প্রথম বাঙালি মহিলা কবি : চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ও জীবনকথা

কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালাগানটি ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকায় তৃতীয় পালাগান এটি। আমরা জানি বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী এক ভিন্ন স্বাদের রামায়ণ রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। সেই কবি চন্দ্রাবতীর জীবন, বিশেষ করে তাঁর মর্মভেদী প্রেমকাহিনি নয়ানচাঁদ ঘোষের এই পালাগানের বিষয়বস্তু। ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে এটি সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। চন্দ্রকুমার সংগৃহীত পালাটি দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পালাটির ৩৫৪টি ছত্রকে দীনেশচন্দ্র ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছিলেন।

এই পালা গান থেকে জানা যায় চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশী দাস ছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ, ষোড়শ শতাব্দীর মনসা- ভাসান গানের বিখ্যাত গায়ক ও মনসামঙ্গল কাব্যের কবি। তিনি ছিলেন মৈমনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ফুলেশ্বরী নদীর ধারে পাতুয়ারি গ্রামের বাসিন্দা। দ্বিজ বংশীদাসের পিতা ছিলেন যাদবানন্দ আর মা ছিলেন অঞ্জনা। আর চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম সুলোচনা। চন্দ্রাবতীর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী –

“ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী-নদী বহি যায়।

বস্তি যাদবানন্দ করেন তথায়।।

ভট্টাচার্য্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।

বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনী।

ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।

কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছাড়ি যায়।।

দ্বিজ বংশী বড় হৈল মনসার বরে।

ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।

ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।

আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।

ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।

চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।

ভাড়াতে দরিদ্র জ্বালা কষ্টের কাহিনি।

তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।”

দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া চন্দ্রাবতী বিদ্বান পিতার কাছে শিক্ষালাভ করেছেন ছোট থেকেই। দ্বিজ বংশী দাস শুধু বিদ্বানই ছিলেন না, ধার্মিকও ছিলেন। বাড়িতে শিবের পুজো করতেন। রোজ সকালে পুকুর পাড়ে শিবপূজারী দ্বিজ বংশীদাসের পুজোর ফুল তুলতে যেত তাঁর কিশোরী কন্যা চন্দ্রাবতী। সেখানে জয়ানন্দ নামে এক কিশোর তাকে ফুল তুলতে সাহায্য করত। সকাল সন্ধ্যা পুজোর ফুল তুলতে গিয়েই তাদের বন্ধুত্ব, সেখান থেকেই প্রেম। নয়ানচাঁদের বর্ণনা অনুযায়ী –

“চাইরকোনা পুষ্করনির পারে চম্পা নাগেশ্বর।

ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।

আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঔ না নদীর পার।

কি কারণে তুল মালতীর হার।।”

“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।

বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”

 

কাহিনির শুরুতেই মামার বাড়িতে আশ্রিত পিতৃ্মাতৃহীন জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে প্রেমপত্রে আড়াই অক্ষরের প্রেমনিবেদন করে বসে। শুধু তাইই নয় জয়ানন্দ পরে আবারও প্রেমপত্র পাঠায়। সে প্রেমপত্র ছিল গোছানো, সাহিত্যরস সমৃদ্ধ।

“পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।

পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।।”

“যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।

সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।

তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।

সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।

আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া।

দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।

তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দাও ভর।

যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিংকর।।”

প্রথম প্রেমপত্র পেয়ে কিশোরী চন্দ্রাবতীর মন উচাটন হয়। হৃদয়ের পাপড়িগুলো যেন হালকা হাওয়ায় উড়তে থাকে! চন্দ্রাবতীও পিতাকে শিবপুজোর আয়োজনে সাহায্য করে নির্জনে সুযোগ খুঁজে জয়ানন্দের চিঠি পড়তে বসে। তার আবেগ ধরে রাখতে পারেনা। তার দুচোখ বেয়ে জল পড়ে- প্রথম যৌবনে প্রথম প্রেমে পড়ার আবেগে। চন্দ্রবতীও মনের কথা লিখে চিঠির উত্তর দেয়। এভাবেই প্রেমপত্রের মাধ্যমে দুটি হৃদয় কাছাকাছি আসে- চন্দ্রাবতী জয়ানন্দকে স্বামী হিসাবে কামনা করে –

“তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া।

তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া।।

বাড়ীর আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা-মালতী।

জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মতন পতি।।”

জয়ানন্দ এমনিতেই অস্থির, উদ্দাম। ফুল তুলতে গিয়েই ধৈর্য হারিয়ে ডাল ভাঙ্গে- সে চন্দ্রাবতীকে পেতে আর দেরি করতে চায় না। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের প্রেম পরিনতি পেতে চায়। তবে জয়ানন্দের প্রতি চন্দ্রাবতীর গভীর, অনন্ত ও সংযত প্রেম পিতার অনুমতির অপেক্ষা করে -

“ঘরে মোর আছে বাপ আমি কিবা জানি।

 আমি কেমনে দেই উত্তর অবলা কামিনী।।” -

এখানে চন্দ্রাবতীর প্রেমিকাসত্ত্বা ও কন্যাসত্ত্বা সমান ভাবে প্রতিফলিত হয়। সে পিতার অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাই না। মৈমনসিংহ গীতিকার ‘মহুয়া’ পালায় দেখা যায় মহুয়া অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে বিয়ে করেছে। এবিষয়ে মহুয়া অত্যন্ত সাহসী। কিন্তু নয়ানচাঁদ বর্ণীত চন্দ্রাবতী এই মন ও মানসিকতা থেকে বহু দূরে থেকে গিয়েছে। নীরবে মন দিয়েছে জয়ানন্দকে, তবু তার শিক্ষা, তার সংস্কার বিয়ের জন্য পিতার অনুমতি চেয়েছে।

পরে ঘটকের সহযোগিতায় পিতার ইচ্ছাতেই সামাজিক নিয়ম মেনে পঞ্জিকা দেখে পিতৃ্মাতহীন জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর বিয়ের দিন ঠিক হয়। কিন্তু বিয়ের আয়োজনের মধ্যেই জয়ানন্দের মন পরিবর্তিত হয়। এক মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ের প্রতি সে হঠাত্ করেই আকৃ্ষ্ট হয়ে পড়ে -

 “কে তুমি সুন্দরী কন্যা জলের ঘাটে যাও।

আমি অধমের পানে বারেক ফিরে চাও।।

জয়ানন্দ ঐ মেয়েটির প্রতি এতটাই আকৃ্ষ্ট হয় যে চন্দ্রাবতীর কথা সে ভুলে যায়। ভুলে যায় তাদের ফুল তোলার স্মৃতি, ভুলে যায় প্রেম, প্রেমপত্র, বিয়ের আয়োজনের কথা, ভুলে যায় যমপটে আঁকা নানারঙ্গের ছবির মত হৃদয়কাষ্ঠে জড়িয়ে থাকা স্বপ্নের কথা। এদিকে পূর্বনির্দিষ্ট দিনে দ্বিজ বংশীদাসের প্রতিবেশী রমণীরা গান গেয়ে পানে খিল দিয়ে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চন্দ্রাবতীর হৃদয়, আঁচল আর আঙ্গিনা জুড়ে খুশির হাওয়া বয়ে চলে তখনও- । চন্দ্রাবতীর বাড়িতে বিয়ের দিনে, বিয়ের এই আয়োজন চলাকালীন সেই নিদারুন খবর আসে। পাড়া পড়শিরা জানাই জয়ানন্দ ঐ মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করেছে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।

পাড়া- পড়সি কয় “ঠাকুর কইতে না জুয়ায়।

কি দিব কন্যার বিয়া ঘটল বিষম দায়।।

অনাচার কৈল জামাই অতি দুরাচার।

যবনী করিল বিয়া জাতি কৈল মার।।”

লোকশ্রুতি ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় কৈশোরের বন্ধু জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতী পরিবারের মতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু বিবাহের প্রস্তুতি পর্বে জয়ানন্দ এক কাজির কন্যা আশমানির রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে প্রেমপত্র লিখে বসে। সে চিঠি আশমানির কাছেও ছিল প্রেমপত্র। চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের বিয়ের খবর পেয়ে আশমানি বিচলিত হয় এবং সেই চিঠি নিয়ে তার পিতা কাছে অভিযোগ জানায়। কাজির কাছে সে চিঠির সত্যতা স্বীকার করে। জয়ানন্দ আশমানিকে বিয়ে করে। সেই বিয়ের জন্য সে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তার নাম হয়ে যায় জয়নাল।

 চন্দ্রাবতীর শূন্য আঙ্গিনা তখন অশ্রুতে, অপমানে সিক্ত। তার হৃদয় থেকে, আঙ্গিনা থেকে সকল সুখের শীতল হাওয়া সরে গিয়েছে। বিষাদমরুর তপ্ত হাওয়ায় ঝলসে গিয়েছে তার সব স্বপ্ন। সেই ঝলসে যাওয়া স্বপ্নে নতুন করে প্রলেপ দিতে দ্বিজ বংশী দাস মেয়ের জন্য আবার সম্বন্ধ দেখা শুরু করে। এবার জয়ানন্দের চেয়েও ভালো সম্বন্ধ পেতে চায়। দেশ বিদেশ থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এলে বাছাই করতে থাকে। কিন্তু চন্দ্রাবতী অসম্মত হয়। জয়ানন্দের এই চরম আচরণে দুঃখে, অপমানে চন্দ্রাবতী সারাজীবন কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সে পিতাকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়-

সম্বন্ধ আসিল বড় নানা দেশ হইতে।

একে একে বংশীদাস লাগে বিচারিতে।।

… চন্দ্রাবতী বলে “পিতা, মম বাক্য ধর।

জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।

শিবপূজা করি আমি শিব পদে মতি।

দুঃখিনীর কথা রাখো কর অনুমতি।।”

পিতা দ্বিজ বংশীদাস তাঁর সুশিক্ষিত, দৃঢ়চেতা মেয়ের এমন কঠিন সিদ্ধান্তও মেনে নেন। তত্কালীন সমাজের সাধারণ নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারের অভিভাবকের পক্ষে মেয়েকে সারাজীবন কুমারী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটি সহজ ছিল না। কুমারী মেয়েদের জন্য অরক্ষনীয়া শব্দটিও ছিল বেশ প্রচলিত। তবু দ্বিজ বংশী দাস এই কঠিন সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মেয়েকে ভবিষ্যতের পথও দেখিয়েছেন।

“অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।

“শিবপুজা কর আর লেখ রামায়ণে।।”

বলাবাহুল্য দ্বিজ বংশী দাস চন্দ্রাবতীকে তত্কালীন ব্রাহ্মণ্য সমাজের ‘কন্যা’র মত করে পালন করেননি, তাকে লেখা- পড়া শিখিয়েছেন, তিনি তাঁকে প্রকৃ্ত ‘সন্তান’ হিসাবেই পালন করেছিলেন। তাই নির্দ্বিধায় তাঁর সন্তানকে নির্দেশ দিয়েছেন রামায়ণ রচনা করতে। পিতার নির্দেশ পাবার পর চন্দ্রাবতীর জীবনে শুরু হয় অন্য এক অধ্যায়। শুরু হয় সাধনার জীবন -

“নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইয়া মন্দির।

শিবপূজা করে কন্যা মন করি স্থির।।

অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।

যাহারা পড়িলে হয় পাপবিমোচন।।

পাতুয়ারি গ্রামের বাড়িতেই দ্বিজ মাধব একটি শিব মন্দির নির্মান করে দেয় চন্দ্রাবতীকে। সেখানেই শিব পূজা ও অবসরে বিদ্যাচর্চায় মন দেয় সে, সম্পূর্ণ তপস্যীর জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলে।

এদিকে কালের স্রোতে ভেসে গিয়ে হঠাৎ একদিন জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পারে। বিয়ের কিছুদিন পর (২/৩ বছর) তার মোহভঙ্গ হয়। হিন্দু সমাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা জয়ানন্দ মুসলমান সমাজে হাঁপিয়ে ওঠে। ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য নারীকে বিয়ে করে কঠিন জীবনের শিকলে সে নিজেকে বেঁধেছিল সেই শিকল ছিঁড়ে সে নিজেই বেরিয়ে আসতে চায়! রূপের মোহ কেটে গিয়ে তার জীবনে তখন ‘জলে বিষ বাতাসে বিষ’। সে আবারও চন্দ্রাবতীকে চিঠি লেখে অন্তত একবার দেখা করার জন্য।

জয়ানন্দের চিঠি পড়ে চন্দ্রাবতী মন বিচলিত হয়, ছোটবেলার স্মৃতি তাঁকে যেন দুর্বল করতে থাকে… জয়ানন্দকে যেন ক্ষমা করতেও ইচ্ছা হয়! বারবার জয়ানন্দর চিঠি পড়তে থাকে, ঝরে পড়া স্মৃতির পাপড়িগুলো যেন আবার হাওয়ায় দোল খেলতে থাকে। কিন্তু চন্দ্রাবতী এবারেও নিজেকে সংযত করে, তখনও পিতার অনুমতির অপেক্ষা করে। কিন্তু পিতা দ্বিজ বংশী দাস এবার আর অনুমতি দেননি। বলেছেন-

“তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ করো।

 অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।”  

অর্থাৎ চন্দ্রাবতীকে শিবপূজায় মনোনিবেশ করতে আদেশ দেয়। কিন্তু জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা চাইতে ছুটে আসে চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরে। সারারাত মন্দিরের দরজার সামনে চন্দ্রাবতীর জন্য অপেক্ষা করে, অনেক ডাকাডাকি করলেও চন্দ্রাবতী তার মন্দিরের দরজা খোলে নি। তখনও সে পিতার কথা মত শিবের ধ্যান করতে নিজেকে মগ্ন রাখে… মগ্ন রাখে স্মৃতিকে মুছতে…

“কিসের সংসার কিসের বাস কেবা পিতা মাতা।

পূজিতে ভুলিল কন্যা শৈশবের কথা।

জয়ানন্দ ভুলি কন্যা পূজয়ে শঙ্করে।

একমনে ভাবে কন্যা হর বিশ্বেশ্বরে।।

শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।

আসিল পাগল জয়া শিকল ছিড়িয়া।।”

  জয়ানন্দের কর্মফল ভোগ করার সাহসও নেই। সে প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়! নিজেকে চরম পরিনতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। মন্দিরের বাইরে থেকে সারারাত ধরে চন্দ্রাবতীকে ডেকেও সারা না পেয়ে মন্দিরের দরজায় সন্ধ্যা- মালতীর রক্ত- রসে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে যায়…।

“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।

অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।

পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।

বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জন্মের মত।।”

 সকালে মন্দিরের দরজা খুলে সে লেখা দেখতে পায় সাধিকা- চন্দ্রাবতী কিন্তু তাতে জয়ানন্দের প্রতি করুণা হয়না আর বরং মন্দিরের দরজায় মুসলমানের ছোঁয়া লেগেছে বলে সংস্কার বশত মন্দির পবিত্র করার জন্য নদীতে জল আনতে যায়। নদীর ঘাটেই জয়ানন্দের মৃতদেহ ভাসতে দেখে চন্দ্রাবতীও উদাস হয়ে যায়, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জয়ানন্দের দিকে। জয়ানন্দের মৃতদেহ দেখে চন্দ্রাবতীর মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে নয়ানচাঁদ লিখলেন-

  “দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান।

ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নমাসীর চান।।

আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই বাণী।

পারেতে রহিল খাড়া উমেদা রমণী।।” (দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত)”/ খাড়াইয়ে দেখে চন্দ্রা উমেদা রমণী (ক্ষিতীশ মৌলিক সম্পাদিত)”।

  কবি নয়ানচাঁদ শেষাংশেও জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর প্রেমকে অক্ষুন্ন রাখতে চেয়েছেন। বাস্তব ঘটনা বিশিষ্ট এই কাহিনিতে জয়ানন্দকে কবি খলনায়ক করে তোলেননি বরং করুণার উদ্রেক করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এই প্রেম কাহিনিকে এক অপার্থিব প্রেম কাহিনি বলতে চেয়েছেন।

এই প্রেমকাহিনি বহু নাটক, নৃ্ত্যনাট্য, এমনকি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে। কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজনায় পরিচালক স্বপন কুমার সাহা নির্মান করেন কাহিনিচিত্র ‘কবি চন্দ্রাবতী’। বাংলাদেশের পরিচালক এন রশিদ চৌধুরী সম্প্রতি নির্মান করেছেন ‘চন্দ্রাবতী কথা’ কাহিনিচিত্র।

নয়ানচাঁদ ঘোষের চন্দ্রাবতী পালাগান থেকেই চন্দ্রাবতী সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি তথ্য জানা যায়। নয়ানচাঁদ ঘোষ পালাগানটি ঠিক কোন সময় লিখেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে নয়ানচাঁদের সঙ্গে আর যে তিনজন ‘কঙ্ক ও লীলা’ পালা রচনা করেন রঘুসুত তাদের মধ্যে একজন। নয়ানচাঁদ ঘোষের সমসাময়িক কবি এই রঘুসুত আজ থেকে ৩৫০ বছর আগে জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। সেখান থেকে নয়ানচাঁদ ঘোষের জীবনকাল এবং পালাগানটির রচনাকাল সম্পর্কেও আমরা ধারণা পাই।

  নয়ানচাঁদ ঘোষের কাহিনি যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই শুরু হয় চন্দ্রাবতীর জীবনের নতুন অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের আকাশে তাঁর আবির্ভাব হল এক নব নক্ষত্রের আগমনের মত। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে অনেক পুরুষের মাঝে যে মহিলার নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন এই কবি চন্দ্রাবতী। কৃ্ত্তিবাস ওঝা, মাধব কন্দলি, শঙ্কর দেব, নিত্যানন্দ আচার্য, রামশঙ্কর দত্ত, দ্বিজ লক্ষ্মণ নামের সঙ্গে চন্দ্রাবতী নামটি স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একমাত্র মহিলা কবির আখ্যা পেয়েছেন (কোথাও কোথাও নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবী, পদকর্তা যাদবেন্দ্র দাসের পত্নী স্বর্ণলালীর নাম পাওয়া সত্ত্বেও)। সম্পূর্ণ মৌলিক চিন্তা ভাবনায় বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করে সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ জয়গা করে নিয়েছেন। তবে তিনি শুধুই রামায়ণ রচনা করেননি, পিতা দ্বিজ বংশীদাসের মনসা ভাসান বা পদ্মাপুরাণ লেখার সময় তিনি কয়েক পঙক্তি লিখেওছেন। সেই সঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকার মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা ও দস্যু কেনারামের পালাগানও রচনা করেছেন।

   চন্দ্রাবতী ঠিক কোন সময় জীবিত ছিলেন তা নিয়ে সঠিক ভাবে জানা না গেলেও কিছুটা অনুমান করা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। এই চন্দ্রাবতীর পিতা বংশীদাস ১৫৭৫ সালে মনসাভাসান বা পদ্মাপুরাণ রচনা করেন যে রচনায় চন্দ্রাবতীও কাব্য রচনায় হাত পাকান। জানা যায় এই বংশীদাসের “পদ্মাপুরাণ” পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেই কারণেই হয়ত ১৯০৪ সালে ঢাকার পূর্ণচন্দ্র সিংহ কলকাতা থেকে বংশীদাসের “পদ্মাপুরাণ” ছাপা কপি বের করেন, তার আগে বটতলা থেকে এই পদ্মাপুরাণ ছাপা হয়েছে বলেও জানা যায়, আবার ১৩১৮ বঙ্গাব্দে দ্বারকানাথ চক্রবর্তী ও রমানাথ চক্রবর্তীর সম্পাদনা করে দ্বিজ বংশীদাসের (বংশীবদন) এই পদ্মাপুরাণ ছাপান। সেটি মূলত ১৭১৭ শকাব্দের একটি পুথিকে কেন্দ্র করে, সে সঙ্গে আরো কিছু পুথি পাঠ করে তাঁরা সম্পাদনা করেন। এই বইটির “গোত্রবল” এর শেষে কাব্যরচনার তারিখ এইভাবে নির্দেশিত হয়েছে।

“জলধির বামেত ভুবন মাঝে দ্বার।

শকে রচে দ্বিজ বংশী পুরাণ পদ্মার।।”

   এখানে জলধির মানে ৭, ভুবন মানে ১৪, দ্বার ৯ হলে ১৪৯৭ শকাব্দ হয় অর্থাৎ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ। শ্লোকটি অন্য কোনো পুথিতে পাওয়া যায়নি বলে অনেকেই তাকে ষোড়শ শতকের কবি বলে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য”এ বলেছেন-

 “মনসামঙ্গল রচনার সময় চন্দ্রাবতীর বয়ঃক্রম অন্যূন ২৫ বছর ধরিয়া লইলে ১৪৭২ শকে অর্থাৎ ১৫৫০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, এইরূপ নির্দেশ করা যাইতে পারে।“

   এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে চন্দ্রাবতী ১৫৭৫ সালে জীবিত ছিলেন। ১৬০০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে মারা যান। নয়ানচাঁদ ঘোষ যখন গাথাকাব্যটি রচনা করেন তাঁর পঞ্চাশ বছর আগেও চন্দ্রাবতী জীবিত ছিলেন এবং চন্দ্রাবতী নয়ানচাঁদ ঘোষের থেকেও বড় কবি ছিলেন। কবি নয়ানচাঁদের রচনাগুণে চন্দ্রাবতীর প্রেমকাহিনি অমরত্ব লাভ করেছে তাইই নয় চন্দ্রাবতী চরিত্রটিও কিম্বদন্তী হয়ে উঠেছে বাঙ্গালির কাছে। তিনি না লিখলে চন্দ্রাবতীর জীবন-কাহিনি নিশ্চিত কালের গর্ভে ডুবে যেত।

চন্দ্রাবতীর রামায়ণ -

পিতার আদেশে, বলা যায় জীবনের আদেশে কবি চন্দ্রাবতী যে রামায়ণ লিখলেন সেই রামায়ণও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহিলা রচিত রামায়ণ। চন্দ্রাবতী রামায়ণ চন্দ্রকুমার দে ১৯১৪ সালের আগেই সংগ্রহ করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে পূর্ববঙ্গ গীতিকার চতুর্থ খণ্ডে, দ্বিতীয় ভাগে প্রকাশ করেন। সেখানে এই রামায়ণ তৃতীয় খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত পাওয়া যায়। অর্থাৎ চন্দ্রকুমার দে তিনটি খণ্ডের মোট তেরোটি অধ্যায় খুঁজে পেয়েছিলেন। অনেকে এই রামায়ণকে অসম্পূর্ণ রচনা বলেছেন। সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দেরও মনে হয়েছিল ‘চন্দ্রাবতী এই রামায়ণ শেষ করিতে পারেন নাই সীতার বনবাস অবধিই লিখিয়াছেন’। পরে ১৯৬৬ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক এই রামায়ণের আরো কিছু অংশ খুঁজে পান। খুঁজে পান আগের অংশের কিছু বিকল্প রূপও। আচার্য সুনীতি কুমার চট্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক সম্পাদনা সহযোগে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সপ্তম খণ্ডে এই রামায়ণ প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে তৃ্তীয় খন্ডের নবম অধ্যায়ে শেষ হয় যে কাহিনি তাকে পূর্ণাঙ্গ বলা যেতে পারে।

    আয়তনে বাল্মীকি রামায়ণের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ। বাল্মীকির বিশাল সপ্তকাণ্ড রামায়ণের তিনটি কাণ্ড - সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড – যা চন্দ্রাবতী রামায়ণের বিষয়বস্তু - মোট ৩০৭টি সর্গে বিন্যস্ত। সুন্দর কাণ্ডে ৬৮টি, যুদ্ধকাণ্ডে ১২৮টি, উত্তরকাণ্ডে ১১১টি সর্গ আছে। চন্দ্রাবতী রামায়ণ তিনটি খণ্ডে মাত্র উনিশটি অধ্যায়ে রচিত। প্রথম খণ্ডে ৮টি, দ্বিতীয় খণ্ডে ২টি ও তৃ্তীয় খণ্ডে ৯টি অধ্যায় আছে। বাল্মীকি এমনকি কৃত্তিবাসী রামায়ণের বহু কাহিনি বাদ দিয়ে চন্দ্রাবতী নিজের মত করে কাহিনি সাজিয়েছেন ক্ষুদ্র আয়তনে।

তাঁর রামায়ণ প্রথমেই সীতার জন্মবৃত্তান্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, এরপর এসেছে রামের জন্ম, রামসীতার বিবাহ, রামের বনবাস। দ্বিতীয় খণ্ডে শুরু হয়েছে সীতার বারোমাস্যা। দুঃখের বারোমাস্যা বর্ণনার মধ্য দিয়ে রাবণের সীতাহরণ ও অতি অল্পপরিসরে রাম-রাবণের যুদ্ধের কথা পাওয়া যায়। তৃ্তীয় খণ্ডে সীতার বনবাসের পূর্ব সূচনায় রাম অযোধ্যায় ফেরার পর কুকুয়ার চক্রান্তে সীতার স্বামী পরিতক্ত হয়েছে, পাঁচমাসের গর্ভবতী সীতাকে রাজ্যের বাইরে বনবাসে পাঠিয়েছে রাম। সেখানে যমজ পুত্রের জন্ম দিয়েছে সীতা। আবার রাজ্যকে অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বন থেকে সীতাকে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তাকে সতীত্ব প্রমাণ করতে বললে শেষপর্যন্ত পাতলে প্রবেশ করেছে সীতা। তিনি বিভিন্ন লোকগাথা থেকে রামকথার উপাদান সংগ্রহ করে নতুন এক রামায়ণ রচনা করেন যাকে নবনীতা দেবসেন সীতায়ণ বলে প্রশংসা করেছেন।

 চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণে প্রথম ছয়টি অনুচ্ছেদে বিস্তারিত ভাবে সীতার জন্মকাহিনি রচনা করেছেন। রামজন্মভূমি অযোধ্যার রাজা দশরথের রাজপ্রাসাদের বর্ণনার পরিবর্তে লঙ্কার রাবণের রাজপ্রাসাদের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয় রামায়ণ। চমকে যেতে হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও কয়েকশো বছর আগের লেখা এই রামায়ণের এই সূচনায়।

“সাগরের পারে আছে গো কনক ভূবন।

তাহাতে রাজত্বি করে গো লংকার রাবণ।।

বিশ্বকর্মা নির্ম্মাইল গো রাবণের পুরী।

বিচিত্র বর্ণনা তাহার গো কহিতে না পারি।।

যোজন বিস্তার পুরী গো দেখিতে সুন্দর।

বড়বড় ঘরগুলি গো পাহাড় পর্বত।।”

চন্দ্রাবতী রামায়ণে সীতা হল রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যা। তবে আরো একটি বিষয়ে তিনি অন্যান্য রামায়ণ রচয়িতাদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছেন। সেটি হল সীতার জন্মকাহিনি। তাঁর রচনায় সীতা রাবণ ও মন্দোদরীর জৈবিক সন্তান নন, রাবণের ঔরসে তার জন্ম নয়, তিনি মন্দোদরীর একার সন্তান। সীতার এমন জন্মের কথা জাভা দেশের রামায়ণে দেখা যায়। সেখানে সীতাকে রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যা বলে দেখানো হয়েছে। মালয় দেশের রামায়ণেও সীতা মন্দোদরীর কন্যা, তিব্বত ও কাশ্মীরের রামায়ণেও তাই।

ড. দীনেশচন্দ্র সেনও বলেছেন, “আশ্চর্যের বিষয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের বৃত্তান্তের অনুরূপ কাহিনী আমরা পাই না। তিব্বত, মালয়, কাশ্মীর, জাভা প্রভৃতি স্থানে সীতার জন্ম সম্বন্ধে যে সব প্রবাদ আছে, চন্দ্রাবতী সেই সকল কথাই আমাদিগকে শুনাইয়াছেন।”

তাঁর রামায়ণের কুকুয়া চরিত্রটিও কাশ্মীরী, জাভা, কম্বোজ, মালয় দেশের রামায়ণে পাওয়া যায়। এই বিভিন্ন দেশের রামায়ণ কথা বা কাহিনি ঐ অঞ্চলে বহুদিন ধরে প্রচলিত থাকায় তা সম্ভব হয়েছে। মৈমনসিংহ জেলার মেয়েদের মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা এই বিভিন্ন দেশের রামায়ণ কথা তিনি শৈশব থেকেই শুনে এসছেন। ঐ অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রাধান্য পাওয়ার আগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রাধান্য ছিল। সে কারণে বৌদ্ধ ও জৈনদের রচিত রামায়ণের কাহিনি এই অঞ্চলে প্রচলিত থাকা স্বাভাবিক। নবনীতা দেবসেন নিজে গত শতকের নব্বয়ের দশকে মৈমনসিংহ জেলা থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন সেখানকার মহিলারা মুখে মুখে বিভিন্ন রকমের রামায়ণ গান গেয়ে থাকে। বাল্মীকি রামায়ণ পুরুষ গাইনরা গায় কিন্তু মহিলারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক রামায়ণের কাহিনি গেয়ে থাকে যেখানে সীতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, রামকে নয়। কবি চন্দ্রাবতী নিজে লিখেছেন তিনি ছোটবেলায় মায়ের মুখ থেকে পুরাণ ইত্যাদি শুনেছেন। অর্থাৎ বোঝা যায় এই সমস্ত রামায়ণের কথা বা গান চন্দ্রাবতী শুনেছিলেন বলেই তা থেকে নিজের মত করে সীতার জন্মকথা লিখতে পেরেছিলেন। আবার অনেকে চন্দ্রাবতী রামায়ণের সঙ্গে অসমের দূর্গাবর কায়স্থের গীতিরামায়ণের মিল খুঁজে পেয়েছেন। তবে এটাও স্পষ্ট যে তিনি সংস্কৃত রামায়ণের থেকে ধার নেননি। রচনার শুরুতেই পুরুষের ঔরস ছাড়া মন্দোদরীর গর্ভধারণ ও অদ্ভূত প্রসব- কাহিনি বর্ণনা করেছেন, আর ঘটনাচক্রে জনক রাজার ঘরে জন্ম নিয়েও ‘সতা’ জেলেনির নামানুসারেই শিশুকন্যার নাম হয়েছে সীতা, যা অত্যাধুনিক নারীবাদী মানসিকতাকে অনেকখানি উস্কে দেয়।

   তাঁর রামায়ণে আরও একটি ব্যতক্রমী বিষয় লক্ষনীয়, রাবণের অশোকবনে বন্দিনী সীতার একমাত্র সখী হয়ে উঠেছিল সরমা। সীতা সরমার কাছে পঞ্চবটী বনের যে বর্ণনা দিয়েছে তা মাইকেলের বর্ণনাতেও পাওয়া যায়, শুধু এই অংশটি পরবর্তিতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’এ বিস্তৃতি লাভ করে। এই সরমা লক্ষ্মণকে তার স্ত্রী ঊর্মিলার প্রতিও সদয় হতে পরামর্শ দেন, যা পরবর্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’র বিষয়বস্তু হয়েছে।

চন্দ্রাবতী রামায়ণে রামের জন্মকথার শুরুতে একবার মাত্র তাকে বিষ্ণুর অবতার বলেছেন, পরে সমস্ত কাহিনি জুড়ে কোথাও তার সেই চরিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি। রাম হয়ে ওঠতে পারেনি পতিত পাবন, বীর- যোদ্ধা, বুদ্ধিমান কিংবা বিষ্ণুর অবতার। সে এখানে মেরুদণ্ডহীন এক প্রেমিক, প্রতারক স্বামী, পদলোভী রাজনীতিবিদ। সে সীতার অগ্নিপরীক্ষার জন্য নিজে হাতে আগুন জ্বালায়।

এখানে সীতার বারমাস্যা শুরুই হয়েছে রামকে অভিযুক্ত করে, সীতা স্পষ্টত বলছে রামের মত স্বামী পেয়ে তার জীবনটা দঃখে ভরে গেল-

সাত পাঁচ সখী বইসা গো জোড়-মন্দির ঘরে।

এক সখী কহে কথা গো জিজ্ঞাসে সীতারে।।

তুমি যে গেছলা গো সীতা এই বনবাসে।

কোন কোন দুঃখ পাইছিলা গো কোন কোন মাসে।।

“আমার দুঃখের কথা গো কহিতে কাহিনী।

কহিতে কহিতে উঠে গো জ্বলন্ত আগুনী।।

জনম- দুঃখিনী সীতা গো দুঃখে গেল কাল।

রামের মতন পতি পাইয়া গো দুঃখেরি কপাল।।

এক ত দিনের কথা গো মোর শুন সখীগণ।

চারি বইন আছি গো মোরা মিথিলা ভুবন…।।”

অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র গর্ভবতী স্ত্রী সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে সীতার প্রতি যে অন্যায় করেছে তার প্রতিবাদ করে চন্দ্রাবতী লিখেছেন-

“পুড়িবে অযোধ্যাপুরী গো কিছুদিন পরে।

লক্ষ্মীশূন্য হইয়া রাজ্য গো যাবে ছাড়খারে।।

পরের কথা কাণে লইলে গো নিজের সর্ব্বনাশ।

চন্দ্রাবতী কহে রামের গোবুদ্ধি হইল নাশ।।”

বাল্মীকির রামায়ণের বিষ্ণুর অবতার পতিতপাবন রামচন্দ্রকে অভিশম্পাত করার মত সাহস দেখিয়েছেন চন্দ্রাবতী।  তাঁর রামায়ণে রাম খলনায়ক হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিনাশ তো শুধু রামের হয়নি, জয়ানন্দেরও যে হয়েছিল!  তার সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য জয়ানন্দকে যে অভিশাপ তার দিয়ে ওঠা হয়নি সেই অভিশাপ যেন রামের ওপর ঝরে পড়েছে! তিনি নিজে জীবনে যে আঘাত পেয়েছেন, পুরুষের দ্বারা প্রতারিত অবহেলিত হয়েছেন, তার ফলে যে করুন পরিস্থিতি জীবনে নেমে এসেছে তাঁর সে দুঃখের জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে সীতার চরিত্রের মধ্যে।

নবনীতা দেবসেন বলেছেন, “…‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’কে রাম কাহিনির একটি ব্যক্তিগত ভাষ্যরূপে, বিশেষত, অবিচার পীড়িত এক নারীর দৃষ্টকোণ থেকে দেখতে পারা যায়”।

জনম দুঃখিনী সীতার দুঃখের কথা লিখতে গিয়ে রামের প্রশস্তি আর করা হয়নি, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠেছে সীতার প্রশস্তি। তাই অতি দরিদ্র সতা জেলেনির ঘরে সোনার কৌটোতে করে ‘ডিম্ব’ রূপে সীতা আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে যত্ন করে তুলে রেখেছিল সতা, তাই তার সব অভাব দূর হয়ে যায়। সতার বন্ধ্যা গাভীর বাচ্চা হয়, তাদের জমিতে সোনার ফসল হতে শুরু করে। সতার স্বামী মাধবকেও আর জলে মাছ ধরতে যেতে হয় না। সতাও আর মাছ বেচতে যায় না। ছেঁড়া শাড়ির বদলে সে ‘গঙ্গাজল-শাড়ি’ পড়ে, দামী ‘রাম-লক্ষ্মণ শাঁখা’ পরে।

“মাছের ডুলি মাথায় সতা গো না যায় বাড়ি বাড়ি।

‘রাম-লক্ষ্মণ শাখা’ পরে গো মাধবের নারী।।

‘গঙ্গাজল- শাড়ি’ পরে গো পিন্ধন বাহার।

কোমরে বেড়িয়া পড়ে গো পাটের পসার।।

কাঞ্চন সরা বাটায় গো সুখে পান খায়।

ফুলের মাচায় শুইয়া গো সুখে নিদ্রা যায়।।”

আবার সীতাকে ত্যাগ করার পর রামের সুখের রাজ্যে অ- সুখের কালো মেঘ নেমে আসে-

“ যেই না দিন সীতা দেবী গো বনবাসে গেল।

অযীধ্যা ভুবনে হায় গো অমঙ্গল লাগিল।।

ক্ষেতে নাই সে হয় ফসল গো, নদীতে না হয় পানি।।

রোগ-ব্যাধির জ্বালায় প্রাজার গো আকুলপরাণি।।”

পতিতপাবন রাম এখানে নিজের রাজ্যের সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনতে অক্ষম। তখন সে অন্যের পরামর্শ নেয় এবং তখনও সেই সীতাকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনারই প্রস্তাব আসে। নবনীতা দেবসেন তাঁর রামায়ণ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-

    “… ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণে’ কান পাতলে একটি পরিচ্ছন্ন উচ্চারিত নারীর কন্ঠ স্পষ্ট শোনা যায়। চন্দ্রাবতী ব্রাহ্মণদের রামায়ণকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি রামের বীর্যশৌর্য বিষয়ে নীরব, নীরব রামের গুণপনা ও দেবত্ব বিষয়ে, নীরব রামের যুদ্ধ-দক্ষতা বিষয়ে, এবং নীরব রামের বোধি সম্পর্কেও।“

রামায়ণ গবেষক কোয়েল চক্রবর্তী বলেছেন, “নস্যাৎ করেছেন দেবভক্তিবাদকেও”।

চন্দ্রাবতী তার রামায়ণে গঠনগত, ভাষাগত ও কাহিনিগত দিক থেকে প্রচলিত প্রথাকে ভেঙ্গেছেন। মহাকাব্যের ঢঙে নয়, পাঁচালির ঢঙে লিখেছেন তাঁর রামায়ণ আর মঙ্গলকাব্যের ঢঙ্গে লিখেছেন সীতার বারোমাস্যা। প্রায় প্রতিটি ছত্রে পাঁচালির ঢঙে ‘গো’ শব্দটি যোগ করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন এ সম্পর্কে বলেছেন-

 “চন্দ্রাবতীর রামায়ণের ভাষা যেমন সহজ তেমন সুন্দর। একটি নির্মল জলপ্রপাতের মত সেই কবিত্ব অবাধ গতিতে ছুটিয়াছে। কোনো স্থানে বহ্বাড়ম্বর কিংবা ভাষা-পল্লবের বাহুল্যে সেই গতির বিঘ্ন সাধিত হয় নাই। সর্বত্র করুন রসের এক মধুর ঝঙ্কার আছে। সীতার কষ্টে সেই রস উথলিয়া উঠিয়াছে”।

চন্দ্রাবতী যে সংস্কৃত জানতেন না তা নয়, তবু তিনি রামায়ণ রচনার সময় সংস্কৃত ভাষার বা শব্দ ভাণ্ডারের সাহায্য নেননি। তিনি পালাগানের ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি সহজ সরল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন রামসীতার কথা, বলা ভালো শুধুই সীতার কথা।

    তবে বিগত শতাব্দীতে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর রামায়ণ ও পালাগানগুলি সম্পাদনা করে প্রকাশ না করলে কবি চন্দ্রাবতীর এই অত্যাধুনিক রামায়ণ সম্পর্কে বাঙালি অজ্ঞাত থাকত। আর ক্ষিতীশচন্দ্রের সম্পাদিত রামায়ণটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে রামায়ণটি অসম্পূর্ণই থাকত! চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে দীনেশচন্দ্র সেন, ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিক, সুনীতি কুমার চট্ট্যোপাধ্যায় যত গুরুত্বই দেননা কেন ভাষাতত্ত্বের বিচার করে সুকুমার সেনের মত অনেকেই একে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে নবনীতা দেবসেন বলেছেন-

 “বছরের পর বছর ধরে আমাদের বাংলা সাহিত্যের হর্তাকর্তা যাঁরা, সেই পণ্ডিত-পুরুষ সুরক্ষীদের দ্বারা একটি দুর্বল মহাকাব্য এবং অসম্পূর্ণ কাজ হিসাবে উপেক্ষিত ও বর্জিত হয়ে এসেছে ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’। একেই আমরা বলছি টেক্সটের কন্ঠরোধ। রাম-স্তুতি নেই বলে এই রামায়ণকে দীন মনে করা হল। এবং মৌখিক লৌকিক গানের রচনাশৈলীকে ধ্রুপদী কাব্যের রচনাশৈলীর সঙ্গে তুলনা করে একে দুর্বল এবং গুরুত্বহীন সাহিত্যকৃ্তি বলে খারিজ করে দেওয়া হল”।।

অথচ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন কাহিনি বিশিষ্ট যে সংস্কৃত রামায়ণ প্রচলিত আছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় সেগুলি বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনি থেকে ভিন্ন কাহিনিযুক্ত। ১৩১১ বঙ্গাব্দে শ্রীতারাকান্ত কাব্যতীর্থ অনূদিত ও ভবানীচরণ প্রকাশিত অদ্ভুত রামায়ণের কথা জানা যায় যা সাতটা কাণ্ডে বর্ণিত, বড় অদ্ভুত এই রামায়ণ। অন্যান্য অদ্ভুত কাহিনির সঙ্গে সীতার অদ্ভুত জন্ম বৃত্তান্ত যেমন রয়েছে তেমনি অসিতা রূপিনী সীতার হাতে সহস্র স্কন্ধ রাবণবধের কাহিনিও রয়েছে।

১৮২০ শকাব্দে প্রকাশিত পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত যোগবাশিষ্ট রামায়ণ পাওয়া যায় যা বৈরাগ্য, মুমুক্ষু, ব্যবহার, উত্পত্তি, স্থিতি, উপমান ও নির্বাণ এই ছয়টি প্রকরণ বিশিষ্ট। এই রামায়ণের মূল উদ্দেশ্য বিষ্ণুর অবতার রামের প্রচার নয়, জগত সংসারে অনিত্যতা এবং তার পিছনে এক অবিনশ্বর তত্ত্ব বিদ্যমান- এই কথারই প্রচার করা হয়েছে এই রামায়ণে।

  তেলেগু ভাষায় বুদ্ধ রেড্ডি ১২৩০ সালে ছয় খণ্ডে বিভক্ত দ্বিপদ রামায়ণ রচনা করেন। বাল্মীকি রামায়ণে নেই এমন অনেক কাহিনিই এই রামায়ণে রয়েছে। উত্তরকাণ্ড সহ তেলেগু ভাষায় প্রথম রামায়ণ লেখেন টিক্কন। তেলেগু ভাষায় রচিত বিভিন্ন রামায়ণ বা রামকথা পাওয়া যায় যারা - ভাস্কর রামায়ণ, ইয়ানা রামায়ণ, রামকথা, কট্টবরদারাজু রামায়ণ, মোল্লা রামায়ণ, অচ্চতেনুন রামায়ণ, রাঘব পাণ্ডবীয় নামে পরিচিত।

    ষোড়শ শতাব্দীতে কন্নড় ভাষায় কুমার বাল্মীকি ওরফে নরহরি তোরবেয় ভাসিনী ষঠপদী ছন্দে ৫ হাজার শ্লোকে প্রথম রামায়ণ রচনা করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে (১৭৫০) হেলবন কট্টে গিরিষম্মা সীতাকল্যাণ নামে রামায়ণ রচনা করেন।

এমন কি আদিবাসীদের মধ্যেও রামকথা বা রামায়ণ প্রচলিত আছে। মুণ্ডাদের কবি বদুবাবু রামায়ণ নামে ২১টি গান রচনা করেন। এছাড়া ওরাওঁ, অসুর, কোল, বীরহোড়দের মধ্যে রামকথার গান প্রচলিত আছে তাও প্রচলিত রামকথা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। সে সব রামায়ণে কোথাও কোথাও রামের থেকে রামকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রচয়িতার স্বাধীনভাবে রামায়ণ রচনার অধিকার অলিখিতভাবে বহুদিন থেকেই স্বীকৃত।

   চন্দ্রাবতীর কাহিনির মত একই রকম কাহিনি প্রচলিত আছে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। চন্দ্রাবতীর সমসময়ে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে তেলেগু ভাষায় মোট চারজন মহিলা কবির রামায়ণ পাওয়া যায়, মোল্লা- রামায়ণ, মধুবাণীর রঘুনাথ- রামায়ণ, সুভদ্রা- রামায়ণ ও সরস্বতী- রামায়ণ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল কবি মোল্লা রচিত রামায়ণ। চন্দ্রাবতীর মত তিনিও শৈব ও চির-কুমারী ছিলেন। চন্দ্রাবতী পিতার আদেশে রামায়ণ লিখলেও স্বপ্নে রামের আদেশে রামায়ণ রচনা করা মোল্লার রামায়ণকে সেখানে শূদ্রকাব্য বলা হয়। কারণ তাঁর পিতা আতুকারি কেসন কুম্ভকার ছিলেন। তাই ব্রাহ্মণ সমাজে এই রামায়ণেরও জায়গা হয়নি, তবু সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেই রামায়ণটিই। খুব কম দামে অজস্র মুদ্রণ কপি পাওয়া যায় রাস্তার পাশের দোকানেও। এই রামায়ণের হিন্দি অনুবাদও রয়েছে। মোল্লার রামায়ণ যতটা জনপ্রিয় হয়েছে চন্দ্রাবতী রামায়ণ ততটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

দীনেশচন্দ্র সেনের পর এই চন্দ্রাবতীকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচিতি দান করেন আধুনিক বাংলার আর এক মহিলা সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। নবনীতা দেবসেন চন্দ্রাবতী রামায়ণ পড়ার পর এতটাই অভিভূত হন যে ১৯৮৯ সালে প্রথমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে দিল্লিতে এ বিষয়ে দুটি বক্তৃতা দেন। ১৯৯১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ নিয়ে বক্তৃতা দেন। পরে ইউটা, কলম্বিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই সম্পর্কে বলেন। তিনি অবাঙালিদের কাছে এর গুরুত্ব বোঝাতে চন্দ্রাবতী রামায়নের ইংরাজী অনুবাদও করেন। এভাবেই বাংলার পরিধি ছাড়িয়ে বাইরেও পৌঁছয় কবি চন্দ্রাবতী ও তাঁর রামায়ণকথা। বাঙালিরাও অনেকে এই বিষয়ে জানতেন না। সেই চর্চাও গতি পায়

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশের শতবর্ষের আলোকে আজ আর একবার আলোকিত হছে চন্দ্রাবতী ও তাঁর রচনা। যেমন আলোচিত হচ্ছে মহুয়া, সোনাই, কমলা, কাজলরেখা, লীলা, তেমনি আলোচিত হচ্ছে তাঁর মলুয়া, সোনাই, সীতাও…। তাঁর রামায়ণের সীতার মত তাঁর মলুয়া ও সোনাইও প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছে পুরুষের অবহেলা বা অত্যাচারের কারণে। জাতি-ধর্ম, ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সবচেয়ে দুঃখি, কোণঠাসা, অপমানিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিতদের কথা বলেছেন তাঁর কাব্যে, যার ফলে চন্দ্রাবতীর রামায়ণও হয়েছে সীতায়ণ! এখানেই তাঁর রচনা যেন এক প্রতিবাদ হয়ে উঠেছে। নারীর বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে চন্দ্রাবতীর এই প্রতিবাদকে আগামী শতাব্দীর সূর্যও স্মরণ করবে সন্দেহ নেই!

  

 তথ্যসুত্র-

১] দীনেশচন্দ্র সেন রায় বাহাদূর, মৈমনসিংহ গীতিকা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা। চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৩

২] মুনমুন চট্টোপাধ্যায়, মৈমনসিংহগীতিকার পুনর্বিচার, পুস্তক বিপণি, ২০১৫

৩] কোয়েল চক্রবর্তী, চন্দ্রাবতীর জীবন ও রামায়ণ, দে বুক স্টোর, ২০১৮

৪] নবনীতা দেনসেন, চন্দ্র- মল্লিকা এবং প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ, দে’জ পাবলিশিং, ২০১৯

৫] চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০২৩

৬] ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক, চন্দ্রাবতী রামায়ণ, প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা, সপ্তম খণ্ড।