রবীন্দ্রনাথের নিষ্কৃতি : কবিতার শরীরে ফুটে ওঠা নারীর বন্ধন মোচনের গল্প

রবীন্দ্রনাথ মূলত গীতিকবি,আবার তিনি শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারও। যদি লেখক একাধারে হন  গীতিকবি ও গল্পকার তাঁর পক্ষে  তখন গদ্যে গল্প লেখার মত কবিতাতেও  গল্প লেখা সহজ হয়ে ওঠে।  পাঠকও এতে লাভবান হন। লিরিকের ধর্ম  মনে রেখে  কবিতাটিকে  যেমন আস্বাদন করা যায় তেমনি গল্পে  চিত্রিত  চরিত্রের সঙ্গেও একাত্মতা অনুভব  করতে পারেন  পাঠক। সংরূপের  এই মিশ্রণ  কবিতাকে  আকর্ষণীয়  ও বৈশিষ্ট্য মন্ডিত  করে তোলে। গল্পের  বিষয়বস্তু  যখন  কবিতার আঙ্গিকে  প্রকাশিত হয় তখন সে পাঠককে  এক নতুন রসাস্বাদ দেয়।  যা  শুধু কবিতা বা শুধু গল্প পড়ে পাওয়া যায় না। তবে গল্প বলার এই আঙ্গিক টিকে  সম্পূর্ণ  নতুন বলা  যায়না, রবীন্দ্রনাথের আগেও  কাহিনীকবিতার  একটি ধারা দীর্ঘদিন  ধরেই  প্রচলিত ছিল।  রবীন্দ্রনাথ  তাকে নতুন  রূপ দিয়েছেন, কবিতা আকারে দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা নয়, কবিতায় ছোটগল্পের আস্বাদ তিনি নিয়ে এসেছেন।
তাঁর গল্প রচনার  সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্ব পর্যন্ত গদ্যে গল্প লেখার পাশাপাশি পদ্যে গল্প রচনা করেছেন সমানতালে।
                            কবির 'পলাতকা' কাব্যগ্রন্থের 'নিষ্কৃতি'ও এমনই এক গল্প কবিতা। এ কবিতার শরীরে লুকিয়ে  রয়েছে ছোটগল্পের মুক্ত বিন্দুটি। পলাতকা  প্রকাশিত হয় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে।এই কাব্যের কবিতা গুলি সবই ১৩২৪ -২৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র বৈশাখের মধ্যে লেখা। কবিতাগুলি সবুজপত্র  পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩২৫ বঙ্গাব্দে।
                         মাত্র দু বছর আগে  প্রকাশিত  'বলাকা'(১৯১৬)  কাব্যের " হীরামুক্তামানিক্যের ঘটায়' পূর্ণ অপরূপ তাজমহলের পাশে পালাতকার  স্তিমিত লিরিক প্রবাহ কিছুটা ম্লানজ‍্যোতি,তাই এই  কাব্যটি রবীন্দ্রকাব্যধারায়  ততটা গুরুত্ব পায়নি।কিন্তু একটু ধীরভাবে কবিতাগুলি পড়লে বুঝতে পারা যায় যে এই কাব্যনির্ঝরিনীটিতেও বলাকার বাণীই  ধ্বনিত হয়েছে। বলাকায় কবি দেখলেন নিরন্তর  গতির মধ্যেই রয়েছে বিশ্বের  প্রাণশক্তির প্রকৃত প্রকাশ।যৌবনের চলার ছন্দেই  লুকিয়ে রয়েছে  জীবনের সত্য। মানবজীবনে কোনকিছুই
স্থায়ী নয় সবই বন্ধন মুক্তির জন্য ছুটে চলেছে। জীবনের হাসি কান্না, সুখ দুঃখ, প্রেম লজ্জা,মান অপমান  ইত্যাদি কোন কিছুরই স্থায়ী কোন সত্তা নেই।জীবনের সমস্ত কিছুই অস্থায়ী; পলাতকা।
                                 'পলাতকা'য়  নারী সম্বন্ধে কবির এক নতুন দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।নারী জীবনের এই নতুন আদর্শটি অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী তাঁর অপূর্ব বিশ্লেষণে উপস্থাপিত করেছেন
"রবীন্দ্রনাথের  শেষ জীবনের রচনা ব্যক্তির বন্ধন মোচনের আহ্বানে পূর্ণ।তিনি দেখিয়েছেন  জরা, জড়তা,অভ্যাস,সংস্কার ,একান্নবর্তী প্রথা -বন্ধনের আর অন্ত নাই, সমস্তই ব্যক্তির বিকাশের পক্ষে অন্তরায়। এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া ব্যক্তিকে , individual কে,পূর্ণভাবে  বিকশিত হতে তিনি বার বার আহবান  করিয়াছেন। এই আহ্বানের একপ্রান্তে 'মুক্তি' নামে কবিতাটি ; হালদারগোষ্ঠী,
স্ত্রীর পত্র, পয়লানম্বর প্রভৃতি অন্যপ্রান্তে; ....
পলাতকা কাব্যের  নারী নায়িকার দল  মাতৃত্ব- প্রেয়সীত্ব-পত্নীত্বের ধাপে ধাপে  উন্নীত হইয়া  এক সময়ে  বিশুদ্ধ  নারীত্বে আসিয়া উপনীত হয় -তখন বুঝিতে পারে 'আমি নারী ,আমি মহীয়সী'"।১
                              রবীন্দ্রনাথের  'পলাতকা' পর্বের  কবিতা গল্পে মুখ্যত  সমাজমনস্কতা ও নারীকেন্দ্রিকতার যে প্রকাশ দেখা যায় ,সবুজপত্র পর্বের  গদ্যগল্পগুলিতেও তা রয়েছে।'স্ত্রীর পত্র'-এ (শ্রাবণ ১৩২১)  পাই তার আশ্চর্য বলিষ্ঠ প্রকাশ। সমসাময়িক কালের  ইউরোপের নতুন সামাজিক চেতনা  কবি স্বচক্ষে দেখেছিলেন, বুঝেছিলেন এবং কবিচিত্তে তার স্পর্শ লেগেছিল।পলাতকার  দশটি নারীকেন্দ্রিক কবিতাগল্পের প্রায় সবকটিতেই নারী জীবন সম্বন্ধে  কবির এক বিশেষ দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে ,নারী জীবনের একটি নতুন  আদর্শ তিনি এইসব কবিতায় ঘোষণা করেছেন-"আমাদের সমাজে নারীর কোনো মূল্য ছিল না একথা বলা চলে না। কন্যা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে,  মা হিসাবে  নারীর প্রতি একটি রোমান্টিক দৃষ্টি ও তজ্জনিত  প্রীতি এবং শ্রদ্ধাও ছিল,কিন্তু পারিবারিক সম্পর্ক নিরপেক্ষ নারী হিসাবে নারীর মূল্য কিছুই ছিল না, শুধু আমাদের দেশে নয় কোন দেশেই ছিল না। এই নারীর মূল্য অপেক্ষাকৃত বর্তমান যুগের আবিষ্কার, আর্থিক ও সামাজিক বিবর্তনের ফল, ইউরোপের এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে এই ফল,এই আবিষ্কারের সূচনা দেখা দিয়াছিল ঊনবিংশ  শতাব্দীর গোড়াতেই কিন্তু তাহার প্রকাশ দেখা গেল সে শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থপাদে এবং পূর্ণতার বিকাশ আমরা দেখিলাম  মহাযুদ্ধের পর।সে ঢেউ যে আমাদের নিস্তরঙ্গ সমুদ্রতটে আসিয়া লাগিল তাহার প্রথম পরিচয়  পাওয়া গেল 'স্ত্রীর পত্রে'"।২
                              'স্ত্রীর পত্র' গল্পের মৃণাল সম্পর্কে সমালোচকের এই উক্তি যতটা সত্য, পলাতকার  নারী নায়িকাদের সম্পর্কেও তা সমানভাবে সত্য।
                       পলাতকা কাব্যের 'নিষ্কৃতি' কবিতায় বর্ণিত হয়েছে মঞ্জুলিকার জীবনের গল্প,জীবন যন্ত্রণার গল্প- নবজীবনের গল্প।  কৌলীন‍্য প্রথার  বলি হয়ে  বিধবা মঞ্জুলিকা ভন্ড, স্বার্থপর পিতার সেবায় আত্মোৎসর্গ করে নিজের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়াকে  ভুলে থাকতে  চেয়েছিল। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর পর বছর না ঘুরতেই  পিতা যখন দ্বিতীয় বিবাহ করতে বাখড়্গঞ্জ ছুটলেন, তখন পূর্বপ্রেমিক পুলিনের সাহসী সহযোগিতায় সে সামাজিক অনুশাসন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন জীবনের পথে পা  বাড়িয়েছে।নারীর জীবনের অধিকার রক্ষায় কবি এখানে তাকে বিদ্রোহিনী করে গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এই কাব্যের 'মুক্তি'ও 'ফাঁকি' কবিতার  নায়িকাদের মত মৃত্যুতে মুক্তি না খুঁজে  মঞ্জুলিকা মুক্তি খুঁজেছে নিজের অধিকার রক্ষায় সচেতন হওয়ার মধ্যে।সে কাজে সাহসী কোন বন্ধুর হাত ধরতেও দ্বিধা করেনি।
                           'নিষ্কৃতি'নামকরণের মধ্যেই রয়েছে   মুক্তির দ্যোতনা।প্রেম  কিভাবে একটি মেয়েকে সমাজের তথা পিতৃতন্ত্রের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি বা নিষ্কৃতি দিয়েছে,এখানে সেই গল্পই শুনিয়েছেন কবি একান্ত সহজ সরল  অলঙ্কার হীন ঘরোয়া ভাষায়।মুক্তছন্দের ব্যবহার, আটপৌরে শব্দের প্রয়োগ, গদ্যধর্মিতা ,আদি -মধ্য-অন্ত যুক্ত নিটোল  কাহিনী বিন্যাস এ  কবিতায় রোপণ করেছে গল্পের বীজ। এ গল্পের চরিত্র গুলি রক্ত মাংসে বাস্তব হয়ে উঠেছে।মঞ্জুলিকার বাবার মত  চূড়ান্ত  হৃদয়হীন চরিত্র কবির  গদ্যগল্পেও খুব বেশি নেই।
                   এ কবিতার শরীরের দিকে তাকালে আমাদের প্রথমেই চোখে পড়ে সংলাপধর্মিতা। যা রচনাকে  চরিত্রকেন্দ্রিক  করে কবিতায় নিয়ে এসেছে আখ্যানধর্মিতা।

"মা কেঁদে কয়,'মঞ্জুলি মোর ওই তো কচি মেয়ে,
ওরই সঙ্গে বিয়ে দেবে, বয়সে ওর চেয়ে
               পাঁচগুনো সে বড়।
তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়োসড়ো
     এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো'।"

"বাপ বললে,'কান্না তোমার রাখো',
পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে-
জান না কি মস্ত কুলীন ও যে।
সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাবো?
ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাবো।"

মুখের ভাষায় পারিবারিক কথোপকথন বা সংলাপের সাহায্যে কাহনী গঠন করেছেন কবি।এভাবেই সংলাপের মাধ্যমে প্রথম স্তবকেই কাহিনীর মূল সমস্যাটির কথা বলা হয়েছে একেবারে  কথ্য রীতির ভাষাছাঁদে।বলাকা পরবর্তী সমস্ত সামাজিক কবিতাগল্পে এরপর থেকে কথ্যভাষারীতিই অনুসৃত হয়েছে।চালিত রীতর ভাষা ছাঁদে  আটপৌরে শব্দ সংযোজিত হয়ে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের গল্প কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
                   কবিতা-কাহিনীর বিষয়বস্তুকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য কখনো দীর্ঘ প্রলম্বিত পংক্তি, আবার কখনো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্ষুদ্র পংক্তি ব্যবহার করেছেন কবি বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে।এরই  মধ্যে রক্ষা করেছেন অন্তমিল। ফলে কাহিনীটি যেমন স্পষ্টতা পেয়েছে, তেমনি অন্ত্যমিলের  প্রয়োগে রচনার কাব্যিক সুষমাটিও বজায় থেকেছে।
                  সংলাপ যেমন এ রচনায় কাহিনী গঠন করেছে তেমনি চরিত্রগঠনেও  সংলাপকে কাজে লাগিয়েছেন কবি।মঞ্জুলিকার বাবার হৃদয়হীন  চরিত্রটি কবি বিবরণের পাশাপাশি সংলাপ সংযোজন করে স্পষ্ট করে তুলেছেন। মা তার বিধবা মেয়ে মঞ্জুলিকার আবার বিয়েরকথা বললে -

"বাপ বললেন  কঠিন হেসে, 'তোমরা মায়ে ঝিয়ে
একলগ্নেই বিয়ে কোরো আমার মরার পরে,
সেই কথা দিন থাকো ধৈর্য ধরে।"
                    এই বলে স্ত্রীর সমস্ত আশায় জল ঢেলে দিয়ে  তার  "ফের  চলল পড়া ইংরেজি সেই প্রেমের উপাখ্যান।"কথার সঙ্গে চরিত্রটির কাজের বৈপরীত্য ব্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে তার ক্রূর নিষ্ঠুরতাকে  সুকৌশলে
প্রকাশ করেছে।বাবা তার নিজের  অল্পবয়সী বিধবা মেয়ের কৃচ্ছ্রসাধন দেখে  বলেছে -

                            "গর্ব করি নেকো,
কিন্তু তবু আমার মেয়ে সেটা স্মরণ রেখো।
                             ব্রহ্মচর্য ব্রত
আমার কাছেই শিক্ষা যে ওর  নইলে দেখতে অন্যরকম হত।"

তারপরে এই কথার ঠিক বিপরীত আচরণটি  তিনি করেছেন, স্ত্রীর মৃত্যুর এগারো মাস পেরোতে না পেরোতেই  দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তুতি নিয়ে,

"দেখলে বাপের নতুন করে সাজ সজ্জা শুরু-
         হঠাৎ কালো ভ্রমর কৃষ্ণ ভুরু,
         পাকাচুল সব কখন হল কটা
    চাদরেতে যখন তখন গন্ধ মাখার ঘটা।"

পর পর দুই স্তবকে মঞ্জুলিকার বাবার সংলাপ ও আচরণের মধ্যে  যে বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন কবি, সেই সংলাপ ও বিবরণের ভাষার মধ্যে আত্মগোপন করে আছে চাপা ব্যঙ্গ।ভাষার আভ্যন্তরীণ এই ব্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে  ভোগী, লোভী, হৃদয়হীন মানুষটির স্বরূপ। স্ত্রী- কন্যাকে প্রতারিত করে নিজে ভোগের রাস্তা থেকে এতটুকু সরেনি চরিত্রটি। ভাষার আভ্যন্তরীণ ব্যঙ্গকে কাহিনী তথা চরিত্রগঠনের এক বিশেষ প্রকৌশল হিসেবে লেখক এখানে ব্যবহার করেছেন যা পিতৃতন্ত্রের নিষ্ঠুরতাকে  তীব্র আঘাত করেছে।
                   কবিতাটিতে আটপৌরে ভাষার বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। এইসব আটপৌরে শব্দ কবিতার শরীরে গল্পের ফুলটি ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।এ বিষয়ে মঞ্জুলিকার বাবার খাদ্যতালিকাটির  উল্লেখ করা যায়-
"সকাল বেলায় ভাতের পালা, সন্ধ্যাবেলায় রুটি কিংবা লুচি,
            ভাতের সঙ্গে মাছের ঘটা
            ভাজাভুজি হত পাঁচটা ছটা,
            পাঁঠা হত রুটি লুচির সাথে।"

চাঁচাছোলা ভাষায়  বাস্তবের এই বর্ণনা ভাষাকে গদ্যের কাছে নিয়ে গেছে।মঞ্জুলিকার  মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবার সেবাযত্নের ভার  মঞ্জুলিকার ওপর পড়ার কারণ দেখিয়েছেন  কবি একেবারে ঘরোয়া ভাষায় -
বড়ো ছেলে বাস করে তার স্ত্রী পুত্রদের সাথে
                     বিদেশে পাটনাতে ।
দুই মেয়ে তার কেউ থাকে না কাছে ,
শ্বশুরবাড়ি আছে।
একটি থাকে ফরিদপুরে
আরেক মেয়ে থাকে আরো  দূরে
মাদ্রাজে কোন বিন্ধ্যগিরির পার।
পড়ল মঞ্জুলিকার 'পরে বাপের সেবাভার'।

মঞ্জুলিকার বাবার  অসুখের বর্ণনাতেও আছে  আটপৌরে শব্দের ব্যবহার-

                "ব্যামো সেরে আসছে ক্রমে,
              গাঁটের ব্যথা অনেক এল কমে।
                       রোগী শয্যা ছেড়ে
             এখন একটু চলে  হাত পা নেড়ে।"

মঞ্জুলিকার গৃহকাজের বিবরণে ভাষার আঁটসাঁট ব্যবহার রচনার  গল্পধর্মিতাকে  বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে- 'রৌদ্রে দিয়ে গরম পোশাক আপনি তোলে পাড়ে','ধোবার বাড়ির ফর্দ টুকে  রাখে'।   'গয়লানী আর  মুদির হিসাব রাখতে চেষ্টা করে', 'কাসুন্দি তার কোনমতেই হয়না মায়ের মতো'--  ইত্যাদি  ঘটনার বাস্তব বিবরণের মধ্যে  কোথাও কোন ফাঁক নেই - মনে হয়  কবিতা নয়  যে যেন দৈনন্দিন জীবনের  কোন গদ্য গল্প শুনছি।
                         আবার এই বাস্তব বিবরণের পাশাপাশি মঞ্জুলিকার জীবনে যৌবন-আগমনের  পদধ্বনি, প্রেমের অনুভূতি  জেগে ওঠার ছবিটি কবি ফুটিয়ে তুলেছেন অপূর্ব কাব্যময় ভাষায়।

"আকাশপথে বাণী তারে ডাক দিয়ে যায়  আলোর ঝরনা বেয়ে,/রাতের অন্ধকারে/কোন অসীমের রোদন-ভরা বেদন লাগে তারে!/ বাহির হতে তার  ঘুচে গেছে সকল অলংকার,/অন্তর তার  রাঙিয়ে ওঠে স্তরে স্তরে, /তাই দেখে সে আপনি ভেবে মরে।/কখন কাজের ফাঁকে/জানলা ধরে চুপ করে সে বাইরে চেয়ে থাকে/যেখানে ওই শজনেগাছের ফুলের ঝুরি বেড়ার গায়ে/ রাশি  রাশি  হাসির ঘায়ে/ আকাশটারে পাগল করে দিবারাতি।"

এখানে অসম মাত্রার পংক্তি গুলি অপূর্ব সব চিত্রকল্প নির্মাণ করে মঞ্জুলিকার মনের ভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। 'রোদন ভরা বেদন' বাক্যাংশে  রোদন ও বেদন  এই সামিল  শব্দের ব্যবহার রণন সৃষ্টি করেছে । নায়িকার বৈধব্য বোঝাতে -'বাহির হতে তার ঘুচে গেছে সকল অলংকার' এই পংক্তি ব্যবহার করে কবি  বৈধব্যের  বহিরঙ্গীয় বিবর্ণতাকে যেমন স্পষ্ট করেছেন তেমনি এর পরের পংক্তিতে  'রাঙিয়ে' শব্দের প্রয়োগে বৈপরীত্য সৃষ্টি  করে ষোল বছরের  কিশোরীর  প্রেমপূর্ণ টুকটুকে লাল রঙের মনটিকে  ইঙ্গিত করেছেন।' স্তরে স্তরে' পুনরাবৃত্ত এই পদটি তার মনের আনাচে কানাচে রঙের ছোয়া বুলিয়ে দিয়েছে। শজনে গাছের অজস্র সাদা ফুলকে রাশি রাশি হাসির সঙ্গে তুলনা ও তার দিকে মঞ্জুলির চেয়ে থাকার  বর্ণনা  মঞ্জুলিকার  তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের  আনন্দ- পিপাসার  স্বরূপটি ফুটিয়ে তোলে।
    
                          "পায়ের শব্দ  তারি
       মর্মরিত পাতায় পাতায় গিয়েছে সঞ্চারি।
                কানে কানে তারি করুণ বাণী,
              মৌমাছিদের পাখার গুণ গুণানি।"

সে তার প্রিয়তমের আগমনের  পদধ্বনি যেন শুনেছে মর্মর ধ্বনির মাঝে,তার দয়িতের বাণী  শুনেছে মৌমাছিদের  গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে। তার বয়োধর্ম  তাকে প্রেমের পথের সন্ধান দিয়েছে, কিন্তু সমাজধর্ম তাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে।
এই সমাজধর্মের  নিষ্ঠুরতার কথা কবি এ রচনায়  একেবারে চাঁচাছোলা  গদ্যময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন, রচনায় যা গল্পধর্মিতা নিয়ে এসেছে আর তার অন্তরে প্রেমের উন্মেষের  কাহিনীটি কবি বলেছেন  কাব্যিক ভাষায়। এই দুয়ের সঠিক সমন্বয় রচনাটিকে এক সার্থক কবিতাগল্প হিসেবে গড়ে তুলেছে।
                    মঞ্জুলিকার প্রেম ও আজন্ম লালিত সংস্কারের দ্বন্দ্ব যে তীব্র  অন্তর্দাহ  সৃষ্টি  করেছে কবি তাও খুব সুচারু রূপে প্রকাশ করেছেন। মঞ্জুলিকে  পুলিন বিবাহের প্রস্তাব দিলে নিজের পাপ ইচ্ছে পুলিনের চোখে ধরা  পড়েছে ভেবে  সে বৈধব্যের   কৃচ্ছ্রসাধন  দ্বিগুণ করে দিয়েছে।

"মঞ্জুলিকা বাপের সেবায় লাগল দ্বিগুন করে
                        অষ্টপ্রহর ধরে।
আবশ্যকটা সারা হলে তখন লাগে অনাবশ্যক কাজে
যে বাসনটা মাজা হল আবার সেটা মাজে!
                         দু তিন ঘন্টা পর
একবার যে ঘর ঝেড়েছে ফের ঝাড়ে  সেই ঘর।
কখন যে স্নান ,কখন যে তার আহার,
           ঠিক ছিল না তাহার।"

একেবারে আটপৌরে শব্দবন্ধ প্রয়োগ করে আটপৌরে ভঙ্গিতে  ঘরোয়া কাজের  বিবরণের  মধ্যে  দিয়ে গল্প বলার ঢঙে কবি নায়িকার মনোভাবটি এখানে সুচারু  কৌশলে প্রকাশ করেছেন, যা তার  অন্তর্দ্বন্দ্বকে  পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে  যা ছোট গল্পের প্রাণ।
              
             আগেই বলেছি পলাতকার  কবিতা গুলি আমাদের ব্যক্তির বন্ধনমোচনের গল্প শুনিয়েছে,শুনিয়েছে ব্যক্তিসত্তার মুক্তির গল্প। মঞ্জুলিকার  জীবনেও সেই মুক্তি এসেছে। মঞ্জুলিকার মায়ের মুক্তি ঘটেছে মৃত্যুতে, কিন্তু তার পরের প্রজন্ম মঞ্জুলিকার মুক্তি এসেছে  জীবিত থেকেই, প্রেমের পথে এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে।কবির কলমে এই  প্রতিবাদের ভাষাও যথেষ্ট বলিষ্ঠ রূপ পেয়েছে।বাবা  দ্বিতীয় বিবাহ সেরে ঘরে এসে দেখেছেন --
"ঘরেতে নেই মঞ্জুলিকা।খবর পেলেন চিঠি পড়ে
          পুলিন তাকে বিয়ে করে
     গেছে দোঁহে ফারাক্কাবাদ চলে।

"কুপমন্ডুক, দুষ্টমতি ক্রুদ্ধ  পিতৃত্বের পরাজিত অভিশাপের উপর  'ফারাক্কাবাদ' শব্দটির  আঙ্গুলিহেলন স্বশব্দ বিদ্রূপে বেজেছে।"
                           এভাবেই 'পলাতকা'র  অন্যান্য কবিতার মত 'নিষ্কৃতি' কবিতার শরীরে চলিত রীতি প্রয়োগ করে,ক্রিয়াপদ গুলিতে  কথ্য রীতি অনুসরণ করে, মুক্তক ছন্দে অসমমাত্রিক দীর্ঘ প্রলম্বিত পংক্তি ও ক্ষুদ্র পংক্তির বিন্যাসে  একটি গল্প শুনিয়েছেন কবি যা   মানবাত্মার মুক্তির আকাংখ্যায় পরিপূর্ণ।  এ গল্প বলতে গিয়ে যেমন কবি অনায়াসে আটপৌরে ঘরোয়া  শব্দের ব্যবহার করেছেন,অনুসরণ করেছেন  কথা বলার ঘরোয়া রীতি , সংলাপের সঠিক প্রয়োগে গঠন করেছেন  চরিত্র ,গড়ে তুলেছেন গল্প তেমনি  অন্ত্যমিলের ব্যবহারে ,স্বল্প উপমা অনুপ্রাসের প্রয়োগে উপযুক্ত ক্ষণে কাব্যিকতার ছোঁয়ায় গল্পকে করে তুলেছেন কাব্য সুষমা  মন্ডিত।  ফলে কবিতা এবং গল্প মিলেমিশে একটি নতুন শিল্পরূপের সৃষ্টি করেছে। যাকে আমরা কবিতাগল্প বলতে পারি।
                     লক্ষ করার বিষয়  পলাতকার সমকালে গদ্যে মাত্র তিনটি গল্প লেখা হয়  'তপস্বিনী',' পয়লা নম্বর' এবং 'পাত্র পাত্রী'। পূর্ববর্তী পর্বে 'স্ত্রীর পত্র' 'অপরিচিতা'। যা আন্তরধর্মে পলাতকার খুব কাছাকাছি। মনে হয় পলাতকার কবিতাগল্প গুলি লিখেই তাঁর মনের গল্প লেখার চাহিদা পূরণ হয়ে যাচ্ছিল। নতুন আঙ্গিকে গল্প লিখতে পেরে বেশ তৃপ্তিও হচ্ছিল তাঁর। তাই কবিতায় গল্পের বীজ বপন করে তাকে পত্রপুষ্পে সাজিয়ে তোলেন তিনি 'পলাতকা'র  কবিতা গুলিতে যা সার্থক কবিতাগল্পের দৃষ্টান্ত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে  বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে।