আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই-এর নারী ভাবনা

কোলোন্তাইকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অন্যস্বরের পাতায় লিখছেন শতাব্দী দাশ। এক একটি সংখ্যায় উঠে আসছে কোলোন্তাইয়ের জীবন, রাজনীতি, দর্শন, নারীভাবনার এক একটি দিক। এটি দ্বিতীয় নিবন্ধ।  এর আগের লেখাটির লিংকও এখানে থাকল।

প্রথম নিবন্ধ - রুশ বিপ্লবী, তাত্ত্বিক কোলোন্তাইকে ফিরে দেখা

১৯২০ থেকে ১৯৩০এর দশকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হিসাবে প্রশংসিত, আবার বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় 'মুক্ত প্রেম'-এর প্রবক্তা হিসাবে নিন্দিত আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই। তাঁর নিজের দেশ ও দল সাধারণত একপাক্ষিক ভাবে তাঁর বিশ্লেষণ করেছে। একথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি লেনিনের ‘কমরেড ইন আর্মস’, যাঁর সম্পর্কে বিপ্লবের সময় লেনিন বলেছিলেন, 'উজ্জ্বল এক বক্তা এবং শক্তিশালী প্রচারক'। একথাও মনে করানো হয়েছে যে, ১৯১৭ সালের অগাস্টে কেন্দ্রীয় কমিটির একমাত্র নারী সদস্য তিনি। তিনিই প্রথম সোভিয়েত সরকারের সমাজকল্যাণ কমিসার। তাঁকে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নারী আন্দোলনের এমন একজন অগ্রণী নেত্রী হিসেবে চেনানো হয়েছে, যিনি কিছুদিন সোভিয়েত রাশিয়ার কেন্দ্রীয় মহিলা বিভাগের ('ঝেনোৎদেল') প্রধানও ছিলেন। তাঁকে নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচিত করানো হয়। অথচ শেষ পদক্ষেপটি প্রকৃতপক্ষে তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে নীরব করে দেওয়া ও তাঁর রাজনৈতিক পতনের ইঙ্গিত দেয়। লেনিনের লেখা ‘অন দ্য ইমানসিপেশন অফ উইমেন’ (১৯৬৫) নিবন্ধে তাঁর ‘কমরেড-ইন-আর্মস’ ও সফল কমিসারের উল্লেখ নেই, তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর  দেওয়া তো দূরস্থান। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে কোলোনতাই-এর লেখাপত্র ‘নির্বাচিত বক্তৃতা এবং নিবন্ধ’ নামে প্রকাশ পায়—  তা একটি পাতলা ভলিউমের মধ্যে সীমাবদ্ধ [প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো (১৯৮৪)]। সেই ‘নির্বাচিত’ রচনাসংকলন এমন ভাবে নির্বাচিত, যাতে কোলোনতাইয়ের একটি অ-বিতর্কিত মূর্তি উপস্থাপিত করা যায়, যা  নিয়ে অফিসিয়াল পার্টি আপত্তি করবে না। সরকারি বাছাইপর্ব অস্বস্তিকর দিকগুলি ধরে রাখে না, যেমন দলীয় অবস্থানের প্রতি তাঁর বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মুহূর্ত, পার্টির অভ্যন্তরে তাঁর প্রথমদিকের সংগ্রাম, শেষদিকের নিস্তব্ধতা।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তি এবং শ্রমিকদের বিরোধী-দলে অংশগ্রহণের বিষয়ে (ওয়ার্কার্স ইউনাইটেড) একসময় কোলোনতাই আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় অবস্থানের বিরোধিতা করেছিলেন (শেষটির ব্যাপারে পরের পর্বে বলা হবে বিশদে)।  তবে 'নারীপ্রশ্ন' নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল তাঁর প্রতি ধেয়ে আসা উষ্মা ও সমালোচনার অন্যতম প্রধান কারণ।

বুর্জোয়া নারী আন্দোলনের শ্রেণী-প্রকৃতি যে শ্রমজীবী নারীদের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়, একথা কোলোনতাই বারবার বলেন, কিন্তু দল ও সরকারের পুরুষ ও পিতৃতান্ত্রিকতা নিয়ে বড় একটা বলেননি। তাও কেন এ নির্বাসন? বস্তুত, শুরু থেকেই, পার্টির মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত মহিলাদল গড়ে তোলার প্রচেষ্টার জন্য এবং ‘নব্য নৈতিকতা’’ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি যথেষ্ট সমালোচনা এবং প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর লেখায় পুরুষ কমরেডদের প্রতি মৃদু অনুযোগ, তাঁর গল্পের কমরেড পুরুষদের চরিত্র বিশ্লেষণ ও সমসায়মিক ইতিহাস থেকে এইসব আভাস পাওয় যায়। তা পড়া যায়। সরকারের আধিকারিক এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে তিনি পার্টি/সরকারের স্পষ্ট সমালোচনা করতে পারছেন না। বলশেভিক পার্টিকে প্রথমে জারের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল, তারপর বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে। আর পার্টির মধ্যে নারীদের একটা আলাদা সংগ্রাম ছিল। সমাজ, দল ও রাষ্ট্রে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রথার বিরুদ্ধেও লড়ছিল। তাঁর সময়ের মার্কসবাদী নারীবাদ (বলা ভাল, মার্ক্সবাদের আলোকে নারীপ্রশ্ন) এঙ্গেলস এবং বেবেলের নারী নিপীড়নের উপরেই নির্ভরশীল। সেই ঘরানার ইতিহাস-বিশ্লেষণকেই আরেকটু প্রসারিত করার চেষ্টা হচ্ছে খাপছাড়া, কিন্তু তত্ত্ব ও অনুশীলন উভয় ক্ষেত্রেই ভাবনার অপ্রতুলতা দেখা যাচ্ছে।

ঝেনেৎদেল:

'ঝেনোৎদেল' ছিল রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে নারীদের একটি স্বায়ত্তশাসিত  শাখা। 'রাবনিতসা' বা 'নারী কর্মী' নামের এক পৃথক কাগজও তারা চালাত।  দলের অন্য কাগজগুলিতে নারী সম্পর্কিত বিশেষ পৃষ্ঠা ছিল।  নারীদের বিষয় উত্থাপনের স্পেস যান্ত্রিকভাবেই, আপনা-আপনিই কিন্তু তৈরি হয়ে যায়নি ‘দুনিয়া-কাঁপানো দশদিনের’ পর। এসব আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই-এর মতো বিপ্লবী নারীদের ক্রমাগত এবং কঠিন সংগ্রামের ফল। বলশেভিক বিপ্লবের পথিকৃৎরা নারীদের গণসংহতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার অনেক আগেই নারীরা কৃষক বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। অভিজাত হয়েও কৃষক আন্দোলনের কর্মী হয়েছিলেন ভেরা ফিগনার এবং লেশর্ন বোনরা, যাদের কথা তুর্গেনেভ তার বিখ্যাত কবিতা 'অন দ্য থ্রেশহোল্ড'-এ লিখেছিলেন। উনিশ শতকের শেষভাগে কারখানা ধর্মঘটেও প্রলেতারিয়ান নারীদের সঙ্গে অভিজাত নারীরা  জড়িয়ে পড়েন। এরপর মার্ক্সিস্টরা আবির্ভূত হলেন। অন্যান্য সামাজিক নিপীড়নের সঙ্গে নারী-নিপীড়নকে সংযুক্ত করা এবং শোষণের নির্ধারক কারণ হিসেবে অর্থনীতিকে চিহ্নিত করা মার্কসবাদীদের উল্লেখযোগ্য অবদান। কিন্তু নারী-নিপীড়নের যৌন, মনস্তাত্ত্বিক, পারিবারিক ভাবধারাগত দিকগুলির বিশ্লেষণ তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। নারীজীবনের এই দৈনন্দিন বাস্তবতাগুলোর তত্ত্বায়ন করতেন রাডিকাল ফেমিনিস্টরা। তাঁরাই আনেন পিতৃতন্ত্রের তত্ত্ব, যা নারী নির্যাতনের বহুমুখী প্রকৃতি বোঝার একটি তাত্ত্বিক কাঠামো দেয়।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে মার্কসবাদীরা যৌনতা, বিবাহ, পরিবার সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে প্রায়শই গৌণ ভাবে, যা অর্থনৈতিক কাঠামোর রূপান্তরের পরেই সমাধান করা যেতে পারে। কোলোনতাই  এই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সময়কালে নারীজীবনের সাইকোসেক্সুয়াল অবদমনের দিকগুলির উপর লেখার কুণ্ঠাহীন সাহস দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে সরকারের সদস্য হিসেবে তিনি বেশ কিছু বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, যেখানে তিনি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক-কে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন।

মার্কসবাদী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে শ্রমিকের নিপীড়ন নারী-নিপীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমত, তিনি শ্রমের মার্কসবাদী ধারণা প্রয়োগ করে বলেন যে মানুষের অস্তিত্বের সারমর্ম হল তার সৃজনশীলতার ও তার শ্রমক্ষমতার সঙ্গে প্রকৃতির মিথোষ্ক্রিয়া। অতএব, যে ভূমিকা একজন নারীকে তার শ্রমের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তা নিপীড়নমূলক। এই সাধারণ সূত্র  মা, গৃহিণী থেকে পতিতা, সকলের নিপীড়ন বিশ্লেষণ করতে ব্যবহৃত হতে পারে। ব্যক্তির শ্রমের অধিকার রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গে জড়িত।  সোভিয়েত অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের জন্য নারী-পুরুষ সবার শ্রমকেই কাজে লাগাতে হবে, এই ছিল যুক্তি।

 

মাতৃত্ব:

সমাজকল্যাণ কমিশনার হিসাবে, কোলোনতাই এবার মাতৃত্বের ক্ষেত্রে তাঁর তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, সন্তানের জন্মদান এবং লালনপালন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দায় নয়। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অতএব সোভিয়েত রাষ্ট্র নারীকে 'মাতৃত্বের বোঝা' থেকে মুক্তি দিতে উদ্যোগী হল। ডিক্রি পাস করা হয়েছিল, যাতে রাষ্ট্র ও সমাজ একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলে যাতে সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালনে মায়ের ভার লাঘব হয়। ক্রেস, যৌথ  রান্নাঘর, কর্মক্ষেত্রে নার্সারি, গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পরামর্শ কেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল প্রসূতির স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং সন্তানের লালন-পালন। মা নিজের যত্ন নেবেন এবং রাষ্ট্রপ্রদত্ত অনুকূল পরিস্থিতিতে একটি 'সুস্থ শিশু' জন্ম দেবেন, এই ছিল কোলোনতাইয়ের স্বপ্ন। উল্লেখ্য, অবিবাহিত এবং বিবাহিত উভয় মহিলাদের জন্য মাতৃত্বের বিধান একই ছিল।

জন্মদানকে প্রতিপালনের থেকে আলাদা করা হয়েছিল, কারণ সমাজকল্যাণ কমিশনার কোলোনতাই দাবি করেছিলেন যে, ‘মাতৃত্ব মানে মায়ের সবসময় সন্তানের সঙ্গে থাকা বা তার শারীরিক ও নৈতিক শিক্ষার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করা নয়।’ [কোলোনতাই, ১৯৮৪, ১৪৫]।

গর্ভপাতের অনধিকার:

তবে সোভিয়েতের জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যাটি তাঁর মাথায় ছিল। কমিসারের হিসেবে শ্রমশক্তি নিশ্চিত করাও জরুরি ছিল। অতএব তাঁর কাছে মাতৃত্ব জনসংখ্যা জোগানোর 'সামাজিক বাধ্যবাধকতা', (গর্ভপাত সংক্রান্ত ইন্টারভিউতে বলেছেন জন্ম দেওয়া নারীর ‘সোশাল অব্লিগেশন’)। তাই মায়ের ভারমুক্তির ও সুস্থ শ্রমশক্তির জন্ম-প্রতিপালনের ব্যবস্থাও সমাজকেই করতে হবে। কিন্তু সন্তানের গর্ভপাতে নারীর এজেন্সি এই বোঝাপড়ার মধ্যে স্থান পায় না। বস্তুত  ১৯২০ সালে গর্ভপাত অনুমোদিত হলেও ১৯৩৬ সালে অনুমোদন তুলে নেওয়া হয় (যদি না ভ্রুণ অসুস্থ, বিকৃত বা মায়ের পক্ষে ক্ষতিকর হয়)।

উপরিউক্ত ইন্টারভিউতে কোলোনতাই আরও বলেন, নারীর সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে দুই ভূমিকা: ১) সক্রিয় নাগরিকের ২) সন্তান-উৎপাদকের। স্বাস্থ্যহানি ছাড়া অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত খারিজ করার সময় নারীর অধিকার নিয়ে কম আর রাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন কোলোনতাই, বোঝা যায়। একাজ করতে গিয়ে তিনি মা এবং শিশুর সম্পর্ককে মহিমান্বিত করেছেন।

‘নারীর আরেক (দ্বিতীয়) বাধ্যবাধকতা হল তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো, শুধুমাত্র যখন সে এটি করেছে, তখনই নারীর বলার অধিকার রয়েছে যে সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতিপালন সংক্রান্ত অন্যান্য কাজগুলি সম্মিলিতভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে। অবশ্যই মাতৃত্বের প্রবৃত্তি শক্তিশালী এবং এটিকে দমিয়ে রাখার দরকার নেই। কিন্তু কেন এই প্রবৃত্তি সংকীর্ণভাবে নিজের সন্তানের প্রতি ভালবাসা এবং যত্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে?’ (কোলোনতাই, ১৯৮৪: ১৪৪)

সমাজতান্ত্রিক সমাজ এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যেখানে সমস্ত মহিলারা মাতৃত্বকালীন সুবিধাগুলি উপভোগ করবে, সচেতনভাবে নিজেদেরকে সমষ্টির একটি অংশ হিসাবে বিবেচনা করবে এবং অন্য শিশুদের প্রতিও তাদের স্নেহচ্ছায়া প্রসারিত হবে, এই ছিল কোলোনতাইয়ের স্বপ্ন।

গৃহশ্রম:

যদিও শিশুপালনকে সন্তানধারণের থেকে আলাদা করা হয়, তবু পুরুষদের কি রাতারাতি বদলে ফেলা গেছিল? রাষ্ট্র কি যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে পেরেছিল? না পারলে, বাধ্যতামূলক কারখানার শ্রম আর গৃহস্থালির কাজ মিলে, চাপ নিশ্চয় বেড়েছিল মেয়েদের।  কোলোনতাইয়ের শ্রমতত্ত্ব অনুযায়ী গৃহশ্রম অনুৎপাদনশীল, অন্তত পুঁজিবাদী সমাজের প্রেক্ষাপটে। কৃষি অর্থনীতিতে নারী ঝাড়াই-মাড়াই, পশু পরিচর্যা, দুগ্ধদোহন ইত্যাদিও করে। তার তাও কিছু মূল্য আছে কোলোনতাইয়ের চোখে। কিন্তু পুঁজিবাদের অধীনে গৃহকাজ মানে বাড়ি পরিষ্কার, রান্না, ধোয়া-মাজা ও কাপড় কাচা। তিনি মনে করেন এই চারটি কাজ শুধু ক্লান্তিকর, শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ নয়, রাষ্ট্র ও জাতীয় অর্থনীতির পিছনে এর কোনো ভূমিকা নেই। নারীবাদীরা সঠিকভাবেই মার্কসবাদীদের এ প্রসঙ্গে সমালোচনা করেছেন, যেহেতু উৎপাদনশীল শ্রম বলতে তাঁরা বোঝেন শুধু সেই শ্রম যার বিনিময় মূল্য আছে, যা উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে এবং মূলধনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। কোলোনতাইও মার্ক্সের পথই অনুসরণ করেন।  তিনি শোষণমূলক পরিবার-ব্যবস্থাকে বুঝতে ব্যর্থ হন, যে শোষণ স্ত্রীর অবৈতনিক শ্রমের উপর ভিত্তি করে। শ্রম উৎপাদনশীল না অনুৎপাদনশীল তা উৎপাদনের প্রকৃতি নির্ধারণ করে না, বরং উৎপাদনের সম্পর্কই শ্রমের মর্যাদা নির্ধারণ করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে নারীরা অবৈতনিক শ্রম গার্হস্থ্য দাসত্বের সমান। মার্কসবাদীরা গৃহশ্রমকে উৎপাদনশীল ভাবেননি, তার আরেক কারণ এটি যে তাঁরা মনে করেন, পুঁজিবাদের অধীনে পরিবার উৎপাদনশীলই নয়।

এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, কোলোনতাই তাঁর সময়ে গৃহশ্রমে শক্তিক্ষয়কে চিনতে পেরেছিলেন (গার্হস্থ্য শ্রমের মজুরি বিতর্ক ষাটের দশকে সংঘটিত হয়েছিল।) কোলোন্তাই বলেছেন, ‘যদি একজন মহিলাকে হাজার বছর দেওয়া হয়, তবুও তাকে প্রতিদিন নতুন করে শুরু এসব শুরু করতে হবে। সর্বদাই ধুলোর একটি নতুন স্তর সরাতে হবে - ম্যানটেলপিস থেকে, তাঁর স্বামী সর্বদা ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসবেন এবং তাঁর সন্তানরা তাদের জুতোয় কাদা নিয়ে আসবেই।'' [কোলোনতাই : ১৯৭৭,২৫৫]

পুঁজিবাদী সমাজেও ক্রেস, স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, লণ্ড্রি, রেস্তোরাঁ ছিল। কিন্তু সব ধনীদের জন্য। শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য পাবলিক ডাইনিং রুম, কমিউনিটি রান্নাঘর এবং লন্ড্রি খোলার মাধ্যমে এই কাজ থেকে নারীদের ভারমুক্ত করতে চেয়েছেন কোলোনতাই। তিনি শুধু বলেননি ‘সাম্যবাদের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গ্র ঘরের কাজের চারটি বিভাগ বিলুপ্ত হবে বলে মনে করা হয়’ (কোলোনতাই, ১৯৭৭, ২৫৫), তার বাস্তব চেষ্টাও করেন।

যৌন সম্পর্ক এবং কমিউনিস্ট নৈতিকতা:

পরিবারই পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার দেখভাল করত। রাষ্ট্র যখন গৃহস্থালি এবং শিশুর যত্নের কাজগুলি সম্পাদন করল, নারী-পুরুষ উভয়েই যখন রোজগেরে, তখন তাত্ত্বিকভাবে কোলোনতাইয়ের যে সমস্যা সমাধান করা বাকি থাকে, হল দুই লিঙ্গের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক।  কোলোনতাই বলেছেন, বুর্জোয়া ধারণায় তথাকথিত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা যায় না। কিন্তু সমাজের প্রকৃত পুনর্গঠনের জন্য ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলি নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার।

‘কেন এই সত্য উপেক্ষা করা হয় যে ইতিহাস জুড়ে সামাজিক সংগ্রামের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য হল লিঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক এবং নৈতিক কোডের ধরন, যা এই সম্পর্কগুলিকে নির্ধারণ করে, এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ককে চালিত করে?’(কোলোনতাই ১৯৭৭,২৪০)। বিবাহের ইতিহাস অনুসন্ধান করে কোলোনতাই ব্যাখ্যা করেছেন যে, নারী-নিপীড়ন প্রেমের ডিসকোর্সের উপরই ভিত্তি করে সংঘটিত হত, যাকে ন্যায্যতা দিত বিবাহ/পরিবার। বুর্জোয়া প্রেম পরিবারের মধ্যে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নারীর অবিভক্ত ভালবাসা এবং আনুগত্য দাবি করেছিল, অথচ পুরুষরা পতিতাবৃত্তির সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানও বজায় রেখেছিল। (এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য কোলোনতাইয়ের সোভিয়েতে বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ হয়েছিল)। কোলোনতাইয়ের কাছে পুঁজিবাদী সমাজে প্রেমের মতাদর্শ ছিল পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ এবং প্রকৃতিগতভাবে ব্যক্তিবাদী। পুঁজিবাদী সমাজে  আধুনিক মানুষের মনোবিজ্ঞানের দুটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছিলেন। (ক) বিবাহিত সঙ্গীর মালিকানার লোভ এবং (খ) এই বিশ্বাস যে, দুই লিঙ্গ অ-সমকক্ষ। কোলোনতাইয়ের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের একাকীত্ব ব্যক্তিকে ‘অন্য ব্যক্তির মধ্যে নিজের আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক আনন্দ সন্ধান’ করতে বাধ্য করে। (কোলোনতাই ১৯৭৭,২৪০)। নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার তাগিদ এতটাই প্রবল যে অন্যের আত্মার মালিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা নিপীড়ক হয়ে ওঠে।  নারীকে শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, বরং তার নিজের কোনো ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না।

 ‘আমরা একজন নারীকে তার শারীরিক এবং মানসিক অভিজ্ঞতা নির্বিশেষে, ব্যক্তিগত কৃতিত্ব এবং ব্যর্থতার নিরিখে, ব্যক্তিত্ব হিসাবে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত নয়, [এই জায়গায় তিনি সিমোন দি ব্যুভোরের সেকেন্ড সেক্স তত্ত্বের কাছাকাছি পৌঁছন] .. আমরা তাকে কেবল একজন পুরুষের অনুষঙ্গ ভাবি। এই মানুষটি, স্বামী বা প্রেমিক, তার ব্যক্তিত্বের আলো নিক্ষেপ করে। সমাজের দৃষ্টিতে একজন পুরুষের ব্যক্তিত্ব যৌন ক্ষেত্রে তার ক্রিয়াকলাপ থেকে সহজে আলাদা হতে পারে। একজন মহিলার ব্যক্তিত্ব তার যৌন জীবনের পরিপ্রেক্ষিতেই একচেটিয়াভাবে বিচার করা হয়" (কোলোনতাই ১৯৭৭, ২৪৫)।  তিনি আরও বলেন, ‘কেবলমাত্র নারীর অর্থনৈতিক ভূমিকার পরিবর্তন, এবং উৎপাদনে তার স্বাধীন সম্পৃক্ততা, এই ভুল ও কপট ধারণাগুলোকে দুর্বল করে দিতে পারে’(কোলোনতাই:১৯৭৭,২৪৫)  লক্ষণীয়, ‘দুর্বল করে দিতে পারে’ লেখা হল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রাথমিক প্রয়োজন, কিন্তু এটি শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলিকে দুর্বল করবে, নির্মূল করবে না, এটা কি কোলোনতাই বুঝেছিলেন? আরও লক্ষণীয়, পিতৃতন্ত্রের কিছু দায় তিনি বুর্জোয়াতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের উপর চাপালেন, যদিও পরবর্তীতে অবশ্য দেখা গেছে, সেসব পিতৃতান্ত্রিক দোষ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেরও থেকে গেল। 

নতুন সমাজের নৈতিকতা :

নতুন সমাজের জন্য এক নব্য নৈতিকতাও তিনি কল্পনা করার চেষ্টা করেন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া বিভিন্ন ধরণের যৌন সম্পর্কের উত্থান দেখছিল। কমিউনিস্ট নেতারা একে যৌন নৈরাজ্য হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। কোলোনতাই চেয়েছিলেন, শ্রমিক-সমষ্টির  মধ্যে নৈতিকতার প্রশ্নে বিতর্ক ও আলোচনা হোক।  কোলোনতাইয়ের নতুন নৈতিকতা  অনুযায়ী, সোভিয়েত এমন একটি সমাজ হবে যেখানে সম্পর্কে সমতা থাকবে, যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কে স্বাধীনতাই সত্য,  যেখানে কমরেডশিপই অসমতাকে দূর করবে। পুঁজিবাদী সমাজে, বিবাহবহির্ভূত ক্ষণস্থায়ী যৌন মিলন ছিল, কিন্তু তা ছিল  ‘উইংলেস ইরোস’ (সংকুচিত যৌন আকর্ষণ)। নতুন সমষ্টিতে ইরোসে কোন বাধা থাকবে না, কিন্তু তা হবে ‘উইংগড ইরোস’, সংবেদনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকবে যৌন আকর্ষণেও, থাকবে সমতা, অধিকারের পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং কমরেডসুলভ সংবেদনশীলতা:

‘এখন যখন বিপ্লব বিজয়ী প্রমাণিত হয়েছে এবং একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, এবং এখন যখন পুরুষ এবং নারীদের সম্পূর্ণরূপে শোষণ করা বন্ধ করে দিয়েছে, কোমল-পাখাওয়ালা ইরোস ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং তার ন্যায্য স্থান দাবি করতে শুরু করেছে।

…..প্রেমের দেবতার বহু-তারের লিয়ার ডানাহীন ইরোস-এর একঘেয়ে কণ্ঠকে ডুবিয়ে দেয়। পুরুষ এবং নারী এখন শুধুমাত্র যৌন প্রবৃত্তির ক্ষণস্থায়ী তৃপ্তি চায় না, তারা আবার প্রেম অনুভব করতে শুরু করেছে..’

(কোলোনতাই ১৯৭৭,২৪৫)

তিনি আরও বলেন, দম্পতি যদি সমষ্টির স্বার্থ সমুন্নত রাখার কথা না ভোলে, তবে তাদের মধ্যে বন্ধনও দৃঢ় হয় :

‘নতুন এবং সম্মিলিত সমাজে, যেখানে আনন্দময় ঐক্য এবং কমরেডশিপের পটভূমিতে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেখানে ইরোস একটি সম্মানজনক স্থান দখল করবে একটি মানসিক অভিজ্ঞতা হিসেবে মানুষের সুখকে বহুগুণ করে।’

 কোলোনতাইকে প্রায়শই ভুলভাবে  ‘এক গ্লাস জল’ তত্ত্বের জন্য নিন্দা করা হয়, যা যৌনতাকে এক গ্লাস জল পান করার মতো স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করে। এই তত্ত্বের কথা লেনিন ও ক্লারা জেটকিনের কথোপকথনেও আছে (এবং সেখানেও লেনিন কোলোনতাই-এর নাম নেননি)। এর ভিত্তিতেই তাঁর বিরুদ্ধে অবাধ যৌনতা প্রচার এবং যৌন নৈরাজ্যকে আস্কারা দেওয়ার অভিযোগ। অথচ এ তার দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট বিকৃতি। তিনিই বলেছিলেন:

‘আমরা এখানে প্রেমের দ্বৈততার কথা বলছি, ‘ডানাওয়ালা ইরোস’ এর কথা বলছি; এটিকে কেবলমাত্র যৌন সম্পর্কের সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়, যেখানে একজন পুরুষ অনেক নারীর সঙ্গে বা একজন নারী অনেক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে, যে সম্পর্কে কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতি নেই। এর পরিণতি দুর্ভাগ্যজনক এবং ক্ষতিকারক পরিণতি হতে পারে।’

তাঁর নতুন নৈতিকতার ধারণা আসলে সোভিয়েত সমাজে যৌন সংকটের প্রতিক্রিয়া। তিনি যখন বলেছিলেন, ‘নতুন বিশ্বে যৌন সম্পর্কের স্বীকৃত নিয়মগুলি সম্ভবত মুক্ত, স্বাস্থ্যকর এবং প্রাকৃতিক আকর্ষণ (বিকৃতি এবং বাড়াবাড়ি ছাড়া) এবং রূপান্তরিত ইরোসের উপর ভিত্তি করে হবে’, তিখন সোভিয়েত সমাজ তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।  যৌন সম্পর্কের বিষয়ে কোলোনতাই-এর দৃষ্টিভঙ্গি সোভিয়েত পার্টির মধ্যে তাঁর সমালোচনার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।

কেন্দ্রীয় মহিলা বিভাগেও  থেকে তিনি প্রায়শ সমালোচনার সম্মুখীন হতেন। ভিনোগ্রাদস্কায়া নামের এক তরুণী যিনি ওই বিভাগে কাজ করতেন, যিনি কোলোনতাইয়ের প্রবল সমালোচক ছিলেন (১৯৭৭: ২৪০)। অ্যালিক্স হোল্ট লিখেছেন, ‘ভিনোগ্রাদস্কায়া নিজে বোধহয় নিশ্চিত ছিলেন যে মার্কসবাদীরা অযৌন এবং সামাজিক অস্থিরতার সময়ে বহুগামী প্রেম এজেন্ডায় নেই। যে যৌনতা নিজের স্বার্থে, যে যৌনতা সন্তান জন্মের সাথে জড়িত নয়, তার তীব্র নিন্দা করা উচিত।’ ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে কোলোনতাই-এর অপ্রথাগত লেখা সম্পর্কে যদি এই মনোভাব থাকে, তবে সোভিয়েত ইতিহাসের সরকারি রেকর্ড রক্ষকদের স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।

ইওরোপীয় নারীবাদের সেকেন্ড ওয়েভের অনেক আগেই,  শ্রেণি সংগ্রাম এবং সামাজিক পুনর্গঠনের ইস্যুগুলির সঙ্গে সঙ্গে  কোলোনতাই ব্যক্তিগত বিষয়ও উত্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন, যা প্রশংসনীয়। নারীর মনোযৌন বিশ্লেষণ, পিতৃতন্ত্রের সমালোচনার সঙ্গে মার্কসবাদকে মেলানোর প্রাথমিক প্রয়াস— এসবের জন্য কোলোনতাই পাঠযোগ্য। কিন্তু এই অন্তর্দৃষ্টি সত্ত্বেও, মার্কসবাদী কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে, তাঁর ধারণাগুলির পূর্ণ বিকাশ যেন হয়েও হয়নি। তাঁর ‘উৎপাদনশীল শ্রম’-এর সংজ্ঞার সমালোচনা হয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজকল্যাণে নারীদের প্রজননের এজেন্ট বিবেচনা করারও সমালোচনা হয়েছে। নারীর পছন্দ ও অধিকারের ধারণা পর্যাপ্তভাবে প্রতিফলিত হয়নি তাঁর লেখায়।  তাঁর বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতার বোঝাপড়া সোভিয়েত অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার মাপে নিজেকে ছেঁটে নিয়েছিল। তবে এ কথা স্বীকার্য  যে নানারকম প্রান্তিকতা এবং নিপীড়নের প্রেক্ষিতে, নিপীড়িতদের মধ্যে বৃহত্তর জোটের প্রয়োজন আছে। নারী ও শ্রমিকদের নির্যাতনকে মেলানোর চেষ্টা তাই আবার নতুনভাবে হওয়া প্রয়োজন।