সঙ্ঘ পরিবারের ভূগোল বিজ্ঞান: বেদ কথিত “সরস্বতী” নদী

[১] ইতিহাসের ভূগোল

ইতিহাস ভালো করে বুঝতে হলে, ঐতিহাসিক তথ্য বিচার করতে হলে, অনেক সময়ই আনুষঙ্গিক ভৌগোলিক উপাদানগুলিকে সঠিকভাবে বুঝতে হয়। হয়ত এই কারণেই ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অন্ধতার সুযোগ নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের এক দল বুদ্ধিজীবী ভূগোলকে বিকৃত করে তার ভিত্তিতে প্রদত্ত ভ্রান্ত বিবরণীকে ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। ঋগবেদে উল্লিখিত “সরস্বতী” নদীকে খুঁজে বের করার নামে বৈদিক সংস্কৃতির সময়কালকে পিছিয়ে দিয়ে হরপ্পা সভ্যতারও আগে স্থাপন করার, এবং তারপর, হরপ্পা সভ্যতাকে বৈদিক জনগোষ্ঠীরই সৃষ্টি হিসাবে দেখানোর একটা বিরাট অপপ্রয়াস চলছে। প্রাচীনত্ব যেহেতু সব সময়েই মানুষের মনে এক ধরনের বিশেষ সমীহভাব জাগিয়ে তোলে, বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাচীনত্ব বৃদ্ধি স্বভাবতই এক দল মানুষের মনে বাড়তি গর্বের অনুভূতির জন্ম দেয়। সুতরাং এই বিষয়টির সত্যমিথ্যাও যুক্তি ও সংশ্লিষ্ট তথ্যের আলোকে যাচাই হওয়া দরকার।

ঋগবেদে অগ্নি, সূর্য ও ঊষার পরেই বহু কবিতায় যাকে নিয়ে প্রচুর উচ্ছ্বাস করা হয়েছে তা হচ্ছে নদী। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশস্তি করা হয়েছে এক “সরস্বতী” নদীর উদ্দেশে; বলা হয়েছে—“অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী” [ঋগবেদ ২/৪১/১৬], ইত্যাদি। অর্থাৎ, তাকে বলা হয়েছে নদীতমা, বা সর্বশ্রেষ্ঠ নদী, নদীমাতা বা অন্য সমস্ত নদীর জননীস্বরূপা, ইত্যাদি। এই নদী হিমালয়ের সু-উচ্চ কোল থেকে প্রবল বেগে সগর্জন তরঙ্গায়িত ফেনা তুলে নির্গত হয়ে নানা দেশ প্লাবিত করে অবশেষে সমুদ্রে মিলিত হয়েছে। [ঋগবেদ ১/৩/১২; ৫/৪৩/১১; ৬/২; ৬/৬; ৬/৪৯/৭; ৭/৯/৫; ৭/৩৬; ৭/৪০/৩; ৭/৯৫; ৮/৫৪; ১০/১৭/৯; ১০/৭৫; ও অন্যান্য]

প্রসঙ্গত বলা দরকার, ঋগবেদে সিন্ধু নদীকে ঘিরেও অনেক প্রশস্তিপূর্ণ সুক্ত রচিত হয়েছে। এই সিন্ধু নদীর সাপেক্ষে কোথাও সপ্তসিন্ধু বা সাত নদী, আবার অন্যত্র পঞ্চনদীর উল্লেখ আছে। পাঞ্জাব প্রদেশটির নামও সংস্কৃত পঞ্চ অপ থেকে উচ্চারণের ফার্সিকরণের মধ্য দিয়ে নিষ্পন্ন হয়েছে। এই বৈদিক বিবরণের সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান পাক-ভারত ভূখণ্ডে সিন্ধু, ঝিলম (বিতস্তা), চেনাব (চন্দ্রভাগা), বিয়াস (বিপাশা), রাবি (ইরাবতী), শতদ্রু এবং ঘগ্‌গর—এই সাতটি বিদ্যমান নদীর সম্পর্ক স্থাপন ও তাদের কম বেশি সনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে (যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋগবেদে অন্য নাম এবং দশটি নদীর নাম রয়েছে [ঋগবেদ ১০/৭৫/৬])। লক্ষণীয় যে ঋগবেদের প্রাচীন ভাষ্যকার সায়ণাচার্য এই ঋকটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সপ্তসিন্ধু-র অর্থ “নদী সপ্ত সংখ্যকা” বলে ছেড়ে দিয়েছেন। সাত বনাম দশের ব্যাখ্যায় যাননি। অর্থাৎ, বৈদিক কবি দশটি নাম লিখলেও সায়ণের কাছে দৃশ্যমান সাতটি নদীই গুরুত্ব পেয়েছে।

তাছাড়া ঋগবেদে প্রদত্ত বয়ানকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার বিপদ আছে। একটা উদাহরণ দিই। হিন্দুদের বিয়েতে সিঁদুর দানের যে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয়, অনেকেই জানেন না, তা সত্যিই কোনো সিঁদুর সংক্রান্ত মন্ত্র নয়, স্রেফ উচ্চারণের নৈকট্যের জোরে সিন্ধু নদীর স্তুতিবাচক ঋক দিয়ে কাজ সেরে ফেলা হয়। [সেন ১৯৪৬; ঋগবেদ ৪/৫৮/৭ এবং ৭/৪৬/৪৩]

“সরস্বতী” নদী নিয়েও একই রকম গোল আছে কিনা বিচার করা দরকার। কেন না, এই ভৌগোলিক অঞ্চলে সেই “সরস্বতী নদী”-র কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। এখন হরিয়াণায় সরসোতিয়া (বা সরসোয়াতি/সরসুতি) নামে যে ছোট বর্ষাকালীন নদী দেখা যায়, সেটাকে কোনোভাবেই বেদ বর্ণিত সরস্বতীর সঙ্গে মেলানো যায় না। তাই বলে সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা হাল ছাড়েনি। বর্তমান ভারতস্থ ঘগ্‌গর এবং পাকিস্তান ভুক্ত হাকরা, যারা এখন বিচ্ছিন্ন হলেও অতীতে হয়ত একই খাতে সংযুক্ত ছিল, এবং যথেষ্ট প্রশস্ত (কোথাও কোথাও ৬-৮ কিলোমিটার চওড়া) হলেও মূলত শুষ্ক ও অগভীর, তাকেই তারা বেদোক্ত সরস্বতীর মজে যাওয়া খাত হিসাবে ধরতে বা চালিয়ে দিতে চাইছে। কিছু বিদ্বান ব্যক্তিও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। তাঁদের মোদ্দা বক্তব্য হল: এখন এক রকম জল শূন্য হয়ে গেলেও এক কালে, অর্থাৎ, বৈদিক সাহিত্য রচনার যুগে এই ঘগ্গর ও হাকরা খাতেই প্রবাহিত হত এক বিপুল জলধারা। বৈদিক ঋষিরা একেই নাম দিয়েছিলেন “সরস্বতী” নদী। পরবর্তী কালে এতদঞ্চলে থর মরুভূমির বিস্তার এবং কচ্ছের রান এলাকা শুকিয়ে আসার ফলে নদীটিও ক্রমশ দুর্বল হয়ে শুকিয়ে এবং হারিয়ে গেছে। [Radhakrishna 1999a, xxiii]

১৯৭০-এর দশক থেকে কৃত্রিম উপগ্রহ সংযোগ প্রযুক্তি (satellite communication) এবং অবলোহিত দূর সংবেদ (infrared remote sensing) প্রযুক্তি বিকশিত হওয়ার পর থেকে বিদেশি ও ভারতীয় বিভিন্ন উপগ্রহ থেকে এই অঞ্চলটার বেশ কিছু ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এরকম কিছু ছবিতে দেখা গেছে: ১) এক সময় যমুনা নদী দক্ষিণ পশ্চিম অভিমুখে প্রবাহিত হত এবং এর একটা পুরনো খাত সরসোতিয়া ধরে এবং অপর একটা পুরনো খাত আলাদাভাবে বর্তমান ঘগ্‌গরের সঙ্গে মিলিত হত; ২) শতদ্রু নদী এখন রোপারের কাছে সমকোণে বেঁকে গিয়ে বিপাশার সঙ্গে মিলিত হলেও এক সময় এর খাত সোজা দক্ষিণে নেমে ঘগ্‌গরের উপর এসে পড়ত; ৩) অর্থাৎ, সুদূর প্রাচীন কালে ঘগ্‌গর-হাকরা খাতই ছিল যমুনা ও শতদ্রুর প্রবাহ পথ, যদিও তা একই কালে অথবা আলাদা আলাদা সময়ে ছিল, তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। এই দুটো নদীই এক কালে সরাসরি আরব সাগরে মিলিত হত।

মনে হয়, পরবর্তীকালে সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকার ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে (যথা, আরাবল্লী পর্বতমালার বিস্তার, শিবালিক পাহাড়ের উত্থান, ইত্যাদি) যমুনা নদী সরে গিয়ে প্রথমে সোজা দক্ষিণ দিকে চম্বল নদীতে গিয়ে পড়ে, এবং আরও পরে পুব দিকে বাঁক নিয়ে গঙ্গার সমান্তরালে বইতে থাকে ও অবশেষে গঙ্গায় গিয়েই পড়ে। আর শতদ্রু পশ্চিম দিকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে বিপাশার সঙ্গে মিলিত হয়ে পরে সিন্ধু নদীতে মিশে যায়। শতদ্রুর দুটি এবং যমুনার তিনটি পুরাখাত (palaeochannel) উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে খুব সুন্দরভাবে ধরা গেছে (চিত্র-১ দ্রষ্টব্য)। [Pal, Sahai, Sood and Agarwal 1980, 317-31] উত্তর ভারতে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক কর্ম তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সব ছবির তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়।  

বিতর্ক এমনিতে খুবই ভালো জিনিস। মুশকিল হল তখন, ভূবিজ্ঞানীরা ছবিগুলিকে বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত রায় দেবার আগে এক দল বেদপন্থী বুদ্ধিজীবী ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবি করে বসলেন, এত দিনে বেদ কথিত সরস্বতী নদীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সত্যিই কি গেছে, নাকি, এখানেও সেই “সবই বেদে আছে” মানসিকতার প্রতিফলন ও প্রয়োগ ইতিহাস ভূগোলের সত্যের উপর চাপিয়ে দেবার প্রবণতা কাজ করে চলেছে?

এটাই এই নিবন্ধে আমাদের বিচার্য।

[২] তথ্য দখল

তথ্য দখল ও তাতে নিজেদের মনগড়া বিশ্বাস চাপিয়ে দেবার এই ঘটনাক্রম বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ১৯৯৭ সালে গুজরাতের ভদোদরা (বরোদা)-য় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের দিকে। সেবার জিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র উদ্যোগে মহারাজ শাহজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনাচক্র থেকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে দিয়েই আপাতদৃষ্টে একটা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসাবে “সরস্বতী নদী” উদ্ধার প্রকল্পটিকে তুলে আনার চেষ্টা হয়। সেই আলোচনাসভায় আমন্ত্রিত বক্তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন ঐতিহ্যপন্থী এবং বেদ বিশ্বাসী, যাঁরা বেদের যে কোনো কথাকে বিনা বিচারে ইতিহাস এবং ভূগোলের প্রামাণ্য সাক্ষ্য হিসাবে ধরতেই আগ্রহী। পরে এই সোসাইটি যখন সেমিনারে উত্থাপিত পত্রগুলিকে সঙ্কলিত করে একটি বই প্রকাশ করে [Radhakrishna and S. S. Merh 1999], তাতে আরও দু একটি পুরনো ও নতুন প্রাসঙ্গিক মননশীল প্রবন্ধ যেমন যোগ করে, তেমনই আরএসএস পন্থী দীনদয়াল উপাধ্যায় ইন্সটিটিউটের মুখপত্র মন্থন থেকেও কিছু লেখা সংযোজিত করে। যেভাবে সমস্ত বিষয়টাকে পরিবেশন করা হয়েছিল, তাতে এটা স্পষ্ট যে সংগঠকরা প্রাপ্ত তথ্যের সংযোজন ও তাৎপর্য উপলব্ধির চাইতেও বৈদিক ভূগোল বর্ণনাকে নতুন পাওয়া তথ্য দিয়ে যেনতেন প্রকারেন প্রতিষ্ঠা করতে এবং তার গায়ে বিজ্ঞানের মর্যাদাসূচক ছাপ লাগাতেই বেশি উৎসাহী ছিলেন।  

এই প্রচেষ্টা এতটাই সফল হয় যে আলোচকদের অনেকের সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠতা জানা থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ ও ভূবিজ্ঞানী সেই তথ্য সঙ্কলনের দ্বারা ভালো রকম প্রভাবিত হন। তাঁরা ভাবতে সক্ষম হন যে উদ্যোক্তারা সঙ্ঘ মনস্ক হলেও ভূবিজ্ঞানের কাজটা তাঁরা বৈজ্ঞানিক প্রোটোকল মেনেই সম্পন্ন করেছেন। এই ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগতভাবে একটা দুঃখজনক অভিজ্ঞতা আছে। সমস্যার গভীরতা বোঝানোর জন্য আমি সেটা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

১৯৯০-এর দশকে রাজনৈতিক কাজের দায়িত্ব নিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘোরাঘুরির ফলে সরস্বতী নদী নিয়ে বিজেপি-র প্রচারের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে আমার কিঞ্চিত প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল। কলকাতায় “দেশ” পত্রিকাতেও ২০০০ সাল নাগাদ এই বিষয়ে হিন্দুত্বমনস্ক লেখা বেরতে শুরু করে। তার ভিত্তিতে আমি ব্রেকথ্রু পত্রিকার জন্য ইংরেজিতে একটা লেখার খসড়া দাঁড় করাই। তারপর সেটা দেখতে দিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একজন খুব সিনিয়র অধ্যাপককে। ঘটনাচক্রে তিনি আবার তখন আমার কমরেড। খুবই বিশ্বস্ত সম্পর্ক। আমার লেখা পড়ে তিনি বললেন, “তুমি এই বিষয়ে যে সমস্ত কাজ হচ্ছে তার প্রায় কিছুই না জেনে লিখে ফেলেছ। সরস্বতী বেসিন নিয়ে খুব ভালো কাজ হচ্ছে আজকাল। তুমি এই বইটা নিয়ে যাও, ভালো করে পড়। তার পর নতুন করে লেখ।”

সেই প্রথম আমার হাতে রাধাকৃষ্ণ এবং মেঢ় সম্পাদিত বইটা এল। মনও বেশ দমে গেল। একটা জিনিস লিখতে গিয়েছিলাম ভালো করে কিছুই না জেনে—এটা নিজের লেখক সত্তার কাছে যথেষ্ট অস্বস্তিকর!

বইটা পড়তে শুরু করেই আমি পুরো বমকে গেলাম। এসব কী পড়ছি? এক একজন নামকরা ভূতত্ত্ববিদ নানা ভাবে বৈদিক ভূগোলের পক্ষে বলে যাচ্ছেন। আর দুই সম্পাদকের মধ্যে একজন, বি পি রাধাকৃষ্ণ, একেবারে আক্ষরিক অর্থে আরএসএস-বিজেপি-র কথা লিখে বসে আছেন।

সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার সেই অধ্যাপকের কাছে গেলাম। তাঁকে সেই বইতে বিভিন্ন জায়গায় পেন্সিলের দাগ দেওয়া অনুচ্ছেদগুলো দেখালাম। বিভিন্ন লেখক যে সরস্বতীর পুরনো বেসিন বলে আলাদা আলাদা খাতের ছবি দিয়েছেন, তাও তাঁকে দেখালাম। এবার তিনি গেলেন থমকে। মানুষ হিসাবে তিনি খুবই ভালো ছিলেন বলে সব দেখে শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার কথা মেনে নিলেন। বললেন, “তাই তো, দেখছি ওরা বিজ্ঞানের একটা বড় কাজকে হাইজ্যাক করে নিতে চাইছে। ঠিক আছে, বইটা তোমার কাছেই রাখ এবং তুমি গুছিয়ে লেখ।” আমার লেখাটা তখন বেরয় এবং বইটার সৌজন্যে বেশ তথ্যসমৃদ্ধ আকারেই। [Mukhopadhyay 2000]

উপরোক্ত সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও বইটির যুগ্ম সম্পাদক বি পি রাধাকৃষ্ণ তাঁর নিজের একটি রচনায় লিখলেন: “ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, দশ হাজার বছর আগে প্লাইস্টোসিন তুষার যুগের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ শুষ্কতার পর প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়। হিমালয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে অনেকগুলি নদীস্রোত সৃষ্টি হয়ে প্রবল বেগে নীচে নেমে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে প্রচুর জল আর পলি। এই বিপুল পরিমাণ জীবনদায়ী জল ও পলির দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে পাঞ্জাব, রাজস্থান ও উত্তর গুজরাতের সমভূমি এক অন্যতম উর্বরভূমিতে পরিণত হয়। জায়গাটা ভূস্বর্গে পরিণত হয় এবং এখানে মহান সরস্বতী নদী ও তার উপনদীগুলির জলে পুষ্ট হয়ে অরণ্যে এবং আশ্রমে একটি নতুন সভ্যতা—আর্যদের বৈদিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। ৬০০০ থেকে ৩০০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করে, কৃষির বিকাশ ঘটায় এবং স্থায়ী বসতি ও জীবন পদ্ধতির জন্ম দেয়। ফলে বৈদিক সভ্যতার ইতিহাস জড়িয়ে আছে সরস্বতী নদীর সৃষ্টি ও বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে। এই সরস্বতী নদী কৈলাশ পাহাড়ের পাদদেশে মানস সরোবরের কাছাকাছি উচ্চ হিমালয়ের কোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছিল।” [Radhakrishna 1999a, xix]     

এক বৃষ্টিপাতের ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকেই ভদ্রলোক প্রায় আট হাজার বছরের ভূতাত্ত্বিক ও সামাজিক ইতিহাস খুঁড়ে বের করে ফেললেন। ক্ষমতাও বটে!

সেই বরোদা সেমিনারের অধিকাংশ বক্তার বক্তব্যের প্রতিপাদ্য এই রকম:

ক) সুদূর অতীতে, হরপ্পা সভ্যতারও অনেক আগে, ঘগ্‌গর-হাকরা প্রবাহ পথে সরস্বতী নদী প্রচণ্ড শক্তিশালী তরঙ্গময় বেগবান এক জলধারা হিসাবে বিদ্যমান ছিল। হরপ্পা সভ্যতা বিকাশের কালে তা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়;

খ) খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল নাগাদ এই নদীতীরে বৈদিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সুতরাং বৈদিক সভ্যতা হরপ্পাকালের চেয়ে প্রাচীনতর;

গ) আর্যরা বাইরে থেকে ভারতে আসেনি, ভারতবর্ষ থেকেই তারা পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল;

ঘ) মেহেরগড় নবপলীয় বসতি ও কৃষি সংস্কৃতি (আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে শুরু করে হরপ্পা নগর সভ্যতা হয়ে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি এই আর্যবৈদিক সংস্কৃতিরই নিরবচ্ছিন্ন ধারা;

ঙ) হরপ্পা সভ্যতা আর্য-বৈদিক মুনি ঋষিদেরই সৃষ্টি। দুটোর মধ্যে কোনো বিভাজন রেখা টানা যায় না এবং টানা সমীচীনও নয়;

চ) বৈদিক আর্যরাই হরপ্পা নগর সভ্যতার শেষ দিকে সিন্ধু সরস্বতী অববাহিকা থেকে গঙ্গা যমুনা সমতলে সরে আসে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ে;

ছ) হরপ্পা নগর সভ্যতাকে তাই সিন্ধু সভ্যতা বলা ঠিক নয়। একে সরস্বতী সভ্যতা, অথবা, বড় জোর সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত; [Radhakrishna 1999b; Kalyanaramana 1999; Wakankar 1999; also see Gupta 1995] ইত্যাদি।

এই লেখকগণ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য স্থাপন করেননি, প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় যা একটি অমার্জনীয় ত্রুটি।

সেই সেমিনার থেকে তথ্য প্রেরণা পেয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ (প্রয়াত) ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘দেশ’ পত্রিকায় সরস্বতী নদী নিয়ে প্রচুর উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটি নিবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক কোনো খাত চিহ্নিত না করলেও ঋগবেদের যুগে যে সরস্বতী নামে একটা সুবিশাল নদী ছিল, যেটা মহাভারত রচনা কাল পর্যন্তও বেগবতী ছিল, তা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সরস্বতীর দুই তীর ধরে বৈদিক ঋষিরা আশ্রম বসাতেন, বেদচর্চা করতেন, সামগান গাইতেন, বিদ্যাভ্যাস করতেন বলেই নাকি তাঁরা বিদ্যার দেবী বা বাক্‌দেবীকে সম্বোধন করেছিলেন সরস্বতী হিসাবে (বৈদিক সাহিত্যে কোথায় সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী বলে সম্বোধন করা হয়েছে, তিনিই হয়ত জানতেন; আমাদের এখনও জানা নেই)। শুধু তাই নয়, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের দুই সরকারের উদ্দেশে একটা অদ্ভুত আবেদন জানিয়েছিলেন: আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে বেদ কথিত “সরস্বতী” নদীকে আবার জলপূর্ণ করে তোলা হোক। [মুখোপাধ্যায় ২০০০]

লেখক সম্ভবত এও জানতেন না যে সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকার শুক্‌নো বা পরিত্যাক্ত খাতগুলিকে (যার মধ্যে ঘগ্‌গর-হাকরাও আছে) ব্যবহার করে এই অঞ্চলে দুই দেশেই সেচ-খাল পদ্ধতি বিস্তারের উদ্দেশে নানা রকম প্রকল্প অনেক দিন ধরেই চালু আছে। তার মধ্যে ভারত ভূখণ্ডে প্রচলিত প্রকল্পগুলিকে দুই বাজপেয়ী সরকারের আমল থেকে (১৯৯৮-২০০৪) সরকারি মদতে এবং আর্থিক সাহায্যে “সরস্বতী নদী উদ্ধার প্রকল্প” (Restoration of the Vedic Sarasvati River Project) হিসাবে নামাঙ্কিত ও পরিচিত করানো শুরু হয়। বরোদার সেমিনারটিকে সেই প্রকল্পের গায়ে বৈজ্ঞানিক ছাপ লাগানোর কাজে সংগঠিত করা হয়েছিল বলে আমাদের অনুমান।

এই অনুমানের পেছনে আছে সমসাময়িক কালের কিছু ঘটনা। উপরোক্ত প্রচেষ্টা শুরু হয় এমন একটা সময়ে যখন উত্তর ভারতের কিছু রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসীন হয়ে কোথাও নির্দেশ জারি করে কোথাও প্রচার প্রপাগান্ডার জোরে স্কুলে স্কুলে সরস্বতী বন্দনা চালু করতে থাকে। তাদের লক্ষ্য ছিল—সঙ্ঘ পরিবারের উদ্যোগে হিন্দুত্বের মোড়কে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার নাম করে দেশ জুড়ে যে মৌলবাদী অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা চলছিল, নদীস্তুতি ও দেবীপূজাকে মিলিয়ে তাকে আরও শক্তিশালী করা।

কিন্তু আমাদের কাছে এই বিষয়টা ভারতের ইতিহাস ও ভূগোলের একটি কঠোর তথ্যগত সমস্যা। অতএব এই ক্ষেত্রেও ভৌতবিজ্ঞানের বিচার পদ্ধতি অবলম্বন করেই আমাদের এগোতে হবে। সেই স্বার্থে আমরা আলোচ্য তত্ত্বকল্পটিকে সুনির্দিষ্ট ভাষায় প্রথমে লিপিবদ্ধ করছি:

বেদ রচনা কালে যমুনা এবং শতদ্রুর পুরাখাত বাহিত জলধারা পুষ্ট ঘগ্‌গর-হাকরার পক্ষে বেদ কথিত সরস্বতী নদী হওয়া সম্ভব।

আমাদের হাতে এ পর্যন্ত যা তথ্যভাণ্ডার জমা হয়েছে তার আলোকে এই প্রস্তাবনার সম্ভাব্যতা বা সত্যমিথ্যা নির্ধারণই বর্তমান আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।

 

[৩] আসল তথ্য ও যুক্তি

ধরা যাক এই তত্ত্বকল্পটি সত্য।

সে ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হল: বৈদিক জনজাতির সেকালের জনগোষ্ঠী ও তাদের উত্তর প্রজন্মদের কাছে এই ঘগ্‌গর-হাকরা খাত “সরস্বতী নদী” হিসাবে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী নিত্য স্মরণীয় পবিত্র স্রোতধারার মর্যাদা পাওয়ার কথা। তা যদি হয় তাহলে ঋগবেদে উল্লিখিত ছোটবড় অন্যান্য নদীর নাম যেমন বিগত সাড়ে তিন হাজার (গুপ্তা-রাধাকৃষ্ণ-কল্যাণরামণ থিসিস ধরলে আট হাজার) বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে, তেমনই সরস্বতী নদীর নামও অক্ষত থাকা উচিত। এর আরও বেশি করে থাকা উচিত, কেন না, এ ছিল “নদীতমা” এবং ঋগবেদে সর্বাধিক স্তুতি প্রাপ্ত নদী। কিন্তু বাস্তব তথ্য কী বলছে? বেদ বর্ণিত সবচাইতে বড় পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ নদীটি বৈদিক ঐতিহ্যবাহীদের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল এবং তার সংস্কৃত ঐতিহ্য বর্জন করে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রদত্ত নামে কোথাও ঘগ্‌গর, কোথাও হাকরা, কোথাও নালা, কোথাও লুনি, ইত্যাদি স্থানীয় নামে পরিচয় প্রাপ্ত হল। একমাত্র এর একটা ছোট উপনদী(?) হরিয়াণা প্রদেশের এক কোণায় “সরসুতি” অপভ্রংশে পুরনো পরিচয় ধরে রইল! বেদের বর্ণনার সঙ্গে মানানসই একটা সত্যিকারের সুবৃহৎ জলধারার পক্ষে এই পরিচয় হরণ প্রত্যাশিতও নয়, স্বাভাবিকও নয়।

এটা অস্বাভাবিক আরও এই কারণে যে বৈদিক ঐতিহ্যের অনুসারীরা গুজরাতে বাংলায় এবং দেশের যত্রতত্র এক একটা ছোটখাটো নদীকে “সরস্বতী” নাম দিয়ে রাখল, প্রয়াগের কাছে গঙ্গা যমুনার সঙ্গমে কাল্পনিক সরস্বতীকেও এনে যুক্ত করে ফেলল, আর আসল বা আদি সরস্বতী নদীর নামটাই তারা ভুলে গেল বা বদলে দিল—যুক্তি তথ্যের তরফে এরকম পরিণতি সম্ভবপর বলে মনে হয় না!

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, যমুনা এবং/অথবা শতদ্রু সরে যাওয়ার পর “সরস্বতী নদী” যখন শুকিয়ে বা মজে গেল, তখন লোকের কাছে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা হারিয়ে গেল। সেই জন্য নামটাও কালে দিনে পালটে গেল। কিন্তু যাঁরা ঐতিহ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাঁরা জানেন—সাধারণ মানুষ প্রাচীন ঐতিহ্য সহজে ভোলে না বা ছাড়ে না। পাথরের হাতিয়ার প্রস্তর যুগের বেশ কয়েক লক্ষ বছরের দীর্ঘ সংস্কৃতি। অন্তত পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে মানুষ তাকে ছাড়িয়ে ধাতু যুগে চলে এসেছে। কিন্তু পাথরের হাতিয়ার বা বাসনপত্র সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই অসম্ভব পবিত্র এবং প্রিয়। তামা-পেতল-কাঁসার বাসনের পবিত্রতাও এই প্রাচীনত্বের কারণে। ব্যবহারে না থাকলেও এই ঐতিহ্য মানুষ ভোলেনি। বৈদিক পরম্পরার কথাই ধরা যাক। কম পক্ষে দুহাজার বছর ধরেই হিন্দুরা বেদ বর্ণিত দেবমণ্ডলিকে পরিত্যাগ করেছে, বেদোক্ত সমস্ত আচার সংস্কার প্রথা প্রকরণ ভুলে গেছে। তথাপি যে কোনো হিন্দুকে জিগ্যেস করলেই সে বলবে—বেদই হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ বিশ্বাসের ঐতিহ্য সে আজও ছাড়েনি। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জনসাধারণের দৃঢ় বিশ্বাস ভাগীরথী-হুগলির জলধারার মূল স্রোত অতীতে আদি গঙ্গা (এখন যাকে টালি নালা বলা হয়) হয়ে বারুইপুর জয়নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হত। এখন গড়িয়ার দক্ষিণে সেই নদীর চিহ্নমাত্র নেই; আছে শুধু এক সারিবদ্ধ আলাদা আলাদা অসংখ্য পুকুর। অথচ আশপাশের লোকে এখনও সেই পুকুরগুলির জলকেই গঙ্গার পবিত্র জল মনে করে। পুকুরগুলির নামও দিয়েছে সেইভাবে—বোসগঙ্গা (বোসেদের পুকুর), ঘোষাল গঙ্গা (ঘোষালদের পুকুর), ইত্যাদি। “নদীমাতা” নদীর ক্ষেত্রে এর অন্যথা আশাই করা যায় না!  

এই সমস্যাটা ঊনবিংশ শতাব্দের “সরস্বতী” সন্ধানকারী এক ওল্ডহ্যাম সাহেবকেও ধন্দে ফেলে দিয়েছিল: “How the sacred river came to lose its own name and come to acquire that of its former tributary is not known.” [Oldham (1893), 1999, 94]    

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ঋগবেদ রচয়িতারা কি ঘগ্‌গর-হাকরা খাতে যমুনা এবং/অথবা শতদ্রুর জলপ্রবাহ দেখেছিলেন? কয়েকজন ভূতত্ত্ববিদের মতে উত্তর ভারতের বড় বড় নদীগুলি বিগত প্রায় তিরিশ হাজার বছর ধরে মোটামুটি বর্তমানে পরিদৃশ্যমান খাতে এবং অভিমুখেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে। [Singh, Bajpai, Kumar and Singh 1990] এটা সত্য হলে উপগ্রহ ছবিতে দেখা ঘগ্‌গর-হাকরা খাতে যমুনা এবং/অথবা শতদ্রুর জল সংযোগ বৈদিক কবিদের পক্ষে দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাস্তবেও যে কোনো ঋষি এমনটা দেখতে পাননি তার প্রমাণ তারা ঋগবেদে রেখে গিয়েছেন। সেখানে শতদ্রু নদীর সঙ্গে বিপাশার সংযোগের উল্লেখ রয়েছে যথেষ্ট সবিস্তারে এবং সেই নদীদ্বয়কে কেন্দ্র করে আছে নানাবিধ প্রার্থনা। [ঋগবেদ ৩/৩৩] আর এটা সম্ভব হয়েছিল রোপারের কাছে এসে শতদ্রু নদীর প্রায় সমকোণে ঘুরে যাওয়ার পর। অর্থাৎ, ঘগ্গর খাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার পর।

প্রসঙ্গত, ওল্ডহ্যামের আর একটা মন্তব্যও এখানে মনে রাখতে হবে: “হিমালয়ের কোলে শতদ্রু ও যমুনার মাঝামাঝি আর এমন কোনো গিরিখাত নেই যে পথে আর একটা বড় নদী উপর থেকে নীচে নেমে আসতে পারে।” [Oldham (1893), 1999, 93] অস্যার্থ, অন্য কোনো উৎস থেকেও ঘগ্‌গর-হাকরার সারা বছর প্রচুর জল পাওয়ার কোনো প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নেই বা বেদের যুগেও ছিল না। উপরন্তু উপগ্রহ চিত্র থেকে এটাও স্পষ্ট যে বর্তমান সরসুতির সঙ্গে অতীতে কখনই উচ্চ হিমালয়ের অন্য কোনো উৎসের যোগাযোগ ছিল না। অর্থাৎ, আমরা এখন যেমন দেখছি, বৈদিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা যখন সিন্ধু অববাহিকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তারাও এতদঞ্চলের নদনদীচিত্র (hydrography) কম বেশি এই রকমই দেখেছিল। ঘগ্‌গর নদী প্রণালীটি অনেকগুলি ছোট ছোট নালার আকারে তৈরি হয়েছে নিম্ন হিমালয়ের শিবালিক পাহাড় থেকে। ফলে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় এর জলের কোনো যোগান থাকে না। এর প্রবাহ পথের খাত অধিকাংশ জায়গাতেই বছরের বেশির ভাগ সময় শুকনো থাকে এবং খাত অগভীর বলেই প্রশস্ত। সম্ভবত এই কারণেই একে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক ভাবে কোনো বৈদিক বা বেদোত্তর ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তৈরি হয়নি।

তৃতীয়ত, একথা ঠিক, ঊনবিংশ শতাব্দের শেষ দিকে আর এক ভূতত্ত্ববিদ ওল্ডহ্যাম [Oldham (1886) 1999] এবং বিংশ শতাব্দের মাঝামাঝি সময়ে পুরাতত্ত্ববিদ অরেল স্টাইনও [Stein 1942] ঘগ্‌গর-হাকরা খাতে শতদ্রু এবং/অথবা যমুনার প্রাচীনতর প্রবাহের দ্বারা পুষ্ট “সরস্বতী”-র সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। এই সম্ভাবনা সত্য হওয়ার জন্য একটা জিনিসই দরকার—বৈদিক যুগ পর্যন্ত শতদ্রু এবং/অথবা যমুনার প্রবাহ এই খাতে সক্রিয় ছিল। একে তো এটা কাল সাপেক্ষে  ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা যায়, এবং তাতে এই সম্ভাবনা বাতিল হয়ে গেছে। তার উপর আর এক সমস্যা হল, এই সম্ভাবনা বাস্তব হলে তখন আবার বেদের যুগে শতদ্রু কোথায় গেল, যমুনা কোথায় রইল—খুঁজে দেখতে এবং বলতে হবে। অর্থাৎ, বৈদিক হিসাব থেকে সেকালের বাস্তব ভূগোলে একটা নদীখাত অন্তত সব সময়ই কম পড়ে যাচ্ছে। আর ঋগবেদের দশটি নদীর নাম ধরলে কম পড়ছে আসলে চার খানা।

চতুর্থত, কেউ কেউ বলেছেন, এক সময়ে বেগবতী থাকলেও বৈদিক যুগের সরস্বতী নদী পরবর্তীকালে থর মরুভূমির বিস্তারের ফলে তার ভেতরে পড়ে শুকিয়ে বা হারিয়ে গিয়েছে। এটা প্রথম শুনলে আপাতভাবে খুব বিশ্বাসযোগ্য থিসিস বলে মনে হয়। কিন্তু এতে আসলে ভূগোল এবং ভূতত্ত্বের একটা মৌল শিক্ষাকেই অস্বীকার করা হয়। একথা ঠিক, নদী বারবার খাত পরিবর্তন করে, একটা খাত ছেড়ে নতুন খাত খুঁজে নেয়। তবে খাত পরিবর্তন আর হারিয়ে বা শুকিয়ে যাওয়া এক কথা নয়। আলোচ্য অঞ্চলে সিন্ধু শতদ্রু যমুনা প্রভৃতি বড় নদীগুলির ব্যাপকতর খাত বদল ও অভিমুখের পরিবর্তন (৯০ থেকে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত) ঘটেছে। কিন্তু তাদের কেউ হারিয়ে বা শুকিয়ে যায়নি। একা সরস্বতী, সবচাইতে বড় শক্তিশালী বেগবতী, নদী কেন হারিয়ে যাবে বা শুষ্ক হয়ে পড়বে? তাছাড়া বেদ বর্ণিত নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার অর্থ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে একটা ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন সংঘঠিত হওয়া। আর তাই যদি ঘটে থাকে, তাতে সবচাইতে বড় নদীটি হারিয়ে যাবে এবং অন্য সমস্ত নদী অক্ষত থেকে যেতে পারবে—প্রকৃতি এখনও এতটা একচক্ষু হয়ে ওঠেনি।

পঞ্চম এবং আলোচ্য প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একটা নদীর উচ্চতর অববাহিকায় যদি সারা বছর ধরে বরফ গলা জলের অফুরন্ত যোগান থাকে (সিন্ধু, শতদ্রু, যমুনা, গঙ্গার যেমনটি আগেও ছিল, এখনও আছে), তখন তাকে কোনো মরুভূমিই আটকাতে পারে না। কেন না, অত জলস্রোত যাবে কোথায়? তার ভরবেগের কথাটাও ভাবতে হবে তো! দুটো খুব ভালো উদাহরণ হাতের কাছেই রয়েছে। নিল নদ সাহারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে ১৬০০ কিলোমিটার প্রবাহ পথ অতিক্রম করে সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি একইভাবে আরব সাগর অভিমুখে বয়ে চলেছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে কলোরাডো নদীও সোনেরান মরুভূমির মধ্য দিয়ে ৯০০ কিলোমিটার পথ বয়ে নিরন্তর প্রবহমান। কই, এরা তো কেউ মরুভূমিতে  শুকিয়ে বা হারিয়ে যায়নি। সেই দুটো মরুভূমির তুলনায় রাজস্থানের থর বয়সেও নবীন, সামর্থ্যেও দুর্বলতর। সুতরাং বৈদিক বর্ণনা মতো সত্যিই কোনো শক্তিশালী বেগবতী “সরস্বতী” নদী থাকলে আজকে তার ঘগ্‌গর-হাকরার মতো হাড়জিরজিরে চেহারা হওয়ার কথা নয়। খাত বদলে গেলেও নদীটির স্বরূপ টিকে থাকার কথা।

ছ-নম্বরে একটা মূল্যবান ঐতিহাসিক নথির কথা উল্লেখ করতে হবে। দ্বিতীয় শতাব্দে আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ক্লদিয়াস তলেমির রচিত একটি ভূগোল সম্পর্কিত বই—জিওগ্রাফিকা! তলেমি ছিলেন সেকালের একজন খুব ভালো পর্যবেক্ষক। আকাশের জ্যোতিষ্কগুলির সম্পর্কে তাঁর তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ ভ্রান্ত হলেও গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কে খালি চোখে দেখা পর্যবেক্ষণ সমূহে কোনো ভুল ছিল না। তাঁর এই বইতে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর ভারতের ভৌগোলিক অবস্থার বিবরণ খুব সবিস্তারে এবং নিখুঁতভাবে দেওয়া ছিল। অনেকেই হয়ত শুনলে আশ্চর্য হবেন যে এই বইটি সম্পাদনা করে ছাপানোর অপরাধে ষোড়শ শতকের স্পেন দেশীয় বিজ্ঞানী মিগুয়েল সার্ভেতোকে ক্যালভিন পন্থী প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টীয় যাজকরা অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। কেন না, বাইবেলে যিশুর জন্মদেশ প্যালেস্তাইনকে যেরকম “দুধ ও মধু উপচে পড়া” প্রাচুর্যের দেশ বলে দেখানো হয়েছে, তলেমির বাস্তবানুগ ভৌগোলিক বিবরণ তাকে ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছিল। চার্চের লোকেরা তলেমির ভ্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্বকে গ্রহণ করলেও সঠিক ভূগোলবিদ্যাকে মানতে রাজি ছিল না। ধর্ম বিশ্বাসে যেমনটা হয় আর কি! সেই জন্যই তলেমির ভূগোল বইটার পুনঃপ্রকাশকে তারা ক্ষমা করতে পারেনি।

আমাদের কাছে তলেমির এই বইটার গুরুত্ব এইখানে যে এতে উত্তর ভারতের সিন্ধু থেকে গঙ্গা পর্যন্ত সমস্ত নদীর উল্লেখ এবং বিস্তারিত বিবরণ থাকলেও “সরস্বতী” নিয়ে কোনো কথাই নেই। এটা ব্রতীন্দ্রনাথও লক্ষ করেছেন। [মুখোপাধ্যায় ২০০০] অতএব এর থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে অন্তত তলেমির সময়ে এই অঞ্চলে সরস্বতী জাতীয় কোনো বাড়তি বড় নদীর অস্তিত্ব ছিল না।

সপ্তমত, সরস্বতী আবিষ্কারকদের আর একটা জিনিস দেখে আমরা চমকে উঠেছিলাম। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য না পেয়েও যখন কোনো ঘটনাকে পরোক্ষভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হয়, তখন খুব স্বাভাবিক কারণেই অনুমানকারীদের মধ্যে মতদ্বৈধ হতে পারে। উনিশ শতকের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছিল। [Oldham 1886/1999, 84; Wilhemy 1999, 101] কিন্তু যেখানে উপগ্রহ ছবি হাতে নিয়ে একটা নদীর পুরাখাত খোঁজা হচ্ছে, সেখানে একই (কথিত সরস্বতী) নদীর একই (বৈদিক) সময়ের গতিপথ সম্পর্কে পাঁচজন বিজ্ঞানী পাঁচ রকম খাত বাতলাচ্ছিলেন কীভাবে? বিশেষ করে, ভূতত্ত্বে যখন সক্রিয় নদীপ্রবাহের সময়কাল নির্ণয়ের প্রামাণ্য পদ্ধতি রয়েছে? অথচ ঠিক এই ব্যাপারটাই রাধাকৃষ্ণ ও মেঢ় সম্পাদিত বইটিতে ঘটেছে। যেমন, রাধাকৃষ্ণের মতে, উচ্চ হিমালয় থেকে আরব সাগর অবধি “সরস্বতী” আগাগোড়া একটি স্বতন্ত্র খাতে প্রবাহিত হত। [Radhakrishna 1999a, xix] কল্যাণরামণ দেখিয়েছেন, বৈদিক যুগের সরস্বতী এখনকার শতদ্রুর জলেই পুষ্ট ছিল, অর্থাৎ, তিনি শতদ্রুকেই নীচের দিকে বেদোক্ত সরস্বতী বলে চিহ্নিত করেছেন। [Kalyanaramana 1999, 26] অন্য দিকে শ্রীধরদের গবেষণায় বৈদিক যুগে শতদ্রু আর সরস্বতী আগাগোড়াই দুটো আলাদা নদী, কেন না, তাঁরা আবার প্রত্ন-যমুনা খাতে সরস্বতীকে স্থাপন করেছেন। [Sridhar, Merh & Malik 1999, 196; আরও দ্রষ্টব্য: Bakliwal and Grover 1999, 116] ইত্যাদি। পেশাদার ভূবিজ্ঞানীরা একই সম্মেলনে বসেও এরকমটা করলেন কী করে—ভেবেই সেদিন আমার বিস্ময় জেগেছিল।   

শুধু তাই নয়, সরস্বতী কবে শুকিয়ে বা হারিয়ে গেল (“বিনশন”), তার কালক্রম নির্দিষ্ট করে একই সঙ্কলনে রাধাকৃষ্ণ বলেছেন ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব; মালিক ও অন্যান্য ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব; শ্রীধর ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব; উইলহেমি ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ; ইত্যাদি। একটা নদীখাত কবে মজে গেছে তার কাল নির্ধারণে এখনকার উন্নত পদ্ধতিতে বড় জোর ৫০-১০০ বছরের পার্থক্য হতে পারে। কিন্তু সাড়ে চার হাজার বছরের পার্থক্য হওয়া সম্ভব?

বিস্ময়ের উপাদান এখানেই শেষ নয়।

শ্রীধর ও অন্যান্য তাঁদের প্রবন্ধে লিখেছেন: “সাম্প্রতিক এক সমীক্ষাপত্রে রাধাকৃষ্ণ প্রাপ্ত ভূতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক সমস্ত তথ্যকে সংযোজিত করে হোলোসিন যুগে [সরস্বতীর] প্রবাহপথ বিবর্তনের একটা কালানুক্রমিক বিবরণ দিয়েছেন।” [Sridhar, Merh & Malik 1999, 195] ভূতত্ত্বে হোলোসিন যুগ বলতে বিগত দশ হাজার বছরকে বোঝায়। উপরোক্ত সঙ্কলন গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, ভূমিকা, মুখবন্ধ, একক প্রবন্ধ ও যৌথভাবে লেখা প্রবন্ধ—সব মিলিয়ে রাধাকৃষ্ণ পাঁচটি লেখায় উপস্থিত; এবং তার মধ্যে একটি লেখা, আমরা ইতিমধ্যেই দেখে নিয়েছি, সত্যিই হোলোসিন কাল নিয়ে কাজ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সংযোজন তো দূরের কথা, এই সব রচনার একটিতেও তিনি উপরে কথিত তথ্যগত চূড়ান্ত অসঙ্গতিগুলিকে ব্যাখ্যা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। অর্থাৎ, “সরস্বতী” নদীর এই উদ্ধারকর্তারা পেশাগতভাবে ভূবিজ্ঞানী হলেও সঙ্ঘ পরিবারের ঐতিহ্যবাদীদের মতোই ইতিহাসের সাল তারিখ বা তথ্য যুক্তির প্রতি নিতান্তই বীতশ্রদ্ধ!  

সব শেষে আমরা পৌঁছাই এক স্ববিরোধী অবস্থানে। ঘগ্‌গর-হাকরার দুই ধারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ের অসংখ্য বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ১২০০-র মতো বসতি হচ্ছে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত [Kochchar 2003]; আর সাত-আটশর মতো বসতি হচ্ছে বৈদিক বা বেদোত্তর কালের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র (PWG বা Painted Grey Ware) যুগের পরিচায়ক [শর্মা ২০০১, ১৯]। বর্তমানে এগুলিকে এক সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে বৈদিক যুগের সংস্কৃতি লাঞ্ছিত বসতি। প্রমাণ চাইছেন? “সরস্বতী” নদীর দুপাশের সংস্কৃতি বৈদিক যুগের বসতি ছাড়া আর কী হবে? আপনি জানতে চাইতেই পারেন, নদীটা যে “সরস্বতী” সেটাই বা জানা গেল কীভাবে! সহজ উত্তর, বৈদিক যুগের লোকেরা যে নদীর ধারে ধারে বসতি ফেলেছিল, সেটি স্বভাবতই “সরস্বতী”! এ এক অদ্ভুত চক্রাকার যুক্তি (tautology বা circular logic)। এক জায়গায় যাকে প্রমাণ করতে হবে, তাকেই আর এক জায়গায় প্রমাণ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই ভাবেই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা ইতিহাস ভূগোলের এক সরল সত্যকে আড়াল করে চলেছে।

কী সেই সত্য?

সত্যিই যদি বেদের যুগে ঘগ্‌গর-হাকরা নদীতমা অবস্থায় থাকত, তার দুই তীরে বৈদিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলা সম্ভবই হত না। বেদ রচনা সাম গান আর যজ্ঞ হোমানল তো দূরের কথা!

হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নসাক্ষ্যের নিরিখে বিষয়টি বিচার করলে এটা বোঝা যাবে: বিশাল সিন্ধু নদীর ধারে ধারে যেখানে মাত্র পঞ্চাশটির মতো হরপ্পা বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে ঘগ্‌গর বা হাকরার মতো প্রায় শুষ্ক নদীর ধারে ১২০০-র মতো এরকম প্রত্নসাক্ষ্য দেখা গেছে। এর কারণটা বোঝা দরকার। সিন্ধুর মতো একটা স্থায়ী জলপূর্ণ নদীর দুই পাড়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হয়েছিল বড় বড় গাছের গভীর বনাঞ্চল। সেই সব গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করে স্থায়ী বসতি ও নগর নির্মাণ করতে হলে দরকার ছিল লোহার ভারি ভারি কুঠার ও করাত। এর কোনোটাই তাম্রব্রোঞ্জ যুগে অবস্থানকারী হরপ্পা সভ্যতার সদস্যদের আয়ত্তে আসেনি। তাই তারা সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে বেশ দূরে দূরেই থেকেছে।

আবার এযাবত পাওয়া প্রত্নসাক্ষ্য অনুযায়ী, বৈদিক জনজাতিগুলির হাতেও লোহার ভারি হাতিয়ার দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দ নাগাদ। ঋগবেদ তার অনেক আগেকার রচনা, এমনকি তত দিনে তার লিখিত সঙ্কলনও শুরু হয়ে গেছে। এর অর্থ হল, ১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালে ঘগ্‌গর-হাকরার আশে পাশে যখন বৈদিক বসতিগুলি লোহার হাতিয়ার ছাড়াই গড়ে উঠেছিল, তখন তাদের নিশ্চয়ই কোনো ঘন জঙ্গল কাটার সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি। যার মানে হল, অন্তত সেই সময়ে এই নদীখাতটি একটি শক্তিশালী স্থায়ী জলপূর্ণ স্রোতধারা ছিল না। এটাও হয়ত আরও একটা কারণ যে ঘগ্‌গর-হাকরার গায়ে কোনো কালেই “সরস্বতী” পরিচয় দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়নি।

     

[৪] এবার মূল প্রশ্ন

তাহলে ভৌগোলিক, ভূতাত্ত্বিক, পুরাতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও লিখিত—সমস্ত রকম সাক্ষ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, বেদোক্ত “সরস্বতী” নদীর কোনো বাস্তব ভিত্তি বা অস্তিত্ব নেই এবং আলোচ্য সময়কালে কখনই ছিল না। দৃশ্যমান জলধারাগুলির কোনোটাকে (যেমন শতদ্রু অথবা যমুনা) পুরা খাতে “সরস্বতী” ধরে নিলে তখন আবার বেদ লিখিত শতদ্রু অথবা যমুনাকে খুঁজতে হবে। সক্রিয় এবং পুরা খাত মিলিয়ে বেদের প্রদত্ত হিসাবের তুলনায় সব সময়ই চার খানা নদী বাস্তবে কম পড়ছে। তার মানে, আমাদের অন্যভাবে “সরস্বতী’ প্রশ্ন নিরসন করতে হবে।

স্বভাবতই তার জন্য প্রথমে একটা প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে।

সরস্বতী নদীর নামে ঋগবেদে এত উচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রশস্তির কারণ কী? পরবর্তীকালের জনশ্রুতিতেই বা সরস্বতী নামক একটা নদী অন্বেষণের কারণ কী? সরস্বতী কল্পনা যদি একটা নদীমিথও হয়, তার পেছনেও তো একটা কিছু বাস্তব উপাদান থাকার কথা।

এটা একটা যথার্থ প্রশ্ন যা অনেককেই ভাবিয়েছে।

এই প্রশ্নের একটা উত্তর কেউ কেউ দিয়েছেন এইভাবে: যাযাবর বৈদিক গোষ্ঠীগুলি যখন মধ্য এশিয়া থেকে আফঘানিস্তানের হেলমন্দ নদী উপত্যকায় এসে বসবাস করছিল (যার একাধিক সাক্ষ্য বিদ্যমান), তখন এই বড় নদীটি তাদের মনে একটা স্থায়ী ও সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেলেছিল। তার পর যখন তাদের উত্তরপ্রজন্ম এক সময় আরও পূর্ব দিকে সরে আসতে থাকে, তাদের মননে তখন সেই সুবিশাল ও সুদীর্ঘ নদীটির একটা স্মৃতি থেকে গিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে রক্ষিত ও চর্চিত হয়েছে। এই হেলমন্দেরই একটা বড় উপনদীর সংস্কৃত নাম হচ্ছে অর্গন্ধব, যাকে প্রাচীন ইরানীয়দের অবেস্তা ভাষায় বলা হত “হারাখাইতি”। সেই শব্দটা ভাষাবিজ্ঞানীদের অনেকের মতে বৈদিক ভাষার “সরস্বতী”-র সমতুল্য। ঋগবেদ রচনার সময় সেই স্মৃতিই হয়ত বারবার ফিরে ফিরে এসেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দের শেষ দিকে একজন পুরাতত্ত্ববিদ প্রথম এই ভৌগোলিক সম্ভাবনার কথা তোলেন। [Thomas 1883] তার পরে একে একে দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী [Kosambbi 1975, 89], রামশরণ শর্মা (যিনি এক কালে অসতর্কভাবে ঘগ্‌গর খাতকে সরস্বতী হিসাবেই আখ্যায়িত করেছিলেন [শর্মা ১৯৯৮; ২৩, ৭৩, ৭৪]) [শর্মা ২০০১, ২০] সম্প্রতি রাজেশ কোছর [Kochhar 1999, 48-49; Kochhar 2003], প্রমুখ এই প্রস্তাবটিকে পুনরুত্থাপন করেছেন।

ভৌগোলিক আকৃতিগত ভাবে হেলমন্দ আর সিন্ধুর জলবিভাজিকাগুলির মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকায় ঋগবেদের সরস্বতীসহ সাত নদীর বিবরণের সঙ্গে এর মিল দেখানো যায় ঠিকই। কিন্তু সেই ভূগোল স্মৃতির ভিত্তিতে ঋগবেদে সরস্বতী স্তুতির ব্যাখ্যা মেনে নিতে হলে অন্তত আরও তিনটে প্রকল্প সেই সঙ্গে স্বীকার করে নিয়ে এগোতে হবে: (১) যে বৈদিক গোষ্ঠী ভারতে বসতি স্থাপন করার পর ঋগবেদ রচনা করেছিল, তারা আফঘানিস্তানের হেলমন্দ উপত্যকায় প্রাক্তন বসবাসকারীদের সরাসরি বংশধর; (২) তারা কয়েকশ বছর ধরে পূর্বমুখী অভিবাসনের সময় মৌখিক শ্রুতির মাধ্যমে শুধু মাত্র “হারাখাইতি” নামক একটা নদীর ভৌগোলিক স্মৃতি রক্ষা করেছিল, আর সেই নামটা সিন্ধুগঙ্গা অববাহিকায় একটা বড় নদীর ঘাড়ে চাপিয়েছিল; (৩) তারা হেলমন্দ উপত্যকার অন্য সমস্ত নদীর কথা ভুলে গিয়েছিল। এই তিনটি প্রস্তাব অত্যন্ত সুদূর কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত। একটা ছোট জিনিসকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক বেশি জিনিস ধরে নিতে হচ্ছে। ব্যাখ্যার বৈজ্ঞানিক শর্তের যা পরিপন্থী। এই কারণে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে আমাদের অসুবিধা হয়।

একটা বিকল্প এবং অনেক বেশি সরল ও সেই অর্থে অনেক বেশি সম্ভাব্য একটা উত্তরও পাওয়া যায়। নিজের জলধারা ছাড়াও বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা ও শতদ্রু ইত্যাদি অনেকগুলি বড় বড় উপনদীর দ্বারা পুষ্ট হওয়ায় নীচের দিকে সিন্ধু একটি অত্যন্ত বড় এবং ভয়ঙ্কর স্রোতস্বিনী নদী। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অন্য সমস্ত নদীর (যাদের মধ্যে বেদপন্থী তাত্ত্বিকরা সরস্বতীকে স্থাপন করতে চাইছেন) তুলনায় সিন্ধু অনেক বড় নদী, যে সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট সমীহ আদায় করতে পারে। আর বৈদিক জনজাতির পুর্বপ্রজন্মদেরও বিভিন্ন সময়ে সিন্ধু নদী অতিক্রম করতে এবং/অথবা তার পাশ দিয়ে চলতে হয়েছিল। এছাড়া পশ্চিম দিক থেকে এসে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ এলাকায় বসতি স্থাপনের কোনো রাস্তা ছিল না। তার ভিত্তিতে উনিশ শতকের বেশ কয়েকজন ভারত বিশেষজ্ঞ—যথা, ম্যাক্‌মার্ডো [Mcmurdo 1834 & 1839], রথ [Roth 1846], কানিংহাম [Cunningham 1871], ৎসিমার [Zimmer 1879], র‍্যাভার্টি [Raverty 1892], গ্রিফিথ [Griffith 1896], প্রমুখ—অনুমান করেছেন: সিন্ধু অববাহিকায় বসবাসকারী বৈদিক কবিরা সিন্ধু নদীকেই সরস্বতী হিসাবে স্তবস্তুতি করেছেন। সেখানে শব্দটা বিশেষ্য পদ নয়, একটা বিশেষণ বা গুণবাচক বিশেষ্য (attributive noun) হিসাবেই ব্যবহৃত। কেন না, সংস্কৃত ভাষায় শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা অনুসারে সরস্বতী < সরস বতী < সরঃ (জল) + বতী (পূর্ণ) = জলরাশি পূর্ণ বা সমৃদ্ধ। এমনকি হেলমন্দ প্রস্তাবের সাম্প্রতিক সমর্থক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী রাজেশ কোছরও স্বীকার করেছেন যে ঋগবেদের দশম মণ্ডলে ব্যবহৃত শব্দটি সিন্ধু নদীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। [Kochhar 2003] এই তত্ত্বকল্পটির প্রধান সুবিধা এই যে এতে একটা সামান্য ভাষাতাত্ত্বিক অনুমান দিয়ে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাচ্ছি। আর বিদ্যমান কোনো তথ্যের সঙ্গে এই অনুমানের কোনো বিরোধ নেই।

তাহলে কী দাঁড়াল?

১। ঋগবেদের “সরস্বতী” বিবরণের সঙ্গে এক মাত্র সিন্ধু নদীর আকার আকৃতি ও অবস্থাই মেলে;

২। একা শতদ্রু বা একা যমুনার পক্ষে সিন্ধু তথা সরস্বতীর আকার ধারণ আগেও সম্ভব ছিল না, এখনও নয়;

৩। শতদ্রু বা যমুনাকে অতীতের কোনো খাতে সরস্বতী বানালে, সেই কালে শতদ্রু বা যমুনার জন্য সক্রিয় এবং অতিরিক্ত খাত খুঁজতে হবে, যা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই;

৪। সিন্ধু নদীকেই বৈদিক বিশেষণে “সরস্বতী” বলে মেনে নিলে এই সমস্ত বিপত্তি দূরীভূত হয়;

৫। নদী কেন্দ্রিক পরবর্তী সমস্যাগুলি বুঝতেও সাহায্য করে।

অতএব প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য। এবং পরবর্তী সম্ভাবনা এই যে কালক্রমে বৈদিক সংস্কৃতির মৌখিক ঐতিহ্যের সৌজন্যে শব্দটা ধীরে ধীরে একটি বিশেষ্য বা নাম পদে পরিণত হয়।

এই প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করলে সহজেই বোঝা যাবে, বৈদিক জনজাতিগুলি সিন্ধু অববাহিকা ছেড়ে যখন আরও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় সমভূমিতে সরে এল এবং লিখিত সংস্কৃতি আয়ত্ত করে ফেলল, তখন থেকে তারা “সরস্বতী” নামপদটি প্রয়োগ করার মতো স্বতন্ত্র একটা নদী খুঁজতে থাকে। যমুনার পরে গঙ্গাও তখন নামাঙ্কিত হয়ে গেছে এবং বেদোত্তর সাহিত্যে পুরাণে লোকসংস্কৃতিতে ও ধর্মে তাদের স্বমাহাত্ম্য তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। দেবদেবীর পূজায় মন্ত্রোচ্চারণে সরস্বতী নয়, গঙ্গার জলই তখন স্বর্গীয় পবিত্রতায় ভূষিত। আবার মৌখিক ও লৌকিক ঐতিহ্যে “সরস্বতী”-ও তো একটা চাই। তার ফলে তখন থেকে তারা যেখানে সেখানে যাকে হাতের সামনে পায়—ছোটখাটো স্রোতধারা হলেও—তাকেই “সরস্বতী” নামে চিহ্নিত করতে থাকে (পাঞ্জাব হরিয়াণা গুজরাত বাংলায় ইত্যাদি); আর বৈদিক সাহিত্যের আলোকে দুটো নদীমিথের জন্ম দেয়:

এক, সেই বিশাল বেগবতী তরঙ্গময়ী সরস্বতী নদী অদৃশ্যভাবে প্রবাহিত হয়ে প্রয়াগের কাছে গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে মিলিত হয়েছে। যা আজ অবধি জন মানসে পরিব্যাপ্ত রয়েছে।

দুই, ঋগবেদের বর্ণনা অনুযায়ী “সরস্বতী” নদীকে খুঁজে বেড়ানো এবং সেরকম একটা কোনো নদী বাস্তব ভূগোলে দেখতে না পাওয়ার গণ-আক্ষেপ থেকেই আসে “সরস্বতী বিনশন” মিথ। পরিণত মহাভারতে বলা হয়েছে: সরস্বতী নদী পবিত্র আর্যাবর্ত ছেড়ে নীচের দিকে থর মরুভূমি অঞ্চলে “নিম্ন বর্ণভুক্ত” নিষাদ জাতির এলাকায় এসে লজ্জায় ঘৃণায় বালি ও মাটির মধ্যে ঢুকে যায়। [মহাভারত, শল্য পর্ব ৩৬/১] রাজস্থানের মরুভূমি এবং কচ্ছের রান এলাকার শুষ্ক বালি ও জলাজমিতে সরসোতিয়া ঘগ্‌গর হাকরা নালা লুনির বেদের যুগ থেকে দৃশ্যমান বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এই মিথ মিলে গেলেও—আমরা আগেই দেখিয়েছি—উচ্চ হিমালয় থেকে নেমে আসা বড় ও শক্তিশালী নদীর সমুদ্র গমনের ছবির সঙ্গে একেবারেই মেলে না। আসলে যা ছিল না বা নেই, তাকে এক সময় শ্রুতি ও জনশ্রুতির জোরে আছে বলে মনে করার জন্যই পরে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মেলাতে গিয়ে তার বিনশনের গল্প বানাতে হয়েছিল। আর, ভারতের শ্রেণি বিভক্ত সমাজের উদ্গমের কাল থেকে জাতিভেদ প্রথার ঘৃণা বিদ্বেষের চাষেরও একটা ব্যাপার এর গায়ে লেপ্টে যায়। সেটা সঙ্ঘ মতাদর্শের সঙ্গে মিলে গেলেও সরস্বতীর সৃষ্টি ও বিনাশের কল্পনাকে খারিজ করে দেয়।

তবে মিথ এইভাবেই ভাঙে আর গড়ে। নদীরও ভাঙাগড়া চলে। কিন্তু নদীমিথের ভাঙাগড়ার সঙ্গে নদীর ভাঙাগড়াকে একাকার করে দিলে সত্যোপলব্ধির ক্ষেত্রে অনেক সময় খুব উচ্চ মূল্য দিতে হয়। তার উপর সঙ্ঘ পরিবারের সমস্যা হচ্ছে, সিন্ধু নদীর প্রায় পুরোটাই পড়েছে বর্তমান পাকিস্তানে। তার গায়ে আর সরস্বতী বিশেষণ লেপ্টানো যায় না। অতএব যে করেই হোক, বর্তমান ভারত ভূখণ্ডের সীমানায় একটা “সরস্বতী” এনে ফেলতেই হবে। ইতিহাস ভূতত্ত্ব ভূগোল এবং উপগ্রহ ছবির তোয়াক্কা না করেই। হিন্দুত্ব লবির পক্ষ থেকে তোলা এই সরস্বতী নদী উদ্ধার প্রকল্পকে কেন্দ্র করে আমরা আরও একবার ভারতের ইতিহাস রচনা করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ঐতিহ্য, পৌরাণিক কাহিনি এবং সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যুক্তি ও তথ্যকে অগ্রাহ্য ও বিকৃত করার এক বিপজ্জনক প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি!    

 

তথ্যসূত্র

ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (২০০০), “হারানো সরস্বতীর সন্ধানে”; দেশ, ৬৭ বর্ষ ১৮ সংখ্যা, ৪ জুলাই ২০০০।

রামশরণ শর্মা (১৯৯৮), প্রাচীন ভারতে বস্তুগত সংস্কৃতি ও সমাজ গঠন; ওরিয়েন্ট লংম্যান (এখন ব্ল্যাকসোয়ান), কলকাতা।

রামশরণ শর্মা (২০০১), আর্যদের ভারতে আগমন; ওরিয়েন্ট লংম্যান (এখন ব্ল্যাকসোয়ান), কলকাতা।

ক্ষিতিমোহন সেন (১৯৪৬), জাতিভেদ; বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা।

 

A. Cunningham (1871), The Ancient Geography of India; Vol. I; London.

R. T. H. Griffith (1896), The Hymns of the Rigveda; London.

S. P. Gupta (1995), “The Indus-Sarasvati Civilization: Some New Developments”; in S. P. Gupta (1995), The Lost Sarasvati and the Indus Civilization; Kusumanjali Prakashan, Jodhpur.

S. Kalyanaramana (1999), “Sarasvati: River, Goddess and Civilization”, in Radhakrishna and Merh (1999).

Rajesh Kochhar (1999), “Rigvedic Sarasvati: Lost or Misplaced?” in Radhakrishna and Merh (1999). Also see: Rajesh Kochhar (2003), “On the Identity and Chronology of Rigvedic River Saravati”, at https://www.webpages.uidaho.edu/ngier/306/contrasarav.htm

D. D. Kosambi (1975), An Introduction to the Study of Indian History; Popular Prakashan, Mumbai.

J. Mcmurdo (1834), “Dissertation on the River Indus”; Journal of the Royal Asiatic Society, London; Vol. I (1834); pp. 21-44.

J. Mcmurdo (1839), “Observations on the Sindhoo or River Indus”; Bombay Geographical Society Transactions; Vol. II (1839); pp. 124-35.

Ashoke Mukhopadhyay (2000), “Rigvedic Sarasvati: Myth and Reality”; Breakthrough, Vol. 9 No. 1 (December 2000). Also see: Ashoke Mukhopadhyay (2002), “The Truth about Rigvedic Sarasvati River: A pseudo-scientific revision of history and geography”; Socialist Perspective, Vol. 29 No. 3-4 (December 2001 - March 2002).  

C. F. Oldham (1893), “The Sarasvati and the Lost River of the Indian Desert”, in Radhakrishna and Merh (1999).

R. D. Oldham (1886/1999), “On Probable Changes in the Geography of the Punjab and its Rivers: An Historico-Geographical Study”; reproduced in Radhakrishna and Merh (1999).

Y. Pal, B. Sahai, R. K. Sood and D. P. Agarwal (1980), “Remote sensing of the `lost' Sarasvati river”, in Proceedings of the Indian Academy of Science (Earth and Planetary Science), Vol. 89, pp. 317-31.

B. P. Radhakrishna and S. S. Merh (1999), Vedic Sarasvati: Evolutionary History of a Lost River of Northwestern India; Geological Society of India, Bangalore.

B. P. Radhakrishna (1999a), “Holocene Chronology and Indian Pre-history”; in Radhakrishna and Merh (1999).

B. P. Radhakrishna (1999b), “Vedic Sarasvati and the Dawn of Indian Civilization”; in Radhakrishna and Merh (1999).

H. G. Raverty (1892), “The Mirhan of Sindh and Its Tributaries: A Geographical and Historical Study”; Journal of the Asiatic Society of Bengal, Calcutta; Vol. 61 (1892), pp. 155-297.

R. Roth (1846), Zur Literatur und Geschichte des Veda; Stuttgart.

I. B. Singh, V. N. Bajpai, A. Kumar and S. Singh (1990), “Changes in the Channel Characteristics of Ganga River During Late Pleistocene-Holocene”; in Journal of the Geological Society of India, Vol. 36, 1990.

Aurel Stein (1942), “A Survey of Ancient Sites along the `Lost' Sarasvati River”, Geographical Journal (London), Vol. 99, 1942; pp. 173-182.

E. Thomas (1883), “An Essay on the Rivers of the Rigveda”; Journal of the Royal Asiatic Society, London; Vol. 15 (new series), pp. 357-86.

V. S. Wakankar (1999), “Where is the Sarasvati River? Fourteen Historical Findings of Archaeological Survey”; in Radhakrishna and Merh (1999).

H. Zimmer (1879), Altindisches Leben; Berlin.

Papers in Radhakrishna and Merh (1999), by S. Kalyanaraman; R.D. Oldham; H. Wilhemy; P.C. Bakliwal and A.K. Grover; V. Sridhar, S.S. Merh & J.N. Malik.