জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - অষ্টম পর্ব

(৮)

শরীর স্বাস্থ্যের কারণেই ফ্যানির ঘোড়ায় চড়াটা প্রয়োজন। ওর সেই প্রয়োজনীয় ঘোড়ায় চড়া আবার পরের দিন থেকেই শুরু হলো। সেদিন সকালটা বেশ মনোরম। আগের কদিনের তুলনায় গরমটা কিছুটা কম। তাই এডমন্ড ভাবল যে এই কদিনে ফ্যানির শরীর আর মনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। সেদিন মিস্টার রাশওয়ার্থ যখন তার মাকে নিয়ে এলেন ফ্যানি তখনও বাইরে ছিল। মিস্টার রাশওয়ার্থ সৌজন্যর কারণে, বিশেষ করে সকলে মিলে তার বাড়ি সথার্টনে যাওয়ার পরিকল্পনাটা যাতে বাস্তবায়িত হয় সেজন্য এসেছেন। দিন পনেরো আগে এই সথার্টনে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে তিনি বাড়িতে ছিলেন না, তাই এই বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা আর বিশেষ এগোয় নি।

নতুন করে এই বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা আবার শুরু হওয়ায় মিসেস নরিস আর তাঁর বোনঝিরা তো ভারী খুশি। খুব তাড়াতাড়ি একটা দিন ঠিক করে ফেলা হলো। তবে শর্ত একটাই যে মিস্টার ক্রফোর্ডের যেন সেদিন কোনও কাজ না থাকে। তিনিও যেন যেতে পারেন। যদিও মিসেস নরিস জোর দিয়ে বললেন যে মিস্টার ক্রফোর্ড নিশ্চয়ই সেদিন যেতে পারবে, তবুও মিস্টার ক্রফোর্ডের থেকে যাচাই না করে মারিয়া আর জুলিয়া এই বিষয়ে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মারিয়ার ইঙ্গিতে মিস্টার রাশওয়ার্থ বুঝলেন যে এটাই সবথেকে ভালো হবে যদি তিনি একবার হেঁটে গির্জা বাড়িতে গিয়ে মিস্টার ক্রফোর্ডকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসাই করে নেন যে সথার্টনে যাওয়ার জন্য এই বুধবার তার সময় হবে কিনা!

মিস্টার রাশওয়ার্থ গির্জা বাড়ি থেকে ফেরার আগেই মিসেস গ্রান্ট আর মিস ক্রফোর্ড এই বাড়িতে এসে হাজির হলেন। যেহেতু ওরা বেশ কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে একটা অন্য রাস্তা ধরে এসেছে, তাই ওদের মধ্যে আর দেখা হয় নি। তবে আশার কথা একটাই যে গির্জা বাড়িতে গিয়ে মিস্টার রাশওয়ার্থের নিশ্চয়ই মিস্টার ক্রফোর্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সথার্টনে ঘুরতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তো অবশ্যই উঠল। আসলে মিসেস নরিস এই ব্যাপারে এতই উৎসাহী যে এই প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে কথা বলায় উপায়ও ছিল না। এদিকে মিসেস রাশওয়ার্থ মানুষটা বেশ ভদ্রতা ও সৌজন্যপূর্ণ। আবার একইসঙ্গে তিনি বড্ড পিছনে লেগে থাকতে পারেন আর একটু বেশি বাগাড়ম্বর করতে ভালোবাসেন। যেহেতু সবাই মিলে তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিষয়টা তাঁর নিজের সঙ্গে আর ছেলের সঙ্গে জড়িত, তাই আগুপিছু বিশেষ কিছু না ভেবেই তিনি তখনও লেডি বার্ট্রামকে সবার সঙ্গে সথার্টনে ঘুরতে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে চলেছেন। লেডি বার্ট্রাম যতই বারেবারে যেতে অস্বীকার করুন না কেন, মিসেস রাশওয়ার্থ তাঁর নরম গলার আপত্তি শুনতে রাজি নন। তাঁর মনে হচ্ছে মুখে না করলেও মনে মনে লেডি বার্ট্রাম হয়ত সথার্টনে ঘুরতে যেতে ইচ্ছুক। শেষ পর্যন্ত মিসেস নরিস একটু জোর গলায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে তব মিসেস রাশওয়ার্থকে বোঝাতে পারলেন যে লেডি বার্ট্রাম সত্যিই যেতে চান না।

“আমি আপনাকে বলছি শুনুন মিসেস রাশওয়ার্থ, এতটা যাওয়াআসা করার ক্লান্তিটা দিদির জন্য বড্ড বেশি হয়ে যাবে। আপনি তো জানেন, যেতে দশ মাইল, আসতে দশ মাইল। দিদি এবার আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না, সেটা আপনাকে ক্ষমা করতেই হবে। দিদিকে বাদ দিয়ে আমি আর আমার দুই বোনঝি যাব, সেটাই আপনাকে মেনে নিতে হবে। এত দূরে হওয়া সত্ত্বেও সথার্টনই একমাত্র জায়গা যেখানে দিদির যাওয়ার ইচ্ছে হতে পারত, কিন্তু দিদির পক্ষে যাওয়াটা সত্যিই সম্ভব নয়। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, ফ্যানি থাকছে তো, দিদির দেখাশোনার কোনও অসুবিধা হবে না। এডমন্ড এখন এখানে নেই, তবে ওর হয়ে আমি নিশ্চিত করে বলছি যে খুব খুশি হয়েই সবার সঙ্গে ও সথার্টনে ঘুরতে যাবে। ও তো নিজের ঘোড়ায় চড়েই যেতে পারবে।“

লেডি বার্ট্রাম বাড়িতেই থাকবেন এটা শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেও মিসেস রাশওয়ার্থের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি বললেন, “লেডি বার্ট্রাম যে যেতে পারবেন না, সেটা জেনে বড্ড খারাপ লাগছে। আর মিস প্রাইসও এলে খুব ভালো লাগত। ও তো কখনও সথার্টনে আসে নি। তাই ওর না আসাটা ভারী দুঃখজনক।“ 

“আপনার দয়ার শরীর, মিসেস রাশওয়ার্থ। কিন্তু ফ্যানির দিক থেকে দেখতে গেলে ও তো পরেও অনেক সুযোগ পাবে সথার্টন ঘুরতে যাওয়ার। পরে সময় করে যাবেখন। কিন্তু এখন ওর পক্ষে যাওয়াটা প্রশ্নের অতীত। দিদি ওকে এখন কিছুতেই ছাড়তে পারবে না।“ মিসেস নরিস জোর গলায় বলে উঠলেন।

“না, না, এখন সত্যিই ফ্যানিকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলবে না আমার। “

মিসেস রাশওয়ার্থ ধরেই নিয়েছেন যে সবাই সথার্টনে ঘুরতে যেতে চায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে তিনি এবার সবাইকে, এমন কী মিস ক্রফোর্ডকেও আমন্ত্রণ জানালেন। মিসেস রাশওয়ার্থ এলাকায় এসেছে জেনেও মিসেস গ্রান্ট এর আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন নি। এখন তিনি খুব বিনীত ভাবে সথার্টনে যাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। তবে তাঁর বোন মেরি সথার্টনে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। মিসেস রাশওয়ার্থের পিড়াপীড়িতে মেরির যেতে রাজি হওয়া দেখে মিসেস গ্রান্ট বেশ খুশিই হলেন। মিস্টার রাশওয়ার্থ গির্জা বাড়ি থেকে ফিরে জানালেন যে তিনি মিস্টার ক্রফোর্ডকে সথার্টনে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করাতে পেরেছেন। মিসেস রাশওয়ার্থ আর তাঁর ছেলে ফিরে যাওয়ার ঠিক আগে এডমন্ড বাড়ি ঢুকে সামনের বুধবারের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পারল। তারপর ও মিসেস রাশওয়ার্থকে তাঁর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে অন্য দুই মহিলার সঙ্গে পার্কের মাঝামাঝি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল।

বাড়িতে আবার ফিরে এসে এডমন্ড দেখে মিসেস নরিস এটা বোঝার চেষ্টা করছেন যে ওদের সবার সঙ্গে মিস ক্রফোর্ডের যাওয়াটা আদৌ সুবিধাজনক হবে কিনা। সেক্ষেত্রে তার দাদার বারোচ গাড়িতে যথেষ্ট জায়গা হবে কিনা। মারিয়া আর জুলিয়া এই কথা শুনে হেসে জানাল যে বারোচে চারজন খুব ভালোভাবে বসতে পারে, এমনকি চাইলে একজন কেউ সামনে মিস্টার ক্রফোর্ডের পাশের আসনে বসেও যেতে পারে।

“কিন্তু, এটা করার দরকারটাই বা কী? এমন তো নয় যে শুধু মিস্টার ক্রফোর্ডের গাড়িতেই যাওয়া যেতে পারে। আমাদের মায়ের যে চেইস গাড়িটা আছে, তাতেও তো তিনজন বসতে পারে। সেই গাড়িটাই বা নেওয়া হবে না কেন? আগের দিন যখন আমাদের এই পারিবারিক ঘুরতে যাওয়ার কথাটা প্রথম উঠল, আমি তখনও এটা বুঝতে পারি নি যে পারিবারিক ভ্রমণ কেন আমাদের পারিবারিক গাড়িতে করা হবে না।“ এডমন্ড বলল।

“কি বলছো! যেখানে আমরা বারোচে আরাম করে বসে যেতে পারি সেখানে এই গরমে তিনজন মিলে গাদাগাদি করে ছোট একটা চেইস গাড়িতে বসে যাব? না এডমন্ড, এটা ঠিক হবে না।” জুলিয়া বলল অবাক স্বরে।

এবার মারিয়াও বলে উঠল, “আর তাছাড়া, আমি জানি মিস্টার ক্রফোর্ড আমাদের নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই করেছে। একবার যখন সেই হিসেবে কথা হয়েছে তখন সে তো এটাকে কথা দিয়েছে বলেই ধরে নেবে।”

“আর বাবা এডমন্ড, একটা গাড়িতেই যদি কাজ চলে যায়, তাহলে দুটো গাড়ি নেওয়া মানে অকারণ ঝামেলা ছাড়া আর কী! এছাড়া আরেকটা কথা, এটা শুধু আমাদের নিজেদের মধ্যে থাকলেই ভালো যে আমাদের গাড়ির কোচম্যান সথার্টনের রাস্তাটা একেবারেই পছন্দ করে না। সবসময় ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে যে সরু গলিতে ওর গাড়িতে আঁচড় লেগে যায়। আর তুমি তো জানোই স্যর থমাস বাড়ি ফিরে এসে যদি দেখেন যে তাঁর গাড়িতে নানান জায়গায় আঁচড় লেগে পালিশ উঠে গিয়েছে, তাহলে সেটা আমাদের কারোরই ভালো লাগবে না।“ মিসেস নরিস যোগ করলেন।

“তবে যদি শুধুমাত্র সেই কারণেই মিস্টার ক্রফোর্ডের গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা হয় তাহলে সেটা খুব একটা ভালো কথা নয় অবশ্য। সত্যি কথা এটাই যে উইলকক্সের বয়স হয়ে গিয়েছে, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম। ও জানেই না কী করে গাড়ি চালাতে হয়। যে সরু রাস্তায় যাওয়ার জন্য বুধবার আমাদের যে কোনও অসুবিধা হবে না, সেটা আমি জোর গলায় বলতে পারি।“ মারিয়া বলল।

“তাহলে তো বারুচ গাড়িতে যাওয়াটা একেবারেই কষ্টের বা অস্বস্তির কিছু হবে না। সেক্ষেত্রে আমি বরং ওই গাড়িতে মিস্টার ক্রফোর্ডের পাশে বসেই চলে যাব।“ এবার এডমন্ড বলল।

“অস্বস্তিকর! কী যে বলো! অস্বস্তিকর কেন হবে, বরং আমার তো মনে হয় সাধারণত সবাই ওই গাড়ির চালকের পাশের জায়গাটাই সবথেকে ভালো বসার জায়গা বলে মনে করে। চারপাশটা দেখতে দেখতে যাওয়ার জন্য ওই আসনের কোনও তুলনা নেই। হয়তো দেখা যাবে যে মিস ক্রফোর্ড নিজেই ওই আসন বেছে নেবে।“ চেঁচিয়ে বলে উঠল মারিয়া।

“তাহলে তো তোমাদের সঙ্গে ফ্যানির যাওয়ার কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তোমাদের পাশে নিশ্চয়ই ওর জন্যও জায়গা থাকবে।“

“ফ্যানি! বাবা এডমন্ড, ফ্যানির তো আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কথাই হয় নি। ও তো ওর মাসির সঙ্গে এখানেই থাকবে। আমি তো মিসেস রাশওয়ার্থকে সে কথাই বলে দিয়েছি। ফ্যানি যাবে, সেটা উনিও আশা করছেন না।“ মিসেস নরিস বললেন।

এডমন্ড এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “ম্যাডাম, আপনার নিজের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া আর তো কোনও কারণ তো থাকতে পারে না ওকে এখানে রেখে দেওয়ার। ওকে ছাড়া যদি আপনার বিশেষ অসুবিধে না হতো তাহলে ওকে নিশ্চয়ই বাড়িতে রেখে দেওয়ার কথা বলতেন না আপনি?” 

“একদমই বলতাম না। তবে একথা সত্যি যে ওকে ছাড়া আমার বেশ অসুবিধা হবে।“

“আমি থাকলে তো আর কোনও অসুবিধা হবে না, তাই না? সেক্ষেত্রে, আমিই বরং থেকে যাব।“

একথা শুনে সবাই মিলে চেঁচামেচি জুড়ে দিল। এডমন্ড তাও থামল না। বলে চলল, “আরে, আমার যাওয়ার তো কোনও দরকার নেই। তাই আমি বাড়িতেই থাকব বলে ঠিক করলাম। ফ্যানির খুব শখ সথার্টন জায়গাটা দেখার। আমি জানি। এরকম আনন্দের সুযোগ ও খুব কমই পায়, আর আমি নিশ্চিত, মা, আপনি নিশ্চয়ই ওকে এই আনন্দটা দিতে চাইবেন?"

“অবশ্যই, অবশ্যই। ওর মাসির যদি কোনও আপত্তি না থাকে তাহলে আমি খুব খুশি হয়েই রাজি হব।“

একমাত্র যে কারণে এই ব্যাপারে আপত্তি করা যায়, মিসেস নরিস সেই একমাত্র আপত্তির কারণটা সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরলেন। তাঁরা যে মিসেস রাশওয়ার্থকে আগেভাগেই বলে দিয়েছেন যে ফ্যানি যেতে পারবে না, তাই এখন ফ্যানিকে নিয়ে গেলে সেটা ভারী অদ্ভুত দেখাবে, সেকথা বললেন। আর এটা এমন একটা সমস্যা যেটা মানিয়ে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। পুরো ব্যাপারটাই শুধু যে খুব অদ্ভুত দেখাবে টা নয়, ভারী অশোভনও দেখাবে। মিসেস রাশওয়ার্থের প্রতি একরকম অসম্মানই দেখানো হব বলা চলে। যেখানে মিসেস রাশওয়ার্থের ব্যবহার এতো ভদ্র, সেখানে তাঁর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করাটা খুবই অশোভন।

আসলে, মিসেস নরিসের না আছে ফ্যানির প্রতি কোনও ভালোবাসা, না আছে কখনই ফ্যানিকে আনন্দ পেতে দেওয়ার কোনও ইচ্ছে। এখন তিনি সব কিছু ছেড়ে এডমন্ডের কথার বিরোধিতা কিছুটা এজন্যই করছেন যে এটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি সবকিছু এত ভালোভাবে পরিকল্পনা করেছেন যে সেই পরিকল্পনার সামান্য অদলবদল হলেও সেটা ভালো তো হবেই না, বরং খারাপ হবে। এত কথা বলার পর মিসেস নরিস একটু ঠাণ্ডা হলে এডমন্ড মিসেস নরিসকে জানালো যে ফ্যানির যাওয়ার ব্যাপারে মিসেস রাশওয়ার্থের কী মনে হবে সেটা ভেবে তাঁকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এডমন্ড যখন মিসেস রাশওয়ার্থকে সঙ্গে নিয়ে হল ঘর দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল, তখনই ফ্যানির যাওয়ার সম্ভবনার কথাটা তুলেছিল। আর মিসেস রাশওয়ার্থও যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে ফ্যানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কথাটা শুনে মিসেস নরিস ভীষণ বিরক্ত হলেন। তাই খুব একটা খুশি মনে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না। এখন বিশেষ কিছু না বলে শুধু বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, সেটা তো খুব ভালো কথা। তাহলে তোমার যা মনে হয় তাই করো, আমি শুধু এটুকু জানি যে আমি আর এই নিয়ে মাথা ঘামাতে পারছি না।“

“কিন্তু এটা ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক দেখাবে না, যে ফ্যানির বদলে তুমি বাড়িতে থাকবে?” মারিয়া বলল।

“ওর তো তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকা উচিত।“ কথাটা বলতে বলতে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জুলিয়া। সত্যি কথা বলতে কী, ওর অস্বস্তি হচ্ছে এই ভেবে যে এডমন্ডের বদলে আদতে ওরই বাড়িতে থাকার প্রস্তাবটা দেওয়া উচিত।

“আরে সে ঠিক আছে। ফ্যানি এর জন্য যতোটা হওয়া উচিত ততোটা কৃতজ্ঞ নিশ্চয়ই থাকবে।“ এডমন্ড এই কথা বলায় আলোচনাটা এখানেই থেমে গেল।

ফ্যানির কানে যখন এই পরিকল্পনার কথা গেল, তখন ওর যতোটা না আনন্দ হলো কৃতজ্ঞতার অনুভূতি হলো তার থেকে অনেক বেশি। এসব কিছুর মধ্যে ফ্যানি তার নিজের প্রতি এডমন্ডের মমতা টের পেল। সর্বোপরি, ফ্যানি তাকে কতটা ভালোবাসে সেটা না বুঝেও এডমন্ডের ফ্যানির প্রতি এই যে মমতা, ফ্যানি সেটাও অনুভব করল। কিন্তু ফ্যানির জন্য এডমন্ড যে কোনো আনন্দ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে, সেটা ভেবে ফ্যানির মনটা ব্যথায় ভরে উঠল। সত্যি কথা বলতে কী, এডমন্ডকে ছাড়া একা একা সথার্টন দেখার আনন্দের কোনও দাম নেই ওর কাছে।

এর পরের বার যখন ম্যান্সফিল্ডের দুই পরিবারের দেখা হলো তখন ওদের পরিকল্পনায় আরেকটা বদল হলো। এবার এই বদলটা সকলেরই মনের মতো হলো। মিসেস গ্রান্ট প্রস্তাব দিলেন যে তিনি দিনের বেলায় লেডি বার্ট্রামের সঙ্গে থাকবেন, আর সন্ধ্যায় ডক্টর গ্রান্ট রাতের খাবার খেতে আসবেন। লেডি বার্ট্রাম এতে খুবই খুশি হলেন, আর মারিয়া, জুলিয়াও আবার খুব খুশি হয়ে উঠল। এমন কী এডমন্ডও এই পরিকল্পনায় খুব খুশি হয়ে উঠল, কারণ এর ফলে সেও আবার সবার সঙ্গে যেতে পারবে। মিসেস নরিসও বললেন এটা দারুণ পরিকল্পনা, তিনিও এরকম ভাবছিলেন, আর সবে প্রস্তাবটা দিতেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় মিসেস গ্রান্ট প্রস্তাবটা দিয়েছেন।

বুধবারের দিনটা সঙ্গে খুব সুন্দর শুরু হলো। সকালের জলখাবারের পরপরই মিস্টার ক্রফোর্ড মিসেস গ্রান্ট আর মিস ক্রফোর্ডকে নিয়ে তার বারুচ গাড়িটা চালিয়ে এসে পৌঁছল। সবাই তো যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাই মিসেস গ্রান্ট গাড়ি থেকে নামতেই সবাই যে যার জায়গায় বসে পড়ল। তবে যে জায়গাটা সবথেকে সম্মানের আর সবার এতো আকাঙ্ক্ষার, সেই জায়গাটা খালিই রইল। শেষ পর্যন্ত কার সৌভাগ্য হবে সেই জায়গায় বসার? যখন মারিয়া, জুলিয়া দুজনেই ভাবছে যে কী করে বাকিদের খুশি রাখার ভান করে ওই জায়গাটা জিতে নেওয়া যায়, তখন মিসেস গ্রান্টের কথায় ব্যাপারটার নিস্পত্তি হলো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে তিনি বললেন, “তোমরা যেহেতু পাঁচজন আছ, সেহেতু একজনকে তো সামনে হেনরির সঙ্গে বসতেই হবে। জুলিয়া, তুমি তো বলছিলে যে তুমি গাড়ি চালানো শিখতে চাও, তাই এটা তোমার শিখে নেওয়ার জন্য একটা ভালো সুযোগ হবে বলে আমার মনে হয়।“

এই কথায় জুলিয়ার আনন্দ আর কে দেখে! আর মারিয়ার কষ্টই বা কে বোঝে! মুহূর্তের মধ্যে এক ঝটকায় জুলিয়া ঘোড়ার গাড়ির সামনের আসনে উঠে বসল। আর মুখ গোমড়া করে অপমানিত মনে মারিয়া গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসল। মিসেস গ্রান্ট আর লেডি বার্ট্রামের শুভেচ্ছা আর মালকিনের কোলে থাকা কুকুরটার ঘেউ ঘেউ শব্দের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল।

ওরা বেশ মনোরম গ্রামীণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। ফ্যানি এর আগে কখনই ঘোড়ায় চড়ে খুব একটা ঘোরে নি। তাই রাস্তায় যেতে যেতে চারিপাশের নতুন নতুন দৃশ্য দেখে, সুন্দর সুন্দর নানান জিনিস দেখে ভারী খুশি হয়ে উঠল। বাকি সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ওকে কিছু বলছেও না, আর ওর নিজেরও ওদের সব কথায় ঢোকার কোনও ইচ্ছে নেই। ও সাধারণত ওর নিজের চিন্তাভাবনার মধ্যেই ডুবে থাকতে ভালোবাসে। ও এখন চারিপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য, রাস্তার মোড়, নানান রকম মাটি, চাষাবাদ, কুঁড়েঘর, গবাদি পশু আর বাচ্চাদের দেখেই ভারী খুশি। শুধু যদি এডমন্ড এখন ওর পাশে থাকত, তাহলে এডমন্ডের সঙ্গে ওর মনের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে পারলে ফ্যানির আরও ভালো লাগত। ফ্যানি আর ফ্যানির পাশে বসা মিস ক্রফোর্ডের মধ্যে এটাই একমাত্র মিল। দুজনেই এডমন্ডকে ভালোবাসে। এই একটা ব্যাপার ছাড়া আর সবদিক থেকে মিস ক্রফোর্ড ফ্যানির থেকে একেবারেই আলাদা। ফ্যানির সূক্ষ্ম রুচি, মনন বা অনুভুতির কিছুই নেই মিস ক্রফোর্ডের মধ্যে। স্থির প্রকৃতির সৌন্দর্য মিস ক্রফোর্ডের চোখে সেভাবে ধরা পড়ে না। ওর সবটা আগ্রহ মানুষকে ঘিরে। ছোটখাটো প্রাণবন্ত হাসি কৌতুক আর মজা করাই ছিল ওর সবথেকে বড় প্রতিভা। ওরা দুজনেই গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে, তার উল্টোদিকে মুখ করে বসেছে। তাই যেই না কোনও উঁচু টিলায় ওঠার সময় এডমন্ড ওদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তখন দুজনেই একসঙ্গে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে আর বলে উঠছে, “ওই তো এডমন্ড!” এরকম ঘটনা একবার নয়, বারেবারে ঘটল।  

যাত্রার প্রথম ঘণ্টা সাতেক মারিয়ার একটুও ভালো লাগছিল না। মিস্টার ক্রফোর্ড আর ওর বোন জুলিয়া সামনে বসে একনাগাড়ে গল্প করতে ব্যস্ত। ওদের হাসিঠাট্টাও চলছে সমান তালে। মারিয়ার চোখ বারেবারে সেদিকেই চলে যাচ্ছে। যখনই মিস্টার ক্রফোর্ড হাসিমুখে জুলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে বা জুলিয়া হাসছে, মারিয়ার মনটা যেন হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সামাজিক ভদ্রতার মুখোস পরে সে এই জ্বলুনি সহ্য করে চলেছে। মাঝেমাঝে যখন জুলিয়া পিছন দিকে তাকাচ্ছে, ওর মুখটা যেন আনন্দে ঝলমল করছে। যখন কথা বলছে, তখনও ওর কথায় একরাশ আনন্দ ফুটে বেরোচ্ছে। বারেবারে বলছে, “ইশ, জায়গাটা কী সুন্দর! আহা, তোমরাও যদি দেখতে পেতে!” তবে বারবার একথা বললেও শুধুমাত্র মিস ক্রফোর্ডকেই আসন বদলের প্রস্তাব দিল। সে প্রস্তাবও না দেওয়ারই মতন, একবার আর নামেমাত্র। যখন ওরা একটা উঁচু টিলা পেরোচ্ছিল তখন জুলিয়া পিছন ঘুরে মিস ক্রফোর্ডকে বলল, “এই জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর। ইশ, আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে আমার জায়গায় বসতে দিই, কিন্তু যতই বলি না কেন, তুমি যে এখানে বসবে না, সেটাও আমি জানি।“ এরপর মিস ক্রফোর্ড কিছু উত্তর দেবে কী, তার আগেই আবার দ্রুত গতিতে গাড়ি চলতে শুরু করল।

এরপর গাড়িটা যখন সথার্টনের কাছাকাছি পৌঁছল, তখন মারিয়ার মনটা একটু ভালো লাগতে শুরু করল। এখন ওর মনে চলছে দুই রকম ভাবনার দোলাচল। একদিকে মিস্টার রাশওয়ার্থের প্রতি টান, অন্যদিকে মিস্টার ক্রফোর্ডের প্রতি আকর্ষণ। সথার্টনের কাছকাছি আসতেই প্রথম জনের প্রতি ওর টান বেড়ে গেল মারাত্মক। মিস্টার রাশওয়ার্থ যে একজন কতো বড় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সেটা প্রকাশ করার মধ্যেই যেন মারিয়া তার নিজের গুরুত্ব খুঁজে পেল। নিজের মনের গোপন আনন্দটা সে অনুভব না করে পারল না যখন কথার কথা বলার ছলে যখন মিস ক্রফোর্ডকে বলল যে “ওই দিকের জঙ্গলটা সথার্টনের”, কিম্বা হালকা গলায় বলে উঠল, “মনে হয় রাস্তাটার দুই দিকের পুরো জমিই এখন মিস্টার রাশওয়ার্থের।” সেই আনন্দ আরও বেড়ে গেল যখন ওরা মিস্টার রাশওয়ার্থের নিজস্ব প্রাসাদের দিকে এগিয়ে এল। রাশওয়ার্থরা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া এই অতীব পুরনো প্রাসাদেই সাধারণত বসবাস করেন। তাঁদের যে শুধু নিজেদের বসবাসের জন্য এই রাজকীয় প্রাসাদটাই আছে, তাই নয়, তাঁদের অগাধ সম্পত্তি ও জমিজমা আছে। সেই জায়গাজমি যারা ভাড়া নিয়েছে তাদের বিভিন্ন সমস্যা বিচার করার দায়িত্বও আইনত মিস্টার রাশওয়ার্থের।

“এরপরের রাস্তাটা আর খারাপ নয়, মিস ক্রফোর্ড। বাকি রাস্তাটা যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনই। সম্পত্তির মালিকানা হাতে পেয়েই মিস্টার রাশওয়ার্থ রাস্তাটা ঠিক করিয়েছেন। এখান থেকেই গ্রামের শুরু। ওই চাষি, শ্রমিকদের থাকার কুঁড়েঘরগুলো দেখছ, ওইগুলো অবশ্য দেখতে মোটেই ভালো লাগে না। তবে গির্জার চূড়াটা যে খুব সুন্দর, সেটা মানতেই হবে। যেমন সাধারণত বিভিন্ন পুরনো জায়গায় গির্জাটা বাড়ির মূল অংশের কাছাকাছি হয়, এখানে যে তেমন নয়, তাতে আমি খুব খুশি। গির্জার ঘণ্টার শব্দটা শুনতে নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো লাগত না। ওদের পাদ্রির বসবাসের জন্য যে বাড়িটা আছে, সেটাও বেশ সুন্দর, ছিমছাম। শুনেছি, পাদ্রি আর তার স্ত্রী দুজনেই বেশ ভালো মানুষ। আর ওই যে ওগুলো দেখছ, ওগুলো গরিবগুর্বোদের জন্য তৈরি করা ঘর। এই পরিবারের তরফ থেকেই বানানো। ডানদিকে এই প্রাসাদের সমস্ত কিছু দেখভাল করার দায়িত্ব যার, তার বাড়ি। ভদ্রলোক বেশ কাজের আর সভ্য ভদ্র। এবার আমরা পাহারাদারের ঘর লজ গেটের কাছাকাছি চলে এসেছি। তবে এখনও পার্কের ভিতর দিয়ে প্রায় মাইল খানেক যেতে হবে আমাদের। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, এখান থেকে জায়গাটা আর খুব একটা খারাপ নয়। আশেপাশে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর গাছগাছালি আছে। কিন্তু বাড়ির অবস্থানটা খুবই বাজে। প্রায় আধা মাইল নিচে নেমে যেতে হয়। এটাই বড্ড খারাপ লাগে যে বাড়িতে ঢোকার জায়গাটা যদি আরেকটু ভালো হতো, তাহলেই কিন্তু জায়গাটা আর অতটা খারাপ দেখাত না।“

মিস ক্রফোর্ড প্রশংসা করতে দেরি করল না। সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মারিয়ার মনের অবস্থাটা। আর সেটা বুঝে তাকে আরও খুশি করে তোলাটাকে যেন নিজের দায়িত্ব বলে ধরে নিল। মিসেস নরিসও খুশিতে ফেটে পড়ে একনাগাড়ে কথা বলে চললেন। এমন কী ফ্যানিও প্রশংসার সুরে যা বলল, সবাই সেটা মন দিয়ে শুনল। ওর চোখটা তখন ওর নিজের আশেপাশে যা কিছু দেখতে পাচ্ছে সবকিছুই খুব আগ্রহভরে দেখছে। বেশ চেষ্টা চরিত্র করে বাড়িটা ভালো করে দেখার পর বলে উঠল, “এটা এমন একধরনের বাড়ি যেটা যেমনতেমন করে দেখার নয়। খুব মন দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গেই এই বাড়ি দেখা উচিত।“ তারপর আরও বলল, “বাড়িটার ঢোকার মূল রাস্তাটা কোন দিক দিয়ে? যা দেখছি, বাড়িটা তো পুব দিক মুখ করে। তাহলে ওই রাস্তাটা নিশ্চয় বাড়ির পিছনদিক থেকেই শুরু হয়েছে? মিস্টার রাশওয়ার্থ তো বলছিলেন পশ্চিম দিকের কথা।”

“হ্যাঁ, একেবারে বাড়ির পেছনে। মূল রাস্তাটা একটু দূর থেকে শুরু হয়ে আধা মাইল পর্যন্ত চলে গেছে জমির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। এখান থেকে কিছুটা দেখা যাচ্ছে – ওই যে দূরের ওই গাছগুলো। সব গুলোই ওক গাছ।”

মিস্টার রাশওয়ার্থ যখন তার মতামত জানতে চেয়েছিলেন, তখন মারিয়া বলেছিল যে সে সথার্টনের ব্যাপারে নাকি কিছু জানে না। অথচ এখন এমন করে কথা বলছে যেন সবকিছু সে খুব ভালো করেই জানে। শেষ পর্যন্ত যখন মূল প্রবেশপথের সামনে বিশাল পাথরের সিঁড়ির কাছে গাড়ি থামল, তখন মারিয়ার আনন্দ আর কে দেখে। ওর মনটা তখন আত্মতৃপ্তি আর গর্বে ভরে উঠেছে।