
জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - একাদশ পর্ব
- 07 October, 2025
- লেখক: সুস্মিতা সরকার
১১
এর কদিন পরেই স্যর থমাসের চিঠি আন্তিগুয়া থেকে ম্যান্সফিল্ডে এসে পৌঁছল। তবে সেই চিঠি পেয়ে দুই বার্ট্রাম বোনের কেউই খুশি হলো না। বাবার চিঠির তুলনায় নানান ঝুটঝামেলাপূর্ণ সথার্টনে কাটানো দিনটাই বরং অনেক বেশি ভালো লেগেছে ওদের। বাবার কথা ভাবার থেকেও, হেনরি ক্রফোর্ডের কথা ভাবতে ওদের বেশি ভালো লাগছে। কিন্তু চিঠিতে যেমন লেখা আছে, সেই হিসেবে আর মাত্র কিছুদিন পরেই বাবা আবার ইংল্যান্ডে এসে উপস্থিত হবেন। আর এই ব্যাপারটা ওদের একদমই ভালো লাগছে না।
স্যর থমাস তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর দুশ্চিন্তা সামলে যতোটা সম্ভব নিশ্চয়তার সঙ্গে চিঠিতে লিখলেন যে নভেম্বর মাসে তিনি ফিরছেন। আন্তিগুয়ায় তিনি তাঁর ব্যবসা প্রায় গুটিয়ে এনেছেন। তাই সেপ্টেম্বরের জাহাজেই ফেরার কথা ভাবছেন। সেই মতন আর মাস দুয়েক পর নভেম্বরে তিনি তাঁর ভালোবাসার পরিবারে ফিরে আসার আশায় দিন গুনছেন।
এই খবরে জুলিয়ার থেকেও বেশি করুণ অবস্থা হলো মারিয়ার। কারণ বাবা ফেরা মানেই তো বিয়ে। যেহেতু বাবা ওর সবথেকে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী, তাই তিনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মারিয়াকে তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে খুশি দেখতে চাইবেন। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনার কথা ভাবতেও যেন মনটা বিকল হয়ে যাচ্ছে মারিয়ার। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ও এসব কথা ভাবাই ছেড়ে দিল। ভাবটা এমন, যেন না ভাবলেই সমস্যাটার সমাধান এমনি এমনিই হয়ে যাবে। এছাড়াও ওঁর মনে হলো, যেহেতু বিভিন্ন কারণে সাধারণত দেরি হয়েই থাকে, তাই নভেম্বরের শুরুর দিকে বাবার ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। মারিয়া সবকিছু দেখেও দেখতে চায় না, বুঝেও বুঝতে চায় না। তাই বাবার ফেরার দেরি হওয়ার সম্ভাবনা ওর কাছে এক বিরাট স্বস্তির ব্যাপার হয়ে ওঠে। হয়তো নভেম্বরের মাঝামাঝি হবে তাঁর ফিরতে ফিরতে। সেক্ষেত্রে এখনও তিন মাস সময় আছে হাতে। তিন মাস মানে তেরো সপ্তাহ। আর এই তেরো সপ্তাহে তো কতো কিছুই ঘটে যেতে পারে, তাই না!
বাবার বাড়ি ফেরার বিষয়ে মেয়েরা কী ভাবছে তার অর্ধেকও যদি স্যার থমাস আন্দাজ করতে পারতেন, তাহলে এতোটাই দুঃখ পেতেন যে তাঁর ফেরার খবরে যে আরেক তরুণী ভিতরে ভিতরে দারুণ আগ্রহ বোধ করছে এই খবরেও তিনি খুব একটা সান্ত্বনা পেতেন না। মিস ক্রফোর্ড সেদিন সন্ধ্যায় দাদার সঙ্গে ম্যান্সফিল্ড পার্কে সময় কাটাতে এসে মিস্টার থমাসের ফেরার সুখবরটা পেল। খবরটা শুনে সে যে খুশি হয়েছে সেটা জানানো ছাড়া স্বাভাবিক ভদ্রতার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখাল না ও। তবে মিস্টার থমাসের ফেরার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী নয় এমন ভান করলেও এই বিষয়ে সব খবরই ও বেশ মন দিয়ে শুনল। চিঠিটায় কী কী লেখা আছে, সেসব বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললেন মিসেস নরিস। তারপর একসময় এই প্রসঙ্গ শেষ হলো।
চা খাওয়া শেষ হলো। এডমন্ড আর ফ্যানির সঙ্গে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে মিস ক্রফোর্ড। মারিয়া, জুলিয়া, মিস্টার রাশওয়ার্থ আর হেনরি পিয়ানো বাজানো নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় আচমকা আবার এই প্রসঙ্গ তুলল মিস ক্রফোর্ড। জানলার দিক থেকে ঘুরে দলের বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “মিস্টার রাশওয়ার্থকে কত খুশি খুশি দেখাচ্ছে। মনে মনে উনি নিশ্চয়ই নভেম্বর মাসের কথা ভাবছেন।”
এডমন্ডও মিস্টার রাশওয়ার্থের দিকে ঘুরে তাকাল, তবে কিছু বলল না।
“তোমার বাবার দেশে ফেরাটা বেশ ঘটনাবহুল হবে বলে মনে হচ্ছে।”
“তা তো বটেই। এতটা লম্বা অনুপস্থিতি। আর শুধু যে লম্বা অনুপস্থিতি, তা তো নয়, অনেক বিপদও হতে পারত।”
“উনি ফিরলে তোমার বোনের বিয়ে, ধর্ম যাজক হিসেবে তোমার দায়িত্ব নেওয়া, এরকম গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কিছুই ঘটবে।”
“হ্যাঁ, তা ঘটবে।”
“কিছু মনে কোরো না, কিন্তু সব মিলিয়ে তোমার বাবার ফেরাটা আমার কেমন যেন পৌরাণিক বীরের ঘরে ফেরার কাহিনী বলে মনে হচ্ছে। এমন এক বীর যিনি বিদেশে দারুণ বীরত্বের কাজ সেরে দেশে ফিরে ঈশ্বরের কাছে কিছু একটা বলি দেবেন।” একটু হেসে মিস ক্রফোর্ড বলল।
“কিন্তু এক্ষেত্রে বলি দেওয়ার কোনও প্রশ্ন তো নেই! মারিয়া সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করছে।” পিয়ানোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে একটু গম্ভীর মুখে হেসে বলল এডমন্ড।
“আরে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি এমনিই একটু মজা করছি। সাধারণত যে কোনও তরুণী যা যা করতে পারে, মারিয়া তার থেকে বেশি কিছু তো আর করছে না। ও যে খুব সুখি হবে, তাতে আমার কোনও সন্দেহই নেই। আমি যে অন্য বলি দেওয়ার কথা বলছি, তুমি নিশ্চয়ই সেটা ধরতে পারো নি।”
“আমার ধর্ম যাজক হওয়ার ব্যাপারটা তো? শোনো, আমি তোমাকে একদম মন থেকে বলছি যে মারিয়া যতোটা নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করছে, আমিও ঠিক ততোটাই নিজের ইচ্ছেয় ধর্ম যাজক হতে চলেছি।”
“আরে বাঃ, এটা তো দারুণ ব্যাপার যে তোমার নিজের যেটা ইচ্ছে সেটাই আবার তোমার বাবার ইচ্ছে। শুনলাম, তোমার জন্য বেশ ভালো একটা কাজের ব্যবস্থা করা আছে।”
“আর তোমার মনে হচ্ছে সেজন্যই আমি ধর্ম যাজক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই তো?”
একথায় ফ্যানি বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল, “আমার কিন্তু মনে হয় না সেটা সত্যি।”
“তুমি যে আমার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উপর এতটা ভরসা করো, সেটা জেনে খুব ভালো লাগছে ফ্যানি। কিন্তু কী বলতো, আমি নিজেও কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত নই যে আমি যে ওই কাজের কথাটা জানি সেটা আমাকে যাজক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে কী না। বরং আমার তো সন্দেহ হয় যে ওই কাজটা আছে এই তথ্যটা আমাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে। তবে তাতে তো কোনও অসুবিধা দেখছি না আমি। সত্যি কথা বলতে কী, শুধু যে আমি অসুবিধা দেখছি না তা নয়, বাস্তবিকই তাতে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। এমন তো নয় যে আমার ইচ্ছে ছিল না। আর জীবনের শুরুতে যথেষ্ট স্বচ্ছলতা থাকবে না এটা জানার জন্য কেউ খারাপ ধর্ম যাজক হবে, সেটাও আমার মনে হয় না। আমাকে আমার বাবা সব সময় বেশ সামলে রেখেছেন। আমি কোনও ভুল পথে যাই নি, আর আমার মনে হয় না যে সেরকম কিছু করলে আমার নীতিবোধ সম্পন্ন বাবা সেটা মেনে নিতেন। কোনও সন্দেহ নেই যে আমি প্রভাবিত হয়েছি, তবে এরকম প্রভাবিত হওয়ায় কোনও দোষ নেই।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফ্যানি বলল, “ব্যাপারটা কিছুটা এরকম যে যেমন একজন অ্যাডমিরালের ছেলে যখন নৌবাহিনীতে যোগ দেয়, বা কোনো জেনারেলের ছেলে যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, তখন কেউ তাতে কোনও অসুবিধা দেখতে পায় না। কেউ ভাবে না যে ওদের পরিবারের সুবিধা হবে এমন কোনও কাজের ক্ষেত্রে ওদের যোগ দেওয়াটা ঠিক হবে কী না, বা কেউই ভাবে না যে ওরা হয়তো নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজে যোগ দিচ্ছে।”
“না, মিস প্রাইস, সত্যিই ব্যাপারটায় কেউ কোনও অসুবিধা বা দোষ খুঁজে পায় না। আর এই দোষ খুঁজে না পাওয়ার পিছনে অবশ্যই জোরালো কারণ আছে। নৌবাহিনীই বলো, বা সেনাবাহিনী, দুটো বাহিনীর কাজই নিজের যোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ। এই পেশার সঙ্গে জড়িত বীরত্বের ধারণা, বিপদের হাতছানি, ব্যস্ততা, কাজ করার ধরণ, সব কিছুই এই দুই পেশাকে মহিমান্বিত করে। সমাজে সেনা আর নাবিকের স্থান অনেক উঁচুতে। কারোর এটা ভাবার মতন বা প্রশ্ন করার মতন সাহস হয় না যে একজন কেন সেনা বা নাবিকের পেশাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।”
“কিন্তু তোমার মনে হয় যে কেউ যদি আগে থেকেই জানে যে তার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করাই আছে, তাহলে সেক্ষেত্রে তার যাজক হওয়ার সিদ্ধান্তে একটু সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক, তাই তো? তোমার মতে, সত্যিই যদি কারোর যাজক হওয়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে তো তার কোনও কাজের সম্ভাবনা ছাড়াই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ - সেক্ষেত্রে কোনও প্রশ্ন উঠবে না, তাই তো?” এডমন্ড জানতে চাইল।
“সে কী! কোনও কাজের সন্ধান না থাকতেও যাজক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া! সে তো একেবারে পাগলামি! চূড়ান্ত পাগলামি!”
“কাজের নিশ্চয়তা রয়েছে বা কাজের নিশ্চয়তা নেই উভয় ক্ষেত্রেই যদি কেউ যাজক না হতে পারে তাহলে এবার তুমিই বলো, চার্চে যাজকের পদে কাউকে কী করে পাওয়া যাবে? আমি জানি, এর উত্তর তোমার কাছে নেই। তবে তুমি এতক্ষণ যা যা যুক্তি দিয়েছ, তার ভিত্তিতেই আমি যাজকদের হয়ে কিছু কথা বলব। সৈনিক বা নাবিকের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব প্রলোভন ও পুরস্কারকে তুমি এতো গুরুত্ব দিচ্ছ, যেমন, বীরত্ব, খ্যাতি বা আড়ম্বর, তার কিছুই তো যাজকের কাজে পাওয়া যায় না। তাই এসব পাওয়ার প্রলোভনও তো একজন যাজকের থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে কারোর যাজকের পেশা বেছে নেওয়ার ইচ্ছের আড়ালে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কী না, সেই সন্দেহও তো থাকার কথা নয়।”
“ও হ্যাঁ, তা তো বটেই! কষ্ট করে কাজ খুঁজতে হচ্ছে না, আগে থেকেই উপার্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত, সারা জীবন শুধু খাওয়া আর মোটা হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করতে হবে না, এসব জানার পর কেউ যাজক হতে চাইলে তার সেই ইচ্ছেতে যে আন্তরিকতার অভাব নেই, সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। মিস্টার বার্ট্রাম, শোনো, এটাকে বলে পরিষ্কার কুঁড়েমি। কুঁড়েমি আর নিছক আরামের লোভ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সমাজের হোমরাচোমরা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বা সকলের সঙ্গে মিলেজুলে থাকার ইচ্ছে, এসবের অভাবেই সাধারণত কেউ যাজক হতে চায়। ভারি স্বার্থপর আর অগোছালো হয় যাজকরা। খবরের কাগজ পড়া, আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকা, আর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করা ছাড়া আর কোন কাজটাই বা করে একজন যাজক? দরকারি সব কাজকর্ম তো সহকারীই করে, আর যাজকের কাজ শুধু খেয়েদেয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া।”
“তুমি ঠিকই বলেছ মিস ক্রফোর্ড। আমি মানছি এরকম যাজক অনেক আছে। তবে আমার মনে হয় এরকম যাজক এতো বেশিও নেই যে যাজক মানেই এরকম হবে, সেটা বলা যায়। আমার ধারণা তুমি যা বলছ, তা যে তুমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছ তা হয়তো নয়। তুমি মনে হয় অন্যের মুখে ঝাল খেয়েছ। যারা পক্ষপাতদুষ্ট মতামত দেয়, তুমি তাদের কথা শুনেই এসব বলছ। তোমার নিজের অভিজ্ঞতায় তো যাজকদের বিষয়ে এতো বেশি জানা সম্ভব না। এতোটা অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও তুমি মেলামেশা করবে সেরকম মানুষের সংখ্যা তো বেশি হওয়ার কথা নয়। আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার কাকুর খাওয়ার টেবিলে যে সব গালগল্প শুনেছ, সেসবের ভিত্তিতেই এসব কথা বলছ।”
“সবাই যাজকদের সম্পর্কে সাধারণত যা ভাবে, আমি সে কথাই বলছি। আর সাধারণ মতামত সাধারণত সত্যি হয়। এটা ঠিক যে আমি একজন যাজকের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছু দেখেছি তা নয়। কিন্তু অনেকেই তো দেখেছে। সেসব আমি শুনেছি। তাই এই ব্যাপারে যে আমি কিছুই জানি না, তা কিন্তু নয়।”
“দেখো, আলাদা আলাদা ধ্যানধারণা থাকা সত্ত্বেও যদি একদল শিক্ষিত মানুষকে একযোগে নিন্দামন্দ করা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি থাকতে বাধ্য।” একথা বলে একটু হেসে আবার বলল এডমন্ড, “আর যদি জানার কমতি না থাকে তাহলে হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে এরকম নিন্দা করার পিছনে। তোমার অ্যাডমিরাল কাকু বা তাঁর সহকর্মীরা যাজকদের সম্পর্কে নির্ঘাত বিশেষ কিছু জানতেন না। ভালো, মন্দ যাই হোক না কেন, ওঁরা যাজকদের এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করতেন হয়তো।”
“আমার ভাই উইলিয়াম কিন্তু অ্যান্টওয়ার্প জাহাজের যাজকের থেকে খুবই ভালো আচরণ আর যত্ন পেয়েছে”, এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ডের আলোচনায় বিশেষ প্রাসঙ্গিক না হলেও নিজের আবেগে একথা বলে উঠল ফ্যানি।
“শোনো, আমার কাকুর মতামতকে খুব বেশি গুরুত্ব আমি কখনই দিই নি। তবে তুমি যখন এই প্রসঙ্গ তুললেই, তখন বলি, আমার মনে হয় না যে আমি যাজকদের সামনাসামনি না দেখেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছি। আপাতত আমি আমার নিজের জামাইবাবু ডক্টর গ্রান্টের বাড়িতেই অতিথি হিসেবে আছি। এমনিতে তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, ভীষণই ভদ্রলোক, যথেষ্ট বিদ্বান আর প্রায়ই খুব ভালো ভালো ধর্মের বাণী শোনান। তিনি খুবই সম্মানীয় একজন মানুষ। কিন্তু আমার চোখে তিনি অলস, স্বার্থপর আর ভোজনবিলাসী একটা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি নিজের খাবারের থালার বাইরে আর কোনও কিছু নিয়েই বিন্দুমাত্র ভাবেন না। কারোর জন্য কুটোটি ভেঙে দুটো করেন না। এমন কী, দৈবাৎ রাঁধুনি যদি কোনও রান্না খারাপ করে ফেলে, তাহলে তিনি মোটেই তাঁর বউকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। সত্যি কথা বলতে কী, হেনরি আর আমি যে আজকে সন্ধ্যায় বেরিয়েছে, সেটা কিছুটা এরকম কারণেই। কচি হাঁসের মাংসের স্বাদ মনমত হয়নি। তাই তিনি বেজায় অখুশি। আমরা নাহয় বেরিয়ে এলাম, কিন্তু আমার দিদিকে তো এখন কথা শুনতেই হবে। তাঁর তো আর বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই।”
“সত্যি বলছি, আমি বুঝতে পারছি তোমার কতটা খারাপ লেগেছে। নিজের চাওয়াপাওয়া কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাগারাগি করলে সকলেই মেজাজ হারায়, আর সত্যিই এটা একটা বড় সমস্যা। ডক্টর গ্রান্টের এই খারাপ মেজাজ সহ্য করতে হচ্ছে তোমার দিদিকে, আর চুপচাপ সেটা তোমাকে দেখে যেতে হচ্ছে, এ বড় যন্ত্রণার। নাহ ফ্যানি, এটা দেখছি আমাদের বিরুদ্ধে গেল। এক্ষেত্রে ডক্টর গ্রান্টকে সমর্থন করার উপায় নেই একেবারেই।”
ফ্যানি বলে উঠল, “তা তো বটেই। কিন্তু ওঁর একার জন্য তো আর সব যাজকদের খারাপ বলা যায় না। কারণ, ডক্টর গ্রান্ট যাজক না হয়ে অন্য যে পেশাতেই থাকতেন, তাঁর মেজাজ একইরকম রুক্ষ থাকত। আর আমি তো বলব, যাজক হিসেবে আজকে তাঁর অধীনে যতো লোক কাজ করে, তিনি যদি নৌবাহিনী বা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেন, তাহলে তাঁর অধীনে আরও অনেক বেশি লোক থাকত। তাই আজ যাজক হিসেবে কাজ করার জন্য যত লোক অখুশি ওঁর উপর, সৈন্য বা নাবিক হিসেবে কাজ করলে তার থেকে অনেক বেশি লোক ওঁর উপর রেগে থাকত। আর তাছাড়া, যে যতই আশা করুক যে ডক্টর গ্রান্টের স্বভাবটা একটু কম রুক্ষ হলে ভালো হতো, কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়। আমার মনে হয় উনি যদি আরও ব্যস্ত বা কেজো কোনও পেশায় থাকতেন, তাহলে তাঁর সময় আর অন্য কারোর প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা দুটোই আরও কম থাকত। এখন অন্তত তিনি নিজেকে কিছুটা হলেও জানার সময় পান, বারেবারে তাঁকে ভাবতে হয় যে যাজক হিসেবে তিনি নিজের স্বভাব সংযত রাখতে দায়বদ্ধ। এটা কিন্তু অন্য যেকোনো পেশায় পাওয়া অসম্ভব। তাই কে বলতে পারে, যাজক না হয়ে অন্য কোনও পেশায় থাকলে তিনি আরও বেশি রুক্ষ স্বভাবের হয়ে উঠতেন কী না! কেউ, বিশেষ করে ডক্টর গ্রান্টের মতন একজন সচেতন মানুষ নিয়মিতভাবে প্রতি সপ্তাহে সবাইকে নিজের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়া, প্রতি রবিবার দুবার করে চার্চে গিয়ে এতো সুন্দর করে ভালো ভালো ধর্মোপদেশ দেওয়ার কাজ করে যেতে পারতেন না, যদি না তিনি নিজেও এই ব্যাপারে কিছুটা সচেতন হতেন। এই কাজগুলো করতে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেন। আমি নিশ্চিত যাজক হিসেবে কাজ করার বদলে অন্য কোনও পেশায় থাকলে সেটা তিনি করতেন না।”
“এটা ঠিক যে তুমি যেমন বললে সেটা যে সত্যি নয়, সেটা আমরা কেউই প্রমাণ করতে পারব না। তবে আমি কামনা করি তোমার ভাগ্যে যেন এর থেকে ভালো কিছু হয়। তোমাকে যেন এমন লোকের স্ত্রী না হতে হয়, যার ভদ্র ব্যবহার শুধুমাত্র ভালো ভালো ধর্মোপদেশ দেওয়ার কারণে টিকে থাকে। তিনি যেন এমন মানুষ না হন, যিনি প্রতি রবিবার ভালো ব্যবহার করবেন, আর সোমবার সকাল থেকে শুরু করে শনিবারের রাত পর্যন্ত কচি হাঁসের মাংসটা কেন যথেষ্ট ভালো রান্না হয় নি, সেই নিয়ে সমানে ঝগড়া করে যাবেন।”
“আমার তো মনে হয় যে লোক ফ্যানির সঙ্গে সমানে ঝগড়া করতে পারে, তার উপর কোনো ধর্মোপদেশই কাজ করবে না।” কথাটা খুব স্নেহের সঙ্গে বলল এডমন্ড।
কথাটা শুনেই ফ্যানি চট করে আরও বেশি করে জানলার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এদিকে মারিয়া আর জুলিয়া মিস ক্রফোর্ডকে সমানে ডেকে চলেছে ওদের সঙ্গে একসঙ্গে পিয়ানো বাজিয়ে গান করার জন্য। হালকা পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে সে মিষ্টি হেসে বলে গেল, “আমার মনে হচ্ছে মিস প্রাইস যতোটা প্রশংসার যোগ্য, ততোটা প্রশংসা শুনতে বোধহয় অভ্যস্ত নয়।” মিস ক্রফোর্ডের চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল এডমন্ড। মিস ক্রফোর্ডের সৌজন্যবোধ থেকে শুরু করে তার হালকা পায়ে সুন্দর ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া, সব কিছুই ওকে মুগ্ধ করে তুলছে।
“একেই বলে সত্যিকারের সৌজন্যবোধ। এ এমন এক স্বভাব, যেটা কাউকে কখনও কষ্ট দেয় না। আর হাঁটার ভঙ্গিটাও কী মনোরম। কত সহজে কী সুন্দর সবার সঙ্গে মিশতে পারে! যেই না একবার ডাকল, অমনি ওদের সবার সঙ্গে গাইতে চলে গেল।” খুশি খুশি গলায় বলে উঠল এডমন্ড। তারপর আবার একটু ভেবে আফসোসের গলায় বলল, “বেচারি! আর ওকেই কী না এত ভুলভাল লোকের সঙ্গে এত কষ্টে থাকতে হয়!”
এই ব্যাপারে ফ্যানি এডমন্ডের সঙ্গে একমত। তবে, মিস ক্রফোর্ডের সঙ্গে এডমন্ডও যে গানের দলে যোগ দিতে চলে গেল না বরং ফ্যানির সঙ্গে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে রইল, তাতে ফ্যানির মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠল। যেরকম ফ্যানি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেরকমই এডমন্ডের দৃষ্টিও যে বাইরের দৃশ্যের দিকে ফিরল, তা দেখেও ফ্যানির খুব আনন্দ হচ্ছে। বাইরের সবকিছুই শান্ত, সুন্দর আর মোহময়। মেঘহীন রাত আর চারপাশের গভীর অরণ্যের ছায়ার আলোআঁধারি যেন সেই সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। মুগ্ধ ফ্যানি আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, “এটাই তো প্রকৃত সুর, প্রকৃত শান্তি! হয়তো পৃথিবীর সমস্ত ছবি বা সঙ্গীতের থেকেও বড় এই সৌন্দর্য। কবিতায় এই সুর আর শান্তিকে বর্ণনা করার চেষ্টাই করা যায় শুধুমাত্র, করা যায় না। এই সৌন্দর্যই হয়তো মানুষকে জীবনের সব দুর্দশা ভুলিয়ে এক অসীম আনন্দের সন্ধান দিতে পারে। এরকম রাতের সৌন্দর্যের দিকে তাকালে আমার মনে হয় যেন দুনিয়ায় কোথাও কোনও দুঃখ নেই, কোনও কষ্ট নেই। আমার মনে হয় যদি প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়, তাহলে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট কমে যায়। এমন দৃশ্য দেখলে মানুষ নিজের দুঃখ, দুর্দশার কথা ভুলে এক অনন্য আবেগে ভেসে যায়।”
“কী সুন্দর করে বললে ফ্যানি। এতো সুন্দর এক রাত দেখে যারা কিছুটা হলেও তোমার মতন না ভাবতে পারে, তারা বড়ই দুর্ভাগা। আর যারা ছোট থেকেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে শেখেনি, তারা সত্যিই অনেক কিছু হারিয়েছে।”
“প্রকৃতিকে এভাবে দেখতে, অনুভব করতে তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছ দাদা।”
“আমার ছাত্রীও যে ভীষণ ভালো, সেটাও তো মানতে হবে! ওই দেখো, আর্কটুরাস তারাটাকে কত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।”
“হ্যাঁ। আর ওদিকে ভল্লুক নক্ষত্রমণ্ডল। কাশিওপিয়াও যদি দেখা যেত!”
“সেটা দেখতে হলে আমাদের বাইরে বাগানে যেতে হবে। বাইরে জোলো হাওয়া দিচ্ছে, এই হাওয়ায় বাইরে যেতে তোমার ভয় লাগবে নাকি?”
“একটুও না। অনেক দিন হয়ে গেল আমরা একসঙ্গে তারা দেখি নি।”
“হ্যাঁ, কী করে যে সেটা বন্ধ হলো জানি না।” এমন সময় সবাই মিলে গান গাওয়া শুরু করল। জানলার দিক থেকে ঘুরে এডমন্ড বলল, “গানটা শেষ হওয়া না হওয়া পর্যন্ত আমরা বরং ঘরেই থাকি ফ্যানি।” মুখে একথা বললেও গান যত এগোল, ফ্যানির এটা দেখে মন ভেঙে গেল যে এডমন্ডও ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গানটা যখন শেষ হলো, তখন দেখা গেল ও গায়কদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ওদের কাছে গিয়ে এডমন্ড এত আন্তরিকতার সঙ্গে আবার গান গাওয়ার অনুরোধ জানালো যে সবাই আবার গান গাইতে শুরু করল।
ফ্যানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর যতক্ষণ পর্যন্ত না মিসেস নরিস এসে ঠাণ্ডা লেগে যাবে বলে বকাবকি করে ওকে সরিয়ে দিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ও একা একাই মন খারাপ নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকল।