জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - তৃতীয় পর্ব

প্রথম পর্বের লিংক

দ্বিতীয় পর্বের লিংক

(৩)

এরপর যখন ফ্যানির বয়স বছর পনেরো প্রায়, তখন একটা বড় ঘটনা ঘটল। মিস্টার নরিস মারা গেলেন। এই ঘটনায় পুরো পরিবারেই বেশ কিছু বদল হলো, অনেক কিছু নতুন যোগ হলো। নরিস দম্পতি চার্চের যে বাড়িটায় থাকতেন, সেই বাড়ি ছেড়ে মিসেস নরিস প্রথমে ম্যান্সফিল্ড পার্কের বাড়িতে এসে উঠলেন। তারপর কিছুদিন পর গ্রামে স্যর থমাসের একটা ছোট্ট বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। স্বামীকে ছাড়াও তিনি দিব্যি ভালো থাকতে পারবেন এই ভেবে তিনি স্বামীকে হারানোর শোক ভোলার চেষ্টা করলেন। আর সেই সঙ্গে স্বামীর অবর্তমানে আয় নিতান্তই কমে যাওয়ায় তাঁর কম খরচ করার করার অভ্যাসটা আরও জাঁকিয়ে বসল।

মিস্টার নরিস যে কাজটা করতেন, সেই পারিবারিক পাদ্রির কাজটা পরবর্তীতে এডমন্ড করবে সেটাই ঠিক করা ছিল। মিস্টার নরিস যদি আর কয়েক বছর আগে মারা যেতেন তাহলে এডমন্ড বড় হয়ে সেই দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত পারিবারিক বন্ধুস্থানীয় কাউকে এই দায়িত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু এই ঘটনার আগে টম এত বেশি বেহিসেবি খরচা করে ফেলেছে যে পারিবারিক প্রথা ভঙ্গ করে ওই পারিবারিক পাদ্রির পদের জন্য এডমন্ডের বদলে অন্য একজনকে বিবেচনা করতে বাধ্য হলেন স্যর থমাস। ছোট ভাই হিসেবে এডমন্ডকে এখন বড় ভাইয়ের আনন্দ ফুর্তির খরচ মেটাতে সাহায্য করতে হবে। তবে এই পারিবারিক পাদ্রির কাজ ছাড়া আরেকটি পারিবারিক কাজও এডমন্ডের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা ছিল। তাই পরিস্থিতির চাপে মিস্টার নরিসের মৃত্যুর পর সেই পারিবারিক পাদ্রির পদের জন্য যখন অন্য কাউকে বেছে নিতে বাধ্য হলেন তখন স্যর থমাস এডমন্ডের ন্যায্য প্রাপ্য ছিনিয়ে নেওয়ার কাজটাকে অন্যায় ছাড়া আর কিছু না ভাবলেও ভিতরে ভিতরে যেন কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এতদিন তিনি টমের স্বভাব শুধরানোর জন্য যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন সে সবের থেকে বেশি কাজ দেবে ভেবে তিনি এডমন্ডকে বঞ্চিত করার কাজটা যে কত বড় অন্যায় হলো, সেটা তাঁর বড় ছেলেকে বোঝাতে কসুর করলেন না।

তিনি ভীষণ সংযত ও শালীন গলায় বললেন, “তোমার জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে টম। আর এজন্য আমাকে যেটা করতে হলো সেটার জন্যও আমার খুবই লজ্জা লাগছে। ভাই হিসেবে হয়তো তোমারও এই ব্যাপারে খারাপ লাগছে। তোমার জন্য এডমন্ড ওর প্রাপ্য রোজগারের অর্ধেক হারালো। দশ বছর, কুড়ি বছর, তিরিশ বছর এমন কী হতে পারে সারা জীবনের জন্যই। ভবিষ্যতে হয়তো আমি ওর জন্য ভালো কিছুর ব্যাবস্থা করতে পারব। কিম্বা আমার জায়গায় তুমিও সেটা করতে পারবে হয়তো। অন্তত আমি সেই আশা রাখি। এটা ভুললে কিন্তু চলবে না যে এডমন্ড সেরকম কোনও ব্যাবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানালে সেটা অস্বাভাবিক দাবি হবে না। কিন্তু, আজ তোমার ঋণের দায়ে যে সুযোগ ওকে হাতছাড়া করতে হচ্ছে কোনকিছু দিয়েই সেটা পূরণ হওয়ার নয়।“

কিছুটা দুঃখ আর কিছুটা লজ্জা নিয়ে টম কথাগুলো শুনল। তবে বেশিক্ষণ নয়, খুব তাড়াতাড়িই সেসব ঝেড়ে ফেলে সে আবার স্বার্থপরের মতন নিজের স্বমহিমায় ফিরে গেল। প্রথমত, ওর বন্ধুরা যত ধারদেনা করেছে ও সেই তুলনায় অর্ধেক ধার করেছে। দ্বিতীয়ত, বাবা এই নিয়ে একটু বেশিই ঝামেলা করছেন। আর তৃতীয়ত, যিনি পাদ্রি হিসেবে কাজে যোগদান করতে চলেছেন তিনি সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবেন।

মিস্টার নরিস মারা যাওয়ার পর ম্যান্সফিল্ডের পারিবারিক পাদ্রির কাজে বহাল হলেন ডক্টর গ্রান্ট। কাজে যোগ দিয়ে তিনি ম্যান্সফিল্ডে থাকা শুরু করলেন। বছর পঁয়তাল্লিশের ডক্টর গ্রান্টের শরীর স্বাস্থ্য যে বেশ ভালোই তা দেখে টম একটু হতাশই হলো। তবুও তার মনে হলো ডক্টর গ্রান্ট লোকটার ঘাড় যেরকম ছোট, যেরকম খাওয়াদাওয়া করেন তাতে তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না, তাড়াতাড়িই মারা যাবেন হয়তো।

ডক্টর গ্রান্টের স্ত্রী তাঁর থেকে বছর পনেরোর ছোট আর তাঁদের কোনও সন্তানাদি নেই। তাঁরা যখন এখানে থাকতে শুরু করলেন তখন তাঁরা যে বেশ সম্মানীয় আর ভালোমানুষ, সেই পরিচিতি সঙ্গে নিয়েই এলেন।

পরিস্থিতি যখন এরকম, তখন  স্যর থমাস ভাবলেন মিসেস নরিস এবার হয়তো তাঁর বোনঝির দায়িত্ব নিতে চাইবেন। মিসেস নরিসের বর্তমান অবস্থা, ফ্যানির একটু বড় হয়ে ওঠা এই দুই ঘটনা মিলিয়ে পরিস্থিতি সেরকমই মনে হলো তাঁর। ফ্যানিকে নিয়ে থাকার ব্যাপারে মিসেস নরিসের আগে যে আপত্তি ছিল সেটা এখন আর নেই, বরং ওরা একসঙ্গে থাকলে ওদের ভালোই হবে। এছাড়াও সম্প্রতি তাঁর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ার সম্পত্তিতে বেশ কিছু ক্ষতি হয়েছে আবার তার উপর বড় ছেলের অপচয়, এই দুই মিলিয়ে স্যর থমাসের বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেজন্য তিনি চাইছিলেনই ফ্যানির বর্তমান ও ভবিষ্যতের দেখভালের খরচ থেকে মুক্তি পেতে। মিসেস নরিস যে এবার বোনঝির দায়িত্ব নেবেন সে ব্যাপারে তিনি এতোটাই নিশ্চিত ছিলেন যে এই সম্ভাবনার কথা স্ত্রীকেও বললেন। লেডি বার্ট্রাম এই ব্যাপারে এই প্রথম আবার একটু ভাবনাচিন্তা করলেন। একদিন ফ্যানিকে দেখে শান্তভাবে বললেন, “তাহলে ফ্যানি, এবার তো তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমার দিদির সঙ্গে থাকবে। কেমন লাগবে ব্যাপারটা তোমার?”

প্রশ্নটা শুনে ফ্যানি এমন হতবাক হয়ে গেল যে মাসির কথার পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না, “আপনাদের ছেড়ে যাব?”

“হ্যাঁ, সোনা। কিন্তু তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমি তো আমাদের সঙ্গে বছর পাঁচেক রইলে। আমার দিদি সবসময়ই চাইতেন মিস্টার নরিস মারা গেলে তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। তবে আমি কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি যে তুমি কিন্তু আগের মতোই আমার সেলাইয়ে হাত লাগাবে।“

খবরটা ফ্যানির কাছে যতোটা অপ্রত্যাশিত, ঠিক ততোটাই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। মিসেস নরিসের কাছ থেকে সে কখনই সেই আদর ভালোবাসা পায় নি যে সে তার বড় মাসিকে ভালোবাসবে।

আমতা আমতা করে ফ্যানি বলে উঠল, “আপনাদের ছেড়ে যেতে আমার খুব খারাপ লাগবে।“

“তা তো লাগবেই, আমি জানি। সেটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। যবে থেকে এই বাড়িতে এসেছ, তবে থেকে পৃথিবীর আর যারই কষ্ট হোক না কেন, তোমাকে একটুও কষ্ট পেতে হয় নি বলেই আমার মনে হয়।“

“আশা করি আমি অকৃতজ্ঞ নই মাসি।“ ফ্যানি খুব ভদ্রভাবে বলল কথাটা।

“না,না, সোনা, আমিও সেটাই মনে করি। তোমাকে আমার খুব লক্ষ্মী মেয়ে বলেই তো মনে হয়েছে সবসময়।“

“আমি কি আর কোনোদিনই এখানে থাকব না?”

“না, আর কোনোদিনই এখানে থাকবে না। তবে তুমি খুব ভালোই থাকবে। তুমি এখানে থাকো বা, দিদির কাছে, তোমার জন্য কিছুই সেরকম বদল হবে না।“

ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ঘর ছেড়ে গেল ফ্যানি। এই বাড়ি বদলের ব্যাপারটা এত ছোট ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না ওর। বড় মাসির সঙ্গে থাকতে ওর একটুও ভালো লাগবে না। এডমন্ডের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই ও ওর কষ্টের কথাটা এডমন্ডকে খুলে বলল।

“দাদা, আমার সঙ্গে যেটা হতে চলেছে সেটা আমার একটুও ভালো লাগছে না। তুমি আমাকে সবসময় বলো যেটা ভালো না লাগে সেটাকেও মানিয়ে নিতে, কিন্তু এটা আমি পারব না। আমাকে নাকি এবার থেকে নরিস মাসির সঙ্গে থাকতে হবে।“

“তাই নাকি!”

“হ্যাঁ, বার্ট্রাম মাসি এখুনি আমাকে সেটাই বললেন। সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমাকে ম্যান্সফিল্ড পার্ক থেকে চলে যেতে হবে। তারপর নরিস মাসি হোয়াইট হাউসে গিয়ে থাকতে শুরু করলে আমাকেও তাঁর সঙ্গে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে।“

“আচ্ছা। তবে ফ্যানি, এই পরিকল্পনাটা যদি তোমার এত অপছন্দ না হতো তাহলে কিন্তু আমার মতে পরিকল্পনাটা খুবই ভালো।“

“দাদা!”

“দেখো, এটা সব দিক থেকেই ভালো হবে। নরিস মাসি তোমার ভালোই চান। তিনি তোমাকে একজন বন্ধু আর সঙ্গী হিসেবে দেখবেন। টাকাপয়সার প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা সেটা যে কোনও অসুবিধা করছে না তাতে আমার খুবই ভালো লাগছে। তুমি ওঁর কাছে নিজের মতোই থাকবে। আশা করি এতে তোমার খুব একটা অসুবিধা হবে না ফ্যানি।“

“না, সত্যিই অসুবিধা হবে। আমার ভালো লাগছে না। আমি এই বাড়িটাই ভালোবাসি। এই বাড়িতে যা কিছু আছে, সেসবই আমার ভালো লাগে। ওখানে কোনকিছুই আমার ভালো লাগবে না। নরিস মাসির সঙ্গে থাকতে আমার কতটা অস্বস্তি লাগে তুমি তো জানো।“

“তুমি যখন ছোট ছিলে তখন নরিস মাসি তোমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করতেন সেই ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদের সবার সঙ্গেই তিনি কম বেশি ওরকমই ব্যবহার করতেন। ছোটদের সঙ্গে কীকরে মিষ্টি ব্যবহার করতে হয়, তিনি সেটাই জানেন না। কিন্তু তুমি এখন বড় হয়েছ। এখন তাঁর ব্যবহার ভালোই হবে। আমার তো মনে হয় তিনি এখনই বেশ ভালো ব্যবহার করেন। এরপর যখন তুমিই তাঁর একমাত্র সঙ্গী হবে, তখন দেখো তাঁর কাছে তোমার গুরুত্ব অনেক বেশি হবে।“

“আমি কোনদিনই কারোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারব না।“

“কেন, কীসে আটকাচ্ছে তোমার?”

“সব কিছুতেই – আমার পরিস্থিতি – আমার বোকামি আর আমার জবুথুবু ভাব – সব।“

“তোমার বোকামি বা জবুথুবু ভাবের কথা যদি বলো, বিশ্বাস করো, সেসবের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই তোমার মধ্যে। তুমি শুধুশুধুই এরকম ভাবছ। তোমাকে জানলে তোমাকে গুরুত্ব না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। যথেষ্ট বুদ্ধি ধরো তুমি। তোমার স্বভাবটাও মিষ্টি। আমি নিশ্চিত তোমার কৃতজ্ঞ মন ভালো ব্যবহার পেলে সেটা ফিরিয়ে দিতে চায়। একজন বন্ধু ও সঙ্গীর মধ্যে এর থেকে ভালো আর কী গুণ থাকতে পারে আমার জানা নেই।“

এত প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে ফ্যানি বলল, “তুমি খুবই ভালো। আমার সম্পর্কে এত ভালো চিন্তা করার জন্য আমি তোমাকে কী ভাবে যে ধন্যবাদ জানাব! দাদা, আমাকে যদি চলে যেতে হয় আমি তোমার এই সদ্গুন সবসময় মনে রাখব, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।“

“তা কেন ফ্যানি! আমি সত্যিই চাই ওই হোয়াইট হাউসে গিয়েও তুমি আমাকে মনে রাখবে। কিন্তু ওই বাড়িটা খুব কাছেই। তুমি এমন করে বলছ যেন দুশো মাইল দূরে কোথাও চলে যাচ্ছ। আসলে তো শুধুমাত্র এই পার্কের উল্টোদিকের বাড়িতে যাবে। আর সত্যি বলতে কী বলো তো, তুমি আগের মতোই আমাদের সঙ্গেই থাকবে বলা যায়। সারা বছরের প্রায় রোজদিনই এই দুই পরিবারের দেখা হবে। শুধু একটা জিনিসই পাল্টে যাবে। নরিস মাসির সঙ্গে থাকলে তোমাকে আরেকটু স্পষ্টবক্তা হতে হবে। সেটা তো তোমার এমনিতেই হওয়া দরকার। এখানে অনেকে একসঙ্গে থাকি বলে তুমি একটু আড়ালে থাকার সুযোগ পাও, কিন্তু তাঁর সঙ্গে থাকলে তোমাকে নিজের জন্য কথা বলতেই হবে।“

“ইশ, ওরকম বোলো না।“

“আমাকে বলতেই হবে। আর আমি সেটা খুব খুশির সঙ্গেই বলব। নরিস মাসি আমার মায়ের থেকে অনেক বেশি উপযুক্ত তোমার দেখভাল করার জন্য। পছন্দের মানুষের জন্য তিনি অনেক কিছু করতে পারেন। উনি তোমাকে বাধ্য করবেন যাতে তুমি তোমার যে স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে তার উপযুক্ত দাম দাও।“ 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্যানি বলল, “আমি তোমার মতন করে ভাবতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় আমি ভুল ভাবছি আর তুমিই ঠিক বলছ। আমি সত্যিই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ যে পুরো ব্যাপারটা তুমি এভাবে দেখছ, আমাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করছ। আমাকে তো মানিয়ে নিতেই হবে। নরিস মাসি আমার জন্য সত্যিই ভালো কিছু চিন্তা করেন, এটা ভাবতে পারলে কারোর কাছে আমার যে দাম আছে সেটা জেনে আমার খুবই ভালো লাগত! জানি আমি এই বাড়ির নই, তবুও এই বাড়িটাকে আমি খুবই ভালোবাসি।“

“ফ্যানি, তুমি এই বাড়ি ছেড়ে যাবে, এই জায়গা ছেড়ে তো নয়। তুমি এখানকার বাগান বা পার্কে আগের মতোই নিজের ইচ্ছে মতন যাওয়াআসা করতে পারবে। এই সামান্য বদল নিয়ে এত মন খারাপ কোরো না তো। এরপরেও তুমি একই রাস্তা দিয়ে যাওয়াআসা করবে, একই গ্রন্থাগার থেকে বই পছন্দ করবে, একই লোকজনের সঙ্গে দেখা করবে, একই ঘোড়ায় চড়বে।“

“একদম ঠিক বলেছ তুমি। ইশ ওই ধুসর টাট্টু ঘোড়াটা! ঘোড়ায় চড়ার কথা ভাবলে কী ভয়টাই না পেতাম আমি। ঘোড়া চড়তে শিখলে সেটা যে আমার নিজের জন্যই ভালো হবে এই কথা শুনলেও ভয় হতো। উফ! মেসোমশাই ঘোড়ার কথা বলতে শুরু করলেই আমি ভয়ে কাঁপতে শুরু করতাম। তারপর তুমি ভালোবেসে, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে আমার ভয় কাটালে। কিছুদিন পর এই ঘোড়ায় চড়তে আমার নিজেরই ভালো লাগবে এটা কত ধৈর্য নিয়ে বোঝালে। যখনই এই কথাগুলো মনে পড়ে তখনই বুঝি তুমি কতটা ঠিক বলেছিলে। আর আশা করি যে তোমার করা ভবিষ্যবাণী যেন সবসময়ই এরকম মিলে যায়।“

“যেমন ঘোড়ায় চড়তে শেখা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ছিল, ঘোড়ায় চড়তে শিখে তুমি ভীষণ খুশিও হয়েছিলে, তেমনই আমি একদম নিশ্চিত যে নরিস মাসির সঙ্গে থাকলে সেটা তোমার ভালোই লাগবে।“

ওদের আলাপ আলোচনা এখানেই শেষ হলো। এই আলোচনা ফ্যানির খুবই কাজে আসতে পারত। কিন্তু দেখা গেল এত সব কথা না হলেও কোনও অসুবিধা কিছু হতো না। কারণ, মিসেস নরিসের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ফ্যানিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। তিনি শুধু যে এই ব্যাপারে একটুও বিবেচনা করছেন না তাই নয়, তিনি তাঁর বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে ব্যাপারটাকে খুব সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। তিনি ফ্যানিকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন এটা যাতে কেউ আশা না করে তাই মিসেস নরিস ম্যান্সফিল্ড পার্ক এলাকার সবথেকে ছোট বাড়িটাকে থাকার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বেশ ছিমছাম আর মার্জিত বাড়িটা এতই ছোট যে সেখানে শুধুমাত্র তিনি তাঁর চাকরবাকর নিয়ে থাকতে পারবেন। সেই হোয়াইট হাউসে মাত্র একটা বাড়তি ঘর আছে, বন্ধুবান্ধব কেউ এলে থাকতে পারবে সেখানে। এতদিন যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে কোনও বাড়তি ঘর ছিল না, দরকারও হয় নি, কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। তাই এখন এই বাড়িতে একটা বাড়তি ঘর থাকা যে খুবই দরকার, এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এটা তিনি কাউকে ভুলতে দেন নি। আবার অন্যদিকে একটা বাড়তি ঘর থাকার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে এত জোর দেওয়াতেই বোধহয় স্যর থমাস একটু ভুল বুঝেছেন। তিনি ভেবেছেন ওই বাড়তি ঘরটা হয়তো ফ্যানির জন্যই। লেডি বার্ট্রাম একদিন হালকা চালে মিসেস নরিসের কাছে কথাটা তুললেন, -

“দিদি, আমার মনে হয় ফ্যানি যখন তোমার সঙ্গে থাকতে শুরু করবে তখন আর মিস লি কে রাখার দরকার হবে না, ঠিক না?”

মিসেস নরিস প্রায় চমকে উঠলেন, “আমার সঙ্গে থাকবে? লেডি বার্ট্রাম, কী বলছ কী?”

“কেন, ও তোমার সঙ্গে থাকবে না? স্যর থমাসের সঙ্গে সেরকমই কথা বলেছ বলে শুনলাম যে?”

“আমি! একদম না! এই ব্যাপারে স্যর থমাসের কাছে আমি একটা শব্দও উচ্চারণ করি নি, আর তিনিও কিছু বলেন নি আমাকে। ফ্যানি আমার সঙ্গে থাকবে! দুনিয়ার কেউ যদি আমাদের দুজনকে চেনে তাহলে ফ্যানির আমার সঙ্গে থাকার ব্যাপারটা কখনই তার মাথায় আসবে না। হা ঈশ্বর! আমি ফ্যানিকে কী করে রাখব? আমি! আমি একটা অসহায়, দুঃখী, একলা বিধবা মানুষ। এখন আমার মনোবলও একদম ভেঙ্গে গিয়েছে – এই অবস্থায় একটা মেয়েকে কী করে দেখাশোনা করব? তাও আবার এমন বয়সের একটা মেয়ের! এখন ফ্যানির বয়স পনেরো বছর – এই বয়সেই তো সবথেকে বেশি মনোযোগ আর যত্ন দরকার হয়! এই বয়সটাই এমন যে খুব হাসিখুশি মনকেও অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতে হয়। স্যর থমাস ফ্যানি আমার সঙ্গে থাকবে এরকম কিছু আশা করছেন সেটা হতেই পারে না। তিনি আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি নিশ্চিত, আমার ভালো চান এরকম কেউ এই প্রস্তাব করতেই পারেন না। স্যর থমাস তোমাকে একথা বললেন কী করে?” 

“সত্যি কথা বলতে কী, আমি জানি না। আমার মনে হয় হয়তো এটাই সবথেকে ভালো হবে বলে ভেবেছেন তিনি।“

“কিন্তু তিনি ঠিক কী বলেছেন? তিনি তো আর এটা বলতে পারেন না যে তিনি চান আমি ফ্যানিকে নিয়ে যাই আমার কাছে। আমি জানি উনি এটা চাইতেই পারেন না।“

“না, উনি শুধু বললেন যে উনি ভাবছেন এটাই হয়তো হবে – আর আমিও সেটাই ভেবেছি। আমাদের দুজনেরই মনে হয়েছে এরকম হলে সেটা তোমার জন্য ভালোই হবে। তবে তুমি যদি সেটা না পছন্দ করো, তাহলে আর কিছু বলার নেই। ফ্যানি আমাদের এখানে থাকলে সেটা কোনও অসুবিধা নয়।“

“বোন, একটা জিনিস তো বুঝতে পারছ, আমার মনটা ভালো নেই, তাহলে ও আমার সঙ্গে থাকলে সেটা আমার জন্য কোন দিক থেকে সুবিধাজনক হবে শুনি? আমি একটা একা বিধবা মানুষ, স্বামী থাকার আনন্দ থেকে বঞ্চিত। স্বামীর সেবাযত্ন করতে গিয়েই আমার শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে, আর মনের কথা তো না বলাই ভালো। এই দুনিয়ার সব সুখশান্তি চলে গিয়েছে আমার। একজন ভদ্রমহিলার সম্মান বজায় রেখে চলার মতন যে সামান্য টাকাপয়সা আছে তাতে শুধুমাত্র আমার প্রিয় স্বামীর স্মৃতির যেন অসম্মান না হয় সেটুকুই ব্যবস্থা হতে পারে। এই অবস্থায় ফ্যানির দায়িত্ব নিয়ে কোন সান্ত্বনা পাব আমি? যদি নিজের স্বার্থর কথাই শুধু ভাবি তাহলেও ওই বেচারি মেয়েটার সঙ্গে এত বড় অন্যায় আমি হতে দিতে পারি না। ও এখানে খুব ভালো আছে। আমার যা কিছু দুঃখ কষ্ট সেসব আমাকে নিজেকেই সামলাতে হবে, সে যেভাবেই হোক।“

“তাহলে তুমি বলছ একদম একা একা থাকতে তোমার অসুবিধে নেই?” 

“প্রিয় লেডি বার্ট্রাম, একা থাকা ছাড়া আমার আর উপায় কী! অবরে-সবরে আমার ছোট্ট বাড়িতে কোনো বন্ধুবান্ধব আসবে এটুকুই শুধু আশা করি আমি। সে জন্যই তো আমার একটা বাড়তি ঘর থাকা দরকার। তবে ভবিষ্যতে আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়টা একাই কাটবে। যদি এই দুটো দিক সামলে নিতে পারি, তাহলে তার থেকে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই আমার।“

“আশা করি তোমার অবস্থা খুব একটা খারাপ হবে না। স্যর থমাস বলছিলেন তুমি বছরে ছ’শো পাবে।“

“লেডি বার্ট্রাম, আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমি জানি এতদিন যেভাবে চলেছি, সেভাবে আর চলতে পারব না আমি। তবে যতোটা সম্ভব চেষ্টা তো করতেই হবে। আমাকে আরও ভালো ভাবে সবদিক দেখেশুনে চলা শিখতে হবে। এতদিন আমি উদার হাতে সংসার সামলেছি, কিন্তু এখন একটু রাশ টেনে চলতে হবে, এতে লজ্জার কিছু নেই। আমার নিজের পরিস্থিতির যেমন বদল হয়েছে, তেমন আমার আয়ও। চার্চের পাদ্রি হিসেবে বেচারা মিস্টার নরিসের থেকে অনেক বেশি আশা করা হতো, কিন্তু সেসব এখন আমার কাছ থেকে আর আশা করলে তো আর চলবে না। এত লোকজন যে আসত যেত, তাদের খাবারদাবারের পিছনে যে কত খরচ হতো, তার কোনও হিসেব নেই। এবার হোয়াইট হাউসে গিয়ে সেসব খরচাপাতির ব্যাপারগুলো আরও ভালো ভাবে দেখে রাখতে হবে। আমার যতটুকু আয়, তার ভিতরে থেকে খরচ করতে হবে। নাহলে আমার নিজেরই অবস্থা করুণ হবে। আর সত্যি কথা বলতে কী, সবকিছু সামলে বছরের শেষে সামান্য কিছু সঞ্চয় করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে।“

“আমি জানি তুমি ঠিক পারবে। আমার যে সেটা সবসময়ই মনে হয়, তুমি তো সেটা জানো, তাই তো?”

“আমার একমাত্র ইচ্ছে যে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। তোমার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবেই আমার ইচ্ছে করে যদি আমার কিছু সহায়সম্পত্তি থাকত। কারোর জন্য যে ভাবব, সেরকম আর কে আছে আমার? যদি ওদের জন্য সামান্য কিছু ধনদৌলত রেখে যেতে পারি তাহলে সেটাই আমার সবথেকে বড় আনন্দ হবে।“ 

“তুমি বড্ড ভালো। কিন্তু ওদের কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিয়ো না যেন। ওদের যথেষ্ট থাকবে। স্যর থমাস সেরকম ব্যবস্থাই করে রেখে যাবেন।“

“তা কী করে বলছ? তুমি তো জানো, স্যর থমাসের বেশ টানাটানি অবস্থা দাঁড়াবে যদি অ্যান্টিগুয়া এস্টেট থেকে এত কম লাভ হয়।“

“ওঃ, সে খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। স্যর থমাস এই নিয়ে লেখালেখি শুরু করে দিয়েছেন, আমি জানি।“

“আচ্ছা, বুঝতে পারছি লেডি বার্ট্রাম। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে তোমার পরিবারের কোনও উপকারে আসাটাই আমার একমাত্র ইচ্ছে। এরপর স্যর থমাস যদি আমার ফ্যানিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেন, তাহলে বোলো আমার শরীর আর মন দুই মিলিয়ে ব্যাপারটা এখন প্রশ্নাতীত। এছাড়াও ওকে থাকতে দেওয়ার মতন বাড়তি জায়গা নেই আমার। যতই হোক, বন্ধুবান্ধব কেউ এলে তার জন্য একটা বাড়তি ঘর তো আমাকে রাখতেই হবে, তাই না?” বিদায় নিতে নিতে বললেন মিসেস নরিস।

মিসেস নরিসের সঙ্গে যা কিছু আলোচনা হলো স্বামীকে সেসব কথা খুলে বললেন লেডি বার্ট্রাম। স্যর থমাস যে মিসেস নরিসকে কতটা ভুল বুঝেছেন সেটা তিনি তাঁর স্বামীকে বারেবারে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি আরও বললেন যে এই মুহূর্ত থেকে তাঁর দিদি মিসেস নরিসের থেকে আর কিছুই আশা করা হবে না, এমন কী এই ব্যাপারে স্যর থমাস যেন সামান্যতম ইঙ্গিতও না দেন। স্যর থমাস অবশ্য একটু অবাকই হলেন। ফ্যানিকে দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে মিসেস নরিস তো খুবই উৎসাহী ছিলেন। তিনি প্রথম থেকেই স্যর থমাস ও লেডি বার্ট্রামকে এটাও বলতেন যে তাঁর যা কিছু সহায় সম্পত্তি সেসব কিছুই বার্ট্রাম পরিবারের জন্য। আর এদিকে বোনঝির দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় এখন এক্কেবারে এড়িয়ে গেলেন! যাক গে, স্যর থমাস খুব দ্রুত এসব কথা ভুলে সবকিছু মানিয়ে নিলেন। এই ব্যবস্থা শুধু যে সম্মানজনক তাই নয়, দেখা গেল এতে ওঁদের সবার সুবিধাই হলো। এই ব্যবস্থার ফলে তিনি ফ্যানির জন্য যা কিছু করতে হবে সেসব আরও ভালো ভাবে করতে পারবেন।

খুব তাড়াতাড়ি ফ্যানিও জানতে পারল যে ওকে এই জায়গা ছেড়ে যেতে হবে সেই ভয়টা কতটা অপ্রয়োজনীয় ছিল। কথাটা জেনে এডমন্ড একটু হতাশ হলো, কারণ ফ্যনির জন্য যা ভালো হবে বলে এডমন্ডের মনে হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হয় নি। তবে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে না জেনে ফ্যানির যে সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ তা দেখে এডমন্ড কিছুটা সান্ত্বনা পেল। মিসেস নরিস হোয়াইট হাউসে থাকা শুরু করলেন। ম্যান্সফিল্ড পার্কের পারিবারিক চার্চে গ্রান্ট পরিবার এসে পৌঁছল। এসব কিছু ঘটে যাওয়ার পর কিছুদিন আবার সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকল।

গ্রান্ট পরিবারের লোকজন যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আর মিশুকে স্বভাবের তাতে প্রতিবেশীদের সবাই বেশ খুশি হলেন। অবশ্য গ্রান্ট পরিবারের যে একেবারেই কোনও দোষত্রুটি নেই, তা নয়। মিসেস নরিস কিছুদিনের মধ্যেই সেসব খুঁজে বের করলেন। ডক্টর গ্রান্ট খেতে বড় ভালোবাসেন। তিনি রোজ রোজ ভালো ভালো খাওয়াদাওয়া করেন। এদিকে মিসেস গ্রান্ট! কোথায় তিনি কম খরচের মধ্যে স্বামীর মন মতন খাবারদাবারের ব্যবস্থা করবেন, তা নয়, উল্টে তিনি ম্যান্সফিল্ড পার্কের মতন একজন দামি রান্নার লোক রেখেছেন ভালো ভালো রান্না করার জন্য। সেই রান্নার লোকই সব রান্না করে, মিসেস গ্রান্টকে রান্নাঘরে দেখাই যায় না প্রায়। এই সব অনাসৃষ্টির কাণ্ড দেখে মিসেস নরিসের শান্তি উধাও হয়ে যায়। ওই বাড়িতে যে পরিমাণ মাখন আর ডিম খাওয়া হয় তাই নিয়েও তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যায়। “আমার থেকে বেশি উদার আর অতিথিপরায়ন আর কেউ হতে পারে না – আবার ছোট মনের কাজকর্মও সহ্য করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে – যখন আমরা থাকতাম তখন ওই বাড়িতে কোনও আরামের কমতি ছিল বলে কেউ আমার বদনাম করতে পারবে না – কিন্তু এখন যেভাবে সবকিছু চলছে, তাতে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই গ্রামের চার্চের বাড়িতে এত বড়লোকি! এসব এখানে মানায় না মোটেই। আমার ভাঁড়ার ঘরটা মিসেস গ্রান্টের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ভালো ছিল, কিন্তু তিনি তো সে ঘরেও যান না। খবরটা বার করার আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই জানতে পারছি না যে মিসেস গ্রান্ট পাঁচ হাজার পাউন্ডের বেশি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কী না!”  

মিসেস নরিস যখন গজগজ করতে করতে এরকম অভিযোগের ঝুলি খুলে বসেন তখন লেডি বার্ট্রাম চুপচাপ শুনে যান, খুব একটা পাত্তা দেন না। অর্থকড়ি নিয়ে যারা এত চিন্তা ভাবনা করেন, তিনি তাদের দোষ ত্রুটি নিয়ে মাথা ঘামাতে বিশেষ রাজি নন। তবে দেখতে খুব একটা রূপসী না হয়েও মিসেস গ্রান্ট যে এত ভালো বিয়ে করে এত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাচ্ছেন, তাতে অবশ্য তিনি একটু অবিচারের ছায়া দেখতে পান। ব্যাপারটা যে সৌন্দর্যের প্রতি কতবড় অবিচার এই নিয়ে তিনি প্রায়ই বিস্ময় প্রকাশ করেন। যদিও মিসেস নরিস মিসেস গ্রান্টের খরচের হাত নিয়ে যতোটা বিস্তারিত কাটাছেঁড়া করেন, লেডি বার্ট্রাম মিসেস গ্রান্টের সৌন্দর্য বিষয়ে তত আলোচনা করেন না।

বছরখানেক এসব আলোচনা করে কাটার আগেই পরিবারে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল যে মহিলাদের চিন্তাভাবনা ও আলাপ আলোচনায় সেটা বেশ বড়সড় জায়গা দখল করে নিল। ব্যবসা সংক্রান্ত সবকিছু ভালো করে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর নিজেরই অ্যান্টিগুয়ায় যাওয়ার ব্যাপারটা প্রয়োজন বলে বিবেচনা করলেন স্যর থমাস। এখানে না থাকলে খারাপ সঙ্গের প্রভাব কমবে এই আশায় তিনি বড় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাঁরা ইংল্যান্ড ছাড়লেন প্রায় বছর খানেক এখানে থাকবেন না সেই সম্ভাবনা নিয়ে।

একদিকে অর্থনৈতিক কারণে এই সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে আর অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তে ছেলের উপকার হবে এই ভেবে স্যর থমাস পরিবারের থেকে দূরে থাকার এই পরিস্থিতি মানিয়ে নিলেন। মেয়েদের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের অন্যের ভরসায় ছেড়ে থাকাও মেনে নিলেন তিনি একই কারণে। মেয়েদের ব্যাপারে স্যর থমাসের যা করণীয় সেটা লেডি বার্ট্রাম আদৌ করতে পারবেন কীনা সেটা তো ছেড়েই দিলেন এমন কী লেডি বার্ট্রামের মেয়েদের ব্যাপারে তাঁর নিজের যা কিছু করণীয় সেটাই করতে পারবেন কীনা স্যর থমাস সেই ভরসা করতে পারলেন না। তবে মিসেস নরিসের সতর্ক নজরদারি আর এডমন্ডের বিচক্ষণতার উপর তাঁর যথেষ্ট আস্থা ছিল। তাই কোনও ভয় ছাড়াই মেয়েদের রেখে তিনি রওনা হলেন।

স্যর থমাস যে তাঁদের রেখে এভাবে চলে গেলেন সেটা লেডি বার্ট্রামের একদমই পছন্দ হলো না। তবে তিনি স্যর থমাসের নিরাপত্তা বা আরাম আয়েসের কথা ভেবে একটুও উদ্বিগ্ন হলেন না। তাঁদের নিজেদের ছাড়া আর কারোর কোনও বিপদআপদ হতে পারে, কোনও অসুবিধে হতে পারে, কিম্বা ক্লান্তি হতে পারে এরকম মনে করার বান্দাই তিনি নন।

বার্ট্রাম বোনেদের অবশ্য বেশ মন খারাপ হলো। তবে সেই মন খারাপ কিন্তু কোনও দুঃখের কারণে নয়, বাস্তবে যে তাদের জীবনে কোনও দুঃখ নেই, সেই কারণেই। বাবার প্রতি ওদের মোটে ভালোবাসা নেই। স্যর থমাস কখনই তাঁর মেয়েদের আনন্দের সঙ্গী হন নি। তাই দুঃখজনক হলেও বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা খুব খুশি হয়ে উঠল। তিনি নেই মানে ওদের বাধা দেওয়ার আর কেউ রইল না। স্যর থমাস বারণ করতে পারেন এরকম কোনও আমোদ প্রমোদের খোঁজ না করলেও বাবার অনুপস্থিতিতে তারা বেশ স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারছে। সবরকম সুযোগ সুবিধাই যেন ওদের হাতের নাগালে চলে এসেছে। ফ্যানিও যেন মুক্তি পেল। ওর মাসতুতো বোনরা যেমন মুক্তির স্বাদ পেয়ে খুশি, ঠিক তেমনই স্যর থমাসের অনুপস্থিতিতে ফ্যানিও যেন নিজেকে মুক্ত অনুভব করে প্রায় ততোটাই খুশি হয়ে উঠল। তবে তার কোমল স্বভাব ওকে মনে করিয়ে দিল যে এরকম ভাবা কতটা অকৃতজ্ঞতার কাজ। ওর যে মন খারাপ হচ্ছে না, সে কারণেই যেন ওর বেশি বেশি মন খারাপ হচ্ছে। “স্যর থমাস আমার জন্য, আমার ভাইদের জন্য কত কিছু করেছেন। এই যে তিনি গেলেন, কে জানে, হয়তো আর কোনোদিনই ফিরবেন না। সেই তিনি চলে গেলেন আর আমার চোখে এক ফোঁটা জল এলো না! এত অসংবেদনশীল আমি! ছি, ছি! কী লজ্জার কথা!” রওনা দেওয়ার আগের দিন সকালে স্যর থমাস ফ্যানিকে বলেছিলেন যে তিনি আশা করছেন এই শীতে উইলিয়াম আর ফ্যানির আবার দেখা হবে। তিনি এটাও নির্দেশ দিয়েছিলেন যে উইলিয়াম যে জাহাজে আছে সেটা ইংল্যান্ডে ফিরেছে এই খবর পেলেই যেন ফ্যানি উইলিয়ামকে চিঠি লিখে ম্যান্সফিন্ডে আসার জন্য বলে। “সত্যি, তিনি তো আমাদের কথা ভেবেই এরকম বলেছেন। এত দয়ার শরীর মানুষটার!” তিনি ফ্যানিকে সবসময় হাসিমুখে “ফ্যানি সোনা” বলে ডাকেন। আর যখনই এরকম ডাকেন তখন তিনি এর আগে যদি কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়েও থাকেন বা ঠাণ্ডা গলায় কথা বলেও থাকেন, সে সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু সেদিন যে কথা দিয়ে স্যর থমাস তাঁর কথা শেষ করলেন, তাতে ফ্যানির মনটা ভারী ছোট হয়ে গেল। তিনি বললেন যে, “উইলিয়াম যদি আসে ম্যান্সফিল্ডে তাহলে আশা করি তুমি ওকে বোঝাতে পারবে যে এতগুলো বছর যে তোমরা দূরে দূরে থাকলে, তা বৃথা যায় নি। তোমার দিক থেকে অনেক কিছুরই অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে আমার চিন্তা হচ্ছে যে হয়তো উইলিয়ামের মনে হবে ওর ষোল বছরের বোন এখনও অনেক ক্ষেত্রেই ওর দশ বছরের বোনের মতোই রয়ে গিয়েছে।“ মেসোমশাই চলে গেলে এই কথাগুলো মনে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ফ্যানি। বড় কষ্টের সে কান্না। তার চোখ লাল হয়ে গেল। কিন্তু সেই লাল চোখ দেখে ওর মাসতুতো বোনদের মনে হলো এটা ফ্যানির ঢং ছাড়া আর কিছুই না।