বাংলা গীতিকার সুলুকসন্ধান

গীতিকার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীতে রচিত কালিমপুর অনুশাসনে। এই অনুশাসন থেকে জানা যায় এক ধরনের পল্লীগীতি সেই সময় রচিত হয়েছিল, যা রাখাল বালকদের কণ্ঠে শোনা যেত। এই পল্লীগীতিগুলিতে ছিল রাজা ধর্মপাল ও সেই সময়ের কথা। দশম শতাব্দীতে উত্কীর্ণ বাণগড়ের তাম্রশাসনেও কিছু পল্লীগীতির উল্লেখ আছে। এই পল্লীগীতিগুলি আর এক পাল রাজা রাজ্যপালকে নিয়ে রচিত হয়েছিল। ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত কিছু ছড়া ও কয়েকটি গান পাওয়া গেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’এ যোগীপাল, ভোগীপাল, মহীপাল সম্পর্কিত বেশ কিছু গীতিকার কথা জানা যায়। রামপালকে নিয়েও কতগুলি পালাগানের উল্লেখ পাওয় যায় ‘সেক শুভোদয়া’য়। তবে এগুলি সবই ছিল মূলত রাজা মহারাজাদের কাহিনি নির্ভর। সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ বিশেষ করে প্রেমকাহিনি নিয়ে রচিত পালাগানও কিন্তু ষোড়শ শতাব্দী থেকেই জনসমাজে জনপ্রিয় হয়েছিল।

অনেকের মতে বাংলার প্রণয়নির্ভর গাথা কবিতার প্রাচীন নিদর্শন সরূফের ‘দামিনীচরিত্র’। আবার সুকুমার সেনের মতে উত্তরবঙ্গ থেকে পাওয়া ‘নীলার বারোমাসি গান ‘এবং শ্রীধর বানিয়া গাথা’ই প্রাচীনতম লোকগাথা। দীনেশচন্দ্রের মৈমনসিংহ প্রকাশের পর এই নিয়ে উৎসাহ বাড়ল। এরকম আরো নিদর্শন সংগ্রহের চেষ্টায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সংগ্রাহক ও গবেষকরা ছড়িয়ে পড়লেন। একে একে বহু গীতিকা সংগৃহীত হল। ত্রিপুরা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম থেকেও গীতিকা পাওয়া গেল। উত্তরবঙ্গ থেকে যুগীযাত্রার পালা বা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, ময়নামতির গান, এবং জাগগান পাওয়া যায়।

বাংলা লোকসাহিত্যের নতুন সংযোজন ‘গীতিকা’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ফেলল। মৈমনসিংহ জেলা থেকে পাওয়া আখ্যানধর্মী গানগুলিকে দীনেশচন্দ্র সেন ‘গীতিকা’ নামে অভিহিত করেন। তখন থেকেই এগুলি গীতিকা নামে পরিচিত হয়। আবার দীনেশচন্দ্রই এই গীতিকার ইংরাজি অনুবাদকে ব্যালাড বলেছেন। ব্যালাড ও গীতিকার মধ্যে কিছু সাদৃশ্য বৈশাদৃশ্য থাকলেও গীতিকাকে ব্যালাডের সমগোত্রীয় বলে মেনে নিতে আসুবিধা হয় না।

তবে এই ‘গীতিকা’ নাম নিয়ে কিছু সংশয়ের জায়গা যে নেই, তা নয়। কারণ দীনেশচন্দ্র সেন নিজেই মৈমনসিংহের ভূমিকায় এগুলিকে গীতিকা, পালাগান, গাথা বলেছেন। প্রশ্ন জাগতেই পারে পালাগান, গাথা আর গীতিকা কি একই? 

গাথার আভিধানিক অর্থ হল ‘কাহিনিমূলক কবিতা’। গাথা সম্পর্কে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘গাথা হল কবিতা বা গানে বিবৃত লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাস্তব জীবনের সুখ দুঃখের কাহিনি’। তিনি এও বলেছেন গাথাকেন্দ্রিক লোকসাহিত্যের মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকা খুবই উত্কৃষ্ট মানের। তাঁর মন্তব্য থেকে বলা যায় গীতিকা গাথারই অন্তর্ভুক্ত। ‘গীতিকা’ শব্দটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে পণ্ডিত মহলে। বিভিন্ন আলোচনা থেকে গীতিকার যে সর্বজনগ্রাহ্য সরল সমাধান পাওয়া গেছে তা হল আখ্যানধর্মী লোকগীতিকে গীতিকা বলা হয়। এর আখ্যান কল্পনাধর্মী বা বাস্তবনির্ভর হতে পারে। তবে গীতিকা সুরে সুরে গীত হলেও সুরের চেয়ে কাহিনিই এখানে প্রাধান্য লাভ করে থাকে।

দীনেশচন্দ্র সেনকে অনুসরণ করে পরবর্তিতে সিলেট গীতিকা (১৯৬৮), মোমেনশাহীগীতিকা (১৯৭২), রংপুর গীতিকা(১৯৭৭) প্রকাশিত হয় ও ‘গীতিকা’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা শক্ত করে নেয়।

এদিকে যে অঞ্চল থেকে আখ্যানগীতিগুলি সংগ্রহ করা হয়াছে সেখানে এগুলি পালাগান বলেই পরিচিত। গীতিকা সেই লোকসমাজ থেকে উদ্ভূত যে সমাজের লোক প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও সুষ্ঠু সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত। বিশেষত বিভিন্ন জাতি উপজাতির মিশ্রনে সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হয় গীতিকা। এই আখ্যানগীতিগুলির নামকরণের মধ্যেও তা প্রকাশ পায়, যেমন- মৈমনসিংহ গীতিকার ‘দস্যু কেনারামের পালা’, পূর্ববঙ্গ গীতিকার শ্যাম রায়ের পালা, রতন ঠাকুরের পালা, নিজাম ডাকাতের পালা, বীর নারানের পালা, রাজা রঘুর পালা। ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক সংগৃহীত ও সম্পাদিত ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশিত মণির ওঝা- মঞ্জুর মাও পালা, কমল সদাইগরের পালা, ফিরোজ খাঁ দেওয়ান– সখিনা বিবির পালা, পরীবানু বেগমের পালা, ছুরত জামাল অধূয়া সুন্দরী পালা, বারোতীর্থের গান বা রাজা ভগদত্তের পালা, ভেলুয়া সুন্দরী-মদন সাধুর পালা, বাইন্যা বউ ও লক্ষ্মীর ঝাঁপি পালা, মলয়া কন্যার পালা, হরিণকুমার জিয়ালনী কন্যার পালা, সন্নমালার পালা, দেওয়ান ঈশা খাঁর পালা ইত্যাদি।  এগুলিকে গীতিকা না বলে পালাগান বললেই যুক্তিযুক্ত হত বলে অনেকে মনে করেন। এমন কি রংপুর থেকে সংগৃহীত পালাগানগুলি ঢাকা বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮৫খ্রিঃ এ তিনটি খণ্ডে ‘রংপুরের পালাগান’ নামেই প্রকাশিত হয়েছে। আবার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশিত হয়েছে তেমনি ‘লালনগীতিকা’ও প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যায় লালন ফকিরের লেখা বাউলগান যদি গীতিকা হয় তাহলে গীতিকার সংজ্ঞা পাল্টয়ে যায়। মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগান আর বাউল গান এক নয়। সে ক্ষেত্রে ‘গীতিকা’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যে অস্পষ্টতা তৈরি করেছে।

গীতিকার সংজ্ঞা নিয়ে নানা জনের নানা মত। ড. বরুণ কুমার চক্রবর্তী (গীতিকা : স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য গ্রন্থে) বলেছেন, “জটিলতামুক্ত একটি ঘটনা কেন্দ্রিক আখ্যান, সচরাচর যা জনপ্রিয়, নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে কোনো প্রকার নীতি-উপদেশে ভারাক্রান্ত না হয়ে, সারল্যকে রক্ষা করে, অপরিনত চরিত্রকে উপলক্ষ্য করে, ঘটনা ও সংলাপকে আশ্রয় করে গোষ্ঠীবিশেষের মানসিকতা সঞ্জাত হয়ে অজ্ঞাত পরিচিত রচয়িতার আত্মনির্লিপ্তির পরিচয়বাহী, মৌখিক ঐতিহ্যে প্রাপ্ত মুদ্রাকৃতির তবকে রচিত যে সংগীত, তাই হল গীতিকা"। আশুতোশ ভট্টাচার্যের মতে গীতিকা সবসময়ই গীত হয়, কোথাও কেবলমাত্র আবৃত্তি করা হয় না। গীতিকায় সুর নয়, কাহিনিই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

পশ্চিমের ব্যালাড ও আমাদের গীতিকা

ব্যালাডের (Ballad) আভিধানিক অর্থ হল ছোট গল্পগীতি। ইউরোপীয়রা খুব জনপ্রিয় একপ্রকার আখ্যান মূলক লোকগীতিকে (Narrative Folk song) Ballad বলে। তবে দীনেশ চন্দ্র সেন ব্যালাডের বাংলা করেছেন গীতিকা। বাংলা গীতিকার মত আখ্যানধর্মী লোকগানকে ইংরাজি সাহিত্যে ‘Ballad’ বলা হয়। ইংরাজি সাহিত্যের ব্যালাড সম্পর্কে ‘Standard Dictionary of folklore Mythology and legend’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইউরোপে মধ্যযুগে এক ধরনের বর্ণনাত্মক কাহিনিমূলক যে লোকগীতি প্রচলিত ছিল, তাই ই ব্যালাড। বাংলায় গীতিকার বৈশিষ্ট এবং ইংরাজি Ballad এর বৈশিষ্টের কিছু তারতম্য থাকলেও দুটোই আখ্যানধর্মী লোকগীতি। ইউরোপে দ্বাদশ শতাব্দীতে এর প্রচলন শুরু হওয়ার পর ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যেও ব্যালাড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার প্রমাণ পাই  ইউরোপের ভিন্ন দেশে ব্যালাডের ভিন্ন নাম দেখে। স্পেনে Ballad কে Romance বলা হয়, ইউক্রেনে Dumi বলা হয়, রাশিয়ানরা বলে Bylina, ডেনমার্কের ভাষায় Vice, সাইবেরিয়ায় Junacka pesme বলা হয়। ‘Ballad’ শব্দটি নর্ম্যান ফ্রান্সের  ‘Ballet’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ নৃ্ত্যগীত সহযোগে নাট্য। আবার অনেকের মতে ইতালির Ballare শব্দথেকে Ballad শব্দ এসেছে, এই ব্যালারে শব্দের অর্থ নৃ্ত্য করা। যে শব্দ থেকেই Ballad শব্দ আসুক না কেন এর সঙ্গে নৃ্ত্য জড়িয়ে আছে। তবে মধ্যযুগের শেষে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মূলত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে এর উদ্ভব। এই সময় থেকে লিরিক-ধর্মী কাহিনিমূলক লোকগীতিকে ব্যালাড বলা হয়। ব্যালাডের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আব্রামস ( M H Abrams) তাঁর এ গ্লসারি অফ লিটারারি টারমস ( A Glossary of Literary Terms) গ্রন্থে বলেছেন,

‘It is a song, transmitted orally, which tells a story. In all probability the original version was composed by a single author, but he is unknown; and since each singer who learns the ballad by word of mouth is apt to introduce changes in both the Text and the tune, a popular ballad exist in many variant forms. Typically, the popular ballad is dramatic and impersonal, the narrator begins with the climatic episode , tells the story tersely by means of action and dialogue ( sometimes, by means of dialogue alone), and tells it without expressing his personal attitudes and fillings.’

তাঁর এই সংজ্ঞার মধ্য দিয়ে ব্যালাডের বৈশিষ্ট্য গুলিও উল্লেখ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য্যের ভাষায়, ‘গীতিকার বিশেষ একটি সংকটপূর্ণ, ঘটনা মুখর কাহিনি থাকবে, ঘটনা ও সংলাপের ভিতর দিয়াই এই কাহিনি অগ্রসর হইবে, সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত  হইয়াই একান্ত বস্তুধর্মী কাহিনি ইহাতে বর্ণনা করিবেন।‘ তাঁর মতে গীতিকার কাহিনি দৃঢ়বদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়, এবং নাটকীয়তার মধ্যে চরিত্র, পরিবেশ, বিষইয়বস্তু, সংলাপ থাকলেও তাদের চেয়ে ক্রিয়া বা Action প্রধান হয়ে উঠে। এর নাটকীয়তা কাহিনি -প্রধান হয়, চিত্র-প্রধান নয়। আশুতোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন, ‘চলন্ত গাড়িতে আহোরণ করিলে যাত্রীর চোখে পথিপার্শস্থ দৃশ্যসমূহ যেমন অস্পষ্ট হইয়া যায়, গীতিকায় ঘটনা প্রবাহের মধ্যে প্রবেশ করিলে পারিপার্শিক চিত্র সমূহ তেমনি  অস্পষ্ট হইয়া যায়।

ব্যালাডের উত্পত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। তার মধ্যে দুটি মত সব চেয়ে বেশি আলোচিত। একটি Communalist theory, অন্যটি Individualist theory।  কেউ কেউ বলেন ব্যালাড লোকসমাজের সমবেত সৃষ্টি। এর ওপর ভিত্তি করে Communalist theory গড়ে উঠেছে। এই থিওরির সমর্থন করেছেন Francies james child. তাঁর ‘The English and the Scottish popular Ballads’ গ্রন্থে popular Ballads সম্পর্কে বলতে গিয়ে communalist theory র পক্ষে বলেছেন,

 ‘ Different members of the throng, one after another may chant his verse, composed on the spur of the moment, and the sum of these various contributions, makes a song. This communal composition, though each verse, taken by itself, is the work of an individual. A song made in this way is no man's property and has no individual. The folk is its author … the history of balladry, if we could follow it back in straight line without interruptions, would lead us to very simple conditions of society, to the singing and dancing throng, to a period of communal composition’.

অর্থাৎ একটি দলের বিভিন্ন সদস্য একের পর এক মুহূর্তের উদ্দীপনায় এক একটি চরণ গাইতে থেকে, এভাবেই সম্পুরণ গান্টি রচিত হয়। যদিও এক একটি চরণ ব্যক্তি বিশেষের রচনা, তবুও তা হয়ে ওঠে গোষ্ঠীগত বা সম্প্রদায়গত রচনা। এভাবে যে গানটি রচিত হয় তা কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি নয়,এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষ তার রচয়িতা নয়। তা লোকসমাজের সৃষ্টি।ব্যালাডের উতপত্তির ইতিহাসটি অনুসরণ করলে আমরা সমাজের এমন এক সহজ সরল অবস্থায় পৌঁছে যাই, যেখানে একদল মানুষ সমবেত নাচগানের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত রচনায় ব্যাপৃ্ত।

 আবার Individualist theory র প্রবক্তা ‘Cecil Sharp তাঁর English folk song: some conclusions (1907), বলেছেন যে ব্যালাড প্রথমে ব্যক্তি বিশেষের দ্বারাই রচিত হয়, পরে গোষ্ঠী বা সপ্রদায় তাতে পরিবর্তন ঘটায়। 

‘every line, every word of a ballad sprang in the fast instance from the head of some individual, riciter, minstrel, or peasant; just as every note every phrase of a folk tune proceeded originally from the mouth of a solitary singer. Corporate action has originated nothing and can originate nothing. Communal composition is unthinkable. The community plays a part, it is true, but it is at a later stage after and not before the individual has done his work and manufactured the material. Its part is then to weigh, shift, and select from the mass of individual suggestions those which most accurately express the popular test and the popular ideal; to reject the rest; and then, when more variations are produced, to repeat the process once more, and again once more. The process goes on unceasingly while the ballad lives or until it gets into print when, of course, it process is checked, so far as educated singers and concerned’

প্রথমে কোনো এক ব্যক্তির চিন্তা থেকে জন্ম নেয় ব্যালাডের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ - আবৃত্তিকার, কবি বা কৃ্ষক এর জন্মদাতা হতে পারেন। ব্যালাড একক গায়কের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃ্ত হয়, তা যৌথ উদ্যোগের সৃষ্টি কখনোই নয়। তাঁর মতে সমবেত রচনা অকল্পনীয়। তবে একথা সত্যি যে গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের একটি ভূমিকা থাকে। ব্যক্তি আগে সৃষ্টি করে তারপর এতে সম্প্রদায়ের ভূমিকা দেখা যায়। ব্যক্তির সৃষ্টিকে আবলম্বন করে সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিচার বিশ্লেষনের মাধ্যমে তার মূল্য নির্ধারিত হয়। জনরুচি আর আদর্শের উপর নির্ভর করে চলে গ্রহণ- বর্জনের পালা। এই ভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে ব্যালাডের রূপ। আর মুদ্রিত হওয়ার পর সেই রূপটি শিক্ষিত গায়েনদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

এগুলি সাধারণত ব্যক্তি বিশেষের রচনা হলেও তা গোষ্ঠীবদ্ধ জনজীবনের মহৎ সমাজভাবনা থেকে উদ্ভুত। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত ব্যালাডে অন্যান্য বৈশিষ্টে মিল থাকলেও (আখ্যানমূলক, গীতযোগ্য, লোকসমাজের বৈশিষ্ট) ভাব ও আঙ্গিকে পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। ব্যালাডের কাহিনি বর্ণনাত্মক, এবং একটি মাত্র একমুখী নাটকীয় ঘটনা সুরে সুরে গীত হয়। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ব্যালাডগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাওয়া গেলেও তার দুশো বছর পর আমাদের দেশে বাংলা গীতিকা খুঁজে পাওয়া যায়।

ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলা গীতিকাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছেন - ক) নাথ গীতিকা খ)  পূর্ববঙ্গ গীতিকা গ) মৈমন সিংহ গীতিকা।

ক) নাথগীতিকা - নাথগীতিকা মূলত উত্তরবঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়ে বিহার সহ উত্তরভারতে প্রচলিত। নাথ সম্প্রদায়ের ধরম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই গীতিকার জন্ম হয়েছিল। মূলত নাথধর্ম সম্প্রদায়ের তত্ত্বভিত্তিক রচনা এই গীতিকাগুলি। এর আবার দুটি ভাগটি আছে, একটি হল নাথ গুরুদের অলৌকিক সাধন ভজনের কাহিনি যা গোরক্ষ বিজয় বা মীনচেতন নামে পরিচিত। অন্যভাগটি রাজকুমার গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস নেবার কাহিনি। গোপীচাঁদের পাঁচালী, গোপীচাঁদের সন্ন্যাস, গোবিন্দচন্দ্রের গীত, ময়নামতির গান প্রভৃতি নামে দ্বিতীয় ভাগটি পরিচিত। তবে এই নাথ গীতিকা উত্তর বঙ্গে যুগীযাত্রা নামে বিশেষ ভাবে পরিচিত। প্রথমটি গুরুশিষ্যের কাহিনি। সিদ্ধগুরু মীননাথ এক নারীর মোহে আকৃ্ষ্ট হয়ে পতিত হতে চলেছিলেন, কিন্তু শিষ্য গোরক্ষনাথ নিজে ইন্দ্রীয়জিতের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে গুরুর চেতনা জাগিয়ে প্রকৃ্ত জ্ঞান চেতনার পথে ফিরিয়ে আনেন। এখানে নায়ক গোরক্ষনাথ একটি আধ্যাত্বিক প্রেরণার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ভাগের কাহিনি হল গোপীচন্দ্রকে নিয়ে যেখানে রাজা মানিক ও রানী ময়নামতির পুত্র গোপী চন্দ্র। রানি ডাকসিদ্ধ হওয়ায় বিবাহের পরই গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস নেবার প্রয়োজন মনে করেন। প্রথমে প্রতিবাদ করলেও পরে মাদের আদেশে সন্ন্যাস নিলেও প্রাসাদ ছেড়ে যাবার সময় ফিরে ফিরে তাকিয়েছে, পিছুটান অনুভব করেছে ভোগ বিলাশের প্রতি। আর সেখানেই মানবিক আবেদনে ভরে উঠেছে গল্প। নাথ গীতিকা বিষয়ের সার্বজনীনতার গুণে বাংলার সীমা পার করে সুদূর উত্তর ভারতে গুজরাত, পাঞ্জাব, এমনকি দাক্ষ্যিণাত্বে জনপ্রিয় হয়েছে। তবে এর পশ্চাতে ধর্মীয় কারণও অস্বীকার করা যায় না। নাথ ধরম সম্প্রদায় বাংলার বাইরেও রয়েছে, যেখানে নাথ সম্প্রদায় রয়েছে সেখানে নাথ সাহিত্য প্রচারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। রংপুর জেলার মুসলমান কৃ্ষকদের মুখে শুনে জন গ্রিয়ারসন সংগ্রহ করেন। পরে ‘মানিকচন্দ্রের রাজা’ নাম দিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই বিষয়ে আগ্রহ দেখাদিলে অনেকেই ছুটে যান নতুন গীতিকার সন্ধানে। উত্তর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই একই বিষয়ে বিভিন্ন গীতিকার খুঁজে পান। এর কাহিনির নায়ক গোপীচন্দ্রকে অনেকে একাদশ খ্রিস্টাব্দের বাংলার রাজা গোবিন্দ চন্দ্র বলে মনে করেন। এও মনে করেন যে তাঁর রাজধানী ছিল ত্রিপুরা জেলা। তবে নাথগীতিকার অনেক পুথি পুর্ববঙ্গে আবিষ্কৃত হলেও উত্তরবঙ্গে এর জনপ্রিয়তা বেশি লক্ষ করা যায়।

খ) পূর্ববঙ্গ গীতিকা

মৈমনসিংহ গীতিকার দশটি পালাগান ছাড়াও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাহকরা মৈমনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে আরও অনেক গান সংগ্রহ করেন। এগুলিকে পরে পূরববঙ্গ গীতিকা নামদিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা হয়। আশুতোষ চৌধুরী “নিজাম ডাকাতের পালা”, “কফিনচোরা”, ”ভেলুয়া”, “হাতী-খেদা”, “কমল সদাগর”ও “সুজা-তনয়ার বিলাপ” সংগ্রহ করেন। বিহারীলাল রায় “মানিকতারা বা ডাকাইতের পালা”, “বার তীর্থের ডাক” সংগ্রহ করেন। চন্দ্রকুমার দের ভাই নগেন্দ্রচন্দ্র দে “মাঞ্জুর মা”,” “রাজা রঘুরপালা”, “বীর নারাণের পালা” সংগ্রহ করেন। সেগুলি সঙ্গে আরও পালা সংগ্রহ করে  তিনটি খন্ডে প্রকাশিত হয়। এদের নাম দেওয়া হয় “পূর্ব বঙ্গ গীতিকা”। চারটি খণ্ড মিলে (প্রথম খণ্ডে ১০টি, দ্বিতীয় খণ্ডে ১৪টি, দ্বিতীয় খণ্ডের, তৃতীয় সংখ্যা ১১টি, চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যায় ১৯টি)  মোট চুয়ান্নটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের গীতিকা গুলি হল- “ধোপার পাট”, “মইষাল বন্ধু”, “কাঞ্চনমালা”, “শান্তি”, “নীলা”, “ভেলুয়া”, “কমলারাণীর গান”, “মানিকতারা বা  ডাকাতের পালা”, “মদনকুমার ও মধুমালা”, “সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া”, “নিজাম ডাকাইতের পালা”, “দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদালি”,”সুরৎ  জামালও অধুয়া” এবং “ফিরোজ খাঁ দেওয়ান”। দ্বিতীয় খণ্ডের  তৃতীয় সংখ্যায়  আছে- “মাঞ্জুর মা”, “কাফেন চোরা”, “ভেলুয়া”, “হাতী- খেদা”, “আয়না বিবি”, “কমল সদাগর”, “শ্যাম রায়”, “চৌধুরীর লড়াই”, “গোপিনী -কীর্তণ”, “সুজা-তনয়ার বিলাপ” এবং “বার তীর্থের গান”। চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যায়  আছে- “নছর মলুম”, “শিলাদেবী”, “রাজা রঘুর পালা”, “নূরন্নেহা ও কবরের কথা”, “মুকুট রায়”, “ভারইয়া রাজার কাহিনি”, “আন্ধা বন্ধু”, ‘বগুলার বারমাসী”, “চন্দ্রাবতীর রামায়ণ”, “সন্নমালা”(স্বর্ণমালা), “বীরনারাণের পালা”, “রতন ঠাকুরের পালা”, “পীর বাতাসী”, “রাজা তিলক বসন্ত”, “মলয়ার বার মাসী”, “জিরলিনী”, “পরীবানুর হাঁহলা”, “সোণারায়ের  জন্ম” এবং “সোণা বিবির পালা”। তবে এই গানগুলির এক তৃ্তীয়য়াংশ পাওয়া গেছে মৈমনসিং হ জেল থেকে, ৫৪ টি গীতিকার মধ্যে ৩৯টি গান মৈমনসিং হ জেলা থেকে পাওয়া। তবু এই গীতিকার নাম পূর্ববঙ্গ গীতিকা দিয়েছিলেন দীনেশ চন্দ্র সেন। এগুলির, বিশেষ করে মৈমনসিংহ গীতিকার ভাষার প্রাচীনতা, কৃত্রিমতা, কাহিনির বিন্যস্ত রূপ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিদেশে প্রশংসা পেলেও বাংলায় সমালোচনা হয়। শুরু হয় গবেষণা।  ড সুকুমার সেন অভিযোগ করেন সংগ্রাহক সংগ্রহ করার সময় নিজে কলম চালিয়ে ও সম্পূর্ণ গীতিকাগুলি সম্পূরণ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “চন্দ্র কুমার দে সংগ্রহ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, গাথাগুলির ভাষার ছন্দে কলম চালাইয়া সেগুলিকে “ভালো করিয়া সম্পাদনা করিয়াছিলেন। কিন্তু সেকথা তিনি একবারও বলেন নাই”। দীনেশবাবু চন্দ্র কুমার দে’র কাছে প্রাপ্ত বস্তু সম্পূর্ণ রূপে খাটি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং সেই ভাবে ছাপাইয়াছিলেন তবুও মুদ্রিত গাথাগুলিতে স্থানীয় উপভাষার রূপ বজায় রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও বাঙ্গলা সর্বজনীন সাধুভাষার ও কলিকাতা অঞ্চলের চলিত কাব্যভাষার ছাপ মুছিয়া যায় নাই। মধ্যে মধ্যে আবার পশ্চিমবঙ্গের উপভাষার (এবং সাধুভাষার) শব্দগুলিতে পূর্ব বঙ্গীয় ছাপ দিবার চেষ্টা স্পষ্ট হইয়া দেখা দিয়াছে। ভাষাবিচারে মুদ্রিত গাথাগুলি পুরোপুরি অকৃ্ত্রিম নয়”। আরো বলেছেন, “কোনো কোনো গাথায় অন্য গল্পের জোড়াতালি দিয়া অথবা অন্য উপায়ে কাহিনিকে  পরিবর্ধিত ও পরিবরতিত করিয়া আধুনিক কালোচিত রোমান্টিক ছাপ দেবার চেষ্টা দেখা যায়।” সুকুমার সেন ছাড়াও নন্দগোপাল সেনগুপ্ত অভিযোগ তুললেন তার বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা গ্রন্থে, “গীতিকার গল্পগুলি পুরাতন, কিছু কিছু অংশও পুরাতন, কিন্তু তাকে ঘসে মেজে যথা সম্ভবপ্রাচীন সাজে সাজিয়ে একালেই লাখা হয়েছে। একালের অনুযায়ী ব্যাঞ্জনা দিয়ে”। পরে ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদের ‘বাদ্যানীর গান’। এই পালাটি মৈমনসিংহের মহুয়া পালার গ্রাম্যরূপ। এই পালাটি প্রকাশিত হলে মৈমনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো প্রবল হয়। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অন্যতম গীতিকা সংগ্রাহক কবি জসিমুদ্দিন ও রৌশন ইজদানি অভিযোগ করেছেন চন্দ্রকুমার দে’র বিরুদ্ধে। এদিকে মৈমনসং হ গীতিকার ভূমিকায় দীনেশ চন্দ্র লিখেছেন, চন্দ্রকুমার দে- প্রেরিত মহুয়া পালায় কতকগুলি গোড়ার পদ ও শেষের পদ বিশৃ্ঙ্খলভাবে দেওয়া ছিল। “তিনি যেমন শুনিয়াছিলেন তেমনই সংগ্রহ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। আমি সেগুলি যথাসাধ্য শৃঙ্খলার মধ্যে আনিয়াছি”।

ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক ১৯১৬খ্রিঃ এর কাছাকাছি সময়ে  মৈমনসিংহ জেলায় মহাখালী বাজারে পূর্ববঙ্গের প্রাচীন পালা “সুনাই সুন্দরী” র গান শুনে মুগ্ধ হন এবং এগুলি সংগ্রহে ব্রতী হন। গীতিকা সম্পর্কে সন্দিগ্ধ মন নিয়ে ১৯৩৩ সাল থেকে পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলা ঘুরে গীতিকাগুলি তিনি নতুন করে সংগ্রহ করেন। এই কাজে ১৯৩৪খ্রিঃ থেকে ১৯৭০খ্রিঃ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। পরে সুনীতিকুমারের চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় এবং আনুকুল্যে  প্রকাশিত হয় “প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা”র প্রথম খণ্ড (১৯৭০)। একে একে দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৭১), তৃতীয় খণ্ড (১৯৭১), চতুর্থ খণ্ড (১৯৭২), পঞ্চম খণ্ড (১৯৭৩) ষষ্ঠ খণ্ড (১৯৭৪), সপ্তম খণ্ড (১৯৭৫) প্রকাশিত হয়। “দেওয়ানী-ভাবনা” পালাটি তাঁর সম্পাদনায় “সুনাই সুন্দরী” নাম পেয়েছে। তিনি মূলত দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকার ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দূর করার উদ্দেশ্যে এই পরিশ্রম করেন। দীনেশচন্দ্র সেন এর সম্পাদনায় মহুয়া পালার ছত্র সংখ্যা ৭৫৫। কিন্তু ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিক এর সম্পাদনায় মহুয়া পালার মোট ছত্র ৯৮৬। মোট ৭৭টি পালার পাঠান্তর হয়েছে এখানে। ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক প্রাচীন পূরব বঙ্গ গীতিকা প্রকশ করেন তা দীনেশচন্দ্রের পূর্ববঙ্গ গীতিকার পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপ। তিনি নতুন কোনো গীতিকা প্রকাশ করেননি। তবে তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ করেন।

গ) মৈমনসিংহ গীতিকা - মূলত নরনারীর প্রেমের সুর রয়েছে মৈমনসিংহ গীতিকায়। যখন বাংলা সাহিত্যের লিখিত ধারা- মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য, বৈষ্ণব কাব্য ধর্মকে নির্ভর করে রচিত হয়েছে তখন দেবতার আরতি না করে মর্তের সাধারণ মানুষের জীবনারতি করেছে মৈমন সিংহ গীতিকার গানগুলি। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বেশিরভাগ রচনাই লোকসাহিত্য। নাথ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ছাড়াও গল্পকাহিনি, নীতিকথা, প্রণয়কথা প্রভৃতি নিয়ে গান বাঁধত কিছু অখ্যাত কবি। সেই সব গান লোকসমাজে রক্ষিত হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।

আজ থেকে একশো বছর আগে মৈমন সিংহ জেলা থেকে খুঁজে পাওয়া এমন দশটি গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল মৈমনসিং হ গীতিকা। প্রকাশক দীনেশচন্দ্র সেনের হাত ধরে প্রবর্তিত হল নতুন ধারার। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকুল্যে মৈমনসিংহের চন্দ্রকুমার দে' র সংগ্রহ করা দশটি গানের সঙ্কলন এই মৈমনসিংহ গীতিকা। চাষীদের কাছে সমাদৃত এই গান যেমন কোনো ধর্মীয় কাহিনিমূলক নয় তেমন কোনো নির্দিষ্ট কাহিনি নির্ভরও নয়। মৈমন সিং হ গীতিকার মোট দশটি পালাগানে আছে দশ রকমের পালা- মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারাম, রূপবতী, দেওয়ান মদিনা। মৈমনসিংহ গীতিকাতে ওই জেলায় বসবাসকারী গারোদের বাংলা ভাষাভাষী হাজংদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব রয়েছে। সে কারণে এই গীতিকার নায়িকারা স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।নাথগীতিকা মূলত উত্তরবঙ্গের হলে মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গগীতিকা পূর্ববঙ্গের নিজস্ব সম্পদ। জনপ্রিয়তার রাজপথে নাথসাহিত্যকে পিছনে ফেলে মৈ্মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সহস্র যোজন এগিয়ে গেছে।  মৈমনসিংহ গীতিকা ও প্রাচীনপূর্ববঙ্গ গীতিকাতে জাতি সম্প্রদায়হীন মানবপ্রেমের মহিমা এবং লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাস্তবজীবনের সুখদুঃখের কথা বর্ণিত আছে। আর আছে শতাব্দী-প্রচীন মাটি, জল, জঙ্গল, বাতাস, আর ইতিহাসের গন্ধ। পূর্ববাংলার মৈমনসিংহ ছাড়াও সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কবিরা এই গান রচনা করেছিলেন। দৃষ্টান্তমূলকভাবে এঁরা হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবি ছিলেন। মূলত প্রণয়ঘটিত রোমান্টিক ঘটনা ও অন্যান্য সামাজিক ঘটনা নিয়ে ছড়া- পাঁচালিঢঙে আখ্যান কাব্যগুলি রচিত কাহিনি-মূলক গানগুলি অভিনীত ও গীত হত। মৈমনসিং হ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই পালা গানের আয়োজন করা হত। যে অঞ্চল থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সেই কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে এগুলি পালাগান বলে পরিচিত, কেউ কেউ লম্বা গানও বলে থাকে। গায়েনরা মুখস্ত করে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গানগুলি আসরে গেয়ে পরিবেশন করতেন।

তথ্যপঞ্জি-

১) মৈমনসিংহ গীতিকা - দীনেশচন্দ্র সেন

২) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - ড অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

৩) বাংলার লোকসাহিত্য (প্রথম খণ্ড) - ড আশুতোষ ভট্টাচর্য্য।

৪) প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা - ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক ।

৫) মৈমনসিংহ গীতিকাঃ পুনর্বিচার - মুনমুন চট্টোপাধ্যায়।

৬) মৈমন সিংহ ও প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা - আশিস ঘোষ।