জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - সপ্তম পর্ব

সপ্তম পর্ব 

()

পরের দিন নিজের মনেই কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে এডমন্ড ফ্যানির কাছে জানতে চাইল, “তো তাহলে ফ্যানি, এখন বলো তো, মিস ক্রফোর্ডকে তোমার কেমন লাগছে? কালকে কী মনে হলো?”

ওকে খুবই ভালো লাগে আমার। ওর কথা শুনতেও আমার বেশ ভালো লাগে। একে তো এত সুন্দর দেখতে, তার উপর আবার এত সুন্দর মজা করে কথা বলে, আমার তো ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেও খুব ভালো লাগে।

হ্যাঁ, ওর মুখটাই এত সুন্দর যে খুব আকর্ষণীয় দেখায়। তার উপর ওর চেহারাটা সত্যিই খুব সুন্দর। কিন্তু কাল ওর কথাবার্তায় এমন কিছু কি ছিল না, যেটা তোমার ঠিক ভালো লাগে নি?”

হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। নিজের কাকার ব্যাপারে যেভাবে কথা বলল, সেটা ওর বলা উচিৎ হয় নি। আমি তো বেশ অবাকই হলাম। ওই কাকার কাছে এত বছর থেকেছে, আর সেই কাকা, সে তাঁর যত দোষই থেকে থাক, তবুও মিস্টার ক্রফোর্ডকে এত ভালোবাসেন, নিজের ছেলের মতন দেখেন, তাঁর নামে এরকম করে বলাআমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

আমার মনেই হয়েছিল তুমি এটা ঠিক খেয়াল করবে। এটা খুবই অন্যায় হয়েছে, ভীষণ অশোভন।

আর খুব অকৃতজ্ঞতাও বটে।

অকৃতজ্ঞতা শব্দটা হয়তো একটু বেশি কঠোর শোনায়। আমি জানি না, ওর কাকা এমন কিছু করেছেন কী না যাতে ওর কাকার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। তবে কাকিমা তো করেছেন অবশ্যই। তাই কাকার ব্যাপারে যা কিছু বলেছে তা সেটা আসলে ওর কাকিমার স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই বলেছে মনে হয়। তবুও আমি বলব, সেটা একদম ঠিক হয় নি। মিস ক্রফোর্ড এখন বেশ অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এত আবেগ আর প্রাণবন্ত স্বভাব নিয়ে কাকার উপর কিছুটা কালিমা লেপন না করে কাকিমার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করা নিশ্চয়ই খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছে ওর জন্য। ওদের মতবিরোধের জন্য কার কতটা দোষ সেটা যে আমি জানি তা বলব না, তবে বর্তমানে ওর কাকার যা আচার আচরণ, তাতে যে কেউ কাকিমার পক্ষই নেবে। আর এটা খুব স্বাভাবিক আর প্রশংসনীয় যে মিস ক্রফোর্ড তার কাকিমাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে মনে করছে। কিন্তু সে কী মনে করছে আমি সেটা বিচার করছি না, তবে প্রকাশ্যে একথাগুলো বলা একদমই ঠিক হয় নি।

একটু ভাবনাচিন্তা করে ফ্যানি বলল, “কিন্তু তোমার কি এটা মনে হয় না যে এরকম অশোভন কথাবার্তা বললে সেটা মিসেস ক্রফোর্ডকেই সবার চোখে ছোট করে ফেলে? যতই হোক, ভাইঝিকে তো তিনিই বড় করে তুলেছেন! এরকম অশোভন কথা বললে মনে হয় ওর কাকিমাই ওকে কাকাকে সম্মান করতে শেখাতে পারেন নি।

দেখো, কথাটা তুমি নেহাত ভুল কিছু বলো নি। এটা ঠিকই যে এরকম কথাবার্তা শুনলে যেন মনে হয় ভাইঝি হিসেবে সে যা কিছু ভুল করছে সেসব ও কাকিমার থেকেই শিখেছে। ও যে খুব একটা ভালো শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে বড় হয় নি, সেটাও বোঝা যায়। তবে আমার মনে হচ্ছে যে এখন যেখানে থাকছে সেখানে থেকে ওর ভালোই হবে। মিসেস গ্রান্ট খুবই ভদ্র। আর মিস ক্রফোর্ড দাদাকে খুবই ভালোবাসে, যখনই দাদার ব্যাপারে কিছু বলে সেটা বোঝা যায়।

হ্যাঁ, সেটা ঠিক। শুধু দাদা যে ওকে একদম ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লেখে সেই ব্যাপারটা বাদ দিয়ে। ওর কথা শুনে আমার তো হাসিই পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে দাদা দূরে থাকা বোনকে একটু কষ্ট করে এমন চিঠি লিখতে পারে না যেটা পড়ে বোনের মন ভালো হয়ে যাবে, সেই দাদার মনটা যে সত্যিই কতটা ভালো, বা বোনকে যে সে কতটা ভালোবাসে সেই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমি ঠিক জানি উইলিয়াম আমার সঙ্গে কক্ষনো এরকম করত না, কোনও অবস্থাতেই না। আর মিস ক্রফোর্ড কোন অধিকারে এটা ধরে নিল যে তুমিও দূরে থাকলে এরকম ছোট চিঠিই লিখবে?”

ফ্যানি, ও ভারী ছটফটে আর বেশ বুদ্ধি ধরে। তাই যেটায় নিজে বা অন্য কেউ মজা পাবে এরকম কিছু খুব চটপট ধরে ফেলে। এমনিতে সেটা দোষের কিছু নয় যতক্ষণ না সেটা রুক্ষ বা খারাপ মনোভাব থেকে করা হচ্ছে। ওর মধ্যে এসব কিছুই দেখি নি। ওর চেহারায়, বা ওর আচরণেকোনও রুঢ়তা, চিৎকার চ্যাঁচামেচি বা খোঁচা মেরে কথা বলা, কোনটাই নেই। এমনিতে ও একেদমই মেয়েলি স্বভাবেরশুধু কয়েকটা ব্যাপার বাদ দিলে, যেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। সেই ব্যাপারগুলোর ক্ষেত্রে ওর ব্যবহার ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। আমার এটা ভেবে খুব ভালো লাগছে যে তুমিও পুরো ব্যাপারটা ঠিক সেভাবেই দেখছ, যেভাবে আমি দেখছি।

যেহেতু ফ্যানি এডমন্ডকে খুবই পছন্দ করে আর একইসঙ্গে ওর চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও এডমন্ডের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে, তাই এটা খুব স্বাভাবিক যে ফ্যানির ধ্যানধারণা এডমন্ডের ধ্যানধারণার সঙ্গে মিলে যাবে। তবে এই মুহূর্তে এই বিশেষ বিষয়ে দুজনের আলাদা আলাদা মত তৈরি হওয়ার একটা বিপজ্জনক সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এডমন্ড মিস ক্রফোর্ডের প্রতি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে পড়ছে যে ফ্যানি ওর তালে তাল মেলাতে পারছে না।

মিস ক্রফোর্ডের আকর্ষণ কিন্তু একটুও কমছে না। হার্পটা এসে পৌঁছাল, আর তা যেন ওর সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা আর হাসিখুশি স্বভাবকে আরও বাড়িয়ে দিল। বাজানোর সময় দেখলেই বোঝা যায় যে সে খুব খুশি হয়ে বাজাচ্ছেতার হার্প বাজানোর ভঙ্গি ও সুরের রুচিও অসাধারণ। প্রতিটি সুর বাজিয়ে শেষ করার পর কিছু বুদ্ধিদীপ্ত কথাও বলে। এডমন্ড রোজই গির্জা বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়, তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র শোনার জন্য। প্রতিদিন সকালেই পরের দিন শুনতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ পাকা হয়ে যায়। কারণ মিস ক্রফোর্ড নিজেও যে তার বাজনার একজন শ্রোতা পাবে তাতে অখুশি হবে কেন! ফলে সব কিছুই খুব সহজ ছন্দে এগিয়ে চলল।

একজন সুন্দরী, প্রাণবন্ত তরুণী, তার মতোই অভিজাত হার্প হাতে, জানালার পাশে বসে আছে –  জানালাটা মেঝের একদম উপর থেকে উঠেছে, সামনেই বাইরে একটি সবুজ লন, চারপাশে গ্রীষ্মের লতাপাতার সবুজ ঝোপঝাড়। এমন দৃশ্য যেকোনো পুরুষের মন কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এরকম মধুর একটা সময়, পরিবেশ, আবহাওয়াসবই যেন তাদের নরম আবেগকে এক বিশেষ দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। মিসেস গ্রান্ট ও তাঁর সেলাই করার কাঠের ফ্রেম, সেটাও যেন সবকিছুর সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গিয়েছে। আসলে ভালোবাসায় সবই ভালো লাগে। তাই এমন কী, স্যান্ডউইচের ট্রে, ডক্টর গ্রান্ট যেভাবে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সেটা পরিবেশন করেন সবই যেন এক ছন্দে বেজে যায়।

এরকম এক সপ্তাহ যাওয়ার পর ব্যাপারটা যে ঠিক কী হচ্ছে, বা ও নিজেও ঠিক কী করতে চলেছে, সেসবকিছু গভীরভাবে না বুঝেই এডমন্ড বেশ ভালো মতোই প্রেমে পড়ে গেল। এদিকে মিস ক্রফোর্ডের ক্ষেত্রেও বলা যায় যে যদিও এডমন্ড তার পছন্দের জগতের মানুষ না, বা তার বড় দাদা না, তবুও কোনও ফ্লার্টিং বা চাটুকারিতা ছাড়াই সে এডমন্ডকে পছন্দ করতে শুরু করল। মিস ক্রফোর্ড এটা ভাবেই নি, বা পুরোপুরি ঠিক বুঝেও উঠতে পারল না, কিন্তু যে এডমন্ড কোনও বাজে কথা বলে না, কোনও প্রসংসা করার ধার ধারে না, নিজের মতেই স্থির থাকে, সহজ আর শান্ত মনোযোগের সঙ্গে কথা বলে, যাকে ভালো লাগার সেরকম বিশেষ কোনও কারণ নেই, সেই এডমন্ডকেই যে তার ভালো লাগছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারল। হয়ত এডমন্ডের সততা আর নিষ্ঠাতেই সেই বিশেষ আকর্ষণ লুকিয়ে ছিল। এই আকর্ষণ মিস ক্রফোর্ড অনুভব করতে পারলেও ঠিক যেন নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। তবে এই নিয়ে সে খুব একটা মাথা ঘামাল না। আপাতত এডমন্ডকে তার ভালো লাগছে, এডমন্ড আশেপাশে থাকলে তার বেশ ভালো লাগেএটাই যথেষ্ট তার জন্য।

ফ্যানি অবাক হয়নি যে এডমান্ড প্রতিদিন সকালে গির্জা বাড়িতে যায়। সুযোগ পেলে সেও খুশি হয়ে বাজনা শুনতে যেত, এমন কী কেউ না ডাকলেও না কেউ ওকে লক্ষ না করলেও শুধুমাত্র হার্প শোনার জন্যই যেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসঙ্গে ঘোরাফেরা করার পর ফেরার জন্য দুই পরিবার যখন আবার আলাদা আলাদা রাস্তা ধরে তখন মিস্টার ক্রফোর্ড পার্কের মহিলা দলের সঙ্গে সময় কাটাতে মগ্ন থাকলেও এডমন্ড যে মিসেস গ্রান্ট আর তাঁর বোনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে সেটাতেও ফ্যানি অবাক হয় নি। তবে এই যে দুজনের জায়গার অদলবদল হচ্ছে, সেটা ফ্যানির খুব খারাপ একটা ব্যাপার বলে মনে হয়। এছাড়াও, এডমন্ড যদি নিজে হাতে ওকে ওয়াইন আর জল মিশিয়ে না দিত, তাহলে ও বরং একেবারেই ওয়াইন খেত না, আর সেটাই ভালো হতো বলে ফ্যানির মনে হয়।

ফ্যানির একটু আশ্চর্য লাগে যে এডমন্ড মিস ক্রফোর্ডের সঙ্গে এতটা সময় কাটায়, অথচ আগে মিস ক্রফোর্ডের যেসব দোষ বা খামতি দেখতে পেত, এখন সেসব আর তার চোখেই পড়ে না। অথচ মিস ক্রফোর্ডের সঙ্গে থাকলেই সেসব খামতির কথা মনে পড়ে যায় ফ্যানির। এভাবেই সময় কেটে যেতে লাগল।

মিস ক্রফোর্ডের ব্যাপারে ফ্যানির সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগে এডমন্ডের। ফ্যানির মনে হয় এডমন্ড ভাবছে যেহেতু এখন অ্যাডমিরাল আর এখানে নেই, তাই এই ব্যাপারে কোনও অসুবিধে নেই। সব কিছু দেখে শুনে ফ্যানির নিজের যে ঠিক কী মনে হয় সেকথা এক অদ্ভুত সংকোচের কারণে এডমন্ডকে বলতে পারে না। ওর কেবলই মনে হয় কথাগুলো বললে যদি খারাপ দেখায়!

ফ্যানি প্রথমবারের মতন খুব কষ্ট পেল যখন মিস ক্রফোর্ড ঘোড়ায় চড়া শিখতে চাইল। ম্যান্সফিল্ড পার্কে থাকতে শুরু করার পর পার্কে তরুণীদের ঘোড়ায় চড়া দেখে ওরও ঘোড়ায় চড়া শেখার শখ জাগল। মিস ক্রফোর্ডের ঘোড়ায় চড়া শেখার ইচ্ছের কথা শুনে এডমন্ড আরও বেশি করে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করল। সবসময় ওকে এই বিষয়ে উৎসাহ দেয়, এমন কী একসময় নিজের শান্তশিষ্ট ঘোড়াটায় শেখা শুরু করার প্রস্তাবও দিয়ে বসল। সমস্ত ঘোড়ার আস্তাবল খুঁজলেও একজন নতুন শিক্ষার্থীর জন্য ওই শান্ত ঘোড়াটার থেকে বেশি উপযুক্ত আর একটা ঘোড়াও পাওয়া যাবে না। এডমন্ডের মিস ক্রফোর্ডকে এই প্রস্তাব দেওয়ার পিছনে ফ্যানিকে কষ্ট দেওয়ার কোনও উদ্দেশ্য নেই। এই ব্যবস্থার কারণে ফ্যানির যেন একদিনও ঘোড়ায় চড়া বাদ না যায়, সে ব্যাপারে এডমন্ড খুবই সতর্ক। মিস ক্রফোর্ড ঘোড়ায় চড়া শেখার ঠিক আধ ঘণ্টা আগে ঘোড়াটাকে গির্জা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্যানিকে যখন এই পরিকল্পনার কথা প্রথম বারের মতন জানানো হল, তখন ওর একটুও খারাপ লাগে নি, বরং ও তো এই ভেবেই প্রচণ্ড কৃতজ্ঞ বোধ করল যে এডমন্ড অন্তত ওকে জানানোর কথা ভেবেছে!

প্রথম চেষ্টায় মিস ক্রফোর্ড যথেষ্ট ভালো করল। ফ্যানিরও কোনও অসুবিধে হলো না। এডমন্ড নিজে ঘোড়াটাকে নিয়ে গিয়ে পুরো সময়টা উপস্থিত থেকে আবার যখন ঘোড়াটাকে নিয়ে ফিরল ফ্যানি বা ওদের পুরনো বিশ্বস্ত কোচম্যান কেউই তৈরি হয়ে উঠতে পারে নি। যখনই ফ্যানি একা ঘোড়ায় চড়ে, এই কোচম্যান তখনই ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তবে দ্বিতীয় দিন ব্যাপারটা আর অতটা সহজ হলো না। মিস ক্রফোর্ডের ঘোড়ায় চড়তে এত ভালো লেগে গেল যে থামতে চাইছিল না তার মন। চটপটে, নির্ভীক আর কিছুটা ছোট হলেও শরীরিকভাবে শক্তপোক্ত গঠনের মিস ক্রফোর্ড যেন ঘোড়া চালানোর জন্য আদর্শ। তার ঘোড়ায় চড়ার অনাবিল আনন্দ হয়তো আরও বেড়ে গেল এডমন্ডের উপস্থিতি আর নির্দেশনায়। এত তাড়াতাড়ি হয়তো আর কোনও মেয়েই এতটা শিখতে পারত না, এই ভেবে সে এত খুশি হয়ে পড়ল যে ঘোড়া থেকে আর নামতেই ইচ্ছে করল না ওর। এদিকে পুরোপুরি তৈরি হয়ে ফ্যানি অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে মিসেস নরিস যখন বকাবকি শুরু করে দিয়েছেন যে ফ্যানি এখনও কেন রওনা দেয় নি, তখনও পর্যন্ত না এডমন্ড, না ঘোড়ার, কারোরই দেখা নেই। শেষে মাসিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আর এডমন্ডকে খোঁজার জন্য ফ্যানি বাইরে বেরিয়ে গেল।

বাড়ি দুটোর দূরত্ব মাইল খানেকেরও কম। কিন্তু একটা বাড়ি থেকে আরেকটা দেখা যায় না। তবে হল ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মাত্র পঞ্চাশ গজ হেঁটেই ফ্যানি পার্কের দিকে তাকিয়ে গির্জা বাড়ি ও তার আশপাশের জায়গাগুলো দেখতে পেল। বাড়িটা গ্রামের রাস্তার উপর যেন সম্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর গ্রান্টের মাঠের দিকে তাকাতেই ও দলটাকে দেখতে পেল। এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ড দুজনে পাশাপাশি দুটো ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে। ডক্টর ও মিসেস গ্রান্ট আর মিস্টার ক্রফোর্ড সঙ্গে দুই তিনজন ঘোড়া দেখাশোনা করার চাকরবাকর নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছেন। দৃশ্যটা দেখে ফ্যানির মনে হলো, বাঃ, সবাই মিলে কতো মজা করছে। সবাই একটা বিষয়েই মনোযোগী। ওদের হাসির শব্দ ফ্যানির কানেও এসে পৌঁছচ্ছে, নিঃসন্দেহে সবাই খুব খুশি। ওদের এই আনন্দ করার শব্দ কিন্তু ফ্যানিকে কোনও আনন্দ দিতে পারল না। ওর মনে একটাই প্রশ্ন জাগল যে এডমন্ড কি ওকে ভুলে যাবে? কথাটা ভেবেই ওর বুকটা যেন কেঁপে উঠল। তবুও ওই মাঠের দিক থেকে ও চোখ ফেরাতে পারল না। মাঠে যা কিছু ঘটে চলেছে, না চাইলেও সব কিছু না দেখে ও পারছে না।

মিস ক্রফোর্ড আর এডমন্ড প্রথমে ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে মাঠটা ঘুরল। মাঠটা খুব যে ছোট, তা নয়। তারপর হয়তো মিস ক্রফোর্ডের ইচ্ছেতেই ওরা একটু জোরে ঘোড়া ছোটাতে শুরু করল। ভীতু স্বভাবের ফ্যানি এটা দেখে ভীষণ চমকে উঠল যে মিস ক্রফোর্ড কত সাবলীলভাবে ঘোড়ায় চড়ছে। কয়েক মিনিট পর ওরা একদম থেমে গেল। এডমন্ড পাশ থেকে ওর সঙ্গে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘোড়ার লাগামটা কী করে ধরতে হবে সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে। ফ্যানি সত্যিই দেখতে পাচ্ছে নাকি কল্পনা করছে, ঠিক বুঝতে পারল না, তবে ওর যেন মনে হলো যে এডমন্ড মিস ক্রফোর্ডের হাত ধরে আছে। কিন্তু এসব নিয়ে ফ্যানির এত বিচলিত হওয়ার তো কিছু নেই! এডমন্ড তো সব সময়ই সবাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কাজেই এখনও যে ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, এতে আশ্চর্যের কী আছে! কিন্তু একই সঙ্গে ফ্যানির এটাও মনে হলো যে মিস্টার ক্রফোর্ড তো চাইলেই এডমন্ডকে এই ঝামেলার হাত থেকে রেহাই দিতে পারত। কারণ বড় দাদা হিসেবে ও যদি বোনকে শেখাতে সাহায্য করত, সেটাই তো সবথেকে উচিৎ কাজ হতো। কিন্তু নিজের স্বভাব আর ঘোড়া চালানো নিয়ে মুখে যতই বড়াই করুক, মিস্টার ক্রফোর্ড হয়তো বাস্তবে সত্যিই এই ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানে না। একথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যানি এটাও ভাবল যে এডমন্ডের যতোটা আন্তরিক স্বভাব মিস্টার ক্রফোর্ড ঠিক ততোটা আন্তরিক নয়। এরপর ফ্যানির ঘোড়াটার কথা ভেবে মায়া লাগতে শুরু করল। সত্যিই তো, ঘোড়াটাকে তো দু-দুবার খাটতে হচ্ছে। ওর মনে হলো, ওকে যদি সবাই ভুলে যায়, তাও ঠিক আছে, কিন্তু ঘোড়াটার কষ্টের কথা যেন ওরা ভুলে না যায়।

ওদের দেখে মনটা যেরকম অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেই অস্থিরতা একটু স্তিমিত হয়ে এল যখন এরপর ফ্যানি দেখল যে ওই মাঠের সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। মিস ক্রফোর্ড এখনও ঘোড়ার পিঠে চড়ে রয়েছে, কিন্তু এডমন্ড ওর পাশে পাশে হেঁটে চলেছে। এরপর ওরা ফটক পেরিয়ে রাস্তায় উঠে পার্কের দিকে যেখানে ফ্যানি দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে এগিয়ে এল। সেই দেখে ফ্যানির ভয় হলো যে ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে হয়তো অভদ্র বা অধৈর্য হয়ে পড়েছে বলে মনে হবে। তাই সেই সন্দেহ এড়াতে সে নিজেই ওদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। 

কথা বললে শোনা যাবে এমন দুরত্বে আসার সঙ্গে সঙ্গে মিস ক্রফোর্ড বলে উঠল, “মিস প্রাইস, এতক্ষণ তোমাকে অপেক্ষা করানোর জন্য আমি নিজে মুখে ক্ষমা চাইতে এলাম। তবে আমার সত্যিই কিছু বলার মুখ নেই। আমি জানি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আর আমি খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই পারলে ক্ষমা করে দাও আমাকে। আসলে কী বলো তো, স্বার্থপরতাকে সবসময় ক্ষমা করে দিতে হয়, কারণ এর কোনও সুরাহা নেই।

ফ্যানি খুব ভদ্র ভাবেই কথার উত্তর দিল। তার সঙ্গে এডমন্ড যোগ দিল এই বলে যে ফ্যানির তাড়া থাকার কোনও কারণ নেই। আরে, ফ্যানি রোজ যত দূর যায়, আজ যদি তার দ্বিগুণ দুরেও যেতে চায়, তাহলেও অসুবিধা হবে না, কারণ এখনও পর্যাপ্ত সময় আছে। আর আধ ঘণ্টা আগে রওনা হলে ও বরং রোদে কষ্ট পেত, এখন বেশ মেঘ জমেছে আকাশে। তাই তুমি ওর উপকারই করেছ। আমার তো বরং মনে হচ্ছে এতক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে তুমি খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। এরপর হেঁটে বাড়ি ফেরার মতন শক্তি তোমার আছে কী না, সেটাই ভাবছি।

এডমন্ডের সাহায্য নিয়ে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে মিস ক্রফোর্ড বলল, “বিশ্বাস করো, এই ঘোড়া থেকে নামা ছাড়া আর কিছুই আমাকে ক্লান্ত করতে পারে না। আমি খুব শক্তিশালী। শুধু যে কাজটা করতে ইচ্ছে করে না, সেটা করতে হলে আমার ক্লান্ত লাগে, নাহলে আর কোন কিছুতেই আমি ক্লান্ত হই না। মিস প্রাইস, যদিও তোমাকে এই ঘোড়াটা ফেরত দিতে আমার একটুও ভালো লাগছে না, তবুও আমি কিন্তু মন থেকে চাই যে তুমি এখন এই ঘোড়ায় চড়াটা যেন খুব উপভোগ করো। আর এই ঘোড়াটা এত ভালো যে ওর সম্পর্কে শুধু ভালো কথাই শুনতে ইচ্ছে করে আমার।

ফ্যানিকে এবার নিজের ঘোড়ায় চড়িয়ে দেওয়া হলে সে পার্কের অন্য দিকে রওনা দিল। পুরনো কোচম্যান যে এতক্ষণ নিজের ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল, সেও ফ্যানির সঙ্গে যোগ দিল। ফ্যানির অস্বস্তির ভাবটা কিছুতেই কমলো না। ও পিছন ঘুরে দেখল মিস ক্রফোর্ড আর এডমন্ড একসঙ্গে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে। ওর সঙ্গে থাকা কোচম্যানও ওকে খুব একটা স্বস্তি দিতে পারল না, কারণ সে মিস ক্রফোর্ডের দুর্দান্ত ঘোড়ায় চড়ার প্রশংসা করতে লাগল। পুরো ঘটনাটা সে ঠিক ততোটা আগ্রহ নিয়ে দেখেছে, যতোটা আগ্রহ নিয়ে ফ্যানি দেখেছে।

সে বলল, “একজন মহিলাকে এত সাবলীলভাবে ঘোড়ায় চড়তে দেখতেও খুব ভালো লাগে! আমি খুব কম মেয়েকেই এত সাবলীলভাবে ঘোড়ায় চড়তে দেখি। ওর মনে যেন ভয় বলে কিছুই নেই। আজ থেকে ছয় বছর আগে, ইস্টারে আপনি যখন প্রথম ঘোড়ায় চড়া শুরু করলেন, মিস ক্রফোর্ড তার থেকে একেবারেই আলাদা। বাবা রে! মনে আছে, কীভাবে কাঁপছিলেন আপনি, যখন স্যার থমাস আপনাকে প্রথম ঘোড়ায় তুললেন!”

বসার ঘরেও সবাই মিস ক্রফোর্ডের নামে ধন্য ধন্য করতে লাগল। মারিয়া, জুলিয়া দুজনেই মিস ক্রফোর্ডের স্বাভাবিক শক্তি আর সাহসিকতার ভীষণ প্রশংসা করল। মিস ক্রফোর্ডের ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ যেন ওদের নিজেদেরই ঘোড়ায় চড়ার আনন্দের সমান। সে যে এত তাড়াতাড়ি এত ভালোভাবে ঘোড়ায় চড়তে পারছে, তাতে যেন ওদের নিজেদেরই আনন্দ। তাই মিস ক্রফোর্ডের প্রশংসা করতেও খুব ভালো লাগছে ওদের।

জুলিয়া বলল, “আমি জানতাম ও খুব ভালোভাবেই চড়তে পারবে। ওর সেই ইচ্ছেটা আছে। আর ওর গড়নটাও ওর দাদার মতোই একেবারে ছিমছাম।

মারিয়া বলে উঠল, “হ্যাঁ, ওর সত্যিই ইচ্ছে আছে। আর সেই সঙ্গে ওর সেই শক্তিও আছে। আমি মনে করি, ভালো মতন ঘোড়ায় চড়ার ক্ষমতা অনেকাংশে মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করে।

সেদিন রাতে সবাই বিদায় নেওয়ার সময় এডমন্ড ফ্যানির কাছে জানতে চাইল যে পরের দিন ফ্যানির ঘোড়ায় চড়ার পরিকল্পনা আছে কী না।

ফ্যানি উত্তর দিল, “না, মানে, আমি ঠিক জানি না। তবে তুমি যদি ঘোড়াটা নিতে চাও তাহলে চড়ব না।“ “ঘোড়াটা আমি আমার জন্য চাইছি না মোটেই। তবে এরপর যেদিন তুমি বাইরে না গিয়ে ঘরে থাকবে বলে ভাববে, সেদিন আমার মনে হয় বেশি সময়ের জন্য মানে পুরো সকালটা ঘোড়াটা পেলে মিস ক্রফোর্ড খুব খুশি হবে। ওর খুব ইচ্ছে যে ম্যান্সফিল্ড কমন পর্যন্ত যায়। জায়গাটা এত খোলামেলা যে মিসেস গ্রান্ট সমানে বলে চলেছেন ওখান থেকে চারিদিকটা দেখতে খুব সুন্দর লাগে। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে একবার ওখানে গেলে মিস ক্রফোর্ডও একই কথা বলবে। তবে তার জন্য যেকোনো দিন সকালে গেলেই চলবে। তোমার অসুবিধা করে কিছু করতে চায় না ও। আর করলে সেটা অন্যায় হবে। কারণ ও তো শুধু আনন্দ পাওয়ার জন্য ঘোড়ায় চড়বে, এদিকে তোমাকে তোমার শরীর সুস্থ রাখার জন্য ঘোড়ায় চড়তে হয়।এডমন্ড বলল।

না, না, আমি কালকে ঘোড়ায় চড়তে বেরব না। কিছুদিন থেকে আমি একটু বেশিই বেরচ্ছি, আমি কাল বরং বাড়িতেই থাকব। তুমি তো জানোই হেঁটে চলাফেরা করার মতন যথেষ্ট শক্তি আছে আমার।“  ফ্যানি বলল।

এডমন্ডকে বেশ খুশি দেখাল। ফ্যানির তাতেই শান্তি। পরের দিন সকালে সবাই দল বেঁধে ম্যান্সফিল্ড কমনের দিকে যাবে বলে ঠিক করা হলো। সেই দলে ফ্যানি ছাড়া বাড়ির সব তরুণ তরুণী যোগ দিল। সবাই যে শুধু খুব আনন্দ করল তাই না, সন্ধ্যেবেলায় সবাই মিলে আবার এই ঘোরার আলোচনা করে সকালের থেকেও দ্বিগুণ আনন্দ পেল। এরকম কোনো একটা পরিকল্পনা সফল হলে সাধারণত তারপর আরও পরিকল্পনা করা হয়। তাই কমনে যাওয়ার পর, তারপরের দিনও সবাই মিলে আবার অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। দেখানোর মতো আরও অনেক জায়গা আছে। যদিও যথেষ্ট গরম, তবে সবজায়গাতেই ছায়াঘেরা রাস্তা আছে। আর তরুণদের দল সবসময় এমন ছায়াঘেরা রাস্তার খোঁজ পেয়েই যায়। এভাবে ক্রফোর্ড ভাইবোনকে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখিয়ে আরও চারটে সকাল খুব ভালোভাবে কেটে গেল। হাসি মজায় সবকিছুই দারুণ চলছে। শুধু গরমের জন্যই যা একটু অসুবিধে হচ্ছে। তবে সেটা নিয়ে আলোচনা করার মধ্যেও ওরা আনন্দ খুঁজে নিল।

চতুর্থ দিন অবশ্য এই দলের একজনের আনন্দ একটু মলিন হয় গেল। মারিয়ার। সেদিন এডমন্ড আর জুলিয়াকে আমন্ত্রণ জানালেও মারিয়াকে গির্জা বাড়িতে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো না। মিসেস গ্রান্ট কাজটা কিন্তু মারিয়ার ভালো চেয়েই করলেন। কারণ সেদিন মিস্টার রাশওয়ার্থ সেদিন পার্কে আসতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু এই ঘটনায় মারিয়ার খুব খারাপ লাগল। বাড়ি ফেরার সময় পর্যন্ত নিজের ভিতরের রাগ আর হতাশা চেপে রাখার জন্য ওকে অনেক চেষ্টা করে শান্ত থাকতে হলো। এরপর শেষ পর্যন্ত যখন মিস্টার রাশওয়ার্থ এলেনই না, তখন মন খারাপ লাগাটা আরও বেড়ে গেল। মিস্টার রাশওয়ার্থের উপর নিজের প্রভাব দেখিয়ে মনকে শান্ত করার সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেল ওর। তাই সে শুধু মা, মাসি আর ফ্যানির উপর মেজাজ দেখিয়ে রাতের খাবার সময়টাকে যতোটা সম্ভব তিক্ত করে দিল।

রাত দশটা-এগারোটার দিকে ফিরে এডমন্ড আর জুলিয়া বসার ঘরে এসে ঢুকল। সন্ধ্যার হাওয়া খেয়ে, খুশিতে ঝলমল করতে করতে। আর দেখল বসার ঘরের পরিস্থিতি একদম উল্টো। তিনজন মহিলা বসে আছে। মারিয়া তার বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে, বই থেকে চোখই তুলছে না। লেডি বার্ট্রাম অর্ধেক ঘুমে তলিয়ে গিয়েছেন। এমন কী মিসেস নরিস পর্যন্ত তার বোনঝির দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বসে আছেন। রাতের খাবারের প্রসঙ্গে একটা দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতেও তাঁর অনাগ্রহ দেখে মনে হলো তিনি ঠিক করে নিয়েছেন আপাতত আর কোনও কথাই বলবেন না। কয়েক মিনিট ভাই বোন নিজেরাই খুব উৎসাহ নিয়ে রাতের সৌন্দর্য আর আকাশের তারা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেল। তারপর দুজনেই একটু শান্ত হতেই এডমন্ড চারপাশে তাকিয়ে জানতে চাইল, “কিন্তু ফ্যানি কোথায়? ও কি শুতে চলে গিয়েছে নাকি?”

মিসেস নরিস উত্তর দিলেন, “না না, শুতে যায় নি, অন্তত আমি তো সেরকমই জানি। এই তো, একটু আগেই এখানে ছিল।

বসার ঘরটা অনেক লম্বা। সেই লম্বা ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে ফ্যানির মৃদু গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল যে ফ্যানি সোফায় রয়েছে। তাই শুনে মিসেস নরিস বকুনি দিতে শুরু করলেন।

ফ্যানি, এ আবার কী? সারা সন্ধ্যা তুমি অলসভাবে সোফায় গা এলিয়ে বসে কাটাচ্ছ! কেন, এখানে এসে আমাদের মতন কিছু কাজকর্ম করতে পারছ না? তোমার যদি সেরকম কোনও কাজ না থাকে তাহলে আমি গরিব লোকজনের জন্য যে সেলাই করছি সেখান থেকে তোমাকে কিছু কাজ দিতে পারি। এই যে গত সপ্তাহে অনেকটা ক্যালিকো কাপড় কেনা হয়েছে, সেটায় তো এখনও হাত দিয়ে উঠতে পারি নি। এই কাপড়টা এত শক্তপোক্ত যে এটা কাটতে গিয়ে আমার প্রায় কোমর ভেঙ্গে যাওয়ার যোগাড়। একটু অন্য লোকের কথাও ভাবতে শেখো ফ্যানি। আর হ্যাঁ, আমার এই একটা কথা মনে রেখ, এই কম বয়সে এরকম সোফায় গা এলিয়ে পড়ে থাকা এক ভয়ংকর বদভ্যাস।

মিসেস নরিসের কথা পুরোটা শেষ হওয়ার আগেই ফ্যানি আবার এসে টেবিলে যেখানে ওর বসার কথা, সেখানে বসে পড়ল। আর বসে পড়েই ওর নিজের কাজ করা শুরু করে দিল। জুলিয়া তখনও নিজের খুশিতেই মশগুল ছিল। মিসেস নরিসের কথায় ও বলে উঠল, “আমি তো বলব, আমাদের বাড়িতে যে সবথেকে কম সোফায় বসে সে ফ্যানি।

মন দিয়ে ফ্যানির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এডমন্ড জানতে চাইল, “ফ্যানি, নির্ঘাত মাথা ধরেছে তোমার, তাই না?”

ফ্যানি অস্বীকার করতে পারল না, তবে জানালো যে ব্যথাটা খুব বেশি হচ্ছে না।

তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। তোমার চেহারা আমি যথেষ্ট ভালো করেই চিনি। কতক্ষণ ধরে ব্যথা হচ্ছে?”

রাতের খাবার খাওয়ার একটু আগে থেকেই। আসলে গরমটার জন্যই।

এই গরমে বাইরে গিয়েছিলে নাকি?”

এডমন্ড একথা জিজ্ঞাসা করতেই মিসেস নরিস ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, “বাইরে গিয়েছে মানে কী? অবশ্যই গিয়েছে। এমন সুন্দর দিনে কেউ কি ঘরে বসে থাকে? আমরা সবাই বাইরে ছিলাম। এমনকি তোমার মাও তো প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় বাইরে ছিলেন।"

মিসেস নরিসের ফ্যানিকে বকাবকি করার তীক্ষ্ণ আওয়াজে জেগে উঠেছেন লেডি বার্ট্রাম। তিনিও এবার বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, এডমন্ড, আমিও প্রায় ঘণ্টাখানেক বাইরে ছিলাম। সেই এক ঘণ্টার মধ্যে পৌনে এক ঘণ্টা তো ফুলের বাগানেই ছিলাম। ফ্যানি তখন গোলাপ ফুলগুলো কাটছিল। তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে ভীষণ ভালো লাগছিল। তবে বড্ড গরম। গাছের ছায়ায় বসেছিলাম বটে, তবে এটা মানতেই হবে যে বাগান থেকে ঘরে ফেরার কথা ভাবতেই ভয় হচ্ছিল।

ও আচ্ছা, ফ্যানি তাহলে গোলাপ কাটছিল, তাই তো?”

"হ্যাঁ, আর সম্ভবত এটাই বছরের শেষ গোলাপ। আহা বেচারা মেয়েটা! প্রচণ্ড গরমে ওর কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু ফুলগুলো এতটাই ফুটে গিয়েছে যে আর দেরি করা তোলা ঠিক হতো না।"

মিসেস নরিস এবার একটু কোমল গলায় বললেন, "হ্যাঁ, এটা তো করতেই হতো। আমারও মনে হয় ওর মাথাটা তখনই ধরেছে। রোদে দাঁড়িয়ে আর বারবার নিচু হয়ে কাজ করলে মাথাব্যথা হতেই পারে। তবে আমার মনে হয় কালকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চাইলে ওকে তোমার সুগন্ধি ভিনিগারটা দিও, আমি তো সবসময় ভুলে যাই আমারটা ভরতে।"

হ্যাঁ, ওকে দিয়েছি। তোমার বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বারের মতন ফিরে আসার পর থেকেই ওটা ওর কাছে আছে।

এডমন্ড বিস্মিত গলায় বলে উঠল, “কী! এই গরমে এত হাঁটাহাঁটি, গোলাপ কাটা, তারপর এই পার্ক পেরিয়ে দু-দুবার আপনার বাড়ি যাওয়া আসা! এত কিছুর পর ওর যে মাথা ধরবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!”

মিসেস নরিস ইতিমধ্যে জুলিয়ার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন, তাই তিনি এডমন্ডের বলা কথাগুলো কিছুই শুনলেন না।

লেডি বার্ট্রাম বললেন, “আমার তখনই মনে হচ্ছিল যে এত কিছু ওর জন্য বাড়াবাড়ি রকমের বেশি কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু গোলাপ ফুলগুলো তোলার পর তোমার মাসি চাইলেন যেন তাঁর বাড়িতে কিছু গোলাপ দেওয়া হয়। তাই তখন সেটা ওই বাড়িতে তো নিয়ে যেতেই হবে, বুঝতেই তো পারছ।

কিন্তু এতো গোলাপ ছিল নাকি যে সেই গোলাপ দেওয়ার জন্য ওকে দু-দুবার যেতে হলো?”

না, তা নয়। মাসির যে বাড়তি ঘরটা আছে, সেই ঘরে গোলাপ গুলো রাখতে হতো, যাতে ভালো করে শুকিয়ে যেতে পারে। আর ফেরার সময় দুর্ভাগ্যবশত ও সেই ঘরের দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। তাই চাবিটাও আনতে পারে নি। তখন ওকে আবার যেতে হলো।

এডমন্ড উঠে ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আর সেটা আনার জন্য ফ্যানি ছাড়া আর কেউ ছিল না? সত্যি বলতে কী, আপনারা পুরো ব্যাপারটা খুব বাজেভাবে সামলেছেন।

মিসেস নরিস এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন, “আশ্চর্য ব্যাপার! এর থেকে আরও ভালো করে আর কী ভাবে পুরো ব্যাপারটা সামলানো যেতে পারত, আমার তো মাথাতেই আসছে না। এক হতে পারত যে আমি নিজেই গেলাম। কিন্তু আমিও তো আর একসঙ্গে দুজায়গায় থাকতে পারি না। ঠিক তখনই আমি তোমার মায়ের দুধওলার ব্যাপারে মিস্টার গ্রিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেটাও তোমার মা বলেছিলেন, সেজন্যই। এছাড়াও আমি জন গ্রুমকে কথা দিয়েছিলাম যে ওর ছেলের ব্যাপারে মিসেস জেফারিজকে লিখে দেব। বেচারা আমার জন্য আধাঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিল। আমি কাজ এড়িয়ে চলি বা ফাঁকি দিই এই অপবাদ মনে হয় আমাকে কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু সবকিছু তো আর একসঙ্গে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আর আমার জন্য ফ্যানি যে আমার বাড়িতে গিয়েছে, সেটাই বা এমন কী দূরে! আমার বাড়ি তো এখান থেকে মাত্র সোয়া মাইলের একটু বেশি দূরে। ওকে আমার বাড়িতে যেতে বলে এমন কিছু অন্যায্য দাবি করেছি বলে তো মনে হয় না আমার। আমি তো প্রায়ই দিনের মধ্যে তিনবার হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করি। সকাল, রাত, ঝড়, বৃষ্টি কোনও কিছুরই পরোয়া না করে। কই এই নিয়ে আমি তো কিছুই বলি না!”  

ফ্যানির যদি আপনার শক্তির অর্ধেক শক্তিও থাকত!”

"ফ্যানি যদি আর একটু নিয়মিত শরীর চর্চা করত, তাহলে এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হতো না। অনেক দিন হলো সে ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যায় না। আমি তো বলি, যদি ও ঘোড়ায় নাও চড়ে, তাহলেও অন্তত হাঁটাহাঁটি তো করতেই পারে। ওর যদি আগে থেকেই ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস না থাকত, তাহলে সেক্ষেত্রে আমি কিছুই বলতাম না। বরং আমি তো মনে করলাম অতক্ষণ ঝুঁকে গোলাপ ফুল তোলার পর একটু হাঁটাচলা হয়তো ওর জন্য ভালোই হবে। এরকম ক্লান্তির পর কিছুক্ষণ হাঁটলে শরীরটা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, রোদটা বেশ কড়া ছিল, তবে গরম তেমন ছিল না।এরপর লেডি বার্ট্রামের দিকে ইশারা করে মিসেস নরিস আরও বললেন, “এডমন্ড, শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, তবে আমার মনে হয়, গোলাপ ফুল কাটা আর বাগানে অলস ঘোরাঘুরিই ফ্যানির মাথা ধরার আসল কারণ।"

আস্তে আস্তে বলা হলেও মিসেস নরিসের কথাটা লেডি বার্ট্রামের কানে গেল। তিনি খুব সরলভাবেই সত্যিটা স্বীকার করলেন, “হ্যাঁ, আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। রোদটা যা কড়া ছিল, কাউকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আমারও মনে হচ্ছে ওই রোদেই ওর মাথাটা ধরেছে। ওখানে বসে আমারই এত কষ্ট হচ্ছিল। একে তো ওখানে ওই গরমে বসে থাকতে হচ্ছিল, এরপর আবার পাগকে (কুকুর) ডাকাডাকি করে ফুলের জায়গা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছিল, সব মিলিয়ে আমার জন্য খুব মুস্কিল হয়ে যাচ্ছিল।

এডমন্ড ওদের দুজনকেই আর কিছু বলল না। চুপচাপ আরেকটা টেবিলে যেখানে খাবারের ট্রেগুলো এখনও আছে, সেখানে গিয়ে ফ্যানির জন্য মাদেরা ওয়াইনের এক গ্লাস ভরে আনল। এই ওয়াইন খেলে ফ্যানির শরীরটা একটু ভালো লাগবে এটাই আশা। ওয়াইন দিয়ে ফ্যানিকে জোর করল গ্লাসের বেশিরভাগটাই খাওয়ার জন্য। ফ্যানির ইচ্ছে করছিল বারণ করতে। কিন্তু এই মুহূর্তে এতো রকমের আবেগ ওর মধ্যে কাজ করছে যে ওর চোখে জল এসে গিয়েছে। আর তাই কথা বলার থেকে ওয়াইনটা খেয়ে নেওয়াই ওর সহজ বলে মনে হলো।

মা আর মাসির উপর যতই বিরক্ত হোক না কেন, আসলে এডমন্ডের কিন্তু নিজের উপরেই সব থেকে বেশি রাগ হচ্ছে। ফ্যানির ব্যাপারে ওর অসতর্কতা ওর মা, মাসি যা করেছে তার থেকে অনেক বেশি খারাপ। ফ্যানির ব্যাপারে ঠিক মতন খেয়াল রাখলে এসবের কিছুই হতো না। চারদিন ধরে ফ্যানির না ছিল কোনও সঙ্গী, না ছিল শরীরচর্চা করার কোনও সুযোগ। ফ্যানির অযৌক্তিক মাসিরা যা কিছু দাবি করেছে সেসব অস্বীকার করার কোনও অজুহাত ফ্যানির কাছে ছিল না। এখন এডমন্ডের একথা ভেবেই লজ্জা লাগছে যে চারদিন ধরে ফ্যানির ঘোড়ায় চড়ার কোনও সুযোগ ছিল না। এখন মনে মনে ঠিক করল, এরপর থেকে মিস ক্রফোর্ডের আনন্দে একটু বিঘ্ন ঘটাতে হলেও এরকম আর কখনও হতে দেবে না ও।     

পার্কে আসার পর প্রথম রাতে যেরকম ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিল, ফ্যানি সেদিন রাতেও ঠিক সেরকম ভারী মন নিয়ে শুতে গেল বিছানায়। এই কদিন ওর নিজেকে বড্ড অবহেলিত বলে মনে হচ্ছিল। একটা ঈর্ষা আর হতাশ ভাব মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই সব মিলিয়ে ওর মনটা ভালো ছিল না, আর সেজন্যই হয়তো শরীরটাও খারাপ লাগছিল। ও যখন সোফায় গা এলিয়ে বসেছিল, তখন ওর মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওকে না দেখে। তখন ওকে ওর মাথা যন্ত্রণার থেকেও বেশি কষ্ট দিচ্ছিল ওর মানসিক যন্ত্রণা। আর এখন এডমন্ডের হঠাৎ এই বদল, দয়া, ভালোবাসা পেয়ে ফ্যানি জানে না নিজেকে কী ভাবে সামলাবে।