জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - দ্বিতীয় পর্ব

প্রথম পর্বের লিংক

(২)

মেয়েটা সে এক লম্বা যাত্রা শেষ করে বেশ নিরাপদেই নর্থহ্যাম্পটনে এসে পৌঁছল। সেখানে মিসেস নরিস তাকে স্বাগত জানালেন। সবার আগে মেয়েটাকে স্বাগত জানানোর সুযোগ পেলেন ভেবে তিনি তো খুবই গর্বিত। শুধু তাই নয়, তিনিই যে বাকি সবার সঙ্গে মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলেন সেজন্যও তিনি খুব খুশি। তিনি জনে জনে সবাইকেই অনুরোধ করলেন মেয়েটার সঙ্গে একটু ভালো ব্যবহার করার জন্য।  

সেই সময় ফ্যানি প্রাইসের বয়স মাত্র দশ বছর। প্রথম দেখায় খুব আকর্ষণীয় না মনে হলেও ওকে দেখেই খারাপ লাগার মতন কিছু অন্তত ছিল না। বয়সের তুলনায় চেহারাটা বেশ ছোটখাটো। গায়ের রঙে নেই কোনও ঔজ্জ্বল্য। কিম্বা দেখতেও যে দারুণ সুন্দর তা নয়। বরং খুবই চুপচাপ, লাজুক আর একটু লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে বলে মনে হচ্ছে। সবমিলিয়ে একটু অন্যরকম হলেও ওকে দেখে একটুও খারাপ কিছু লাগছে না। গলার স্বরটা বেশ মিষ্টি, কথা বলার সময় মুখটাও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। স্যর থমাস ও লেডি বার্ট্রাম তাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। ফ্যানিকে দেখে স্যর থমাস বুঝতে পারলেন যে মেয়েটার সঙ্গে একটু নরম ব্যবহার করে ওকে সহজ করে তুলতে হবে। সেই মতন তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাধ সাধল তাঁর স্বাভাবিক গম্ভীর স্বভাব। অন্য দিকে লেডি বার্ট্রাম অত ঝামেলায় গেলেন না। যেখানে স্যর থমাস দশটা কথা বললেন সেখানে তিনি হয়তো একটা কথা বললেন। কিন্তু তাঁর মুখের সদয় হাসিই মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে ফ্যানির কাছে ওই দুজনের মধ্যে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলল।

সেদিন ছেলেমেয়েরা সবাই বাড়িতেই ছিল। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় তারা সবাই বেশ হাসিখুশি আর সহজ ব্যবহার করল। কেউই বিব্রত বোধ করল না। অন্তত ছেলেরা। ওদের বয়স ষোল আর সতের বছর। ছোট্ট ফ্যানির চোখে ওরা ইতিমধ্যেই বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। মেয়ে দুটো ছোট আর বাবার প্রতি একটু বেশিই মুগ্ধ। ফ্যানির সঙ্গে পরিচয় করানোর সময় স্যর থমাস সেদিন অকারনেই ওদের প্রতি এতো বেশি মনোযোগ দিচ্ছিলেন যে ওরা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল। তবে নিয়মিত নানান অতিথি দেখে আর বিভিন্ন প্রশংসা শুনে ওরা এতোটাই অভ্যস্ত যে খুব একটা ঘাবড়ে যাওয়া ওদের স্বভাব নয়। বিশেষ করে ওদের মাসতুতো বোন ফ্যানির লাজুকভাব দেখে ওদের যেটুকু অস্বস্তি বা সংকোচ ছিল, তা দ্রুত কেটে গেল। তারপর বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফ্যানির পোশাকআশাক আর মুখের দিকে তাকিয়ে জরিপ করতে শুরু করল ওরা।

ওদের পুরো পরিবারটাই দেখতে শুনতে খুব সুন্দর। ছেলেদের চেহারা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই মেয়েরাও অপূর্ব রূপসী। বয়সের তুলনায় ছেলেমেয়েদের সবার চেহারাই বেশ সুগঠিত আর পরিণত। এক দেখাতেই বোঝা যায় যে ওরা ওদের মাসতুতো বোনের থেকে শারীরিক ভাবে অনেকটাই আলাদা। তার সঙ্গে ওদের শিক্ষাদীক্ষা ওদের চেহারায় যে উজ্জ্বলতা দিয়েছে তাতে ওদের দুই বোনের আর ওদের মাসতুতো বোনের বয়সটা যে এতো কাছাকাছি সেটা কেউ চট করে বুঝতে পারবে না। ওদের ছোট মেয়েটার থেকে ফ্যানি মাত্র বছর দুয়েকের ছোট। জুলিয়া বার্ট্রামের বয়স বারো আর মারিয়া তার থেকে এক বছরের বড়। এদিকে ফ্যানিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে ওর মনে খুবই দুঃখ। যাকে দেখছে তাকেই ভয় পাচ্ছে। নিজেকে নিয়ে সবসময় ভারী লজ্জিত। ওর কেবলই ইচ্ছে করছে ও যে বাড়ি ছেড়ে এসেছে সেখানেই যদি আবার ফিরে যেতে পারত। কী করে কারোর কাছে কিছু জানতে চাইবে সেটাও সে জানে না। কথা বললে গলাই শোনা যায় না আর কথা বলতে বলতে প্রায়ই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। নর্থহ্যাম্পটন থেকে আসার সময় সারা রাস্তা ধরে মিসেস নরিস ফ্যানিকে এই কথাই শোনাতে শোনাতে এসেছেন যে ওর কপাল কতটা ভালো। ওর যে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকা উচিত আর সবার সঙ্গে ভীষণ ভালো ব্যবহার করা উচিত বারে বারে সেকথাই বলতে বলতে এসেছেন। এতো কথা শুনে  আর নিজের দুর্দশার কথা ভেবে ফ্যানির শুধু যে মন খারাপ আরও বেড়ে যাচ্ছিল তাই নয়, একই সঙ্গে সে কেন খুশি থাকতে পারছে না, সেটা ভেবে আরও খারাপ লাগছিল ওর। ম্যান্সফিল্ডে পৌঁছাতে যে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে, সেই লম্বা যাত্রার ক্লান্তিও ওকে কাহিল করে ফেলেছে। ফলে স্যর থমাসের এতো ভালো ব্যবহার বিফলে গেল। মিসেস নরিস যে ওকে পইপই করে বলে দিলেন যে ওকে ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে হবে সেসবও বৃথা গেল। লেডি বার্ট্রাম হাসি মুখে ভালোবেসে ওকে নিজের পাশে, আদরের কুকুর পাগের পাশে সোফায় বসতে দিলেন, কিন্তু তাতেও কিছু লাভ হলো না। এমন কী ওর ভালো লাগবে ভেবে ওকে গুসবেরি টার্ট খেতে দেওয়া হলেও ওর কান্না বাগ মানল না। দুই কামড় দিতে না দিতেই চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করল। হয়তো ঘুমালে একটু ভালো লাগবে, মন খারাপ করা কমবে ভেবে এরপর ওকে শুতে নিয়ে যাওয়া হলো।

ফ্যানি ঘর ছেড়ে যেতেই মিসেস নরিস বলে উঠলেন, “নাঃ, শুরুটা তো মোটেই সুবিধার হলো না দেখছি। এখানে এসে প্রথমে ভালো ব্যবহার করার উপর যে অনেক কিছু নির্ভর করছে সেকথা আসার সময় পইপই করে বলে দিলাম। কিছুই তো দেখি কাজে লাগল না। ওর মা যা গোঁয়ার! আশা করি মেয়েটা সেরকম গোঁয়ার হবে না। অবশ্য সবে সবে বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এসেছে, মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটুকু ছাড় তো দিতেই হবে ওকে, তাই না! হাজার হোক সেটা তো ওর নিজের বাড়িই ছিল, সে সেখানে যত অসুবিধাই থাকুক না কেন। এটাও ঠিক যে ওই বাড়ি ছেড়ে এসে এখানে ও যে কত ভালো একটা পরিবেশ পাবে তা ও এখনও বুঝতে পারছে। তবে যত যাই হোক, আমার মতে আরেকটু ভালো ব্যবহার করতেই পারত মেয়েটা।“

ম্যান্সফিল্ড পার্কের নতুনত্ব, এতদিন যাদের সঙ্গে থাকত তাদের থেকে আলাদা থাকার কষ্ট; এসব কিছু মানিয়ে নিতে মিসেস নরিস যতোটা ভেবেছিলেন ফ্যানির তার থেকে বেশি সময় লাগল। ওই ছোট্ট মেয়েটার তীব্র কষ্ট কেউ তাকিয়েও দেখে নি, বোঝা তো দূরের কথা। কেউ যে ইচ্ছে করে ওকে কষ্ট দিতে চেয়েছে ঠিক তা নয়, তবে ওর কষ্ট যাতে একটু কম হয়, সেজন্য কেউ একটু বাড়তি আগ্রহও দেখায় নি।

ফ্যানি যেদিন এসে পৌঁছল, তার পরের দিন মিস বার্ট্রামদের ছুটি দেওয়া হলো যাতে ওরা ওদের মাসতুতো বোনের সঙ্গে সময় নিয়ে মেলামেশা করতে পারে, আর ফ্যানির মনটা ভালো হতে পারে। কিন্তু সেসবই বিফলে গেল। ওদের মধ্যে খুব একটা মিলমিশ হলো না। ফ্যানি ফরাসি ভাষা জানে না, আর ওর যে মাত্র দুটো ফিতে আছে জেনে দুই বোন ওকে অবজ্ঞা করতে শুরু করল। তারপর দুই বোন মিলে ওকে ডুয়েট গেয়ে শোনাল। তাতেও যখন ফ্যানি খুব একটা খুশি হলো না, তখন ওদের আর খুব একটা কিছু করার থাকল না। নকল ফুল তৈরি করা বা সোনালি কাগজ নষ্ট করাই ছিল ছুটির দিনে ওদের সবথেকে পছন্দের খেলা। কিছুতেই ফ্যানিকে খুশি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ওরা ফ্যানিকে ওদের সবথেকে কম পছন্দের কিছু খেলনা দিয়ে একলা রেখে সেসব করতে চলে গেল।

ফ্যানির ভারী একলা লাগে এখানে। সবসময়ই। সে ও ওর মাসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে থাকুক বা অন্য কোথাও। যে ঘরে পড়াশোনা করে সেই ঘরে বা ড্রয়িংরুমে অথবা বাগানের ঝোপে ঝাড়ে – সবজায়গায় ওর ভয় লাগে। সবাইকেই ও ভয় পায়। যেমন একদিকে লেডি বার্ট্রাম এত চুপচাপ দেখে ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়, স্যর থমাসের গম্ভীর চাহনি দেখে ভয় লাগে তেমন অন্যদিকে মিসেস নরিস সবসময় এত জ্ঞান দেন যে ও সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ে। ওর মাসতুতো বোনরাও কম যায় না। ওরা ফ্যানির ছোটখাটো চেহারা বা ওর লাজুক স্বভাব সবকিছু নিয়েই ওকে বিব্রত করে। ও যে বিশেষ কিছু শেখে নি, সেটা দেখে মিসেস লি অবাক হয়ে যান, ওর জামাকাপড়ের ছিরি দেখে বাড়ির চাকরবাকররা নাক সিঁটকায়; সব মিলিয়ে ফ্যানির অস্বস্তি আর লজ্জার শেষ নেই। এছাড়াও ওর নিজের ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে যায়। ওদের সঙ্গে কত খেলা করেছে, কত সময় ওদের শাসন করেছে, কত সময় ওরা ব্যথা পেলে, ওদের শরীর খারাপ হলে সেবাযত্ন করেছে আর ওরা ওকে কত ভালোবাসত সেসব কথা মনে পড়ে আর দুঃখে কাতর হয়ে পড়ে ফ্যানি।

এত বড় বাড়ি দেখে সে তো হতবাক। কিন্তু তাও যে ওর মন মানে না। ঘরগুলো এত বড় বড়, তাও ওর নড়তে চড়তে ভয় লাগে। কোনও কিছুতে হাত দিতে গেলেই মনে হয় যদি ভেঙ্গে ফেলে তাহলে কী হবে? সবসময় কিছু না কিছু ভয় ওকে কুড়েকুড়ে খায়। তাই প্রায় সময়ই নিজের ঘরে গিয়ে একা একা কাঁদে ফ্যানি। সবাই ভাবে ও হয়ত নিজের এত সৌভাগ্য দেখে খুব খুশি, ও ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে গেলেই সবাই একথাই বলাবলি করে। কিন্তু দিনের শেষে সেই মেয়েই একরাশ মন খারাপ নিয়ে একা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমায়। সপ্তাহ খানেক এভাবেই কেটে গেল। ওর শান্ত আর নির্লিপ্ত ভাব দেখে কারোর মনে কোনও সন্দেহ হয় নি। কিন্তু একদিন সকালে বাড়ির ছোট ছেলে এডমন্ড দেখে ও চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে কাঁদছে।

তাই দেখে এডমন্ড ওর পাশে বসল। অনেক চেষ্টা করল যাতে ও যে ফ্যানিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ফেলেছে সেই লজ্জা কাটিয়ে ফ্যানি ওর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে। এডমন্ড খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করল, “এ কী! কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? কেউ রাগারাগি করেছে তোমার সঙ্গে? নাকি মারিয়া বা জুলিয়া কারোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? কিম্বা পড়াশোনার কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? সেরকম কিছু হলে আমাকে বলো, আমি নিজে তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে বলো, দেখি আমি যদি যোগাড় করে দিতে পারি।” “না, না – কিচ্ছু লাগবে না – কিচ্ছু হয় নি আমার, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে” – অনেকক্ষণ পর্যন্ত এর থেকে বেশি আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না ফ্যানির কাছ থেকে। এডমন্ড কিন্তু তাও ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেল। ও যখনই ফ্যানির বাড়ির কথা তোলে তখনই ফ্যানির কান্নার বেগ বেড়ে যায় দেখে শেষ পর্যন্ত এডমন্ড বুঝল ফ্যানির মন খারাপের আসল কারণ কী। তাই বুঝে ও ফ্যানিকে সান্ত্বনা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করল।

“মায়ের জন্য মন খারাপ করছে তাই না ফ্যানি? তুমি খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আর দেখো, তুমি তো এখন তোমার আত্মীয়স্বজনদের কাছেই আছ। সবাই তোমাকে ভালোবাসে আর তোমাকে খুশি রাখতে চায়। চলো, আমরা বরং একটু পার্ক থেকে হেঁটে আসি। সেখানে তুমি তোমার ভাইবোনদের কথা বলবে আমাকে, ঠিক আছে?”

এডমন্ড এই নিয়ে আরও কিছুটা কথা বলে বুঝল যদিও সব ভাইবোনের জন্যই ফ্যানির মন খারাপ করছে, তবে যার কথা সবথেকে বেশি ওর মনে পড়ছে সে হলো উইলিয়াম। ফ্যানি উইলিয়ামের কথাই বেশি বলল আর ওর জন্যই যে মনটা সবথেকে বেশি ছটফট করছে সে কথাও বলল। ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে বড় উইলিয়াম ফ্যানির থেকে মাত্র এক বছরের বড়। ওর সব সময়ের সঙ্গী আর বন্ধু। যেহেতু মা সবথেকে বেশি উইলিয়ামকেই ভালোবাসে, তাই যে কোনও ঝামেলায় উইলিয়ামই ফ্যানির হয়ে মাকে বোঝায়। “উইলিয়াম বলছিল, তুই চলে যাবি, আমার একটুও ভালো লাগছে না রে, আমার বড্ড মন খারাপ করবে তোর জন্য।“ “উইলিয়াম তোমাকে চিঠি লিখবে নিশ্চয়ই?” “হ্যাঁ, ও কথা দিয়েছে, কিন্তু আমাকেই আগে চিঠি লিখতে বলেছে।“ “তাহলে কবে লিখবে তুমি চিঠি?” এবার মাথাটা নিচু করে ফ্যানি একটু দ্বিধার সুরে উত্তর দিল, “আমি জানি না, আমার কাছে তো কোন কাগজই নেই।“

“শুধু এটাই যদি তোমার সমস্যা হয় তাহলে শোন, আমি তোমাকে কাগজ আর তার সঙ্গে যা যা লাগে সব যোগাড় করে দেব। তাহলেই তো তুমি যখন ইচ্ছে চিঠি লিখতে পারবে। উইলিয়ামকে চিঠি লিখতে পারলে তুমি খুশি হবে তো?”

“হ্যাঁ, খুউব খুশি হব।“

“বেশ, তাহলে আর কী! এই কাজটা তো এক্ষুনি করে ফেলা যায়। চলো, আমার সঙ্গে সকালের জলখাবার খাওয়ার ঘরে চলো, ওখানে তোমার যা কিছু লাগবে সব পেয়ে যাব। আমরা নিজেদের মতন সময় নিয়ে গুছিয়ে করতে পারব কাজটা।“

“কিন্তু চিঠিটা পোষ্ট অফিসে পৌঁছবে কি?”

“আরে, একদম চিন্তা কোরো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। অন্য সব চিঠির সঙ্গেই এই চিঠিও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর তোমার মেসোমশাই চিঠিটা ফ্র্যাঙ্ক করে এমন করে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন যে কোনও স্ট্যাম্প লাগবে না, আবার উইলিয়ামকেও এই চিঠির জন্য এক পয়সা খরচ করতে হবে না।“

“মেসোমশাই!” ভীত গলায় বলে উঠল ফ্যানি।

“হ্যাঁ, তোমার চিঠি লেখা হলে আমি আমার বাবার কাছে নিয়ে যাব চিঠিটা, ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠানোর জন্য।“

এটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভাবলেও ফ্যানি আর প্রতিবাদ করল না। দুজনে মিলে সকালের খাওয়ার ঘরে গেল। সেখানে এডমন্ড ফ্যানির চিঠি লেখার কাগজের ব্যবস্থা করে দিল। ওই কাগজে লাইন টেনে দিল। কাজটা এত পরিপাটি করে করল যে হয়তো ফ্যানির ভাইও বুঝতে পারবে যে কাজটা কতটা যত্ন করে করা হয়েছে। ফ্যানি যতক্ষণ চিঠি লিখল, এডমন্ড ততক্ষণ ওর সঙ্গে থেকে ওকে সাহায্য করল – পেন কেটে সরু করার ছুরি দিয়ে, বানান ঠিক করে দিয়ে, যখন যেমন দরকার। ফ্যানির মনে হলো এডমন্ড এসব করছে ওর ভাই উইলিয়ামের প্রতি মমতা থেকে। আর সেটাই ফ্যানিকে সবথেকে বেশি আনন্দ দিল। এডমন্ড নিজের হাতে উইলিয়ামের প্রতি ওর ভালোবাসা জানিয়ে দু পংতি লিখে একটা অর্ধ গিনিও চিঠির মধ্যে গুঁজে দিল। সেই দেখে ফ্যানির এত ভালো লাগল যে ও কী করে নিজেকে প্রকাশ করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না। তবে ওর ভাবভঙ্গি আর সহজ সরল কথা থেকেই প্রকাশ পাচ্ছিল যে ও কতটা কৃতজ্ঞ আর কতটা খুশি হয়েছে। সেই দেখে এডমন্ড ফ্যানির দিকে আরও মনোযোগ দিতে শুরু করল।

ফ্যানির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর এডমন্ড বুঝতে পারল যে ফ্যানির মনটা ভারী নরমসরম। ও সব কিছু ঠিকমতন করতে চায়, তবে বড্ড লাজুক। এদিকে ফ্যানির বর্তমান পরিস্থিতি যে কেমন এডমন্ড সেটাও বুঝতে পারছে। সবকিছু মিলিয়ে এডমন্ড বুঝতে পারল যে ফ্যানির প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এমনিতে এডমন্ড কখনই জেনেশুনে ফ্যানিকে কোনও কষ্ট দেয় নি। তবে এডমন্ড এখন বুঝতে পারছে যে ফ্যানিকে আরেকটু ভালোবাসা দরকার। এসব কিছু চিন্তাভাবনা করে এডমন্ডের মনে হলো সবার আগে ফ্যানি যে সবাইকে ভয় পাচ্ছে সেটা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সেই মতন ফ্যানিকে মারিয়া আর জুলিয়ার সঙ্গে আরও বেশি মেলামেশা করতে আর যতোটা বেশি সম্ভব হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে বলল।

এডমন্ডের সঙ্গে এত কথা হওয়ার দিন থেকে ফ্যানি কিছুটা স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করল। ওর মনে ভরসা জাগল যে ওর একজন বন্ধু আছে। এডমন্ড ওর প্রতি যেমন নরম ব্যবহার করল তাতে ফ্যানি আর সবার প্রতিও বেশ ভালো বোধ করতে শুরু করল। একটু একটু করে জায়গাটা যেন ফ্যানির কাছে চেনা পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করল। ওই বাড়িতে যেসব লোকজন থাকে তাদেরও একটু কম ভয় লাগে এখন। তবে তারপরেও যাদের একটু ভয় ভয় লাগত তাদের আচরণের ধরণটা বুঝে নিয়ে কী করে তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে থাকতে হবে ও সেটাও ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল। শুরুর দিকে ফ্যানির গেঁয়োভাব ও অস্বস্তিকর আচরণে শুধু যে ওর শান্তি ভঙ্গ হতো তাই না, বাড়ির আর সকলেরও অশান্তি হতো। একসময় সেই গেঁয়োভাব ও অস্বস্তি ধীরে ধীরে চলে গেল। ও এখন আর মেসোমশাইর সামনে যেতে ভয় পায় না। মাসি নরিসের গলা শুনেও আর চমকে ওঠে না। আস্তে আস্তে ওর মাসতুতো ভাইবোনরাও ওর সঙ্গে সহজ হয়ে উঠল, ওকে মেনে নিল। বয়স আর গায়ের জোর কম হওয়ায় ফ্যানি সবসময় ওদের সঙ্গে খেলতে পারত না। তবে কখনও কখনও ওদের খেলাধুলার জন্য, আনন্দের জন্য তৃতীয় এক জনের দরকার হয় যে বেশ বাধ্য আর নরম স্বভাবের হবে। তাই মাসি নরিস যখন ফ্যানির দোষত্রুটি সম্পর্কে খোঁজ নেন তখন ওরা এডমন্ডের পরামর্শ মতন জানায়, “ফ্যানি বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।“

এডমন্ড ওর প্রতি সবসময়ই সদয়। আর টমও ওকে খুব একটা জ্বালায় না, বড়জোর একটু আধটু মজা করে, এই যা! একটা সতেরো বছরের ছেলে একটা দশ বছরের মেয়ের সঙ্গে সাধারণত যেমন দুষ্টুমি করে থাকে আর কী। টম সবে বড় হচ্ছে। উচ্ছ্বল, উদ্দীপনায় ভরা। তার উপর আবার পরিবারের বড় ছেলে। সে তো মনে করে যে সে শুধু খরচ আর আনন্দ করার জন্যই জন্মেছে। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে যতটুকু অধিকার সেই হিসেবমতন টম এমনিতে ফ্যানির প্রতি যথেষ্ট সদয়। মাঝেমাঝে ফ্যানিকে বেশ কিছু সুন্দর উপহার দেয়। তবে মাঝেমাঝে কিছু দুষ্টুমিও করে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যানির চেহারা আর মনোভাবের কিছুটা উন্নতি দেখে স্যর থমাস আর মিসেস নরিস তাঁরা যে কত ভালো একটা কাজ করেছেন সেই ভেবে বেশ আত্মসন্তুষ্টি বোধ করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওঁরা ভাবতে শুরু করলেন যে খুব একটা চালাক চতুর না হলেও মেয়েটা বেশ বাধ্য স্বভাবের। এই মেয়ে সম্ভবত ওঁদের জন্য কোনও সমস্যা হয়ে উঠবে না। তবে ফ্যানি যে খুব একটা বেশি কিছু করে উঠতে পারবে না, সে বিষয়ে ওঁদের দুজনের কারোর কোনও সন্দেহ নেই। ফ্যানি পড়তে পারে, লিখতে পারে, সেলাইও করতে জানে। কিন্তু তার থেকে বেশি আর কিছু ওকে শেখানো হয় নি। ওর মাসতুতো ভাইবোনেরা অনেকদিন থেকেই অনেক কিছু শিখছে। ওরা যখন দেখে যে ফ্যানি সেসবের কিছুই জানে না, ওদের মনে হয় ফ্যানি নিশ্চয়ই ভীষণ বোকা। ফ্যানির আসার পর প্রথম দুই তিন সপ্তাহ ওরা নিত্যদিন ফ্যানির এই কোনোকিছু না জানার কথা, ও যে কতটা বোকা সেই কথা বসার ঘরে এসে সবাইকে জানাত। “মা জানো তো, ফ্যানি না জিগশ পাজলের টুকরো জুড়ে ইউরোপের ম্যাপ বানাতে পারে না – জানো তো, ও না রাশিয়ার প্রধান নদী গুলোর নাম জানে না – মা, ভাবতে পারছ, ফ্যানি নাকি কোনোদিন এশিয়া মাইনরের নামই শোনে নি – এমন কী জল রং – ক্রেয়ন রঙের মধ্যে পার্থক্যটা পর্যন্ত জানে না! – কী আজব না! এত হাবাগোবা যে কেউ হতে পারে, কোনোদিন শুনেছ মা?”

ওদের মাসি মানুষটা তো খুবই বিবেচক একজন মানুষ, তাই তিনি ওদের বুঝিয়ে বলতেন, “সোনা মেয়ে, এসব না জানা সত্যিই ঠিক না, তবে কী বলোতো, সবাই যে তোমাদের মতন খুব তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শিখে নিতে পারবে সেটা তো তোমরা আশা করতে পারো না।“   

“কিন্তু মাসি, ও সত্যিই কিচ্ছু জানে না! – তুমি জানো, কাল রাতে আমরা ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কোন রাস্তা ধরে আয়ারল্যান্ডে যাওয়া যায়, ও বলে কী না, আইল অফ ভাইট পেড়িয়ে যেতে হবে। আইল অফ ভাইট ছাড়া আর কিছুই ও ভাবে না। ওর মতে আইল অফ ভাইটই একমাত্র দ্বীপ, যেন দুনিয়ায় আর কোনও দ্বীপ নেই। আমার তো মনে হয় ওর বয়সে আমি যদি এসব না জানতাম তাহলে আমার খুবই লজ্জা লাগত। আমি তো এটাও মনে করতে পারছি না যে আমি কবে সেসব নিয়ে অনেকটা জানতাম না যেসব জিনিসের ব্যাপারে ফ্যানি এখনও একদম কিচ্ছু জানে না। তুমিই বলো মাসি সেসব কত দিন আগের কথা, যখন পরপর ইংল্যান্ডের রাজাদের নাম, তাঁদের শাসনকাল, কবে তাঁরা সিংহাসনে  বসেছেন, তাঁদের শাসনকালে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে সব কিছু কেমন বারে বারে মুখস্ত বলতাম আমরা!” 

আরেক বোন আরও জুড়ে দেয়, “হ্যাঁ, সম্রাট সেভেরাস পর্যন্ত আমরা রোমের সম্রাটদের নাম আর তাঁদের শাসন সম্পর্কেও মুখস্ত বলতাম। এছাড়াও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, সমস্ত ধাতু, আধা ধাতু, গ্রহ ও বিখ্যাত দার্শনিকদের ব্যাপারেও মুখস্ত বলতাম।“

“একদম ঠিক বলেছ আমার সোনারা। কিন্তু কী বলো তো, তোমাদের মনে রাখার ক্ষমতা খুব ভালো। ফ্যানি বেচারির হয়তো মনে রাখার কোনও ক্ষমতাই নেই। সব কিছুতেই যেমন তোমাদের মধ্যে তফাৎ আছে, তেমনই মনে রাখার ব্যাপারেও আছে। তাই তোমাদের মাসতুতো বোনের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিতেই হবে। ওর এইসব খামতির জন্য ওকে একটু দয়া দেখাতে হবে। তবে একটা কথা কিন্তু মনে রাখতেই হবে যে তোমরা যতই চালাক চতুর হও না কেন, যতই ওর থেকে এগিয়ে থাকো না কেন, তোমাদের কিন্তু নম্র ব্যবহার করতে হবে সবসময়ই। কারণ আপাতত তোমরা যতোটা শিখেছ তার থেকেও অনেক বেশি শেখার আছে এখনও। “

“হ্যাঁ, সেটা আমিও জানি। সতেরো বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত আরও অনেক কিছু শিখতে হবে। কিন্তু ফ্যানির বিষয়ে একটা কথা আমি তোমাকে বলবই। এত বেমানান আর এত বোকা! তুমি জানো, ও নাকি গান বা আঁকা কিছুই শিখতে চায় না।“

“সত্যিই তো, এটা তো খুবই বোকা বোকা একটা ব্যাপার। এতেই বোঝা যাচ্ছে ওর মধ্যে শেখার ক্ষমতা আর তোমাদের সঙ্গে সমান হয়ে ওঠার ইচ্ছে কত কম। তবে সব দিক দেখলে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না যে এরকম হওয়াই ভালো হচ্ছে কী না। তোমরা তো জানোই কিছুটা আমার ইচ্ছেতেই তোমাদের বাবা, মা ওকে এখানে এনে তোমাদের সঙ্গে বড় করছেন। তাই ওকে যে তোমাদের মতন সবকিছু শিখতেই হবে, তা কিন্তু নয়। বলা ভালো ফ্যানির থেকে তোমরা আলাদা হলে সেটাই বরং ঠিক হবে।“

এভাবেই মিসেস নরিস তাঁর বোনঝিদের বোঝাতে চেষ্টা করেন। আর এভাবেই ওদের মানসিকতা গড়ে ওঠে। ফলে অনেক কিছু শেখার পরেও সাধারণ বোধবুদ্ধি যে ওদের কম হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ওদের হয়তো অনেক প্রতিভা, ওরা হয়তো অনেক কিছুই বেশ তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে, কিন্তু নিজের সম্পর্কে সচেতনতা, সাধারণ উদারতা বা বিনয়ের মতন ছোট ছোট জিনিসগুলো আর ওদের শেখা হয়ে ওঠে না। এক মানবিক স্বভাব ছাড়া আর সব কিছুই ওদের খুব ভালো করে শেখানো হয়। স্যর থমাস নিজেও জানেন না যে ঠিক কী চান তিনি। বাবা হিসেবে তিনি ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে চিন্তা করলেও সেই স্নেহের প্রকাশ তাঁর ছিল না। তাঁর সংযত স্বভাবের কারণেই সেই স্নেহ আর উচ্ছ্বাস তিনি নিজের মধ্যের রেখে দেন।

মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি লেডি বার্ট্রামের বিন্দুমাত্র মনোযোগ ছিল না। এসব কাজের জন্য তাঁর সময় কোথায়? তিনি সারাদিন সুন্দর পোশাক পরে, সেজেগুজে সোফার উপর বসে সুঁচ সুতো নিয়ে সেলাই করেন। সেসব বড় বড় সেলাই না হয় দেখতে সুন্দর, না হয় কোনও কাজের। সেলাই করার সময় তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের থেকেও বেশি তাঁর আদরের কুকুর পাগের কথা ভাবেন। ছেলেমেয়েদের তিনি খুবই ভালোবাসেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা তাঁর জন্য কোনও অসুবিধা তৈরি করছে। জীবনে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেসব কিছু তিনি স্যর থমাসের কথা শুনে করেন, আর ছোটখাটো ব্যাপারে দিদির কথা শুনে চলেন। যদি বা তাঁর কিছুটা সময় থাকে মেয়েদের দেখাশোনার জন্য, তখনও হয়তো তাঁর সেটা করা অকারণ বলে মনে হয়। কারণ মেয়েদের জন্য সবসময় দেখাশোনা করার একজন রয়েছেন, শিক্ষাদীক্ষার জন্য একজন রয়েছেন, এরপরেও আর কিছু কীসের দরকার! এখন ফ্যানি যে সেভাবে কিছু শেখে নি সেজন্য তাঁর মনে হয়, “এটা সত্যিই ভারী দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু কিছু মানুষ থাকে যারা এমনিতেই বোকাসোকা ধরণের হয়। এখন ফ্যানি যদি সেরকমই বোকা হয় তাহলে ওকে আরেকটু চেষ্টা করতে হবে। আমি জানি না, আর কী করা যেতে পারে। তবে ফ্যানি বেচারি খানিকটা হাবাগোবা ধরণের হলেও মেয়েটা কিন্তু খারাপ নয় – সবসময় আমার কথা শোনে, যাকে যা খবর দেওয়ার দিয়ে আসে আর আমি কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা এনে হাজির করে।“

ফ্যানি তার সবরকমের অজ্ঞতা আর ভয় পাওয়ার ভুলত্রুটি সহ ম্যান্সফিল্ড পার্কে টিকে গেল। ধীরে ধীরে এই নতুন জায়গার জন্যও ওর আগের বাড়ির প্রতি যে ভালোবাসা ছিল সেরকম ভালোবাসা জন্ম নিল। ওর মাসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো আর আগের মতন অতটা কষ্ট দেয় না ওকে। মারিয়া বা জুলিয়া দুই বোনের কেউই সেরকম খারাপ না। যদিও প্রায়ই ওদের ব্যবহারে ফ্যানির মন খারাপ হয় তবে ও নিজের অধিকার এতোটাই কম বলে মনে করে যে সেসব ব্যবহার ওকে ততোটা কষ্ট দিতে পারে না।

আগে প্রতি বছর বসন্ত কালে লেডি বার্ট্রাম শহরে গিয়ে থাকতেন। কিন্তু যে বছর থেকে ফ্যানি এসে থাকতে শুরু করল, সেই বছর থেকে কিছুটা শরীর খারাপের কারণে আর বেশিভাগটা আলস্যের কারণে তিনি আর শহরে গিয়ে থাকেন না। তাঁর স্বামী স্যর থমাস সংসদে তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য শহরে থেকে যান, কিন্তু লেডি বার্ট্রাম ফ্যানি এসে থাকতে শুরু করার বছর থেকে পুরো বছরটা গ্রামেই থাকতে শুরু করলেন। তিনি না থাকার কারণে তাঁর স্বামীর কোনও সুবিধা অসুবিধা হতে পারে কিনা সেই নিয়ে তিনি বিশেষ মাথা ঘামান না। ফলে গ্রামে থাকতে থাকতেই মিস বার্ট্রামরা তাদের পড়াশোনা করা, ডুয়েট গাওয়া এসব করতে করতে কখন যেন লম্বা হয়ে গেল, বড় হয়ে গেল। বাবা স্যর থমাস যখন ওদের দেখেন তখন ওরা কেমন বড় হয়ে উঠছে, কেমন সভ্যভব্য হয়ে উঠছে, কী কী শিখল সেসব দেখেন আর নিজের মনে শান্তি পান। তাঁর বড় ছেলে বড্ড উদাসিন আর বেহিসেবি। তাই বড় ছেলেকে নিয়ে তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় থাকেন। তবে তাঁর বাকি ছেলেমেয়েরা কখনও ভালো ছাড়া মন্দ কিছুর ইঙ্গিত দেয় নি। তাঁর মনে হয় যতদিন না বিয়ে হচ্ছে ততদিন শুধু যে তাঁর মেয়েরা বার্ট্রাম নামের মর্যাদা রক্ষা করবে তাই নয়, বিয়ের পর যখন বার্ট্রাম নাম ত্যাগ করে নতুন নাম নেবে তখন তা আরও বেশি সম্মান বহন করে আনবে। তাঁর মেয়েরা আরও ধনী পরিবারে বিয়ে করে আরও বেশি সম্মানের অধিকারি হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে এডমন্ডের চরিত্র নিয়ে আর কী বলার থাকতে পারে। এডমন্ডের জোরালো বুদ্ধিমত্তা, সৎ মনোভাব, সবাইকে সম্মান করার, আনন্দ দেওয়ার আর অন্যের উপকারে আসার যে ব্যগ্রতা, তাতে শুধু যে সে নিজে আনন্দ পায় তা নয়, তার আশেপাশে যে বা যারা থাকে তারাও সবাই খুশি হয়। এডমন্ড ভবিষ্যতে একজন পাদ্রি হতে চায়।

নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতি আদরযত্নের মাঝেও স্যর থমাস কিন্তু মিসেস প্রাইসের ছেলেমেয়ের প্রতি তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে যান নি। মিসেস প্রাইসের ছেলেদের পড়াশোনা, বড় হয়ে উপযুক্ত কর্মজীবনে থিতু হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি উদার হাতে সাহায্য করেছেন। আর ফ্যানি যদিও তার পরিবারের থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন তবুও তার পরিবারের কারোর জন্য কোনও উপকার করা হয়েছে জানলে, ওদের পরিস্থিতি একটু শুধরেছে শুনলে সত্যিকারের তৃপ্তি পায়। অনেকগুলো বছর পেড়িয়ে গেল, ফ্যানি একবার, মাত্র একবারই উইলিয়ামের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর আনন্দ পেয়েছে। আর বাদবাকি ভাইবোনদের কাউকে চোখে দেখার সুযোগ পায়নি। কারোর মনে হয়নি যে ও একবার কিছুদিনের জন্য হলেও বাড়িতে যেতে পারে। কিম্বা ওর নিজের বাড়ির কেউ ভাবে নি যে ও আরেকবার আসুক। ফ্যানি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই যখন উইলিয়াম নাবিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন সমুদ্রে যাওয়ার আগে এক সপ্তাহ নর্থাম্পটনশায়ারে তার বোনের সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ জানানো হলো তাকে। ওদের দেখা করার ব্যগ্রতা, একসঙ্গে সময় কাটানোর তুমুল আনন্দের মুহূর্তগুলো কিম্বা গুরুগম্ভীর আলোচনাগুলো যে কতটা সুখ বয়ে আনল ওদের জন্য তা কিছুটা অনুমান করে নিতে হলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উইলিয়ামের আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আর উইলিয়ামের চলে যাওয়ার পর ফ্যানির কষ্ট বড় স্পষ্ট ছিল। সৌভাগ্যবশত ওদের দেখা হল ক্রিসমাসের ছুটির সময়। সেই সময় এডমন্ড কাছেই ছিল, তাই ও ফ্যানিকে সান্ত্বনা দিতে পারল। উইলিয়াম কাজে যোগ দিয়ে কী কী করবে, ওর কীরকম উন্নতি হবে এডমন্ড সবকিছু খুব সুন্দর করে ফ্যানিকে বুঝিয়ে বলল। এর ফলে ফ্যানি ধীরে ধীরে মেনে নিল যে উইলিয়াম আর তার বিচ্ছেদের ফলে কিছু উপকার হলেও হতে পারে। এডমন্ড আর ফ্যানি সবসময়ের বন্ধু হয়ে উঠল। যখন ইটন থেকে অক্সফোর্ডে চলে গেল এডমন্ড তখনও ফ্যানির প্রতি তার বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের কোনও পরিবর্তন হয় নি। বরং সে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রমাণ দিয়েছে আরও অনেক বেশি। কারোর থেকে বাড়তি কিছু না করে, বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেলার ভয় না পেয়েও সে কিন্তু যা করতে চায় সেটা সে একদম অন্তর থেকে সৎ ভাবেই করতে চায়। সবসময় ফ্যানির অনুভুতিকে সম্মান করে। একই সঙ্গে কী করে ফ্যানির ভালো দিকগুলো যাতে সবাই বুঝতে পারে সেই চেষ্টা করা যায় সেই ব্যাপারেও এডমন্ড সবসময়ই ওকে নানান পরামর্শ দেয়। আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে ফ্যানির নিজেকে লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা তা কী করে কাটিয়ে তোলা যায় সেজন্যও সমানে সান্ত্বনা বা উৎসাহ দিয়ে যায় এডমন্ড। 

আর সবাই ফ্যানিকে এমন করে পিছনে ঠেলে রাখত যে একা এডমন্ডের পক্ষে ওকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভব ছিল না। তবে এডমন্ডের মনোযোগ ফ্যানির কাছে এতোটাই দামি যে সেটা ওকে এক অন্য রকমের আনন্দ দেয়। এডমন্ডের মনোযোগ ফ্যানির মননের উন্নতিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। এডমন্ড জানে ফ্যানি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সবকিছু চটপট ধরে ফেলে, পড়াশোনা করতে ভালোবাসে। ঠিকমতন পরিচালিত হলে এসবকিছুই এক একটা দামি শিক্ষা। মিস লি ফ্যানিকে ফরাসি ভাষা শেখান, রোজ কিছুটা করে ইতিহাস পড়ান। কিন্তু অবসর সময়ে যেসব বই পড়তে ফ্যানি মুগ্ধ হয়ে পড়ে সেগুলো এডমন্ডই ওকে পড়তে বলে দেয়। ফ্যানির রুচিবোধের উন্নতি হোক বা নীতিবোধের গঠন – সব কিছুতেই এডমন্ড যথেষ্ট উৎসাহ দেয়। ফ্যানি যা কিছু পড়াশোনা করে সেগুলো যাতে সত্যিই কাজে আসে তার জন্য এডমন্ড সেগুলো নিয়ে ফ্যানির সঙ্গে আলোচনা করে, ওকে সমানে প্রশংসা করে উৎসাহ জুগিয়ে যায়। এডমন্ডের এত কিছু করার বিনিময়ে ফ্যানি যা দেয় তা হলো ওর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এমনিতে ফ্যানি উইলিয়ামকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে। আর তারপর ফ্যানি দুনিয়ার সবথেকে বেশি ভালোবাসে এডমন্ডকেই।