জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - পঞ্চম পর্ব

প্রথম পর্বের লিংক

দ্বিতীয় পর্বের লিংক

তৃতীয় পর্বের লিংক

চতুর্থ পর্বের লিংক

(৫)

পারস্পরিক সাহচর্য পেয়ে বার্ট্রাম আর ক্রফোর্ড পরিবারের তরুণ তরুণীরা প্রথম থেকেই সবাই বেশ খুশি। দুই পরিবারেরই অপর পরিবারকে এত ভালো লেগে গেল যে ওদের পরিচয় দ্রুত বেশ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলো। সৌজন্যের গণ্ডির মধ্যে থেকে যতোটা ঘনিষ্ঠতা হয় আর কী! মিস ক্রফোর্ড যে এত রূপসী, তাতে মিস বার্ট্রামদের সঙ্গে বন্ধুত্বে কোনও বাধা হয় নি। ওরা নিজেরাই এত রূপসী যে অন্য কোনও তরুণীর সৌন্দর্য দেখে ওদের হিংসে করতে হয় না। বরং বলা যায় মিস ক্রফোর্ডের প্রাণবন্ত গাঢ় চোখ, উজ্জ্বল বাদামি গায়ের রঙ, এবং সবমিলিয়ে তার মিষ্টি চেহারায় ওর দাদা যতোটা মুগ্ধ, ওরাও ততোটা মুগ্ধ। যদি মিস ক্রফোর্ড আরও লম্বা, ভারী সুঠাম গড়নের হতো, তার গায়ের রঙ যদি আরও ফর্সা হতো, তাহলে হয়তো একটা রেষারেষির মনোভাব জেগে উঠতে পারত। কিন্তু মিস ক্রফোর্ডের সৌন্দর্য এতোটাই অন্যরকম যে মিস বার্ট্রামদের সঙ্গে তার তুলনার প্রশ্নই ওঠে না। যেখানে মিস বার্ট্রামরা দেশের সবথেকে রূপসী তরুণীদের মধ্যে পড়ে, সেখানে মিস ক্রফোর্ড শুধুমাত্র একজন মিষ্টি চেহারার তরুণী বই আর কিছু না।   

মিস ক্রফোর্ডের ভাই মিস্টার ক্রফোর্ড অবশ্য সেরকম সুদর্শন না। প্রথম দেখায় তো তাকে মনে রাখার মতন বলে মনেই হয় নি। তবে মিস্টার ক্রফোর্ডের গায়ের রং বেশ কালো আর চেহারা অত্যন্ত সাদামাটা হলেও তার আচার আচরণ কিন্তু বেশ ভদ্র আর আকর্ষণীয়। এরপর যখন দ্বিতীয়বার দেখা হলো তখন কিন্তু তাকে আর অতটা সাধারণ বলে মনে হলো না। হ্যাঁ, তাকে দেখতে সাদামাটা, সেটা সত্যি। তবে এমন তার ব্যক্তিত্ব, সুগঠিত দাঁতের সারি, আর পরিশীলিত চালচলন যে তার অতি সাধারণ চেহারার কথা সবাই খুব তাড়াতাড়ি ভুলে গেল। এতো গেল দ্বিতীয় দেখা সাক্ষাৎকারের কথা। এরপর যখন তৃতীয়বারের জন্য তার সঙ্গে দেখা হলো, সবাই মিলে পারিবারিক গির্জার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করল, তখন আর কারোর সেই ক্ষমতা নেই যে মিস্টার ক্রফোর্ডকে সাধারণ চেহারার বলবে। সত্যি কথা বলতে গেলে দুই বার্ট্রাম বোনের দেখা তরুণদের মধ্যে মিস্টার ক্রফোর্ডই সবথেকে আকর্ষণীয়। তাকে দুই বোনেরই সমান ভালো লেগে গেল। তবে যেহেতু মারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তাই মিস্টার ক্রফোর্ড জুলিয়ার প্রতি বেশি মনোযোগ দিল। জুলিয়া নিজেও সেটা বুঝতে পারছে। সপ্তাহ খানেকও যায় নি মিস্টার ক্রফোর্ড ম্যান্সফিল্ডে এসেছে, অথচ জুলিয়া তার প্রেমে পড়ার জন্য ইতিমধ্যেই একেবারে তৈরি!   

এই ব্যাপারে মারিয়ার ধ্যানধারণা তো আরও বিভ্রান্তিকর ও অস্পষ্ট। তবে সেটা সে কিছুতেই দেখতেও চায় না, বুঝতেও চায় না। তার মনে হয় একজন আকর্ষণীয় পুরুষের প্রতি তার আকর্ষিত হওয়ার মধ্যে কোনও দোষ নেই। তার যে আরেকজন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা তো সবারই জানা কথা। তাই মিস্টার ক্রফোর্ডের নিজেরই উচিত নিজেকে সামলে রাখা। মিস্টার ক্রফোর্ড নিজেও কোনও ঝামেলায় পড়তে চায় না। বার্ট্রাম বোনদেরকে দেখে সত্যিই পছন্দ করার মতন। আবার কোনও তরুণের যে তাদেরকে ভালো লাগছে সেটাও তারা বেশ উপভোগ করে। প্রথমদিকে মিস্টার ক্রফোর্ড আর বিশেষ কিছু নয়, শুধুমাত্র এটুকুই চেয়েছে যেন ওরা দুই বোন তাকে পছন্দ করে। সে মোটেই চায় না দুই বোন তার প্রেমে পড়ে কষ্ট পাক। তবুও যথেষ্ট বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও, যথেষ্ট বিচার বিবেচনার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে নিজেকে সামলাতে পারল না।

সেদিন খাওয়াদাওয়ার পর নিজেদের ঘোড়ার গাড়ির দিকে ফেরার সময় মিস্টার ক্রফোর্ড তার দিদি মিসেস গ্রান্টকে বলল, “তোমার এই দুই বার্ট্রাম বোনকে আমার অসম্ভব পছন্দ হয়েছে। দুজনেই ভারী অভিজাত আর পছন্দ করারই মতন।“

“তা তো ঠিকই। সত্যিই ওদের পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। তোমার কাছ থেকে একথা শুনে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। তবে বোধহয় জুলিয়াকে বেশি পছন্দ হয়েছে তোমার।“

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যিই তাই। জুলিয়াকেই আমার বেশি ভালো লেগেছে।“

“কিন্তু সেটা কি সত্যি? সব মিলিয়ে দেখতে গেলে মারিয়াকে বরং বেশি রূপসী বলে মনে করা হয়।“

“আমারও সেটাই মনে হয়। মারিয়ার সব কিছুরই এক আলাদা আকর্ষণ। ওর দেখতেও বেশি সুন্দর। কিন্তু তবুও আমার জুলিয়াকেই বেশি পছন্দ হয়েছে। মারিয়া যে বেশি রূপসী, সেটা সত্যি। আর আমারও ওকেই বেশি পছন্দযোগ্য বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তবুও যেহেতু তুমি চাও, তাই আমি জুলিয়াকেই বেশি পছন্দ করব।“

“তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলব না হেনরি, কিন্তু আমি জানি শেষ পর্যন্ত তুমি জুলিয়াকেই বেশি পছন্দ করবে।“

“আর আমিও তো সেটাই বলছি যে আমি প্রথম থেকেই জুলিয়াকে বেশি পছন্দ করছি।“

“এছাড়া মারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, সেটাও মাথায় রেখো। ও একজনকে ইতিমধ্যেই পছন্দ করে ফেলেছে।“

“আরে, ঠিক সেজন্যই তো আমার মারিয়াকে বেশি ভালো লেগেছে। বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে এমন মেয়েরা সবসময়ই বিয়ে ঠিক না হওয়া মেয়েদের থেকে বেশি আকর্ষণীয়। ওদের না আছে নিজেদের প্রমাণ করার ব্যাপার, না আছে কোনও দুশ্চিন্তা। ওদের মনে হয় কারোর সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইলে এখন আর কেউ কোনও সন্দেহ করবে না। তাই বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া তরুণীর ক্ষেত্রে সবকিছুই খুব নিরাপদ, কোনও বিপদের সম্ভাবনাই নেই।“

“তা কেন? দেখতে গেলে মিস্টার রাশওয়ার্থও খুব ভালো স্বভাবের। মারিয়ার জন্য একেবারে উপযুক্ত।“

"কিন্তু মিস বার্ট্রাম মিস্টার রাশওয়ার্থকে মোটেই ভালোবাসেন না – তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সম্পর্কে এটাই তোমার মত, তাই না? আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে একমত নই। আমি নিশ্চিত, মিস বার্ট্রাম মিস্টার রাশওয়ার্থকে খুব ভালোবাসেন। মিস্টার রাশওয়ার্থের নাম করলেই মিস বার্ট্রামের চোখে সেই ভালোবাসা দেখা যায়। মিস বার্ট্রামকে যতোটা বুঝেছি, যাকে মন দেন নি, ভালোবাসেন নি, তাকে তিনি বিয়ে করবেন না মোটেই।“

“মেরি, মিস্টার রাশওয়ার্থকে কীভাবে সামলাব আমরা?”

“ওকে নিজের মতো থাকতে দিতে হবে বলে মনে হয় আমার। ওর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে না। শেষ পর্যন্ত লোকটা নির্ঘাত ঠকবে, দেখে নিও।“

“কিন্তু মিস্টার রাশওয়ার্থ ঠকে গেলে আমার একদম ভালো লাগবে না। আমি চাই না মিস্টার রাশওয়ার্থ প্রতারিত হোক। আমি চাইব যেন সব কিছু ন্যায়সঙ্গত ও সম্মানজনক হয়।“  

“আরে বাবা, ওকে নিজের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দাও তো, ঠকলে ঠকবে! তাতে কী যায় আসে? জীবনের কোনো না কোনো সময়ে সবাইকেই ঠকতে হয়।"

“তাই বলে বিয়েতে না, মেরি!”

“বিশেষ করে বিয়েতেই তো বেশি ঠকতে হয়। দিদি, এখানে যারা বিবাহিত তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, একশ জন নারী পুরুষের মধ্যে একজনকেও পাবে না, যে বিয়ে করে ঠকে নি। যেদিকেই তাকাই, এটাই সত্যি বলে মনে হয়। আবার যখন দেখি যে বিয়েতে সবাই অন্যের কাছ থেকে সততা আশা করে, কিন্তু নিজের সততা বজায় রাখে না, তখন আমার মনে হয় এটা তো হওয়ারই কথা।“

“আঃ, বিয়ের ব্যপারে তোমার তো দেখছি হিল স্ট্রিটে খুব বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে।“

“বেচারা কাকিমার ভালোবাসার এই পরিস্থিতিকে ভালো লাগার কোনও কারণ ছিল না, কিন্তু আমি যা দেখছি তাতে আমার মনে হয়েছে এই চালাকি সব সময়ই হয়। অনেককেই দেখেছি কাউকে বিয়ে করেছে একটা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশা রেখেই। সে ভালো গুণ হোক বা অন্য কিছু পাওয়ার আশা, যাই হোক না কেন। আর সেই আশা নিয়েই বিয়ে করে অনেকে একেবারে ঠকে গিয়েছে। তারপর একদম বিপরীত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে এটাকে স্রেফ প্রতারণা ছাড়া আর কী বলব, বলো?”

“কিছু মনে কোরো না, আমি তোমার কথা পুরোপুরি মানতে পারছি না। যা মনে হচ্ছে, তুমি পুরোটা না, হয়তো অর্ধেক ছবি দেখেছ আর বাদবাকি অংশটা কল্পনা করে নিয়েছ। খারাপটাই শুধু দেখেছ, ভালোটা না। আমরা সবাই একটু বেশিই আশা করি জীবনের কাছ থেকে। কিন্তু জীবনে ছোটখাটো ধাক্কা আর হতাশা তো থাকবেই। তারপরেও, এক জায়গায় আনন্দ না পেলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আরেকটা সুখের জায়গা খুঁজে নেওয়া। প্রথম হিসেবটা যদি ভুলও হয়, তাহলেও আমরা পরের বার হিসেব করার সময় আর সেই ভুল করি না। আমরা কোথাও না কোথাও আমাদের স্বস্তি খুঁজে নিই ঠিকই। আর খুঁত ধরার মানসিকতার লোকজন সামান্য বিষয়কে বড় করে দেখে। শেষ পর্যন্ত যারা এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে যায় তাদের থেকেও ওই খুঁত ধরা মানুষগুলোই কিন্তু বেশি ঠকে যায়।“

“আরিব্বাস দিদি! নিজে বিয়ে করেছ বলে বিয়ের প্রতি তোমার এই মনোভাবের জবাব নেই। যখন আমি বিয়ে করব, তখন ঠিক রকমই হতে চাই আমি। আর আমার সব বন্ধুরাও এরকম হোক, সেটাই চাই আমি। তাহলে মন ভাঙ্গার যে কষ্ট তার থেকে বেঁচে যেতাম আমি।“

“মেরি, তুমি তো দেখি তোমার দাদার মতোই দুষ্টু। তবে আমাদের এখানে তোমাদের দুজনকেই শুধরে দেব। ম্যান্সফিল্ড তোমাদের ঠকাবে না, বরং শান্তি দেবে তোমাদের দুজনকেই। আমাদের সঙ্গে থাকো, দেখো, তোমরা ঠিক বদলে যাবে।“

নিজেদের বদলাতে না চাইলেও ম্যান্সফিল্ডে থাকার জন্য ক্রফোর্ড ভাইবোন দুজনই ভারী উৎসাহী। বর্তমানে বসবাস করার জন্য চার্চের এই বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে মেরির। আর হেনরিও এখানে আরও কিছুদিন থাকার জন্য রাজি হয়ে গেল। যদিও সে কেবল মাত্র কয়েকদিন থাকার জন্যই এসেছিল, তবে এখানে এসে ম্যান্সফিল্ড জায়গাটা তার বেশ ভালো লেগেছে। এছাড়াও আপাতত তার অন্য কোথাও যাওয়ারও খুব একটা তাড়া নেই। ভাইবোন দুজনই থেকে যাওয়ায় মিসেস গ্রান্ট তো দারুণ খুশি। আর মিস্টার গ্রান্টও ভারী খুশি। মিস ক্রফোর্ডের মতো সুন্দরী ও কথা বলতে ভালোবাসে এমন একজন তরুণী সঙ্গী পেলে মিস্টার গ্রান্টের মতন অলস ও ঘরকুনো মানুষের জন্য এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে! আবার অন্যদিকে মিস্টার ক্রফোর্ড বাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকায় সেটা মিস্টার গ্রান্টের জন্য রোজ রোজ ক্ল্যারেট (এক ধরনের ওয়াইন) পান করার একটা ভালো অজুহাত হয়ে উঠল।

দুই বার্ট্রাম বোন মিস্টার ক্রফোর্ডের প্রতি যতোটা মুগ্ধ হয়ে পড়ল, মিস ক্রফোর্ড কিন্তু মিস্টার বার্ট্রামদের প্রতি অতটা আগ্রহ দেখাল না। সেটা তার স্বভাবই নয়। তবে সে এটা স্বীকার করল যে দুই বার্ট্রাম ভাইই বেশ আকর্ষণীয়। এত ভালো দুই যুবক একসঙ্গে এমনকি লন্ডনেও দেখা যায় না। ওদের দুই ভাইয়ের আচার আচরনই ভারী ভদ্র। বিশেষ করে বড় ভাই টমের। টমের একে তো লন্ডনে গিয়ে কিছুদিন থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার উপর সে তার ভাই এডমন্ডের তুলনায় বেশি প্রাণোচ্ছল আর মেয়েদের প্রতি তার ব্যবহার বেশি সৌজন্যপূর্ণ। তাই তাকেই বেশি ভালো লাগল মিস ক্রফোর্ডের। এছাড়াও, টম যে দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই, সেই যে পরিবারের সব সম্পত্তির অধিকারি হবে, সেটাও তাকে পছন্দ করার একটা জোরালো কারণ। যেহেতু হিসেব কষে এগোনটাই তার স্বভাব তাই মিস ক্রফোর্ডের প্রথম থেকেই মনে হচ্ছে যে বড় ভাই টমকেই তার বেশি ভালো লাগা উচিৎ।  

হাসিখুশি টমকে সবসময়ই সবার ভালো লাগে। ওর সহজসরল, প্রাণোচ্ছল স্বভাবটা এমনই যে সাধারণত লোকে বেশি বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে যতোটা পছন্দ করে, টমকে তার থেকে বেশি পছন্দ করে। অনেক লোকজনের সঙ্গে ওর চেনাজানা আছে। খুব সুন্দর অনেক বিষয়ে কথা বলতে পারে। সবথেকে বড় কথা, টম যে শুধু ম্যান্সফিল্ড পার্কের ভবিষ্যৎ মালিক তাইই নয়, ভবিষ্যতে সেও ব্যারনেট উপাধির মালিক হবে। মিস ক্রফোর্ড দ্রুত বুঝে ফেলল যে টমের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বেশ ভালো। একটা পার্ক, পাঁচ মাইল পরিধির বিশাল এক ভূসম্পত্তি, বেশ বড়সড় আধুনিক একটা বাড়ি – প্রাসাদ তুল্য সেই বাড়ি এতোটাই সুন্দর যে যেকোনোও অভিজাত বাড়ির চিত্র সংগ্রহে জায়গা পেতে পারে, শুধু আসবাবপত্রগুলো বদল করে একদম নতুন করে সাজালেই বাড়িটা একদম সম্পূর্ণ হয়। মিষ্টভাষী দুই বোন, শান্ত স্বভাবের মা, আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে টম নিজেও একজন পছন্দ হওয়ার মতোই ভদ্র যুবক। বাবাকে কথা দেওয়ার দরুন এখন খুব বেশি জুয়াও খেলে না টম। খুব সাবধানে সবকিছু বিবেচনা করে মিস ক্রফোর্ডের এটাই মনে হলো যেহেতু প্রায় সবকিছুই টমের পক্ষে যাচ্ছে, সেহেতু টমকে বেছে নেওয়াই বোধহয় তার উচিৎ হবে। সেই মতন সেও টমের প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। বিশেষ করে টম তার যে ঘোড়াটা নিয়ে ঘোড়দৌড়ে বাজি ধরবে, সেই ঘোড়াটার ব্যাপারেও মিস ক্রফোর্ড একটু আগ্রহী হয়ে উঠল।

ঘোড়দৌড়ে অংশ নেওয়ার কারণে টমকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শহর ছাড়তে হবে। টম যে শুধু শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যাবে তাই না, তার যেরকম কাজকারবার, তাতে বাড়ির লোকজনও আশা করে না যে সে বেশ কয়েক সপ্তাহ না কাটিয়ে বাড়ি ফিরবে। এদিকে মিস ক্রফোর্ডের সঙ্গে টমের পরিচয় হয়েছে সেটাও খুব বেশি দিন হয় নি। এরকম পরিস্থিতিতে টম কতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে, সেটা ওর মিস ক্রফোর্ডের প্রতি মনোভাব বোঝার জন্য একটা পরীক্ষা হবে। টম আপ্রাণ চেষ্টা করল মিস ক্রফোর্ড যাতে ঘোড়দৌড় দেখতে যায়। বেশ অনেকে মিলে যাবে, এরকম পরিকল্পনা করা হলো। সবাই রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ব্যাপারটা আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে গেল, বাস্তবে আর পরিণতি পেল না।

আর ফ্যানি? এই সবকিছু যখন ঘটে যাচ্ছে তখন ফ্যানি কী করছে, কী ভাবছে? এই যে নতুন দুজন, এদের বিষয়েই বা সে কী ভাবছে? সাধারণত একটা আঠারো বছরের মেয়ে নিজের মতামত প্রকাশের যতোটা সুযোগ পায় ফ্যানি ততটা পায় না। আর বিশেষ গুরুত্ব পায় না বলেই ও শুধুমাত্র খুব মৃদুস্বরে মিস ক্রফোর্ডের রূপের প্রশংসা করে ক্ষান্ত দিয়েছে। এদিকে মিস্টার ক্রফোর্ডকে ওর বড্ড সাধারণ বলে মনে হয়। তাই যতই বারেবারে ওর মাসতুতো বোনেরা অন্যরকম বোঝাক, সে মিস্টার ক্রফোর্ডের নাম নেয় না মোটে। তবে ফ্যানি নিজের অজান্তেই নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলল। একদিন মিস ক্রফোর্ড দুই বার্ট্রাম ভাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আস্তে আস্তে আমি তোমাদের সবাইকেই একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছি। শুধু মিস প্রাইসকেই একটুও বুঝতে পারছি না যেন। ও কি আদৌ সামাজিকভাবে পরিচিত হয়েছে? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। সেদিন তোমাদের সঙ্গে চার্চের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে গেল, তাতে তো মনে হলো সামাজিক পরিচিতি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এত চুপচাপ যে মনে হচ্ছে হয়তো ও এখনও সামাজিক মেলামেশ শুরু করেনি।“

প্রশ্নটা এডমন্ডের উদ্দেশ্যে করা। সে হেসে জবাব দিল, “আমি জানি তুমি কী বোঝাতে চাইছ।। তবে এই প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিতে পারব না। আমার মাসতুতো বোন বড় হয়েছে। একজন পরিপূর্ণ নারীর মতন ওর বুদ্ধি বিবেচনা, কিন্তু এই সামাজিক পরিচিতি হওয়া বা না হওয়ার বিষয়ে আমার জানা নেই।“

“সেকি! এটা আবার না বোঝার কী আছে? সামাজিক মেলামেশা শুরু করা মেয়ে আর সামাজিক মেলামেশা শুরু না করা মেয়ের মধ্যে এত বেশি তফাৎ থাকে যে সাধারণত এটা বোঝা সব থেকে সহজ! এই দুই ধরনের মেয়ের আচার আচরণ, সাজ পোশাক সব কিছুই একদম আলাদা হয়। আজ পর্যন্ত আমি ভাবতেও পারিনি যে একজন মেয়ে সামাজিকভাবে পরিচিত হয়েছে নাকি হয়নি সেই নিয়ে দ্বিধায় পড়তে পারি আমি! যে মেয়ের সামাজিক পরিচিতি হয়নি, তার পোশাকের ধরন বা আচার আচরণ আলাদা হয়। যেমন ধরো, পুরো চারপাশ দিয়ে মাথা ঢাকা টুপি পরে, শান্ত, সংযত ভঙ্গিতে খুব কম কথা বলে। এখন আমার কথা শুনে তুমি হাসছ ঠিকই তবে আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি যে এটাই হয়। হয়তো মাঝসাঝে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তবে এতে যথেষ্ট শালীনতা বজায় থাকে। মেয়েদের শান্ত আর সংযত থাকাই উচিত। সবথেকে আপত্তিজনক বিষয় এটাই যে সামাজিক মেলামেশা শুরু করার পর হঠাৎ করেই মেয়েদের আচার আচরণে অনেক বদল চলে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই খুব কম সময়ের মধ্যে একদম বিপরীত স্বভাবের হয়ে যায়। সংযত আচরণ হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী আচরণ! বর্তমান ব্যবস্থায় এটাই সবথেকে বড় সমস্যা। একটা আঠেরো উনিশের মেয়ে, বছরখানেক আগেও যার মুখে কথা ফুটত না, হঠাৎ করেই সে সব বিষয়ে এত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলে সেটা কারোরই ভালো লাগে না। মিস্টার বার্ট্রাম, আমি নিশ্চিত যে তুমিও কখনও কখনও এরকম পরিবর্তন দেখেছ।“

“তা আমি দেখেছি। কিন্তু এটা তো ঠিক হলো না। আমি বুঝতে পারছি তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ। কিন্তু তুমি আমাকে আর মিস অ্যান্ডারসনকে নিয়ে মজা করছ।“

“একদম না! কে এই মিস অ্যান্ডারসন! আমি জানিনা তুমি কার কথা বলছ, বা কী বোঝাতে চাইছ। এই ব্যাপারে আমি তো একদমই অন্ধকারে। তবে আমি খুব খুশি হয়েই তোমাকে নিয়ে মজা করব যদি তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলো।“

“আহা, সে তুমি খুব ভালোই পারো। কিন্তু এখনই এতকিছু তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাই না, বুঝলে! তুমি নির্ঘাত মিস অ্যান্ডারসনের কথাই বললে যখন এরকম হঠাৎ আমুল বদলে যাওয়া মেয়েদের কথা বললে। তোমার বর্ণনা এমন নিখুঁত যে আমার বুঝতে ভুল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আর ব্যাপারটা ঠিক সেরকমই হয়েছে। বেকার স্ট্রিটের অ্যান্ডারসন পরিবার – মনে নেই, সেদিন তো আমরা ওদের কথাই আলোচনা করছিলাম!

এডমন্ড, তুমি তো আমার মুখে চার্লস অ্যান্ডারসনের নাম শুনেছ। এখন এই ভদ্রমহিলা যেমন বর্ণনা দিল, সেদিন ঠিক সেরকমই ঘটেছিল। আজ থেকে প্রায় বছর দুয়েক আগে অ্যান্ডারসন যখন ওর পরিবারের সঙ্গে আমাকে প্রথমে আলাপ করিয়ে দিলো, ওর বোনের তখনও সামাজিক মেলামেশার বয়স হয় নি। তখন আমি চাইলেও আমার সঙ্গে একটা কথাও বলত না। ওদের বাড়িতে একদিন সকালে আমি প্রায় ঘণ্টাখানেক অ্যান্ডারসনের জন্য অপেক্ষা করেছি। ঘরে তখন শুধু দু-একটা বাচ্চা মেয়ে আর ওর বোন ছিল। বাচ্চাদের দেখাশোনা করার মহিলা হয় অসুস্থ ছিল নয়তো পালিয়ে গিয়েছিল। ওদের মা কাজ কারবার সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র নিয়ে বারেবারে ঘরে আসছিলেন আর যাচ্ছিলেন। অতটা সময় যে আমি ওই ঘরে বসে থাকলাম, অ্যান্ডারসনের বোন না একবার আমার দিকে তাকাল, না একটা কথা বলল। সামান্য একটা দুটো ভদ্রতার কথাও না। অভদ্রের মতন ঠোঁট টিপে আমার দিকে পিছন ফিরে বসে রইল। এই ঘটনার পর প্রায় বছরখানেক ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে সে সামাজিক মেলামেশা শুরু করেছে। ওর সঙ্গে আবার দেখা হলো মিসেস হোলফোর্ডের এক পার্টিতে। আমি তো তাকে চিনতেই পারিনি। কিন্তু সে নিজে এগিয়ে এসে বলল যে আমাকে সে চেনে। শুধু তাই না, যেভাবে আমার দিকে তাকাল, কথা বলল, হাসল, তাতে আমার তো অবস্থা শোচনীয়। কোনদিকে তাকাব সেটাই বুঝতে পারছি না। এমন অবস্থা যে মনে হচ্ছে যেন পুরো ঘরের সবাই নির্ঘাত আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে। এখন বুঝতে পারছি যে এই গল্প মিস ক্রফোর্ডের কানেও এসে পৌঁছেছে।“

“যাই বলো না কেন, গল্পটা কিন্তু দারুণ মজার। তবে এটাও সত্যি যে এতে মিস অ্যান্ডারসনের সম্মান খুব একটা বাড়ে না। এরকম ভুল খুবই দেখা যায়। মায়েরা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি যে তারা তাদের মেয়েদের কীভাবে বড় করে তুলবে। ঠিক কোথায় যে ভুলটা হচ্ছে সেটা আমি বলতে পারব না। আর লোকজনকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ভানও করব না। কিন্তু অনেকেরই যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।“  

“আর মেয়েদের জন্য আদর্শ ব্যবহার কেমন হওয়া উচিৎ, সেটা যারা দেখিয়ে দিচ্ছেন, তারা খুবই ভালো একটা কাজ করছেন”, টম খুব ভদ্রভাবেই কথাটা বলল।

এডমন্ড এবার একটু রুঢ়ভাবেই বলে উঠল, “হ্যাঁ, এই ভুলটা খুব স্পষ্ট। এরকম মেয়েরা বড়ই হয়েছে ভুল শিক্ষা পেয়ে। শুরু থেকেই। ওরা প্রথম থেকেই বড্ড দেখানেপনা করে। সত্যিকারের ভদ্রতা বলতে এদের কিছুই নেই। সামাজিক মেলামেশা শুরু করার আগেও না, পরেও না।“

একটু দ্বিধান্বিত হয়ে মিস ক্রফোর্ড বলল, “সে আমি জানি না। তবে এই ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। যদিও পুরো ব্যাপারটা ভীষণ শালীনতার সঙ্গে হওয়ার কথা তবুও দেখা যায় যেসব মেয়ে সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে শুরু করেনি, তারাও এমন নাক উঁচু আর স্বাধীন হাবভাব দেখায়, যেন সামাজিক মেলামেশা করতে শুরু করে দিয়েছে। আমি এরকম অনেক দেখেছি। এটাই সবথেকে খারাপ লাগে – একেবারেই অশোভন এটা।“

টম বলল, “হ্যাঁ, সেটা সত্যিই ভারী ঝামেলার ব্যাপার। তার ফলে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়, বুঝতেই পারে কী করা উচিত। মাথা ঢাকা টুপি, শান্তশিষ্ট ভঙ্গি যেটা তুমি খুব নিখুঁতভাবে বর্ণনা করলে, এসব দেখলে সবাই বুঝে যায় ওই মেয়েটার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত বা মেয়েটার থেকে কেমন ব্যবহার আশা করা যায়। এসব না থাকার কারণেই গতবছর আমি এক বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলাম। গতবছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ফেরার পরের ঘটনা। সেপ্টেম্বর মাসে সপ্তাহ খানেকের জন্য আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রের ধারে একটা ভিলা - র‍্যামসগেটে ঘুরতে গিয়েছি। এডমন্ড, তুমি আমার বন্ধু স্নেইডের নাম তো শুনেছ। ওখানে স্নেইডের বাবা-মা, দুই বোন সবার সঙ্গেই আমার প্রথমবারের মতন আলাপ হলো। একদিন আমরা যখন অ্যালবিয়ন প্লেস বলে জায়গাটায় পৌঁছলাম, তখন ওরা কেউই সেখানে ছিল না। পরে যখন সমুদ্রের ধারে জেটিতে গেলাম তখন দেখি ওখানে ওদের সবাই রয়েছে। মিসেস স্নেইড, তাঁর দুই মেয়ে ছাড়াও তাঁদের কয়েকজন পরিচিত লোকজন। আমি ভদ্রভাবে সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম। যেহেতু মিসেস স্নেইড কয়েকজন পুরুষ পরিবেষ্টিত ছিলেন, তাই আমি ওঁর এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। মেয়েটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার সময় যতোটা সম্ভব ভদ্রভাবে কথাবার্তা বললাম। মেয়েটাও খুব সাবলীল। আমার কথা শুনল, আমার সঙ্গে সহজভাবে গল্প করল। আমার তো একবারও মনে হয়নি যে আমি কোনও ভুল করছি। দুই বোনকে প্রায় একই রকম দেখতে। দুজনেই পরিপাটি সাজগোজ করা, সুন্দর পোশাক, মাথা ঢাকা, হাতে ছাতা – যেমন সাধারণত হয় আর কী! কিন্তু পরে আমি জানতে পারলাম যে আমি দুই বোনের মধ্যে ছোট বোন মিস অগাস্টার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। আর সেই মেয়ে নাকি সামাজিক মেলামেশা শুরুই করেনি। আর তার ফলে বড় বোন মিস স্নেইড গেল মারাত্মক ক্ষেপে। এমন কী এরপরের মাস ছয়েকও আমার ওর সঙ্গে কথা বলাই উচিৎ ছিল না। আর বড় বোন মিস স্নেইড তো মনে হয় আজও আমাকে ক্ষমা করেনি।“

“নাহ, খুবই বাজে হয়েছে ব্যাপারটা। বেচারি মিস স্নেইড! আমার কোনো ছোট বোন নেই, তাও মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। সময়ের আগে এমন অবহেলা পাওয়া সত্যিই কষ্টের। তবে পুরো দোষ কিন্তু মায়েরই। মিস অগাস্টার তো গভর্নেসের সঙ্গেই থাকা উচিত ছিল। সামাজিক মেলামেশা শুরু করেনি, অথচ এমন হাবভাব যেন মেলামেশা শুরু করেছে, এরকম হলে এর ফল কখনই ভালো হয়না। আচ্ছা, এখন বলো তো, মিস প্রাইসের ব্যাপারটা কী? ও কি বল নাচের আসরে যায়? সব জায়গায় খাওয়াদাওয়া করতে যায়? আমার দিদির বাড়িতেও ডিনারে যায়?”

“না, আমার মনে হয়না ও এখনও পর্যন্ত কোনও বল নাচের আসরে গিয়েছে। মা নিজেও খুব একটা বাইরে কোথাও যান না। আর মিসেস গ্রান্টের বাড়িতে ছাড়া আর কোথাও খেতেও যান না। ফ্যানি তো সবসময় মায়ের সঙ্গে বাড়িতেই থাকে।“ এডমন্ড বলল।

“আচ্ছা, এবার পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। মিস প্রাইস তাহলে এখনও সামাজিক মেলামেশা শুরু করেনি।“