জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - দ্বাদশ পর্ব
- 07 November, 2025
- লেখক: সুস্মিতা সরকার
(১২)
নভেম্বরে স্যর থমাসের ফেরার কথা। সেপ্টেম্বর মাসে নানান রকম বিনোদন, শিকার ও বিভিন্ন আমোদপ্রমোদ শুরু হয়। সেই বিনোদনে অংশ নেওয়া গ্রামীণ মানুষের জন্য বেশ সম্মানের কাজ। স্যর থমাসের বড় ছেলে টম সেই বিশেষ কাজে যোগ দেওয়ার জন্য আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। টমের প্রথম চিঠি এসে পৌঁছল বাড়িতে যে সমস্ত পশুপাখি দেখে রাখে তার কাছে। দ্বিতীয় চিঠি এলো এডমন্ডের কাছে। তারপর আগস্ট মাসের শেষের দিকে সে নিজেই সশরীরে এসে হাজির হলো। দেখা গেল টমের ব্যবহার ঠিক আগের মতোই, হাসিখুশি, ভদ্রতাপূর্ণ। এছাড়া পরিস্থিতি বুঝে মিস ক্রফোর্ডের উপস্থিতিতে তো বেশ সাহসী প্রেমিকের মতন হাবভাবও শুরু করল। ঘোড়দৌড়ের মাঠে কী কী হয়েছে, ওয়েমাউথের সমুদ্র সৈকতে কেমন সময় কেটেছে, নানান পার্টিতে কেমন সময় কেটেছে, বন্ধুদের কথা, সব কিছুই মিস ক্রফোর্ডের কাছে গল্প করতে শুরু করল। সপ্তাহ ছয়েক আগে হলে মিস ক্রফোর্ড এসব গল্প হয়তো বেশ মনোযোগ সহকারেই শুনত। কিন্তু এখন সবকিছু মিলিয়ে সে নিজেই বুঝতে পারছে যে টমের তুলনায় টমের ছোট ভাই এডমন্ডকেই ওর বেশি ভালো লাগছে।
টমের গল্পগাছা এখন মিস ক্রফোর্ডের কাছে বড্ড বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে। সেজন্য ওর যে খারাপ লাগছে না, তাও নয়। কিন্তু এটাই বাস্তব। এখন টমকে বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই ওর নেই। সে যে যথেষ্ট সুন্দরী, সেই সচেতন রংঢং বাদ দিলে এমন কী টমকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার বিশেষ কোনও চেষ্টাও নেই ওর মধ্যে। ম্যান্সফিল্ডে টমের দীর্ঘ অনুপস্থিতি, নিজের ইচ্ছে মতন চলাফেরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মিস ক্রফোর্ডের জন্য তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আপাতত মিস ক্রফোর্ডের প্রতি টমের এই উদাসীনতা আর টমের প্রতি মিস ক্রফোর্ডের উদাসীনতা প্রায় একই পর্যায়ের। একসময় টম ম্যান্সফিল্ড পার্কের মালিক হবে, সত্যিই স্যর থমাস হয়ে উঠবে, সেটা ঠিকই। তবে সেটা যদি এখনই হয় তবুও মিস ক্রফোর্ড যে আদৌ টমকে বিয়ে করতে চাইবে সেটা ওর নিজেরই মনে হচ্ছে না।
ঋতুকালীন যে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য টম ম্যান্সফিল্ডে ফিরে এসেছে, ঠিক সেই একই কারণে মিস্টার ক্রফোর্ডও নরফোকে গিয়েছে। এভারিংহ্যাম – তার নিজের প্রাসাদেও সেপ্টেম্বরের শুরুতে শিকার ও অন্যান্য আমোদপ্রমোদ শুরু হয়। সেখানে তাকে ছাড়া চলবে কেন! দিন পনেরোর জন্য সে সেখানে গিয়েছে। আর সেই দিন পনেরো দুই বার্ট্রাম বোনের সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। সবকিছুই এতটা একঘেঁয়ে লাগছে যে সেটা ব্যাপারটার গুরুত্ব বা বিপদ তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে। বোনকে হিংসা করলেও জুলিয়া শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেই ফেলল ওই লোকটার মনোযোগকে শুধু যে বেশি পাত্তা না দেওয়াই ভালো, তা নয়, বরং লোকটা আর না ফিরলেই সবথেকে ভালো হয়। অন্যদিকে মিস্টার ক্রফোর্ডও এই পনেরো দিনে শিকার করা আর ঘুমানোর ফাঁকে চিন্তাভাবনা করার জন্য যথেষ্ট অবসর পেল। তার যদি নিজের আচার ব্যবহার বা উদ্দেশ্য নিয়ে অনুধাবন করার সামান্য অভ্যাস থাকত, বা একবারও ভেবে দেখত যে তার নিজের অকারণ অহং আর খামখেয়ালি আনন্দের ফলাফল কী হতে চলেছে, তাহলে সে এটাও বুঝতে পারত যে একজন ভদ্রলোক হিসেবে তার আরও অনেকদিন ম্যান্সফিল্ড পার্ক থেকে দূরে সরে থাকা উচিৎ। তবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভ্যেস আর খারাপ উদাহরণের প্রভাবে তার স্বভাবটাই এমন হঠকারী আর স্বার্থপরের মতন যে বর্তমান মুহূর্ত ছাড়া আর কিছু সে দেখতেই পাচ্ছে না। সুন্দরী, বুদ্ধিমতি আর আগ্রহী দুই বোন মিস্টার ক্রফোর্ডের কাছে বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়। তাই নরফোকে ম্যান্সফিল্ডের মতন সেরকম সামাজিক আমোদপ্রমোদ না পেয়ে সে নির্দিষ্ট সময়ে খুব খুশির সঙ্গেই ম্যান্সফিল্ডে ফিরে এলো। আর যাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও ফষ্টিনস্টি করবে বলে ফিরে এলো, তারাও ভারি আনন্দের সঙ্গেই তাকে স্বাগত জানাল।
মিস্টার রাশওয়ার্থই আপাতত মারিয়ার একমাত্র সঙ্গী। মিস্টার রাশওয়ার্থ মারিয়াকে সারাক্ষণ শুধু শিকার করার খুঁটিনাটি গল্প, সে ভালো মন্দ যেমনই হোক, শোনান। তার কুকুরগুলো কতটা ভালো সেটা শোনান, তার প্রতিবেশিরা বেশি বেশি শিকার করে ফেলছে কিনা সেই নিয়ে হিংসা করেন, ওদের শিকার করার অনুমতি পাওয়ার মতন টাকাপয়সা আছে কিনা বা কেউ বেআইনিভাবে ওর পাখি শিকার করছে কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। বারেবারে এই একই খুঁটিনাটি বিবরণ শুনতে শুনতে মারিয়া রীতিমত ক্লান্ত। এইসব বিষয়ে কথাবার্তা মেয়েদের মোটেই পছন্দ নয় যদি না সে নিজেই এই বিষয় বিশেষ আগ্রহী হয় বা যে এতো কথা বলছে তার প্রতি খুব ভালোবাসা থাকে। মিস্টার রাশওয়ার্থের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ক্লান্ত মারিয়া তাই মিস্টার ক্রফোর্ড যে এখানে নেই, সেটা বেশি বেশি করে অনুভব করছে। অন্যদিকে একে জুলিয়ার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য কেউ নেই, আবার সেরকম কাজকর্মও বিশেষ নেই ওর, তাই মিস্টার ক্রফোর্ডের অনুপস্থিতি অনুভব করে কষ্ট পাওয়াটা যেন ওর অধিকারের মধ্যেই পড়ে বলে ওর মনে হচ্ছে। দুই বোনেরই বিশ্বাস যে মিস্টার ক্রফোর্ড তাকেই বেশি পছন্দ করে। মিসেস গ্রান্ট চান মিস্টার ক্রফোর্ড জুলিয়াকেই পছন্দ করুক, তাই তাঁর ইন্ধন পেয়ে যেমন একদিকে জুলিয়ার এই বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে তেমন অন্যদিকে মারিয়ার বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে উঠছে স্বয়ং মিস্টার ক্রফোর্ডের আস্কারায়। মিস্টার ক্রফোর্ড ফিরে আসার পর সবকিছু আবার আগের মতোই শুরু হয়ে গেল। দু’জনের সঙ্গেই তার ব্যবহার এতোটাই প্রাণোচ্ছল আর ভদ্র যে কারোর সঙ্গেই এতটুকু দূরত্ব তৈরি হলো না। শুধু তাই না, দুই বোনের সঙ্গেই তার ব্যবহার এতোটাই যথাযথ আর পরিমিত যে বিষয়টা সেভাবে অন্য কেউ খেয়ালও করছে না, টেরও পাচ্ছে না।
কারোর কিছু মনে না হলেও, ফ্যানির কিন্তু খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না ব্যাপারটা। সেই যেদিন ওরা সবাই মিলে সথার্টনে গিয়েছিল, সেদিন থেকেই মিস্টার ক্রফোর্ড মারিয়া বা জুলিয়া যখন যার সঙ্গেই থাকুক না কেন, ও আর কিছুতেই একটু বিশেষ নজর না রেখে পারে না। মিস্টার ক্রফোর্ডকে মারিয়া বা জুলিয়ার সঙ্গে দেখে ফ্যানির কখনও যদি বা অবাক লাগে তো কখনও কখনও বিরক্তও লাগে। অন্য সব কিছুতেই ফ্যানির নিজের উপর ভরসা আছে, কিন্তু নিজের বিচার বুদ্ধির উপর যথেষ্ট ভরসা নেই। তা যদি থাকত, বা যেটা পরিষ্কার চোখে দেখতে পাচ্ছে বা ভাবছে সেটা যে সত্যি, সেই পূর্ণ বিশ্বাস থাকত, তাহলে হয়তো ওর সবসময়ের ভরসার জায়গা এডমন্ডকে সব কথা খুলে বলতে পারত। একটু ইঙ্গিত অবশ্য ও দিলো, কিন্তু সব কথার ভিড়ে এডমন্ড সেই ইঙ্গিত খেয়াল করল না। “আমার কিন্তু বেশ অবাকই লাগছে। মিস্টার ক্রফোর্ড প্রায় সাত সপ্তাহ তো এখানেই ছিল। তারপরেও এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলো! আমি তো ভেবেছি ও ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, তাই হয়তো একবার এখান থেকে গেলে তারপর নিশ্চয়ই অন্য কোথাও যাবে। ম্যান্সফিল্ডের মতন ছোট জায়গা তো তার পছন্দ নয়, তার পছন্দ বড় বড় জমজমাট সব জায়গা।”
ফ্যানির মুখে একথা শুনে এডমন্ড উত্তর দিল, “ওর জন্য ভালোই হয়েছে। আমার তো মনে হয় ওর বোনও খুশিই হয়েছে। দাদার এই উড়নচণ্ডী জীবনযাপন ওরও পছন্দ নয়।”
“আরে বাঃ, আমার মাসতুতো দাদা দিদি সবার কাছেই তো দেখি দারুণ প্রিয় হয়ে উঠেছে মিস্টার ক্রফোর্ড!”
“সেটা তো ঠিকই। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে ওর আচার আচরণ এমনই যে সবারই ভালো লাগবে। আমার মনে হয় মিসেস গ্রান্ট সন্দেহ করছেন যে মিস্টার ক্রফোর্ড জুলিয়াকে পছন্দ করে। আমি অবশ্য সেরকম লক্ষণ দেখি নি। তবে সেটা হলে তো ভালোই হয়। মিস্টার ক্রফোর্ডের মন কোথাও টেঁকে না, এই একমাত্র দোষ। আমার মনে হয় ভালোবাসা পেলে সেটাও নিশ্চয়ই শুধরে যাবে।”
“আমার তো কখনও কখনও মনে হয় যে নেহাত মারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে তাই, তা নাহলে জুলিয়ার থেকে মারিয়াকেই ওর বেশি ভালো লাগে।” হালকা গলায় বলে উঠল ফ্যানি।
“তাতে এটাও তো বোঝা যেতে পারে যে ওর আসলে জুলিয়াকেই বেশি পছন্দ। তুমি নিজেও হয়তো এটা বুঝতে পারছ। আমার মনে হয় এটা অনেকসময়ই এরকম হয় যে পুরুষমানুষ কোনও নারীর বিষয়ে নিজের মনস্থির করার আগে সেই নারীর থেকেও বেশি মনোযোগ দেখায় সেই নারীর বন্ধু বা বোনের প্রতি। ক্রফোর্ড যথেষ্ট বুদ্ধিমান। মারিয়ার প্রতি ওর কোনও আকর্ষণ তৈরি হলে ও এখানে থাকতোই না। আর ইতিমধ্যেই মারিয়া ওর জোরালো অনুভুতি না থাকার যে প্রমাণ দিয়েছে, তাতে ওর যে ক্রফোর্ডের প্রতি কোনও টান তৈরি হবে সেই ভয়টাও আমি পাই না।”
ফ্যানির মনে হলো তাহলে নিশ্চয়ই ওর নিজেরই বুঝতে ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে ব্যাপারটা ও অন্যভাবে দেখবে বলে ভেবে নিল। কিন্তু যতই ও এডমন্ডের কথা মেনে নিতে চাক না কেন, যতই অন্যান্য সবাই চোখের চাহনি বা বিভিন্ন ইঙ্গিতে এটা বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন যে ক্রফোর্ড জুলিয়াকেই পছন্দ করে, তবুও ও নিশ্চিত হতে পারছে না।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় একটা বল নাচের আসরে ফ্যানি কিছুটা বাধ্য হয়েই বাড়ির বড়দের সঙ্গে আগুনের পাশে বসে ছিল। সবাই নাচ করছে। আর এডমন্ড এলে ফ্যানি হয়তো ওর সঙ্গে জুটি বেঁধে নাচতে পারবে সেই আশায় ও অপেক্ষা করে বসে আছে যে কখন এডমন্ড ফিরে আসবে। এমন সময় পাশে বসে থাকা মিসেস নরিস আর মিসেস রাশওয়ার্থের আলাপ আলোচনা কানে এল। তাঁদের দুজনেরই মিস্টার ক্রফোর্ডকে নিয়ে একই আশা। তাঁদের আলোচনা শুনতে শুনতে কিছুটা অবাক ফ্যানির মনে হলো, এসব কথাবার্তা ওকে না শুনতে হলেই ভালো হতো।
সেদিন ফ্যানির জীবনের প্রথম বল নাচের আসরে যাওয়া। অন্যান্য তরুণী মেয়েরা প্রথমবার বল নাচের আসরে গেলে যেমন নানা রকম প্রস্তুতির ঘনঘটা করে ও সেরকম কিছুই করে নি। সেদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই সমস্ত পরিকল্পনা করা হলো। একটা নতুন চাকর কাজ করতে শুরু করেছে। সে আবার বেহালাও বাজায়। আর এদিকে টমের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঘুরতে এসেছে। সেই সঙ্গে মিসেস গ্রান্টের সহায়তায় সব মিলিয়ে পাঁচ জোড়া ছেলে মেয়ে জড়ো করা যেতে পারে সেই আশায় আজকের বল নাচের আসরের আয়োজন করা হয়েছে। তবে প্রথম বল নাচের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য সেরকম প্রস্তুতি না থাকলেও ফ্যানির আনন্দ কিন্ত কিছু কম হয় নি। প্রথম চারটে নাচ ও ভীষণ উপভোগ করেছে। আপাতত এই যে পনেরো মিনিট যে নাচ করতে পারছে না, তাতে ওর মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আবার কখন নাচ করতে পারবে সেই আশায় একবার সামনে যারা নাচ করছে তাদের দিকে আর একবার দরজার দিকে তাকিয়ে হাপিত্যেশ করে বসে আছে। এর সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়া। কাছাকছি বসে থাকার কারণে বাধ্য হয়েই মিসেস নরিস আর মিসেস রাশওয়ার্থের আলাপ আলোচনা শুনতে হচ্ছে।
মারিয়া আর মিস্টার রাশওয়ার্থ তখন দ্বিতীয়বারের মতন জুটি বেঁধে নাচ করছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মিসেস নরিস বললেন, “আমার মনে হয় এখন আবার ওদের মুখে হাসি দেখতে পাব আমরা।”
“সত্যিই তাই। এখন ওদের দেখলেও একটা তৃপ্তি হবে। এই বল নাচের আসরে ওরা যে শুধু নিজেরা নাচ করতে পারছে না, সবার সঙ্গেই নাচতে হচ্ছে, দুজনকে দুজনের থেকে দূরে দূরে থাকতে হচ্ছে, সেটা ভারি দুঃখের বিষয়। এই তো বয়স। ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন এই সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য ওদের যে আলাদা আলাদা সঙ্গীর সঙ্গে নাচ করতে হচ্ছে, সেটা সত্যিই ওদের ভালো লাগার কথা নয়। আমার তো এটা ভেবেই অবাক লাগছে যে আমার ছেলে কেন এই নিয়ম ভেঙে শুধু মারিয়ার সঙ্গে নাচের প্রস্তাব দেয় নি।”
“আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ। মিস্টার রাশওয়ার্থ কখনও কোনও কাজে ভুল হয় না। ও সেই প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মারিয়ার আবার ভদ্রতা বোধ টনটনে। আজকালকার দিনে এতো মার্জিত মেয়ে চট করে দেখা যায় না। মারিয়া বল নাচের আসরের সামাজিক প্রথা ভেঙে সবাই সবার সঙ্গে নাচ করার বদলে শুধু মিস্টার রাশওয়ার্থের সঙ্গে নাচ করার প্রস্তাবে রাজি হয় নি। দেখুন, দেখুন। ঠিক এই মুহূর্তে ওর মুখটা শুধু দেখুন একবার। এর আগে তো আরও দুজনের সঙ্গে নাচ করল, অথচ এখন কতো আলাদা দেখাচ্ছে। এখন ওর মুখে যেন এক অনন্য আলো ফুটে উঠেছে।”
মারিয়াকে সত্যিই ভারি খুশি দেখাচ্ছে। চোখদুটোতে খুশি ঝিলিক দিচ্ছে। কথা বলায় এক আশ্চর্য প্রাণবন্ত আনন্দ ছলকে পড়ছে। আর এসবই হচ্ছে এজন্য যে জুলিয়া আর তার নাচের সঙ্গী মিস্টার ক্রফোর্ড এখন ওর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সবাই মিলে হাসি গল্পে মত্ত। এর আগে মারিয়াকে কেমন দেখাচ্ছিল সেটা আর মনে পড়ছে না ফ্যানির। ও নিজেই তো তখন এডমন্ডের সঙ্গে নাচ করছিল আর তখন মারিয়ার কথা ওর মনেই ছিল না।
মিসেস নরিস বলে চললেন, “আহা, মারিয়া আর মিস্টার রাশওয়ার্থকে দেখলেও চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। ওদের দেখলেই মনে হয় যেন একেবারে রাজযোটক। আমি তো শুধু ভাবছি স্যর থমাস কতো খুশি হবেন। মিসেস রাশওয়ার্থ, আরেকটা জুটি তৈরি হওয়ার কতটা সম্ভাবনা আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে? মিস্টার রাশওয়ার্থ একটা আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। এরকম উদাহরণ থাকলে আরও এরকম জুটি তৈরি হওয়াই তো স্বাভাবিক বলে মনে হয়।”
এদিকে মিসেস রাশওয়ার্থের চোখ তো শুধু নিজের ছেলের দিকেই। তাই মিসেস নরিসের এই প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে কিছু বলতে পারলেন না। মিসেস নরিস তখন জুলিয়া আর মিস্টার ক্রফোর্ডের দিকে চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে জানতে চাইলেন, “ওই যে ওদের দেখছেন, ওদের দেখে আপনার মনে হচ্ছে না যে আরেকটা জুটি তৈরি হতে চলেছে?”
এবার মিসেস রাশওয়ার্থ বললেন, “ও আচ্ছা, আপনি আমাদের জুলিয়া আর মিস্টার ক্রফোর্ডের কথা বলছেন! হ্যাঁ, সত্যিই ওদের ভারি সুন্দর মানায়। তা মিস্টার ক্রফোর্ডের সম্পত্তি-টম্পত্তি কেমন?”
“তা বছরে প্রায় হাজার চারেক পাউন্ড।”
“বাঃ, বাঃ, তাহলে তো বেশ অনেকটাই। সে যার যতোটা আছে, তাকে তো তাতেই খুশি থাকতে হবে, সেটাও তো ঠিক। বছরে চার হাজার পাউন্ড নেহাত কম কিছু নয়। আর ওকে তো বেশ ধীর স্থির আর ভদ্র বলেই মনে হয়। আমার মনে হয় জুলিয়া বেশ আনন্দেই থাকবে।”
“না, মানে, এখনও কিছুই ঠিক হয় নি। শুধু আমরা নিজেদের মধ্যে এটা আলোচনা করি যে এটা হলে খুব ভালো হয়। তবে মিস্টার ক্রফোর্ডের জুলিয়ার প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখে ব্যক্তিগত ভাবে আমার আর কোনও সন্দেহ নেই। আমি নিশ্চিত যে ওদের জুটিটা তৈরি হবেই।”
এরপর ওঁদের মধ্যে আর কী কথাবার্তা হলো, সেসব শোনার সুযোগ হলো না ফ্যানির। টম ঘরে এসে ঢুকল। টম যদি ওকে নাচ করার জন্য ডাকে তাহলে ফ্যানির জন্য সেটা বেশ সম্মানের ব্যাপার হবে। ও মিসেস নরিস আর মিসেস রাশওয়ার্থ আলাপ আলোচনা শুনতে শুনতে এতক্ষণ যে এতো কিছু ভাবছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেল। ওর মনে হলো টম নিশ্চয় ওকে নাচ করার জন্য ডাকতেই এসেছে। তবে টম ওদের দিকে এগিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু ফ্যানিকে নাচের জন্য না ডেকে একটা চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে পড়ল। একটা ঘোড়ার শরীর খারাপ। ঘোড়াটা যে দেখাশোনা করে এতক্ষণ তার সঙ্গেই কথা বলছিল টম। এখন ফ্যানিকে সেসব কথাই বলতে লাগল। ঘোড়াটা কেমন আছে এইসব। ফ্যানি বুঝতে পারল এবারেও ওর আর নাচ করা হলো না। নিজের মিইয়ে থাকা স্বভাব মতন ও এবার নিজেকেই দোষ দিল অকারণে অতিরিক্ত আশা করার জন্য। ঘোড়ার ব্যাপারে কথা বলার সময় টম টেবিল থেকে একটা খবরের কাগজ উঠিয়ে নিয়েছে। সেটা দেখতে দেখতে যেন জিজ্ঞাসা করতে হয় বলে খুব দায়সারা গলায় বলল, “ফ্যানি, তুমি নাচ করতে চাইলে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যেতে পারি নাচ করতে।” যতোটা ভদ্রভাবে টম প্রশ্নটা করল, ফ্যানি তার থেকেও বেশি ভদ্রতার সঙ্গে জবাব দিলো যে ওর এখন নাচ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। খবরের কাগজটা আবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চনমনে গলায় টম বলে উঠল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। ক্লান্তিতে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমি তো শুধু এটা ভেবেই অবাক হয়ে যাই যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এতক্ষণ ধরে এসব কী করে চালিয়ে যেতে পারে! এসব অর্থহীন পাগলামিতে আনন্দ পাওয়ার জন্য সবাইকে প্রেমে পড়তে হবে, তবেই যদি একমাত্র সম্ভব হয়। আমার তো মনে হচ্ছে এরাও সব্বাই প্রেমে পড়েছে। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো! একমাত্র ইয়েটস আর মিসেস গ্রান্টকে বাদ দিলে বাকিদের দেখলেই মনে হচ্ছে সব জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক প্রেমিকা। আর তোমাকে চুপিচুপি একটা কথা বলি, আমার তো মনে হয় আর সবার মতন মিসেস গ্রান্টও নিশ্চয়ই একজন প্রেমিক পেতে চান। বেচারা মিসেস গ্রান্ট। ওই ডাক্তারের সঙ্গে নির্ঘাত ভীষণ আলুনি এক জীবন কাটে তাঁর।” বদমাইশি ভরা মুখে মিস্টার গ্রান্টের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতেই ওর খেয়াল হলো যে মিস্টার গ্রান্ট আসলে ওর একদম কাছেই বসে আছেন। আর তাই দেখে টম সঙ্গে সঙ্গে এমন করে ওর মুখের ভাবভঙ্গি বদল করে একদম অন্য এক বিষয়ে ডক্টর গ্রান্টের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল যে ফ্যানি এত সব কিছুর মধ্যেও না হেসে পারল না। “আমেরিকার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, তাই না, ডক্টর গ্রান্ট? আপনার কী মত? এরকম বিষয়ে আমি সব সময় আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই এটা বোঝার জন্য যে আমার এই বিষয়ে কী ভাবা উচিৎ।”
একটু পরেই মিসেস নরিস জোরে হাঁক দিয়ে বললেন, “বাবা টম, তুমি যখন নাচ করছই না, তাহলে আমাদের সঙ্গে এই তাসের খেলাটা খেলতে এস না। আসবে?” কথাটা বলতে বলতেই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে টমের দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর নিচু গলায় ফিসফিস করে বললেন, “আমরা সবাই মিলে তাস খেললে মিসেস রাশওয়ার্থের খুব ভালো লাগবে বলে মনে হয়। তোমার মাও সেটাই চাইছেন, কিন্তু ওই সেলাই ফোঁড়াই নিয়ে এতো ব্যস্ত যে নিজে যে আমাদের সঙ্গে বসে একদান খেলবেন, সে সময় পাচ্ছেন না। তুমি যদি খেলতে রাজি হও তাহলে তুমি, আমি আর ডক্টর গ্রান্ট মিলে মিসেস রাশওয়ার্থের সঙ্গে খেলা যায়। এমনিতে আমরা অর্ধ ক্রাউন (১/৮ পাউন্ড) বাজি রেখে খেলি, তবে তুমি চাইলে বেশিও বাজি রাখতে পারো।”
“আরে বাঃ, এতো খুব ভালো ব্যাপার। খেলতে পারলে আমি সত্যিই খুব খুশি হতাম। ভীষণ ভালো লাগত। কিন্তু এখন তো আমি খেলতে পারব না, আমি এখন নাচ করতে যাচ্ছি। চলো, চলো ফ্যানি, আমরা যাই। আর দেরি করলে নাচ শেষ হয়ে যাবে।” চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে জোরে জোরে কথা গুলো বলতে বলতে ফ্যানির হাত ধরে হাঁটা লাগালো টম।
ফ্যানিও বেশ আগ্রহের সঙ্গেই নাচের আসরের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু আবার নাচের সুযোগ পাওয়ার জন্য টমের প্রতি যতোটা কৃতজ্ঞতা বোধ করার কথা ঠিক ততোটা যেন কিছুতেই অনুভব করতে পারল না। ওর মাসতুতো দাদা যতই অন্য কারোর স্বার্থপরতা নিয়ে মজা করুক না কেন, সে নিজেও যে আলাদা নয়, সেটা ফ্যানি বুঝতে পারল।
যেতে যেতে রাগে গজগজ করতে করতে টম বলে চলল, “আহা! কী সুন্দর অনুরোধ! নিজে সারাক্ষণ ডক্টর গ্রান্টের সঙ্গে ঝগড়া করে মরছেন, আর ওই বুড়ি, যে কিনা বীজগণিত সম্পর্কে যতোটা জানেন, তাসের খেলা সম্পর্কেও ততোটা জানেন, তাদের সঙ্গে কী না এখন আমাকে দুই ঘণ্টা ধরে তাসের টেবিলে বসে থাকতে হবে। উফ, আমাদের এই মহান মাসি সবসময় এত ব্যস্ত! আমার তো খুব ইচ্ছে করে যদি তিনি একটু কম কাজ করতেন! আবার জিজ্ঞাসা করার ধরণ দেখো! কোনও আড়াল না রেখে আমাকে এমন করে ওদের সবার সামনে জিজ্ঞাসা করছে যে আমি যে খেলতে চাই না সেকথা যেন বলতে না পারি। এটাই আমার সবথেকে বিরক্তিকর লাগে। এই যে এমন ভান করা যেন আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের সত্যিই দাম আছে, আমাকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে, অথচ একইসঙ্গে আমাকে এমন করে বলা হচ্ছে যে আমি যেন কাজটা করতে বাধ্য হই, এতেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। কপাল গুণে তোমার সঙ্গে নাচ করার কথাটা মাথায় এলো, না হলে এই ফাঁদ কেটে বেরোনোর কোনও উপায় ছিল না। অসহ্য একেবারে। তবে আমার মাসির মাথায় একবার পোকা নড়লে তাকে থামায়, কার সাধ্যি!”