জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল - গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী - পর্ব ২৬

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল

(গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী)

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদঃ অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – ছাব্বিশ

শেষবারের মতো যখন বাররানকিয়ায় চলে গেলাম, এই পরিবর্তনটা আমার কাছে শুধু একটা শহর বা বাড়ি বদল করা মাত্র ছিল না, ছিল তার চেয়েও কিছু বেশি – অভিভাবকের পরিবর্তন আর তা ঘটেছিল আমার এগারো বছর বয়সে। এই নতুন মানুষটি বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু দাদু-দিদিমার বাড়িতে আমি আর মার্গারিতা যে পিতৃবৎ কর্তৃত্বের আবহে সানন্দে দিন কাটাতাম তার থেকে এই মানুষটির শাসন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা ছিলাম নিজেরাই নিজেদের মালিক। হঠাৎ করে এই অপরিচিত নিয়মের অধীন হতে তাই বেশ কষ্ট হয়েছিল। বাবার প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যেটি উল্লেখযোগ্য তা হল সম্পূর্ণভাবে স্বশিক্ষার প্রচেষ্টা। তাঁর মতো স্বশিক্ষিত ও সর্বগ্রাসী পাঠক আমি জীবনে দেখিনি। অথচ ব্যক্তিজীবনে তিনি একেবারেই শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন না। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি নিজে নিজেই হোমিওপ্যাথি শিখেছিলেন এবং সম্মানের সঙ্গে লাইসেন্সও অর্জন করেছিলেন। সেই সময় অবশ্য এর জন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির প্রয়োজন হত না। তবে আমার মায়ের মতো দুঃসময়ের মোকাবিলা করার শক্তি তাঁর ছিল না। ঝামেলার সম্মুখীন হলেই তিনি নিজের ঘরে হ্যামকে শুয়ে হাতের কাছে যা পেতেন তাই পড়তেন আর শব্দজব্দ করতেন। বাস্তবের সঙ্গে তাঁর মোকাবিলা কোনও সমাধানে পৌঁছতে পারত না। ধনী মানুষদের প্রতি তাঁর ভক্তি ছিল প্রায় গল্প-কথার মতো। তবে যাদের অর্থের উৎসের কোনও হদিশ নেই তাদের জন্য বাবার ভক্তি ছিল না, ছিল তাদের জন্য, যারা নিজেদের প্রতিভাবলে ও সততার সঙ্গে অর্থ উপার্জন করেছে। দিনের বেলাতেও হ্যামকে শুয়ে জেগে জেগেই কল্পনায় প্রভূত অর্থ রোজগারের পরিকল্পনা করতেন এবং তা করতেন এমন সব সহজ ব্যবসার মাধ্যমে যে নিজেই বুঝে উঠতে পারতেন না এই বুদ্ধি কেন তাঁর আগে উদয় হয়নি। তিনি দারিয়েন গ্যাপের বিরল সব ঐশ্বর্যের উদাহরণ দিতে ভালোবাসতেন। কিন্তু আমরা যেসব জায়গায় বাস করতাম সেখানে ওই ধরণের অসাধারণ ব্যবসার সন্ধান পাওয়া যেত না। তা ছিল হারিয়ে যাওয়া সব স্বর্গপুরীতে যাদের কথা তিনি শুনেছিলেন টেলিগ্রাফ অফিসে কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়ানোর সময়। আর তাঁর এই বাস্তববোধের অভাব আমাদেরকে এক দুর্দশা থেকে অন্য দুর্দশার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখত। এমনকি মাঝে মাঝে বেশ বড় সময়ের জন্য প্রতিদিনের খাওয়ার পাউরুটির টুকরোটুকুও আকাশ থেকে আমাদের জন্য নেমে আসত না। তবে বাবা-মা আমাদের শিখিয়েছিলেন ভালো আর মন্দ সময়ের মধ্যে একটিকে উদযাপন করতে হবে আর অন্যটিকে সহ্য করতে হবে। আর এ দুটোই করতে হবে আদি ক্যাথলিকদের বিনয় ও আত্মসম্মানের সঙ্গে।

তখনও পর্যন্ত আমার জন্য একটা পরীক্ষাই বাকি ছিল আর তা হল বাবার সঙ্গে একা কোথাও যাওয়া। সেটাও সম্পূর্ণ হল যখন তিনি আমাকে বাররানকিয়ায় নিয়ে গেলেন ওষুধের দোকান খোলা ও পরিবারের সেখানে যাওয়ার আগে সমস্ত বন্দোবস্ত করতে তাঁকে সাহায্য করার জন্য। আমি বেশ অবাক হয়ে দেখলাম যে তাঁর সঙ্গে যখন একা আছি তিনি আমার প্রতি এমন ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করছেন যেন আমি বয়সে অনেকটা বড়। এমনকি যে সব কাজের দায়িত্ব আমায় দিচ্ছিলেন তা আমার বয়সের পক্ষে বেশ শক্ত ছিল। তবুও তা আনন্দের সঙ্গে ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলাম। অবশ্য বাবা সবসময় সেটা মনে করতেন না। তিনি যে গ্রামে জন্মেছিলেন সেইখানে তাঁর ছেলেবেলার গল্প প্রায়শই আমাদের বলতেন। কিন্তু একই গল্প বছরের পর বছর ধরে বলে যেতেন আমাদের পরে যে সব ভাইবোন জন্মেছিল তাদেরকেও। এর ফলে আমরা যারা গল্পগুলো আগেই শুনেছি আর কোনও মজা পেতাম না। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছিল যে খাওয়ার পরে যেই তিনি গল্প বলতে শুরু করতেন আমরা বড়রা টেবিল থেকে উঠে পড়তাম। এরকমই এক দিনে লুইস এনরিকে উঠে যাওয়ার সময় তাঁকে রাগিয়ে দিয়ে মুখের উপর বলে দিলঃ

  • ‘আমাদের ঠাকুরদা আবার যখন মারা যাবেন তখন আমায় ডেকো।’

এনরিকের বারংবার এই ধরণের আবেগপ্রবণ বিস্ফোরণে বাবা ভীষণ রেগে যেতেন এবং তাকে মেদেজিনের নৈতিক উন্নতিসাধনের বিশেষ স্কুলে পাঠানোর কথা যে ভাবছিলেন তা আরও বেশি জোরদার হয়ে যেত। অথচ তিনিই যখন বাররানকিয়ায় আমার সঙ্গে ছিলেন যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি খুলে বসতেন তাঁর উপাখ্যানের ঝাঁপি। আমাকে গল্প করতেন মায়ের সঙ্গে থাকার সময় তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা, তাঁর বাবা কেমন নামকরা কিপটে ছিলেন আর ছাত্রাবস্থায় কত কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। এসব কথা শোনার ফলেই তাঁর খামখেয়ালিপনা সহ্য করে নিতে পারতাম। বুঝতেও পারতাম তার কিছু কিছু অবুঝের মতো ব্যবহার।

তখন আমরা কথা বলতাম যে সব বই পড়েছি আর যেসব বই পড়ব তাই নিয়ে। এমনকি বাজারের হতদীর্ণ বইয়ের দোকান থেকেও কমিকস বইয়ের বেশ ভালো ফসল সংগ্রহ করেছিলাম – টারজান, গোয়েন্দাকাহিনী আর মহাকাশ যুদ্ধের গল্প। পাশাপাশি বাবার বাস্তব জ্ঞানের শিকারও হতে হয়েছিল আমাকে। সবচেয়ে ভয়ংকর হয়েছিল যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমরা দিনে একবার মাত্র খাব। আমাদের প্রথম ঝামেলা হল যেদিন দুপুরের খাওয়ার সাত ঘন্টা পরে আমি সন্ধ্যের আবছা আলো সবেমাত্র ভরিয়ে তুলতে শুরু করেছি সোডা ও মিষ্টি পাউরুটি দিয়ে। তিনি আমাকে একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেললেন। প্রধান সমস্যাটা হল তাঁকে বলতে পারছিলাম না কোথা থেকে খাবার কেনার পয়সা আমি পেয়েছি। স্বীকার করবার সাহস ছিল না যে এখানে আসার আগে মা লুকিয়ে আমায় কিছু পয়সা দিয়েছিলেন। কারণ যাতায়াতের সময় বাবা যে প্রায় মৌন সন্ন্যাসীদের কঠোর অনুশাসন চালাবেন তা জানতে মায়ের বাকি ছিল না। মায়ের সঙ্গে এই গোপন আঁতাত বজায় ছিল যতদিন পর্যন্ত তিনি নিজের হাতে সংসার খরচ করতেন। যখন সেকেন্ডারি স্কুলের হোস্টেলে থাকতাম মা আমার ব্যাগে বাথরুমের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিষ দেওয়ার সময় এক বাক্স রেউতের সাবানের ভেতরে দশ পেসো রেখে দিতেন এই ভেবে যে ভীষণ দরকারের সময় হয়তো আমি এই বাক্সটা খুলব। হতোও ঠিক তাই। আসলে বাড়ি থেকে দূরে থাকার সময় যে কোনো মুহূর্তই দশ পেসো খুঁজে পাওয়ার জন্য আদর্শ মুহূর্ত।

বাররানকিয়ার ওষুধের দোকানে রাত্রিবেলা যাতে আমাকে একা থাকতে না হয় তার ব্যবস্থা বাবা করেছিলেন। কিন্তু সেই আয়োজন আমার মতো একজন বারো বছরের কিশোরের পক্ষে সব সময় যে আনন্দদায়ক হত তা নয়। আমাকে তাঁর বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে যেতেন। কিন্তু সেখানে আমার একদম ভালো লাগত না। কেননা যাঁদের আমার বয়সী ছেলেমেয়ে আছে তাদেরকে আটটার মধ্যে জোর করে শুতে পাঠানো হত আর আমি পড়ে থাকতাম পারিবারিক তুচ্ছ কথাবার্তার পোড়োজমিতে চোখে ঘুম আর মনে চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে। একদিন বাবার এক চিকিৎসক বন্ধুর বাড়িতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর কেমন করে জানি না আর কটার সময়ই বা আমি জেগে উঠলাম একটা অচেনা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। কোথায় যে ছিলাম বা কেমন করে সেখানে পৌঁছলাম সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ঘটনাটাকে স্বপ্নচারণ বা ঘুমের মধ্যে হাঁটা ছাড়া আর কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের বংশে কারুর এই সমস্যা ছিল না। অদ্ভুতভাবে সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আর সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। কিন্তু স্বপ্নচারণ ছাড়া আর কোনও কারণ দিয়ে তার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। জেগে উঠে প্রথম যেটা দেখে আমি চমকে উঠলাম সেটা ছিল একটা সেলুনের জানলায় রাখা আয়নার উজ্জ্বল আলো। সেখানে একটা ঘড়ির নিচে তিন-চারজন খরিদ্দার অপেক্ষা করছে। ঘড়িতে তখন বাজে আটটা দশ। সেই সময়ে আমার বয়সী একজন ছেলের পক্ষে রাস্তায় একা ঘুরে বেড়ানো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। ভয় পেয়ে আমি যাঁদের বাড়িতে ছিলাম তাঁদের নাম ঠিক করে বলতে পারছিলাম না। সেই বাড়ির ঠিকানাটাও ভুলভাল বলছিলাম। তবে কয়েকজন পথচারী আমার কথা থেকেই জোড়াতালি দিয়ে প্রকৃত ঠিকানা বুঝে নিয়ে আমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম পাড়া-প্রতিবেশি সবাই প্রবল আতঙ্কে আমার অদৃশ্য হওয়া নিয়ে সব রকমের ভাবনা ভেবে ফেলেছেন। তাঁদের একমাত্র যেটা মনে ছিল যে আমি কথার মাঝখানে চেয়ার থেকে উঠে গিয়েছিলাম। তাঁরা ভেবেছিলেন যে আমি বাথরুমে গিয়েছি। কিন্তু স্বপ্নচারণের কথা কাউকে বিশ্বাস করানো যায়নি। বিশেষ করে আমার বাবাকে। তিনি সরাসরি ধরে নিলেন যে দুষ্টুমি করতে গিয়ে আমি ফেঁসে গেছি।

কিছুদিন পরে সৌভাগ্যক্রমে অন্য একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। সেখানে আমাকে রেখে বাবা চলে গেলেন ব্যবসা-সংক্রান্ত রাতের খাবারের নিমন্ত্রণে। সেই পরিবারটি খুব পছন্দ করত আতলান্তিকো রেডিয়ো স্টেশনের জনপ্রিয় কুইজ প্রতিযোগিতা শুনতে। সেদিন যে প্রশ্ন করা হল তার উত্তর দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। প্রশ্নটা হল, কোন জন্তু পাক খেয়ে উলটে গেলে নাম পালটে যায়? আশ্চর্য্যজনকভাবে সেদিনই সন্ধ্যবেলা ‘আলমাঙ্কে ব্রিস্তোল’-এর শেষ সংস্করণে এই প্রশ্নের উত্তরটা পড়েছিলাম। পড়ে আমার মনে হয়েছিল একটা বাজে চুটকি। উত্তরটা হল গুবরে পোকা – এই পোকা উল্টে গেলে নাম পালটে যায়। ওই বাড়ির একটা বাচ্চা মেয়েকে চুপিচুপি উত্তরটা বললাম আর বড় মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে আতলান্তিকো রেডিয়ো স্টেশনে ফোন করে উত্তরটা বলে দিল। সে জিতে গেল প্রথম পুরস্কার – একশো পেসো। এই টাকা তাদের তিন মাসের বাড়িভাড়া দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। তৎক্ষণাৎ বসার ঘর পূর্ণ হয়ে গেল উত্তেজিত প্রতিবেশীদের ভিড়ে যারা অনুষ্ঠানটা শুনছিল। তারা এই বাড়ির লোকজনদের অভিনন্দন জানাতে এসেছে। তবে এই বাড়ির সবার কাছে পুরষ্কারের অর্থমূল্যের চেয়েও বেশি ছিল গোটা ক্যারিবীয় উপকূলে ইতিহাস তৈরি করা সেই অনুষ্ঠানে জয়লাভ করা। কিন্তু আমি যে সেখানে আছি তা কেউ খেয়াল করল না। বাবা আমাকে নিতে সেখানে ফিরলে তিনিও আনন্দোৎসবে যোগ দিয়ে সবার সঙ্গে মদ খেলেন। অথচ কেউ তাঁকে বললেন না সত্যিকারের বিজেতা কে ছিল।

সেই সময়ে আমার অন্য আরেকটি বিরাট পাওনা ছিল বাবার অনুমতি নিয়ে কলোম্বিয়া সিনেমা হলে একা একা রবিবারের ম্যাটিনি শো দেখতে যাওয়া। তখনই প্রথম প্রতি রবিবারে সিরিয়ালের একটা করে পর্ব দেখানো শুরু হয়েছিল। তার ফলে সারা সপ্তাহ ধরে জিইয়ে থাকত টানটান উত্তেজনা। ‘লা ইনভাসিয়োন দে মোঙ্গো’ ছিল প্রথম আন্তরগ্রহ মহাকাব্য। সেটি আমার মনের মধ্যে যে জায়গা নিয়েছিল তা একমাত্র প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছিল বহু বছর পরে স্ট্যানলি কুব্রিকের তৈরি ‘ওদিসেয়া দেল এস্পাসিয়ো’। তবে আর্হেন্তিনার সিনেমা, বিশেষ করে কার্লোস গার্দেল ও লিবেরতাদ লামার্কের ছবি আর সবকিছুকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল।

দু’মাসেরও কম সময়ে আমরা ফার্মেসি গুছিয়ে ফেললাম ও একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানেও আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজিয়ে ফেললাম। ফার্মেসিটা ছিল একটা বাজারের মাঝখানের একটা ব্যস্ত কোনায়। পাসেয়ো বোলিবার থেকে মাত্র চারটে ব্লক দূরে। বিপরীতে বাড়িটা ছিল অনুন্নত কিন্তু প্রাণোচ্ছল বাররিয়ো আবাহোর একটা প্রান্তে। তবে ভাড়াটা বাড়ির তখনকার অবস্থার সমতুল্য ছিল না, বরং বাড়িটা যা হতে চাইত তার উপযুক্তঃ দুটো সুউচ্চ মিনার ও জাফরিকাটা খিলান দেওয়া লাল-হলুদ রঙের গথিক আকারের অট্টালিকা।

যেদিন প্রথম আমরা ফার্মেসিটা পেলাম সেদিনই দোকানের পিছনের স্টোরের হুকে হ্যামক ঝুলিয়ে ঘুমোলাম। আমাদের সারা শরীর ঘামে জবজবে হয়ে ভিজে গিয়েছিল। বাড়িটা নেওয়ার পর আবিষ্কার করলাম যে সেখানে হ্যামক টাঙানোর কোনও হুক নেই। তবে আমরা মেঝেয় তোষক পেতে নিলাম আর যেদিন থেকে ইঁদুর ধরার জন্য একটা বিড়াল নিয়ে এলাম সেদিন থেকে নিশ্চিন্তে ঘুমোলাম। তারপর মা এসে পৌঁছলেন বাকি সবাইকে নিয়ে, কিন্তু তখনও পর্যন্ত গোছানোর কাজ শেষ হয়নি। তাছাড়া রান্নার জিনিষপত্র বা অন্য অনেককিছুই ছিল না যা প্রতিদিনের জীবনে অবশ্য প্রয়োজনীয়।

শৈল্পিক হওয়ার কিছুটা ভান থাকলেও বাড়িটা আসলে আমাদের সকলের পক্ষে ছোটই ছিল। সেখানে ছিল একটা বসার ঘর, একটা খাবার ঘর, দুটো শোবার ঘর আর একটা ছোট পাথর বিছানো উঠোন। যে ভাড়া আমরা দিতাম আসলে তার তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া হওয়া উচিত ছিল। মা তো বাড়ি দেখেই ভয়ংকর রেগে গেলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী তাঁকে শান্ত করলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে। সব সময়ে এমনটাই হত। এটা বোঝা সত্যিই দুষ্কর ছিল যে কিভাবে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির মানুষ একে অন্যকে এত ভালো বোঝেন এবং এত ভালোবাসতে পারেন।

মায়ের চেহারা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি তখন সাতবারের বার গর্ভবতী। আমার মনে হল পেটের মতোই তাঁর চোখ আর গোড়ালি ফুলে গেছে। তখন তাঁর বয়স তেত্রিশ আর সেটা ছিল পাঁচ নম্বর বাসা যা তিনি গোছাচ্ছেন। তাঁর খিটখিটে ভাব আমায় চিন্তিত করল। প্রথম রাতের পর তাঁর মেজাজ আরও খারাপ হয়ে উঠল। কারণ কোনও রকম বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই তিনি উদ্ভাবন করলেন যে ওইখানে যে মহিলা এর আগে বাস করত তাকে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছিল। খুন একটা হয়েছিল ঠিকই, তবে তা সাত বছর আগে বাবা-মা যখন বাররানকিয়ায় থাকতেন তখন। সেই সময় মা এত ভয় পেয়েছিলেন যে ওই শহরে আর বাস করবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। এবারে ফিরে আসার সময় সম্ভবত তিনি তা ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু ছায়াচ্ছন্ন বাড়িতে প্রথম রাত কাটানোর পরেই তাঁর সব মনে পড়ে গেল এবং বাড়িটার সঙ্গে তিনি ড্রাকুলার দুর্গের সঙ্গে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন।

সেই মহিলার সম্বন্ধে প্রথম যা শোনা গিয়েছিল তা হল তাকে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় এবং শরীরে এতটাই পচন ধরেছিল যে মুখ দেখে চেনা যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে বোঝা গিয়েছিল যে তার বয়স তিরিশের মধ্যে, চুল কালো এবং চেহারা বেশ আকর্ষণীয়। ধারণা করা হয়েছিল যে তাকে জ্যান্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হয়, কেননা তার বাঁ হাত ছিল চোখের উপর, ভয় পেলে মানুষের প্রতিক্রিয়া যেমন হয় আর ডানহাত ছিল মাথার উপর। তার পরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে ছিল শুধুমাত্র দুটি নীল ফিতে আর একটি নকসা করা চিরুনি যার সঙ্গে সম্ভবত বেণী ঝোলানো ছিল। অসংখ্য অনুমানের মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য তা হল মেয়েটি চটুল চরিত্রের একজন নৃত্যশিল্পী যে খুনের সম্ভাব্য দিনের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়।

বাররানকিয়ার খ্যাতি ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে অতিথিবৎসল ও নিরুদ্বিগ্ন শহর হিসেবে। কিন্তু প্রতি বছর একটা করে ভয়ংকর খুন হওয়ায় তার সে সুনামে চিড় ধরল। তবে এই ছুরিকাহত অপরিচিতার মতো আর কোনও খুনের ঘটনা এত গভীর ও এত দীর্ঘ দিন ধরে জনমানসে প্রভাব ফেলেনি। সেই সময়ের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র ‘লা প্রেন্সা’ বিখ্যাত ছিল রবিবারের কমিক কাহিনী ‘বাক রজার্স’, ‘বনমানুষের মধ্যে টারজান’ ইত্যাদি ছাপার জন্য। পাশাপাশি প্রকাশনার শুরু থেকেই অপরাধের কাহিনী প্রকাশের অগ্রদূত হয়ে উঠল। বেশ কয়েক মাস ধরে বড় বড় হেডলাইন করে ও যুক্তিসহ বা যুক্তি ছাড়াই বিস্ময়কর সব উদ্ঘাটন করে শহরের পারদ চড়িয়ে রেখেছিল আর অধুনা-বিস্মৃত সেই সব সাংবাদিকদের নাম তখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

প্রশাসন কাগজের রিপোর্ট বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল এই বলে যে এই সব খবর তদন্তে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বস্তুত মানুষ প্রশাসনের কথার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করত ‘লা প্রেন্সা’-র উদ্ভাবনে। এই বাদ-প্রতিবাদ জনতাকে আরও বেশি কৌতূহলী করে তুলল এবং নিদেনপক্ষে একবারের জন্য হলেও তদন্তকারীদের নিজেদের কাজের অভিমুখ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিল। নিহত মহিলার ভয়াবহ চিত্র মানুষকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে অনেক বাড়ির দরজা চেন দিয়ে বন্ধ করা হত এবং রাত-পাহারার বিশেষ ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কেননা তাদের ধারণা হয়েছিল যে সেই মুক্ত খুনি তার ভয়ংকর অপরাধ আবারও চালিয়ে যেতে পারে। এমনকি কিশোরী মেয়েরা সন্ধ্যে ছ’টার পর একা বাইরে বেরোতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু সত্যিটা কেউ ধরতে পারল না। তা প্রকাশ পেল আরও কিছুদিন পর যখন অপরাধী এফরাইন দুনকান নিজেই স্বীকার করল যে সে তার স্ত্রী আনহেলা ওইয়োসকে হত্যা করেছে। দিনটাও যা বলল তা পোস্টমর্টেম অফিসের হিসাবের সঙ্গে মিলে গেল এবং স্ত্রীকে যেখানে পুঁতে দিয়েছিল বলল সেখান থেকেই আনহেলের ছুরিকাহত শব পাওয়া গিয়েছিল। পরিবারের লোক চিনতে পারল নীল ফিতে আর চিরুণী যা পরে আনহেল ৫ই এপ্রিল স্বামীর সঙ্গে বেরিয়েছিল কালামার যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তারপর মামলাটির মীমাংসা হল এবং শেষ হল এমন এক অবিশ্বাস্য চমক দিয়ে যে মনে হবে ব্যাপারটা বুঝি কোনও এক আজগুবি গল্পকারের ঝুলি থেকে বেরিয়েছে – আনহেলা ওইয়োসের একজন সদৃশ যমজ বোন ছিল যার জন্যই নির্দ্ধিধায় তার পরিচয় প্রকাশ পেল।

এই মহিলার মৃত্যু সংবাদ একটি আবেগঘটিত অপরাধ হিসেবে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হল, কিন্তু যমজ বোনের রহস্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতে লাগল আর সবার ধারণা হল যে বোন নয়, নিহত মহিলা নিজেই ডাকিনীবিদ্যার দৌলতে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাড়ির সদর দরজা আবার খিল দিয়ে ও প্রাচীরের মতো আসবাব দিয়ে বন্ধ করা হল যাতে জাদুর দৌলতে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া হত্যাকারী রাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে। ধনী এলাকাগুলোতে আক্রমণ করতে প্রশিক্ষিত শিকারী কুকুর রাখা ফ্যাশন হয়ে উঠল যাতে দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে সক্ষম খুনিকে প্রতিরোধ করা যায়। বাস্তবিক আমার মা ভয় কাটিয়ে উঠতে পারলেন তখনই যখন প্রতিবেশীরা তাঁকে বোঝাতে সমর্থ হল যে বাররিয়ো আবাহোর বাড়িটা ওই মহিলা নিহত হওয়ার সময়ে তৈরিই হয়নি।

টীকা

১। দারিয়েন গ্যাপঃ কলোম্বিয়া ও পানামার সীমান্তে অবস্থিত একটি অঞ্চল।

২। আলমাঙ্কে ব্রিস্তোলঃ একটি বার্ষিক পত্রিকা, যা ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে এখনও অবধি প্রকাশিত হচ্ছে।

৩। গুবরে পোকাঃ স্প্যানিশ ভাষায় ‘Escarabajo’। Cara মানে মুখ আর Abajo মানে নিচে। এখন পোকাটা উলটে গেলে মুখ উপর দিকে চলে যাবে, তখন তাকে বলা হয় ‘Escararriba’। Arriba মানে উপরে।‘Escararriba’ একটি তৈরি করা শব্দ।

৪। লা ইনভাসিয়োন দে মোঙ্গোঃ ‘ফ্ল্যাশ গর্ডন’ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মীত সিরিয়াল।

৫। ওদিসেয়া দেল এস্পাসিয়োঃ কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র। ইংরাজিতে নাম - A Space Odyssey 

 

প্রথম পর্বের লিংক

দ্বিতীয় পর্বের লিংক

তৃতীয় পর্বের লিংক

চতুর্থ পর্বের লিংক

পঞ্চম পর্বের লিংক

ষষ্ঠ পর্বের লিংক

সপ্তম পর্বের লিংক

অষ্টম পর্বের লিংক

নবম পর্বের লিংক

দশম পর্বের লিংক

একাদশ পর্বের লিংক

দ্বাদশ পর্বের লিংক

ত্রয়োদশ পর্বের লিংক

চতুর্দশ পর্বের লিংক

পঞ্চদশ পর্বের লিংক

ষোড়শ পর্বের লিংক

সপ্তদশ পর্বের লিংক 

অষ্টাদশ পর্বের লিংক 

উনিশতম পর্বের লিংক 

বিশতম পর্বের লিংক 

একুশতম পর্বের লিংক 

বাইশতম পর্বের লিংক 

তেইশতম পর্বের লিংক 

চব্বিশতম পর্বের লিংক 

পঁচিশতম পর্বের লিংক