মৈমনসিংহ গীতিকা : সংগ্রহ ও মুদ্রণের ইতিকথা

মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে এর প্রকাশক, সংগ্রাহক ও সহায়ক - দীনেশ চন্দ্র সেন, চন্দ্র কুমার দে, কেদারনাথ মজুমদারের অবদান বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে চায় নিবন্ধটি।

আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে মৈমনসিংহ গীতিকা নামে পালাগানের এক সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায়। প্রথমে দীনেশচন্দ্র নিজেই এর ইংরাজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে। তার কয়েকমাস পরে ঐ বছরের নভেম্বরে মাসে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলায় মৈমনসিংহ গীতিকা। দুটি ক্ষেত্রেই ছিল দীনেশ চন্দ্রের দীর্ঘ ভূমিকা। বলা বাহুল্য মৈমনসিংহ গীতিকার মত বাংলার একেবারে নিজস্ব সম্পদ ও গর্বের জিনিসকে ইংরাজিতে অনুবাদ করে দীনেশচন্দ্র তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতের ইংরেজদের ইংরাজি সাহিত্যের দম্ভকে ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি ইংরেজ সহ সারা বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলেন শুধু ইংরাজি সাহিত্যেরই যে প্রাচুর্য রয়েছে তাইই নয়, বাংলা সাহিত্যেরও প্রাচুর্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। ঠিক এই কারণেই তিনি মাত্র চব্বিশ/ পঁচিশ বছর বয়সে লিখেছিলেন প্রবন্ধ ‘শেক্সপিয়র বড় কি কালিদাস বড়?’, ‘বাল্মীমি ও হোমার, রামায়ণ ও ইলিয়ড’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখার আশায় অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন তখন থেকেই। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র মাণিক্যের সাহায্যে প্রকাশ করলেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’র প্রথম সংস্করণ। ইংরেজদের দেখিয়ে দেন শুধু তাদের সাহিত্যের ইতিহাস নেই, বাংলা সাহিরত্যেরও ইতিহাস আছে। দেখিয়ে দেন পল্লীবাংলার বনলতার পুষ্পকলি বিদেশী বাগিচার প্রস্ফুটিত পুষ্পের তুলনায় অনেক বেশি অপরূপ ও সুগন্ধী।

 মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহের জন্য সংগ্রাহক নিয়োগ করেন ঠিকই তবে একসময় তিনি নিজেও বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুথি সংগ্রহ করে বেরিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক প্রকাশ করেছিলেন মহামূল্য সব বই। এমনই এক মহামূল্য বই হল মৈমনসিংহ গীতিকা। প্রথম যৌবন থেকেই ঝড়- বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, দীর্ঘ জল-কাদাময় রাস্তা পেরিয়ে গ্রাম বাংলা ঘুরে ঘুরে পুরানো পুথি সংগ্রহ করে তিনি পল্লীবাংলার মায়ের ‘আঁচলের গ্রাণ’ খুঁজে বেরিয়েছেন দীনেশ চন্দ্র। পল্লীমায়ের আর এক সন্তান বঙ্গসাহিত্যের নন্দনকাননের সৌরভে মাতোয়ারা চন্দ্রকুমার দে’র সংগ্রহ করা সেই পালা গানের মধ্যে তা খুঁজে পেয়েছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের একশো বছর পরেও পল্লীমায়ের আঁচলের সেই ঘ্রাণ মোহিত করে রেখেছে আধুনিক বাঙালিকে, আধুনিক বিশ্ববাসীকেও। আর এই মৈমনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে কে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন এবং দীনেশ চন্দ্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়। এই ত্রয়ীর অবদান না থাকলে সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পালাগানগুলি আজ হয়ত কালের প্রবাহে হারিয়ে যেত। হারিয়ে যেত মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস, হারিয়ে যেত সেকালের নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্ণের পরিবারের মেয়েদের সামাজিক অবস্থান ব্রাহ্মণ্য সমাজের থেকে কত উচ্চে ছিল সে কথা। তাদের মানসিক ও শারিরীক সক্ষমতা ও লড়াইয়ের কথা। হারিয়ে যেত গায়েনদের ভূমিকার কথা, সেযুগের মহিলা কবির রচিত পালাগানের কথা, হারিয়ে যেত তত্কালীন বাংলার সমাজে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আসনে বসে থাকার কথা। মধ্যযুগের সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট দেবদেবী বা রাজারানির মাহাত্ম্য প্রচারের খোলস ছেড়ে ঠিক যে সময়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত রঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভএর মত পণ্ডিতরা বাংলা ভাষার শিকড় খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক তখনই বাংলা সাহিত্যের বাগিচা আলো করে ফুটল মৈমনসিংহ গীতিকা। অন্ত্যজ শ্রেনির মানুষের সুখ দুঃখ ভালোবাসার কাহিনি, পল্লীগ্রামের সমাজচিত্র, বাংলা সাহিত্যে গায়েনদের ভূমিকা, পুরুষের ব্যক্তিত্ব, নারীর স্বতন্ত্রতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন বহনকারী মৈমনসিংহ গীতিকা বাংলা সাহিত্যের বাগিচায় সব চেয়ে সুরভিত পুষ্প তাতে সন্দেহ নেই।

১৯২৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ মৈমনসিংহ জেলায় গিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আঠারোবাড়ির তত্কালীন জমিদার, যিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেনের প্রাক্তন ছাত্র প্রমোদচন্দ্র রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত প্রমোদ লাইব্রেরি করতে গিয়ে উক্ত অনুষ্ঠানে বলেন– “আমার গান দিয়ে শুরু করতে হবে তা কেন, দীনেশচন্দ্রের পালাগান অপূর্ব। মৈমনসিংহ থেকে যে সকল পালা গান সংগ্রহ হয়েছে তাতে সহজেই বেজে উঠ্বছে বিশ্ব সাহিত্যের সুর, মানুষের চিরকালের সুখ দুঃখের প্রেরণায় লেখা সেই গাঁথা। মৈমনসিংহ গীতিকার কাল নির্ণয় চলে না। ওটা আবহমান কালের- যার মধ্যে একটা আশ্চর্য কবিত্ব আছে। আমি এসেছি সেই গান শুনতে, সেই দৃশ্য অবলোকন করতে। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া পালা আমার খুব প্রিয়।“

 শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, কাহিনি ও প্রকাশভঙ্গীর কারণে প্রশংসা পেয়েছে রোমা রোলাঁ, দুসান জুবাভিতেল, স্টেলা ক্রামরিশ, সিলভা লেভি, উইলিয়াম রোথেনস্টাইন, জর্জ এলেন, ও টেন, মিসেস আর্কট, এল ডি বারনেট প্রমুখের মতো বিশ্ব সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্বের। দুসান জুবাভিতেল শুধু মৈমনসিং হ গীতিকা মূল ভাষায় পড়বে বলে স্কলারশিপ নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। তিনমাস মৈমনসিংহ জেলায় থেকে সেখানকার ভাষা শিখেছিলেন।

আজ একশো বছর পরেও স্কুল কলেজের পাঠক্রমের বাইরেও বাংলা সাহিত্যকে, নাট্য সাহিত্যকে, অনুবাদ সাহিত্যকে, সর্বপরি বিশ্ব সাহিত্যকে প্রভাবিত করে চলেছে মৈমনসিংহ গীতিকা। পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা, মৈমনসিংহ, ঢাকা ছিল একই বৃত্তে অবস্থিত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দশটি পালাগানের সংকলন এই মৈমনসিংহ গীতিকার পশ্চাতে রয়েছে যে ত্রয়ীর অবদান, আজ ক’কজই বা মনে রেখেছে তাদের! দীনেশচন্দ্র সেন ছাড়াও চন্দ্রকুমার দে, কেদারনাথ মজুমদারেরও যে অবদান রয়েছে তা ক’জন জানে! অথচ মৈমনসিংহ গীতিকার সঙ্গে এই তিনজনের নাম ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে। আজ মৈমনসিংহ গীতিকার একশো বছর পূর্তিতে তাঁদের অবদানকে ফিরে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে আর একবার চিনে নেবার।

সম্পাদক ও প্রকাশক দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬- ১৯৩৯)

ইংরাজি ও বাংলায় প্রকাশিত মৈমনসিংহ গীতিকায় দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি রিডার দীনেশচন্দ্র সেন। দশটি পালাগান নিয়ে মৈমনসিংহ গীতিকা ১৯২৩ সালের মার্চে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (university of Calcutta) বই হয়ে ‘Eastern Bengal Ballads- mymensing (vol-1, part-1)’ নামে প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায়। ঐ বছরেই নভেম্বর মাসে বাংলায় প্রকাশিত হয় ‘মৈমনসিং হ গীতিকা’।

 মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পর দীনেশচন্দ্র সেনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- “বাংলার প্রাচীনসাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুস্করিণী; কিন্তু মৈমন- গীতিকা পল্লীহৃদয়ের গভীরস্তর থেকে স্বতঃ উচ্ছসিত উৎস, অকৃ্ত্রিম বেদনার স্বচ্ছ ধারা। বাংলা সাহিত্যের এমন আত্মবিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি। এই আবিষ্কৃতির জন্য আপনি ধন্য।“

শুধু মৈমনসিংহ গীতিকা নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । কবি জয়দেবের সমসাময়িক আর এক বিখ্যাত কবি, ‘পবনদূত’ এর রচয়িতা ধোয়ীর বংশধর দীনেশচন্দ্র সেন ছোট থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। লক্ষণ সেনের সভাকবি ও বন্ধু ধোয়ী ছিলেন সেযুগের মহা পণ্ডিত বক্তি। দীনেশচন্দ্রের ঠাকুরদা রঘুনাথ সেন ঢাকা জেলার সুয়াপুরের বিখ্যাত কবিরাজ এবং বাংলা ও ফারসি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। আইনজীবী ঈশ্বরচন্দ্র সেনের একমাত্র পুত্র দীনেশচন্দ্র ছিলেন ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র। তবু তিনি ছোট থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি টান অনুভব করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই দিদির মুখে শুনে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেকটাই মুখস্ত করে ফেলেছিলেন। দশ বছর বয়সে ‘জলদ’ নামে একটি কবিতা ভারত সুহৃদ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতা বড়দের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর রচনা শৈলীর জোরে মাত্র পনের বছর বয়সে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আর একটি কবিতা ‘পূজার কুসুম’।

 ছাত্রাবস্থা শেষ না হতেই বাড়িতে পর পর কয়েকটি দুর্ঘটনায় দীনেশচন্দ্রের দুই বোন, বাবা ও মা পরলোক গমন করলেন। সংসারের দায়িত্ব সামলাতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে হবীগঞ্জের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফণীভূষণ সেনের কাছে মাসিক চল্লিশ টাকা বেতনে তৃ্তীয় শিক্ষকের পদে যোগ দিলেন। এই সময় তিনি মামাতো দাদা ফণীভূষণের বাড়িতেই থাকতেন, সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও করতেন। কবিতা লিখতেন, বই পড়তেন ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থিত হতেন। এরই মধ্যে ইংরাজি অনার্স সহ স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইন্সটিটিউশনে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে প্রধানশিক্ষকের পদে যোগ দিলেন। কিন্তু এর পরেই কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইন্সটিটিউশনের চাকরি ছেড়ে ভিক্টোরিয়া গভর্নমেন্ট স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। এই সময় বেশ কিছু বাংলা কবিতা লিখেছিলেন। ১৮৯০ সালের এপ্রিলে ‘কুমার ভূপেন্দ্র সিংহ’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এক অগ্নিকাণ্ডে প্রেস থেকে আসার পরের দিনই পুড়ে যায় তার সব কপি।

 ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও তিনি ইংরেজ ও তাদের সাহিত্যের অন্ধ ভক্ত ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতীয় সাহিত্য বহু প্রাচীন সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল অপার। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় লিখতেন নানা প্রবন্ধ। জন্মভূমি পত্রিকায় ১৮৯১ সালে লিখলেন ‘সেক্সপীয়ার বড় না কালীদাস বড়?’, পরের বছর অনুসন্ধান পত্রিকায় লিখলেন ‘বাল্মীকি ও হোমার, রামায়ণ ও ইলিয়ড’ এর মত প্রবন্ধ। ১৮৯২ সালে নবজীবন, জন্মভূমি, অনুসন্ধান নামক অন্যান্য পত্রিকার মত কলকাতার পিস এসোসিয়েশনে একটি প্রবন্ধ পাঠালেন। বঙ্গভাষার উত্পত্তি ও পরিপুষ্টি সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রবন্ধ বিদ্যাসাগর পদক জিতে নিয়েছিল। শুধু তাইই নয়, বাংলার পুথি খুঁজে খুঁজে উনি লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও।

একসময় ‘মগলুব্ধ’ নামের একটি বই দেখার পরই তিনি পুরোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক অপ্রকাশিত পুথির খোঁজ পেলেন। খুঁজে বার করলেন সঞ্জয়ের মহাভারত, পেয়ে গেলেন গোপীনাথ দত্তের দ্রোণপর্ব্ব, দ্বিজেন্দ্র দাসের শকুন্তলা, দ্বিজ কংসারির প্রহ্লাদ চরিত্র, রাজারাম দত্তের দণ্ডীপর্ব্ব, ষষ্ঠীবর ও গঙ্গাদাসের মহাভারতোক্ত উপাখ্যান, পরাগলি মহাভারত প্রভৃতি সহ প্রায় একশোটি অপ্রকাশিত বই। সে সব বই গৃহস্থের কারাগার থেকে মুক্তি পেল। পরে এই বই বা পুথি সম্পর্কে লিখলেন সাহিত্য পত্রিকায়। গ্রামের অনুপযুক্ত পরিবেশে এতো মূল্যবান বই পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দেখে তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠোলেন। কিন্তু সারা বাংলা জুড়ে গ্রামে গঞ্জে যত বই লুকিয়ে আছে তা তাঁর একার পক্ষে খুঁজে বার করা সম্ভব নয় বলে মনে করলেন। তবু হাল ছাড়লেন না, যোগাযোগ করলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ডক্টর হোরন লি সাহেবের সঙ্গে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর আগ্রহের বিষয় সম্পর্কে জেনে খুশি হয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিত শ্রীবিনোদ বিহারী কাব্যতীর্থকে তাঁর সঙ্গে এই কাজে সহযোগীতার জন্য পাঠালেন।  তাঁর কাকা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালীকিঙ্কর সেনের সহযোগীতায় বিনোদ বিহারী ও তিনি মফস্বলের ক্যাম্পে থেকে গ্রামে গ্রামে হন্যে হয়ে ঘুরে পুরাতন বই খুঁজেছেন। ঢাকা নোয়াখালি, ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট ঘুরে ঘুরে, কখনো ঘন জঙ্গলে, কখনও কাদাজলে পায়ে হেঁটে, কখন হাতির পিঠে চড়ে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বই খুঁজেছেন। মাঝে মাঝে বিনোদ বিহারী দু’ তিন মাসের জন্য যখন বাড়ি যেতেন তখন দীনেশচন্দ্র সেন একাই বই খুঁজে বেড়াতেন এমনই একাগ্রতা ছিল তাঁর। এভাবেই পেলেন আলাওলের পদ্মাবতী, রাজা জয়নারায়ণ ঘোষালের কাশিখণ্ড, রামেশ্বর নন্দীর মহাভারত, মধুসূদন নাপিতের নল দময়ন্তী। অতি কষ্টে খুঁজে খুঁজে বই সংগ্রহ করে তা নিয়ে লিখলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। এই দুঃসাধ্য কাজ করার পর বইটি প্রকাশের জন্য সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ত্রিপুরার ম্যাজিস্ট্রেট গ্রিয়ারসন সাহেব, যিনি ১৮৭৮ সালে উত্তর বাংলার রংপুরের চাষীদের থেকে গান সংগ্রহ করে দেবনাগরী হরফে ‘মানিক রাজার গান’ নামে গীতিক প্রকাশ করেন। তাঁরই সহযোগিতায় ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র মাণিক্য বই প্রকাশের ব্যয় ভার নিতে রাজি হলেন। ১৮৯৬ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হল বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের প্রথম সংস্করণ। আসলে তিনি ব্রিটিশদের দেখাতে চেয়েছিলেন শুধু ইংরাজি সাহিত্যেরই ইতিহাস নেই, বাংলা সাহিত্যেরও গৌরবের ইতিহাস আছে।

   ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশ হতেই রবীন্দ্রনাথ উচ্চ প্রশংসা করে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পত্রমিতালী শুরু হয় তখন থেকেই। রবীন্দ্রনাথের ক্ষণিকা, কথা প্রকাশের পর তা দীনেশচন্দ্রকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। এই সময় দীনেশচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিত্সার কারণে বারবার কলকাতায় আসতে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করলেন। ১৭ নম্বর শ্যা্মাপুকুর স্ট্রিটের এক বাসায় থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতে সাক্ষাত করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। দু’ জনের মধ্যে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হওয়ায় দীনেশচন্দ্র বেশ কয়েকবার শান্তিনিকেতনেও গেছেন। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের দ্বিতীয় সংস্করণের সময় রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেনন।

    এরই মধ্যে ১৯০৫ সালে পণ্ডিত রজনীকান্ত গুপ্ত মারা গেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পরীক্ষকের পদ খলি হয়। দীনেশচন্দ্র সেই পদের জন্য আবেদন করেন। ততদিনে তিনি ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ লিখে সরকারী বৃত্তি লাভ করেছেন। যোগ্যপ্রার্থী হিসাবেই বি এ পরীক্ষার বাংলা পরীক্ষকের পদে যোগ দেন মাসিক আটশো টাকা বেতনে।  ১৯০৯ সালে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য তাকে রিডার করা হল। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার হলেন। সিন্ডিকেতে সমালোচনা হলেও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে রিডারের পদে নিয়োগ করলেন। অনেকে এও বললেন যে বাংলা ভাষার গৌরব এতো বড় নয় যে তার জন্য একটা রিডারের পদ সৃষ্টি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিযুক্ত হলেন। পরের বছর সেনেটের সদস্য হলেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ পেলেন।

 দীনেশচন্দ্র সেন রিডার হয়ে মোট পাঁচ বছরে যে যে বক্তৃতা দেন তা সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হল “ History of Bengali Language and Literature” নামক বই। এই বইয়ের বক্তৃতা গুলি ছিল “Chaitaniya andi His Companions, Old Bengali literature, Bengali ramayanas, The Folk Literature of Bengal, chaitaniya and his age.”।

সিন্ডিকেটের প্রবল আপত্তি সত্বেও রামতনু লাহিড়ী ফেলোশিপ এ দ্বিতীয় বারের জন্য নির্বাচিত হন। তখন ফেলোশিপের জন্য দীনেশচন্দ্র সেনের থেকে যোগ্য প্রার্থী কেউ ছিল না তবু তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছিল।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার চক্রান্তের শিকার হয়েছেন আর বারবার স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে রক্ষা করেছেন। সিন্ডিকেটের সদস্য হবার পর তিনি বুঝতে পারছিলেন বাংলা ভাষার প্রতি কতটা ঘৃণা রয়েছে অন্যান্য সদস্যদের। তারা বেশিরভাগই চসার ও স্পেন্সারের কবিত্বে মুগ্ধ, তারা মুকুন্দরামের চণ্ডী মঙ্গল কাব্য, মাধব আচার্যের গঙ্গামঙ্গল কাব্য, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের নাম শুনলেই নাক সিটকান, শেক্সপিয়র পড়ে বোঝেন কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীর রসাস্বাদন করতে চাননা। 

  তিনি বাংলায় স্নাতোকোত্তর বিভাগ চালু করতে চাইলে তা নিয়েও বিরোধিতা শুরু হয়। ফ্যাকাল্টি সভায় কারো কারো প্রশ্ন ছিল - “প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে কী এমন ছাই ভষ্ম আছে?... বাংলায় লেখা মুদির দোকানের পাঠ্য কতগুলি খাতাপত্র পড়াবার জন্য আবার এম এ ক্লাস!” 

   এর উত্তরে দীনেশচন্দ্র বলেছিলেন- “মশাই, বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক জিনিস আছে যা আপনি বহু চেষ্টা করেও বুঝতে পারবেন না। নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তি রত্নাকর’ সপ্তদশ শতাব্দীতে লেখা এই মোটা বই, রয়েল সাইজের প্রায় ছশো পৃষ্টা হবে! তার মধ্যে সঙ্গীত সম্পর্কে একটি অধ্যায় আছে, তাতে ভারতীয় প্রাচীন সঙ্গীত বিদ্যার এমন সূক্ষ আলোচনা আছে, যা এখনকার অনেক কলাবিদই জানেন না। কাশী বা দিল্লীর বাঘা বাঘা সঙ্গীতজ্ঞের শেখার মতো জিনিস আছে শুধু ঐ একটি অধ্যায়ে। ‘সহজিয়া সাহিত্য’ ও ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ প্রাচীন হিন্দু আর বৌদ্ধ দর্শনের সাথে এমন আঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে, যে ব্যক্তি ভারতীয় দর্শন একেবারে গুলে না খেয়েছেন তার পক্ষে এ দুই বই একেবারে অনধিগম্য। কাউওয়েল সাহেব যেদিন কবিকংকঙ্কে কবি চসারের সাথে তুলনা করে অতি শ্রদ্ধার সাথে তার রচিত চণ্ডীর ইংরাজি অনুবাদ করেন, আপনি কি জানেন, সেই অনুবাদ পড়ে অনেক ইংরেজ পণ্ডিত মুগ্ধ হয়ে গেছেন? সিস্টার নিবেদিতা রামপ্রসাদের কবিত্ব, হুইটম্যান, ব্লেকের থেকেও শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য ‘মাদার কালী’ নামে মস্ত একখানা বই লিখে ফেললেন। সেই বই পড়ে আপনাদের ইংরেজ পণ্ডিতরা আর একবার হাই তুলে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। এই তো আমাদের দেশের অবস্থা। আমরা হলাম আত্মবিস্মৃতির জাতি, তাই নিজেদের গৌরবের ধনকে ব্যঙ্গ করতে মরমে মরে যাই না।“

  এমন কি বাংলা বিভাগের জন্য আগে থেকেই লড়াইকারী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ‘একটা কথা বলুন তো দীনেশবাবু, আপনার সত্যিই কি মনে হয় বাংলায় শেক্সপিয়র বা মিল্টনের মতো কবি আছেন?

এর উত্তরে দীনেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘আছেন বৈকি। তবে অপরাপর স্বাধীন জাতির মতো ঢাক, ঢোল, দামামা পেটাবার সাধ্য তো আমাদের নেই। যদি থাকত তবে আমাদের দেশের প্রাচীন কবিদের স্থান মুদির দোকানে হত না, তারাও রাজ সিংহাসনের দাবি করতেন।‘

    অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালুর জন্য তোড়জোড়ও শুরু হল। তাকে ঢেলে সাজানোর জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক জেমস ড্রামণ্ড আন্ডারসনের সহযোগিতা করলেন, সিলেবাসের খসড়া করে পাঠালেন তিনি। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বসন্ত রঞ্জন রায়, শশাঙ্ক মোহন সেন, রাজেন্দ্র শাস্ত্রী প্রমুখ বাংলার তত্কালীন পণ্ডিত ব্যক্তিদের অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করে শুরু হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। ১৯২১ সালে ভার্নাকুলার অ্যাক্টএর দ্বারা এম এ পরীক্ষা চালু হল। ইংরেজ শাসন আর ইংরাজি সাহিত্যের আমলে বাংলার জয় হল।

    দীনেশচন্দ্র সেন যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেশাল ইউনিভার্সিটি প্রফেসার, রিডার ও বাংলা বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন, লিখে ফেলেছেন তিনবন্ধু, বেহুলা, সতী, ফুল্লরা, জড়ভরত, রামায়ণী কথার মতো বই তখন সৌরভ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে’র ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ পড়ে ওই লেখকের প্রতি আকৃ্ষ্ট হলেন। এই সৌরভ পত্রিকা যেহেতু তাঁর পুরোনো বন্ধু কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন সেহেতু খোঁজ পেতে বেগ পেতে হয়নি। তবে চন্দ্রকুমার দে’র অসুস্থতার জন্য বছর দু’ এক অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। শেষে ১৯১৯ সালের অক্টোবরে দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন। দীনেশ চন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস –চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুমতি নিয়ে বেতনভোগী (মাসে সত্তর টাকা) পালাগান সংগ্রাহক বা ক্ষেত্র সমীক্ষক হিসাবে তাঁকে নিয়োগ করলেন। চন্দ্রকুমার অত্যন্ত পরিশ্রম করে এক বছরে মৈমনসিং হ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট একুশটি পালাগান সংগ্রহ করে এনে দিলেন। অবশেষে যে বছর তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় বাহাদূর উপাধী পান সেই বছরেই, ১৯২১ সালের ৯ মার্চ চন্দ্রকুমার দে’র সংগ্রহ করা গান গুলি হাতে পান। এই গান গুলি বেশির ভাগই মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ থেকে সংগৃহীত। ১৯২৩ সালের মার্চে একুশটি পালাগানের থেকে মহুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ানা মদিরা, দস্যু কেনারামের পালা, মলুয়া, কঙ্ক ও লীলা, দেওয়ান ভাবনা, কাজলরেখা ও রূপবতী নামের মোট দশটি পালাগানকে সম্পাদনা করে, ইংরাজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। সেই অনুবাদের নাম দেন ‘Eastern Bengal Ballads- mymensing(vol-1, part-1)’। পরে প্রকাশিত বাংলা সঙ্কলনের নাম দেন ‘মৈমনসিং হ গীতিকা’। বলাবাহুল্য বাংলার পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকা পালাগানের সুতোকে বিশ্বসাহিত্যের বেনারসির তাঁতে তিনিই বসালেন, আর ‘গীতিকা’ নামেও অবিহিত করলেন।

   দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা ও ইংরাজি উভয় সাহিত্যেই বিশেষ পারদর্শী ছিলেন- বৈষ্ণব পদাবলী, চণ্ডীমঙ্গল, রামায়ণ, মহাভারতত যেমন তাঁর মুখস্ত ছিল তেমনি শেক্সপিয়র ইলিয়ডও মুখস্ত ছিল। তবু তিনি তাঁর কাজের ক্ষেত্রে বাংলার ঐতিহ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথায়। তিনি দেখেছিলেন এই বাংলাতেই হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি সুখে দুঃখে বাস করে। তিনি নিজে দেখেছেন ত্রিপুরার গোল মহম্মদকে সপারিষদ ঝিঝিট রাগে কালীকীর্তন শোনেতে, পীরের দরগায় হিন্দুদের দেখেছেন সিন্নি চড়াতে। তিনি এনামেল হক সাহেবের থেকে জেনেছেন এবং আকৃ্ষ্ট হয়েছেন মোহাম্মদ আকবরের প্রতি, যিনি ‘জেবল মুলুক শামারোখ’ কাব্যে লিখেছেন। যিনি লিখেছেন-

“…হজরত রসুল বন্দি প্রভুর নিজ সখা।

হিন্দুকুলে অবতারি চৈতন্যরূপে দেখা।।

খোজায় খিজির বন্দুম জলেত বসতি।

হিন্দুকূলে বাসুদেব, শূণ্যে যে প্রকৃ্তি।।

আছব্বা সকল বন্দি নবীর সভায়।

হিন্দুকূলে দোয়াদশ গোপাল ধেয়ায়।।“

 

  পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ চক্রান্তেই ১৯৩৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলীম লিগের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর যা আরো বেড়ে যায়। এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালির উদ্দেশ্যে পরপর চারটি বক্তৃতা দেন যে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ছিল হিন্দু ও মুসলমান আসলে বাঙালি জাতি- তারা একজাতি, একপ্রাণ। এই বক্তব্যগুলিই পরে ১৯৩৮ সালে ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ নামে প্রকাশিত হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে চন্দ্রকুমার দে শুধু মুসলমান চাষীদের কাছ থেকে দেড়শোটি পালাগান পেয়েছেন।

   তাঁর মাতামহ গোকূল কৃ্ষ্ণ মুন্সী ফারসি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। পিতামহ রঘুনাথ সেন মোক্তারে ফারসি পড়াতেন। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেছিলেন। তিনি মনে করতেন,

“হিন্দু মুসলমান এদেশে চালে চালে ঠেকাঠেকি হইয়া বাস করিতেছে। হিন্দু গৃহের মাধবীলতার ফুল মুসলমান গৃহের চালায় যাইয়া ফুটিতেছে এবং মুসলমান গৃহের এককোণ হইতে চন্দ্র রশ্মি হিন্দু মন্দিরের উপর পড়িতেছে।“

  দীনেশচন্দ্র বাংলা সাহিত্যকে, বাংলা ভাষাকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি দেশকেও ভালোবাসতেন।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের আগেই পরলোক গমন করলেন যিনি, তিনি লিখে গেলেন,

“বাহ্য দৃষ্টিতে হিন্দু, মুসলমান, দেশীয় খৃষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি নামী দেশবাসী শতধা- খণ্ডিত, কিন্তু অন্তরদৃষ্টি সহকারে লক্ষ্য করিলে দেখা যাইবে, ইহাদের একই আদর্শ, একই অনুপ্রেরণা এবং একই বৈশিষ্ট্য। সাম্প্রদায়িক যতপ্রকার বৈষম্যই থাকুক না কেন, বাংলার জনসাধারণেরই একনাম জানি, ইহারা বাঙ্গালী এবং এই নামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আমি আমার জাতিকে পুনঃ পুনঃ আন্তরিক প্রীতি জ্ঞাপন করিতেছি।“

মৈমনসিংহ গীতিকায় অন্যান্য বৈশিষ্টের সঙ্গে তত্কালীন সামাজের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় চিত্র ফুটে ওঠে। তার একটি উদাহরণ হল এই পংক্তি কটি--

“উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্বত।

যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাত্তর।

পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান।

উদরিশে বাড়ায়ছালাম মমিন মুসলমান।।

সভা কইর‍্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান।

সভার চরণে আমি জানিলাম সেলাম।।“

    যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সাহিত্য সাধনার পীঠস্থান ছিল, সারা বছর তার লিখিত বা সম্পাদিত গ্রন্থের কাছে সেখানকার ছাপাখানা ব্যাস্ত থাকত, সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২৪ সালে আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নিলে এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা গেলে তাঁকে প্রতি নিয়ত অপমান ও অপদস্থ হতে হয়েছে।

সহকর্মী কবি জসীমুদ্দিন স্মৃতিকথায় লিখলেন, “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বত্সরগুলিতে দীনেশবাবুর জীবন বড়ই অসহায় ছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দল বড়ই কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। শনিবারের চিঠি ‘শ্রীদীনেশ’ নাম দিয়া ধারাবাহিকভাবে তাঁকে গালাগালি দিতেছিল। স্যার আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করিতেছেন। পিতার অনুরক্ত এই মহামনীষীকে তিনি অগণ্য শত্রুগণের বুহ্য হইতে রক্ষা করিতে সাহস করিলেন না। আজীবন সাহিত্য সাধনার পীঠভূমি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে দীনেশবাবুকে বিদায় গ্রহণ করিতে হইল। কেহ তাঁহাকে কোন ফুলের মালা দিল না। কোনো বিদায় অভিনন্দনের ব্যবস্থা হইল না। অকৃ্তজ্ঞ বাঙা্লি জাতি এইভাবে সেই বাংলা সাহিত্যের অক্লান্তসেবীর প্রতি কৃ্তজ্ঞতা জানাইল”।

আজ একশো বছর পরেও কি বাঙালি জাতি তাঁর প্রতি কোনো কৃ্তজ্ঞতা জানাবে না?]

                                         

    শুধু তাইই নয়, শনিবারের চিঠি ‘শ্রীদীনেশ’ শিরোনামে তাঁর সমালোচনা করেছে ধারাবাহিকভাবে। চর্যাপদের ভাষা বিতর্কের কারণে একদা স্বয়ং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন, আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের মত ব্যক্তিত্বরাও তাঁকে আক্রমণ করেছেন। তাঁরা তখন মৈমনসিংহ গীতিকার খুঁত ধরতেই ব্যস্ত, এই আবিষ্কার যে বাংলা সাহিত্যের তথা বাংলা সমাজজীবনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে বিকশিত করতে পারে তা নিয়ে বলেননি। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘A Pillar of our university’ ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার সময় তিনি দলবদ্ধ অত্যাচারে পরাজিত এক মানুষ। কিন্তু এই মানুষটিই বলেছিলেন, “হিন্দু ও মুসলমান আসলে বাঙালি জাতি- তারা একজাতি, একপ্রাণ”। মৈমনসিংহ গীতিকা সম্পর্কে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গিয়েছিলেন- “এই গীতিসাহিত্য হিন্দু মুসলমান উভয়ের, এখানে পণ্ডিতগণের রক্তচক্ষে শাসাইবার কিছু নাই”।

 

সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে(১৮৮৯-১৯৪৬)

কয়েকশো বছর ধরে মৈমনসিংহের বাতাসে ভেসে থাকা এই গাথাকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মৈমনসিংহের সন্তান চন্দ্রকুমার দে একশো বছর আগে কলমবন্দী করেছিলেন। শুধু তাই ই নয়, তিনি তা বাংলা তথা কলকাতার শিক্ষিত সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিলেন। নিজেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন বলেই তিনি কবি ও সাহিত্যিক হবার জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে অনবরত লড়াই করেছেন, লড়াই করেছেন ভগ্ন স্বাস্থের সঙ্গে, লড়াই করেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে। তবে এই লড়াইয়ে তাঁর একেবারে পরাজয়ও হয়নি। কবি বা সাহিত্যিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলেও শেষপর্যন্ত মৈমনসিং হ গীতিকার সংগ্রাহক রূপে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দাগ কাটতে পেরেছেন চন্দ্রকুমার।   

   চন্দ্রকুমার দে মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা উপজেলার আইথর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রামকুমার দে। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাব ও ছোটবেলায় বাবা মা দুজনেই মারা যাওয়ার কারণে খুব বেশিদিন প্রথাগত শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে নিজের প্রচেষ্টায় তিনি অল্প স্বল্প বাংলা ও সংস্কৃত শিখেছিলেন। অল্প বয়সে গ্রামের একটি মুদির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজে মনোযোগ না থাকায় কাজটি ছেড়ে যায়। পরে ঐ গ্রামেই তারকনাথ তালুকদারের কাছে কর আদায়ের কাজ পান মাসিক দু’টাকা বেতনে। এই সময় কর আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাঁকে। তখনই এই গ্রামে প্রচলিত পালাগানের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। দরিদ্র চাষীদের মুখ থেকে অনেক গান সংগ্রহ করতেন। তবে তিনি কর আদায় করতেন কম, গান শুনতেন বেশি। তিনিই প্রথম এই গান বা আখ্যানকাব্যগুলি সংগ্রহ করে লিখে রাখতেন। এই লেখার নেশা তার ছোট থেকেই। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস সবই লিখতেন এবং ভালোই লিখতেন। এই সময় মৈমনসিংহ থেকে “সৌরভ” নামে একটি অতি উত্কৃষ্ট মানের পত্রিকা প্রকাশিত হত। কেদারনাথ মজুমদার পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। বাইশ/তেইশ বছরের যুবক চন্দ্রকুমার দে ১৯১২ সাল থেকে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন এই পত্রিকায়। এই পত্রিকার জন্য ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ নামে চন্দ্রাবতীর উপাখ্যান লেখা শুরু করেন। ১৯১৩ সালের এপ্রিল সংখ্যা থেকে “মালীর যোগান” নামে লোক সাহিত্যের ওপর লেখা প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রচলিত কতগুলো গান কবিতার মতো করে প্রকাশ করেন।  আবার ‘লোহার মাঞ্জাস’ নামে একটি কাব্য লিখতে শুরু করেও অসুস্থতার কারণে সপ্তমসর্গ পর্যন্ত লিখে আর শেষ করতে পারেনি। একবার কেদারনাথ মজুমদার সৌরভ পত্রিকার অফিসে ডেকে এনে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে জানতে পারেন তাঁর অভাব অনটনের কথা। সহযোগিতায় চন্দ্রকুমারের অন্য একটি কাজ জোগাড় হয়। মৈমনসিং হ জেলার গৌরীপুরের কালীপুর এস্টেটের জমিদার বিজয়কান্ত লাহিড়ীকে বলে মাসিক আট টাকা মাইনের তহশিল আদায়ের কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হিসাবের খাতায় গ্রামের গায়েনদের গাওয়া বিভিন্ন পালাগান লিখে রাখতেন। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা কর্তব্যে অবহেলা এনে দিল। এই চাকরিটিও চলে গেলো।

 তিনি সৌরভ পত্রিকায় লেখার জন্য অদম্য পরিশ্রম করতেন, এক সময় দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখেছিলেন, “সেই সময় শরীরের দিকে দৃকপাত না করিয়া গুরুতর পরিশ্রম করিতাম। প্রাতে পত্রিকার জন্য গল্প, বিকালে উপন্যাস ও গভীর রাত্রে ‘লোহার মাঞ্জাস’ লিখিতাম”।

  তিনি ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সেটি পড়েই দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর খোঁজ করেন। সৌরভ পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার দীনেশ চন্দ্র সেনের পুরোনো বন্ধু ছিলেন। দীনেশ চন্দ্র তাঁকে চিঠি লিখলেন। প্রথমে তাঁর সংসারের চরম অভাব ও মাথা খারাপ হয়ে যাবার খবর পেয়েছিলেন। কিন্তু এর দু’বছর পর চন্দ্রকুমারের সুস্থতার খবর পেলেন। কেদারনাথ মজুমদারের সহযোগিতায় ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। হত দরিদ্র চন্দ্রকুমার দে কলকাতায় আসার জন্য স্ত্রীর দু’একটি রুপোর গহনাও বিক্রি করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনও তাঁর চিকিত্সার ব্যবস্থা করলেন - কবিরাজ যামিনীভূষণ রায় চন্দ্রকুমারের চিকিত্সা করলেন। পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতিতে সংগ্রাহকের কাজে যোগ দিলেন। দীনেশ চন্দ্রের কথা মত মৈমনসিংহ জেলায় ফিরে গিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে, পালাকারদের মুখে শুনে পালা সংগ্রহ করতে লাগলেন। দীনেশ চন্দ্র সেনের সঙ্গে চলল চিঠি বিনিময়, মতের আদান প্রদান। এনে দিলেন দেড়শোটি মত পালাগান। কিন্তু সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা পালাগানকে সংগ্রহকরা তাঁর একার পক্ষে অসম্ভব বুঝতে পেরে দীনেশচন্দ্র সেন আরো কয়েকজনকে কাজে লাগাতে চাইলেন। উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জির পরামর্শে তত্কালীন শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ওটেন সাহেব সংগ্রাহকের কাজের জন্য একেক জনকে মাসে সত্তর টাকা করে দিতে রাজি হলেন। বিজ্ঞাপন দেখে অসংখ্য আবেদন জমা পড়লেও শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাজ পেলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী, আশুতোষ চৌধুরী, কবি জসিমুদ্দিন।

 চন্দ্রকুমার দে শুধু সংগ্রাহকই ছিলেন না মৈমনসিংহ গীতিকার সমালোচকও ছিলেন। ভারতবর্ষ পত্রিকায় ‘ময়মনসিংহের পল্লীকবি’ শিরোনামে ধোপার পাট ও বিরহিনী কাঞ্চনমালার কাহিনি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেছেন। সাহিত্যসেবার জন্য নিশ্চিত রোজগারের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া এমন দরিদ্র, ভগ্নস্বাস্থ্য, নিঃস্বার্থ সাহিত্য সেবী বাংলা সাহিত্যে বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

 

সহায়ক কেদারনাথ মজুমদার(১৮৭০- ১৯২৬) ও সৌরভ পত্রিকা

 

“সাহিত্য জনজীবনে এক নবশক্তি সঞ্চার করে। প্রকৃতির শিক্ষা এবং লৌকিক শিক্ষা সাহিত্যের প্রধান সহায়।“

        - সাহিত্য সম্পর্কে একথা বলেছিলেন যে ব্যক্তি সেই কেদারনাথ মজুমদারের নামটি মৈমনসংহ গীতিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বিগত একশো বছর ধরে। দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্র কুমার দে কে খুঁজে পেয়েছিলেন এই কেদারনাথ মজুমদারের জন্যই। এই কেদারনাথ মজুমদার কলকাতার বাবুয়ানা থেকে বহু দূরে মৈমনসিংহ জেলায় বসে সাহিত্যসেবা করতেন নীরবে। তিনি সারাজীবন সাহিত্যসাধনা করেছেন তাই ই নয়, তিনি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলেছেন, ইতিহাসের খোঁজে ফিরেছেন, ইতিহাস লিখেছেন এবং একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এই কেদারনাথ মজুমদারের পত্রিকাতেই লিখতেন চন্দ্রকুমার দে। যেহেতু দীনেশচন্দ্র সেনের বিশেষ বন্ধু ছিলেন কেদারনাথ মজুমদার তাই কেদারনাথের কাছে চিঠি লিখে চন্দ্রকুমার দের সন্ধান চেয়েছিলেন। কেদারনাথেরই সহযোগিতায় চন্দ্রকুমার দেকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। আর একথা তিনি মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকাতে লিখেও গেছেন। এই কেদারনাথ মজুমদার শুধু যে জেলায় বসে কলকাতার শিক্ষিত সাহিত্য সমাজের আড়ালে থেকে নীরবে পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন তাই ই নয়, এই ইতিহাস উত্সুক ও বাংলা সাহিত্যের নিষ্ঠাবান সাধক নতুন প্রতিভাকে খুঁজে বার করতেন।

   তত্কালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধান শহর কলকাতা থেকে বহু দূরে মৈমনসিংহ জেলায় বসে কেদারনাথ মজুমদার মোট পাঁচটি সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলি কুমার, বাসনা, আরতি, শিক্ষা, সৌরভ নামে প্রকাশিত হয়। তবে এই পত্রিকাগুলির মধ্যে আরতি ও সৌরভ নামের মাসিক পত্রিকা সেই সময় বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। এছাড়াও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থ যেখানে সংরক্ষিত ছিল, সেই মৈমনসিংহের দুর্গাবাড়ি ধর্মসভা গ্রন্থাগারটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাঁর রচিত অনেকগুলি হারিয়ে যায়। বর্তমানে তাঁর রচিত দশটি গ্রন্থ পাওয়া যায় মাত্র। তার মধ্যে তিনটি আঞ্চলিক ইতিহাসের বই, তিনটি গবেষণা মূলক বই এবং কথাসাহিত্য চারটি।

 তাঁর লিখিত আঞ্চলিক ইতিহাস হল- ঢাকার ইতিহাস, ফরিদপুরের ইতিহাস, ময়মনসিংহের ইতিহাস। গবেষণামূলক গ্রন্থের মধ্যে আছে- রামায়ণের সমাজ, সারস্বত কুঞ্জ, বাংলার সাময়িক সাহিত্য। কথা সাহিত্যের মধ্যে আছে- স্রোতের ফুল, চিত্র, শুভদৃষ্টি, সমস্যা। তাঁর রচিত গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে পারা যায় পরবর্তিতে তাঁকে নিয়ে তাঁর ভাইয়ের লেখা থেকে।

যতীন সরকারের ‘কেদারনাথ মজুমদার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় কেদারনাথের ভাই নরেন্দ্র নাথ লিখেছেন-“ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলি লিখিয়া যেমন নিরাশ হইয়াছিলেন, উপন্যাস প্রকাশ করিয়া তেমন নিরাশ হইতে হয় নাই। তিন বত্সরে যে তিনখানা উপন্যাস প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহার দুইখানা পনঃসংস্করণ করিতে হইয়াছে। ইহাই বাঙালি পাঠকের নির্বাচন-রুচির প্রকৃ্ষ্ট নিদর্শন, ইতিহাস লেখকের নিরাশা ও অবসাদের অন্যতম কারণ।

 তাঁর গ্রন্থ সম্পর্কে যতীন সরকার লিখছেন, “আজকের দিনে কেদারনাথের ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলির প্রসঙ্গ যদিও বা উত্থাপিত হয় কখনও কখনও, তাঁর গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে আমরা একেবারে অজ্ঞ ও অসচেতন। তাঁর ‘চিত্রা’, ‘স্রোতের ফুল’, ‘শুভদৃষ্টি’, ‘সমস্যা’ আমরা চোখেও দেখিনি। কালের কবল থেকে বইগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হবে কি-না জানি না।“

 তবে বর্তমানে তাঁর কয়েকটি ইতিহাস গ্রন্থের পি ডি এফ পাওয়া যায়, সেই কারণে তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি অনেকে পড়ে যেমন সমৃদ্ধ হতে পারছেন তেমনি তাঁর লেখা ও গবেষণা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছেন।

   কেদারনাথ মজুমদার ১৮৭০ সালে ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬শে জৈষ্ঠ্য বুধবার মৈমনসংহ জেলার অন্তর্গত কিশোরগঞ্জ জেলার কাপাসাটিয়ার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এই কিশোর গঞ্জের গচিহাটা গ্রামেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল। তাঁর পিতা লোকনাথ মজুমদার বিশেষভাবে সাহিত্যানুরাগী ছিলেন বলে তাঁদের বাড়িতে বেশ বড় একটি গ্রন্থাগারও ছিল। বাবার মত তিনিও ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, তাঁদের পারিবারিক গ্রন্থাগারটি অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল মহাভারত প্রণেতা রামেশ্বর নন্দী ও ‘ভারত সাবিত্রী’র রচয়িতা বিধুরাম নন্দীর উত্তর পুরুষের। এছাড়াও মাতা জয়দুর্গা দেবীর সুললিত কন্ঠে ছোট থেকেই রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প শুনে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কার ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর অনুরাগ জন্মায়। পরবর্তীতে রামায়ণ নিয়ে বিশেষ পরিশ্রম সাধ্য গবেষণা মূলক বই রামায়ণের সমাজ রচনা করেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পড়া শেষ করে মৈমনসিংহ শহরে নাসিরাবাদ এন্ট্রান্স স্কুলে পড়া শুরু করেন। এই সময় তিনি তাঁর মামা কৃষ্ণকুমার রায়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন বেদজ্ঞ পণ্ডিত উমেশ চন্দ্র বিদ্যারত্ন। এই উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন কেদারনাথের জীবনে ও সাহিত্য সাধনায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলেন, বিশেষ করে রামায়ণের সমাজ সম্পর্কিত গবেষণা মূলক কাজে তাঁর অবদান রয়েছে বলে জানা যায়। যদিও এই নাসিরাবাদ স্কুল ছেড়ে কিছুদিন সিটি স্কুলে পড়েন এবং পরে ১৮৮৪ সালে মৈমনসিংহ জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি হন। এই জেলা স্কুলটিতে মৈমনসিংহের ব্রাহ্মসমাজের পীঠস্থান ছিল। এই স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষক ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন। ১৮৫৪ সালে মৈমনসিংহ জেলার ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসু, যিনি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা।

   এই স্কুলেই মনোরঞ্জিকা ক্লাব নামে একটি সংগঠন ছিল যেটি ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ক্লাবে ঙ্কুলের সেরা ছাত্রদের সঙ্গে মৈমনসিংহের বুদ্ধিজীবীরাও সদস্য হতেন। ক্লাবের নিয়ম ও শৃঙ্খ্লা মেনে প্রতি রবিবার অধিবেসন বসত। এই অধিবেশনে থাকতেন ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য আনন্দমোহন বসু ও ঢাকার নববিধান সমাজের প্রধান প্রচারক বঙ্গচন্দ্র রায়। নির্দিষ্ট বই থেকে ঈশ্বরের স্তোত্র পাঠ করে অধিবেশন শুরু হত। বড়রা নির্দিষ্ট বিষয়ে ইংরাজি ও বাংলায় বক্তৃতা দিতেন আর ছাত্ররা বিভিন্ন ধরণের রচনা বা স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করত। কেদারনাথ মজুমদার এই ক্লাবে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে উত্সাহ পেতেন সন্দেহ নেই। এই জেলার বিশিষ্ট ব্রাহ্মনেতা শ্রীনাথ চন্দ্র ছিলেন কেদারনাথের অন্যতম শিক্ষক। এই শিক্ষকের প্রভাব তাঁর জীবন ও সাহিত্যে পড়েছিল।

   ততদিনে ব্রাহ্মসমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এদের একটি ছিল সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, অন্যটি ছিল নববিধান নামে। এদিকে আবার মাথা চারা দিয়েছে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের তরঙ্গ। মৈমনসিংহ জেলার দুর্গাবাড়ির হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা প্রবলভাবে ব্রাহ্মবিরোধী ছিল। পরবর্তিতে তিনি নিজে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ না করলেও অন্তত তাঁকে যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ হতে সাহায্য করেছে এই ব্রাহ্মধর্মের সংস্পর্শ। ১৮৭৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘মৈমনসিংহ সারস্বত্ব সমিতি’ মাঝে নিষ্কৃ্য হয়ে পড়লে তাকে আবার পুনোরুজ্জীবিত করার জন্য স্থানীয় কিছু যুবক সহ কেদারনাথ এগিয়ে আসেন এবং সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। বিশেষ করে এই জেলার নতুন লেখকদের যন্ত্রে ছাপানো বইয়ের সঙ্গে পুরোনো লেখকদের হাতে লেখা বইয়ের প্রদর্শনের আয়োজন করতেন। গড়ে তুলেছিলেন মৈমনসিং হ সাহিত্য পরিষদ।

   কেদারনাথ মজুমদারের জীবনীকার যতীন সরকার দাবি করেন, কেদারনাথ কোনোদিনই স্কুলপাঠ্য বইয়ে মনোযোগী ছিলেন না। এমন কি ক্লাসেও মনোযোগ দিতেন না। ক্লাস চলাকালীন পিছনের বেঞ্চে বসে তিনি হয় অন্য বই পড়তেন অথবা গল্প প্রবন্ধ লিখতেন। তবে তিনি ১৮৮৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে প্রথাগত লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য অল্প বয়সে পিতা মারা যাওয়ার কারণে তাঁকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। লেখাপড়া ছাড়ার পর মৈমনসিংহের কালেক্টরিতে মামা কৃষ্ণকুমার রায়ের চেষ্টায় নকল নবিশীর চাকরি পান। সামান্য আয়ে সংসার চালাতে অসুবিধা হওয়ায় বিকল্প জীবিকা হিসাবে তিনি পাঠ্যপুস্তক, মানচিত্র প্রকাশ, ছাপাখানার ব্যবসাকে বেছে নিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাময়িক পত্র পরিচালনার সখ ছিল। বিশেষ করে জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ির ‘বালক’ পত্রিকার আদলে তিনি কুমার পত্রিকা প্রকাশ করতে চাইতেন। যখন তিনি দুর্গাবাড়ির দালানের কোঠায় খারুয়া গ্রামের ভূমধ্যিকারী মুরারী মোহন চৌধুরীর ‘সংসার যন্ত্র’ নামক প্রেস থেকে নিজে হাতে কম্পোজ করে ১২৯৫ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে ‘কুমার’ নামক সাময়িক পত্রটি প্রকাশ করেন তখন তিনি অষ্টম কি নবম শ্রেনিতে পড়েন। এই পত্রিকাটির যে কটি সংখ্যা প্রকাশিত হোক চারটি সংখ্যার কথাই জানা যায়।

‘কুমার’এর পর ঠাকুর বাড়ির ‘সাধনা’ পত্রিকার মত করে প্রকাশ করেছিলেন ‘বাসনা’। যদিও এই পত্রিকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করেই বন্ধ করে দেন। এরপর ১৩০৭ বঙ্গাব্দের পয়লা আষাঢ় ‘আরতি’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে বেদজ্ঞ উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সম্পাদনায় ‘আরতি’ প্রকাশিত হয়। ১৩০৮ সালে মৈমনসিংহ শহরে সাহিত্যসভার প্রতিষ্ঠা করেন সিলেটের প্রবীণ সাহিত্যসেবী রায় বাহাদূর রমণী মোহন দাসের সহযোগিতায়। এই রমণী মোহন দাসের উপর ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার ভার দেয় তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার। তিনি এই কাজের সহকারী হন আর পুরানো সরকারি দলিল ঘেঁটে দেখার সুযোগ পান। এই সময়ই এমন কিছু উপকরণ পেয়ে যান যা পরবর্তীতে তাঁকে ‘মৈমনসিংহের ইতিহাস’ লিখতে সাহায্য করে। মৈমনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রে্ট রমণী মোহন দাস বদলি হয়ে গেলে ‘আরতি’র ভার নেয় ‘সুহৃদ সমিতি’ আর সম্পাদক হন তিনি নিজে। কেদারনাথের ‘মৈমনসিংহের ইতিহাস’ প্রথম ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় এই পত্রিকাতেই। এর পর পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর বিশেষ চিকিত্সার কারণে কলকাতায় এলে আরতির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

   কিন্তু অসুস্থ শরীরে কলকাতায় এসেও তাঁর গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৩০৯ সালের শেষের দিকে একটু সুস্থ হয়েই তিনি কলকাতার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে দুষ্প্রাপ্য বইগুলি পড়তে শুরু করলেন। এমনকি  নিজে হাতে লিখে কিছু দুর্লভ বইয়ের নকল করাও শুরু করলেন।  আর্থারাইটিজ বা বাতরোগে পঙ্গু হয়ে গেলেও সেই অবস্থাতেই সাহিত্যচর্চার করতে থাকেন। তত্কালীন সাহিত্য, আর্যাবর্ত, ভারত মহিমা, নব্যভারত, বীণাপাণি, নির্মাল্য, প্রয়াস, ভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর রচিত গদ্য ও পদ্য প্রকাশিত হয়েছে।

   ১৩১৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের অধিবেশনে ‘সম্মিলন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার প্রস্তাব আসে। সেই সঙ্গে এটি মৈমনসিংহ থেকে প্রকাশ করার পরিবর্তে অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র ঢাকা থেকে প্রকাশ করতে চাইলেন। তাঁর ‘ঢাকা রিভিউ’ পত্রিকাটি ‘সম্মিলন’ পত্রিকার সঙ্গে একত্রে প্রকাশ করতে চাইলেন। কেদারনাথ মজুমদার পত্রিকা প্রকাশের টানে মৈমনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলেন কিন্তু রায়বাহাদুরের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় ঢাকা থেকে নিজের শহর মৈমনসিংহে ফিরে আসেন। স্বাধীনভাবে পত্রিকা চালানোর পরিকল্পনা করে অবশেষে ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে অর্থাৎ ১৯১১ সালে ‘সৌরভ’ নামক মাসিক পত্রিকাটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। প্রথমে পত্রিকাটি বইয়ের আকারে ছাপা হলেও পরে পত্রিকার আকারে ছাপা হতে থাকে। প্রথম সংখ্যায় পত্রিকাটি ছিল ৩২ পাতার, পরে এটির পাতা বেড়ে ৪৫ হয়েছিল। লেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মনোরম ছবিও ছাপা হত এই পত্রিকায়। সেই সঙ্গে পত্রিকার লেখার মানও ছিল উৎকৃষ্ট, বিষয় হিসাবে ছিল ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি। প্রথম পাঁচবছর এটি ঢাকার জগত আর্ট প্রেস থেকে সতীশচন্দ্র রায় ছাপিলেও পরে তাঁর আমলাপাড়ার বাড়িতে অবস্থিত ‘রিসার্চ হাউস’ থেকে কেদারনাথ মজুমদার নিজেই প্রকাশ করতেন। এই রিসার্চ হাউসটি তিনি ইতিহাস ও পুরাণের গবেষণার উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছিলেন। এই সৌরভেরই পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংখ্যা রামচন্দ্রের মৈমনসিংহের লিপি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল।

 তিনি অনেক আশান্বিত হয়ে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর সৌরভের প্রথম সংখ্যায় তিনি ‘আভাষ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন –

“…বঙ্গ সাহিত্যের কাননে বহু কুসুম বিকশিত হইয়াছে; কত কুসুম সৌরভ বিতরণ করিতেছে। এ কুসুম ক্ষুদ্র এবং ইহার সৌরভ অল্প হইতে পারে কিন্তু ভরসা- সরস্বতী অকিঞ্চনকে কখনো উপেক্ষা করেন না।“…

 এই পত্রিকার জন্য বিষয় ও লেখক নির্বাচন করতেন সুচিন্তিত ভাবে। স্থানীয় বিশিষ্ট লেখকের পরিবর্তে প্রতিভা সম্পন্ন নতুন লেখকের লেখাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন বিশিষ্ট লেখকের লেখা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার থেকে সম্ভাবনাময় নতুন লেখক তৈরি করে নেওয়া ভালো। সৌরভের লেখকরা সৌরভ সংঘ গড়ে তুলেছিলেন।    

   সৌরভ পত্রিকাকে বাংলা সাহিত্য যতটা মনে রেখেছে তাঁর সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারকে এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদানকে ততটা মনে রাখা হয়নি। কেদারনাথ মজুমদার সৌরভ পত্রিকা ছাড়াও আরো চারটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তা অনেকেই জানেন। তবে তিনি সাময়িক সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে গবেষণাও করেছিলেন। লিখেছিলেন সাময়িক পত্রিকার ইতিহাস। ১৮৭১ সাল থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত সাময়িক পত্রিকার ধারাবাহিক ইতিহাস লিখেছেন। লিখেছেন চল্লিশটি বাংলা সাময়িক পত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। এ ছাড়াও একশো পঁচিশটি সংবাদ পত্র ও সাময়িক পত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থেই ভেসে উঠেছে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক ইতিহাস। তার সেই বই থেকেই জানতে পারি বিশ্বে প্রথম সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয় চিন দেশে। মোঘলদের হাত ধরে তা ভারতে আসে- বাবর, আকবর, শাজাহানের সংবাদপত্র পাঠের কথা। সেই বইয়ে জানিয়েছেন ইউরোপে প্রথম সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয় ১৫৩৬ সালে ইতালির ভেনিসে আর ইংল্যান্ডে ১৫৫৮ সালে রানি এলিজাবেথের আমলে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়- দি ইংলিশ মার্কিউরি। বিশ্বে প্রথম সাহিত্য পত্রের সূচনা হয় ফ্রান্সের ১৬৬৫ সালে। সেখানকার পার্লামেন্টের সদস্য ডেনিস ডে স্যালো প্যারিস থেকে প্রকাশ করেন – দি জার্নাল দেজ স্কাভারস। তিনি দেখিয়েছেন- ১৯০৩ সালে গ্রেট ব্রিটেনে মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা আড়াই হাজার। আয়ারল্যান্ডেও তাই। আমেরিকায় প্রায় চার হাজার। তখন ভারতে পৌণে দু’হাজার। দেখালেন তখন মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হত প্রায় দেড় হাজার পত্রিকা, বোম্বে থেকে তিনশো তিনটি পত্রিকা, বাংলায় একশো তেষট্টিটি পত্রিকা, ব্রহ্মদেশে সাতান্নটি পত্রিকা এবং বিহার ও উড়িষ্যা থেকে প্রকাশিত হত কুড়িটি পত্রিকা। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভালোবাসা না থাকলে এমন কাজ করা যায় না। এছাড়াও বাংলার মফস্বলের সংবাদ পত্র নিয়েও আলোচনা করেছেন। তাঁর কাজের জন্যই জানতে পারি সে সময় ঢাকা, বরিশাল, মাদারীপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খাগড়া, চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, বরাহনগর, কাঁচড়াপাড়া, খড়দহ কুমারখালী থেকে কোন কোন পত্রিকা প্রকাশিত হত।

তাঁর নিজস্ব সংবাদ পত্র সৌরভে মৈমনসিংহের মহিলা কবিরাও লিখতেন। তৃ্তীয় সংখ্যায় প্রথম মহিলা কবির কবিতা প্রকাশিত হয়। শ্রীমতি হেমন্ত বালা দত্তের কবিতা ‘প্রার্থনা’। চতুর্থ সংখ্যায় একটি একাঙ্ক নাটক ‘প্রকৃ্তির অভিযান’ প্রকাশিত হল। এই সৌরভ পত্রিকা যে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে তা ঠিক কিন্তু কেদারনাথ মজুমদার বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে ততটা কি গুরুত্ব পেয়েছেন। সেপ্রশ্ন থেকেই যায়।

   কেদারনাথ মজুমদার শিক্ষা নামক একটি শিক্ষা বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯১৭ সালের ১৩ই আগষ্ট তার মায়ের নামে জয়দুর্গা এম ই স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পড়ে জয়দুর্গা ইন্সটিটিউট নামে হাইস্কুলে পরিণত হয়। তার ইচ্ছায় ও চেষ্টায় মৈমনসিংহের প্রতিটি স্কুলে ‘সাহিত্য সঙ্ঘ’ গড়ে উঠেছিল। এছাড়া বড়দের নিয়ে ‘মৈমনসিংহ সাহিত্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। ছোট বড় সবাইকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘কেদারমণ্ডলী’ নামের সাহিত্যসেবী সংগঠনও। পত্রিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশের জন্য কাউকে তোষামোদ করার থেকে নতুন, সুপ্ত প্রতিভাকে ঘষে মেজে তৈরি করে নিতেই পছন্দ করতেন। তিনি নিজে যাঁদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন এবং সৌরভ পত্রিকায় লিখতে উত্সাহ দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাহিত্যিক আব্দুল করিম, নুরুল হোসেন কাশিমপুর্রী, নেত্রকোনার সুধীরকুমার চৌধুরী, যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য, বঙ্কিমচন্দ্র সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে সুধীর কুমার চৌধুরীর কবিতা পড়ে প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কেদারনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুধীর কুমারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে প্রবাসী পত্রিকার সহ সম্পাদকের কাজ দেন। বঙ্কিমচন্দ্র সেনও পরবর্তীতে দেশ পত্রিকা সম্পাদনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

 কেদারনাথের জীবনীকার যতীন সরকার দাবি করেন, সুকুমার সেন বাংলা গদ্য নিয়ে গবেষণা করার বহু আগে ১৩১৫ বঙ্গাব্দে কেদারনাথ ‘সারস্বত কুঞ্জ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করান। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ছিল বাঙ্গালির ভাষার ও গদ্য সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সৌরভ পত্রিকায় গ্রন্থটির একটি বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। ১৩২১বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়-

“যাহারা মনে করেন বাংলা সাহিত্য শত বত্সরের নবীন সাহিত্য, তাহারা সাহিত্য- কুঞ্জে সহস্র বত্সরের প্রাচীন গদ্য সাহিত্যের নমুনা পাঠ করিয়া সে ধারণা পরিবর্তন করিতে বাধ্য হইবেন। সারস্বত কুঞ্জে প্রতি শতাব্দীর গদ্য সাহিত্যের নমুনা ও পরিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস প্রদর্শিত হইয়াছে, এতদ্ব্যতীত বাংলার প্রাথমিক যুগের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকদিগের চিত্রসহ প্রদত্ত হইয়াছে।“

  সাহিত্য সাধনা ও ইতিহাস চর্চার কারণে তাঁর পৈতৃক লাইব্রেরির শ্রীবৃ্দ্ধি হয়েছিল, এনেছিলেন বহু দুষ্প্রাপ্য বই। প্রায় পাঁচশোটি হাতে লেখা মুদ্রা এবং বহু প্রাচীন মাসিক ও সাময়িক পত্রিকার সমাহার ছিল সেখানে। ইতিহাসের চর্চার জন্য তিনি শুধু বইয়ের ওপর নির্ভর করেননি। ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন, সরজেমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন অত্যন্ত পরিশ্রমী মানুষটি। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও প্রথম থেকেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন। স্কুলপাঠে ইতি টানার পর পরই মৈমনসিংহের মোক্তার হেমাঙ্গ মোহন ঘোষের সঙ্গে এলাহাবাদে গিয়ে সেখানকার কায়স্থ কলেজের অধক্ষ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। আগ্রায় গিয়েছেন, ‘যমুনা লহরী’ খ্যাত কবি গোবিন্দচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। জীবনের শেষদিন পরযন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি যেমন তাঁর ভ্রমণ কথা ভারতী, প্রয়াস, বীণাপাণি পত্রিকায় লিখতেন তেমনি ইতিহাসের উপাদানও সংগ্রহ করতেন। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর কথা থেকে জানা যায় একটি ১৩৪০ শকের দনুজ মর্দন দেবের মুদ্রা ও একটি কুচবিহারের আদি রাজা শ্রীসম্বর নারায়ণের ১৪১৭ শকের মুদ্রা কেদারনাথ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন।

 যতীন সরকার দাবি করেন তিনি ‘বাংলার ইতিহাস’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেটি রসিক চন্দ্র বসুর কলম অনুযায়ী, “আঠারশত বিরানব্বই সালে বাংলার একখানা ইতিহাস প্রণয়ন করিয়া ‘পৃ্থিবীর ইতিহাস’– প্রণেতা শ্রীযুক্ত দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয়ের প্রেসে মুদ্রণের জন্য দিয়াছিলেন। দুর্দৈববসত গ্রন্থখানা মুদ্রাযন্ত্রের কবলেই কবলিত হইল।“

   কেদারনাথের পাঁচটি সন্তান নলিনী, আরতি, তরু, সৌরভ ও অমর- এদের মধ্যে আরতি ও সৌরভ সহ মোট তিনটি সন্তান তাঁর জীবিত অবস্থায় মারা যায়। এই আরতি ও সৌরভের নামেই তিনি পত্রিকার নাম রেখেছিলেন। যখন আরতি পত্রিকা প্রকাশিত হয় তখন কেদার নাথের একটি কন্যা সন্তান হয়, পত্রিকার নামে কন্যার নামও রাখেন আরতি। ছোট আরতি গুরুতর অসুস্থ হলে বহু অর্থ ব্যায় করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। আরতির শোক ভুলতে ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ রচনা শুরু করেন। পরে সৌরভ পত্রিকা প্রকাশিত হলে সেই সময় একটি পুত্র জন্মায়। সেই পুত্রের নামও রাখেন সৌরভ। ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ রচনাকালীন সৌরভও অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। ১৯১৭ সালে জুলাই মাসে বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি তিনি কন্যা আরতি ও পুত্র সৌরভকে উত্সর্গ করেন। ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ গ্রন্থে তিনি লিখলেন-

 “যাহার মৃত্যুশোক ভুলিবার জন্য এই গ্রন্থ লিখিতে উদ্যোগ করিয়াছিলাম এবং যাহার মত্যুশয্যার পাশে বসিয়া গ্রন্থ লেখা শেষ করিয়াছিলাম আমার সেই স্বর্গত পুত্র ও কন্যা সৌরভ ও আরতির পুণ্যনামে এই গ্রন্থ উত্সর্গ করিলাম।“

 এক সময় সময় তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে মৈমনসিংহের কালেক্টরিতে নকল নবিশীর চাকরি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরকারের কাছে সাহিত্যিক ভাতার জন্য আবেদন করেও কাজ হয়নি। লেখার সুবিধার জন্য তাদের দেওয়া টাইপ রাইটারও ব্যবহার করতে না পারায় ১৯০৯ সালে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।

     তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘রামায়ণের সমাজ’ রচনা করেও প্রকাশ করতে পারেননি। প্রুফ দেখা শেষ না হতেই ১৯২৬ সালে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ৬ জৈষ্ঠ বেলা দশটার সময় তিনি মারা গেলে সৌরভের দায়িত্ব পান ভাই নরেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁর মৃত্যুর দু’ বছর পর তাঁর ভাই নরেন্দ্রনাথ মজুমদারের চেষ্টায় প্রকাশিত হয়।

   তাঁর মৃত্যুর পরের বছর ১৯২৭ সালের জৈষ্ঠ মাসে তাঁরই সৌরভ পত্রিকায় নরেন্দ্রনাথ মজুমদার ‘কেদার স্মৃতি’ নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন। দুর্গাবাড়িতে ৬ই জ্যৈষ্ঠ তাঁর নামে পুজোর আয়োজন করা হয়। এই টুকুই তাঁর প্রাপ্তি।

   সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করতে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করেছেন। শুধু পত্রিকা সম্পাদনা বা গ্রন্থ রচনা নয় প্রকৃ্ত সারস্বতচর্চা ছিল তাঁর মজ্জাগত। অষ্টাদশ শতকের কবি গঙ্গারামের ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ বইটি তিনি আবিষ্কার করেন এবং ১৩১২ বঙ্গাব্দে মৈমনসিংহের কৃ্ষিশিল্প প্রদর্শনীতে এই পুথিটি প্রদর্শন করেন। তিন বছর পর এবিষয়ে একটি প্রবন্ধও প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তাঁর এই কৃ্তিত্বকে অনেকেই উপেক্ষা করেন। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট পণ্ডিত ডক্টর সুকুমার সেন উপেক্ষা করলেও আর এক বিশেষজ্ঞ ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাদ্যায় তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করেন। শুধু এপার বাংলায় নয় ওপার বাংলাতেও তিনি উপেক্ষিত হয়েছেন। কেদারনাথ মজুমদারের জীবনীকার যতিন সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ‘ময়মন সিংহ জেলা গেজেটিয়া’তে সেখানকার সাহিত্য সেবকদের তালিকায় কেদারনাথের নামই নেই। সেখনকার সাময়িক পত্রিকার তালিকায় সৌরভ পত্রিকার উল্লেখও নেই।

   তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেন- “কেদারবাবুকে বাঙ্গালা সাহিত্য-সমাজ কোনও সম্মান করেন নাই। ময়মনসিংহের ন্যায় জমিদার প্রধান স্থানের জমিদারও কেদারের সাহিত্য চর্চার সহায়ক স্বরূপে অগ্রসর হন নাই, তবু কেদারনাথ দারিদ্রের সহিত সংগ্রাম করিয়া এক লক্ষ্যে চলিয়া আপনার দারিদ্র্যকে দূর করিয়া সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। বৃ্দ্ধ কেদারনাথকে কোন সাহিত্যিসমাজ কোন সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতির পদে বৃত করেন নাই- তাহার কারণ অতি সহজ। প্রথমতঃ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদাধিকারী ছিলেন না, দ্বিতীয়ত তিনি ধনী ছিলেন না, তৃ্তীয়ত তিনি বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ছিলেন না- সমাজে রাজকর্মচারী হিসাবে কি অন্য কোন হিসাবে তাহার প্রতিষ্ঠা ছিল না- বোধ হয়ইহাই তাহার প্রধান কারণ।“

   তাঁর প্রথম স্মৃতিবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার ‘বঙ্গবাণী’ সাহিত্য পত্রিকা্র সম্পাদক বিজয়চন্দ্র মজুমদার একটি চিঠিতে লেখেন-

 “কেদারনাথ মজুমদার মহাশয় সুলেখক ছিলেন ও ইতিহাসের চর্চায় তাহার বিশেষ অনুরাগ ছিল। যাহারা কলিকাতা শহরে বাস করিয়া ঐ শহরের পদস্ত সাহিত্যিকদের সহিত পরিচিত হন না, শতগুণ থাকিলেও সাহিত্যে তাঁহাদের নাম ও যশ সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থাত খাঁটি গুণ দেখিয়া এদেশে এখনও সাহিত্যিকের আদর হয় নাই, এটা দেশের দুর্ভাগ্য। কেদার নাথ কৃ্তী সাহিত্যিক ছিলেন, কলিকাতার সাহিত্যিকরা তাঁহার নামে যশের ঢোল না পিটিলেও বঙ্গ সাহিত্যে তাঁহার কীর্তি লুপ্ত হইবার নয়।“

   এদিকে সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে স্বীকার করেছেন, কেদারনাথ মজুমদার প্রথম তাঁকে গীতিকা- সংগ্রাহক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয় কেদারনাথ কাজটি সম্পূর্ণরূপে পরিচালনা করতেন। সৌরভ পত্রিকার কেদারস্মৃতি সংখ্যায় বলেছিলেন যে, - ময়মন সিংহের চাষারগানগুলি আজ সাতসমুদ্র পার হয়ে সুদূর ইওরোপ আমেরিকায় আপন সম্মানীত আসনটি অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়েছে তার মূলে ছিল কেদারনাথের প্রাচীন সাহিত্যানুরাগ। তিনি সৌরভে তার সন্ধান না দিলে আদৌ তা লোকচক্ষুর সামনে ধরা দিত না।

   চন্দ্রকুমার দে তাঁর সৌরভ পত্রিকায় প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে লিখেছেন। আবার মৈমনসিংহের বিশিষ্ট কবিয়াল বিজয় নারায়ণ আচার্য লিখতেন আর এক মহিলা কবি সুলা গাইন সম্বন্ধে, যিনি বাংলার দ্বিতীয় মহিলা কবি হিসাবে চিহ্নিত। বিজয় নারায়ণ আচার্য মৈমনসিংহের কবি লাল মামুদ ও তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান সম্পর্কেও কবিতা লিখতেন।

এই সৌরভ পত্রিকায় ১৯১৩ সালে চন্দ্রকুমার দে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীদেবী সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন যে প্রবন্ধটি দীনেশ চন্দ্র সেন পড়েন এবং চন্দ্রকুমার দে র সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে কেদারনাথের সহযোগীতায় চন্দ্রকুমার দে দীনেশ চন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাহকের কাজে যোগ দেন। দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় লিখেছেন-

 “সৌরভ সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার মহাশয়ের উত্সাহে চন্দ্রকুমার বাবু বিচিত্রিভাবে নানা দিক দিয়া সাহিত্যিক চেষ্টায় উদ্যোগী হইয়াছিলেন। ‘সৌরভে’ তিনি নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে প্রবৃত্ত হন”।

তিনি আরো লিখেছেন-

    “কেদারবাবু নানা দিক দিয়া ইহাঁর সাহিত্যিক চেষ্টায় উত্সাহ দিতেছিলেন। কিন্তু ‘সৌরভে’ চন্দ্রকুমার বাবুর প্রবন্ধে প্রাচীন পালাগানের যে সামান্য কিছু নমুনা প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা পড়িয়া আমি কেদারবাবুকে সেইগুলি সংগ্রহের জন্যই প্রবন্ধ লেখককে বিশেষভাবে উত্সাহিত করিতে অনুরোধ করিয়া চিঠি লিখিয়াছিলাম। ---- ‘সৌরভে’ সেই সব পালাগানের কিছু কিছু নমুনা প্রকাশিত না হইলে তত্প্রতি কাহারও দৃষ্টি আকৃ্ষট হইত না”।

    এই কেদারনাথ ও তাঁর সৌরভ পত্রিকা আঞ্চলিক সংকীর্ণতা ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নাগরিক সংকীর্ণতাকে ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন। বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। সেই কারণে মৈমনসিংহের মত আঞ্চলিক ইতিহাস যেমন প্রকাশিত হত তেমনি সাহিত্য সম্পর্কিত রচনাও প্রকাশিত হত। প্রকাশিত হত মৈমনসিংহের কবিগান, বাউলগান, ঘাটু গান, ঐ জেলার পুরাকীর্তি, সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়েও মূল্যবান রচনা। লিখতেন মহিলারাও। কেদারনাথ সৌরভ পত্রিকায় প্রবন্ধ, কবিতা, নাটকের সঙ্গে তর্ক- বিতর্ককেও রাখতেন। এই পত্রিকা মফস্বল থেকে প্রকাশিত হলেও তার মান ও বিষয়বস্তু ছিল প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে চিন্তা ভাবনা দুনিয়াকে এগিয়ে রাখতে সাহায্য করে তিনি সেই চিন্তা ভাবনা সৌরভের মাধ্যমে জনসমাজে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রাণ হলেও তাঁর সুসম্পাদিত পত্রিকায় ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হত। যে সময় তিনি সৌরভ পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন সেই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলায় হিন্দু রিভাইভ্যালিজম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে আর ব্রাহ্ম আন্দোলনের জোয়ার আসে। সমাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকতার দিক থেকে নতুন চিন্তাধারার প্রবর্তন হতে দেখা যায়। এই চিন্তাধারা মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি শ্রীঅন্নদা প্রসাদ চক্রবর্তীর ‘ধর্মে বিপত্তি’ নামক একটি প্রবন্ধটিও সৌরভে ১৩২০ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন-

   “ছেলেবেলায় পণ্ডিত মহশয়ের নিকট ধর্ম শস্ত্রের একটা ব্যাখ্যা শুনিয়াছিলাম। ‘যাহা ধারণ করিয়া আছে তাহাই ধর্ম’। এখন কিন্তু মনে হয় যে যাহা পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে তাহাই ধর্ম। তুমি হিন্দু, আমি মুসলমান, এই জন্য আমরা কখনও এক হইতে পারিব না। আমাদের এক দেশ, এক স্বার্থ, এমন কি হয়ত আমরা একই মাতৃস্তনে পুষ্টিলাভ করিয়াছি। (আকবরের শাসনকালে এরূপ ব্যপার নিতান্ত বিরল ছিল না।

"কিন্তু তাহা হইলে কী হয়, তুমি যে হিন্দু, আমি যে মুসলমান!চিরকাল আমাদের কাটাকাটি মারামারি করিতে হইবে, নহিলে ধর্মচ্যুত হইবে। হায় ধর্ম। তুমিই পরস্পরকে ধারণ করিয়া আছো?"

ধর্মের নামে পৃ্থিবীর যত রক্তপাত হইয়াছে ও যত নৃশংস অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইয়াছে, এত আর কিছুতে হয় নাই।“

তাঁর সাহিত্য চর্চা ও জ্ঞানের পরিধি নিয়ে অনেক পণ্ডিত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেছেন, কিন্তু ইতিহাস চর্চা, সাহিত্য চর্চা, পত্রিকা সম্পাদনার ঊর্ধে তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের একশো বছর পর কেদারনাথ মজুমদারকে বাঙালি কতটা চর্চায় রেখেছে, তাঁর অবদানকে কতটা স্বীকৃতি দিয়েছে তা ফিরে দেখারও সময় এসেছে। সময় এসেছে মৈমনসিংহ গীতিকার মত আপন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ মহৌষধী বাংলার বনলতাকে দুই বাংলার বাঙালিজাতি নামক বটবৃক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে সজীব রাখার।   

 

তথ্যসূত্র-

১) দীনেশ চন্দ্র সেন- মৈমনসিংহ গীতিকা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

২) সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, স্মৃতি বিস্মৃতিতে দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরে বাইরে প্রকাশনী।

৩) মুনমুন চট্টোপাধ্যায়, মৈমনসিংহ গীতিকা পুনর্বিচার, পুস্তক বিপণি।

৪) আদিত্যকুমার লালা, মৈমন সিংহ গীতিকায় প্রাপ্ত জীবন ও শিল্পরূপ, দে’জ পাবলিশিং

৫) অংশুমান ভৌমিক, অবিভক্ত বাংলার উদার জীবনের প্রতিফলন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ মার্চ, ২০২৩।

৬) যতীন সরকার, কেদারনাথ মজুমদার, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।

৭) ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য, দীনেশ চন্দ্র সেন, জিজ্ঞাসা, কলকাতা।

8) ড. দুসান জুবাভিতেল, বেঙ্গলি ফোক ব্যালাডস ফ্রম মৈমনসিং হ অ্যান্ড প্রবলেম অফ দেয়ার অথেন্টিসিটি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

৯) আশিস ঘোষ, মৈমনসিংহ ও প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা, অক্ষর প্রকাশনী।

১০) কেদারনাথ মজুমদার, বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য, প্রকাশক- নরেন্দ্রনাথ মজুমদার।