জেন অস্টেনের এমা - প্রথম পর্ব

 

এমা

জেন অস্টেন

প্রথম অধ্যায়

এমা1 উডহাউজ, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, ধনী। তার একটা সুন্দর খোলামেলা বাড়ি আছে, আছে ফুরফুরে মনমেজাজ, সব দিক থেকেই সে যেন সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে ধন্য। তার একুশ বছরের জীবনে খুব কম ঘটনাই তাকে দুঃখ দিতে বা তার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছে।

দুই বোন, এমা ছোট। তাদের বাবা যেমন স্নেহশীল, তেমনই উদার। ফলে বড় বোনের বিয়ে হওয়া ইস্তক অল্প বয়েস থেকেই এমা বাড়ির গিন্নি হয়ে উঠেছে। তাদের মা যখন মারা যান, এমা তখন এত ছোট যে, তাঁর আদরের ঝাপসা স্মৃতিটুকুই খালি তার মনে আছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জায়গা নেন চমৎকার এক শিক্ষয়িত্রী, যাঁর স্নেহ মা’র চাইতে কম ছিল না।

সেই মিস টেলর মিস্টার উডহাউজের বাড়িতে আছেন ষোল বছর হয়ে গেল। পরের দিকে তিনি যত না শিক্ষয়িত্রী, তার চেয়ে মেয়েদের বন্ধুই বেশি হয়ে উঠেছিলেন। দুই বোনকেই তিনি ভালোবাসেন, তবে এমা তাঁর চোখের মণি। এমা যেন তাঁর নিজেরই মায়ের পেটের বোন। এমা বড় হওয়ার পর মিস টেলর ঠিক আর তার গভর্নেস রইলেন না। তবে তারও আগে থেকে, তাঁর নরম স্বভাবের কারণে তিনি এমার উপর নিয়মকানুন বড় একটা চাপিয়ে উঠতে পারতেন না। তাই শাসনের ছায়াটুকুও বহুদিন হ’ল তাঁদের সম্পর্কের উপর থেকে সরে গিয়েছিল। তাঁরা ছিলেন বন্ধু, গলায়-গলায় বন্ধু। এমা তার যা ভালো লাগত, তাই করত। শোনার বেলায় মিস টেলরের কথা সে শুনত বটে, কিন্তু করার বেলায় নিজের মতটাই থাকত।

এমার বিপদের মূলে ছিল তার এই নিজের মতো চলা, আর নিজেকে একটু বেশিরকম ভালো ভাবা – এই স্বভাবই তার সুখের সমুদ্রে এক ফোঁটা চোনা হয়ে দাঁড়াল। অবশ্য বিপদ তখনো এত দূরে যে,তার এই স্বভাবকে সম্ভাব্য দুর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে দেখার দরকার তখনো পড়েনি।

দুঃখ এল – হালকা দুঃখ – তেমন তীব্র নয়। আসলে মিস টেলরের বিয়ে হয়ে গেল। মিস টেলরকে হারিয়ে এমা জীবনে প্রথম দুঃখের স্বাদ পেল। বিয়ের দিন সে মন ভারি করে বসে এরপর কী হবে তাই ভাবছিল। অনুষ্ঠান তখন শেষ, নিমন্ত্রিতরা চলে গেছেন। এমা আর তার বাবা রাতের খাওয়া খেতে বসলেন, দীর্ঘ সন্ধেটাকে হাসিঠাট্টায় ভরে দেওয়ার মতো তৃতীয় আর কেউ নেই। এমার বাবা তো অভ্যেস মতো খাওয়ার পরে ঘুমোবার তোড়জোড় করতে লাগলেন, আর এমা বসে ভাবতে লাগল, সে কী হারাল।

যা ঘটে গেল, তা তার বন্ধুর জীবনে সুখ নিয়ে আসবেই। মিস্টার ওয়েস্টন অত্যন্ত সজ্জন। টাকাপয়সার অভাব নেই, বয়েস বেশি না, সুন্দর ব্যবহার। আর এই বৈবাহিক সম্পর্কটিকে খাড়া করার পিছনে এমার নিজের যে স্বার্থহীন, উদার বন্ধুত্বের নজির রয়ে গেল, তাতেও সে বেশ সন্তুষ্ট বোধ করছিল, তবু মনের ভার কমে না।

মিস টেলরের অভাব যে এবার পদে পদে টের পাওয়া যাবে! পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল – ষোল বছরের স্নেহমমতাময় ইতিহাস। সে যখন মোটে পাঁচ বছরের, তখন থেকে তাকে শেখানো-পড়ানো-খেলানো, তার শরীরস্বাস্থ্য ভালো রাখা, অসুখ হলে সেবা করা – সেজন্য তার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। তবু, ইসাবেলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে, গত সাত বছর ধরে সমানে-সমানে বন্ধুত্বের যে নিখুঁত জগতটা গড়ে উঠেছিল, যেখানে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না, সেই বছরগুলোই যেন এখন বেশি প্রিয় ঠেকছিল। তাঁর মতো বন্ধু বা সাথী ক’জন পায় – বুদ্ধিমতী, চৌখস, কাজেকর্মে পাকা, নরম স্বভাব, পরিবারের খুঁটিনাটি সব নখের ডগায়, এ পরিবারের সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী, আর বিশেষ করে এমার প্রতি তাঁর আগ্রহ, প্রতিটি আনন্দে, প্রতিটি কাজে পরস্পরকে শামিল করে নেওয়া। যেকোনো ভাবনা মনে এলেই তাঁকে খুলে বলা যেত, আর তাঁর মনে তো এমার জন্য এত ভালোবাসা ছিল যে, তিনি তার কোনো ভুলই দেখতে পেতেন না।

এই অভাব মিটবে কেমন করে? অবশ্য তার বন্ধু এখন তার থেকে মোটে আধ মাইল দূরে থাকেন বৈ তো নয়। কিন্তু এমা ভালোই জানত, মোটে আধ মাইল দূরের মিসেস ওয়েস্টন আর ঘরের ভিতরকার মিস টেলরের মধ্যে আসলে বিস্তর ফারাক। তার নিজের স্বভাব যত চমৎকারই হোক, আর পারিবারিক অবস্থা যতই ভালো, তাকে এবার একটা ভয়ানক একাকীত্বের মুখোমুখি হতে হবে। সে তার বাবাকে কম ভালোবাসত না, কিন্তু তিনি তো আর তার সাথী হয়ে উঠতে পারেন না। তিনি যে তার সাথে কথাতেই পেরে ওঠেন না! সে গম্ভীর বিষয়েই হোক, আর ঠাট্টা-ইয়ার্কিই হোক।

তাঁদের দু’জনের বয়সের তফাত যত না (এবং মিস্টার উডহাউজ খুব কম বয়সে বিয়ে করেছিলেন, এমনটিও নয়), তারও চেয়ে তিনি স্বভাবে আর হাবেভাবে বুড়ো। চিরকাল নড়বড়ে স্বাস্থ্যের অধিকারী, শরীর-মনের চর্চার অভ্যাস নেই, তাই বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছিলেন। ফলে, উদার হৃদয় আর নরম মেজাজের কারণে সকলের প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, কাজেকর্মে পারদর্শিতার দিক থেকে কারও পক্ষে তাঁকে নম্বর দেওয়া কঠিন ছিল।

এমার দিদি বিয়ের পরে সামান্য হলেও দূরে সরে গেছেন। মাত্র ষোল মাইল দূরে লন্ডনে তাঁর সংসার বটে, তবে তাঁকে ধরাছোঁয়া কঠিন হয়ে গেছে2। তাই ইসাবেলার আনন্দময় সাহচর্য পাওয়ার আগে, ক্রিসমাসে তাঁকে স্বামী সমেত কাছে পাওয়ার আগে, ছোট ছোট বাচ্চারা এ বাড়িটাকে কলকলানিতে ভরিয়ে তুলবার আগে, অক্টোবর আর নভেম্বরের বহু দীর্ঘ সন্ধ্যা বাপ-মেয়েকে হার্টফিল্ডে বসে কাটাতে হবে।

হাইবারি এক বড়, জনবহুল গ্রাম, প্রায় একটা ছোট শহরই বলা চলে। আর হার্টফিল্ড তার ঘাসের লন, ঝোপেঝাড়ে ভরা বাগান আর গালভরা নাম সমেত সেই গ্রামেরই এমন এক বিশেষ অংশ, যাকে আর কিছুর সাথে তুলনা করা যেত না। উডহাউজরা ছিলেন সেখানে সবচেয়ে গণ্যমান্য। তাঁদের প্রতি সকলের মনেই ছিল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। এমার মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তার পরিচিত মানুষের অভাব ছিল না, কিন্তু মিস্টার উডহাউজ নিজের সামাজিক বৃত্তের বাইরে মেলামেশায় রাজী ছিলেন না। আধা দিনের জন্যেও মিস টেলর মতো কেউ ছাড়া আর কারো সঙ্গে সময় কাটানোর কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। এই হঠাৎ-বদলটা তাই বাবার জন্য কতটা সমস্যার, এমা সেটা বুঝতে পেরেছিল কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর অসম্ভবের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া তার আর কিছু করারও ছিল না। এমা অপেক্ষায় ছিল কবে আবার তার তার বাবা হঠাৎ এসে পড়া এই একাকিত্ব থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে আবার হাসিখুশি হয়ে উঠবেন। এমার বাবা মানুষটি একটু অসহায়। সহজেই বিচলিত বা অবসন্ন বোধ করতেন, যাদের সাথে ওঠাবসায় অভ্যস্ত ছিলেন তাদের সকলকেই পছন্দ করতেন, এবং তাদের থেকে দূরে যেতে একেবারে পছন্দ করতেন না। পরিবর্তন জিনিসটাই ছিল তাঁর না-পসন্দ্‌। বিয়ে মানেই যেহেতু পরিবর্তন, তাই বিয়ে জিনিসটা সবসময়ই তাঁর অপছন্দের হয়ে থেকেছে, বিশেষ করে নিজের বড় মেয়ের বিয়েটা তাঁর এখনো হজম হয়নি। ইসাবেলার সম্পর্কে কথা বলতে হলে তিনি সমবেদনার সাথেই বলতেন, যদিও তার বিয়েটা ছিল রীতিমতো ভালোবাসার বিয়ে। আর এখন তো মিস টেলরকেও হারাতে হ’ল। তাঁর কোমল আত্মকেন্দ্রিক স্বভাব, এবং অন্য কেউ তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে একমত না-ও হতে পারে এ নিয়ে চিরস্থায়ী অজ্ঞতার কারণে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, মিস টেলর খুবই দুর্ভাগ্যজনক একটা কাজ করে ফেলেছে। এসব গোলমালে না গিয়ে বরং হার্টফিল্ডে তাঁদের বাড়িতে সারাজীবন কাটালেই সে জীবনে অনেক বেশি সুখী হতে পারত। এমা তার বাবাকে এইসব ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য হাসিমুখে কথাবার্তা বলে যাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন চা এসে উপস্থিত হল, তখন মিস্টার উডহাউজের পক্ষে সেই কথাটা চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠল, যা তিনি গতরাতে নৈশভোজের টেবিলেও বলে উঠেছিলেন,

‘বেচারি মিস টেলর! — আজ যদি এখানে থাকত! কি কুক্ষণেই না মিস্টার ওয়েস্টনের ওর কথা মাথায় এসেছিল!’

‘বাবা! তুমি জানো এ কথাটায় আমার একটুও মত নেই। মিস্টার ওয়েস্টন কেমন ভদ্র, কেমন সুন্দর রসবোধ, চমৎকার একজন মানুষ। তাঁর মতো মানুষের এমন ভালো বউ পাওয়াই উচিত। তুমি কি চাও মিস টেলর নিজের বাড়িতে নিজের সংসার না পেতে সারা জীবন আমাদের সাথে থাকবে আর আমার সব বিদঘুটে রসিকতা সহ্য করবে?’

‘নিজের বাড়ি! নিজের বাড়ি হয়ে লাভ কী? এ বাড়িটা তো তার তিনগুণ বড়। আর তোমার রসিকতাগুলো মোটেও বিদঘুটে নয়, মামণি।’

‘আমরা তো মাঝেমাঝেই ওদের সাথে দেখা করতে যাব, আর ওরাও আসবে! দেখাসাক্ষাৎ হতেই থাকবে! এখনই এই যাতায়াতটা শুরু করে দেওয়া উচিত। শিগগিরই যাই একদিন, চলো।’

‘মামণি, আমি অত দূরে যাব কীকরে? র‍্যান্ডাল্‌স কি এখানে! আমি তার আদ্ধেকও হাঁটতে পারব না।’

‘বাবা, তোমায় কেউ হাঁটতে বলছে না। আমরা গাড়ি করেই তো যাব, আবার কী!’

‘গাড়ি! কিন্তু জেমস কি এত অল্প রাস্তা যাওয়ার জন্য ঘোড়া জুততে রাজি হবে? তাছাড়া আমরা যখন ওদের সাথে কথাবার্তা বলব, বেচারা ঘোড়াগুলো কী করবে?’

‘ওদের মিস্টার ওয়েস্টনের আস্তাবলে রাখা হবে, বাবা! তুমি তো জানো, এ কথাগুলো আগেই হয়ে গেছে। আমরা গত রাতে মিস্টার ওয়েস্টনকে সব বলে রেখেছি। আর জেমসের কথা যদি বলো, সে সবসময়ই র‍্যান্ডাল্‌স যেতে রাজি, কারণ তার মেয়ে এখন ও বাড়িতে কাজ করে। বরং আমার সন্দেহ এই যে, জেমস এখন আমাদের র‍্যান্ডাল্‌স ছাড়া আর কোথাও নিয়ে যেতে রাজি হবে কিনা! তোমার জন্যই এই অবস্থা, বাবা। তুমিই হানাকে ওখানকার চাকরিটা করে দিলে। তুমি বলার আগে কেউ হানার কথা ভাবেওনি। জেমস তো তোমার কাছে কৃতজ্ঞ!’

‘ভাগ্যিস আমরা ওর কথা ভেবেছিলাম, না? আসলে কথাবার্তা হওয়ার পরে পিছিয়ে গেলে জেমস আবার নিজেকে খাটো মনে করে কষ্ট না পায়, সেটা তো আমায় দেখতেই হত। মেয়েটি নিশ্চয় ভালোভাবেই কাজ করবে। ও তো বেশ ভদ্র, সুন্দর কথা বলে; ওকে আমি অত্যন্ত যোগ্য বলেই মনে করি। ওর সাথে যখনই দেখা হয়, ও আমায় অভিবাদন করে, খুব মিষ্টি করে আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করে। আমি খেয়াল করেছি যে, তুমি যখনই ওকে সেলাইয়ের কাজের জন্য ডাকো, ও দরজার হাতলটা যত্ন করে ঘোরায়, কখনোই দড়াম করে বন্ধ করে না। ও নিশ্চয় ওবাড়ির কাজগুলো ভালোভাবে করবে; আর মিস টেলরেরও ওবাড়িতে একটা চেনা মুখ দেখতে পেলে ভালো লাগবে। যখনই জেমস তার মেয়ের সাথে দেখা করতে ও বাড়ি যাবে, মিস টেলর তার কাছ থেকে আমরা কেমন আছি না আছি জানতে পারবে।’

এই সুখকল্পনার মুক্তধারা যাতে বাধা না পায়, এমা তার জন্য কোনো কসুরই ছাড়ল না। মনে আশা, বাবার সাথে কোনোক্রমে ব্যাকগ্যামন খেলে যদি সন্ধেটা পার করে দেওয়া যায়, তাহলে তার নিজের দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কোনো দুশ্চিন্তার ভার তাকে সামলাতে হবে না। ব্যাকগ্যামনের3 বোর্ড পাতাও হল, কিন্তু ঠিক সেইসময় এক অতিথি এসে উপস্থিত হওয়ায় এসবের আর কোনো প্রয়োজন রইল না।

মিস্টার নাইটলি বছর সাঁইত্রিশ-আটত্রিশের একজন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি শুধু যে এই পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ পুরনো বন্ধু তা-ই নয়, কুটুম্বও বটে, কারণ তিনি হলেন ইসাবেলার স্বামীর বড় ভাই। তিনি হাইবারির মাইল খানেকের মধ্যে থাকতেন, প্রায়ই আসতেন। এ বাড়িতে তিনি সদাই স্বাগত, আর এই মুহূর্তে তো অন্যদিনের চেয়ে বেশিই স্বাগত, কারণ তিনি লন্ডন থেকে উভয়পক্ষের পরিচিতদের কাছ থেকে সরাসরি আসছেন। কিছুদিন যাবত এই এলাকায় তাঁর ঢুঁ মারা হয়নি, আজই হঠাৎ একটু দেরি করে শুরু হওয়া এক নৈশভোজে যোগ দিতে এসেছেন, তারপর হার্টফিল্ড অবধি হেঁটে খবর দিতে এসেছেন যে ব্রুন্সউইক স্কোয়ারে সবাই মঙ্গলে আছেন। এই মন ভালো করে দেওয়া ঘটনায় মিস্টার উডহাউজ চনমনে হয়ে উঠলেন। মিস্টার নাইটলির হাসিখুশি স্বভাব এমনিতেই মিস্টার উডহাউজের মন হালকা করে দিত। তার উপর বেচারি ইসাবেলা আর তার বাচ্চাকাচ্চাদের সম্পর্কে তাঁর সমস্ত প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর তাঁর কাছে পাওয়া গেল। সেসব মিটে গেলে মিস্টার উডহাউজ কৃতজ্ঞতার সাথে বললেন, ‘আপনি এত কষ্ট করে আমাদের খবর নিতে এলেন। এখন তো আবার অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।’

‘না না, এমন চমৎকার চাঁদনি রাত, মনোরম আবহাওয়া, এবার আপনার ফায়ারপ্লেসের আরাম ছেড়ে উঠে পড়াই ভালো।’

‘কিন্তু রাস্তাটা যে নোংরা আর কাদা-কাদা। আপনার যদি ঠান্ডা লেগে যায়?’

‘নোংরা! স্যার, আমার জুতোটা দেখুন। এক কুচি ধুলোও লেগে নেই।’

‘আচ্ছা, আশ্চর্য তো! কারণ আমাদের এদিকটায় বেশ বৃষ্টি হয়েছে। আমরা যখন প্রাতরাশ সারছিলাম, তখন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হল। আমি তো ভাবছিলাম বিয়েটা পিছিয়ে দিতে বলি।’

‘ওহ্‌ তাই তো, আপনাদের অভিনন্দনই জানানো হয়নি। তবে আপনাদের মনের অবস্থা কী সেটাও বুঝতে পারছি, তাই অভিনন্দন জানাবার তাড়া নেই। তবে আশা করি গোটা অনুষ্ঠানটা ভালোভাবে মিটে গেছে। কে সবকিছু সামলাল? কে বেশি কাঁদল?’

‘বেচারি মিস টেলর! কী করুণ অবস্থা দেখুন তো।’

‘মিস্টার উডহাউজ, মিস উডহাউজ, যাই বলুন, আমি তো মিস টেলরকে বেচারি বলে মনে করতে পারছি না। আমি আপনাকে আর এমাকে মানুষ হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এই কে কার দায়িত্ব নেয় সে ব্যাপারটায়… যাই হোক, এটা তো মানবেন যে, দু’জনকে খুশি রাখার গুরুদায়িত্বের তুলনায় একজনকে খুশি রাখার কাজটা হালকা!’

‘বিশেষ করে সেই দু’জনের মধ্যে একজনের স্বভাব যদি হয় খামখেয়ালি আর গোলমাল পাকানো!’ এমা মজা করে বলল, ‘আপনার মাথায় নিশ্চয় এই কথাটাই ঘুরছিল, আর বাবা সামনে না থাকলে নিশ্চয় আপনি এটাই বলতেন।’

‘সত্যিই তো মামণি,’ মিস্টার উডহাউজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ‘আমি মাঝে মাঝে সত্যিই খেয়ালিপনা করি আর গোলমাল পাকাই।’

‘বাবা! আমি তোমার কথা বলছি ভেবো না! মিস্টার নাইটলিও তা বলছেন না। কী যে সব ছাইপাঁশ চিন্তা আসে তোমার মাথায়! না না, আমি তো নিজের কথা বলছিলাম। মিস্টার নাইটলি আমার খুঁত ধরতে পারলে ভারি খুশি হন, জানো তো – আমরা রসিকতা করছিলাম মাত্র। আমরা দেখা হলেই একে অন্যের সাথে ইয়ার্কি করি।’

মিস্টার নাইটলি সত্যিই সেই অল্পসংখ্যক মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁরা এমা উডহাউজের ভুল দেখতে পেতেন। আর সেই ভুল তাকে মুখের উপর বলার মতো মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক ও একমাত্র। এমার এই বিষয়টা খুব একটা পছন্দ না হলেও সে জানত, তার বাবা আবার এ কথাটা বাড়াবাড়ি রকমের অপছন্দ করবেন। মানে, এমাকে প্রত্যেকে প্রতি মুহূর্তে নিখুঁত বলে মনে করছে না, এটা কল্পনা করাই তাঁর পক্ষে অসম্ভব।

‘এমা জানে যে, আমি কখনো বানিয়ে বানিয়ে ওর তারিফ করি না,’ মিস্টার নাইটলি বললেন, ‘তবে আমি কাউকে লক্ষ্য করেই কথাটা বলিনি। মিস টেলর এখানে দু’জনের দেখাশোনা করছিলেন, ওখানে মোটে একজন। সেই হিসেবে ওঁর লাভ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, এটুকুই বলছিলাম।’

‘বেশ,’ এমা আর কথা না বাড়িয়ে বলল – ‘আপনি বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না? তবে শুনুন, বিয়েতে আমরা সবাই চমৎকার ব্যবহার করেছি। প্রত্যেকে ঠিক সময়ে এসেছে, সুন্দর করে সেজেগুজে, কেউ কাঁদেনি, কারো মুখ ভারি অবধি হয়নি। কী জানেন, আমাদের সবারই মনে হচ্ছিল, আমরা তো মোটে আধ মাইলের মধ্যেই রইলাম, নিশ্চয় আমাদের রোজ দেখা হবে।’

‘এমা সবকিছু এত ভালো সামলায়,’ তার বাবা বললেন, ‘কিন্তু মিস্টার নাইটলি, মিস টেলরের অভাবটা ওর মনে বড়ই বাজবে, আমি ঠিক জানি। ও যতটা ভাবছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাবে।’

এমা হাসিকান্নার মাঝে পড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ‘এরকম একজন সঙ্গীর অভাব বোধ না করাটাই অসম্ভব,’ মিস্টার নাইটলি বললেন। ‘আমরা যদি মিস টেলরকে আরেকটু কম ভালবাসতে পারতাম, আমাদের জন্যেই বুঝি ভালো হত। তবে এমা জানে, তাঁর কাছে বিয়েটা কত জরুরি ছিল – নিজের বাড়ি, নিজের সংসার, নিরাপদ আরামদায়ক জীবনের আশ্বাস – তাই এমার দুঃখের চেয়েও সুখ বেশি হবে। মিস টেলরের প্রতিটি বন্ধুই নিশ্চয় তাকে এমন আনন্দের সাথে বিয়ে করতে দেখে সুখীই হয়েছে।’

‘আরেকটা খুশির কথা তো আপনি ভুলেই গেলেন,’ এমা বলল, ‘খুব দরকারি কথা। এই বিয়েটা যে আমিই ঠিক করেছি বছর চারেক আগে! আর শেষ অবধি বিয়েটা হল – এত ভালোভাবে হল – লোকে তো বলছিল মিস্টার ওয়েস্টন আর বিয়েই করবেন না – এতে কিন্তু আমার খুশির শেষ নেই।’

মিস্টার নাইটলি বিদায় নেওয়ার জন্য তার সাথে করমর্দন করলেন। এমার বাবা স্নেহের সাথে বললেন, ‘মামণি, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করা আর ভবিষ্যৎবাণী করা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো, কারণ তুমি যা বলো, তাই দেখি সত্যি হতে ওঠে। আর কিন্তু সম্বন্ধ করে কাজ নেই।’

‘আমি নিজের জন্য আমি এসব কিছু করব না বাবা, কিন্তু অন্যের জন্য তো করতেই হবে! এতে আমার সবথেকে বেশি মজা লাগে। আর প্রতিবার ঘটনাগুলো সত্যি ঘটে যাওয়ার পর, বুঝলে! – উফ্‌ প্রত্যেকে বলেছিল যে মিস্টার ওয়েস্টন আর বিয়ে করবেন না। নাকি করবেনই না! মিস্টার ওয়েস্টন, যিনি এতদিন আগে বিপত্নীক হয়েছেন, এবং স্ত্রী না থাকাটা যাঁর বেশ ভালোই অভ্যেস হয়ে গেছে, যিনি সারাক্ষণ কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত, হয় শহরে তাঁর ব্যবসা নিয়ে, নয় এখানকার বন্ধুবান্ধব নিয়ে, সর্বত্র তিনি স্বাগত, সবসময় হাসিখুশি – যাঁকে বছরে একটা সন্ধেও একলা কাটাতে হয় না। না না! মিস্টার ওয়েস্টন নিশ্চয়ই আর বিয়ে করবেন না। কেউ বলত যে, তিনি তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় শপথ করেছিলেন। কেউ আবার বলত, তাঁর ছেলে আর কাকা তাঁকে বিয়ে করতে দিচ্ছে না। লোকে যে কী না বলত! কিন্তু আমি কারো কথায় কান দিইনি।

সেদিন থেকেই – প্রায় চার বছর আগে – যেদিন মিস টেলর আর আমার সাথে তাঁর ব্রডওয়ে লেনে দেখা হয় – সেই যে যেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, আর তিনি বীরের মতো লাফ দিয়ে গিয়ে মিচেল চাষির কাছ থেকে আমাদের জন্য দুটো ছাতা নিয়ে এলেন, সেই মুহূর্তেই ওদের সম্বন্ধটা আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলি। আর বাবা, আজ যখন সে কাজে আমি এমন সাফল্য লাভ করেছি, তখন আমি বিয়ের সম্বন্ধ করা বন্ধ করে দেব, এমন মোটেও ভেবো না।’

‘সাফল্য বলতে কী বলছ তা তো বুঝতে পারলাম না,’ মিস্টার নাইটলি বললেন। ‘কোনো কাজের জন্য খাটলে তবে না সাফল্যের কথা আসে। তুমি যদি গত চার বছর ধরে এই বিয়েটা দেওয়ার জন্য বিশেষ খাটাখাটনি করতে, তবে নাহয় বুঝতাম। তরুণী মনের যোগ্য কাজ হত সেটা! কিন্তু আমি যেটুকু বুঝলাম, পরিকল্পনা বলতে তুমি একদিন খালি অলস ভাবে ভেবেছিলে যে, ‘মিস্টার ওয়েস্টনের সাথে মিস টেলরের বিয়ে হলে বেশ হয়,’ আর তারপর থেকে মাঝে মাঝে নিজের মনে চিন্তাটা আওড়াতে মাত্র – এতে সাফল্যের কী আছে? এতে তোমার বুদ্ধি খরচ হল কোথায়? কী নিয়ে গর্ব করছ? তুমি একটা আন্দাজ করেছিলে, সেটা সত্যি হয়েছে মাত্র।’

‘আর আপনি বুঝি আন্দাজ সত্যি হওয়ার আনন্দ জানেন না? আপনার জন্য আমার খারাপই লাগছে। আমি ভাবতাম আপনার আরেকটু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। আন্দাজ সত্যি হওয়ার পিছনে কখনোই শুধু ভাগ্য কাজ করে না। সবসময়ই তাতে প্রতিভার একটা জায়গা থেকে যায়। আর আমার ব্যবহার করা সাফল্য শব্দটা, যেটা নিয়ে আপনি এতগুলো কথা শোনালেন, সেটার বিষয়ে বলি – আমার তো মনে হয় না এই বিয়েটা ঠিক হওয়ার পিছনে আমার কোনো ভূমিকা নেই! আপনি খাটা আর না খাটার দু’টি চমৎকার উদাহরণ দিলেন বটে, কিন্তু আমার মনে হয়, তৃতীয় একটা অবস্থানের কথা আপনার মনে নেই – যেটা কিনা সব-করব আর কিছুই-করব-না-র মাঝামাঝি। আমি যদি মিস্টার ওয়েস্টনের এখানে আসার ব্যবস্থা না করতাম, ছোট ছোট নানা মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে ওঁদের এগিয়ে যেতে সাহায্য না করতাম, ছোট ছোট নানা সমস্যার সমাধান না করতাম, হয়তো ঘটনা এতদূর গড়াতই না। আপনি নিশ্চয় হার্টফিল্ড এলাকাটাকে ভালোমতোই চেনেন। আমি কী বলছি ভালোই বুঝতে পারছেন।’

‘ওয়েস্টনের মতো সোজাসাপটা খোলা মনের একজন মানুষ আর মিস টেলরের মতো বুদ্ধিমতী, ধীরস্থির মেয়ে নিশ্চয় নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারটা দেখে নিতে পারতেন। তুমি ওঁদের ব্যাপারে নাক গলাতে গেলে ওদের উপকারের চেয়ে নিজের অপকার করে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘পরের উপকারের সময় এমা কখনো নিজের কথা ভাবে না,’ মিস্টার উডহাউজ পুরো কথাবার্তার খানিক বুঝে, খানিক না বুঝে বলে উঠলেন, ‘কিন্তু মামণি, তুমি আর কারো বিয়ে দিতে যেও না। ওসব বোকা বোকা ব্যাপার। ওতে শুধু পরিবারগুলো ভেঙেচুরে যায় মাত্র।’

‘শুধু আর একবার, বাবা! শুধু মিস্টার এলটনের জন্য। বেচারি মিস্টার এলটন। তুমি তো ওনাকে পছন্দই করো, বাবা। আমায় ওঁর জন্য পাত্রী খুঁজে বার করতেই হবে। হাইবারিতে ওনার যোগ্য কেউ নেই, এদিকে উনি এখানে আছেন প্রায় এক বছর হতে চলল, নিজের বাড়িটা কত সুন্দর করে সাজিয়েও নিয়েছেন। ওঁর পক্ষে আর বেশিদিন একা থাকাটা মোটেই ঠিক হবে না – আজ যখন উনি ওদের দু’জনের হাতদু’টি ধরে পাণিগ্রহণ করাচ্ছিলেন, ওঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, ওঁর নিজের জন্যেও এরকম একটা অনুষ্ঠান ঘটাতে পারলে উনি খুবই খুশি হন! আমি মিস্টার এলটনকে খুবই পছন্দ করি। এইভাবেই আমি ওঁকে ঠিকমতো সাহায্য করতে পারব।’

‘মিস্টার এলটন নিঃসন্দেহে খুবই রূপবান এক যুবক, হৃদয়বানও। তাঁকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি। তবে তুমি যদি তাঁর প্রতি মনোযোগ দিতে চাও তো তাঁকে আমাদের সাথে খেতে ডাকো না কেন? সেটাই ভালো হবে। মিস্টার নাইটলিও নিশ্চয় তাঁর সাথে দেখা করতে আপত্তি করবেন না।’

‘আমি খুশিই হব। আপনি যেদিন ডাকবেন,’ মিস্টার নাইটলি হেসে বললেন, ‘আর আমি আপনার সাথে একমত যে, ওঁকে খেতে ডাকাটাই ঠিক হবে। এমা, ওঁকে নিমন্ত্রণ করো, ভালো করে মাছমাংস খাওয়াও, কিন্তু পাত্রী খোঁজার ব্যাপারটা ওঁর নিজের হাতেই ছেড়ে দাও। বিশ্বাস করো, ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একজন পুরুষ এই দেখাশোনার কাজটুকু নিজেই করে নিতে পারবেন।’

------------------

টীকা

[1] এমা জেন অস্টেনের একমাত্র উপন্যাস, যার নাম তার নায়িকার নামে দেওয়া হয়েছে। নর্দাঙ্গার অ্যাবির নাম প্রথমে নায়িকার নামে থাকলেও পরে বদলে যায়। এটাও উল্লেখযোগ্য যে জেন অস্টেনের ছটি উপন্যাসের মধ্যে শুধু এই দুটো উপন্যাসের সূচনাই হয়েছে নায়িকার বর্ণনা দিয়ে।

[2] সে সময় গাড়ির গতি ছিল গড়পড়তা ঘন্টায় সাত আট মাইল।

[3] একধরনের বোর্ড গেম।