জেন অস্টেনের এমা - সপ্তম পর্ব
- 07 December, 2025
- লেখক: মধুশ্রী
সপ্তম অধ্যায়
মিস্টার এলটন যেদিন লন্ডন চলে যাবেন, এমার হাতে সেদিন তার বন্ধুকে সাহায্য করার আরেকটা সুযোগ এসে পড়ল। হ্যারিয়েট যথারীতি প্রাতরাশের পরে হার্টফিল্ডে চলে এসেছিল, তারপর আবার বাড়ি গেলেও দুপুরে খাওয়ার জন্য তার আবার আসার কথা। কিন্তু তার আগেই সে এসে উপস্থিত। চোখেমুখে উত্তেজনা, যেন মস্ত একটা কিছু ঘটে গেছে, আর সেকথা বলার জন্য সে ছটফট করছে। আধ মিনিটেই এমার পুরো গল্পটা শোনা হয়ে গেল। মিসেস গডার্ডের ওখানে গিয়ে হ্যারিয়েট জানতে পারে, মিস্টার মার্টিন ঘন্টাখানেক আগে এসেছিলেন। কিন্তু সে নেই আর তার এখনই ফেরার সম্ভাবনা নেই দেখে তার এক বোনের দেওয়া একটা পার্সেল রেখে গেছেন। তাতে এলিজাবেথকে সে যে দুটো গান কপি করতে দিয়েছিল সে দুটো তো আছেই, তার সাথে আছে মিস্টার মার্টিনের লেখা একটা চিঠি – তাকেই লেখা – তাতে সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব। ‘কী কাণ্ড বলুন তো!’ হ্যারিয়েট তো এমন অবাক যে বুঝেই উঠতে পারছে না কী করা উচিত। চমৎকার চিঠি, প্রস্তাবটাও উনি এমন মিষ্টি ভাষায় করেছেন… অন্তত হ্যারিয়েটের তো তাই মনে হল। তিনি লিখেছেন, তিনি হ্যারিয়েটকে খুব ভালোবাসেন। মা গো! সে যে এখন কী করে! তাই তড়িঘড়ি এসেছে মিস উডহাউজের কাছে। এমা এদিকে তার বন্ধুর ছেলেমানুষিপনা দেখে লজ্জায় মরে।
‘যাচ্চলে,’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পাছে নিজে থেকে জিজ্ঞেস না করলে হাত ফসকে যায়, তার জন্য ইনি তো দেখি মরিয়া হয়ে উঠেছেন! একটু রাশ টানলে ভালো হয় না!’
‘চিঠিটা একবার পড়ুন না,’ হ্যারিয়েট মিনতি করল, ‘আমি যে আপনাকে চিঠিটা ভীষণ পড়াতে চাই।’
এ অনুরোধটায় এমা খুশিই হল। কিন্তু পড়তে গিয়ে সে হল অবাক। চিঠিটা যেমন হবে বলে ভেবেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সুখপাঠ্য। ব্যাকরণের ভুল তো নেইই, লেখার ধরনটিও মার্জিত। ভাষা সরল সাধাসিধে হলেও তাতে জোর আছে, নিজস্বতাও আছে। মনের কথাটি লেখক যেভাবে বলেছেন, তাতে তাঁকে বাহবা দিতেই হবে। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু তাতে একটি বুদ্ধিমান, উষ্ণ, মুক্তমনের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি সূক্ষ্ম অনুভূতিরও। এমা পড়তে পড়তে কয়েকবার থামল। এদিকে হ্যারিয়েট তার কী মনে হচ্ছে জানার জন্য ব্যাকুল, খালি ‘তাহলে? তাহলে?’ করেই চলেছে। শেষে মুখ ফুটে বলেই ফেলল, ‘কী বুঝলেন? চিঠিটা ভালো? বড্ড ছোট, না?’
‘ভালো… ভালো বলতেই হবে…’ এমা ধীরে ধীরে বলল, ‘এতটাই ভালো যে, হ্যারিয়েট, আমার মনে হচ্ছে ওঁকে নিশ্চয় ওঁর বোনেদের মধ্যে কেউ এটা লিখতে সাহায্য করেছে। কারণ আমি ওঁকে যেমন দেখেছি – মানে, যখন উনি তোমার সাথে কথা বলছিলেন আর কী – তাতে কিন্তু এ চিঠি ওঁর লিখতে পারার কথা নয়। লোকটি হয়তো নিজের মতো করে একরকম গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু মেয়েরা যেমন করে পারে, তেমনটি না। তুমি ঠিকই বলছ, চিঠিটা বড্ড সরাসরি লেখা, বড্ড জোরালো। বোঝাই যাচ্ছে তিনি বেশ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন, পরিষ্কার ভাবনার মানুষ। যখন হাতে কলম তুলে নেন, তখন তাঁর চিন্তাগুলো সহজেই লিখিত শব্দ হয়ে কাগজে ফুটে ওঠে। পুরুষদের মধ্যে কারো কারো সেই ক্ষমতা থাকে। হ্যাঁ, এটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে, তিনি একজন তেজস্বী, দৃঢ়চিত্ত, হয়তো কিছুদূর অবধি অনুভূতিশীল একজন পুরুষ। এ চিঠিটা সত্যিই বেশ ভালো লেখা হয়েছে, হ্যারিয়েট।’ এই বলতে বলতে এমা চিঠি ফিরিয়ে দিল।
‘তাহলে?’ হ্যারিয়েট এদিকে তখনো এমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, ‘তাহলে, আমি এখন কী করি?’
‘কী করি মানে? কী বিষয়ে? এই চিঠির বিষয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী করি বলছ কেন? উত্তর দেবে, আবার কী?’
‘সে তো দেব, কিন্তু কী লিখব? মিস উডহাউজ, আমাকে একটু বলে দিন না কী লিখব!’
‘একদম না। এই চিঠির উত্তর তুমি নিজে দেওয়াই ঠিক হবে। তুমি যথেষ্ট গুছিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে, তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কথা পড়ে উনি বুঝতে পারবেন না, তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এই গেল এক নম্বর কথা। দ্বিতীয়ত, তোমার লেখার মধ্যে যেন দু’রকম মানে খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকে। তুমি ওঁকে যে ব্যথা দিতে চলেছ, তার বদলে চিঠিতে যেন যথেষ্ট কৃতজ্ঞতাবোধ আর শুভেচ্ছা থাকে। ওঁর মনঃকষ্টের প্রতি যে তুমি সহানুভূতিশীল, এটা বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটা তুমি নিজেই পারবে, এর জন্য তোমাকে কিছু শিখিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।’
‘তাহলে… ওঁকে “না” করে দেব?’ হ্যারিয়েট চোখ নিচু করে বলল।
‘এটা কি একটা জিজ্ঞেস করার মতো কথা হল! কী বলছ! এতে কি তোমার কোনো সন্দেহ আছে নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম – দাঁড়াও দাঁড়াও – আমি হয়তো ভুল ভেবেছি – আমি তো ভাবলাম ওঁকে কীকরে প্রত্যাখ্যান করবে, তুমি আমার কাছে তারই বয়ান জানতে চাইছ।’
হ্যারিয়েট চুপ করে রইল। এমা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তুমি তাহলে ওঁর প্রস্তাব মেনে নিতে চাও?’
‘না, তা না, আমি… আমি কী করব? আপনার কী মনে হয়? মিস উডহাউজ, দয়া করে আমাকে বলুন আমার কী করা উচিত…’
‘আমি কোনো উপদেশ দেব না, হ্যারিয়েট, আমার এ নিয়ে কিছু বলার নেই। এই অবস্থায় তুমি কী চাও সেটা তোমাকেই বুঝে নিতে হবে।’
‘আমি তো জানতামই না উনি আমাকে এত পছন্দ করেন,’ হ্যারিয়েট চিঠিটার কথা ভাবতে ভাবতে বলল। এমা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর এমন একটি মুগ্ধ আপ্লুত চিঠির সরাসরি নিন্দে করা ঠিক হবে না ভেবে শেষ অবধি বলে উঠল, ‘আমি একটা সোজাসাপটা কথা বলি, হ্যারিয়েট, যদি একটি মেয়ের মনে একজন পুরুষের প্রেমপ্রস্তাব নিয়ে দোলাচল চলে, সেক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করাটাই ঠিক। যদি সরাসরি “হ্যাঁ” বলতে আটকায়, তাহলে সরাসরি “না” বলাই ঠিক। এটা ভেবো না যে মনে দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও তুমি একজনের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। আমার মনে হয়েছে, তোমার বন্ধু হিসেবে, তোমার বড় দিদি হিসেবে এটুকু আমার তোমায় জানানো উচিত। তা’বলে ভেবো না আমি তোমায় কোনোকিছু করতে জোর করছি।’
‘না না, ছি ছি, তেমন মানুষ আপনি নন। তবু আপনি যদি আমায় একটু উপদেশ দেন যে, আমার ঠিক কী করা উচিত, না মানে… আমি তা বলছি না… আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার মন আমাকেই স্থির করতে হবে, দোনামনা করলে… হয়তো “না” বলে দেওয়াটাই ঠিক হবে, হয়তো… তাহলে বলছেন, “না” বলে দেওয়াই ভালো?’
‘একেবারেই না,’ এমা দয়ালু হাসি হেসে বলল, ‘আমি তোমায় কিছুই করতে বলছি না। তোমার আনন্দ কিসে তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। যদি আর সব পুরুষের তুলনায় তুমি মিস্টার মার্টিনকেই শ্রেয় মনে করো, যদি তাঁকেই তোমার যথার্থ সঙ্গী বলে মনে হয়, তাহলে এত দ্বিধা কেন? হ্যারিয়েট, তোমার মুখ লাল হয়ে গেছে – তোমার কি যথার্থ সঙ্গী বলতে আর কারো কথা মনে পড়ছে? হ্যারিয়েট, হ্যারিয়েট, নিজেকে ঠকিও না, কৃতজ্ঞতা আর সহানুভূতির বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিও না। তুমি কার কথা ভাবছ?’
অবস্থা ক্রমশ ভালোর দিকে যাচ্ছিল। হ্যারিয়েটের মুখে আর কথাটি নেই, চোখে বিভ্রান্তি। চিঠিটা যদিও তার হাতেই ছিল, তবু সে সেটার কথা ভুলে গিয়ে সেটাকে হাতের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল। এমা মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠলেও তার আশা হচ্ছিল যে, কাজ হয়েছে। শেষে দ্বিধাজড়িত গলায় হ্যারিয়েট বলে উঠল, ‘মিস উডহাউজ, আপনি যেহেতু আমায় বললেন না আমার কী করা উচিত, আমাকেই যা করার করতে হবে। আমি আমার মন ঠিক করে ফেলেছি, আমি ওঁকে “না” বলে দেব। এবার বলুন, আমি কী ঠিক করছি?
‘একদম ঠিক! ওহ্ হ্যারিয়েট, তুমি একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তুমি যতক্ষণ নিজের মন ঠিক করছিলে, আমি কিছু বলে তোমায় বিভ্রান্ত করতে চাইছিলাম না। কিন্তু এখন যখন তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ, আমার মনেও আর কোনো দ্বিধা নেই। আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমার সঙ্গ না পেলে আমার মনটা একদম খারাপ হয়ে যেত। আর মিস্টার মার্টিনের সাথে তোমার বিয়ে হলে ঠিক তাই ঘটত। তোমার মনে যতক্ষণ এই নিয়ে এতটুকুও হেলদোল ছিল, আমি কিছু বলতে চাইছিলাম না, কারণ তোমাকে তাহলে আমি হয়তো প্রভাবিত করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এই বিয়ে আসলে আমাদের বন্ধুবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়াত। কারণ আর যাই হোক, আমার পক্ষে অ্যাবে-মিল ফার্মের মিসেস রবার্ট মার্টিনের বন্ধু হওয়া সম্ভব হত না। যাক, এখন আর কোনো ভয় নেই।’
হ্যারিয়েট আগে বিপদের এই দিকটা ভেবে দেখেনি। কিন্তু এখন সেও উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘সত্যিই তো! আপনি কীকরে আমার সাথে দেখা করতেন! আরে আমি তো এটা ভাবিইনি। কী কাণ্ড! যাক বাবা – মিস উডহাউজ, আর যাই হয়ে যাক, আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।’
‘তাই তো বলছি, হ্যারিয়েট, তোমায় ছেড়ে থাকতে আমার খুবই কষ্ট হত, কিন্তু আর তো কোনো উপায় থাকত না। তুমি যদি সভ্য সমাজের বাইরে গিয়ে থাকা শুরু করতে, আমার আর কিচ্ছু করার থাকত না গো।’
‘মা গো! সে আমি সহ্যই করতে পারতাম না। হার্টফিল্ডে আসতে না পারলে আমি মরেই যাব!’
‘দূর বোকা। যাকগে, তার বদলে তুমি অ্যাবে-মিল ফার্মকে তোমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে পেরেছ। শিক্ষাদীক্ষাহীন ছোটলোকের জীবনে আটকে পড়া কি তোমার সাজে! আমি ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি, লোকটির তোমাকে ওকথা বলার স্পর্ধা হল কী করে! নিজের ব্যাপারে কী ভাবেন উনি!’
এতটা হ্যারিয়েটের সইল না। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘উনি কিন্তু এমনিতে মোটেই ওরকম নন। ওঁর স্বভাব খুব সুন্দর। আমি চিরকাল ওঁকে শ্রদ্ধা করব। কিন্তু তাই বলে… জানেন তো, উনি আমায় পছন্দ করলেও আমি কিন্তু এখানে আসার পর থেকে এমন সব মানুষকে দেখেছি, যাদের সাথে ওঁর কোনো তুলনাই হয় না – সে স্বভাবই হোক, আর চলনবলনই হোক। এক-একজনকে এমন চমৎকার দেখতে। তবে আমার এটা মনে হয় যে মিস্টার মার্টিনও মানুষ ভালো। উনি কেমন আমায় পছন্দ করেন, আর কেমন সুন্দর চিঠিটা লিখেছেন – কিন্তু যাই হোক না কেন, আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাই ওঠে না।’
‘ধন্যবাদ হ্যারিয়েট, ধন্যবাদ। আমার কচি মিষ্টি বন্ধুটাকে কি আমি না দেখে থাকতে পারি! দেখো, একজন পুরুষ চেয়েছে বলেই তাকে বিয়ে করে ফেলাটা কোনো কাজের কথা না। সে একটা মোটামুটি চিঠি লিখে ফেলেছে বলেও না।’
‘হ্যাঁ, তাও আবার এতটুকু একটা চিঠি।’
এমা তার বন্ধুর পছন্দের প্রশংসা করতে পারল না বটে, কিন্তু তখনকার মতো আর কথা বাড়াল না। বরং বলল, ‘ঠিক। তাছাড়া বিয়ের পরে তোমার স্বামী যখন সারাক্ষণ ভাঁড়ের মতো তোমায় বিরক্ত করত, তখন কি ওই চিঠি ধুয়ে তুমি জল খেতে!’
‘হ্যাঁ, একটা চিঠির আর কী দাম! কার সাথে মিশছ, তাতে কতটা আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে, এগুলোই বড় কথা। নাহ্ কাজটা আমি ঠিকই করছি। কিন্তু ওঁকে বলব কীকরে?’
এমা তাকে বুঝিয়ে বলল যে, প্রত্যাখ্যান করা কঠিন কিছু না, সরাসরি বলে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। জবাব লিখতে এমার সাহায্য পাওয়া যাবে, এই আশায় হ্যারিয়েটও এ নিয়ে আর তর্ক করল না। এমা যদিও শেষ অবধি “নিজে লেখো, নিজে লেখো”-ই বলে গেল, তবু কাজের বেলায় দেখা গেল প্রায় প্রতিটা বাক্যই তার কথামতো লেখা হচ্ছে। মূল চিঠির সুরটা এমন নরম ছিল যে, তার জবাব লেখাতে গিয়ে কিছু কড়া কড়া বাক্যবন্ধের ব্যবহার করতেই হল। হ্যারিয়েটের ওদিকে চিন্তা যে, মিস্টার মার্টিনের মা কী মনে করবেন, বোনেরা কী মনে করবে। তারা যদি ভাবে সে অকৃতজ্ঞ! সেই চিন্তায় সে এমন ব্যাকুল হয়ে পড়ল যে, এমার মনে হতে লাগল, মিস্টার মার্টিন তৎক্ষণাৎ সেখানে এসে পড়লে তাদের বিয়েটা হয়তো হয়েই যেত।
শেষ অবধি চিঠি লেখা হল, তাকে মুড়ে, আঠা লাগিয়ে গন্তব্যে পাঠানোও হল। সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেল, হ্যারিয়েট এখন নিরাপদ। কিন্তু তার মনটা সারা সন্ধে মুষড়ে রইল। অযথা জানলেও তরুণী মনের ওটুকু দোনামনা এমা মেনে নিল। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হ্যারিয়েটের প্রতি তার ভালোবাসার কথা আর মাঝে মাঝে মিস্টার এলটনের কথা বলতে লাগল।
‘আমার আর ওরা কখনো ও বাড়িতে ডাকবে না…’ হ্যারিয়েট ভারি গলায় বলল।
‘এদিকে আমার কী হত বলো? অ্যাবে-মিলের চেয়ে হার্টফিল্ডে তোমার দরকারটা যে অনেক বেশি!’
‘আমারও আর ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। হার্টফিল্ডে থাকতে আমার যত ভালো লাগে, ততটা আর কোথাও লাগে না।’
খানিকক্ষণ পরে… ‘মিসেস গডার্ড মনে হয় এসব শুনলে খুব অবাক হবেন। মিস ন্যাশ অবশ্য… জানেন, উনি মনে করেন ওঁর বোনের বিয়েটা দারুণ হয়েছে… কিন্তু আসলে তাঁর স্বামী একজন কাপড়ের ব্যবসাদার বৈ তো কিছু নন…’
‘একজন স্কুলশিক্ষিকার থেকে এর চেয়ে বেশি আশা না করাই ভালো, হ্যারিয়েট। মিস ন্যাশ হয়তো এমন একটা সুযোগ পেলেই বর্তে যেতেন। তাঁর কাছে এটাও মূল্যবান ঠেকত। আসলে তাঁর পক্ষে এর চেয়ে বড় কিছু কল্পনা করাই যে সম্ভব না। আসলে সেই বিশেষ লোকটির তোমার প্রতি যে মনোযোগ, তা নিয়ে হাইবারিতে এখনো কানাকানি শুরু হয়নি… যাই হোক, তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ এখনো এসব জানে না।’
হ্যারিয়েট লজ্জা পেয়ে হাসল। তারপর, তাকে কেন এত লোকের ভালো লাগে, তাই নিয়ে কী একটা মন্তব্যও করল বটে। কিন্তু মিস্টার এলটনের উল্লেখ সুখকর হওয়া সত্ত্বেও ঘুরেফিরে তার মনটা মিস্টার মার্টিনকে প্রত্যাখ্যান করার দিকেই ফিরে যাচ্ছিল।
‘উনি হয়তো এতক্ষণে আমার চিঠিটা পেয়েছেন,’ সে আস্তে আস্তে বলল, ‘ওঁরা যে কী করছেন আমি খালি তাই ভাবছি… ওঁর বোনেরা কি এসব জানে? মা গো, ওঁর কষ্ট হলে ওরাও কিন্তু খুব কষ্ট পাবে। আহা ওঁর যেন বেশি কষ্ট না হয়…’
‘যদি অনুপস্থিত বন্ধুদের নিয়েই কথা বলতে হয়, তাহলে এমন লোকেদের নিয়ে বলি, যারা আনন্দে আছেন, কী বলো?’ এমা বলল, ‘যেমন ধরো মিস্টার এলটন। এই মুহূর্তে উনি হয়তো ওঁর মা আর বোনেদের তোমার ছবিটা দেখাচ্ছেন। আর বলছেন, রক্তমাংসের মেয়েটিকে ছবিটার চাইতে আরও কত সুন্দর দেখতে! হয়তো বা পাঁচ-ছ’বার জিজ্ঞেস করার পরে শেষমেশ তোমার নামটা ওঁদের বলছেন – হ্যারিয়েট, হ্যারিয়েট।’
‘আমার ছবি! – সেটা তো বন্ড স্ট্রিটে!’
‘তাই নাকি! তাহলে বলতে হয় আমি মিস্টার এলটনকে চিনিই না। দূর! তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও। কাল উনি ঘোড়ায় ওঠা পর্যন্ত ও ছবি বন্ড স্ট্রিটের ছায়া মাড়াবে না। আজকের গোটা সন্ধেটা ওই ছবিটাই তাঁর সঙ্গী, তাঁর সান্ত্বনা, তাঁর আনন্দ। তিনি পরিবারের কাছে নিজের পরিকল্পনা খুলে বলবেন, তোমার পরিচয় দেবেন, তাঁরা খুশিয়াল হয়ে উঠবেন, তোমাকে দেখতে উদগ্রীব হবেন, নানারকম প্রস্তুতি শুরু করে দেবেন। কী আনন্দ! কী রোমাঞ্চ! তাঁদের কল্পনা না জানি আজ কত রঙিন হয়ে উঠছে!’
হ্যারিয়েট আবার হাসল, এবারে সে হাসিতে দ্বিধার ভাগ কম।