কোলোন্তাইয়ের ডায়রি ও স্তালিন ট্রটস্কি বিরোধের জমানার পুনঃপাঠ

কোলোন্তাই সম্পর্কে শতাব্দী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন অন্যস্বর পত্রিকায়। এটি পঞ্চম পর্ব। আগের পর্বগুলি সংশ্লিষ্ট লিংক থেকে পড়া যাবে।

প্রথম পর্ব - রুশ বিপ্লবী, তাত্ত্বিক কোলোন্তাইকে ফিরে দেখা

দ্বিতীয় পর্ব - আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই-এর নারী ভাবনা

তৃতীয় পর্ব - আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই, ওয়ার্কাস অপজিশন ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার বিতর্কের এক দিক

চতুর্থ পর্ব - কোলোন্তাইয়ের কথাসাহিত্য : ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক

 

বিট্রিস ফার্নসওয়ার্থ ছিলেন কোলোন্তাইয়ের এক উল্লেখযোগ্য জীবনীকার। তিনি কোলোন্তাইয়ের ডায়রি পড়ে, তার আলোকে তাঁর জীবন ও কার্যাবলির রূপরেখা আঁকতে চেয়েছিলেন। তাঁর লিখিত বই ‘আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই’: সোশালিজম, ফেমিনিজম অ্যান্ড বলশেভিক রেভোলিউশন’ পড়লে চমকে উঠতে হয়। তিনি হাতে লেখা যে ডায়রি নোটের উল্লেখ করেছেন, তার সবটা কোলোন্তাইয়ের স্মৃতিকথায় ছাপাও হয়নি। কিন্তু আমরা যদি মানুষকে তার সমগ্রতায় চিনতে চাই, যদি তাঁকে তাঁর পার্টি যেভাবে উপস্থাপিত করেছে, তার বাইরে বেরিয়ে বুঝতে চাই, তাহলে ব্রিট্রিসের লেখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্রিট্রিসের বইটি যেমন বহু-আলোচিত, তেমনই বিতর্কিত তাঁর একটি নিবন্ধ : দ্য ডায়রিজ অফ আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই অ্যান্ড দ্য ইন্টার্নাল লাইফ অফ পলিটিক্স।’ আগামী দুই পর্বে সেই গোপন এবং একপ্রকার নিষিদ্ধ ‘ব্যক্তিগত’-র আলোয় আমরা কোলোন্তাইকে দেখতে চাইব।

যেমন, বিট্রিস আমাদের জানান, ১৯৩৮ সালে, যখন স্ট্যালিন যুগ মধ্যগগনে, তখন  ডায়রিতে লিখেছিলেন ছেষট্টি বছরের কোলোন্তাই:

“পৃথিবী কি ভয়ংকর উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে! বন্ধুরা চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছে। আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয় তাদের জন্য। মেনে নিতে পারছি না। বুঝতে পারছি না যে, কেন এমনকি এ.এ (এএ স্যাতকেভিচ)-ও ‘ইতিহাসের চাকার তলায়’ নিষ্পেষিত হয়ে গেল! কি নিবেদিতপ্রাণ ছিল সে! কি সৎ কর্মী! আমি নিজে যদি ওই ‘ইতিহাসের চাকার তলায়’ না পড়ি, তবে তা হবে আশ্চর্যের। জানি, কোনো কারণ নেই, আমার কোনো কর্মও এমন নেই (যা তাদের প্ররোচিত করবে)। কিন্তু ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ‘কারণ’ লাগছে না। অন্য কোনো নির্ণায়ক বিষয় কাজ করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি এসব বুঝবে? তারা কি বুঝবে এখন আসলে কী ঘটছে?”

 

কোলোন্তাই তথাকথিত সেই ‘ইতিহাসে চাকায়’ পিষে মরেননি। দু দুবার ডাক পড়েছিল মস্কোয়। দুবারই ফিরেছিলেন। সুইডেনে ইউএসএসআর-এর রাষ্ট্রদূতের পদটি পাকা ছিল ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। ঐতিহাসিকরা কেউ কেউ মনে করেন, এ এক আয়রনি যে নারীমুক্তির পথিকৃৎ কোলোন্তাই বেঁচে গেছিলেন অভিজাত, রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ, সুন্দরী এবং সর্বোপরি নারী বলেই। এ একরকম ‘শিভ্যালরি’। কেউ আবার মনে করেন, বিষ দাঁত উপড়ে ফেলে কয়েকজন প্রাচীন বলশেভিককে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে জনগণকে বোঝানো যায়, স্তালিনের একমাত্র কাজ ‘পার্জ’-এর নামে কমরেড-হত্যা নয়। লক্ষ্যণীয়, কোলোন্তাইয়ের সঙ্গে স্ট্যালিনের সম্পর্কের আপাত উন্নতিই হয়েছিল। তাই ১৯৫২ সালে মারা যাওয়ার ঠিক আগে কোলোন্তাই ভরসা করে রাষ্ট্রীয় আর্কাইভগুলিতে রেখে যান হাতে-লেখা ডায়রি, চিঠি, টাইপ করা স্মৃতিকথা, স্ট্যালিনের সঙ্গে কথোপকথনের অনুলিখন। অনুরোধ করেছিলেন, ১৯৭২ সাকে যখন তাঁর জন্মের শতবর্ষ হবে, তখন যেন সেগুলো প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সোভিয়েত সরকারের পতনের আগে, স্বাভাবিক কারণেই, তারা প্রকাশিত হয়নি। সোভিয়েতের পতনেরও দশ বছর পর, ২০০১ সালে সেগুলো প্রকাশিত হয়। বিশেষত এই স্তালিনের সঙ্গে কথোপকথনের অনুলিখনগুলি, দেখায় যে কোলোন্তাই নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতে, বা অন্তত ‘মিটিয়ে নিতে’, বা এটুকু প্রমাণ করতে যে তিনি আর বিরোধী নন (ওয়ার্কার্স অপোজিশন-এর কিস্তিটি স্মর্তব্য) ব্যস্ত ছিলেন। সাক্ষাৎকারগুলিতে এককালের অগ্নিকন্যা বেশ মেয়েলি, মিতবাক ও উৎকর্ণ শ্রোতা রূপে দেখা দেন। এই পরিবর্তিত ভাবমূর্তিই কি তাঁর বেঁচে যাওয়ার কারণ?

এদিকে কোলোন্তাইয়ের ডায়রিগুলি কিন্তু ঠিক বিপরীত প্রবণতা দেখায়, যা বিপজ্জনক। ডায়রি যে রাখতে পেরেছিলেন, সেটাই আশ্চর্যের, কারণ সে সময় ডায়রি রাখতে মানুষ ভয় পেত। ডায়রিই প্রথমেই খুঁজত পুলিশ৷ তাই ব্যক্তিগত লেখাপত্র ও ডায়রি অনেকেই পুড়িয়ে ফেলছিলেন। অনেকে আবার ডায়রির মতো করে দিনলিপি লিখতেন, কিন্তু সেসব ভুয়ো দিনলিপি বলে সন্দেহ হয়— এতটাই স্তুতি সেখানে স্তালিন সরকারের৷ হয়ত নানা ঘটনার থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মানুষও জানতেন যে প্রথমেই খোঁজা হবে ডায়রি। তাই হয়ত তাঁরা মিথ্যা ডায়রি লেখার কথা ভেবেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে৷ সেইসময়ে, কোলোন্তাই এমন ভাবে ডায়রি লিখছেন, যেন তিনি নিশ্চিত যে এ ডায়রি রাষ্ট্রের হাতে পড়বে না৷ বাস্তবেও পড়েনি কোলোন্তাই না চাওয়া পর্যন্ত৷ কিন্তু ডায়রির বয়ান বারবার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে৷

সোভিয়েত দেশের লেখিকা লিডিয়া চুকোভস্কায়া লিখেছিলেন যে "সেই দিনগুলিতে একটি বাস্তব ডায়েরি রাখার কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল।" কিন্তু কোলোনতাই ঠিক তাই করেছিলেন। স্ট্যালিনের শাসনকালে তাকে গ্রেফতার করতে চাইলে প্রমাণ খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধা হত না। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোলোন্তাই কিন্তু কেবল রাজনীতিবিদ নন, তিনি লেখকও। লেখকসত্তা আবেগের ধারপাশ মাড়াবে না, নিজেকে খুঁড়বে না, এ প্রায় অসম্ভব।

তাঁর তীব্র ডায়রিগুলি তার আবেগকে ধারণ করেছে। কেন ও কীভাবে তিনি ‘নতুন নারী’-র ধারণাটি গড়ে তুলছেন  বুর্জোয়া নৈতিকতা এবং ঐতিহ্যগত পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করে, তা বলে ডায়রি। সেখানে তিনি তার প্রেমের অভিজ্ঞতাগুলিকে গোপন করেননি। যৌনতাও না। এমন মানুষ ডায়রিতে খুব বেশি অসৎ হতে পারেন কি?

বিট্রিস আমাদের বলেন, ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে, স্তালিনের সঙ্গে কোলোনতাইয়ের সম্পর্ক জটিল ছিল। ১৯২১ সালে কোলোন্তাই পার্টির মহিলা বিভাগের নেত্রী হিসাবে স্তালিনের সাহায্য চেয়েছিলেন। পাননি। হতাশ হয়েছিলেন। অন্যদিকে, স্তালিন স্বাভাবিক ভাবেই ওয়ার্কার্স অপোজিশন-এরও বিরোধিতা করেন। ১৯২২ সালে কোলোন্তাইকে দল থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা হয়েছিল। তিনি রয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু, আসলে তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। এই বেদনা স্মরণ করতে গিয়ে কোলোন্তাই বলেন, “অল্প অল্প অল্প করে, আমি আমার কাজ থেকে মুক্তি পেয়েছি।”

কিন্তু, ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি, কোলোন্তাই-স্তালিনের সম্পর্কের সমীকরণ বদলায়। ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে, জীবনের একটি ‘অন্ধকার সময়’ চলাকালীন, স্টালিন তার ‘ব্যক্তিগত চিঠি’-র উত্তর দিয়েছিলেন। কোলোন্তাই লিখেছিলেন, তিনি তাঁর প্রেমিক, অসামরিক কমান্ডার, পাভেল ডাইবেনকোর থেকে সাময়িক বিচ্ছেদ চান। তিনি বিদেশে যেতে চান। ওই বছর অক্টোবর মাসে পঞ্চাশ বছরের কোলোন্তাইকে স্তালিন নরওয়েতে সোভিয়েত বাণিজ্য প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। কোলোন্তাই আনন্দিত হয়েছিলেন। লিখেছিলেন, তিনি সেই আনন্দের দিনটি কখনই ভুলতে পারবেন না যখন “পার্টি আবার আমাকে দায়িত্বশীল কাজে ডেকেছিল।”

১৯২৩ সালে নরওয়ে থেকে তিনি স্তালিনকে জানান, ডাইবেনকারের সঙ্গে তাঁর নাম যেন আর জড়ানো না হয়। তিনি স্তালিনকে কমরেডদের প্রতি সংবেদনার জন্য ধন্যবাদও জানান।

১৯২৪ সালে স্তালিনের সঙ্গে কোলোন্তাইয়ের সখ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন কোলোন্তাইয়ের সঙ্গে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লিটভিনভ এবং জর্জ চিচেরিনের মতবিরোধ হয় নরওয়েকে বাণিজ্য-ছাড় দেওয়ার বিষয়ে। তিনি তখন এ বিষয়ে স্তালিনের সমর্থন চেয়েছিলেন। কোলোন্তাই লিখেছেন, স্তালিন ‘খেলাচ্ছলে’ জিজ্ঞাসা করলেন: ‘কে তোমাকে আঘাত করেছে, লিটভিনভ না চিচেরিন?’ তিনিও বাচ্চা মেয়ের মতো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দুজনেই, কমরেড স্তালিন।’ স্তালিনের স্বরভঙ্গিতে সহমর্মিতা ছিল, আবার ছিল যেন দুর্বল নারীর প্রতি পক্ষপাত।

কোলোন্তাই অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি কাউন্সিল অফ কমিসারের অধিবেশনে উপস্থিত থাকুন, যেখানে বাণিজ্য সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হবে। তাঁর উপস্থিতি কোলোন্তাইকে অন্য একটি সমস্যা উত্থাপন করতে "অনুপ্রাণিত" করেছিল: “১৫ মার্চের আগে সীল শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক, নরওয়েকে এর আগে শিকারের অনুমতি দেওয়া তাঁর মতে অসম্ভব ছিল, কারণ যদি মাকে হত্যা করা হয় তবে শিশু সীলও মারা যাবে।’’ কোলোন্তাই স্তালিনের ঠাট্টা শুনতে পেয়েছিলেন এ নিয়ে। তাকে সহাস্যে গ্রহণও করেছিলেন। স্তালিন বলেছিলেন: “এই দেখো কোলোন্তাই মা আর শিশুর (সীলের) সুরক্ষার কথা ভাবছেন যথারীতি।’ সবাই হেসে উঠেছিল, কারণ এর মধ্যে অতীতের ইঙ্গিত ছিল৷ ১৯১৮ সালে জনকল্যাণ কমিশনার হিসাবে মা ও শিশুদের সুরক্ষায় কোলোন্তাইয়ের ভূমিকা কারও অজানা নয়। মিটিং থেকে বেরোনোর স্তালিন হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোলোন্তাই বাণিজ্য ডিক্রিতে খুশি? কোলোন্তাই স্তালিনকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।

১৯২৩ সালের বসন্তের মধ্যে কোলোন্তাই হয়ত জানুয়ারিতে লেখা ভ্লাদিমির লেনিনের গোপন "টেস্টমেন্ট"-এর বিষয়বস্তু জানতে পেরেছিলেন। এই টেস্টামেন্ট পার্টিকে সতর্ক করে যে স্তালিন "অত্যধিক রূঢ়৷” তাঁকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কোলোন্তাই ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর ডায়েরিতে "টেস্টামেন্ট"-এর উল্লেখ করেননি। কিন্তু যখন উল্লেখ করলেন, তখনও বললেন যে, এরকম কিছু একটা ছিল —  কিন্তু মস্কোকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাহস তিনি করবেন না।

সম্ভবত কোলোন্তাই জানতেন যে একজন ‘রূঢ’ মানুষকে ‘সংবেদনশীলতার’ জন্য ধন্যবাদ দিলে সে খুশিই হবে। কোলোন্তাইয়ের এই তোষামোদি কি ইচ্ছাকৃত? বিট্রিস বলছেন, তাঁর ডায়েরি এ ব্যাপারে ইঙ্গিতপূর্ণ। কোলোন্তাই লিখেছেন, ‘‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে, শিল্পীদের মতোই, চাটুকারিতা করতে ভয় পাবেন না, সে প্রশংসা যতই সরল এবং অতিরঞ্জিত হোক। এমনকি খুব শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদরাও এটা ভাবতে ভালবাসে যে তারা আপনাকে আনন্দ দিতে পারে।’’

তবে চাটুকারিতা বা বন্ধুত্ব কোনোটার জোরেই কোলোন্তাই মস্কো ফিরতে পারেননি। সর্বহারা নারীদের মধ্যে যে কাজ তিনি করতে চেয়েছিলেন, তা করতে পারেননি। তিনি লিখেছেন, “আমি মস্কোতে ফিরতে চাই, বাড়ি ফিরতে চাই। এই বিচ্ছিন্নতায়  দমবন্ধ হয়ে যায়।” নিঃসন্দেহে স্তালিন কোলোনতাইকে প্রাথমিক ভাবে বাইরে পাঠিয়েছিলেন, কারণ তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিসারের পদের উপযুক্ত ছিলেন। চিচেরিন, লিটভিনভ এবং মাইস্কির মতো, তিনিও প্রাক-বিপ্লব বুদ্ধিজীবী, বিদেশের জীবনের সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া দেশে বেশ কিছু মহলে তিনি অপ্রিয় ছিলেন। যেমন ১৯২৬ সালে ছুটি কাটাতে গিয়ে কোলোন্তাই নতুন বিবাহ আইনের বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঝেনৎদলের নেত্রীরাই তাঁকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। একে কোলোন্তাই ‘বেদনাদায়ক’ বলে অভিহিত করেছেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, মস্কোয় ফেরার সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘সংগঠিত বিরোধী’-দের সঙ্গে তাঁর সন্দেহজনক সম্পর্ক। ১৯২৬ সালের অগাস্টে কোলোন্তাই জানতে পেরেছিলেন যে তিনি মেক্সিকোতে নিযুক্ত হচ্ছেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, ‘মিথ্যা গুজবের’ উপর ভিত্তি করে স্তালিন তাঁকে এখনও বিরোধী বিবেচনা করতে পারেন। তখন ইউনাইটেড অপোজিশন —লেভ ট্রটস্কি, গ্রিগোরি জিনোভ এবং লেভ কামেনেভের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী জোট— স্ট্যালিনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছিল। ‘মিথ্যা গুজব’-টি তাহলে কী হতে পারে?

১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে মস্কোতে চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে বিরোধীদের সঙ্গে কোলোন্তাইয়ের সাবলীল কথোপকথন সেই মিথ্যে গুজবের উৎস হতে পারে। সেখানে তিনি পুরানো কমরেডদের সঙ্গে সহজে মিশেছিলেন। ‘লেনিনগ্রাদারদের’ মধ্যে, কোলোনতাই অবাক হয়ে দেখেছিলেন “এত পরিচিত, এত কমরেড! এমনকি ক্লাভদিয়া নিকোলায়েভা [ঝেনৎদেল-এর সময় থেকে তাঁর বন্ধু] বিরোধী দলে রয়েছেন।” কোলোন্তাই কামেনেভের সাথে গল্প করেছিলেন, যিনি বলেছিলেন: “আমরা নিজেরাই আশা করিনি এটা (বিরোধিতা) এতদূর গড়াবে।” যদিও, তিনি বলেন ট্রটস্কি তাঁর কথোপকথনে, সমালোচনায় “অকল্পনীয়ভাবে নির্দয়” ছিলেন।

তাঁর প্রাক্তন ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশনের’ সহকর্মী  (ও প্রাক্তন প্রেমিক) আলেকজান্দার শ্লিয়াপনিকভ এবং সের্গেই মেদভেদেভ তখন “লেনিনগ্রাডারদের দিকে ঝুঁকেছেন,’’ - কোলোন্তাই তাঁর ডায়রিতে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু “স্ট্যালিনবাদীরা (মস্কোতে একটি নতুন শব্দ) ব্যক্তিগতভাবে আমার নিকটের ছিল।” তবুও বিরোধীদের সঙ্গে কমরেডসুলভ কথোপকথনে তিনি কার্পণ্য করেননি। হয়ত তা তাঁর সম্পর্কে গুজব তৈরি করেছিল।

জিনোভিয়েভ-ট্রটস্কি ব্লক দাবি করছিল যে তিনি তাঁদের পক্ষে। ক্ষুব্ধ কোলোনতাই ১৯২৬ সালের অক্টোবরে স্তালিনের সঙ্গে একটি বৈঠক প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন যে তিনি বিরোধী অবস্থানে নেই। স্ট্যালিনের ‘জেনারেল লাইন’-কে পুরোপুরি সমর্থন করেন। স্তালিন তা হয়ত জানতেন, তবু তিনি স্তালিনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, জিনোভিয়েভ এবং ট্রটস্কির সাথে তাঁর খারাপ সম্পর্কের কথা।

সাক্ষাতে কোলোন্তাই বলেন, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তিনি স্তালিনের পাশে আন্তরিকভাবে আছেন। কিন্তু তিনি এও স্পষ্ট স্বীকার করেছিলেন যে পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নগুলি এখনও তাঁকে ভাবাচ্ছে৷ এ ধরনের কথা বলার জন্য অনেকের গর্দান গেছে, শোনা যায়। কিন্তু কোলোন্তাইয়ের ক্ষেত্রে স্তালিন কেবল পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন: “আপনার অবস্থান আপনার একান্ত দলীয় বোঝাপড়ার প্রশ্ন। এখানে কেউ আপনাকে বাধ্য করছে না। কিন্তু আপনি বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ককে কীভাবে দেখবেন? আপনি কি ভাঙনে বিশ্বাস করেন?”

কোলোন্তাই বলেছিলেন, ভাঙন তো দলে দেখাই যাচ্ছে! যদি বলপূর্বক কণ্ঠরোধ করা হয়, তবে তা বাড়বে। স্টালিন এই ‘মধ্যপন্থী অবস্থান’ খারিজ করেন। বলেন, “বল দিয়ে নয়, দলীয় যুক্তি ও শৃঙ্খলার দিয়ে... যদি দলের মধ্যে উপদল সহ্য করা হয় তবে তা অনিবার্যভাবে দ্বিতীয় দল গঠনের দিকে যাবে। যিনি সাধারণ লাইনের পক্ষে নন, তিনি আসলে দলের কেউ নন।’’

অক্টোবরের সেই দিনে তাঁদের মধ্যে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা হয়েছিল নানা বিষয়ে। প্রকৃতপক্ষে, যৌন স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং "নতুন নারী’  কোলোন্তাইয়ের সঙ্গে স্তালিনের সাক্ষাৎকার কালে নারীটির মুগ্ধতা দেখার মতো (অন্তত যেভাবে তিনি অনুলিখনে লিখে গেছেন)। ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, প্রায় ষাট বছরের কোলোন্তাই কি এতটাই দাঁতনখহীন যে তাঁর সামনে স্তালিনকে অহং গোপন করতে হয় না? এমনকি স্তালিন যখন সন্দেহ প্রকাশ করেন, তখনও কোলোন্তাইকে চ্যালেঞ্জ বা বিরোধিতা করতে দেখা যায় না। আর্কাইভে তাঁর হাতে লেখা যে অপ্রকাশিত নোট রয়েছে, যেখানে তিনি স্ট্যালিনকে তাঁর দলীয় বিরোধীদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, সেখানেও স্তালিন তাঁর বর্ণনায় "উজ্জ্বল [ইরকো]" "সংযত," এবং "দৃঢ়সংকল্প", চতুর্দশ কংগ্রেসে দৃশ্যত জিনোভিয়েভ এবং ট্রটস্কির চেয়ে "শক্তিশালী এবং আরও সাহসী"। তাঁদের মতো স্তালিন নাকি, “নিজের জন্য নয়, দলের জন্য লড়ছিলেন।” স্ট্যালিন "লেনিনের মতো পার্টির মূর্ত রূপ।" এইসবই কোলোন্তাই লিখেছেন। লিখেছেন, যখন কিনা জিনভয়েভ এবং কামেনেভ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অনুভূতি পোষণ করেন, তখন স্ট্যালিন দলীয় স্বার্থকে ক্ষুদ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন৷ বিট্রিস সন্দধ প্রকাশ করেন, কোলোন্তাই যা বুদ্ধিমতী, তাতে সন্দেহ হয়, কোলোন্তাই এই কথাগুলো কি আত্মরক্ষার জন্য ছিল? যদি কেউ তার ডায়েরি পড়ে? বা কথাগুলো কি পরবর্তী কালে সংযোজিত হয়ে থাকতে পারে? একথা ভাবার কারণ, একেবারে বিপরীতধর্মী বর্ণনাও আছে যে!

১৯২৬ সালের অক্টোবরেও স্তালিন তাঁর অবস্থানে অনড় ছিলেন যে কোলোন্তাইকে মেক্সিকোতে যেতে হবে, সম্ভবত বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সন্দেহ তখনও তাঁকে তাড়া করছিল: তাছাড়া তিনি কি নিজেই দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্ন তোলেননি? কোলোন্তাই প্রতিবাদ করেননি। পরে অবশ্য বলেছেন যে তিনি যদি জোর করতেন তাহলে হয়ত যেতে হত না। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ১৯২৬ সালে স্তালিনকে তাঁর মতের বিরুদ্ধে রাজি করানো যেত। সত্যি যেত কি? যাইহোক, জোর করার পরিবর্তে, কোলোন্তাই জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি কেন্দ্রীয় কমিটির সমর্থনের আশা করতে পারেন? স্তালিন উত্তর দিয়েছিলেন: তিনি সরাসরি তাঁকেই চিঠি লিখতে পারেন।

মেক্সিকোতে এক বছরেরও কম সময় কাটানোর পরে, কোলোন্তাইকে ১৯২৭ সালে নরওয়েতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অসলো বাড়ির কাছাকাছি , কিন্তু কোলোন্তাতাই বিদেশি রাষ্ট্রদূত হতেই চাননি: "আমি মস্কোতে, বাড়িতে যেতে চাই," তিনি ১৯২৩ সালে লিখেছিলেন এবং ১৯২৭ সালেও আশা করেছিলেন যে তিনি মহিলাদের মধ্যে কাজ করতে পারবেন, "যদি তারা আমাকে অনুমতি দেয়"। তিনি জেনৎদেল সম্পর্কে নস্টালজিক। লিখেছেন: জনসাধারণের মধ্যে কাজের যে উত্তেজনা তা আর কিছুতে নেই। "জীবন্ত কাজ", যা "আত্মাকে সমৃদ্ধ করেছে", তা তিনি করতে চান। কিন্তু তিনি দুঃখের সঙ্গে এও বলেছেন সে "তারা তার অনুমতি দেবে না।"ব

প্রকৃতপক্ষে, ঝেনৎদেল কোলোন্তাইকে ত্যাগ করেছিল। এমনকি তাঁকে নিজেদের "ইতিহাস" থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। এই ইতিহাস মুছে দেওয়ার প্রবণতা পরবর্তী দশকে স্তালিনবাদীদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ছিল। ১৯২৭ সালে যখন তিনি মা ও শিশুদের নিয়ে একটি ঝেনেৎদেল প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তখন দেখেছিলেন, তাঁর ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। “আমার ছবি সেখানে থাকা উচিত। বিপ্লবের প্রথম বছরগুলিতে আমি ছাড়া আর কে ছিলাম যে মা এবং শিশুদের রক্ষা করার জন্য কাজ করেছিলাম?”, তিনি বলেন। দীর্ঘশ্বাস লিখে যান: ‘‘অন্য মানুষের হাতে প্রিয় কাজ এবং আমি দাঁড়িয়ে এককোণে।’’

কোলোন্তাইয়ের সকলের কাছে প্রমাণ করার দায় ছিল যে, তিনি বলশেভিক মূলধারার লোক। তাই তাঁকে স্তালিনবাদীদের খোলাখুলিভাবে সমর্থন করতে হচ্ছিল। ১৯২৭ সালের উত্তেজনাপূর্ণ শরতে তিনি দুই মাসের ছুটিতে মস্কোতে এসেছিলেন, ইউনাইটেড অপোজিশন দলের স্তালিন-বিরোধীরা তখন বহিষ্কারের মুখে।  তাঁর ডায়েরিতে তিনি তাঁর দোলাচল লিখে গেছেন। স্বীকার করেছেন,  “১৯১৪ সালে পক্ষ নেওয়া সহজ ছিল। আমরা ছিলাম সেই কমরেডদের পক্ষে যারা পিতৃভূমি রক্ষার ও শ্রেণি শান্তির পক্ষে ছিল। কিন্তু এখন বিষয়টি জটিল। এখন আছে কৃষকদের প্রশ্ন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্ন।”

পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করাই মুশকিল হয়ে উঠেছিল। "আমরা ভেবেছিলাম যে আপনি বিরোধীদের সঙ্গে আছেন," তাঁর বন্ধু এলেনা স্ট্যাসোভা তাঁকে অকপটে বলেছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে কোলোনতাই তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবেন। ১৯২১ সালে তাঁর ওয়ার্কার্স অপজিশন প্যাম্ফলেটটি ইউনাইটেড অপোজিশন দলেরই অনুরূপ ধারণা প্রকাশ করেছিল। বিশেষ করে দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তার আহ্বান ছিল একই রকম। লিউডমিলা স্টল তাকে অভিবাদন জানান এই বলে: "আপনি, অবশ্যই, আমাদের সঙ্গে আছেন, তাই না?" "অবশ্যই না”, কোলোন্তাই জবাব দেন।

কোলোন্তাই প্রয়াত লেনিনের স্ত্রী ও বলশেভিক নেত্রী নাদেজ্দা ক্রুপস্কায়ার সঙ্গেও দেখা করেন, যিনি ১৯২৫ সালে বিরোধীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু ১৯২৬ সালের নভেম্বরে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে, কোলোন্তাই উল্লেখ করেছেন যে তাঁরা বিরোধীদের বিষয়কে স্পর্শই করেননি আলোচনায়। "আমরা দুজনেই এটা এড়িয়ে গেলাম।" এসব আলোচনা অস্বস্তিকর হতে পারে, কারণ বিরোধীদের সমালোচনার বেশিরভাগই বৈধ ছিল। অথবা তারা আশঙ্কা করেছিলেন যে রাজনৈতিক মন্তব্যগুলি কেউ স্তালিনের কানে তুললে ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে। তাই দুই বন্ধু তাঁদের মনে যা ছিল তা নিয়ে আলোচনা করলেন না। কিন্তু ঝেনৎদেলের কাজ এবং লেনিনকে নিয়েই কথাই হল।

কোলোন্তাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিক, শ্লিয়াপনিকভ তাঁর "সম্মানিত নির্বাসন" উল্লেখ করে তাঁকে "কেরিয়ারিস্ট" বলে অভিহিত করেছিলেন। এই অভিযোগ কোলোন্তাইকে কষ্ট দিয়েছিল, কারণ তাঁর মতে তা অসত্য। ট্রটস্কি এবং কামেনেভের বিরোধিতার ধরন তাঁর কাছে "গভীরভাবে অচেনা" ছিল, কারণ ট্রটস্কি পার্টিতে ভাঙন চেয়েছিলেন, যা কোলোন্তাইয়ের দাবিমতো, তিনি চান না।

“পুরোনো বন্ধু সমালোচক’’, যাঁরা এখন ‘সরাসরি বিরোধী’, তাঁরা জানতে চাইছিলেন: “সত্যিই, আপনি ট্রটস্কির এই কঠিন সময়ে তার বিরুদ্ধে নামছেন?” কোলোন্তাই তাঁদের বিদ্বেষকে ‘প্রাকবিপ্লব সময়ের নৈতিকতা’ হিসাবে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। নিজের অবস্থানের সপক্ষে যুক্তি দিতে পার্টির রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। “জনগণ বিরোধীদের সঙ্গে নেই, বিরোধীরা দলীয় শৃঙ্খলা ও সংহতি নষ্ট করছে।”

কোলোন্তাইয়ের প্রকাশিত নিবন্ধগুলো স্তালিনের শিবিরকে নিশ্চিত করেছিল যে তিনি তাদেরই সমর্থন করেছিলেন। এক সকালে, বাণিজ্য কমিসার আনাস্তাস মিকোইয়ান তাকে ডেকে পাঠান। বলেন, "আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন বলে আমরা আনন্দিত। আপনি যা লিখেছেন সুন্দর। এটি প্রয়োজনীয় ছিল।” মিকোইয়ানের মধ্যে কোলোন্তাই দেখছিলেন তারুণ্যের শক্তি, বিপ্লবের রোমান্টিকতা। মিকোইয়ানও কোলোন্তাইয়ের সঙ্গ উপভোগ করছিলেন। রাতের পর রাত তাঁদের আলোচনা চলেছে বিরোধীদের নিয়ে, কুলাক কৃষকদের নিয়ে।  ১৯২৭ সালে তাঁদের কেউই কল্পনা করতে পারেননি যে তাঁরা দু'জন নেতৃস্থানীয় জীবিত মুষ্টিমেয়দের মধ্যে থাকবেন। পলিটব্যুরো যখন ট্রটস্কি, কামেনেভ এবং জিনভ'য়েভকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন কোলোন্তাই এবং মিকোইয়ান ফোনে সেই আলোচনার শুনেছিলেন। ১৯২৭ সালের ৩ ডিসেম্বর, তিন বিরোধীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কোলোন্তাই সহানুভূতিপূর্ণ  প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন: "এই অনিবার্য এবং ঐতিহাসিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত এক ট্র্যাজেডি; এঁরা ১৯১৭ সালের কর্মী ছিলেন।"

যাইহোক, সেদিন মিকোইয়ান উৎসাহের সঙ্গে ভূমির সমবায়করণের সরকারি কর্মসূচির রূপরেখা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কোলোন্তাই একে “এক সুবিশাল, কঠিন কাজ” বলেছেন। বলেছেন যে নিকোলাই বুখারিন পরিস্থিতিটিকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। কোলোন্তাই সরকারি পরিকল্পনাকে মেনে নিয়েছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল স্ট্যালিন শেষ পর্যন্ত বলপূর্বক সমবায়করণ করবেন না। চতুর্দশ কংগ্রেসের পর, কোলোন্তাই বোঝেননি যে স্তালিনের দৃষ্টিভঙ্গি নমনীয় বা মধ্যপন্থী নয়। কুলাক ও ধনী কৃষক ছিল বলশেভিকদের "প্রতিপক্ষ"। তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর দখল নতুন অর্থনৈতিক নীতির অধীনে শক্তিশালী হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কৃষকদের "শক্তিশালী হতে দেওয়া" প্রয়োজন ছিল। কিন্তু "কৃষকের পেটি বুর্জোয়া মতাদর্শকে সাম্যবাদের শ্বাসরোধ করতে না দেওয়া”-ও দরকার ছিল।

কিন্তু বিহ্বল কোলোন্তাইকে ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে গ্রামাঞ্চলের সম্পূর্ণ সমবায়করণের উদ্দেশ্যে স্ট্যালিনের নির্মমতার চরম নজির দেখতে হল। ১৯৩০ সালের জানুয়ারির এই ঘটনা অতিমাত্রায় তাঁর ডায়রিতে প্রভাব ফেলেছে। কোলোন্তাই ডায়রিতে "কুলাক"-দের (যারা সবাই যাচাইযোগ্যভাবে কুলাকও ছিল না, তিনি উল্লেখ করেছেন) বলপূর্বক নির্বাসনের নিন্দা করেছিলেন। মস্কোর একজন "অতিথি", যাঁর নাম তিনি করেননি, একজন পার্টি কমরেড, ষোড়শ পার্টি কংগ্রেস (সম্মিলিতকরণের অশান্তির মধ্যে অনুষ্ঠিত) থেকে ফিরে সদ্য কোলোন্তাইকে বলপূর্বক যৌথ খামারকরণের নৃশংস পরিণতি বর্ণনা করেছিলেন। এই "অতিথি" ১৯৩০ সালের শীতকালে নির্বাসিত "কুলাক"-এর ট্রেনের সঙ্গে ছিল। কোলোন্তাই তাঁর মুখে কৃষকদের গল্প শুনে সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন: "শিশু,  বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের গরু-ভেড়ার মতো গাড়িতে করে সমৃদ্ধ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছিল।’’ তিনি লিখেছেন, "কুলাক অবশ্যই, কিন্তু তারা মানুষ। গরু ছাগল নয়।" তখন এমন তুষারপাত হচ্ছিল যে, "শিশুরা তাদের মায়ের বুকের কাছে মারা গিয়েছিল। তাদের গাড়ি থেকে বরফের স্রোতে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল৷ তাদের মায়েরা কাঁদছিল... তিনি চলে যাওয়ার পর আমি ঘুমাতে পারিনি। মা এবং হিমায়িত শিশুরা আমায় তাড়া করছিল।’’