ঝিলের ধারে বাড়ি : শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের একাদশ আখ্যান
- 18 January, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক
নয় নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘পাগলা সাহেবের বাড়ি’ পড়ে মনে হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যদি পেশায় লেখক না হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হতেন, ছাপোষা লোকের ঘরদোরে একগাদা গুপ্ত সুড়ঙ্গ, গুপ্তগৃহ গজিয়ে উঠতো। অমুকের ঘরের চিলেকোঠার ফোকর গলে দিব্যি চলে যাওয়া যেত পাশের পাড়ার কোনও বাড়ির অন্দরমহলে। কারা সব নাকি ব্ল্যাকমানি রাখার জায়গা খুঁজে খুঁজে হয়রান, সিবিআই গন্ধ পেলেই হালুম করে। সেই অভাগারা চাট্টি গুপ্তগৃহ বানিয়ে দিব্যি সবকিছু লুকিয়ে ফেলতো পারতো, সিবিআইয়ের দাদুও খুঁজে বের করতে পারতো না। শীর্ষেন্দুর এগারোনম্বর উপন্যাস ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’ পড়লে এমন সব অদ্ভুতুড়ে খেয়াল আসা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। এ গল্পে আছে মস্ত এক ঝিল, ঝিলের নীচে নেমে গেছে পরপর অগুনতি সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলে পাওয়া যায় অনেককাল আগে হারিয়ে যাওয়া একটা মন্দির। সে মন্দিরে আজও সযত্নে বিগ্রহ বসানো আছে। মন্দিরের অনেকগুলো দরজা। কোনও দরজার মুখ গিয়ে শেষ হয়েছে আরও কঠিন ভুলভুলাইয়ার অন্দরে। কোনও দরজা নিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত এক ইঁদারার মুখে। কোনও দরজা দিয়ে চলে যাওয়া যায় ভূতপূর্ব জমিদারবাড়ির পাতালঘরে।
দুটো অঞ্চল নিয়ে এ গল্প। কেটেরহাট ও চাঁপাকুঞ্জ। অনেক অনেক দিন আগে কয়েকজন ডাকাত পরের সর্বস্ব লুট করে এলাকার রাজাগজা হয়ে বসে। পাশাপাশি রাজত্ব করতে থাকে দুটি পরিবার। ইংরেজ আমলে আরেকটু হলেই রায়বাহাদুর খেতাব জুটে যেত তাদের। তবে সময় বদলায়। রাজত্বের গর্ব-অভিমানের দিন শেষ। একটি পরিবারে বংশধর বলতে একজনই বেঁচে আছে, নবীন। দেনার দায়ে মাথার চুল পর্যন্ত বাঁধা পড়ে আছে স্থানীয় মহাজনের কাছে। বসতবাড়িটি বাঁধা পড়েছে। তলায় পাতালঘর থাকলেও তার দরজা খোলার কায়দাটা জানে না নবীন। মহাজন তক্কে তক্কে আছে, যেকোনও দিন সে নবীনকে তাড়িয়ে বাড়ি দখল করবে। এলাকার অন্য একটি জমিদার পরিবারে ভাঙন ধরেছে। এর আগে পর্যন্ত অদ্ভুতুড়ে সিরিজের লেখাগুলিতে যৌথ পরিবারের কনসেপ্ট বড় বেশি করে চোখে পড়েছে। দাদু ঠাকুমা জেঠু কাকু পিসি সব্বাই কেমন সুন্দর একসাথে মিলেমিশে থাকে। এগারোনম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৮৮-তে। ‘ছোটা পরিবার সুখী পরিবার’ স্লোগান ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কেটেরহাটের বাড়িতে রয়ে গেছেন দাদু ঠাকুমা। পরিবারের বাকিরা চলে গেছেন শহরে। ছুটিছাটায় নাতি নাতনিরা বেড়াতে আসছে দাদুর কাছে।
ঝিলের কাছে যে বাড়িটি রয়েছে, সেইটি দাদু সদাশিবেরই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়ি। এখন সেখানে থাকতে এসেছে তিনজন শহুরে মানুষ। পোকামাকড় আগাছা নিয়ে গবেষণা করতে চায়, তবু তাদের রকমসকম কিঞ্চিৎ সন্দেহজনক। শীর্ষেন্দু এখানে গোয়েন্দাগল্পের ‘রেড হেরিং’ কনসেপ্টটা ভালোমতো ব্যবহার করেছেন। গোয়েন্দাগল্পে কিছু মিসলিডিং ক্লু থাকে, যার জন্য পাঠকের নজর আসল অপরাধীর ওপর পড়ে না, একেবারে ভুল লোককে মনে মনে ‘এই ব্যাটা দুষ্টু লোক’ ভেবে তাকেই আগাপাশতলা নজরদারি করতে থাকে। এ গল্পেও তাই হয়েছে। ওই তিনজন বিজ্ঞানীকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। আদতে তারা বেশ ভালোমানুষ! ভিলেন সেই এলাকার মহাজন, যে নবীনের বাড়িটি গাপ করবে বলে বসে আছে। নবীন এবং সদাশিব দুজনেই রাজপরিবারের বংশধর। দুজনের বাড়িই গুপ্তসুড়ঙ্গ দিয়ে কানেক্টেড। কেটেরহাট ও চাঁপাগঞ্জ আসলে ফাঁপা জায়গা। মাটির নীচে রয়েছে মন্দির, লম্বা লম্বা সুড়ঙ্গ, গুপ্তগৃহ আর রয়েছে গুপ্তধন! ডাকাত পূর্বপুরুষেরা সব সোনাদানা জমিয়ে রেখে গিয়েছেন পাতালঘরে। আর হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন কিছু কিংবদন্তি। জলের নীচে মন্দির, পাতালঘর, গুপ্তসুড়ঙ্গের ভাসা ভাসা বিবরণ এলাকার সবাই জানে। এই কিংবদন্তির সূত্রেই এসে পড়েছে কিছু দুষ্টুলোক।
গল্প হতে পারতো দারুণ জমাটি। কিন্তু শুরু থেকেই গল্পে যেন বড়ই প্রাণের অভাব। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের সেই চেনা হাসি-ঠাট্টার সুর আগাগোড়াই মিসিং। বড়ই কেঠো, গম্ভীর উপস্থাপনা। একটামাত্র ভূত আছে, সেও কেমন যেন থাকলেও চলে না থাকলেও চলে। ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’এর নিধিরাম ভূত কত উজ্জ্বল একটা চরিত্র ছিল। এ গল্পের ভূতের নামটা গল্প শেষ হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই মাথা থেকে উধাও। এ ভূত মনে দাগ কাটতে অপারগ।
‘‘আচমকাই কানের কাছে একটা 'খুক' শব্দ। তার পর কানে-কানে সেই পরিচিত ফিসফিস আওয়াজ। "বাপের ব্যাটার মতো একটা কাজ করলে বটে হে। ওই চতুর্ভুজের মন্দিরে আমি এক সময়ে পুজুরি ছিলুম।"
নবীন একটু রেগে গিয়ে বলল, "মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবেন না তো! আপনি কোথাকার পুজুরি ছিলেন, তা জেনে আমার লাভটা কী? বিপদের সময় তো আপনার টিকিটিরও নাগাল পাওয়া গেল না। জলে-ডোবা সুড়ঙ্গের মধ্যে আমরা যখন মরতে বসেছিলাম, তখন কোথায় ছিলেন? এখন যে ভারী আহ্লাদ দেখাতে এসেছেন!"
কণ্ঠস্বরটা একটু নিবু-নিবু হয়ে বলল, "সুড়ঙ্গের মধ্যে কি আর সাধে ঢুকিনি রে ভাই? তোমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠপুরুষ কালীচরণকে দেখলে না? ইয়া গোঁফ, অ্যাই গালপাট্টা, ইয়া বুকের ছাতি, হাতির পায়ের মতো প্রকাণ্ড হাত, থামের মতো পা নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।"
ভূতের সঙ্গে নবীনের কথোপকথনটুকু পড়লেই মালুম হয়, এ ভূতের রসবোধ নেই। নবীনের সেন্স অফ হিউমার নেই। লেখকও কমিক রিলিফ ঢেলে পরিবেশন করার মওকাটি হাতছাড়া করেছেন।
আর, আবারও সেই তাড়াহুড়ো। গল্প জমতে না জমতেই হুড়মুড়িয়ে ক্লাইম্যাক্স। আগের উপন্যাস ‘হারানো কাকাতুয়া’তে চমৎকার প্লট ট্যুইস্ট ছিল, গল্প মন দিয়ে পড়লে বেশ বোঝা যায় লেখক ওই ট্যুইস্টের কথা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন এবং সুযোগমতো ক্লু দিতে দিতে এগিয়েছেন। এই গল্পে অর্থাৎ ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’তে ট্যুইস্ট আছে, কিন্তু তার যৌক্তিকতা নেই। এলাকার মহাজনই যদি এত কাণ্ডকারখানার আড়ালে থাকবে, সে কেন অতদিন অপেক্ষা করল? চাইলে সে অনেক আগেই নবীনকে তাড়িয়ে বাড়ির দখল নিতে পারতো, গুপ্তধন কবজা করতে পারতো। ঠিক যখন শহর থেকে তিনজন বিজ্ঞানী এল, তখনই তার টনক নড়ল আর গুন্ডা ধরে আনল গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্য? নবীন খুবই কাকতালীয়ভাবে গুপ্তধনের হদিশ পেয়েছে। মহাজন কী ভাবে জানলো, ওই সময়েই নবীন এদিক ওদিক ঠোক্কর খেতে খেতে গুপ্তধনের রাস্তা খুঁজে বের করে ফেলবে? নবীনের সঙ্গে দুজন খুদে ছিল, সদাশিবের নাতি নাতনী। ছোটদের জন্য লেখা অ্যাডভেঞ্চারের গল্পে খুদেরা বেশ হিরোচিত ডাকাবুকো হবে, তা আশ্চর্যের কথা নয়। তবে গল্পের ক্লাইম্যাক্সে তাদের উপস্থিতি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। দুজন সাহসী জেদী ভাইবোন ইঁদারা আবিষ্কার করেছে, লতাপাতায় ঝুলে ঝুলে ইঁদারার নীচে নেমেছে। জলভর্তি লম্বা সুড়ঙ্গ ডুবসাঁতারে পেরিয়েছে। সঙ্গে নবীন ছিল, সে ওদের গুন্ডাদের গুলি থেকে বাঁচিয়ে এনেছে। তারপর একজন দায়িত্ববান গুরুজন হিসেবে বাচ্চাদুটোকে তাদের দাদুর বাড়িতে রেখে এসেছে। কিন্তু ক্লাইম্যাক্সে যখন পাতালঘরে গুলি চলছে, মারামারি হচ্ছে, তখন সদাশিবের সঙ্গে তাদের ফিরে আসাটা কেমন অদ্ভুত না? সদাশিব নাতি নাতনিকে এত ভালোবাসেন, তিনি কেন তাদের বিপদের মুখে নিয়ে যাবেন? এমনও নয়, যে তিনি নবীনের বাড়ির রাস্তা চেনেন না। আর পাতালঘরের দরজাও খোলা হয়ে গিয়েছিল, অতএব বাচ্চা দুটো ভাইবোন ঠিক কী করতে শেষদৃশ্যে ফিরে এসেছে, তার কোনও ঠিকঠাক উত্তর নেই। এমনিতে পুরো ক্লাইম্যাক্স অত্যন্ত অগোছালো। পড়তে পড়তে মনে হয়, এ উপন্যাস লেখার সময় লেখক বারবার অনির্দিষ্টকালের জন্য লেখা থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। কোন গল্প একটানা লিখে যাওয়া হয়েছে আর কোনটাই বা থেমে থেমে ব্রেক নিয়ে নিয়ে লেখা— গল্প পড়লেই বোঝা যায়। এ গল্পে অসংগতি প্রচুর। স্টোরিলাইন খুবই ভালো, কিন্তু উপস্থাপনার দৌর্বল্যের কারণে এগারো নম্বর অদ্ভুতুড়ে আদর্শ ‘অদ্ভুতুড়ে’ হতে পারেনি।