
জেন অস্টেনের এমা - তৃতীয় পর্ব
- 07 February, 2025
- লেখক: মধুশ্রী
এমা
জেন অস্টেন
তৃতীয় অধ্যায়
মিস্টার উডহাউজের সামাজিকতার একটা বিশেষ ধরন ছিল। তাঁর আন্তরিক ইচ্ছে ছিল বন্ধু-পরিজনরা তাঁকে দেখতে আসুন। তার উপর নানা কারণে – যেমন হার্টফিল্ডে তাঁর বহুকালের বসবাস, তাঁর সম্পত্তি, বাড়ি, তাঁর লক্ষ্মী মেয়েটি – সব মিলিয়ে পরিচিতির ছোট্ট গন্ডিটির উপর তাঁর যেন আপ্যায়নের দাবিই জন্মে গেছিল। সেই গন্ডির বাইরের কারো সাথে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না। বেশিক্ষণ রাত জাগা বা রাতে খাওয়ার সময় হৈ চৈ – এসব অপছন্দ করার ফলে অনেককেই তিনি শেষ অবধি আর বাড়িতে ডেকে উঠতে পারতেন না। ভাগ্যক্রমে হাইবারি এবং ওই একই পল্লীতে র্যান্ডালস, সংলগ্ন পল্লীতে ডনওয়েল অ্যাবে আর মিস্টার নাইটলির বাড়ি, একটি জায়গা মিলিয়ে তাঁর পছন্দের লোকের সংখ্যা কম ছিল না। মাঝেমাঝেই এমার চাপে পড়ে তিনি বিশেষ কয়েকজনকে রাতে খেতে ডাকতেন বটে, তবে সান্ধ্য বৈঠকই তাঁর বেশি পছন্দের ছিল। কালেভদ্রে এক-আধদিন হয়তো তাঁর কারো সাথেই দেখা করতে ইচ্ছে হত না। কিন্তু তা বাদ দিয়ে সন্ধ্যেবেলা এমা অতিথিদের সাথে তাঁর তাস খেলার টেবিল সাজিয়ে না দিচ্ছে, এমন কমই হত।
বহুদিনের পরিচিত এবং পছন্দের মানুষ ওয়েস্টন আর মিস্টার নাইটলির জন্য তো তাঁদের বাড়ির দরজা সবসময় খোলা থাকতই। তাছাড়া মিস্টার এলটন, যে যুবকটি একা থাকতেন বটে কিন্তু থাকতে মোটেও পছন্দ করতেন না, তিনিও তাঁর একাকী সন্ধ্যার শূন্যতাবোধের বদলে যদি মিস্টার উডহাউজের বৈঠকখানার চমৎকার আসর ও তাঁর কন্যাটির চমৎকার হাসিমুখটি উপভোগ করতে চাইতেন, তাঁকে বাধা দেওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারত না।
পরবর্তী স্তরের অতিথিদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন ঘন আসতেন মিসেস ও মিস বেটস এবং মিসেস গডার্ড। এই তিন ভদ্রমহিলা হার্টফিল্ডের যেকোনো নিমন্ত্রণে যোগদান করতে এক পায়ে খাড়া থাকতেন। চোদ্দবার তাঁদের গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসতে এবং ফেরত দিয়ে আসতে গিয়ে জেমস বা ঘোড়াগুলি যে ক্লান্তি বোধ করতে পারে, মিস্টার উডহাউজের সেটা মাথাতেই থাকত না। বছরে একবারই যদি এরকম আনা-নেওয়া করতে হত, তাও নাহয় সে নিয়ে আপত্তি-অভিযোগ জানানোর মানে হত।
মিসেস বেটস ছিলেন হাইবারির পূর্বতন ভিকার-এর১ বিধবা স্ত্রী। অতিবৃদ্ধা, চা-বিস্কুট২-এর নেশা ছাড়া প্রায় সবই তিনি পিছনে ফেলে এসেছিলেন। থাকতেন তাঁর অবিবাহিত মেয়ের সাথে, খুবই সাধারণ ভাবে। এই পরিস্থিতিতে একজন নিরীহ বৃদ্ধার পক্ষে যেটুকু শ্রদ্ধাভক্তি পাওয়ার কথা, তা তিনি পেতেন। তাঁর মেয়ের রূপ ছিল না, সম্পত্তি ছিল না, বিয়ে হয়নি, বয়েসও নেহাত বাড়তির দিকে। তবু মিস বেটস কী করে কে জানে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। লোকে তাঁকে পছন্দ করত – এই ছিল তাঁর দুর্ভাগ্য! তাঁর বুদ্ধি তেমন ধারালো ছিল না যে তিনি সমাজের সামনে তাঁর এই অন্যায্য পাওনার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবেন। অথবা যাঁরা জনপ্রিয় হওয়ার কারণে তাঁকে ব্যাঁকা চোখে দেখতেন, তাঁদের দাবড়ে দিতে পারবেন। রূপ বা বুদ্ধির গর্ব কোনোটাই তাঁর ছিল না। তাঁর যৌবন কেটেছিল সাধারণ ভাবে, আর মাঝবয়েসটা কাটছিল অশক্ত বৃদ্ধা মা’র দেখাশুনো করতে করতে, সঙ্গে সামান্য কিছু আয় করার চেষ্টায়। তবু তাঁর স্বভাব ছিল হাসিখুশি। সবাই তাঁর ভালো চাইত। আসলে তাঁর নিজের শান্ত খোশমেজাজ আর সবার আন্তরিক মঙ্গলকামনা করা – এর জোরেই তাঁর সেই আশ্চর্য পাওনা। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন, প্রত্যেকের সৌভাগ্য বিষয়ে খুঁটিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতেন, অন্যের গুণ চট করে তাঁর চোখে পড়ত। তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন যে, তাঁর বাড়িটি অত্যন্ত চমৎকার, সেখানে কোনো কিছুরই অভাব নেই, তাঁর মা এক অসাধারণ মহিলা আর তাঁর প্রতিবেশী ও বন্ধুরা ততোধিক অসাধারণ। সব মিলিয়ে নিজেকে তিনি খুবই ভাগ্যবতী মনে করতেন। তাঁর এই সারল্য, সদাসন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞময় স্বভাব প্রত্যেকের কাছেই আদর্শ ছিল। আর তাঁর নিজের জন্য তা ছিল আনন্দের খনি। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তিনি বহুক্ষণ উৎসাহের সাথে কথা বলে যেতে পারতেন। এতে মিস্টার উডহাউজের খুবই সুবিধা হত, কারণ তিনি নিজে ছিলেন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলা আর নিরীহ পরচর্চা করার রাজা।
মিসের গডার্ড ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। মোটা টাকার বিনিময়ে লম্বা লম্বা আজগুবি বাক্য ব্যবহার করে যেখানে ধর্মতত্ত্ব, বা উদারপন্থা ও নীতিশিক্ষার সহাবস্থান, অথবা নব্যন্যায় বনাম নব্যসমাজ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণীদের স্বাস্থ্যচ্যুতি এবং দম্ভলাভের রাস্তা পরিষ্কার করা হয়, এমন কোনো গুরুগম্ভীর প্রতিষ্ঠান সেটা নয়। বরং গোদা বাংলায় যাকে বলে বোর্ডিং স্কুল – যেখানে মোটামুটি রকম টাকার বিনিময়ে মোটামুটি রকম শিক্ষা দেওয়া হয়, আর যেখানে ছাত্রীদের অনেককেই পাঠানো হয় এই ভেবে, যাতে তারা বাড়ি বসে সারাদিন ঘ্যানঘ্যান না করে, আর যেখান থেকে তাদের ঘষেমেজে যখন বার করা হয়, তখন তাদের কারো আচমকা অসাধারণ হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে না। মিসেস গডার্ডের স্কুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটা অকারণে নয়। স্বাস্থ্যোন্নতির দিক থেকে হাইবারির নাম ছিল। মিসেস গডার্ডের বাড়িটা ছিল বড়সড়, বাগান দিয়ে ঘেরা। তাই তিনি তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের পেটভরে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াতেন, গ্রীষ্মকালে তাদের খোলা মাঠে দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াবার প্রচুর সুযোগ দিতেন আর শীতকালে ঠান্ডায় তাদের গা-হাত পা ফুলে গেলে নিজের হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। ফলে, চার্চে যাওয়ার সময় দশ জোড়া মেয়ে লাইন করে যে তাঁর পিছু পিছু চলত, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি ছিলেন একজন সাদামাটা স্নেহময়ী মায়ের মতো। সারাজীবন খাটাখাটনি করার পর শেষ বয়সে এসে একদুটো চায়ের পার্টিতে গিয়ে আরাম করাটা তিনি তাঁর প্রাপ্য বলেই মনে করতেন। তাঁর বাড়িটি ছিল ছিমছাম, হাতের কাজ দিয়ে সাজানো। কিন্তু মিস্টার উডহাউজ তাঁকে একসময় এত সাহায্য করেছিলেন যে, এখন তাঁর বাড়িতে ডাক পড়লে, নিজের ঘরের আরাম ছেড়ে সেখানে গিয়ে আগুনের পাশে বসে এক-দু’টাকা বাজি জেতা বা হারাটাকে মিসেস গডার্ড কর্তব্য বলে মনে করতেন।
অতএব এই তিন মহিলার সাথে এমার ঘনঘন দেখা হত। তাঁরা আসতেন বলে মিস্টার উডহাউজের সময়টা ভালো কাটত। তাই এমাও তাঁরা এলে খুশি হত। তাই বলে মিসেস ওয়েস্টনের অভাবটা তাঁদের দিয়ে পূরণ হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তবে বাবাকে খুশি হতে দেখলে তার সত্যি ভালো লাগত। তার উপর নিজের মনের করুণ ভাবটা সে কেমন সুকৌশলে লুকিয়ে রাখতে পারছে, এ নিয়েও তার গর্ব কম ছিল না। কিন্তু তাসত্ত্বেও এঁদের তিনজনের সাথে চুপচাপ সন্ধ্যে কাটাতে গিয়ে তার প্রতিবার মনে হত, ঘড়ির কাঁটা বুঝি আর এগোচ্ছে না।
একদিন সকালে সে যখন আবারও একটি একঘেয়ে দিনশেষের অপেক্ষায় বসে, তার কাছে এসে পৌঁছল মিসেস গডার্ডের একটা চিঠি। তাতে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মিস স্মিথকে সঙ্গে আনার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। কী আশ্চর্য! অনুমতি কেন? মিস স্মিথের ব্যাপারে এমার নিজেরই যে উৎসাহের শেষ ছিল না! মেয়েটির বয়েস ছিল সতেরো বছর। এমা তাকে অনেকবার দেখেছে, আর তার রূপের টানে বারবার তার সাথে আলাপ করতে চেয়েছে। অতএব সেই মুহূর্তেই উডহাউজদের তরফ থেকে মিস স্মিথের উদ্দেশ্যে নিমন্ত্রণ পত্র গেল। আসন্ন সন্ধ্যার একঘেয়েমির আশংকা কেটে তখন সেই প্রাসাদবাসিনী একলা মেয়েটির মনে জন্ম নিয়েছে আগ্রহ আর কৌতূহল।
হ্যারিয়েট স্মিথ কোথাও একটা জন্মেছিল। কেউ না কেউ তাকে বেশ কিছু বছর আগে মিসেস গডার্ডের স্কুলে রেখে যায়। হালে আবার কারো না কারো ব্যবস্থাপনায় তাকে সাধারণ ছাত্রীদের ডর্মিটরি থেকে একার ঘর দেওয়া হয়েছে। তার ইতিহাস সম্পর্কে লোকে মোটামুটি এটুকুই জানত। হাইবারিতে যাদের সাথে তার আলাপ হয়েছে, তারা ছাড়া তার আর তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। স্কুলের কয়েকজন সহপাঠিনীর সাথে কিছুকাল গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেরিয়ে সে তখন সবেমাত্র হাইবারিতে ফিরেছে।
হ্যারিয়েট ছিল সত্যিকারের রূপসী। আর তার রূপের ধরনটা এমাকে খুব টানত। সে ছিল মাথায় খাটো, গোলগাল, ফর্সা, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। সেদিন তার নীল চোখ, সোনালি চুল, মাপসই গড়ন আর মুখের মিষ্টি হাসি এমাকে এমনই মুগ্ধ করল যে, সন্ধ্যে শেষ হওয়ার আগেই এমা তার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব পাতাবেই পাতাবে বলে ঠিক করে ফেলল।
এমা অবশ্য মিস স্মিথের কথাবার্তায় বুদ্ধিমত্তার বিশেষ কোনো পরিচয় পায়নি। তবু মেয়েটিকে তার খুব ভালো লাগল। তার ব্যবহার আন্তরিক, সে অকারণে লজ্জা পায় না, কথা বলায় জড়তা নেই – অথচ অত্যধিক কথা বলে না, যথার্থই বিনীত, হার্টফিল্ডে নিমন্ত্রিত হওয়ার জন্য কৃতজ্ঞও। চারদিকে তার পরিচিত পরিবেশের চেয়ে এত আলাদা, এত দামী আর চোখ ধাঁধানো জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটনো দেখে সে এমনই মুগ্ধ হচ্ছিল যে, এমার বুঝতে অসুবিধা হল না মেয়েটি ভালো জিনিসের কদর করতে জানে এবং সে বিষয়ে তাকে আরও উৎসাহিত করাই তার উচিত কাজ হবে। এমন নীল চোখদুটি, চলাফেরার এমন সহজ ছন্দ – হাইবারির সাদামাটা লোকেদের সঙ্গে সাদামাটা মেলামেশা দিয়ে তার দাম উঠবে না। তার এখনকার পরিচিত বন্ধুরা আসলে তার যোগ্যই নয়! যাদের সাথে সে এইমাত্র বেড়িয়ে ফিরেছে, তারা মানুষ ভালো হতে পারে, কিন্তু তাদের সঙ্গ নিশ্চয় তার ক্ষতিই করছে। ওরা তো ওই মার্টিনদের মেয়ে – এমা তাদের ধরনধারণ ভালোই জানত। মার্টিনরা মিস্টার নাইটলির থেকে একটা বড় খামার ভাড়া নিয়ে ডনওয়েলের যাজকপল্লীতে থাকত। যদিও মিস্টার নাইটলি তাঁদের সম্পর্কে ভালো বৈ মন্দ বলতেন না, তবু এমা নিশ্চিত যে তাঁরা নিশ্চয় আধাশিক্ষিত রুক্ষস্বভাবের লোকজন। তাঁরা কখনোই হ্যারিয়েটের সাথে মেশার যোগ্য হতে পারেন না। বিশেষ করে যখন বোঝাই যাচ্ছে, শিক্ষা আর চলনবলনে একটুখানি ঘষামাজা করে নিলে হ্যারিয়েট হয়ে উঠবে প্রায় নিখুঁত। এমা ঠিক করে ফেলল, সে হ্যারিয়েটকে ঘষামাজার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে। মেয়েটির পক্ষে ক্ষতিকর চেনা-পরিচিতদের হাত ছাড়িয়ে সে তাকে উঁচু সমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, সেই সমাজের উপযুক্ত ব্যবহার শেখাবে, নিজের মতামত প্রকাশ করতে শেখাবে। এই ভাবতে ভাবতে আবার একবার নিজের উদার ও পরোপকারী মনের পরিচয় পেয়ে এমা ভাবল, সমাজে তার অবস্থান হাতের অঢেল সময়ের এর চেয়ে ভালো সদ্ব্যবহার আর কী বা হতে পারে!
নরম নীল চোখদুটির দিকে চেয়ে চেয়ে আর চোখের মালিকের সাথে কথা বলতে বলতে, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে করতে এমা এমনই মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে, সন্ধ্যেটা কখন কেটে গেল বোঝাই গেল না। অন্যদিন নৈশাহারে বসে সময় গোনা ছাড়া তার কোনো কাজ থাকত না। অথচ আজ কখন আগুনের কাছে টেবিল টানা হল, পাত পড়ল, সে খেয়ালই করল না। তবে প্রতিটা কাজ যত্ন করে, মন দিয়ে করা বিষয়ে তার গর্ব ছিল। তাই খেতে বসে আজও সে অসাধারণ তৎপরতার সাথে, নিজের গোপন পরিকল্পনায় নিজেই খুশিয়াল হয়ে পরমানন্দে অভিজ্ঞ গৃহকর্ত্রীর মতো অভ্যাগতদের এটা-ওটা খেতে অনুরোধ জানাতে লাগল। বিশেষ করে মুরগির মাংসের কিমা আর স্ক্যালপ্ড্ অয়েস্টার৩ চেখে দেখতে তার উচ্ছ্বসিত আমন্ত্রণ যে অতিথিদের উৎসাহিতই করবে, তাতে তার কোনো সন্দেহ ছিল না।
খাবার টেবিলে মিস্টার উডহাউজের মনের মধ্যে জবরদস্ত লড়াই শুরু হয়ে যেত। ফলে তাঁর অবস্থা হয়ে উঠত নিতান্তই করুণ। একদিকে তিনি মনে মনে চাইতেন সুন্দর কাপড় দিয়ে টেবিল ঢাকা হোক, কারণ তাঁর যৌবনে তেমনটাই দস্তুর ছিল। অন্যদিকে তিনি খাওয়া জিনিসটাকেই এমন অস্বাস্থ্যকর মনে করতেন যে, খাদ্যবস্তুর কাছাকাছি কিছু পাততে দেখলে তাঁর মনটা একেবারে খারাপ হয়ে যেত। আতিথেয়তার অভ্যাস অনুযায়ী তিনি মন থেকে চাইতেন অতিথিরা সবরকম সুবিধা পান। অথচ খেলেই যে তাঁরা অসুখে পড়বেন, এই আশংকায় তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত।
তিনি নিজে খেতেন ছোট্ট বাটি ভরে পাতলা ঝোল, এবং মনে মনে বিশ্বাস করতেন বাকিদেরও সেটাই খাওয়া উচিত। তবে মহিলারা যখন ভালোমন্দ সাঁটাতেন, তখন তিনি এটুকু বলেই ক্ষান্ত দিতেন –
‘মিসেস বেটস, আপনি বরং একটা ডিম নিন। ডিম খুব নরম করে সেদ্ধ করলে তাতে আর পেট গরম হয় না, জানেন তো? ডিম সেদ্ধ করার ব্যাপারটা সের্লের চাইতে ভালো কেউ বোঝে না। আমি কিন্তু অন্য কারো সেদ্ধ করা ডিম আপনাকে কখনো খেতে বলব না। তবে ভয় পাবেন না, ডিমগুলো একদম ছোট ছোট। দেখুন, এত ছোট একটা ডিম… এটা দেখে আপনার ভয় পাওয়ার কিন্তু কোনো কারণই নেই। মিস বেটস, এমা আপনাকে একটু টার্ট৪ দিক? এই একটুখানি? আমরা কিন্তু বাড়িতে শুধু আপেলের টার্টই খাই। কোনো ভেজাল টেজাল নেই। তবে আমি বলব কাস্টার্ডটা আপনাদের না খাওয়াই ভালো। মিসেস গডার্ড, আপনি আধ গেলাস ওয়াইন খেয়ে দেখুন না। এই ছোট গ্লাসের আধ গ্লাস, এক বাটি ফুটোনো জল মিশিয়ে। এটুকুতে আপনার কোনো অসুবিধা হবে বলে আমার কিন্তু মনে হয় না…’
এমা তার বাবাকে আটকাতে যেত না, কিন্তু অতিথিদের যাতে খেতে অসুবিধা না হয় তার দিকেও নজর রাখত। বিশেষ করে আজকের অতিথিদের মধ্যে একজনকে যে তার বিশেষ পছন্দ হয়েছিল! আপ্যায়ন করে এমার যতো আনন্দ, আপ্যায়ন পেয়ে মিস স্মিথেরও ততোটাই ভালো লাগছিল। হাইবারিতে মিস উডহাউজের এত সুনাম যে, তার নিমন্ত্রণ পত্র পেয়ে প্রথমে সে একটু ঘাবড়েই গেছিল। কিন্তু এই বিনীত কিশোরীটি যখন নৈশাহার শেষ করে বাড়ি ফিরছিল, তখন তার মনে ভয় তো দূরের কথা, আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার সীমা রইল না। মিস উডহাউজ শুধু যে সারা সন্ধ্যে তার সাথে বন্ধুর মতো গল্প করেছেন তাই না, চলে আসার আগে তার হাত অবধি ধরেছেন!
………………………
১ চার্চ প্রতিনিধি
২ মূল লেখায় বিস্কুটের জায়গায় ছিল কোয়াড্রিল
৩ খোল সমেত পরিবেশন করা ঝিনুকের মাংস
৪ নরম বিস্কুট জাতীয় খোলের মধ্যে ভরা মিষ্টি