রুশ বিপ্লবী, তাত্ত্বিক কোলোন্তাইকে ফিরে দেখা

কোনো ওয়েব ম্যাগে আলেক্সান্দ্রা কোলোন্তাইকে নিয়ে লিখে ফেলা বড় কথা নয়। জানা আছে, লিখতে হয় মূলত দুটি দিক নিয়ে। লিখতে হয়, সোভিয়েত মন্ত্রীসভার সদস্য কোলোন্তাই গৃহকাজের রাষ্ট্রীয়করণের কী কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন (স্তালিনের সময়ে সেই সব উদ্যোগের ক্ষেত্রে যে 'পুনর্মুষিক ভব' হয়েছিল, তা অনেক সময় অনুল্লিখিত থাকে)। আর সম্পাদকীয় গোঁড়ামি না থাকলে লিখতে হয়, কোলোন্তাই-এর 'মুক্ত প্রেম ও যৌনতার' ধারণা নিয়ে, যাকে সেকালের তত্ত্বজগতে তাঁর নিজস্ব সংযোজন বলা যায়।

কিন্তু নড়েচড়ে বসতে হয়, যখন সম্পাদক বলেন, ফিচারধর্মী লেখা নয়, পুরোপুরি নিবন্ধ চাইছেন তিনি, যেখান থেকে কোলোন্তাইকে সামগ্রিকভাবে জানাবোঝা সম্ভব হবে। তখন আরও অনেক কিছু লিখতে কলম হাঁকপাক করে। আরও অনেক দিক নিয়ে আলোকপাত করার অবকাশ পাওয়া গেল কি? এই যেমন, কোলোন্তাই 'ওয়ার্কারস অপোজিশন'-এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। ওয়ার্কারস অপোজিশন, মানে বলশেভিক পার্টির মধ্যেই বিরুদ্ধস্বরের অস্তিত্ব, যা নিয়ে পার্টি স্বাভাবিক ভাবেই স্বস্তিতে ছিল না। যতই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জিগির তোলা হোক, একপার্টিতন্ত্রে গণতন্ত্র অবদমিত হয়নি সোভিয়েতে, একথা বলা যায় না। বরং উল্টোটাই জানা যায়। নারীর গৃহশ্রম, নারীর মুক্তপ্রেম ছাড়াও, কোলোন্তাই-এর আরেক মাথাব্যথা ছিল, অন্তত প্রথম রাজনৈতিক জীবনে, এই বিরুদ্ধস্বরটি,  গণতান্ত্রিক পরিবেশটি বজায় রাখার চেষ্টা।

আবার কোলোন্তাই-এর একটি সৃষ্টিশীল দিক ছিল। তিনি একাধিক ছোটগল্প ও অন্তত একটি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর ফিকশন তাঁর রাজনীতির কথাই বলে, কখনও হালকাচ্ছলে, কখনও সুতীব্রভাবে। সে দিকটিও অনালোচিত।

আর আলোচনায় আসে না কোলোন্তাইয়ের ক্ষমতাচ্যুতি। স্তালিনের আমলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁকে দেশান্তরে পাঠানো। বহিরঙ্গে তা মর্যাদাপূর্ণ পদে অভিষেক। কিন্তু অন্তরঙ্গে তা নির্বাসনই। কোলোন্তাই যে চাইলে এক হুমকি হয়ে উঠতে পারেন, তা স্তালিন জানতেন। তাই এ ব্যবস্থা। পার্জ-এ যখন নিহত হচ্ছেন একে একে কমরেডরা, এমনকী প্রেমিকরা, তখন কোলোন্তাই বিদেশে। সন্ত্রস্ত এবং আশ্চর্য নিশ্চুপ। কোলোন্তাই হয়ে উঠতে পারতেন কিন্তু হয়ে উঠলেন না বিরোধী স্বর। কোলোন্তাই কেমন ছিলেন এই মর্যাদাপূর্ণ নির্বাসনে? এ আরেক বিরল আলোচিত দিক।

মনে হল, নিবন্ধে অন্তত এই কটি দিক বিশদে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। এক বিরল বিপ্লবী নারীর থেকে কিছু তত্ত্ব ও যাপনের টোটকা জেনে নেওয়া, জেনে নিয়ে অনুকরণ বা অনুসরণ করা যদি লক্ষ্য হয়, তবে এই নিবন্ধ তার জন্য আদর্শপাঠ নয়। বরং ঐতিহাসিক এক সময়খণ্ডে এক পূর্বজার অন্তর্নিহিত ঘাত-প্রতিঘাত, সাফল্য, ব্যর্থতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ, সবই খুঁটিয়ে দেখা গুরুত্বপূর্ণ— নিবন্ধটি এই বিশ্বাস বহন করবে৷ নিজেদের সাফল্য-ব্যর্থতা, দ্বন্দ্ব-দ্বিধা বুঝতে সাহায্য করে যেরকম বহুকৌণিক পাঠ। উপরন্তু, দেখার চোখ বদলায়। কোলোন্তাই আমার কাছে বিশের কোঠায় যা ছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত বা সৌভাগ্যবশত, এখন তা নেই। তখন তিনি ছিলেন বিপ্লবের অগ্নিশিখা। এখন ভালমন্দয় মেশানো মানুষ, যাঁর কীর্তি থেকে শুধু নয়, ব্যর্থতা থেকেও শেখা যায়।

তবে আমি পাঠককে একসাথে ভারাক্রান্ত করতে চাইনি। তাই  সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হল, কোলোন্তাইকে যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হোক, কিন্তু পাঠককে অতিরিক্ত চাপে না ফেলে। অতএব, নভেম্বর মাস থেকে শুরু করে, কোলোন্তাইয়ের একেকটি দিক নিয়ে একেক মাসে লেখা হবে, এমন স্থির হল। আজ ঘট তোলার কাজটি হয়ে থাক।

আলেকজান্দ্রা কোলোন্তাইয়ের জটিল ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও তাত্ত্বিক লেখালেখির সমন্বয়ে তাঁর যে কর্মজীবন, অনেকদিন পর্যন্ত সেসব ছিল সাধারণের অগোচরে। কমিউনিস্ট প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম থেকে তা বাদ যেত ষাট-সত্তর দশকে। আবার মার্কসবাদের সাথে সরাসরি যুক্ত নয় এমন নারীবাদী ঘরানাগুলির কাছেও তাঁর নাম ও কাজ অজানা ছিল অন্তত ষাটের দশক পর্যন্ত। অথচ লেখাগুলি—বিশেষত সোভিয়েত বিপ্লবের প্রথম দিকের বছরগুলিতে যেগুলি লেখা— তা লিঙ্গ এবং শ্রেণির  আন্তঃসম্পর্ক বোঝার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। রোজা লুক্সেমবার্গ ও ক্লারা জেটকিনও যে খুব পড়া হত তা নয়। মার্ক্সিস্ট ক্লাসিকের রচয়িতারা সকলেই প্রায় পুরুষ। কিন্তু কোলোন্তাই পাঠ শুরু হয়েছে আরও পরে। কোলোন্তাইয়ের বেশিরভাগ রাজনৈতিক লেখাই আসলে প্যামফ্লেট, কিংবা সংবাদপত্র প্রকাশিত নিবন্ধ, যা পরে পুস্তকাকারে সংকলিত। তার সঙ্গে মেলানো যায় কিছু চিঠিপত্র ও ডায়রি। আত্মজৈবনিক লেখায় ভরসা করা যায় না, কারণ তাদের উপর একাধিক কলম চালানো হয়েছিল। কোলোন্তাইয়ের মান্য আত্মজীবনী 'এক যৌন স্বাধীন কমিউনিস্ট নারীর আত্মকথা' কোনো এক অনাম্নী নির্দেশে যে বারবার সংশোধন করতে হয়েছিল তাঁকে, বাদ দিতে হয়েছিল অনেক শব্দ ও বাক্য, তার আভাস তিনি নিজেই দিয়েছেন। এমনকী ডায়রির পুনর্লিখনের আভাসও আছে চিঠিপত্রে, যদিও সেগুলি 'অফিশিয়াল অটোবায়োগ্রাফি'-র চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য। আছে দু-তিনটি জীবনীও। যাদের মধ্যে সোভিয়েত জীবনীটি আবারও একমাত্রিক ও ছায়াচ্ছন্ন। প্রথম ইংরেজি জীবনীটি এক বন্ধুর লেখা, তাই প্রগাঢ় প্রশংসায় ভরা। প্রথম বিশ্লেষণাত্মক জীবনী লেখার চেষ্টা মনে হয় করেন ক্যাথি পোর্টার, ১৯৭৯ সালে, কারণ সে ছিল কোলোন্তাইকে পুনরাবিষ্কারের কাল। এই সূত্রে বলে রাখা ভাল যে যেহেতু পশ্চিমা নারীবাদীদের কোলোন্তাই খুব ভালচোখে দেখতেন না, তাই তারাও তাঁকে পড়ার প্রয়োজন দেখতেন না, অন্তত পার্টিতে তিনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত। এর সঙ্গে আরও মেশে সাহিত্যিক কোলোন্তাইয়ের কিছু গল্প-উপন্যাস প্রচেষ্টা, যা কখনও তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাকে স্পষ্ট করে, কখনও আত্মজীবনীর ফাঁকফোকর ভরাট করে দেয়। এই সব মিলে পাঠকের মননে কোলোন্তাই নির্মিত হন।

বলা বাহুল্য, সমসময়ে বা জীবৎকালে কোলোন্তাই ছিলেন চির বহিরাগত। কখনও বহিরাগত বোধ করেছেন পার্টির মধ্যে, যে সোশালিস্ট ডেমোক্র‍্যাটিক ফ্রন্ট ১৯০৫ সাল নাগাদ এমনকী পার্টির মহিলা শাখা গঠন, মেয়েদের আলাদা মিটিং, সবকিছুকেই 'বিরক্তিকর ফেমিনিস্ট প্রভাব' মনে করত। আবার কখনও তিনি বহিরাগত নারীবাদীদের মধ্যে। রাশিয়ায় তখন সাফ্রেজিস্টদের বা ভোটাধিকারের লড়াই চলছে। সে লড়াই জার্মানীতেও চলছে। ক্লারা জেটকিন এবং অন্য নারী কমরেডরা, শোনা যাচ্ছে, নারী ভোটাধিকারের বিরোধিতা করছেন। আজকের দিনে শুনতে অবাক লাগে। তাঁরা এই উইমেন'স ইউনিয়নগুলিতে যাচ্ছেন, কিন্তু সভা ভণ্ডুল করতে। তাঁরা বলছেন, নারী-ভোটাধিকার শ্রমিক-স্বার্থের বিরুদ্ধে। কোলোন্তাইও মনে করছেন, অভিজাত নারীরা ভোটাধিকার পেলে কোনো মঙ্গল হবে না৷ রাশিয়ায় পার্টিতে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে পূর্বের মুসলমান মেয়েদের যে ভোটাধিকার নেই, তার বেলা! ফলস্বরূপ সেকালের নারীবাদীদের দ্বারাও কোলোন্তাই ও তাঁর দলবল ঘৃণিতই হচ্ছেন। এই চিরবহিরাগত অবস্থান কি তাঁকে ক্লান্ত করেছিল? তাই কি তিনি অ-বিরোধী হয়ে পড়েন শেষে?

ষাটের বা সত্তরের দশকে কোলোন্তাইয়ের পুনর্মূল্যায়নে সেই 'বুর্জোয়া ফেমিনিস্ট'-দের কিছু ভূমিকা ছিল, যাঁদের সঙ্গে কোলোন্তাই মোটেই একাত্ম ছিলেন না। বস্তুত, কোনো 'নারীবাদী' আলোচনায় তাঁর নাম আসবে, তা হয়ত কোলোন্তাই কল্পনা করেননি বা চাননি। কমিউনিস্ট মহলে তখন নারীবাদ চরম অ-জনপ্রিয়। ইন্টারসেকশনালিটির ধারণা তখন সুদূর। পরবর্তীকালে কোলোন্তাইয়ের পুনরাবিষ্কারের কারণ বোঝা দুষ্কর নয়৷ সেটা দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়, যখন 'ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক' হল মূলমন্ত্র। অতএব নারীবাদীরা দেখছেন, 'ব্যক্তিগত' নয়, 'সমষ্টি' গুরুত্বপূর্ণ - একথা মনে করেও, এক নারী কীভাবে 'ব্যক্তিগত' বিষয়েও অভিনিবেশ করছেন, করতে বাধ্য হচ্ছেন - তা সে গৃহকর্ম হোক, বা যৌনতা। সমাজবাদীদের কথার যে অংশগুলির সঙ্গে নারীবাদীরা কখনই অসম্মত হবেন না, সেই প্রশ্নাতীত সত্যগুলির একটি হল, নারীদের বৈষম্য, হিংসা ও নির্যাতনের পরিস্থিতি সহ্য করার প্রবণতা পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি কমবে, যদি তারা তাদের সঙ্গীর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর না করে। এই জায়গায় এসে, নারীবাদীদের কোলোন্তাইকে গ্রহণ করতে সমস্যা হয়নি। নারীর সামাজিক লিঙ্গভূমিকা ও কর্মজগতের চাহিদার বৈপরীত্য, বলা বাহুল্য, এক বাস্তব সমস্যা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এবং বিংশ শতাব্দী জুড়ে, বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘরানা তার বিভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করেছে। বলশেভিক সমাধানটি অনেকখানিই কোলোন্তাইয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। তা একটি ত্রিমুখী পদ্ধতি: শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ, মাতৃত্বকে ঢালাও অধিকারে সজ্জিত করা এবং গৃহশ্রমের অবসান। কোলোন্তাই অবশ্যই এঙ্গেলস আর বেবেলের ছাত্রী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার নারীর দুর্গতির কারণ। কিন্তু এগুলির বিনাশ ঘটলে আপনিই নারীমুক্তি ঘটে যাবে, যা বহুদিন পর্যন্ত কমিউনিস্টদের প্রচলিত লব্জ ছিল, তা তিনি কখনও বলেননি। আর যা যা করণীয় তা তিনি করেছেন সমাজকল্যাণ দপ্তরের কমিশার হিসেবে। মাতৃত্বকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখেছেন। গৃহশ্রমের সামাজিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। কোলোন্তাইয়ের গল্প পড়লে যদিও মনে হয়, মুক্ত যৌনতা করতে চাইলে গর্ভধারণ করা ছাড়া গতি নেই, যা থেকে বোঝা যায় যে গর্ভনিরোধক ততটাও প্রচলিত হুয়নি, তবু সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র প্রথম গর্ভপাতের অধিকার দিয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদকে করেছে সরল ( স্তালিন যুগের উলটপুরাণ পরে আলোচ্য) আরও যা যা ভাবনা, যা কিছু করা যেতে পারে, সেসব তিনি ব্যক্ত করেছেন লেখায়।

কোলোন্তাই সেই সময়ে একটি রাষ্ট্রের মন্ত্রীসভার সদস্য, যখন ইউরোপে রাষ্ট্রের ধারণা সবে গড়ে উঠছে। ১৯১৭ সালে তিনি পিপলস কমিসার অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার হিসাবে তিনি নিযুক্ত হন। প্রথম সোভিয়েত সংবিধানের খসড়ায় তাঁর ভাবনাচিন্তার প্রভাব যথেষ্ট। বিপ্লব সেই মুহূর্তে তাঁর ভূমিকাকে স্বীকৃতিই দিয়েছে। সেই সময়ে পার্টির মধ্যে আদর্শগত বিতর্কের জায়গা কিছুটা হলেও ছিল বলেই মনে হয়। সেই কোলোন্তাই পরবর্তীকালে নিজের দ্বারা প্রবর্তিত সব আইন বাতিল হতে দেখেছেন। তা সত্ত্বেও স্তালিনকে সমর্থন করেছেন, হয়ত অস্তিত্বের তাড়নায়। স্তালিনের 'অফিসিয়াল' কমিউনিজম তাঁর পার্টির মধ্যে 'ওয়ার্কার্স অপোজিশন' গঠন, নিউ ইকোনমিক পলিসি (এনইপি) প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর একদা মেনশেভিক ঘনিষ্ঠতাকে কখনই ক্ষমা করেনি। বেঁচে তিনি ছিলেন বটে শারীরিকভাবে। কিন্তু তাঁকে নিষ্প্রভ ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া গিয়েছিল। সেও কি একরকম মৃত্যু নয়?

১৯২২ সালে তাঁকে সোভিয়েত ছাড়তে হচ্ছে। ১৯২১ সালে তিনি অন্তত পাঁচটি বক্তৃতা দিয়েছেন, পার্টি সার্কেলের বাইরে, যেখানে সাধারণ পার্টি-বহির্ভূত মেয়েদের তিনি বোঝাচ্ছেন, সমানতা পেতে গেলে শ্রমশক্তিতে যোগ দিতে হবে। তাই নারী-অধিকার হয়ে যাচ্ছে কাজ করার অধিকারের সমার্থক। তার হাত ধরে আসছে সেন্ট্রাল অফিস অফ মেটারনিটি অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন। অর্থাৎ অনেক কিছুই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের অপমৃত্যু এভাবেই হয়।

বিংশ শতকের শেষ থেকে উদার অর্থনীতির হাওয়া ঢুকে পড়ল আমাদের ভারতে। সারা বিশ্বেও বিশ শতকের শেষ কটি দশক জুড়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ বেড়েছে। যত তা বেড়েছে, তত নারীবাদীরা 'অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা'-র লেবেল সাঁটা ক্যাপিটালিস্ট ঘরানার ফাঁদটিকে চিনতে পেরেছেন। নারীর কাঁধে এখন দ্বিগুণ বোঝা৷ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীসুলভ ভূমিকা পালনের বোঝা তো ছিলই। বয়স পেরোনর আগে মা হতে হবে, সংসার সামলাতে হবে। অন্যদিকে কেরিয়ারে পিছিয়ে গেলেও কেউ ছেড়ে কথা কইবে না, আছে ছাঁটাইয়েরও ভয়। ঠিক সেই সময় কোলোন্তাই—  একদিকে সাহসী আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিকর্মী ও তার্কিক জাঁদরেল রাষ্ট্রনেত্রী, অন্যদিকে মিখাইল বা মিশার মা, যিনি ফিনল্যান্ডে বসবাসকালে রাঁধুনীর অবিবাহজাত পুত্রের নামও রাখেন মিশা ও তাকে সন্তানস্নেহে প্রতিপালন করেন — তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। যিনি মেয়েদের মুক্ত প্রেম ও যৌনতার প্রবক্তা, অথচ যিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের সময় নব নারীর উদয় হয়নি;  তখনও প্রেম ও তজ্জনিত বেদনা এক ব্যাপার ছিল বটে'— তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। যিনি সংসার ফেলে জুরিখে পলিটিকাল ইকনমি শিখতে গেলেন, কিন্তু বরের অন্য কারো সম্পর্ক হল কিনা ভেবে সাধারণ মানবীর মতোই উতলা হলেন, সেই কোলোন্তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।

তাঁর ঘর বাঁচে না। বারবার ভাঙে। শুধু ভ্লাদিমির কোলোন্তাইয়ের সঙ্গে নয়, মাসলভ ও অন্য প্রেমাস্পদ কমরেডদের মধ্যেও তিনি খুঁজে পান না সেই পুরুষকে, যে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিকে সম্মান করবে যৌনবস্তু ভাবার  পাশাপাশি। সে ক্ষোভ প্রকাশ পায় গল্পে, ডায়রিতে। তার প্যামফ্লেটে আসে 'Winged eros'-এর তত্ত্ব। যে প্রেম ডানা ছাঁটে না, যা নিজেই ডানা দেয়। সে প্রেমও কি তাঁর স্বপ্নের 'নব নারী'-দের একান্ত চাওয়া নয়?

তাঁর দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, পথ খোঁজা, খুঁজে পাওয়া, পেয়ে হারানো, সব নিয়েই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।