক্সের প্রত্যাশা এবং তার হাস্যকর পরিণতি গল্পে এক ধরনের পাঞ্চলাইন হিসেবে কাজ করে। শীর্ষেন্দুর ছাব্বিশ নম্বর অদ্ভুতুড়ে এ জিনিসের আইডিয়াল উদাহরণ।

আর আছে দারুণ একখানা কন্ট্রাস্ট। এই প্রথমবার কোনও অদ্ভুতুড়েতে একসাথে দুজন দারোগা এসেছেন— গজপতি দারোগা আর সতীশ দারোগা। সতীশ দারোগা একজন দারোগার মতো দারোগা, স্বাস্থ্যবান সাহসী, এলাকার চোর গুন্ডারা তাঁর ভয়ে কাঁপে। ছদ্মবেশে তিনি এদিক ওদিক টহল দেন। আর গজপতি দারোগা? সে সতীশ দারোগার ঠিক উল্টোরকম দারোগা!

কন্ধকাটা ক কন্ধকাটা খ-কে বলল, "ওই দ্যাখ, ভুঁড়ি যাচ্ছে।”

কন্ধকাটা খ বলে, "কার ভুঁড়ি?"

"গজপতি দারোগার ভুঁড়ি।"

"তা গজপতি দারোগা কোথায়?"

"ভুঁড়ির পেছনে পেছনে আসছে।"

"ও বাবা, সন্ধের পর গজপতি দারোগা আজ বেরোল যে! এ তো ঘোর দুর্লক্ষণ? দেশে অনাবৃষ্টি, মহামারী, ভূমিকম্প কিছু-না-কিছু হবেই।"

"হুঁ। সন্ধের পর গজপতিকে কেউ ঘরের বাইরে দেখেনি বটে। নিশ্চয়ই গুরুতর কারণ আছে।"

সন্ধের পর গজপতি দারোগা বাড়ির বাইরে পা দেন না। ভূতপ্রেত, চোর-ডাকাত, খুনে-গুণ্ডা, সাপখোপ ইত্যাদি নানা ‘অস্বস্তিকর’ ব্যাপার এই সন্ধের পরই মাথাচাড়া দেয় কিনা। তাঁর বহুকালের অভ্যাস হল সন্ধের পর এক বড় বাটি ভর্তি ক্ষীর, দুটি মর্তমান কলা, একধামা খই দিয়ে মেখে খেয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসে ‘লুডু খেলা’। রাতে থানার কাজকর্ম সেপাইরাই সামলায়। বেশ একটু সারকাজমের গন্ধ ম ম করছে না?

গল্পের ভূত গড়াইঠাকুমা। অদ্ভুতুড়ে সিরিজে এও নতুন জিনিস— ঠাকুমাভূত। কোনও মহিলাভূত এর আগে সিরিজে দেখা যায়নি। গড়াইঠাকুমা মরে গিয়েও নিজের বসতবাড়ির মায়া কাটাতে পারছিলেন না। ঘরে তাঁর গুপ্তধন ছিল তিনশো বাইশ টাকা। নিতাই ফটিককে দেখে তাদের ওপর বড্ড মায়া পড়ে গেল তাঁর। গুপ্তধনটা তাদেরই দিয়ে দিলেন।

আগেই বলেছি, গল্পের ক্লাইম্যাক্স খুবই প্রেডিক্টেবল। সেই দুষ্টু পোষ্যপুত্তুরটি লোক লাগিয়ে নিতাই-ফটিককে খুন করার চেষ্টা করে। গড়াইঠাকুমার ভূত গিয়ে তাদের বাঁচায়। সবশেষে সতীশ দারোগা এসে দুষ্টুলোকগুলোকে ফাটকে ঢোকায় আর ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষই যে আসল ফটিক তা প্রমাণ হয়ে যায়।

গল্প ছোট, তবে ঘন্টাআড়াইয়ের মুচমুচে একটি সিনেমা তৈরির রেসিপি এতে মজুত। অ্যাকশন, সাসপেন্স, থ্রিল, চোর, ভূত, হাসি-মজা-ইয়ার্কি-সারকাজম— কি নেই এতে! গল্পটা একজন যোগ্য পরিচালকের হাতে পড়ারই যা অপেক্ষা।

 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২১ - পাতালঘর -আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২২ - হরিপুরের হরেক কাণ্ড -আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৩ - দুধসায়রের দ্বীপ - আলোচনার লিংক

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৪ - বিপিনবাবুর বিপদ - আলোচনার লিংক 

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৫ - নবাবগঞ্জের আগন্তুক - আলোচনার লিংক