আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই, ওয়ার্কাস অপজিশন ও বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার বিতর্কের এক দিক
- 07 January, 2024
- লেখক: শতাব্দী দাশ
কোলোন্তাইকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অন্যস্বরের পাতায় লিখছেন শতাব্দী দাশ। এক একটি সংখ্যায় উঠে আসছে কোলোন্তাইয়ের জীবন, রাজনীতি, দর্শন, নারীভাবনার এক একটি দিক। এটি তৃতীয় নিবন্ধ। এর আগের দুটি লেখার লিংকও এখানে থাকল।
প্রথম নিবন্ধ - রুশ বিপ্লবী, তাত্ত্বিক কোলোন্তাইকে ফিরে দেখা
দ্বিতীয় নিবন্ধ - আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই-এর নারী ভাবনা
লিঙ্গসাম্য প্রশ্নে নানা বিতর্ক কোলোন্তাইয়ের রাজনৈতিক পতনের সূচনাবিন্দু ছিল মাত্র। আসল কারণ সম্ভবত নিহিত ছিল ‘ওয়ার্কারস অপোজিশন’ নামক গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টায়। কমিউনিস্ট দেশে কতটা গণতন্ত্র-চর্চা থাকবে, সে বিতর্কই তাঁর কেরিয়ারের কফিনে শেষ পেরেক। সেই বিতর্ক আজও প্রাসঙ্গিক, সেই বিরোধিতার অধিকার আজও কোন্দল করে অধিকার করে নিতে হয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভিতরে। এইখানে কোলোন্তাইয়ের জীবন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
১৯২০ সালের ডিসেম্বরেও, অসন্তোষ পুষে না রেখে, বরং পার্টির সঙ্গে বিতর্ক করা সম্ভব বলে কোলোন্তাই মনে করতেন। তাতে হয়ত ভবিষ্যত অনিশ্চিত, অদম্য শত্রুতা নিশ্চিত। তবু কথা বলার অবকাশ ছিল বলে তাঁর মনে হয়েছিল। অতএব, রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেই বিরোধী শ্রমিকস্বরের উপস্থিতি নিয়ে তৎকালীন বিতর্কে তিনি নিজেকে জড়ান। সেই সময়, ‘শ্রমিকদের বিরোধী দল’ বা ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’-কে সর্বহারা শ্রেণীর মুখপাত্রের ভূমিকা দেওয়ার হোক, এই দাবি করছিলেন শ্লিয়াপনিকভ, মেদভেদেভ এবং অন্যান্য ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ৷ তাঁরা বলেন, এমন না করা হলে ১৯১৭ সালের প্রোলেতেরিয়তদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি বেইমানি হবে। তখন বলা হয়েছিল, সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ আমলাদের হাতে নয়, সরাসরি শ্রমিক শ্রেণীর হাতে থাকবে। ১৯২০ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে কোলোন্তাই এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দেন, যদিও তিনি নিজে কোনো শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন না। পরে কোলোন্তাইয়ের প্যামফ্লেটই ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশনের’ কার্যসূচি অনেকাংশে নির্দিষ্ট করে।
এ অবশ্যই ঝুঁকির কাজ ছিল। তিনি পার্টির মহিলা ব্যুরো (ঝেনোৎদেল) এর প্রধান হিসাবে তাঁর নিরাপদ কাজকর্ম থেকে মানসিক ভাবে সাময়িক সরে এসে, তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, কলম ও বাগ্মীতা ‘ওয়াকার্স অপোজিশন’-কে দিলেন। তাঁর লেখা Rabochaia oppozitsiia প্যামফ্লেট পার্টি-পরিচালিত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন প্রস্তাবের একটা রূপরেখা দিয়েছিল। এছাড়াও কোলোন্তাই ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পার্টি মিটিংয়ে, মার্চ মাসে দশম কংগ্রেসে এবং পরের বছর একাদশ কংগ্রেসে এ নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। শেষত ১৯২১ সালের জুলাই মাসের কমিন্টার্ন কংগ্রেসে এবং ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারির কমিন্টার্ন এক্সিকিউটিভ কমিটিতেও তিনি আর্জি পেশ করেছিলেন এ বিষয়ে।
কোলোন্তাই দলীয় কোন্দল অপছন্দই করতেন। কিন্তু এটা সত্যি যে ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা শিল্পে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, সর্বহারাদের দ্বারা সংগঠিত কারখানা-কমিটিগুলিকেই শিল্পের পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা। ক্ষমতায় আসার পর কিন্তু লেনিন শিল্প-উন্নয়নের জন্য কঠোর শৃঙ্খলায় গুরুত্ব দেন। কারখানায় সংগঠক হিসেবে তখন একমাত্র বশংবদ পার্টি-ইউনিয়নকেই তাঁর পছন্দ হল। গৃহযুদ্ধের সময় ‘অল রাশিয়ান সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়ন’ হয়ে উঠল প্রধান শ্রমিক সংগঠন।
অন্যান্য কাঠামোতেও কেন্দ্রীকরণ ঘটছিল। নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বাড়িয়ে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে চাইছিল। কিন্তু এরকম কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব-নির্ভরতা তো জারবাদী আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল! বলশেভিকরা তা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। শত্রুবেষ্টিত একটি বিধ্বস্ত দেশে যখন যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে, তখন বলশেভিকরা আদর্শবাদ ভুলে যৌবনে শেখা উপায়গুলির উপরেই বোধহয় নির্ভর করেছিলেন।
কয়েকজন বলশেভিক অবশ্য ছিলেন, যাঁরা কেন্দ্রীকরণে আপত্তি করেছিলেন। ১৯১৯ সালে আমলাতন্ত্রের বৃদ্ধির বিরোধিতা করে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়বাদী’-এর আবির্ভাব হয়। একই সময়ে ট্রেড ইউনিয়নবাদী এ.জি. শ্লিয়াপনিকভ, শ্রম কমিসার এবং পার্টির সংগঠক, ইউনিয়নগুলির স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাতে শুরু করেন। অর্থনীতির উপর ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণের এই দাবি দেখেশুনে, শ্রমিকদেরও বুকে বল বাড়ে। ১৯২০ সালে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়বাদীরা এবং ওয়ার্কার্স অপোজিশনিস্টরা মিলে নবম পার্টি সম্মেলনে একযোগে দলীয় কাঠামোয় গণতন্ত্রীকরণের দাবি জানান।
নবম সম্মেলনে তাঁরা পার্টির অভ্যন্তরে ভিন্নমতের সহনশীলতা, সর্বহারাদের জন্য উন্নত জীবনযাত্রার গ্যারান্টি, পার্টি কমিটির অন্তত অর্ধেক সদস্যপদে সর্বহারাদের রাখার নীতি ইত্যাদি দাবি নিয়ে হাজির হন। তাঁদের ভয় ছিল, বলশেভিকরা অ-শ্রমিকদের একটি আমলাতান্ত্রিক দলে পরিণত হচ্ছে না তো? কোলোন্তাই তাঁদের বাকস্বাধীনতার দাবির সঙ্গে সহমত হন। কুতুজভ কথা বলার পরে, তিনি সংক্ষিপ্তভাবে নবম সম্মেলনে প্রস্তাব দেন যে, এসব নিয়ে পরে আবারও একটি পূর্ণ আলোচনার হোক।
নবম পার্টি সম্মেলনে, নেতারা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু উদ্যোগ কম ছিল, অস্থিরতা অব্যাহত ছিল। কোলোন্তাই আপাতত পার্টির সমালোচনায় কিছুদিন আর সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। বরং তিনি তখন নিজেকে ঝেনোৎদেল-এ নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু আদর্শগতভাবে কোলোন্তাই সবসময় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে অবিশ্বাস করায় বিশ্বাস করতেন, তার রাজনৈতিক রঙ যাই হোক না কেন। অত্যধিক আমলাতান্ত্রিক হওয়ার জন্য যুদ্ধের আগে তিনি জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনা করেছিলেন। ১৯১৭ সালে সমাজ কল্যাণ কমিসার হিসেবে তিনি কর্মচারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁর মন্ত্রণালয়ে ‘সোভিয়েট’ প্রতিষ্ঠা করেন। গৃহযুদ্ধের সময় খাদ্য সরবরাহে শ্রমিকদেরই একচ্ছত্র দায়িত্ব দেওয়া হোক, এই ছিল তাঁর মত৷ কিন্তু এর আগে একবার ‘লেফট অপোজিশন’-এ অংশগ্রহণের জন্য তিনি কয়েক মাসের জন্য দলীয় জীবনের কেন্দ্র থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। তাই আপাতত কথা বাড়াননি।
এদিকে, নবম সম্মেলনের দলীয় গণতন্ত্রের আলোচনা তখন পার্টির মূল মনোযোগ থেকে সরে গেছে। তখন ট্রেড ইউনিয়নের ডিসিপ্লিন প্রশ্নে মূলত আলোচনা চলছে। ট্রটস্কি নভেম্বরে ‘অল রাশিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন কনফারেন্সে’ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সরকারি ইউনিয়ন নিয়ম-শৃংখলা বজায় রেখে শ্রমিকদের দ্বারা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দূরস্থান, তিনি ইউনিয়নের স্বায়ত্তশাসনের সব ধারণা দূর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলপূর্বক তা চালুও করেছিলেন। নভেম্বর এবং ডিসেম্বর জুড়ে ইউনিয়নগুলির সঠিক ভূমিকা, সরকার এবং দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছিল। লেনিন আলোচনাকে নেতৃত্ব কমিটির বৈঠকে সীমাবদ্ধ করতে চাইলেও, পারেননি। পার্টির নিম্ন স্তরেও এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ২৪শে ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটি ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুটিকে সাধারণ আলোচনার জন্য উন্মুক্ত করে। ৩রা জানুয়ারি জিনোভিয়েভের নেতৃত্বে পেত্রোগ্রাদ পার্টি ইউনিয়ন আহ্বান জানায়, আসন্ন দশম পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধিদেরকে ইউনিয়ন প্রশ্নে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হোক। বাকিরা সেই প্রস্তাব মেনে নেন। এইভাবে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে, বলশেভিক ইতিহাসে প্রথম এবং শেষবারের মতো, কমিউনিস্টরা খোলাখুলি নিজস্ব সরকারের সমালোচনা করছিল।
৩০শে ডিসেম্বর, অষ্টম সোভিয়েত কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের একটি কমিউনিস্ট উপদলের বৈঠকে, শ্লিয়াপনিকভ আবার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ পুনর্গঠিত ইউনিয়নের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানান। জানুয়ারী মাসে তিনি তাঁর ধারণাগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন ‘ট্রেড ইউনিয়নের কাজ’ বিবৃতিতে। ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’ বলত, সামরিকীকরণ নয়, গণতন্ত্রীকরণই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণে সাহায্য করবে। গণতন্ত্রীকরণের জন্য ইউনিয়নগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। ইউনিয়ন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ক্রমবর্ধমান আমলাতন্ত্রে মধ্যবিত্তরা প্রভাব বিস্তার করে। অর্থনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইউনিয়নে হস্তান্তর করা হলেই আমলাতন্ত্র ও বুর্জোয়াতন্ত্রের জোড়া কুপ্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তাদের প্রস্তাব ছিল, ‘কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়ন’ পরবর্তী কংগ্রেস সংগঠিত না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতি পরিচালনা করবে।
কোলোন্তাই ‘ট্রেড ইউনিয়নের কাজ’ নামক বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেননি, কিন্তু সেটিকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছিলেন। এটি ছিল অর্থনীতি, ইউনিয়ন এবং সমগ্র সমাজ পুনর্নির্মাণের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রস্তাব। সরকারি আমলাদের পরিবর্তে, পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদকরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে, সমাজতন্ত্র তাদের অভিজ্ঞতায় শক্তিশালী হবে— এর চেয়ে ভাল কী হতে পারে? জানুয়ারির শেষের দিকে, ‘দ্য টাস্কস অফ দ্য ট্রেড ইউনিয়ন’ প্রকাশের পর, কোলোন্তাই এই বিরোধী দলে যোগ দেন।
একদিকে ট্রটস্কি ইউনিয়নগুলি ক্ষমতা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রবাদীরা অভ্যন্তরীণ দলীয় গণতন্ত্রের দাবি তোলেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই বিতর্ক ট্রটস্কি, ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং লেনিনবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল।
তার বিবৃতি ‘দশের প্ল্যাটফর্ম’-এ লেনিন পালটা যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইউনিয়নগুলি ‘কমিউনিজমের স্কুল’ যা অপরিণত জনসাধারণ এবং পার্টির মধ্যে সংযোগসাধন করে। দলের নেতৃত্বে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পরই, শ্রমিকরা শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে। ততদিন পর্যন্ত ইউনিয়নগুলিকেই প্রলেতারিয়েতদের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের উচ্চ উৎপাদনশীলতার খাতিরে শৃংখলাবদ্ধ করতে হবে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক অপব্যবহার থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। ইউনিয়ন হবে সরকারের সামনে শ্রমিক শ্রেণীর উকিল। বেশিরভাগ বলশেভিক নেতারা ইউনিয়নবাদী ছিলেন না৷ তাঁরা চোখ বন্ধ করে পার্টি ও লেনিনে ভরসা করলেন৷ লেনিন বহিরঙ্গে অন্তত বহুপার্টিতন্ত্রের মতো আচরণ করলেন। মানে, লেখালেখি ও বক্তব্যের মাধ্যমে, প্রচারাভিযানের মাধ্যমে সমর্থন বাড়ালেন।
লেনিনের সঙ্গে বিরোধ হবে জেনেও কোলোন্তাই নিজের জায়গায় অটল থাকলেন। ভোটের আগে তাঁর বক্তৃতা শুনে ওয়ার কলেজে ৩০০ ক্যাডেটের মধ্যে ২৫০ জন ‘ওয়ার্কার অপোজিশন’-কে সমর্থন করেছিল। এসময় কোলোন্তাই সেই কর্মসূচি নির্ধারক প্যামফ্লেটটি লেখেন। কোলোন্তাই এমন প্যামফ্লেট লিখেছিলেন, যা রাশিয়ার বাইরেও আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্প্রদায়কে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিল।
তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, শ্রমিকদের বিরোধিতা বাস্তব, কারণ সর্বহারা পার্টিতে সে তার প্রবেশাধিকার হারিয়েছে। রাশিয়ার আদিম অর্থনৈতিক অবস্থার জেরে শ্রমিকরা বুর্জোয়া এবং কৃষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়েছিল। যখন তারা সফল হল, তখন মধ্যবিত্তরা আবার আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দখল করলেন। শ্রমিকরা যখন এমন নেতৃত্বের প্রতি অবিশ্বাসী, তখন তারা ইউনিয়নেই আশ্রয় খুঁজবে। কোলোন্তাই দশম কংগ্রেসে বলেন, ‘যদিও পার্টির নেতারা শ্রমিকদের বিরোধিতাকে উপেক্ষাই করেন, তবু এটিই সেই ক্রমবর্ধমান, সুস্থ শ্রেণিশক্তি, যা অর্থনীতিকে এবং খোদ কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। সেই সম্ভাবনা ম্লান হতে দেওয়া উচিত নয়।’’
কোলোন্তাই কমিউনিস্ট ভিত্তিতে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সময়কালে ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভূমিকা এবং কাজ কী হবে, তা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনই ছিল কমিউনিস্ট নির্মাণের ভিত্তি, যা মানবমুক্তি ঘটাবে। তবে, নতুন সমাজ গঠনের জন্য, শ্রমিকদের পুঁজিবাদী সমাজে ব্যবহৃত কৌশলগুলির থেকে ভিন্ন, মৌলিক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল, কারণ পুঁজিবাদী পদ্ধতি সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে পারে না। সমাজতন্ত্র গড়ে উঠবে গণতান্ত্রিক ইউনিয়নগুলিতে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণীর দৈনন্দিন প্রচেষ্টা থেকেম সেটাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি। পার্টি থাকবে অগ্রদূত নয়, বরং অভিভাবক হিসাবে। তাদের কাজ সরকারের তত্ত্বাবধান করা, মার্কসবাদকে ব্যাখ্যা করা। কেন্দ্রীয় কমিটির দায় ব্যবহারিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বলা বাহুল্য, নেতৃত্ব শাসক হিসেবে জনসাধারণকে বিশ্বাস করেনি।
আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কোলোন্তাই ১৯১৯ সালে পার্টির অ-সর্বহারা সদস্যদের বহিষ্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পুনরায় জায়গা পাওয়ার আগে তাদের শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ও কায়িক শ্রম করতে হবে, তিনি বলেন। একই সময়ে, তিনি চেয়েছিলেন, দল সমস্ত অফিসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রয়োগ করবে। সমস্ত প্রধান নীতিগত সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেওয়া হবে। সমালোচনাকে উৎসাহিত করা হবে। কোলোন্তাই ভেবেছিলেন, দলের এই পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রীকরণ পরবর্তী সময়ে আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটাবে।
এই যে জনসাধারণে বিশ্বাস, তা অ্যানার্কিস্ট মার্কসবাদের মূল কথা। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড থেকে ধীরে ধীরে তার গভর্নর এবং শেষত সংরক্ষক হয়ে ওঠা— পার্টির এই পরিবর্তন তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তিনি এই ধারণাই আঁকড়ে ধরেছিলেন যে বলশেভিকরা ১৯১৭ সালের গণপ্রক্রিয়া মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিল। তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, কিন্তু নিজের হাতে বিপ্লব ঘটায়নি। তেমনই তাদের অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে জনগণকে, কিন্তু সমাজতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারাই হবে। এইভাবে, কোলোন্তাই ঠিক ভ্যানগার্ড তত্ত্বের বিরোধিতা করেননি, তবে ভ্যানগার্ড তত্ত্ব যা হয়ে উঠছিল, তার বিরোধিতা করেছিলেন। কোলোন্তাই বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ার অভিযোগ আনেন।
কোলোন্তাই দশম পার্টি কংগ্রেসে ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’-কে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শ্লিয়াপনিকভ এবং মেদভেদেভের সঙ্গেযোগ দেন। ক্রোনস্টাড্ট গ্যারিসনের বিদ্রোহে পার্টির বাইরে অসন্তোষ চরমে উঠেছিল। তার উপর লেনিন আনলেন NEP - নয়া আর্থিক নীতি। আর আনলেন উপদলবাদকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব। NEP কৃষকদের উপর দাবিদাওয়া কমিয়ে অর্থনীতির পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। ‘দলীয় ঐক্যের রেজোলিউশন’ বহিষ্কারের শাস্তির ভয় দেখিয়ে উপদলীয় কার্যকলাপকে নিষিদ্ধ করে দিল। ‘পার্টিতে সিন্ডিকালিজম এবং নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতি সংক্রান্ত রেজোলিউশন’ বিশেষভাবে ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশনের’ নিন্দা করল।
কোলোন্তাই কংগ্রেসে দুবার বক্তৃতা করেছিলেন। উভয়বারই তিনি তাঁর দাবির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন: পার্টি সর্বহারা শ্রেণীর সাথে তার সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করুক। দ্বিতীয় বক্তৃতার আবেগঘন উপসংহারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আবারও বলছি, যখনই প্রয়োজন হবে, তখন আমরা পার্টিকে সমর্থন করব এবং কমিউনিজমের নামে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক বিপ্লবের নামে, আমাদের দায়িত্ব পালন করব।’
অন্যদিকে কংগ্রেসেই লেনিন উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি এবং শ্লিয়াপনিকভ নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা। কোলোন্তাই তখন ডাইবেনকোর সঙ্গে বিবাহিত। এই ব্যভিচারের প্রকাশ্য অভিযোগ অহেতুক, অপ্রাসঙ্গিক এবং অশোভন ছিল না কি? লেনিন ও কোলোন্তাই ১৯১৪ সাল থেকে সহকর্মী। বলশেভিকদের মধ্যে কোলোন্তাই একাই ‘দি এপ্রিল থিসিস’’ সমর্থন করেছিলেন। স্পষ্টতই, সহকর্মীর থেকে এমন ব্যবহার তিনি আশা করেননি। অবশ্য তিনি ১৯১৬ সাল থেকে বুখারিনের সাথে কাজ করেছিলেন, তবুও কি তিনি তাঁকে একজন আবেগপ্রবণ নারীবাদী বলে উল্লেখ করেননি?
তিনি ঝেনোৎদেলে ফিরে আসেন। তাঁর লেখায় তিনি শুধুমাত্র নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রেই এরপর ইউনিয়নের কথা উল্লেখ করেছেন কিছুদিন। কিন্তু অন্যদের ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পটি বজায় থাকে। মে মাসে মেটাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে শ্লিয়াপনিকভের কমরেডরা কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবিত প্রার্থীদের অমান্য করে তাদের নিজস্ব প্রার্থী নির্বাচন করে। দলের নেতারা ইউনিয়নের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দলের মনোনীত প্রার্থীদের অফিসে বসিয়ে দেয়। ক্ষুব্ধ, শ্লিয়াপনিকভ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। এদিকে সামারায় ওয়ার্কার্স অপোজিশনের কিছু ক্ষমতা ছিল। তারা লেনিন-সমর্থকদের জেলাছাড়া করে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি দলকে শহরে যেতে হয়েছিল ‘শৃঙ্খলারক্ষা করতে’, অর্থাৎ, ‘ওয়ার্কারস অপোজিশনের’ বিরুদ্ধ অভিযানে লেনিন-সমর্থকদের একত্রিত করতে। অন্যান্য এলাকায় একই ধরনের মারামারি চলতে থাকে।
জুলাই মাসে নির্ধারিত তৃতীয় কমিন্টার্ন কংগ্রেসে, কোণঠাসা ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’ তাদের পরবর্তী প্রকাশ্য প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয়। মুখপাত্র হিসাবে চিত্তাকর্ষক বক্তা কোলোন্তাই-ই সবার পছন্দের। তিনি কৃষক-তোষণকারী এনইপি-বিরোধীও বটে। কোলোন্তাই তাঁদের প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু মনে মনে এতটাই অনিষ্ট আশঙ্কা করেন তিনি যে, বৈঠকের কয়েক সপ্তাহ আগে জার্মান কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির (কেএপিডি) সদস্য বার্নহার্ড রেইচেনবাখকে ‘রাবোচাইয়া অপোজিটসিয়ার’ একটি অনুলিপি দিয়ে যান। এই দলটি কমিন্টার্নে রাশিয়ানদের আধিপত্যের সমালোচনা করেছিল। তাই কোলোন্তাই তাদের সম্ভাব্য মিত্র হিসাবে দেখেছিলেন। তিনি রেইচেনবাচকে বলেছিলেন যে, যদি তাঁকে বক্তৃতার শাস্তি হিসাবে জেলে পাঠানো হয়, তবে প্যামফ্লেটটি যেন নিরাপদে থাকে।
লেনিন, ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, বুখারিন, কামেনেভ, রাইকভ এবং রাদেকের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কোলোন্তাইয়ের জার্মান ভাষার বক্তৃতা ঝলসে ওঠে। তিনি নেপকে ‘পেটি বুর্জোয়াদের জন্য একটি বিশাল ছাড়’ হিসাবে চিহ্নিত করে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি বলেন, নেপ রাশিয়াকে পুঁজিবাদী করে তুলবে। কোলোন্তাই অনুরোধ করেন যে পার্টি যে নেপ নয়, সর্বহারা শ্রেণীর ‘সৃজনশীল শক্তি'-তে ভরসা করে।
কিন্তু রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নীতির সর্বসম্মত অনুমোদনের মধ্য দিয়েই অধিবেশন শেষ হয়। এ পরাজয়টি তত বিধ্বংসী ছিল না যত কোলোন্তাই ভয় পেয়েছিলেন। তিন দিন পরে তিনি মহিলাদের মধ্যে কমিন্টার্নের কাজের আহ্বান জানাতে মঞ্চে ফের আসেন। এই সময় তাঁর বক্তৃতা করতালির মাধ্যমে গৃহীত হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই ট্রটস্কি তাঁকে একান্তে অনুরোধ করেন, জার্মানদের থেকে Rabochaia oppozitsiia ফিরিয়ে আনতে, কারণ বিদেশিদের কাছে রাশিয়ান পার্টির অপমান তিনি চান না। কোলোন্তাই রাজি হন। রেইচেনবাখকে প্যামফ্লেট ফেরত দিতে বলেন। কিন্তু তিনি ইতোমধ্যেই তা বার্লিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সম্ভবত কোলোনতাই যে কোনো মুহূর্তে পার্টিতে আস্থা ফিরে পাবেন ভেবেই। যখন তিনি KAPD-কে জানান যে কোলোন্তাই তাঁর সমালোচনা তুলে নিচ্ছেন, তখন তারা তা ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে Rabochaia oppozitsiia নামক তাদের কাগজে তা প্রকাশ করে দেয়।
আসলে কোলোনতাই মার্চের প্রস্তাব বা জুলাইয়ের প্রতিবাদ ফিরিয়ে নেননি, কেবল রাইচেনবাখ এবং স্ববিরোধী জার্মানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৯২১ সালে ‘ওয়ার্কার্স অপজিশনিস্ট’ হিসাবে আর উপস্থিত হননি, ঝেনোৎদেলেই নিরাপদ কাজ বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্য তখন ঝেনোৎদেলও অস্তিত্বের জন্য লড়ছিল। পার্টি মেয়েদের দলের স্বাধিকারেও বিশ্বাস রাখছিল না।
অন্যদের অবস্থা হয়েছিল আরও শোচনীয়। শ্লিয়াপনিকভকে NEP-এর সমালোচনা করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে প্রায় বহিষ্কার করা হয়েছিল। আলোচনা গোষ্ঠীগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। চিঠি খোলা, টেলিফোন ট্যাপ, কিছুই বাদ যায়নি। ১৯২২ সালের প্রথম দিকে তাঁরা কমিন্টার্নের কাছে আবার অভিযোগ জানায় ‘দ্য পিটিশন অফ দ্য টুয়েন্টি-টু’-এর মাধ্যমে।
কোলোন্তাই পিটিশনের প্রাথমিক স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর এবং তাঁর আজীবনের বন্ধু জোইয়া শাদুরস্কায়ার স্বাক্ষর সহ চব্বিশটি সই জমা পড়ে। আবার তিনি দলীয় ক্ষোভের ঝুঁকি নিচ্ছিলেন, কিন্তু এবার তাঁর হারানোর কিছুই ছিল না। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই তাঁকে ঝেনোৎদেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আবারও রাশিয়ান দলের জয় হল, কারণ কমইন্টার্নের তাকে তিরস্কার করার কোনো ইচ্ছে ছিল না৷ সোভিয়েত রাশিয়া তখন কমইন্টার্নে সর্বশক্তিময়।
১৯২১ সালের ৫ জুলাই, লেনিন কোলোন্তাইকে সতর্ক করেছিলেন যে তিনি যদি বিরোধী হিসাবে আবার মাথা চাড়া দেন, তবে তার পরিণতি ভোগ করবেন। তিনি সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেন। স্তালিন, জারজিনস্কি এবং জিনোভিয়েভের নেতৃত্বে একটি বিশেষ উনিশ সদস্যের কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, শ্লিয়াপনিকভ, মেদভেদেভ এবং কোলোন্তাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে, বিশেষ করে পিটিশনের খসড়া তৈরির জন্য। তাঁর বিরুদ্ধে বুখারিন ও অন্যদের অভিযোগ শোনার পর কোলোন্তাই ২৯ শে মার্চ এক উজ্জ্বল বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
তাঁরা কমিন্টার্নের কাছে আবেদন করতে বাধ্য হয়েছিলন— তিনি বলেছিলেন— কারণ তাঁরা জানতেন, কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁদের সমালোচনা শুনবে না। নেতারা স্বাধীন মতামতকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছেন। কর্মীরা হয় দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বা বিপর্যস্ত হচ্ছেন মানসিক ভাবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ওঁরা চব্বিশজন দশম কংগ্রেস এবং কমিন্টার্ন কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তকে সম্মান করবেন। কিন্তু পাশাপাশি সোভিয়েত জীবনের ঘাটতিগুলির সমালোচনা করতেই থাকবেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘দলের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করা প্রয়োজন যাতে কর্মীদের সরাসরি উদ্যোগ সম্ভব হয়। আমরা পাশে আছি। শ্রমিকদের গণতন্ত্র এবং দলের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার স্বাধীনতার বিষয়ে দশম কংগ্রেসের যা রেজুলেশন, আমরা চাই সেগুলি বাস্তবায়িত হোক। আমরা সেই সবকিছু করব, যাতে শ্রমিকদের গণতন্ত্র কাগজেকলমে বা কথায় সীমাবদ্ধ না হয়, বরং দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা চাই পার্টির কর্মীদের জন্য একটি মৌলিক, প্রধান, অগ্রণী ভূমিকা সুসংহত ভাবে বাস্তবে স্বীকৃত হোক। শ্রমজীবী মানুষের সৃজনশীলতাতেই আমাদের মুক্তি!"
যদিও একাদশ কংগ্রেস তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করেনি, কিন্তু কোলোন্তাই ঝিনোৎদেলে তাঁর কাজ হারিয়েছিলেন এবং তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে এক বন্ধ্যা সময় শুরু হয়েছিল। ১৯২২ সালেও ঠিক একই জিনিস হল। বহিষ্কৃত হলেন না। কিন্তু তাঁকে কূটনৈতিক দূত হিসেবে নরওয়েতে পাঠানো হল। কোলোন্তাই জানতেন যে এটি ছদ্মবেশী নির্বাসন। কিন্তু তিনি এই পদ গ্রহণ করলেন। বিদেশে অন্তত তিনি স্বাধীনভাবে নারীমুক্তির কথা লিখতে পারবেন, সেই পুরনো বন্ধুদের দেখতে পাবেন, যাঁদের সঙ্গে বিপ্লবের স্বপ্নালু দিনগুলোতে আলাপ হয়েছিল — এসবই কি ভেবেছিলেন? তিনিও বোধ করি দলীয় রাজনীতির তিক্ত ও নিরর্থক খেয়োখেয়ি থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলেন। আর কখনও তাঁকে দলের প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিরোধিতা করতে দেখা গেল না।
কোলোন্তাই (এবং ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’) ব্যর্থ হয়েছিল। সমালোচকরা বলেন, সম্ভবত রাশিয়ায় স্বৈরাচারী ঐতিহ্য, তার তৎকালীন সংকট, তার মরিয়া দারিদ্র্য এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে গণতন্ত্রের কথা বলা বাস্তবসম্মত ছিল না। কিন্তু ওয়ার্কার্স অপোজিশনিস্টরা ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, যাঁরা স্বপ্ন দেখার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। সমাজতন্ত্র সুন্দর স্বপ্ন ছাড়া আর কী? বিপ্লবও তো এক পরম স্বপ্ন। তাঁরা চেয়েছিলেন, প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও গণতান্ত্রিক কাঠামো থাকুক, দরিদ্রকেও বিশ্বাস করা হোক, সমাজতন্ত্রের নামে স্বপ্ন দেখা চলুক, নিরীক্ষা হোক, উদ্ভাবন হোক। তাঁরা নাকি যথেষ্ট বাস্তববাদী নন। কে জানে! কিন্তু পার্টি, যে কিনা জারতন্ত্রের যুগে স্বৈরাচার, ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ এবং ভয়ের কাল দেখেছে, তার ফলাফল দেখেছে ও ঘৃণা করেছে, সেই পার্টি কেন একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটালো?