জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - দশম পর্ব

প্রথম পর্বের লিংক

দ্বিতীয় পর্বের লিংক

তৃতীয় পর্বের লিংক

চতুর্থ পর্বের লিংক

পঞ্চম পর্বের লিংক 

ষষ্ঠ পর্বের লিংক

সপ্তম পর্বের লিংক

অষ্টম পর্বের লিংক 

নবম পর্বের লিংক

দশম পর্ব

মিনিট পনেরো কুড়ি কেটে গেল। ফ্যানি এখনও একা একা নিরিবিলিতে বসে এডমন্ড, মিস ক্রফোর্ড আর নিজের কথা ভাবছে। কেউ এসে ব্যাঘাত করার নেই। এতক্ষণ ধরে যে একা রয়েছে, তাতে এবার ওর একটু অবাকই লাগছে। ওর একটু চিন্তান্বিত মন এখন ওদের পায়ের শব্দ আর গলার স্বর শোনার অপেক্ষা করতে শুরু করল। অবশেষে, পায়ের শব্দ আর কথা বলার আওয়াজ এল ওর কানে। তবে সেই শব্দ শুনে যখনই বুঝতে পারল যে ও যাদের পায়ের আর গলার শব্দ শোনার অপেক্ষায় রয়েছে, এরা তারা নয়, ঠিক তখনই মারিয়া, মিস্টার রাশওয়ার্থ আর মিস্টার ক্রফোর্ড ওর সামনে এসে হাজির হলো। যে পথ ধরে ফ্যানি নিজে এসেছে, সেই পথ ধরেই ওরাও এসেছে।   

“এ কী মিস প্রাইস, তুমি একেবারে একা যে! কী ব্যাপার?” সবাই জানতে চাইল। ফ্যানি সব কথা খুলে বলল। “ইশ, ফ্যানি! ওরা এটা একদম ঠিক করে নি। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলেই বরং ভালো হতো।“ ওর মাসতুতো বোন মারিয়া বলে উঠল।

তারপর মারিয়া মিস্টার ক্রফোর্ড আর রাশওয়ার্থ এই দুজনের মাঝে বসে আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল। জায়গাটার কী উন্নতি করা যায়, ওরা সেই বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করল ভারী উৎসাহের সঙ্গে। কিছুই চূড়ান্তভাবে ঠিক না হলেও হেনরি ক্রফোর্ডের মাথায় অনেক নতুন নতুন ধারণা আর পরিকল্পনা রয়েছে দেখা গেল। সাধারণভাবে, সে যা কিছুই বলছে, প্রথমে মারিয়া আর পরে মিস্টার রাশওয়ার্থ সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নিচ্ছে। মনে হচ্ছে, মিস্টার রাশওয়ার্থের একটাই কাজ, আর সেটা হচ্ছে, অন্যদের কথা শোনা। এমনিতে নিজে থেকে কিছু বলছেন না, শুধু একবার বললেন, তার বন্ধু স্মিথের বাড়িটা যদি সবাই একবার দেখত!

এই ভাবে বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল। লোহার দরজাটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মারিয়া বলে উঠল, “ইশ, যদি এই দরজাটা পেরিয়ে পার্কের ভিতরে যাওয়া যেত! তাহলে জায়গাটা সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার পরিকল্পনাটা আরও ভালোভাবে করা যেত।“ হেনরি ক্রফোর্ডও বলল, “সেটাই সবথেকে ভালো হতো। একমাত্র সেটা করলেই পুরো জায়গাটা সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ ধারণা তৈরি হতে পারে। ওই তো, দেখো, আধ মাইল দুরেও না, ওই যে একটা উঁচু টিলা মতন দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে পুরো বাড়িটা খুব ভালো করে দেখা যাবে। আমাদের ওই টিলায় উঠতেই হবে। আর সেটা করার জন্য এই দরজাটা পার করেই যেতে হবে। কিন্তু দরজাটা তো তালা বন্ধ করা!“ তাই শুনে মিস্টার রাশওয়ার্থ আফসোস করলেন এই বলে যে তিনি ভেবেছিলেন চাবিটা সঙ্গে নিয়েই আসবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনেন নি। এরপর থেকে তিনি যে আর কখনও চাবি ছাড়া এখানে আসবেন না, সেটাও বেশ জোরের সঙ্গে জানালেন। কিন্তু এসব কথা এখন তো আর কোনও কাজে আসছে না। তাই শেষ পর্যন্ত মারিয়ার যে কোনও উপায়ে ওই দরজা পেরিয়ে পার্কে ঢোকার এত ইচ্ছে দেখে মিস্টার রাশওয়ার্থ ঘোষণা করলেন যে তিনি এখনই গিয়ে চাবিটা নিয়ে আসবেন। যেমন বলা, তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে চাবি আনার জন্য রওনা দিলেন তিনি।

তিনি যেতেই হেনরি বলল, “এটাই ভালো হলো। আমরা ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে এতটা দূরে চলে এসেছে, তাই এটা করাই সবথেকে বড় কাজ হবে।“

“হ্যাঁ, এখন চাবি এনে এদিক দিয়ে পার্কে ঢুকে বাড়িটা বা জায়গাটা ভালো করে দেখা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই আমাদের। কিন্তু সত্যি করে বলো তো, জায়গাটা তুমি যেরকম হবে বলে ভেবেছিলে, তার থেকে অনেক বেশি খারাপ দেখছ, তাই না?”

“আরে না, না। বরং ঠিক তার উল্টো। যেমন ভেবেছিলাম জায়গাটা আমার তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর, বড় আর জমকালো বলে মনে হচ্ছে। জায়গাটার বেশ নিজস্ব একটা গঠন শৈলী আছে। হয়তো সেটা সবথেকে ভালো গঠন শৈলী, তা নয়, কিন্তু সেটাই যেন এই জায়গাটাকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে।“ এ কথা বলে হেনরি গলাটা একটু নামিয়ে বলল, “তবে আমার মনে হয় না আজকে আমি যত আনন্দ পাচ্ছি সথার্টনে এসে, ততোটা আনন্দ আমি আর কোনোদিন পাব। পরের গরমে এই জায়গাটা আমার আর সেরকম ভালো লাগবে না মোটেই।“

মুহূর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে মারিয়া উত্তর দিলো, “তুমি তো দুনিয়ার অনেক কিছু দেখেছ, কাজেই এটা যে সেই চোখেই দেখবে না, সেটা তো আর হয় না। যদি আর সবাই মনে করে যে সথার্টনের উন্নতি হয়েছে, তাহলে তুমিও নিশ্চয়ই সেরকমই ভাববে।“

“না, না, আমি অতটাও দুনিয়া দেখি নি। আর আমার তো মনে হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার জন্য সেটাই ভালো। আমি যেটা মনে করি সেটা এত সহজে বদলে যায় না। আর সত্যিকারের দুনিয়া যারা দেখেছে, তারা যতো সহজে অতীতের কথা ভুলে যেতে পারে, আমি কিন্তু অত সহজে পুরনো স্মৃতি ভুলে যাই না।“

এরপর কিছুক্ষণের জন্য একটু নিরবতা নেমে এল দুজনের মধ্যে। তারপর মারিয়া আবার বলে উঠল, “আজকে এখানে আসার পুরো রাস্তাটা তুমি বেশ উপভোগ করছিলে বলে মনে হচ্ছিল। তোমার আনন্দ দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। তুমি আর জুলিয়া বেশ হাসাহাসি করতে করতে এলে পুরো রাস্তাটা।“

“তাই বুঝি? আমরা হাসছিলাম? হবে হয়তো! এখন আমারও সেটাই মনে হচ্ছে যে আমরা দুজন মিলে বেশ মজা করতে করতে এলাম পুরো রাস্তাটা। কিন্তু আমরা কী নিয়ে যে এতো হাসাহাসি করছিলাম তার কিছুই এখন আর মনে করতে পারছি না আমি। ও হ্যাঁ, সম্ভবত আমার কাকুর পুরনো আইরিশ চাকরের কিছু মজার ঘটনা বলছিলাম। তোমার বোন হাসতে ভালোবাসে দেখলাম।“

“ও আমার থেকে বেশি মজা করতে পছন্দ করে বলে তোমার মনে হয়, তাই না?”

“হ্যাঁ, খুব ছোটখাটো ব্যাপারেই বেশ মজা পায়, তাই সঙ্গী হিসেবে ও বেশি ভালো, বুঝতেই তো পারছ। এই যে দশ মাইল রাস্তা গাড়ি চালিয়ে এলাম, এই সময়ে আমি যে আইরিস গল্প বলে তোমাকে হাসাতে পারতাম, সে আশাই আমি করতে পারি না।“

“এমনিতে আমি নিজেকে জুলিয়ার মতোই প্রাণবন্ত বলে মনে করি, কিন্তু এই মুহূর্তে নানান চিন্তা সমানে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।“

“তা তো বটেই। সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। এছাড়া কিছু কিছু পরিস্থিতিতে বেশি হাসাহাসি করলে সেটা খুব একটা ভালো দেখায় না। তবে তোমার পরিস্থিতি যা বুঝছি তাতে তো মন খারাপ করার কোনও যুক্তিই নেই। তোমার সামনে যা কিছু দেখছ, সবই সুন্দর।“

“কথাগুলো তুমি আক্ষরিক অর্থে বললে নাকি রূপকার্থে? আক্ষরিক অর্থে ধরলে আমি বলব, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। এই ঝকঝকে সূর্য আর পার্ক, দুটোই খুব সুন্দর। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই লোহার দরজা বা ওই নিচু গর্ত, যেটা দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে, এই দুটো দেখলেই আমার নিজেকে কেমন যেন বন্দি বন্দি বলে মনে হয়। সেই স্টার্লিং পাখিটা যেমন বলেছিল যে ও বাইরে বেরোতে পারছে না, সেরকমই আমার মনে হয় আমিও যেন কোথাও আটকা পড়েছি।“ ভীষণ আবেগ সহকারে কথা গুলো বলে মারিয়া লোহার দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। হেনরিও পিছন পিছন গেল। “ইশ, চাবিটা আনতে মিস্টার রাশওয়ার্থের এতো সময় লাগছে!”

“আর তুমি তো নিশ্চয়ই পৃথিবী উল্টে গেলেও চাবি ছাড়া, মিস্টার রাশওয়ার্থকে ছাড়া বাইরে বের হতে চাইবে না। যতই হোক, বাইরে বেরোতে গেলে মিস্টার রাশওয়ার্থের অনুমতি তো লাগবেই। এছাড়া তিনি সঙ্গে থাকলে মনে একটু বল ভরসাও পাবে, তাই না? নাহলে আমার মনে হয় আমি সাহায্য করলে তুমি একটু কষ্ট করে হলেও এখানে এই দরজার ধারের ফাঁক দিয়ে বেড়া গলে বাইরে যেতে পারো। অবশ্য তুমি সত্যিই যদি আরেকটু খোলামেলা জায়গায় যেতে চাও আর সেই যাওয়াটা নিষিদ্ধ বলে না মনে করো, তবেই সেটা সম্ভব।“

“নিষিদ্ধ! কী যা তা বলছ! আমি অবশ্যই এভাবে বের হতে পারব, আর হবোও। আমরা চোখের আড়াল হওয়ার আগেই মিস্টার রাশওয়ার্থ এক্ষুনি এসে যাবেন, দেখে নিও তুমি।“

“আর যদি আমাদের দেখা নাও যায়, ফ্যানি নিশ্চয়ই তাঁকে বলে দিতে পারবে আমাদের কোথায় পাওয়া যাবে। আমরা ওই টিলার কাছে ওক গাছের বাগানের কাছেই থাকব।“

পুরো ব্যাপারটা ফ্যনির খুব একটা ভালো লাগল না। তাই কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে ও পারল না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “যেও না মারিয়া! তুমি ব্যথা পাবে! ওই কাঁটাগুলো ফুটে যাবে নির্ঘাত। তোমার জামাকাপড় ছিঁড়ে যাবে, এমনকি ওই নিচু গর্তে পড়েও যেতে পারো। না গেলেই ভালো করবে তুমি।”

ফ্যানি এই কথাগুলো বলে চলেছে, এদিকে ওর মাসতুতো বোন মারিয়া ইতিমধ্যে বেশ নিরাপদেই বেড়ার অন্য দিকে চলে গিয়েছে। গিয়ে পেরিয়ে যেতে পেরেছে সেই আনন্দে বলে উঠল, “ফ্যনি, আমি কিন্তু বেড়া পেরিয়ে চলে এসেছি। আমার জামাকাপড় আর আমি নিজে, দুইই অক্ষত আর ভালো আছে। এখন আমি চললাম।“

ফ্যানি আবার একা হয়ে গেল। তবে ওর একটুও ভালো লাগছে না। যা কিছু শুনল বা দেখল, প্রায় সবকিছুর জন্যই ওর খারাপ লাগছে। একইসঙ্গে, যেমন মারিয়ার আচরণে অবাক লাগছে, তেমন মিস্টার ক্রফোর্ডের আচরণে রাগ হচ্ছে। ও দেখল, একটু ঘুরপথে, যেটা দেখে মনে হলো অযথা ঘুরপথ, সেটা ধরে ওরা দুজন টিলার দিকে এগিয়ে গেল। একটু পরে ফ্যানি আর ওদের দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ কারোর কোনও সাড়াশব্দও নেই, কাউকে দেখাও গেল না। কোনও সঙ্গী নেই, একদম একা। মনে হচ্ছে পুরো জঙ্গলে যেন ও একাই আছে। ওর একবার মনে হলো, এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ড হয়তো ওখান থেকে একেবারে চলেই গিয়েছে। তবে এডমন্ড যে ওর কথা একেবারে ভুলে যাবে, সেটা অসম্ভব। তাই এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ড হয়তো চলে গিয়েছে এই সম্ভাবনা মনে এলেও ঠিক বিশ্বাস করল না ফ্যানি।

গুমোট মন নিয়ে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ পায়ের শব্দে চমকে উঠল ফ্যানি। কেউ বড় রাস্তা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ও ভাবল হয়তো মিস্টার রাশওয়ার্থ, কিন্তু দেখা গেল জুলিয়া। গরমে হাঁপাচ্ছে। এসেই হতাশ চেহারায় বলে উঠল, “আরে! বাকিরা সব কোথায়? আমি তো ভাবলাম, মারিয়া আর মিস্টার ক্রফোর্ড তোমার সঙ্গেই আছে।”

ফ্যানি সব কিছু খুলে বলল।

“বাহ! বেশ কাণ্ড হয়েছে তো দেখি! কিন্তু কই, ওদের কোথাও দেখতে পাচ্ছি না তো আমি!” খুব আগ্রহ নিয়ে পার্কের দিকে তাকিয়ে জুলিয়া বলল। “তবে নিশ্চয়ই ওরা খুব দূরে যায় নি। আর আমার মনে হচ্ছে কারোর সাহায্য লাগবে না, আমি একাই মারিয়ার মতো বেড়ার ওদিকে যেতে পারব।”

“কিন্তু জুলিয়া, মিস্টার রাশওয়ার্থ তো এখনই চাবি নিয়ে চলে আসবেন। তুমি বরং একটু অপেক্ষা করো ওঁর জন্য।”

“মোটেই না। একটা সকালের পক্ষে আমি অনেক বেশি সহ্য করেছি এই বাড়ির লোকজনকে। উফ, মিসেস রাশওয়ার্থ কী ভয়ানক এক মহিলা রে বাবা! কোনমতে তাঁর খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছি। তুমি যখন এখানে মনের আনন্দে আরাম করে বসেছিলে তখন আমি ওই মহিলার সঙ্গ যন্ত্রণা সহ্য করছিলাম। আমার জায়গায় তুমি থাকলে হয়তো সবথেকে ভালো হতো, কিন্তু তা কেন হবে! তুমি তো সবসময় এরকম ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার ধান্দা করো।“

এতো বড় অন্যায় অভিযোগ শুনেও ফ্যানি খুব একটা পাত্তা না দিয়ে চুপ করেই থাকল। এখন যতই বিরক্ত থাকুক না কেন বা যতই ওর মেজাজ খারাপ থাকুক না কেন, ফ্যানির মনে হলো খুব বেশিক্ষণ জুলিয়ার মন মেজাজ এরকম থাকবে না। তাই একটু চুপ করে থেকে শুধু জানতে চাইল, “মিস্টার রাশওয়ার্থকে দেখলে নাকি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখলাম তো। এমন তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিলেন যেন জীবন মরণ সমস্যা। কোনমতে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন যে তিনি কোন কাজে যাচ্ছেন আর তোমরা কোথায় আছ।“

“ইশ, শুধু শুধু এতো কষ্ট করছেন তিনি! বড্ড খারাপ লাগছে।“

“সে মারিয়া বুঝুক গে যাক। ওর দোষের জন্য আমি নিজেকে শাস্তি দিতে পারব না। আমাদের ঝামেলার চূড়ামণি মাসি যতক্ষণ এই বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে ভ্যাজরভ্যাজর করছিল, ততক্ষণ তো আমি কিছুতেই মিসেস রাশওয়ার্থকে এড়াতে পারছিলাম না। তবে ওঁর ছেলের খপ্পর থেকে বেরবোই আমি।“  

এসব বলে জুলিয়া তক্ষুনি হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে বেড়া ভেদ করে অন্যদিকে চলে গেল। তারপর ও মিস ক্রফোর্ড আর এডমন্ডকে দেখেছে কী না, ফ্যানির এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই হাঁটা লাগাল। অন্য সময় হলে ফ্যানি এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ডের এতক্ষণ না থাকার ব্যাপারে চিন্তায় পড়ে যেত। কিন্তু এখন মিস্টার রাশওয়ার্থ এলে ও কী বলবে সেই ভেবে এতো অস্বস্তি হতে লাগল যে এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ডের দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে আর ভাবার সুযোগ পেল না। ভদ্রলোকের সঙ্গে বড্ড বাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ওর মনে হচ্ছে। জুলিয়া চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর যখন মিস্টার রাশওয়ার্থ ফিরে এলেন তখন যতই নরম করে সব কিছু বর্ণনা করুক না কেন, সেসব বর্ণনা করতে ফ্যানির খুবই খারাপ লাগছিল। সবকিছু শুনে স্বাভাবিক কারণেই মিস্টার রাশওয়ার্থ যথেষ্ট আহত আর বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো। প্রথমে কিছুই বললেন না। শুধু তাঁর মুখে চরম বিস্ময় আর বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। তারপর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, যেন কী করবেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

“ওরা আমাকে এখানেই থাকতে বলে গিয়েছে। মারিয়া বলেছে আমি যেন আপনাকে জানাই যে ওদের ওই টিলার কাছে বা তার ধারে কাছেই কোথায় পাওয়া যাবে।“

“আমার মনে হয় না যে আমি আর যাব। ওদের তো দেখতে পাচ্ছি না। আমি যতক্ষণে ওই টিলার কাছে পৌঁছব, ততক্ষণে ওরা আবার অন্য কোথাও চলে যাবে হয়তো। এমনিতেই আমি অনেক হাঁটাহাঁটি করে ফেলেছি।“ গম্ভিরভাবে একথা বলে ফ্যানির পাশে বসে পড়লেন তিনি।

“ভারী দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। খুব খারাপ লাগছে আমার।“ শুধু এই কথা বলে চুপ করলেও পরিস্থিতি সহজ করার মতন আরেকটু সহানুভূতির কিছু বলতে পারলে ফ্যানির ভালো লাগত।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তিনি বললেন, “ওরা তো আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারতো!”

“মারিয়া ভেবেছিল আপনি ওর পিছনপিছন যাবেন নিশ্চয়ই।“

“কিন্তু ও যদি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করত, তাহলে তো আর ওর পিছনপিছন যাওয়ার দরকার পড়ত না!”

এটা তো অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তাই ফ্যানি চুপ করে গেল। আরেকটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, “আচ্ছা মিস প্রাইস আপনি বলুন তো, মিস্টার ক্রফোর্ডের এই যে এত এত ভক্ত, আপনিও কি তাদের মধ্যে একজন নাকি? আমার দিক থেকে বললে আমি তো এটাই বলব যে লোকটার মধ্যে আমি কিছুই দেখতে পাই না।“

“কই না তো! আমার তো ওকে সেরকম সুদর্শন বলেও মনে হয় না।“

“সুদর্শন! কী যে বলেন। এমন বেঁটে লোককে কেউই সুদর্শন বলবে না। লোকটার উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চিও না। আমার তো মনে হয় ওর উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির বেশি কিছুতেই হতে পারে না। আমার এটাও মনে হয় যথেষ্ট বাজে দেখতে ওকে। আমার মতে এই ক্রফোর্ড ভাইবোন দুজন না এলেই ভালো হতো। ওদের ছাড়াই আমরা বেশি ভালো ছিলাম।“

একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ফ্যানির। কিন্তু এর বিরোধিতা করে যে ও কী বলতে পারে তা ওর জানা নেই।

“যদি চাবি আনার ব্যাপারে আমি কোনও গড়িমসি করতাম, তাহলেও নাহয় একটা কথা ছিল। কিন্তু ও বলামাত্রই তো আমি ছুটে গেলাম চাবিটা আনতে।“

“সত্যিই আপনার ভদ্রতার জবাব নেই। আর আমি এটাও জানি যে আপনি যতোটা দ্রুত সম্ভব হেঁটে গিয়েছেন। কিন্তু এই জায়গাটা থেকে বাড়িটা বেশ কিছুটা দূরে তো বটেই। আর মানুষ যখন অপেক্ষা করে, তখন তাদের সময়ের হুঁশ জ্ঞান থাকে না। তখন তিরিশ সেকেন্ডকেও পাঁচ মিনিট বলে মনে হয়।“

তিনি উঠে গিয়ে আবার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আর আফসোস করলেন যে যদি তখনই তাঁর কাছে চাবিটা থাকত, তাহলে কত ভালো হতো। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে ফ্যানির মনে হলো মিস্টার রাশওয়ার্থের ক্ষোভ হয়তো একটু কমেছে। তাই ও আরেকবার চেষ্টা করল। “আপনি ওদের সঙ্গে যোগ দিলে সত্যিই ভালো হতো। ওরা সবাই মিলে পার্কের অন্যদিক থেকে বাড়িটাকে আরও ভালো করে দেখতে চাইছে যাতে কী করলে বাড়িটা আরও সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে তোলা যায় সেটা বোঝা যায়। বুঝতেই তো পারছেন, সেটা আপনাকে বাদ দিয়ে ঠিক সম্ভব নয়।

এবার ফ্যানি উদ্দেশ্য সফল হলো। মিস্টার রাশওয়ার্থের মনে হোল ফ্যানি ঠিকই বলছে। তাই তিনি আর ওখানে বসে না থেকে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন। “হুঁ, সত্যিই যদি আপনার মনে হয় যে আমার যাওয়াই ভালো, তাহলে সেটা করাই ভালো হবে মনে হচ্ছে। এমনিতেও যে চাবিটা যখন আনলামই, তখন এটা কাজে না লাগানোটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।“ একথা বলে তিনি চাবি দিয়ে তালা খুলে চুপচাপ চলে গেলেন।   

এখন ফ্যানির মন শুধু তাদের দু’জনের দিকেই পড়ে রইল, যারা তাকে অনেকক্ষণ আগেই ফেলে চলে গিয়েছে। অধৈর্য হয়ে এবার ও ওই দুজনকে খুঁজতে যাবে বলে ঠিক করল। ওরা যেদিক দিয়ে গিয়েছে, ও সেই নিচের রাস্তা ধরেই এগোল। হাঁটতে হাঁটতে যেই না আরেকটা রাস্তায় মোড় নিল, ঠিক তখনই মিস ক্রফোর্ডের হাসি আর গলা কানে এল। গলার শব্দ শুনে আরেকটু এগোতেই ওদের দেখা গেল। ওরা সবেমাত্র পার্ক থেকে আবার জঙ্গলে ফিরে এসেছে। ফ্যানিকে রেখে এগিয়ে যাওয়ার একটু পরেই পার্কের ধারে আরেকটা খোলা দরজা ছিল, যেটা দেখে সেখান যাওয়া থেকে ওরা আর নিজেদের আটকে রাখতে পারে নি। পার্ক পেরিয়ে ওরা এমন একটা রাস্তায় এসে পৌঁছেছে যেখানে আসার জন্য ফ্যানি সকাল থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। ওরা ওখানে গাছপালার নিচে বসে সময় কাটাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ওরা দুজনে এতটা ভালো সময় কাটাচ্ছে যে সময়ের কোনও হুঁশ নেই। ফ্যানিকে দেখা মাত্র এডমন্ড বলে উঠল, “আরে, তোমার কথাই ভাবছিলাম। আমি তোমাকে ডেকে আনব বলে ভাবছিলাম, কিন্তু তুমি এতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলে বলে শেষ পর্যন্ত আর ডাকতে গেলাম না।“ এডমন্ডের বলা এই কথাটাই ফ্যানির জন্য সবথেকে বড় সান্ত্বনার প্রলেপ। কিন্তু ওকে যে এক ঘণ্টা ধরে একা একা অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেই কষ্ট কি সহজে দূর হয়! এডমন্ড তো বলেছিল, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য যাবে! একা এতক্ষণ অপেক্ষা করার কষ্টও যেমন কমলো না, তেমন ওরা এতক্ষণ কী নিয়ে কথা বলেছে, সেটা জানার জন্য ওর ভিতরে যে কৌতূহল জেগে উঠেছে, সেটাও কমলো না। সব মিলিয়ে ওর আর একদমই ভালো লাগছে না। এরপর ওরা ঠিক করল বাড়ির দিকে ফিরে যাবে, কিন্তু ফ্যানির মনটা ভার হয়ে রইল।   

সিঁড়ির নিচে পৌঁছাতেই দেখা গেল ঘণ্টা দেড়েক ঘরে সময় কাটিয়ে মিসেস রাশওয়ার্থ আর মিসেস নরিস সবে বাইরে বের হচ্ছেন। মিসেস নরিস এতক্ষণ একাজ সেকাজে এতো ব্যস্ত ছিলেন যে এর আগে ঘরের বাইরে বেরোনোর সময় পাননি। তাঁর বোনঝিদের হয়তো ভালো লাগে নি, কিন্তু তিনি আজকের সকালটা ভারী আনন্দে কাটিয়েছেন। বাড়ির ফেজান্ট পাখি নিয়ে অনেক আলোচনার পর কাজের মেয়েটা তাঁকে গোয়ালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ওদের গরুগুলোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, বিখ্যাত ক্রিম চিজ কী করে বানাতে হয় সেটা জেনেছেন। জুলিয়া চলে যাওয়ার পর মিসেস নরিস বাগানের মালিকে ডেকেও অনেক গল্প করেছেন। মালির নাতিটার জ্বর এসেছে। তাই শুনে মিসেস নরিস তাকে বুঝিয়েছেন যে এটা নিশ্চয়ই ম্যালেরিয়া। জ্বর সারানোর জন্য তিনি একটা তাবিচের ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও কথা দিয়েছেন। ফলে ভারী খুশি হয়ে মালি মিসেস নরিসকে নিজের পছন্দের বাছাবাছা ফুলের গাছ দেখিয়েছে, আর তারপর একটা ফুলগাছের চারাও উপহার দিয়েছে।  

এমন সময় সবাই একে একে বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করল। বাকি সবাই না আসা পর্যন্ত আর রাতের খাবারের ডাক না আসা পর্যন্ত সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে, Quarterly Reviews পত্রিকা পড়ে তাদের সময় বেশ ভালোই কাটছে। দুই বার্ট্রাম বোন, মিস্টার রাশওয়ার্থ আর মিস্টার ক্রফোর্ড বেশ দেরি করেই ফিরল। চেহারা দেখে মনে হলো ওদের এতো ঘোরাঘুরি খুব একটা কাজের হয় নি। কোনও কিছুতেই ওরা একমত হতে পারে নি। তাই যে উদ্দেশ্যে ওদের আজ সারাদিন এতো ঘোরাঘুরি তা সফল হয় নি। ওরা যা বলল, তাতে মনে হলো ওরা শুধুমাত্র একে অপরের পিছন পিছন হেঁটেছে। ফ্যানির মনে হলো, শেষ পর্যন্ত ওরা যখন একটা জায়গায় জড়ো হতে পেরছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। না ওদের মধ্যে আবার আগের ভাব ভালোবাসা ফিরেছে, না এই জায়গাটা কী করে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যাবে তা নিয়ে ওরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। ফ্যানির নিজের মনটা তো খারাপ ছিলই। এবার জুলিয়া আর মিস্টার রাশওয়ার্থের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, ও একাই কষ্ট পাচ্ছে, তা নয়। ওদের দুজনের মুখেই অসন্তোষের ছাপ। বরং অন্যদিকে মারিয়া আর মিস্টার ক্রফোর্ড অনেক বেশি হাসিখুশি। রাতের খাবার খাওয়ার সময় মিস্টার ক্রফোর্ডকে দেখে ফ্যানির মনে হলো সে বাকি দুজনের ক্ষোভ কমিয়ে একটু খুশির পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে।

রাতের খাবারের পরপরই চা আর কফি এলো। দশ মাইল রাস্তা গাড়ি চালিয়ে ফিরতে হবে। তাই নষ্ট করার মতন সময় নেই। যতক্ষণ না গাড়ি এসে দরজায় দাঁড়াল ততক্ষণ ছোটখাটো ব্যস্ততায় সময় কেটে গেল। এদিকে মিসেস নরিস ঘুরে ঘুরে বাড়ির কাজের মহিলার কাছ থেকে কিছু ফেজান্ট পাখির ডিম আর একটুকরো ক্রিম চিজ জোগাড় করলেন, মিসেস রাশওয়ার্থকে ভালো ভালো অনেক কথা বললেন, আর ফেরার জন্য তৈরি হলেন। ঠিক এমন সময় মিস্টার ক্রফোর্ড জুলিয়ার কাছে এসে বলল,
“যদি না তুমি খোলা আসনে বসে সন্ধ্যার হাওয়াকে ভয় পাও, তাহলে আশা করি তুমি আমার সঙ্গেই বসবে তো?” এরকম অনুরোধের সম্ভবনা আগে থেকে ভাবে নি ঠিকই, কিন্তু জুলিয়া এই আমন্ত্রণ খুব খুশির সঙ্গে গ্রহণ করল। ওর মনে হলো, দিনের শুরুটা যেমন সুন্দর করে শুরু হয়েছিল, শেষটাও সেরকম সুন্দর করেই হবে। মারিয়া মনে মনে অন্য কিছু আশা করেছিল, তাই একটু হতাশই হলো। তবে মিস্টার ক্রফোর্ড যে আসলে ওকেই বেশি পছন্দ করছে, সেটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিল। বিদায় কালে মিস্টার রাশওয়ার্থ মারিয়াকে যেরকম মনোযোগ দিলেন, সেটাও মারিয়া বেশ খুশি মনেই গ্রহণ করল। মিস্টার রাশওয়ার্থ মারিয়াকে গাড়ির সামনে খোলা জায়গায় বসানোর বদলে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে একটু শান্তি পেলেন।

গাড়ি পার্কের মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করল। এবার মিসেস নরিস ফ্যানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তাহলে ফ্যানি, আজকের দিনটা তোমার তো খুব ভালো কাটল, তাই না? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু আনন্দ ছাড়া আর কিচ্ছু না! এই যে তোমাকে এখানে আসতে দেওয়া হলো, আমি জানি, সেজন্য তুমি তোমার মাসি লেডি বার্ট্রাম আর আমার কাছে নিশ্চয়ই খুব কৃতজ্ঞ থাকবে। আজকে তুমি অনেক আনন্দ করেছ।“

মারিয়ার মেজাজটা তখন এতটাই বেজার যে সোজাসুজি বলেই ফেলল, “আমার তো মনে হয়, আপনারই দিনটাই বরং বেশি ভালো কেটেছে। বেশ কোল ভরা জিনিসপত্র নিয়ে ফিরছেন। এদিকে একটা ঝুড়ি ভর্তি কী একটা রেখেছেন, বারেবারে আমার কনুইতে ধাক্কা দিচ্ছে।“

“আরে, ওটা সেরকম বিশেষ কিছু না। একটা ফুল গাছের চারা। ওই বাড়ির বুড়ো মালি কিছুটা জোর আমাকে দিল। কিন্তু ওটা রাখার জন্য তোমার তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আচ্ছা, যদি তোমার সেরকম অসুবিধা হয়, তাহলে নাহয় ওটা আমি আমার কোলে নিয়ে নিচ্ছি। ফ্যানি, তুমি এই ঠোঙাটা ধরো তো। দেখো, সাবধানে ধরো। পড়ে না যায়। রাতের খাওয়ার সময় যে অসাধারণ চিজ খেলাম, এটা সেই ক্রিম চিজ। মিসেস হুইটেকার আমাকে না দিয়ে ছাড়লেনই না। আমি তো কিছুতেই নেব না। শেষে ওর ছলছলে চোখ দেখে নিতেই হলো। তবে আমিও জানি, আমার বোন এটা পেয়ে ভীষণ খুশি হবে। ওই মিসেস হুইটেকার সত্যিই একজন মানুষের মতন মানুষ। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ওরা ঘরের কাজের লোকজন যে টেবিলে খেতে বসে সেখানে ওরা ওয়াইন খেতে পারে কিনা। আমার প্রশ্ন শুনে সে তো চমকে উঠল। এমন কী এটাও বলল যে কাজের মেয়েদের তো সাদা পোশাক পরারও অনুমতি নেই। শুধুমাত্র সাদা পোশাক পরার অপরাধে ও দু-দুটো কাজের মেয়েকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। চিজটা সাবধানে ধরো ফ্যানি। এবার আমি বাকি ঠোঙা আর ঝুড়িটা খুব ভালো মতোই সামলে নিতে পারব।“

“আর কী কী বাগিয়েছেন শুনি?” সথার্টনের যে এতো সুনাম করা হচ্ছে, তাতে কিছুটা খুশি হয়েই প্রশ্নটা করল মারিয়া।

“বাগানো! এ আবার কী কথা! বাগাবো কেন। এখানে তো সামান্য ফেজান্ট পাখির ডিম রয়েছে গোটা চারেক। এগুলো তো মিসেস হুইটেকার বেশ জোর করেই আমাকে গছিয়ে দিল। আমি যতই নিতে অস্বীকার করি না কেন, সে শুনলে তো! বলল, সে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে আমি একেবারে একা থাকি। আর এই পাখি পুষলে সেটা আমাকে খুব আনন্দ দেবে। আমিও জানি, সত্যিই সেটা হবে। আমি তোমাদের গোয়ালা মেয়েটাকে বলব এই ডিমগুলো প্রথমে যেন তোমাদের বাড়িতে এখন যে মুরগিগুলো ডিমে তা দিচ্ছে না, তাদের নিচে বসিয়ে রাখে। তারপর যদি বাচ্চা ফোটে তখন সেখান থেকে একটা খাঁচায় করে নিয়ে গিয়ে আমার নিজের বাড়িতে রাখব। এগুলোর দেখভাল করে আমার একা একা সময়টা খুব ভালো কাটবে। যদি কপাল ভালো থাকে, তাহলে তোমার মাকেও কয়েকটা দেব।“ 

সন্ধ্যাটা সত্যিই খুব সুন্দর। মৃদু আর শান্ত। গাড়িতে করে যেতে ঠিক ততোটাই ভালো লাগছে যতোটা ভালো লাগছে চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিন্তু মিসেস নরিস যখন চুপ করলেন তখন এক অদ্ভুত নিরবতা ছেয়ে গেল গাড়ির ভিতর। সবার মনই যেন ক্লান্ত। সারাটা দিন সত্যিই খুব আনন্দে কেটেছে নাকি কষ্টে, চুপ করে সবাই বোধহয় সেই চিন্তাতেই ডুব দিয়েছে।