হরপ্পা সভ্যতায় বৈদিক ছাপ - সঙ্ঘ পরিবারের দখলদারি

আমরা সরস্বতী নদী প্রসঙ্গ আলোচনায় [ https://othervoice.in/article/ov-7-1-22-2 ] হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সংস্কৃতির সময়কাল ও স্তর পার্থক্য নিয়ে কিছু কথা বলেছি। তখন দেখিয়েছি, সরস্বতী নদী নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের এত মাতামাতির কারণ হল: যে কোনো উপায়ে সিন্ধু প্রত্নক্ষেত্রের বর্তমান ভারতভুক্ত একটা বড় নদীখাতকে “সরস্বতী” হিসাবে দাঁড় করিয়ে হরপ্পা সভ্যতার সমস্ত বসতিকে বৈদিক যুগের ধারাবাহিকতায় ঢুকিয়ে দেওয়া। এটা করতে পারলে খানিকটা ভূগোল ও ভূতত্ত্বের নামেই সঙ্ঘ চাহিদা মতো ইতিহাসের কাজটা সেরে ফেলা যায়। একটু বৈজ্ঞানিক পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধের গন্ধ আর স্পর্শও বুঝি লেগে থাকে।

এবার সেই বিষয়ে আরও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে চাই।

 

[১] সংস্কৃতি ও সভ্যতা

প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসে সভ্যতা ও সংস্কৃতি শব্দ দুটি আদৌ সমার্থক বা সমতুল্য নয়।

সংস্কৃতি বলতে বোঝায় একটা জনগোষ্ঠীর বিশেষ সময়কালে সমবেত জীবনযাপন পদ্ধতিকে। একটা মানব গোষ্ঠী কী ধরনের হাতিয়ার বাসনপত্র এবং অলঙ্কার ব্যবহার করে, কীভাবে খাদ্য সংগ্রহ বা উৎপাদন করে, কীভাবে মৃতের সতকার করে, তাদের পারিবারিক কাঠামো কেমন, ইত্যাদি—সেগুলোই সামগ্রিকভাবে তাদের সংস্কৃতিকে নির্দেশ করে। যেমন—প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি, পশুপালক সংস্কৃতি, ইত্যাদি।

কিন্তু সভ্যতা হল একটা বিশেষ পর্যায়ের উন্নততর সংস্কৃতি, যেখানে একটা জনসমষ্টির জীবনে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি সুস্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে: (ক) পাকাবাড়ি, প্রাকার ও প্রাচীর ভিত্তিক নগর সংস্কৃতি; (খ) শ্রম বিভাজন; (গ) শ্রেণি বিভাজন ও রাষ্ট্র; (ঘ) নৃজাতিগত উপজাতীয় রক্ত সম্পর্কিত সমাজ সংগঠনের বদলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমাজ সংগঠন; (ঙ) নৃজাতিগত বৈবাহিক সম্পর্কের বদলে আঞ্চলিক বৈবাহিক সম্পর্ক; (চ) খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টনের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পদ্ধতি; কৃষি, পশুপালন, প্রভৃতি; (ছ) ধাতুর হাতিয়ার; (জ) লিপি ও লিখন পদ্ধতি; (ঝ) সংখ্যা ও গণনা; (ঞ) বাণিজ্য ও মুদ্রা; (ট) ওজন পরিমাপন ব্যবস্থা (বাটখারা, দাঁড়িপাল্লা, ইত্যাদি), ও অন্যান্য।

অর্থাৎ, সভ্যতাও একটা সংস্কৃতি, বিশেষ ভাবে উন্নততর সংস্কৃতি; কিন্তু যে কোনো সংস্কৃতিকেই সভ্যতা বলা যায় না।

সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তর, যথা, অসভ্য/আদিম পর্যায় (savagery), বর্বর/প্রাচীন পর্যায় (barbarism) অতিক্রম করে, যাযাবর (nomadic) জীবন যাপন পর্ব পার হয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে, গ্রামীন সংস্কৃতির ধাপ পেড়িয়ে এসে, প্রস্তর যুগ থেকে ধাতু যুগে প্রবেশ করে, সংগঠিত কৃষি ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটা উন্নততর পর্যায়ে এসে মানুষ পাকাবাড়ি ও প্রাচীর সমন্বিত নগর নির্মাণ করতে শিখেছে। মিশর, ব্যাবিলন, চিন, গ্রিস ও ভারত—সর্বত্রই সমাজ বিবর্তনের এই পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলি এখন সুস্পষ্ট রূপে আবিষ্কৃত, চিহ্নিত ও সর্বজনস্বীকৃত। [গঙ্গোপাধ্যায় ২০০৩, ১৮-২০; রত্নাগর ২০০৩, ৮-১০]

এই সব যাচকাঠি প্রয়োগ করলে বোঝা যায়, হরপ্পার সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে তাম্রব্রোঞ্জ যুগের এক নগর সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। সেখানে নগর জীবন, ধাতুর ব্যবহার, লিপি ও লিখন, সংখ্যা গণনা, ওজন মাপার বাটখারা, ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষ বস্তুগত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণে এবং এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। এর অধীন এলাকা ছিল সমগ্র অবিভক্ত উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ, বিস্তারে প্রায় সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল মোটামুটি ৪০ লক্ষ। [হাবিব ২০০৪, ২৫-২৬] কারও কারও মতে এর বিস্তার ছিল ১০ লক্ষ বর্গ কিমি। [গঙ্গোপাধ্যায় ২০০৩, ১৯] আবার এই সমস্ত অঞ্চল থেকেই রাষ্ট্র গঠন, শ্রমবিভাজন ও শ্রেণি বিভাজন, সংগঠিত অর্থনীতি, ইত্যাদি বিষয়ে নানা রকম পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে। সারা বিশ্বের সংশ্লিষ্ট পণ্ডিত সমাজ যার মূল্যায়নে মোটামুটি একমত।

এর পাশাপাশি বৈদিক যুগের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার (সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ সমূহ) নিয়ে অনুসন্ধান করলে যে জীবন পদ্ধতির ছবি ফুটে ওঠে তা হচ্ছে অরণ্যবাসী, যাযাবর, পশুপালক, যোদ্ধৃ জনজাতি সমূহের গ্রামীন বসতি। এখানে নগর নেই, লিপি নেই, লেখা নেই, সংখ্যা নেই, গণনা নেই, ওজন বা বাটখারা নেই। কেন না, উৎপাদন ও বন্টনের কোনো প্রশ্ন নেই। এখানে ধাতু আছে; কিন্তু তার ব্যবহার শুধু অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে। এতে দান ভোগ বা দখলের লক্ষ্য জমি নয়, অপরের উৎপন্ন শস্য, তাদের গাভী ও অশ্ব, ইত্যাদি। এমনকি, ঋগবেদের বিশাল অংশ জুড়ে শ্রেণি বিভাজনেরও কোনো চিহ্ন নেই। ফলে বৈদিক সংস্কৃতি কথাটা প্রযোজ্য হলেও “বৈদিক সভ্যতা” শব্দবন্ধ সংজ্ঞাগত ভাবেই অর্থহীন।

বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে কি হরপ্পা সভ্যতার কি কোনো ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক ও নৃজাতিগত যোগসূত্র আছে? এমনটা কি হতে পারে না যে প্রাচীনতর বৈদিক সংস্কৃতি থেকেই কালক্রমে একই জনগোষ্ঠীর বংশধররা হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল? বিজেপি লবির নানা সংগঠনের দ্বারা উত্থাপিত ও প্রচারিত এরকম একটা দাবিকে ভৌগোলিক অবস্থানের সাযুজ্যের কারণে এ দেশের বহু শিক্ষিত মানুষও সহজেই আজকাল গ্রহণ করে বসেন। তাই এই দাবিটিকেও নানা দিক থেকে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।      

আমাদের জেনে রাখা দরকার—হরপ্পা সভ্যতা (খ্রিঃপূঃ ৩৫০০-১৮৫০) ও বৈদিক সংস্কৃতি (খ্রিঃপূঃ ১৫০০-৮০০)-র সময়কাল নানা ভাবে নির্ধারিত হয়েছে। তা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের বাইরে পণ্ডিত মহলে এখন আর খুব একটা মত বিরোধ নেই। সেই সময়ক্রম মেনে নিলে এমনিতেই আর উপরোক্ত দাবিটা উত্থাপন করা যায় না। হরপ্পা সভ্যতার অবসানের কয়েকশ বছর পরে বৈদিক জনগোষ্ঠীর উত্তর পশ্চিম ভারতে আগম ঘটেছিল। সুতরাং তাদের পক্ষে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তোলার প্রশ্নই ওঠে না।

তবে এরকম একটা বিতর্ক এখনও চলমান—হরপ্পা সভ্যতার অবসানের ব্যাপারে প্রথম স্রোতে আগত বৈদিক জনগোষ্ঠীর কোনো ভূমিকা ছিল কিনা, থাকলে কতটা এবং কী ধরনের। কারণ, একদিকে হরপ্পা মহেন-জো-দারো এবং আরও কয়েকটি সিন্ধু প্রত্নক্ষেত্রে ধ্বংস হত্যা লুণ্ঠনের এবং তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যাওয়ার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। অপর দিকে ঋগবেদে পৌনঃপুনিক নগর ধ্বংসের উল্লেখ, “হরিউপিয়া” (= হরপ্পা?) নামক পুরধ্বংসের বিবরণ [ঋগবেদ ৬/২৭/২৫], এবং ইন্দ্রকে বার পঞ্চাশেক অন্তত “পুরন্দর” (= পুর/নগর ধ্বংসকারী) রূপে আবাহন—ইত্যাদি দেখে এক সময় অনেকেই মনে করেছেন, বৈদিক গোষ্ঠীর জনজাতিগুলির বারংবার সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের ফলেই অবক্ষয়িত সিন্ধু সভ্যতা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। [Wheeler 1968; Kosambi 1975, 72-75]

কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় এই তত্ত্বে নানা দিক থেকে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দেখানো হয়েছে যে ভূতাত্ত্বিক, জলবায়ুগত এবং পরিবেশগত কারণেই প্রধানত সিন্ধু সভ্যতা খুব দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যায়। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কৃষি ক্ষেত্র ও নগরায়নের জন্য সিন্ধু নদীর অববাহিকায় দেড় দুহাজার বছর ধরে বিপুল পরিমাণ গাছপালা কেটে ফেলার ফলে ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাত কমে যায়, শুষ্ক মাটির পক্ষে জল ও জলীয় বাষ্প অণু ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে আসে। থর মরুভূমির বিস্তার ঘটতে থাকে। [হাবিব ২০০৪, ৬৭-৭১; গঙ্গোপাধ্যায় ২০০৩, ২৭-৩০] বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় একটা ভয়ঙ্কর বিপদ হিসাবে অধিবাসীদের ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। তখন তারা চার দিকের অনুন্নত জনসমাজে ছড়িয়ে পড়তে ও মিশে যেতে বাধ্য হয়। আবার এই সময়ই পশ্চিম দিক থেকে দলে দলে আগত বৈদিক জনজাতিগুলির পূর্বপ্রজন্মের সঙ্গেও তাদের সংঘর্ষ হতে পারে, যেখানে তারা বেশির ভাগই পরাস্ত ও বশীভুত হয়।

এই সমস্ত পর্যালোচনা থেকেও এটা স্পষ্ট যে এই দুটো সংস্কৃতির ধারকবাহকরা এক নৃগোষ্ঠীর লোক নয়।

এখানে একটা কথা বলে যেতে চাই।

ভারতের ইতিহাস রচনায় ধর্মীয় এবং মতাদর্শগত বিশ্বাস কীভাবে প্রভাব ফেলেছে তার একটা ভালো (আসলে খারাপ) উদাহরণ দিতে চাই। হরপ্পা সভ্যতা আর বৈদিক সংস্কৃতির মধ্যে যে নৃজাতিগত ধারাবাহিক সংযোগ নেই, অন্যান্য স্বপেশাভুক্ত পুরাতত্ত্ববিদদের মতো ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা (ASI বা Archaeological Survey of India) দপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক বি বি লাল এবং বিশিষ্ট পুরাতত্ত্ববিদ এস পি গুপ্তও এক সময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। [Lal 1978; Lal and Gupta eds. 1984, 55-62] দুঃখের বিষয়, রাম জন্মভূমি উদ্ধার ও বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে সেখানে একটা রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে সঙ্ঘ পরিবার যে জঙ্গি মৌলবাদী আন্দোলন শুরু করে, তার খাতায় নাম লেখানোর পর থেকে এনারা নিজেদের পেশার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ করে ঠিক বিপরীত এবং হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন। [Lal 1997, 281-87; Gupta ed. 1995] দেশ ও জাতির পক্ষে, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে, এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় আঘাত।

 

[২] পার্থক্য অনেক

কিন্তু বিজেপি লবির এই বিপরীত ভাবনাটা মেনে নিলে আমরা যে কয়েকটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু অসঙ্গতির সামনে পড়ে যাই—সেটা এনারা হয় খেয়াল করেন না, অথবা, মতাদর্শিক অন্ধতার কারণে অগ্রাহ্য করে থাকেন।

সেই সমস্ত অসঙ্গতিগুলি একে একে দেখা যাক।

প্রথমত, এই প্রকল্পটি মেনে নিলে বলতে হয়: যে জনগোষ্ঠীর লোকেরা বৈদিক যুগের গ্রামীন সংস্কৃতি পার হয়ে এসে সিন্ধু অববাহিকায় এক সমুন্নত নাগরিক সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিল, তারা সেই সভ্যতাকে ধরে রাখতে তো পারলই না, এমনকি তারপর প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে (খ্রিঃপূঃ ১৮০০-৪০০) তারা আর কোথাও নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে পারল না। উপরন্তু নগর সভ্যতা ধ্বংসের পরও তারা সেই এলাকাতেই থেকে গেল, চাষবাস করতেও ভুলে গেল এবং অরণ্য জীবনের ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের অভ্যাসে ফিরে গেল। নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক যোগসূত্র মেনে নিলে জলবায়ু, আবহাওয়া, ভূতত্ত্ব কিংবা সংঘর্ষ, ইত্যাদি দিয়ে এরকম একটা বড় কালানুগ বিচ্ছিন্নতার কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

দ্বিতীয়ত, লেখা এবং লিপি নিয়ে অনেকগুলি সমস্যার সমাধান চাই। বৈদিক জনজাতিগুলি বেদ রচনার যুগে লিখতে জানত না। তাদের সেই জন্য কোনো লিপি বা বর্ণমালা ছিল না। তারা মুখে মুখে কাব্য রচনা করেছে এবং শুনে শুনে বারবার আবৃত্তি করে তা স্মৃতিতে ধারণ করেছে। এই জন্য বেদের এক (শাস্ত্রিক) নাম শ্রুতি। সিন্ধু সভ্যতার পত্তনের কালে তারা লিখতে শিখল, লিপিও উদ্ভাবন করে ফেলল। সেই সভ্যতার অবসান কালে আবার তারা কম বেশি এক হাজার বছর (আনুমানিক খ্রিঃপূঃ ৮০০ পর্যন্ত) লিখতে ভুলে গেল। বেদোত্তর বা বৌদ্ধযুগের সমসাময়িক কালে এসে নতুন করে তারা লিখতে শিখল, নতুন হরফের জন্ম দিল। যা সিন্ধু ক্ষেত্রের অক্ষর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এগুলো কী করে ঘটল? নৃজাতিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় বড় আকারের বা মৌলিক ধরনের ছেদ না থাকলে এটা হতে পারত না।

লিপি-সংযোগ সমস্যা সমাধান করার জন্য আমেরিকা প্রবাসী একজন বিজেপি তাত্ত্বিক নবরত্ন এস. রাজারাম হরপ্পা লিপির সম্পূর্ণ “পাঠোদ্ধার” করে ফেলেছেন বলে দাবি করে ১৯৯৯ সালে (সালটা লক্ষ করুন; তখনও কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি জোট) এক তুমুল শোরগোল ফেলে দেন । [Rajaram and Jha 1999] সেখানে তিনি দাবি করেন, হরপ্পার ১২০০-র মতো সিল তিনি পড়ে ফেলেছেন এবং দেখেছেন যে সেগুলো সব সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এটা সত্যি হলে বৈদিক-সিন্ধু যোগসূত্রের পক্ষে একটা জোরালো যুক্তি হতে পারত। কিন্তু এতে অন্য দিক থেকে একাধিক সমস্যা দেখা দিল:

এক, আবারও আগের প্রশ্নটি উঠে এল। হরপ্পা সভ্যতার আগেও সংস্কৃত ভাষা, পরেও সংস্কৃত ভাষা। সুতরাং মধ্যেও যদি সংস্কৃত ভাষাই হয় এত দিনেও তা চেনা বা পড়া গেল না কেন? এর লিপি ব্যবহার এরই উদ্ভাবক এবং সাংস্কৃতিক অনুসারীদের মধ্যে অপ্রচলিত হয়ে বা হারিয়ে গেল কেন? সংস্কৃত ভাষাতে দ্বিতীয় দফায় লেখার জন্য প্রায় হাজার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল, পুরনো হরফ হারিয়ে গেল, নতুন করে ব্রাহ্মীলিপি খরোষ্ঠী লিপি হয়ে দেবনাগরী লিপিতে পৌঁছতে হল—এই সব ঘটনারও তো ব্যাখ্যা চাই।

দুই, আর একটা আরও ঘোরালো সমস্যা আছে। সিন্ধ সভ্যতার লিপিগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব না হলেও নানা রকম তুলনামূলক আলোচনা করে দেখা গেছে—এর লিখন প্রণালী ছিল ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। আর সংস্কৃত ভাষার লিখন প্রণালী হচ্ছে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। তার মানে দাঁড়ায়—একই নৃসাংস্কৃতিক গোষ্ঠী একই ভাষায় প্রথমে দু-এক হাজার বছর লিখে গেল বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। তার পরের দেড় হাজার বছর ধরে তারা লিখল উলটো ভাবে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। অবশেষে তারা হাজার খানেক বছর সেই লিপি এবং লিখন প্রণালী সম্পূর্ণ ভুলে গেল এবং পরে যখন আবার লিখতে শিখল, তা হয়ে গেল বাঁ দিক থেকে ডান দিকে।

খুবই কষ্ট কল্পনা নয় কি! সেই জন্যই বোধ হয় এবারের মোদী পর্বে রাজারামদের নাম এবং কর্মের কথা আর খুব একটা শোনা যাচ্ছে না।

তৃতীয়ত, হরপ্পা লিপিগুলির চরিত্র ঠিক ধ্বনিমূলক (phonetic) নয়, অনেকটা ভাবমূলক (ideographic)। সেই কারণেই এর পাঠোদ্ধারে এত সমস্যা। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ এবং লিখিত রূপ যখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু আরও খানিকটা উন্নত ও আধুনিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা নির্ভর। ফলে এদিক থেকেও হরপ্পার সভ্যতা বিকাশের পেছনে সংস্কৃত ভাষার বাহক বৈদিক জনগোষ্ঠীকে ধরা যায় না। 

এই সমস্ত তথ্যগুলিকে এক সঙ্গে বিচার করে একটাই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে। ভাষার প্রশ্নে বৈদিক সংস্কৃতি ও সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বা ধারাবাহিকতা নেই। ভাষা হচ্ছে মানব সত্তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিচিতি। সুতরাং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ভারতে এসে যারা বৈদিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল, তাদের এই স্বতন্ত্র (মৌখিক ও লিখিত) ভাষা সত্তাই বলে দিচ্ছে, হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না বা হয়নি।

চতুর্থত, এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে ঘোড়া একটি সুন্দর ও সুনির্দিষ্ট বিভাজক। বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অশ্ব বা ঘোড়া নানা ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ঋগবেদে ঘোড়ার উল্লেখ আছে ২১৫ বার। এর সঙ্গে তুলনীয় গরু আছে ১৭৬ বার এবং বলদ ১৭০ বার। গরু ও বলদ পশুচারণের পরিচায়ক হলেও ঘোড়া মূলত যুদ্ধের সঙ্গী। যোদ্ধার বাহক। বৈদিক জনজাতিগুলির জীবন যাত্রায় যুদ্ধ সংঘর্ষ এবং ঘোড়া ছিল নিত্য সঙ্গী। রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন ঘোড়ার এই সামরিক ব্যবহারকে ম্যাজিক তাৎপর্যে উন্নীত করারই সাক্ষ্য। আমি ঘোড়া ছেড়ে দিলাম। সে যত দূর বাধাহীন ভাবে যাবে ততই আমার রাজ্য বৃদ্ধি পাবে। ধরে নেওয়া হবে, সবাই আমার বশ্যতা মেনে নিয়েছে। তুমি যদি তাকে আটকাও, তোমার সঙ্গে আমার যুদ্ধ হবে। পক্ষান্তরে, খুব ভালো করে খুঁজেও হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রগুলিতে ঘোড়ার অস্থি বা অন্য রকম কোনো জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি। এমনকি সেখান থেকে প্রাপ্ত সিলগুলিতেও ঘোড়ার কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। [শর্মা ২০০২, ২-৯, ২৫-২৬]

যায়নি? তো কী হয়েছে? ম্যাঁয় হুঁ না! পূর্বোক্ত বুদ্ধিমান রাজারাম হঠাৎ দাবি করে বসলেন, তিনি হরপ্পার একটি সিলে ঘোড়ার ছবি দেখতে পেয়েছেন। চার দিকে হইচই পড়ে গেল। সাংঘাতিক খবর। সিন্ধু প্রত্নক্ষেত্রে তাহলে ঘোড়া ছিল?

পরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল, রাজারাম কম্পিউটার প্রোগ্র্যাম দিয়ে ফটোশপ করে আলোচ্য সিলের ছবি নতুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। [Witzel and Farmer 2000] এই ফেক ছবি ভিডিও ইত্যাদি বানানোয় সংঘ পরিবারের ইঞ্জিয়াররা বরাবরই দক্ষ কিনা।

পঞ্চমত, ঘোড়ার বদলে হরপ্পার প্রত্নবস্তুতে যে প্রাণীটির বহু বার (১২০৪টি চিত্রিত সিলে) সাক্ষাত মেলে—এক শিং বিশিষ্ট গণ্ডার (unicorn)—বৈদিক সাহিত্যে তা লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত। এখানে এটাও উল্লেখনীয় যে উত্তর পশ্চিম ভারতে বা সিন্ধু অববাহিকায় ঘোড়া স্বাভাবিক পশু নয়, কিন্তু গণ্ডার এই অঞ্চলের স্বাভাবিক বন্য প্রাণী। ঘোড়া এসেছিল বৈদিক জনগোষ্ঠীর পূর্বপ্রজন্মের লোকদের বাহক ও সহযাত্রী হয়ে এবং সিন্ধু প্রত্নক্ষেত্রে তার আগমন খ্রিঃপূ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ায়। এর আগেকার কোনো ঘোড়ার জীবাশ্ম এখানে মেলেনি। তাই হরপ্পার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কোথাও ঘোড়া নেই। রাজারাম কি আর সাধে মরিয়া হয়ে ফটোশপে হাত লাগিয়েছিলেন! এই একটি প্রাণী অতএব হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সংস্কৃতির মধ্যে শুধু স্তর ভেদ নয়, কালানুক্রমিক পার্থক্যকেও চিহ্নিত করে দিয়েছে। ঘোড়ার পিঠে চেপে বৈদিক জনজাতির পক্ষে ইতিহাসের বেশি দূর অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়—অন্তত ভারতের মাটিতে।

ষষ্ঠত, রথ এবং রথের স্পোক যুক্ত চাকা—দুটোই বৈদিক সংস্কৃতির খুব উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রগুলিতেও চাকা এবং চাকাবাহিত যান দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু রথের কোনো বৈশিষ্ট্যই সেখানে নেই। ভারত সহ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত অধিকাংশ জনসমাজেই (যেমন, গ্রিক, রোমান) রথের ব্যবহার ছিল। রথ ঠিক যাত্রীবাহী বা মাল পরিবাহী যানবাহন নয়, ঘোড়ার গাড়ি বা এক্কা টাঙ্গা জাতীয় গাড়ি নয়। রথ হচ্ছে সেনাপতি এবং তিরন্দাজের উপযোগী, একজনের ব্যবহার্য, দ্রুতগামী ও খোলা যুদ্ধ যান। বৈদিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা সকলে না হলেও অনেকেই রথের ব্যবহার করত। তাদের প্রাচীন বসতিগুলিতে এর বেশ কিছু প্রত্নসাক্ষ্য পাওয়া গেছে। এদের ক্রমাগত যুদ্ধ সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় অভিবাসন এবং/অথবা অভিযান কালে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঘোড়ায় টানা রথের একটা বড় সাফল্যপ্রদ ভূমিকা ছিল। পক্ষান্তরে, হরপ্পার ক্ষেত্রগুলির অধিবাসীরা স্থায়ী বসতিতে সুস্থিত উৎপাদন ও জীবনযাত্রায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলে যুদ্ধ তাদের নিয়মিত ব্যাপার ছিল না। তাই যুদ্ধযান না থাকাটাও তাদের দিক থেকে স্বাভাবিক—এটাও বি. বি. লাল এক সময় বিশেষভাবে লক্ষ করেছিলেন এবং স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন। [Lal 1984, 55] একই কারণে চাকার বিকাশ বা স্পোক যুক্ত হালকা চাকা উদ্ভাবনের প্রয়োজন তাদের হয়নি। তাদের সমস্ত চাকাই সুঠাম এবং জমাট, সেগুলো ভারি মাল পরিবহনের পক্ষে উপযুক্ত মন্থর যানের চাকা।

পরিশেষে, দেবমণ্ডলির কথায় আসা যাক। একটা বিশেষ সময় ও সমাজের কোনো জনগোষ্ঠীকে সনাক্ত বা পৃথক করার একটা সহজ পদ্ধতি হল তাদের দেবদেবীর বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র অনুধাবন। কারণ সমাজতত্ত্বের একটা অন্যতম সূত্র হল: মানুষ তার নিজের দৈহিক, পারিবারিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলির আঙ্গিকেই তার দেবদেবী সমূহ সৃষ্টি করে থাকে। যেমন ধরুন, বৈদিক সাহিত্যে প্রধান প্রধান যে যে দেবতার নাম ও স্তুতি দেখতে পাওয়া যায় তারা সকলেই পুরুষ দেবতা। ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র, মিত্র, অগ্নি, সূর্য, ইত্যাদি। দু-একজন নারী দেবতার নাম পরিচয় থাকলেও গুরুত্বের বিচারে তারা নিতান্তই গৌণ। অনেকেই মনে করেন, যাযাবর পশুপালক বৈদিক জনগোষ্ঠীর লোকদের সমাজে পুরুষ প্রাধান্য ছিল বলেই তাদের দেবমণ্ডলিতে পুরুষ দেবতাদের সংখ্যাধিক্য ও বেশি গুরুত্ব। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার সমাজ কাঠামো যেটুকু আন্দাজ করা যায় তা বিভিন্ন মাটির তৈরি মূর্তি থেকে। কিছু কিছু মূর্তি স্পষ্টতই দেবতা সম্বন্ধীয়। আর সেগুলি সবই নারী মূর্তি। সুস্থিত কৃষি ভিত্তিক সমাজের সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ। বেদোত্তর বা পৌরাণিক যুগের ভারতীয় সমাজে যখন কৃষির পুনর্বিকাশ হল, এখানেও প্রধান দেবতারা সকলেই নারী রূপে দেখা দিল। সূর্য বাদে বৈদিক যুগের প্রায় সমস্ত পুরুষ দেবতাই সমাজ জীবন থেকে চিরতরে অবলুপ্ত হল। অর্থাৎ, দেবমণ্ডলির চরিত্রগত পার্থক্যও সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক জনগোষ্ঠীর সময়গত ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানকে তুলে ধরছে।

শেষ কথা, মৃতের সৎকার। প্রায় সমস্ত হরপ্পা ক্ষেত্র থেকেই মৃতের সৎকার পদ্ধতি হিসাবে কবর দান ও সমাধিস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে হরপ্পাবাসীরা মৃতকে কবর দিত, দাহ করত না। কিন্তু বৈদিক সাহিত্য এবং খ্রিঃপূঃ ১৫০০-পরবর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য—দুদিক থেকেই এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে বৈদিক সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তিকে দাহ করাই ছিল সাধারণ লোকাচার। দুটো সংস্কৃতির মধ্যে এই দিক থেকেও একটা মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।

ইরানের অবেস্তানরা অবশ্য মৃতদেহকে খোলা জায়গায় ফেলে আসত। ইরান থেকে আগত বৈদিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় তারও একটা রেশ দেখা যায় “শ্মশান” শব্দটিতে, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, শব শয়ান স্থান।

 

[৩] মিশ্র উত্তরাধিকার

এইভাবে সমস্ত দিক বিবেচনা করে দেখলে এবিষয়ে বোধ হয় সবাই নিঃসন্দেহ হবেন যে, হরপ্পা সভ্যতার মধ্যে বৈদিক সমাজ ও সংস্কৃতির এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই দেখা যায় না, যার সাহায্যে এই দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র বা ধারাবাহিকতার কথা বলা যায়। যাঁরা এই মৌল পার্থক্যগুলিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরা আসলে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছেন, যুক্তি তর্ক এড়িয়ে গিয়ে নিজেদের অন্ধ বিশ্বাসকে ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এর পেছনে রয়েছে তাঁদের এক “আর্যামিয়ানা”-র প্রতি দীর্ঘকালীন মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণ।      

এই মোহমুগ্ধ আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারলে ভারতবাসী মাত্রই সিন্ধু সভ্যতা এবং বৈদিক সংস্কৃতি—এই উভয় প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়েই ব্যাপক গর্ব বোধ করতে পারে। দুটোর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ঐক্য বা যোগসূত্র না থাকলেও। এবং তার জন্য আলাদা একটা “সরস্বতী” নদী খুঁজে না পেলেও। বর্তমান ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমগ্র জনসাধারণ শারীরিক ভাবে এই দুই সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের সম্মিলিত বংশধর; সামাজিক ভাবে এই দুইয়ের মিলনে নির্মিত ও ক্রমবাহিত (পরবর্তীকালে আরও নানা ধারা উপধারার সঙ্গে মিলিত হয়ে) এক মিশ্র সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ঠিক মতো বুঝলে এই গর্বের ভার কিন্তু অনেক বেশি।

সমস্যা হচ্ছে, বর্তমানে সংঘ পরিবারের এবং কেন্দ্রীয় শাসক দলের এই বহুত্ববাদী মিশ্র সংস্কৃতিতে প্রবল আপত্তি। তারা চাইছে ভারতের গোটা ইতিহাসকে এক হিন্দু ধর্মীয় ইতিহাসের একরঙা বৈচিত্র্যহীন ব্রাহ্মণ্য পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের আপ্লবে নির্মাণ করতে এবং তাকেই ভারতের ইতিহাস বলে চালিয়ে ও চাপিয়ে দিতে। রাজনৈতিক দিক থেকে এর মৌল প্রেক্ষিতকে আমাদের বুঝে নিতে হবে।

সাম্প্রতিক অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারাই ফ্যাসিবাদ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, ফ্যাসিস্টরা কীভাবে তাদের প্রচারকার্য চালায় খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, “Fascist politics, however, makes room for the study of myths as fact. In fascist ideology, the function of the education system is to glorify the mythic past, elevating the achievements of members of the nation and obscuring the perspectives and histories of those who do not belong. . . . In fascist ideology, the goal of general education in the schools and universities is to instill pride in the mythic past; fascist education extols academic disciplines that reinforce hierarchical norms and national tradition. For the fascist, schools and universities are there to indoctrinate national or racial pride, conveying for example (where nationalism is racialized) the glorious achievements of the dominant race.” [Jason Stanley (2018), How Fascism Works; Random House, New York; 46-47]   

ইতালি জার্মানি থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বেও যেখানেই নানা ফ্যাসিবাদী শক্তি বিভিন্ন মাত্রায় কাজ করছে, এটাই তাদের একটা সাধারণ লক্ষ্য। যে জাতি বা নৃজাতির জয়গান তারা গাইতে চায়, তাদের অতীতকে বাস্তবের তুলনায় অধিকতর মহান করে চিত্রিত করতে গিয়ে তারা কোনো মিথ্যা প্রচারেই কুণ্ঠিত হয় না, এবং সরকারি ক্ষমতায় থাকলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ থেকেই সেই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত মিথগুলিকে বাজারে প্রামাণ্যজ্ঞান হিসাবে তুলে ধরতে থাকে। সাম্প্রতিক কালে খড়্গপুর আইআইটি থেকে প্রকাশিত এক ক্যালেন্ডারের মাধ্যমেও তারা ভারতীয় হিন্দুদের অতীত গৌরব গাথা তুলে ধরার নামেও সেই কাজটাই করেছে।

আমাদের ঠিক এই কারণেই এই মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

 

তথ্যসূত্র

আনন্দকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (২০০৩), ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে: শিকড়ের খোঁজে; মাত্রা, শ্রীরামপুর।

শিরিন রত্নাগর (২০০৩), হরপ্পা সভ্যতার সন্ধানে: বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায়; ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।

রামশরণ শর্মা (২০০১), আর্যদের ভারতে আগমন; ওরিয়েন্ট লংম্যান (এখন ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান), কলকাতা।

ইরফান হাবিব (২০০৪), সিন্ধু সভ্যতা; ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি, কলকাতা।

 

S. P. Gupta (ed. 1995), The Lost Sarasvati and Indus Civilization; Kusumanjali Prakashan, Jodhpur.

D. D. Kosambi (1975), An Introduction to the Study of Indian History; Popular Prakashan, Mumbai.

B. B. Lal (1978), “The Indo-Aryan Hypothesis vis-à-vis Indian Archaeology”; Journal of Central Asia, Vol. 1 No. 1 (July 1978).

B. B. Lal (1984), “Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan”; in Lal and Gupta (eds. 1984).

B. B. Lal (1997), The Earliest Civilization of South Asia; Aryan Books International, New Delhi.

B. B. Lal and S. P. Gupta (1984), Frontiers of the Indus Civilization; Books and Books, New Delhi.

N. S. Rajaram and N. Jha (1999), The Deciphered Indus Script: Methodology, Reading, Interpretation; New Delhi.

R. E. M. Wheeler (1968), The Indus Civilization; Cambridge University Press, Cambridge.

Michael Witzel and Steve farmer (2000), “Horse Play in harappa”; Frontline, Vol. 17 No. 19 (13 October 2000).