চৈতন্য সমসাময়িক কবি কঙ্ক ও বাংলার লোকসাহিত্য

চৈতন্য সমসাময়িক কবি কঙ্ক তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যের মুখবন্ধে নিজের জীবনের কথা, নিজের মা-বাবার কথা, চণ্ডাল মা বাবার কথা এবং গুরু ও আশ্রয়দাতা গর্গের কথা লিখে গেছেন। বিদ্যাসুন্দর কাব্য ছাড়াও কবি কঙ্কের জীবন কাহিনি পাওয়া যায় দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকার অষ্টম পালাগান ‘কঙ্ক ও লীলা’তে। এই পালা গানটি দীর্ঘকাল ধরেই মৈমনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একশো বছর আগে এটি প্রকাশিত হলে বৃহত্তর অংশের মানুষের নজরে আসে। ২৩ অঙ্কে বিভক্ত এই পালাটি  শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিকের ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র তৃতীয় খণ্ডে ‘লীলা কন্যা- কবি কঙ্ক পালা’ নামেও প্রকাশিত হয়েছে। পণ্ডিত মহল একমত হয়েছেন যে মৈমনসিংহ গীতিকার বেশিরভাগ পালাগানের কাহিনি স্থানীয় ঘটনার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, যা আজ দুই বাংলার জনজীবনের শিরা উপশিরা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছেছে। লোককবিরা তাঁদের সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে সে কাহিনিকে বুনেছেন আর গায়েনরা নির্দিষ্ট তাল লয় ছন্দে তা পরিবেশন করেছেন। প্রেম, পূজা, দারিদ্র, রূপকথা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে সেকালের বাংলার মৈমনসিংহ জেলাতে যে সাম্প্রদায়িকক বিদ্বেষের বাতাবরণ বর্তমান ছিল তা সাহিত্যে ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয়, ধরা পড়েছে সেযুগে হিন্দুদের বর্ণবৈষম্য ও গোঁড়া ব্রাহ্মণদের প্রতাপের প্রাবল্যও।

কবি কঙ্কের বিদ্যাসুন্দরের মুখবন্ধ ও মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনি থেকে কবি কঙ্কের জীবনবৃত্তান্ত অল্পবিস্তর জানা যায়। মৈমনসিংহ জেলার রাজেশ্বরী নদীর তীরে বিপ্রগ্রামের ব্রাহ্মণ সন্তান কঙ্ক জন্মের ছ’মাস পরেই মা বসুমতীকে হারায়। মায়ের শোকে বাবাও মারা যান কিছুদিন পর। জন্মের পরপরই বাবা মাকে হারিয়েছে বলে সেই ‘খাকুরা’ বা মানুষ খেকো অনাথ শিশুকে ব্রাহ্মণ সমাজ তো দূরের কথা, তথাকথিত উচ্চবর্ণের কেউই লালন পালন করতে এগিয়ে আসেনি। মুরারি নামের এক সহৃদয় চণ্ডাল কঙ্ককে নিজের ঘরে নিয়ে যান। তার স্ত্রী কৌশল্যা সন্তান স্নেহে কঙ্ককে পালন করেন। শূদ্রদম্পতির মানবিকতায় কঙ্ক নতুন করে বাবা মাকে ফিরে পায়। কিন্তু কঙ্কের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মুরারি ‘তেরাখিয়া’ জ্বরে মারা যান। স্বামীর শোকে নিজের প্রতি চরম অবহেলা করে করে কৌশল্যাও কিছুদিন পর দেহত্যাগ করেন। কৌশল্যা মারা যাওয়ার পর কঙ্ক আবারও অনাথ হয়ে পড়ে। এবার কিন্তু গর্গ নামের এক ব্রাহ্মণ সন্তানই কঙ্কর অভিভাকত্বের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। গর্গপণ্ডিত শিষ্যবাড়ি থেকে ফেরার সময় শ্মশানে একলা কেঁদে বেড়াতে থাকা শিশু কঙ্ককে দেখেন। তিনি পাঁচ বছরের কঙ্ককে তুলে নিয়ে আসেন নিজের ঘরে।

গর্গের লীলা নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল, তার স্ত্রী গায়ত্রীদেবী কঙ্ককে পেয়ে নিজের পুত্রের মত স্নেহভরে কোলে তুলে নিয়েছিল। গায়ত্রীদেবী কঙ্ককে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন গোপাল। তাকে তিনি পরম আদরে ক্ষীর- ননী- ছানা খাইয়ে শীতল স্নেহে পালন করতে থাকেন। নতুন করে আবারও বাবা মা পেল শিশুকঙ্ক। ছোটবেলায় গর্গের বাড়িতে কঙ্কের কাজ বলতে ছিল গরু চরানো। এই কঙ্ক ওরফে গোপালের লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে গর্গ দশ বছরে বয়সে তার হতেখড়ি দিয়ে দেয়। তখন থেকেই গরু চরানোর পাশাপাশি কঙ্ক লেখাপড়াতেও মন দিয়েছে। কিন্তু হতভাগা কঙ্কের মাতৃসমা গায়ত্রীদেবীও মারা যান শিতলা রোগে। জন্মের পর কঙ্কের জীবন একাধিকবার থমকে গেছে। বারবার তাঁর আশ্রয়ের বদল হয়। তবে এবার আর আশ্রয় বদলাতে হয়নি। পণ্ডিত গর্গের বাড়ি তার শেষ আশ্রয় হয়। গর্গের আশ্রমে থেকে কঙ্ক বড় হয়েছে। প্রথম থেকেই কঙ্ক শাস্ত্র পাঠে মনোযোগী ছিল। ধীরে ধীরে পুরাণ, সংহিতা, বারোমাস্যা, ফরমায়েসি গানে বিশেষ দক্ষ হয়ে ওঠে, দক্ষ হয়ে ওঠে বাঁশি বাজানোতেও। পণ্ডিত গর্গের মাতৃহীন কন্যা লীলা আর পিতৃমাতৃহীন কঙ্ক এক সঙ্গে বড় হতে থাকে। দুটি কিশোর- কিশোরী একে অন্যের সহমর্মী হয়ে ওঠে, বন্ধু হয়ে ওঠে।

এমন সময় কঙ্কের গরু চরানোর মাঠে পঞ্চপীর নামে একজন সদলবলে উপস্থিত হয়। কাছেই বটগাছের তলায় দরগা স্থাপন করে সেখানেই পীর থাকতে শুরু করে। এই পীর যথেষ্ট জ্ঞানী, উদার, দয়ালু ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল বলে ঐ অঞ্চলের সমস্ত সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রায় সকলেই তার আশির্বাদে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে তাকে সিন্নি দিয়ে যায় কিন্তু “সিন্নির কনিকামাত্র পীর নাহি খায়।/ গরিব দুখীরে সব ডাকিয়া বিলায়।।“

গরু চরানোর মাঠে কঙ্কের বাঁশি শুনে মুগ্ধ হয়ে একদিন তাকে ডেকে পাঠায় পীর। কঙ্ক পীরকে বাঁশি শুনিয়ে, মলুয়ার বারোমাসী গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে। এভাবেই রোজ গরুচড়াতে গিয়ে পীরের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করে কঙ্ক। শেষ পর্যন্ত ‘দীক্ষা লইল কঙ্ক যবন পীরের স্থানে’- কঙ্ক পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গোপনে। মুসলমান গুরুর কাছে দীক্ষা নিলেও সে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে না। ব্রাহ্মণপুত্র কঙ্ক মুসলমান পীরের শিষ্য হয়ে গোপনে পীরের কাছে যাতায়াত শুরু করে কারণ সে জানত তাঁর সমাজ খুব সহজে তা মেনে নেবে না। কিন্তু পীরের কাছে কালাম শিখেছে বলে তার বদনামও হয়, তবু হিন্দু ও মুসলমানের সমস্ত শাস্ত্রপাঠ শেষ করে গুরুকে সন্তুষ্ট করেছে সে। এখানেই কঙ্ক একইসঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষ হয়ে উঠেছে, ধর্মের গণ্ডী অতিক্রম করে সমন্বয়ের ব্যাপ্তিতে পৌঁছেছে। সে তখন একদিকে শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্ত আর অন্যদিকে সত্যপীরের। সে একই মুখে উচ্চারণ করেছে কোরান ও পুরাণ। তার হৃদয়বৃন্তে হিন্দু মুসলমান নামক দুটি কুসুম একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে।

জাতি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর সমাজের জন্য, জনজীবনের জন্য, কঙ্কের মহৎ অবদানের সম্ভাবনা অনুভব করে কঙ্ককে সত্যপীরের পাঁচালী রচনা করতে বলে পীর চলে যায়। কবির ভাষায়-

“সত্যপীরের পাঁচালী, কঙ্কেরে লিখিতে বলি,/ একদিন হৈল অদর্শন।।/ গুরুর আদেশ মানি লিখিয়া পাঁচালী আনি,/ পাঠাইলা দেশে আর বিদেশে।/ কঙ্কের লিখন কথা ব্যক্ত হইল যথা তথা, / দেশ পূর্ণ হৈল তার যশে।।”

গুরুর আদেশেই কঙ্ক সত্যপীরের পাঁচালী রচনা করেন। সেই পাঁচালী দেশ জুড়ে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই খুব জনপ্রিয় হয়। গরু চড়ানো রাখাল কঙ্ক একদিন পীরের আশির্বাদেই কবিকঙ্ক নামে পরিচিত হয়। তত্কালীন সমাজের হিন্দু মুসলমান নামক দুই জলধারা যেন গুরু- শিষ্য নামক এক তরঙ্গে পরিণত হয়।

এদিকে গর্গের কন্যা, কঙ্কের আশৈশব খেলার সাথী লীলার ‘সোনার যৌবন আসি অঙ্গে দেখা দিল’। গর্গের আশ্রমে সহদরের মত বেড়ে ওঠা কঙ্ক ও লীলার সহানুভূতিশীলতা বড় হয়ে প্রেমানুভূতির রূপ নেয়। সেই প্রেম ছিল শ্রদ্ধা, সমানুভূতি আর বন্ধুত্বের মিশ্রিত রূপ। বিদ্যাচর্চার প্রতি অসীম আগ্রহী কঙ্ক গরু চড়ানোর পাশাপাশি সত্যপীরের পাঁচালী ছাড়াও বিদ্যাসুন্দর কাব্য ও মলুয়ার বারোমাসী গান নামে আরো দুটি কাব্য লেখে। কঙ্কের খ্যাতি ও কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেখে গর্গ অত্যন্ত গর্বিত হয়। তাকে সমাজের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের আসরে স্থান দিতে চায়, স্বীকৃতি দিতে চায়। একদল ব্রাহ্মণ তাতে সম্মত হয়। তাদের যুক্তি ছিল কঙ্ক যেহেতু শৈশবে জ্ঞান হবার আগে শুদ্রের ঘরে অন্ন খেয়েছে তাই তার জন্য তাকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু কুচক্রী, কুমতলবি, অনাচারী গোঁড়া হিন্দুর দল যারা সমাজের মাথার উপর বসে সমাজটাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে তারা ততদিনে কঙ্কের খ্যাতিতে ভীত, চিন্তিত, অসন্তুষ্ট। তারা শুদ্রের ঘরে পালিত হওয়ার কারণে তাকে ‘জাতে তোলা’ যাবে না বলে বিধান দেয়। যেন এ সমাজের সকল মানুষের বিধাতা ওরাই। গর্গ ও তার সমর্থকরা এর প্রতিবাদ করলে জোর তর্ক-বিতর্কে শেষে তারা জানিয়ে দেয় কঙ্ককে জাতে তুললে তাদেরকে ছাড়তে হবে। অর্থাৎ যে সমাজে কঙ্ক থাকবে সেই সমাজে তারা থাকবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়।

 “আমরা সম্মত নহি।

 আরো শুন সবে কহি।।

লহ কঙ্কে মোসেরে ছাড়িয়া।।“

আবার বলে-

“জন্মিয়া চণ্ডালের অন্ন খায় যেই জন।

যে তারে সমাজে তুলে নহে সে ব্রাহ্মণ।।“

 কিন্তু গোপনে জল্পনা ও পরিকল্পনা চলতে থাকে। কারো কারো কঙ্কের প্রতি বিরাগ এতটাই তীব্র ছিল যে তার খ্যাতি, যশ ধুলিস্যাৎ করে দিতে চাইল। তারা কঙ্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তারা পীরের কাছে গোপনে দীক্ষা নেওয়ার কথা সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ হিন্দুসমাজকে উত্তপ্ত করে দিতে চাইল আর হিন্দুরাও কঙ্কের লেখা সত্যপীরের পাঁচালী ছিঁড়ে ফেলে, পুড়িয়ে ফেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইল।

 “হিন্দু যত সবে কঙ্কে মোসলমান বলি।

 কেহ ছিঁড়ে কেহ পুড়ে সত্যের পাঁচালী।।

জাতি গেল মোসলমানের পুথি নিয়া ঘরে।

যথাবিধি সবে মিলি প্রায়শ্চিত্ত করে।।“

শুধু তাই নয় কঙ্ক ও লীলার নামে মিথ্যা কলঙ্ক দেয় তারা। কঙ্ককে উপযুক্ত শাস্তি দেবার আকাঙ্ক্ষায় শুদ্ধমতি লীলার চরিত্রেরও দোষ দেয়, অবৈধ সম্পর্কের কলঙ্ক রটায় তারা, যার ফলে কঙ্ক ও লীলার প্রেমেরও মর্মান্তিক পরিণতি হয়। গীতিকার ভাষায়-

 “মদ্য- মাংস খায় সদ্য পাষণ্ড-আচার।

জন্মিয়া ব্রাহ্মণ-কুলে যত কুলাঙ্গার।।

 মিথ্যা বদনাম তারা দিল রটাইয়া।

 কলঙ্কী হইয়াছে লীলা কুল ভাঙ্গাইয়া।।”

গোপনে মুসলমানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার অপরাধে কঙ্কের একমাত্র আশ্রয় কেড়ে নিতে চেয়েছে বলেই গর্গের কাছে অপ্রিয় করে তোলার জন্য এই কলঙ্ক রটায়। সরলমতী গর্গ তাদের কথা বিশ্বাস করে দিশাহারা হয়ে কঙ্ক ও লীলাকে হত্যা করে, পরে আত্মহত্যা করে মারা যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

“কি কলঙ্ক কৈল মোর কহন না যায়।

 কঙ্কেরে মারিয়া পরে মারিব লীলায়।।

 তারপর প্রবেশিয়া জ্বলন্ত আগুনে।

 প্রায়শ্চিত্ত করব নিজে শরীর দহনে।।“

কিন্তু কঙ্কের খাবারে গর্গ বিষ মেশানোর সময় আড়াল থেকে লীলা তা দেখে ফেলে। পরে কঙ্ক এসে সেই খাবার খেতে গেলে লীলা এসে কঙ্ককে খেতে বাধা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে চলে যেতে বলে। সেই বিষ মেশানো খাবার লীলা সরিয়ে রাখলেও সেখান থেকে গর্গের প্রিয় গরু সুরভী খেয়ে মারা যায়। কঙ্ককে হত্যা করার বদলে গর্গ ভাগ্যদোষে গো-হত্যা করে ফেলে। এদিকে লীলা কঙ্ককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলে, চলে যেতে বলে সেই দেশে যে দেশে নেই তার কোনো পরিচিত জন, নেই মা-বাবা- আত্মীয়- স্বজন, নেই মানুষের চক্রান্ত। এমন দেশে গিয়ে নিরাপদে থাকতে বলে। লীলা জানে সমস্ত আশান্তির মূলে তাদের সমাজের পরিচিত মানুষগুলো, যারা নিজেদের প্রয়োজনে সমাজ, ধর্ম, সম্প্রদায় গঠন করছে আর ব্যবহার করছে। এই স্বার্থপর মানুষগুলোই ধর্মকে, শাস্ত্রকে ভুল ব্যাখ্যা করে ইচ্ছামত ব্যবহার করছে। তাই লীলা কঙ্ককে পরিচিত গণ্ডীর বাইরে চলে যেতে বলেছে যেখানে কেউ জানবে না কঙ্ক হিন্দু না মুসলমান, যেখানে কঙ্কের পরিচয় হবে শুধুই মানুষ হিসাবে।

শেষপর্যন্ত কঙ্ক জাতে উঠতে পারে না। হিন্দু সমাজে তার জায়গা হয় না, তাই ‘দেবী’ বলে ডাকা লীলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে শেষ আশ্রয় ছেড়ে, দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে। যাবার আগে শ্রীচৈতন্যদেবকে স্মরণ করে কঙ্ক “প্রভাতে ‘গৌরাঙ্গ’ বলি তেজিলেন ঘর”।

কঙ্ক চলে যাবার পর গর্গ নিজের ভুল বুঝতে পারেন। গো-ঘাতক গর্গ, সুরভীকে হারিয়ে কঙ্কর মত শিষ্যকে হারিয়ে হারাকার করে। সে কুচক্রী, কুমতলবী, স্বার্থপর ব্রাহ্মণের ষড়যন্ত্রকে উপলব্ধি করতে পারে। লীলাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিজের অন্য প্রয়শ্চিত্তের কথা ভাবে এবং শিষ্য বিচিত্র ও মাধবকে বিদেশে পাঠায় কঙ্ককে খুঁজে আনার জন্য। তারা ছ’মাস ধরে পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে অনেক দেশবিদেশ খুঁজে কঙ্ককে না পেয়ে ফিরে আসে। বিচিত্র-মাধব ফিরে এলে গর্গ ও লীলা হতাশ হয়। কঙ্কের জন্য দুশ্চিন্তা করে লীলা এতটায় অসুস্থ হয়ে পড়ে যে গর্গ বিচিত্র আর মাধবকে আর একবার দেশ বিদেশে খুঁজতে পাঠান। কিন্তু এইবার গর্গ উল্লেখ করে দেয়-  

“কিন্তু এক কথা মোর শুন দিয়া মন।

 গৌরাঙ্গের পূর্ণ ভক্ত হয় সেই জন।।

যে দেশে বাজিছে গৌরচরণ- নূপুর।

 সেই পথ ধরি তোমরা যাও ততদূর।।

যে দেশেতে বাজে প্রভুর খোল করতাল।

 হরি নামে কাঁপাইয়া আকাশ পাতাল।

 সেই দেশে কঙ্কর করি অন্বেষণ।

 অবশ্য গৌরাঙ্গ- ভক্তে পাবে দরশন।।

 যে দেশে গাছের পাখী গায় হরিনাম।

নাম-সংকীর্তনে নদী বহে সে উজান।।

 শিষ্য- পদধুলি মেঘে ছাইয়াছে গগন।

 সে দেশে অবশ্য প্রভুর পাবে দরশন।।“

পরে আবারও নানা দেশ ঘুরে কঙ্কর খোঁজ করেও খুঁজে পায়না তারা। এরই মধ্যে লোকমুখে কঙ্কের জলে ডুবে মারা যাবার খবর শুনে লীলা শোকে অনাহারে রুগ্ন হয়ে যায়। কিছুদিন পর কঙ্ককে না পেয়ে মাধবকে আবারও ফিরে আসতে দেখে লীলা আরো হতাশ হয়ে পড়ে। মাধবের কাছেও কঙ্কের জলে ডুবে মারা যাবার কথা শুনে লীলা স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়-  

“বৈকালীর রাঙ্গা ধনু মেঘেতে লুকায়।

দিনে দিনে ক্ষীণ তনু শয্যাতে শুকায়।।

সব আশা মিছারে হইল লীলার প্রাণমাত্র বাকী।

একদিন উইয়া গেল পিঞ্জরের পাখী।।“

ব্রাহ্মণের ষড়যন্ত্র নিরপরাধ লীলাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। লীলাকে দাহ করতে গিয়ে শ্মশানে কঙ্কর সঙ্গে গর্গের দেখা হলে দু’জনে লীলার বিরহে হা- হুতাশ করে। কন্যাহারা শোকাতুর পিতা গর্গ সংসারের প্রতি কেবল আসক্তি হারায় না জীবন দর্শনেও পরিবর্তন আসে তার।

“বোধনে প্রতিমা আমার ডুবাইলাম জলে।

কি কব এ কর্ম্মফল আছিল কপালে।।

আর না ফিরিব ঘরে তোমরা সবে যাও।

শালগ্রাম শিলা যত সায়রে ভাসাও।।

আগুন জ্বালিয়া মোর পুড় গৃহ- বাসা।

আজি হতে সাঙ্গ মোর সংসারের আশা।।“

দেশ ত্যাগ করে বিদেশে চলে যায় কঙ্ক ও গর্গ। সঙ্গে গর্গের আরো পাঁচজন শিষ্যও যায়। এই পালার শেষ দিকের অংশর তিনটি রকমফের মিলেছে, তবু দীনেশচন্দ্র এই কাহিনিকেই মান্যতা দিয়েছেন। অন্য দুটির একটিতে লীলা কঙ্কের বিরহে মারা যায় আর অন্যটিতে কঙ্ক ও লীলার মধুর মিলন হয়।

বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় একই সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাস করা সত্ত্বেও এ দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যেমন প্রায় প্রথার মত লেপ্টে আছে তেমনি বর্ণবৈষম্যও কর্কট রোগের মত জাপটে আছে। কখনো ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির ভেদাভেদ প্রকট হয়েছে তো কখনো বর্ণবৈষম্য প্রকট হয়েছে। বাংলায় একসময় হিন্দু ব্রাহ্মণদের জাত্যাভিমান এতটাই প্রখর ছিল যে তার মাসুল দিতে হয়েছে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের। এমনই কিছু বিদ্বেষমূলক ঘটনা সাহিত্যেও ধরা আছে। তার মধ্যে একটি হল কবি কঙ্কের বিরুদ্ধে গোঁড়া হিন্দুদের ষড়যন্ত্র ও তাঁর রচিত সত্যপীরের পাঁচালী পোড়ানোর ঘটনা। প্রায় পাঁচশো বছর আগে পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলার কবি কঙ্কের ‘সত্যপীরের পাঁচালী’ আগুনে পুড়িয়েছিল গোঁড়া হিন্দুরা। চক্রান্ত এতটা বিস্তারিত ছিল যে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও ঘর থেকে বই বার করে হয় ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে না হয় পুড়িয়ে দিয়েছে। কবি কঙ্ক মুসলমানের কাছে দীক্ষা নেওয়ার অপরাধে গোঁড়া হিন্দুব্রাহ্মণদের কাছে ঘৃণ্য, ব্রাত্য হয়েছে। ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও জন্মের পর শুদ্রের ঘরে পালিত হওয়ার কারণে তাঁকে ‘জাতে উঠতে’ দেওয়া হয়নি। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও সেযুগের পণ্ডিতমহলের একাংশ তাকে সমাসনে বসতে দেয়নি। চক্রান্তের আগুনে তাঁর বইই শুধু নয়, তাঁর শেষ আশ্রয়, কষ্টার্জিত মান, নির্মল প্রেম, বেঁচে থাকার স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছু কুটিল, কুচক্রী ব্রাহ্মণের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত নিরাপরাধী লীলার মৃত্যু হয়েছে। কবি কঙ্ক শুধু সত্যপীরের পাঁচালীর রচয়িতা তাইই নয় তিনি আরো দুটি কাব্যেরও রচয়িতা। বিদ্যাসুন্দর পালা ও মলুয়ার বারোমাসীও তাঁরই রচনা। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গবেষক ও সমালোচক ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি কঙ্কই সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর পালা পূর্ববঙ্গে বসে লিখেছেন।

 

শুধু হিন্দু মুসলমানে বিদ্বেষই নয় বাংলার সমাজে হিন্দুদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ ছিল ভয়ানক প্রখর এ কাহিনি তারই প্রমাণ দেয়। মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যান্য পালাগানের ভূমিকা ও কাহিনি থেকে যতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইঙ্গিত পাওয়া যাক ‘সত্যপীরের পাঁচালী’ পোড়ানোর ঘটনা সাম্প্রদায়িক অসন্তোষকেই প্রকাশ করে। তত্কালীন বাংলায় বিশেষ করে মৈমনসিংহ জেলা ও তার পার্শবর্তী অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক যে ছায় চাপা আগুনের মত ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই তো কঙ্ককে মুসলমান পীরের কাছে গোপনে দীক্ষা নিতে হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার ‘কঙ্ক ও লীলা’ পালা গানের কাহিনির সত্যতা প্রমাণ হয়েছে বহুদিন আগেই। ড শহীদুল্লাহ ও দীনেশচন্দ্র সেনের মতেও কঙ্ক একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। চন্দ্রকুমার দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাহক হিসাবে প্রথম যে কয়েকটি গ্রন্থ উদ্ধার করে দুই দফায় পাঠান তার মধ্যে একটি হল কঙ্কের ‘সত্যপীরের পাঁচালী’।

চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত ১০১৪ ছত্রের ‘কঙ্ক ও লীলা’ পালাগানটির রচয়িতা হিসাবে মোট চারজনের নাম পাওয়া যায়। দামোদর দাস, রঘুসুত, শ্রীনাথ বেনিয়া ও নয়ানচাঁদ ঘোষ। তিনজনের বন্দনা সহ তাদের চারজনের সম্মিলিত রচনা থেকে যা পাওয়া যায় তা আসলে সেযুগের সমাজেরই চিত্র। চারজনের রচনাতে যখন এই কাহিনি উঠে আসছে তখন সে যুগে এমন সামাজিক পরিস্থিতিই যে বর্তমান ছিল, তা অনুমান করা যায়। আর মৈমনসিংহ গীতিকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হল সেযুগের পূর্ববঙ্গের তথা মৈমনসিংহ জেলার হাওর অঞ্চলের সামাজিকচিত্র পরিবেশন।     

‘কঙ্ক ও লীলা’ পালাগান রচয়িতাদের অন্যতম ছিলেন রঘুসুত। রঘুসুত প্রায় ২৫০ বছর আগে জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোণায় কেন্দুয়া থানার আওজিয়া গ্রামের বাসিন্দা রঘুসুত বংশ পরম্পরা গায়েন ছিলেন। রঘুসুতের বংশধর রামমোহন গায়েনের পুত্র শিবু গায়েন ‘কঙ্ক ও লীলা পালা সব চেয়ে ভালো গাইত বলে জানা যায়। তাদের বাড়ি ছিল নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার আওয়াজিয়া গ্রামে। উত্কৃষ্ট পালাগান গাওয়ার জন্য গৌরীপুরের জমিদারের কাছ থেকে পুরস্কার স্বরূপ নিষ্কর জমি পেয়েছিলেন।

পূর্ববঙ্গের বিশিষ্ট কবি কঙ্ক কেন্দুয়ার কাছে রাজেশ্বরী বা রাজী নদীর পাশে যে বিপ্রবর্গে বা বিপ্রগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, দীনেশচন্দ্র সেন দাবি করেছেন এই বিপ্রবর্গের কাছে ধলেশ্বরী বিলের কাছাকাছি পঞ্চপীরের জায়গায় ‘পীরের পাথর’ নামে একটি পাথর আছে। মৈমনসিংহ গীতিকার পীর ঐ স্থানেই আড্ডা বসিয়েছিলেন বলে বিশেষজ্ঞের ধারণা।

দীনেশচন্দ্র কঙ্কের সত্যপীরের পাঁচালী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান গ্রন্থে বলেছেন, “কঙ্কের সত্যপীরের কথা বা বিদ্যাসুন্দর কাব্যের মার্জিত রুচি ও কবিত্ব আমাদিগকে মুগ্ধ করে। এই পুস্তক চৈতন্য দেবের সমসাময়িক এবং…ইহা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বিদ্যাসুন্দর…। সত্যপীরের কাহিনির ভূমিকায় কঙ্ক নিজের জীবনের যে ইতিহাস লিখিয়াছেন, তাহার সহিত রঘুসুত প্রভৃতি কবি রচিত কঙ্ক জীবনের সঙ্গে সকল বিষয়ই ঐক্যদৃষ্ট হয়।“

দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, “কবিকঙ্কের বিদ্যাসুন্দরই বাঙ্গালা ‘বিদ্যাসুন্দর’ গুলির মধ্যে প্রাচীনতম।” প্রাণারাম কবি বিদ্যাসুন্দরের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে নিমৃত্যবাসী কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দরকে আদি বিদ্যাসুন্দর বলেছেন বলে দীনেশচন্দ্র এও বলেছেন যে পূর্ববঙ্গের কবি সম্পর্কে প্রাণারামের ধারণা ছিলনা তাই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কঙ্ক সম্পর্কে ‘বাংলাদেশের জেলা গেজেটিয়ার বৃহত্তর ময়মনসিংহ’ (প্রধান সম্পাদক নুরুল ইসলাম খান, উপনিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সরকারী মুদ্রণালয়, ঢাকা, ১৯৯২, পাতা ৪৪৩) তে বলা হয়েছে, “কবি কঙ্ক রাজেশ্বরী নদীর তীরে কেন্দুয়ার নিকটবর্তী বিপ্রগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্যযুগের একজন প্রখ্যাত কবি। সত্যপীরের পাঁচালী ও বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি তাঁর রচনা বলে কথিত হয়।“

কবি কঙ্কের সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সরাসরি বলেছেন, ‘কঙ্ক ঐতিহাসিক ব্যক্তি’।

 একথা বলা যায় কঙ্ক যেমন ঐতিহাসিক চরিত্র তেমনি কঙ্ক-লীলার কাহিনি বা সত্যপীরের পাঁচালী রচনার কাহিনিও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত। এ থেকে এও অনুমান করা যায় তত্কালীন বঙ্গসমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নির্মম কাঠিণ্যে বলী হয়েছে বহু বাঙালী। বাদ যায়নি পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলাও। এজন্য হয়ত বহু অসহায় হিন্দু আশ্রয় খুঁজেছে অপেক্ষাকৃত উদার ও সাম্যবাদী ইসলাম ধর্মে। মনে রাখতে হবে হিন্দু ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন শুদ্রের বাড়িতে ভাত খাওয়ার বা মুসলমানের কাছে দীক্ষা নেওয়ার অপরাধে ঘর থেকে কঙ্কের পাঁচালী বার করে ছিঁড়ে ফেলেছে কিন্তু গৌরাঙ্গ ভক্ত, হিন্দু কঙ্ক সত্যপীরের পাঁচালী লিখেছে বলে কোনো মুসলমান তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেনি। বরং সমাদর করেছে।

এ সম্পর্কে সুকুমার সেন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ২য় খণ্ডে (পৃ - ৩৯৮) বলেছেন  “বঙ্গে মুসলমান শাসনের শেষের দিকে সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ কাহিনির মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল।” এই বক্তব্যের সত্যতা প্রসঙ্গে কবি কঙ্কের সত্যপীরের কাহিনি দেখে নেওয়া যেতে পারে। যে কাহিনির সংক্ষিপ্তসার দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন তাঁর ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডসে। চন্দ্রকুমার দে কঙ্কের বিদ্যাসুন্দর পালা ও সত্যপীরের পাঁচালী সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন ১৯২১ সালে। দীনেশচন্দ্র সেন তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ না করলেও তাঁর ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস মৈমনসিংহ’ তে ‘সত্যপীরের পাঁচালী’র কাহিনিটি সংক্ষেপে লিখেছেন। সেটি এরকম -

  “বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের নিঃসন্তান রাজা মূল্যবাণ সন্তান লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় অনেক পূজা - অর্চন্‌ জাগযজ্ঞ, উত্সর্গ ও তপোবনবাসী সাধু-সন্ন্যাসীর নিকট বৃথা যাচনা করেছিলেন। দুঃখী নৃপতি অবশেষে মৃগয়ায় যেয়ে গভীর অরণ্যে আকস্মৎ সত্যপীরের সাক্ষাত লাভ করেন। মহান সত্যপীরের দয়ায় রাজা বনমধ্যে এক অনিন্দ্য-সুন্দর সদ্যজাত শিশু পেয়ে মহানন্দে রাজ-পুরীতে নিয়ে আসেন। শিশুটির নাম রাখা হয় সুন্দর। রাজ-পুরীতে প্রত্যাবরতন করে সত্যপীরের পূজা করার প্রতিশ্রূতি নৃপতি বেমালুম বিস্মৃত হন। ফলে, রাজপুত বড়ো হয়ে মৃগয়ায় যেয়ে গহীন অরণ্যে হারিয়ে যায় বনচারী দস্যু রাজকুমারের আশ্ব ও সর্বস্ব নিয়ে যায়। নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব ও  শ্রান্ত রাজপুত অকস্মাৎ অলৌকিক শক্তির অধিকারী সত্যপীরের সাক্ষাত লাভ করে এবং তারই নির্দেশে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে অবশেষে চম্পক নগরে যেয়ে উপস্থিত হয়। চম্পক-রাজ্যের বিদ্যা নামে এক রূপসী কন্যা ছিলো। সুন্দর অজান্তে বিদ্যার মনোরম বাগানে যেয়ে অবিশ্রান্ত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। নিদ্রামগ্ন রাজকুমারকে অবলোকন করে বিদ্যা গভীর প্রেমে নিমজ্জিত হয়-অতঃপর বিদ্যারই অগ্রভূমিকায় উভয়ের মধ্যে গান্ধর্ব বিবাহ ঘটে। তারপর সুন্দর মালিনীর ছদ্মবেশে রাজকুমারীর সুরম্য ভবনে বসবাস শুরু করে। এ-কথা রাজপুরীতে রাষ্ট্র হয়ে গেলে সুন্দর ধৃত হয় কিন্তু সত্যপীরের বরে নির্দোষ প্রতিপন্ন ও বিদ্যার সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়।”

   কঙ্কের সত্যপীরের পাঁচালী হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছিল। “হিন্দু আর মোসলমানে, / সত্যপীরে উভে মানে, / পাঁচালীর হৈল সমাদর।।/ যেই পুজে সত্যপীরে, / কঙ্কের পাঁচালী পড়ে।/ দেশে দেশে কঙ্কের গুন গায়।।“

কঙ্ক তার ব্যক্তিগত জীবন ও কাব্যসাহিত্য উভয়ের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি করেছিলেন। তত্কালীন বাংলার দেব-দেবী পীর-আউলিয়া, সাধু-সন্ন্যাসী ও ফকির-দরবেশ আরাধ্য সমাজে এক অসাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগাতে সক্ষম হয়েছিল তাঁর ‘সত্যপীরের পাঁচালী’। বলা যায় হুসেন শাহী আমলে সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়েছিল। ধর্মীয় সহনশীলতা ও পরস্পরের ধর্মানুভূতির প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলতে সত্যপীরের পাঁচালী খুব ফলপ্রসু ছিল। তুর্কি আক্রমণের পর যেমন বাংলার সাহিত্যে পৌরাণিক দেবদেবী ও লৌকিক দেবদেবীর এক মেলবন্ধন ঘটেছিল মঙ্গলকাব্যে তেমনি হুশেনশাহী আমলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাসের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে এই সত্যপীরের পাঁচালীতে যা বিশ্বসাহিত্যের কাছে বাংলাকে গর্বিত করে। বিভিন্ন কবিদের বিভিন্ন কাহিনির মাধ্যমে সত্যপীর নামক এক বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে একটা বিরাট সাহিত্য- শাখা গড়ে উঠেছিল। ফকিরবেশী মুসলমান দেবতার চরণে শিরনি/সিন্নি দিয়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ ধনসম্পদ লাভ করেছে, নিঃসন্তান ধনকুবের সন্তান ও শান্তি লাভ করেছে এমন কাহিনি সত্যপীরের পাঁচালীতে বার বার লেখা হয়েছে।

কবি কঙ্কের ‘বিদ্যাসুন্দর’ বসুমতী প্রেস প্রকাশ করলেও ‘সত্যপীরের পাঁচালী’র মুদ্রণ সংক্রান্ত কোনও তথ্য পাওয়া যায় নি। ভুবনেশ্বরে উড়িষ্যার রাষ্ট্রীয় যাদুঘরে উড়িয়া লিপিতে লেখা কবি কর্ণের ‘সত্যপীরের পাঁচালী’ নামে যেটি সংরক্ষিত আছে সেটাকেই অনেকে বাংলার কবি কঙ্কের লেখা হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। এই অনুমানের কারণ লীলার মৃত্যুর পর কঙ্ক গৌরাঙ্গের নাম নিয়ে উড়িষ্যায় চৈতন্যদেবের কাছে দীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। তবে বিষয়টি বিতর্কিত। এই পাঁচালিতে বর্ণিত কর্ণের জন্মকথাটি অতিলৌকিক এবং তা কবি কঙ্কের জন্ম বৃত্তান্তের থেকে আলাদা। এই পাঁচালি অনুসারে কবি কর্ণ কুন্তি নামক এক বাদশাহজাদির পুত্র। এই কুন্তি রোজ সকালে কোরান পুরাণ পাঠ করতেন। একদা গঙ্গাস্নান সেরে তিনবার পদ্মফুলের গন্ধ শুঁকে নাকি তিনি গর্ভবতী হন। বলা হয়েছে কবি কর্ণ সেই গর্ভের সন্তান। এর ভাষা বাংলা না ওড়িয়া তাই নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক আছে। উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এটির বিচার বিশ্লেষণ করে একে বাংলা ভাষায় রচিত বলেই দাবি করেন। তবে সকলে তা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। এর ভাষারূপটি এরকম -

"শুন সর্ব বরাদরে প্রভুর কালাম।

নিয়ত হাসিল হয় ফতে হয় কাম।।

ইয়ার পিয়ার ভাই শুন সর্বজন।

সত্যপীর সাহেবের মহিমা বর্ণন।।

আসমানে দিব্যাসনে বসিয়া খুদায় ।

কৌতুক করেন  জনমিয়া দুনিয়ায়।।

পরিশেষে বলা যায় কয়েকশো বছর আগে বাংলার লোককবিরা মুখে মুখে যে পালাগান রচনা করে গেছেন তাতে শুধু নারী- পুরুষের প্রেম বা পার্থিব সুখ- দুঃখের সংকীর্ণতার কথা বর্ণিত হয়নি, তারা পালাগানের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রচলিত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। নিজেদের জ্ঞান আর প্রতিভাকে ভর করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করতে চেয়েছেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম পালা ‘কঙ্ক ও লীলা’।

তথ্যসূত্র -

১। দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ গীতিকা, ১৯২৩, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

২। ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ১ম খণ্ড ও সপ্তম খণ্ড।

৩। কেদারনাথ মজুমদার, মৈমনসিংহের বিবরণ।

৪। স্বপন ধর (সম্পাদিত) জলদ উত্তরকাণ্ড পত্রিকা, (মৈমনসিং হ-গীতিকা শতবর্ষ সংখ্যা), মৈমনসং হ জেলা, ২০২৩।  

৫। সুকুমার সেন - বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। ২য় খণ্ড।

৬। Estern Bengal Ballads Mymensing - Dinesh Chandra sen

 

ময়মনসিংহ গীতিকা সম্পর্কে লেখকের অন্যান্য লেখা -

অন্যস্বর পত্রিকায় প্রকাশিত 

(শিরোনাম এ ক্লিক করলে মূল লেখাটি পড়া যাবে)

বাংলা গীতিকার সুলুকসন্ধান

মৈমনসিংহ গীতিকা : সংগ্রহ ও মুদ্রণের ইতিকথা

প্রথম বাঙালি মহিলা কবি : চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও জীবনকথা

ইতিহাস আড্ডা পোর্টালে প্রকাশিত 

(শিরোনাম এ ক্লিক করলে মূল লেখাটি পড়া যাবে)

মৈমনসিংহ গীতিকার গায়েন সম্প্রদায়