রবীন্দ্রনাথের লিপিকা

'লিপিকা'র  ৩৯টি গল্পকে তিনি নিজেই আখ্যা দিয়েছিলেন 'কথিকা' বলে। রবীন্দ্রসাহিত্যে এই গল্পগুচ্ছ এক অনন্য সম্পদ। বাংলাসাহিত্যের গল্পের ধারাবদলে 'লিপিকা' এক মাইলফলক। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২২সালে। এই 'কথিকা' গুলি লেখার সময় তিনি নানা কারণে কিছুটা অবসাদগ্রস্ত  ছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে চেয়েও কাউকে পাশে পাচ্ছিলেন না। একলাই চলতে হয়েছিল তাঁকে। অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন ইংরেজদের দেওয়া 'নাইটহুড'।
       
       এমনই  মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গে জুড়ে ছিল তাঁর কবিমন আর কর্মিমনের এক চিরকালীন দ্বন্দ্ব। একটি চিঠিতে রথীন্দ্রনাথকে তিনি লেখেন "বিদ্যালয়, জমিদারি,সংসার,দেশ প্রভৃতি সম্বন্ধে আমার যা কর্তব্য আমি কিছুই করিনি। উচিত ছিল নিঃসংকোচে আমার সমস্ত ত্যাগ করে একেবারেই রিক্ত হয়ে যাওয়া এবং আমার সমস্ত পরিবারের লোককে একেবারে চূড়ান্ত ত্যাগের মধ্যে টেনে আনা"'  আরো বলেন "দিনরাত্রি মরার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করছে, মনে হচ্ছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ,যখন এ জীবনে আমার ideal-কে  realiseকরতে পারলুম না তখন মরতে হবে। আর নূতন জীবন নিয়ে নূতন সাধনায় প্রবৃত্ত হতে হবে।"

       কাজের জন্য একটা অন্য জীবন চেয়েছিলেন কবি।   যাপিত জীবন যেন তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারছিল না। এ দ্বন্দ্ব তাঁর মননে চিরস্থায়ী হয়েছিল। চিঠিটি লেখা হয় ১৯১৪ সালে,'বলাকা' রচনার প্রায় সমকালে। ''বলাকা' পরবর্তী বছরগুলিতে লেখক যেন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্মযজ্ঞে। বিশ্বভারতীর জন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে দেশে বিদেশে ঘুরেছেন কবি। জড়িয়ে পড়েছেন নানা রকম রাজনৈতিক বিতর্কে।' এই সময়ে এন্ড্রুজকে লেখা চিঠিপত্রে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিমন ও কর্মিমানসের দ্বন্দ্বের সংকট। এই দোটানা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন সাময়িক অসুস্থতার কারণে। সাল ১৯১৯, এসময় সংসার থেকে কিছুদিনের ছুটি মিলেছিল কবির। এই সময়েই, ১৯১৯ সালের ১৭ ই মে 'বাতায়নিকের' পত্রে তিনি লেখেন, "আমাকে নইলে চলে না এই কথা মনে করে এতদিন ভারী ব্যস্ত হয়ে কাজ করা গেছে। চোখের পলক ফেলতে সাহস হয়নি। ডাক্তার বলেছে এখানেই বাস করে একটু থাম। আমি বলেছি, 'আমি থামলে চলে কই ?' ঠিক এমন এক সময়ে চাকা ভেঙে আমার রথ এই জানলাটার সামনে এসে থামল। এক মুহূর্তে যেন চটক ভেঙে গেল। আমি নইলে চলে না-এর দেশ থেকে আমি নইলে চলের দেশে ধাঁ করে এসে পৌঁছেছি। কেবলমাত্র ওই ডেস্কের থেকে এই জানলার ধারে এসে। "'বাতায়নিক'-এর এই চিঠি পড়ে কি 'লিপিকা'র 'ভুল স্বর্গে'র কথা অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে যায়? কেজো লোকের ভিড়ে বেমানান সেই কাজভোলা শিল্পীটিকে মনে পড়ে?"

         'ভুল স্বর্গ' লিপিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প ।এই গল্পের ভাব অনেকটাই আমরা খুঁজে পাই তাঁর 'চিত্রা'-র 'আবেদন' কবিতায় ভৃত্য  যেখানে রানীকে  বলেছে 'আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর'। সে বৈভব চায় না, সে চায়,'অকাজের কাজ যত/
আলস্যের সহস্র সঞ্চয়।/ শত শত
আনন্দের আয়োজন।" ভৃত্য বলে,  'অবসর লব সব কাজে।...এ উষ্ণীষ রাজসাজ/রাখিনু চরণে তব--যত উচ্চকাজ/ সব ফিরে লও দেবী'।    একটিই অভিলাষ তার ,"প্রতি সন্ধ্যাবেলা, অশোকের রক্তকান্তে/ চিত্রি পদতল চরণ- অঙ্গুলিপ্রান্তে/ লেশমাত্র রেণু  চুম্বিয়া মুছিয়া লব,/এই পুরস্কার।" সন্ধ্যায় রানী যে যূথিকার মালাখানি দিয়ে কবরী সাজাবেন ভৃত্য সোনার থালায় সাজিয়ে তাই অর্ঘ্য দিতে চায় রানীকে।    

গল্পটি পড়তে পড়তেই এর অন্তরে আত্মগোপন করে থাকা কবিতার বীজটিকে আমরা চিনে নিতে পারি। মালাকর যেন 'ভুল স্বর্গে'র সেই বেকার লোকটি, যে ভুলবশত এসে পড়েছে এক 'কেজো লোকের স্বর্গে'। যেখানে আর সবই আছে, নেই কেবল অবসর। অবকাশ নেই কারও পৃথিবীর অমেয় রং-রূপে ভাগ নেওয়ার।
 
        মাত্র চারটি ছোট অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই গল্পটির প্রথম অংশে আমরা সেই বেকার মানুষটির দেখা পাই যে ছোট ছোট কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে ছোট ছোট ঝিনুক সাজায়। লোকে তাকে বলে পাগল। এই অকাজের পাগল মানুষটি পৃথিবীতে এসে শুধু লাঞ্ছনা পায়। তবু কাজের প্রতি টান কমে না তার। সে ভাবে পাগলামি ছেড়ে দেবো। কিন্তু পাগলামি তাকে ছাড়ে না। এই পাগলের কোন এক সুকৃতির ফলে মৃত্যুর পরে তার স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে। সারা জীবন অকাজে কাটিয়ে ভুলবশত সে গিয়ে পড়ে কেজো লোকেদের স্বর্গে। সেখানে অবকাশ ছাড়া আর সবই আছে। সেখানে পুরুষেরা বলছে,'হাঁফ ছাড়ার সময় কোথা'? মেয়েরা বলছে,'চললুম ভাই কাজ রয়েছে পড়ে।' সবাই বলে সময়ের মূল্য আছে। কেউ বলে না সময় অমূল্য"।

এমন যতো কাজের ফাঁসেই আটকে কবির যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল কিছুদিন ধরেই। যেন তারই একটা ছায়া পড়েছে কেজো স্বর্গের বর্ণনায়। কাজ ছেড়ে অসুস্থতার কারণে তিনি যখন নিজের খোলা জানালার সামনে আসন পেতে বসেছেন তখনই তাঁর ইচ্ছা হয়েছে আপন কলসটিকে চিত্রিত করার। সেই চিত্র ফুটে উঠেছে 'লিপিকা'র ছত্রে ছত্রে, সমকালে লেখা গীতবিতানের গানগুলির চরণে চরণে। হৃদয় উৎসারিত সেই তুলির রঙ যেন পৃথিবীতে ধরে না। তার টান বুঝি অনন্তের সন্ধানে!

      গল্পের তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা খোঁজ পাই সেই কলসটির। "এই 'ঘট' বা 'ঘড়া' কিংবা রবীন্দ্রনাথের বহুব্যবহৃত খুব প্রিয় একটি রূপকল্প। সমস্ত প্রয়োজনের বন্ধনকে সম্পূর্ণভাবে অভিভব করে তোলা এক বিশুদ্ধ শিল্প চৈতন্যের অনন্য রূপক। এই কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে কিটসের 'ওড অন এ গ্রিসিয়ান আর্ন' কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।" ১৯২৪ সালে লেখা 'তথ্য ও সত্য' প্রবন্ধে এই কবিতাটি সম্পর্কে কবি বলেন, "এমন অপরূপ পাত্রের প্রয়োজন কী। কী বিচিত্র এর গড়ন, কত রঙ দিয়ে আঁকা। এঁকে সময় নষ্ট করা বললে  প্রতিবাদ করা যায় না। রূপদক্ষ আপনার চিত্তকে এই একটি ঘটের উপর উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে; বলতে পারো সমস্তই বাজে খরচ হল। সে কথা মানি; সৃষ্টির বাজে খরচের বিভাগেই অসীমের খাস তহবিল।"   

         কেজো লোকের স্বর্গে গিয়ে কাজভোলা শিল্পী তাই ব্যস্ত মেয়ের ঘড়াটি চেয়ে নেয়, চারপাশ ঘিরে নকশা আঁকে। নিজের স্বপ্নকল্পনা সেই কলসির গায়ে উজাড় করে এঁকে দেয়। কেজো লোকের স্বর্গে এমন কল্পনার রূপটান আগে কেউ দেখেনি। মেয়েটির চোখে তাই বিস্ময়। সে বুঝতে পারে না এর অর্থ কি? এর প্রয়োজনই বা কোথায়? আবার ভুলতেও পারে না সেই  চিত্ররূপময়তা। এই নকশা যেন কখন মায়ার অঞ্জন পরিয়ে দেয় তার চোখে। সে বুঝতে পারেনা এরও মানে। কেবল দেখে আর দেখে। দেখা যেন তার শেষ হয় না। "সবার চোখের আড়ালে বসে সেটিকে সে নানা আলোতে নানা রকমে হেলিয়ে ঘুরিয়ে দেখলে। রাত্রে থেকে-থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জ্বেলে চুপ করে বসে সেই চিত্রটা দেখতে লাগল। তার বয়সে এই সে প্রথম এমন-কিছু দেখেছে যার কোন মানে নেই।"

       এই দেখা যেন নিজেরই অন্তরকে মেলে ধরে দেখা। এর মধ্যে ছেয়ে থাকা শিল্পীর ছোঁয়া পেতে থাকে যেন। খুঁজে পায় ভালোবাসা, অকারণে পুলকিত হয়ে ওঠে মন। কেজো দুনিয়া যার মূল্য বোঝে না। মেয়েটির অজান্তেই অমূল্য সেই প্রেম,সুন্দরের প্রতি অনুরাগ একটু একটু করে তার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অন্তর্গত এক বিমল আনন্দে ভরে উঠেছে তার মন। এরপর সেই শিল্পী কেজো স্বর্গের মেয়েটির জন্যে নানা রঙের সুতো দিয়ে বুনে দিয়েছ চুল বাঁধার দড়ি। রেশমের সেই রঙিন সুতোর বন্ধনে বাঁধা পড়েছে কন্যার মন। শিল্পীর বানানো দড়ি দিয়ে চুল বাঁধতে বসলেই "মেয়ের অনেক সময় লাগে। কাজ পড়ে থাকে। বেলা বয়ে যায়।"  নানা রঙের অনুভূতির সুতো যেন আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরে মেয়েটির মনে। ভালোবাসা তো এমনই এক কাজ ভোলানো আপাততুচ্ছ বন্ধন। মানুষকে নিমেষে বেঁধে ফেলে তার অদৃশ্য ডোরে। অপ্রয়োজনের আনন্দেই তো প্রেমের সার্থকতা। উপরন্তু ভালোবাসা বেশ সংক্রামকও। তাই কেজো স্বর্গে প্রেমের এহেন আগমনে, শিল্পের মনোহর সমাগমে "কাজের মধ্যে বড় বড় ফাঁক পড়তে লাগল। কান্নায় আর গানে সেই ফাঁক ভরে উঠল।" 'কান্না' যেন আনন্দেরই দ্যোতনা,'গান' বুঝি মুক্তির প্লাবন!

        স্বর্গের প্রবীণেরা বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আসলে কেজো লোকের স্বর্গে শিল্পের জন্ম থেকেই হল আনন্দের সূচনা। যে শিল্পসৃষ্টির কোনো হেতু বা কারণ থাকে না। যা মনকে কেবল অনন্তের দিকে টানে। সুন্দর হাতছানি দেয়,  প্রেমের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যায়। বাস্তবের তুচ্ছ কাজ তখনই ছুটি চায়, দূরে সরে যেতে থাকে। সৃজনের বন্ধনে যে শিল্প তার আস্বাদনে মন উদাসীন হয়। কখনও অপূর্ণতায়, বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়। নিছক কেজো সময় তখন অশ্রুর আর সুরের মেলবন্ধনে পাড়ি দিতে চায় স্বর্গীয় প্রেমের পথে। অনন্তের পথে। সময় হয়ে ওঠে অমূল্য।

        কিন্তু কেজো মানুষ তার রস আস্বাদ করতে জানে না। প্রেম তাদের অন্তরকে স্পর্শ করতে ভয় পায়। তারা বুঝতেই পারে না সৃজনের আনন্দ কী! মনে হয় এ বুঝি মস্ত বড় একটা ভুল। তাই চিরকাল সমাজ একজন প্রেমিককে, স্রষ্টাকে পাগল বলে চিহ্নিত করে এসেছে। নির্বাসন দিয়েছে কাজের জগত থেকে। একমাত্র প্রেমই হয়েছে শিল্পীর সঙ্গী। এই গল্পের শেষেও তাই দেখি কেজো স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসার সময় 'প্রেম' শিল্পীর সঙ্গ নিয়েছে। "মেয়েটি এসে বললে, 'আমিও যাব'।" এর মানে বুঝতে পারেনি প্রবীণ সভাপতি। 'এই সে প্রথম দেখলে এমন একটা কাণ্ড যার কোন মানে নেই।' এ ঘটনা তাকেও যেন একটু অন্যমনস্ক করে দিল, একটু বিষন্ন করলো অকারণেই।

         কর্তব্য আর নিছক কাজের যে পার্থক্য, রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'শান্তিনিকেতন' গ্রন্থে সে বিষয়ে উল্লিখিত কিছু কথা লিপিকার এই 'ভুল স্বর্গ' গল্পটি প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। নিবন্ধে তিনি লিখছেন, "নীতিজ্ঞেরা আমাদিগকে নিন্দা করেন। বলেন, আমাদের জীবন বৃথা গেল। তাঁহারা আমাদিগকে তাড়না করিয়া বলিতেছেন, 'ওঠো, জাগো, কাজ করো, সময় নষ্ট করিয়ো না।'   ... কাজ না করিয়া অনেকে সময় নষ্ট করে সন্দেহ নাই, কিন্তু কাজ করিয়া যাহারা সময় নষ্ট করে তাহারা কাজও নষ্ট করে, সময়ও নষ্ট করে।"

এখানে তিনি তাঁর প্রিয় উপমা ঘটের কথাও এনেছেন, লিখেছেন, "জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও। কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে--- তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে। আর কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহ রক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে। তাহার যে জল আমরা খাল কাটিয়া পুকুরে আনি, তাহাতে স্নান করা চলে কিন্তু তাহা পান করি না; তাহার যে জল ঘটে করিয়া আনিয়া আমরা জালায় ধরিয়া রাখি তাহা পান করা চলে, কিন্তু তাহার উপরে আলো-ছায়ার উৎসব হয় না। ...উদ্দেশ্যকেই একমাত্র পরিণাম গণ্য করা দীনতার পরিচয়।"

ভুল স্বর্গে এসে মানুষটি ঘড়ার ওপরে ছবি আঁকে, রঙিন সুতো দিয়ে মেয়েটির চুল বাঁধার ব্যবস্থা করে। এ কারণে কাজের জগতে সে হাস্যস্পদ হয়ে উঠলেও বস্তুত সে-ই বর্ণময় করে তুলেছিল মানুষের কেজো পৃথিবীকে।  রবীন্দ্রনাথের নিমগ্ন উপলব্ধিতে, "আমরা যাহাকে ব্যর্থ বলি প্রকৃতির  অধিকাংশই তাই। সূর্যকিরণের বেশিরভাগ শূন্যে বিকীর্ণ হয়, গাছের মুকুল অতি অল্পই ফল পর্যন্ত টিকে। আমরাও তেমনি অধিকাংশই পরস্পরকে সঙ্গদান ও গতিদান ছাড়া আর কোন কাজে লাগি না,সেজন্য নিজেকে ও অন্যকে কোন দোষ না দিয়া, ছটফট না করিয়া, প্রফুল্ল হাস্যে ও প্রসন্ন গানে সহজেই অখ্যাত অবসানের মধ্যে যদি শান্তিলাভ করি, তাহা হইলেই সে উদ্দেশ্যহীনতার মধ্যে যথার্থভাবে জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারি।"

       আসলে আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় সারা জীবন একটা ভুল স্বর্গে বাস করি। মনে মনে নিজেদের কর্তব্য স্থির করে সেই বৃথা কর্তব্যের চাকায় চোখ বেঁধে ঘুরতে থাকি। নিজেদের তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করি। অপরূপ এই বিশ্বের রূপ দেখতে চাই না। প্রকৃতির অশ্রুত সঙ্গীত শোনার জন্য প্রকৃতির সঙ্গসুধার প্রয়োজন অনুভব করি না। চোখ থেকেও দেখতে পাইনা মহাবিশ্বের অপরূপ লীলা। পার্থিব জীবনে ছোটখাটো যতকিছু চাওয়া পাওয়ার তুচ্ছতা নিয়ে কাটিয়ে দিই এমন একটা এককালীন জীবন। প্রেমের উপলব্ধিতে, প্রকৃতির অপরূপ লীলা অনুভব করার মধ্যে যে আনন্দ, সেই আনন্দই যে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বর্য সেকথা ভুলে যাই। কেউ এই সারসত্য বুঝে ফেললে সেই প্রেমিক আমাদের চোখে হয় ওঠে নির্বোধ। গোধূলি আকাশের নিবিড় নীলিমার দিকে চেয়ে   ব্যথায় বুক ভরে ওঠে যখন, মনে হয় সত্যিকারের কিছুই তো করা হলো না।  জীবনটা কেজো একটা স্বর্গের যাবতীয় অকাজের মধ্য দিয়েই পৌঁছে গেল অবধারিত একটা ভুল স্বর্গে। অচেনা কুসুমের গন্ধে অনির্বাণ প্রাণের সেই আপন গোপন আনন্দ আর পাওয়া হল কই?