কল্লোল ও রবীন্দ্রনাথ

"কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি"
কল্লোলের অর্থ মহাতরঙ্গ বা কলরব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল বাংলা সাহিত্যে কল্লোলের কাল।


        একদিকে ইংরেজদের শাসন অত্যাচার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা, রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, বিশ্বব্যাপী মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজস্ব শিল্প-সাহিত্যে থমকে থাকা অনুভাব। এই সময়ে দীনেশরঞ্জন দাস,গোকুলচন্দ্র নাগ ও সুনীতি দেবী মিলে 'ফোর আর্টস ক্লাব' নামে একটা ঘরোয়া আড্ডায় আয়োজন করলেন। ১৯২১ সালের ৪ঠা জুন ৮৮ বি হাজরা রোডে এই ক্লাবের প্রথম অধিবেশন হয়।  এই ক্লাবে সাহিত্য, সঙ্গীত ,শিল্পকলা ও নাটক নিয়ে নিয়মিত আলোচনা ও চর্চা হত। দীনেশরঞ্জন এই ক্লাবের চিন্তাধারা প্রসঙ্গে গোকুলচন্দ্রকে বলেছিলেন "ভাবছি একটা পান্থশালার কথা, সেখানে মানুষ এসে শ্রান্ত জীবনভার নিয়ে বিশ্রাম করতে পারবে। জাতি, sex ও position সেখানে কোন বাধা হবে না।"
     ১৯২২ সালে এঁরাই 'ঝড়ের দোলা' নামে একটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ করেন। 'ঝড়ের দোলা'র প্রেরণা নিয়ে ১৯২৩ সালে গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাস 'কল্লোল' নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা ও সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। ক্লাব  উঠে গেলেও পত্রিকা  চলতে থাকে  মুখর হয়ে।যদিও মাত্র সাত বছর, ১৯২৩ থেকে ১৯৩০পর্যন্ত, পত্রিকাটি টিকে ছিল কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ধারা পরিবর্তনে এই পত্রিকার প্রবল প্রভাব ছিল এ কথা অনস্বীকার্য। পরবর্তীকালে 'কালিকলম,' 'প্রগতি' পত্রিকা এই ধারাকে প্রবহমান রাখে।


      কল্লোল সাহিত্যপত্রের সময়কালকে বাংলা সাহিত্যে 'কল্লোল যুগ' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। 'কল্লোল' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত কাল পরিধিতে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাতে এই আন্দোলনের ভূমিকাই মুখ্য বলে বিবেচিত হয়। বাস্তবতার চর্চা, যৌনতার কুণ্ঠাহীন প্রকাশ, নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র, নৈরাশ্যের ও যুগগত যন্ত্রণার প্রকাশ, সাম্যবাদী মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আবেগ, যৌবনাবেগ ও বিদ্রোহচেতনা ও রবীন্দ্রবিরোধী মানসিকতাই ছিল 'কল্লোল' পত্রিকা গোষ্ঠীর সাহিত্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা বাংলার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। একদিকে তীব্র খাদ্য ও বস্ত্র সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বাংলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে চাকরির অভাব যুবসমাজে ব্যাপক বেকারত্ব সমস্যার সৃষ্টি করছিল। ব্রিটিশেরা ভারতবর্ষকে স্বরাজ দান করবে এমন আশ্বাস মিথ্যা পরিণত হল। যুদ্ধ শেষে তার পরিবর্তে এল মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন। ফলে সমগ্র ভারতের মতোই বাংলার যুব সমাজের মধ্যেও দেখা গেল প্রবল নৈরাশ্য। কল্লোলের রচনা সমষ্টিতে যুবচিত্তের এই অব্যক্ত যন্ত্রণা ভাষারূপ লাভ করল।


     অর্থনৈতিক ও সামাজিক পেষণে নৈরাশ্যপীড়িত এই যুব সমাজের কাছে রবীন্দ্রনাথের কল্যাণব্রত, পবিত্র ভাবের চেতনা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। ফলে রোমান্টিক ভাবালুতাকে বিসর্জন দিয়ে কল্লোলের কবিকূল ও কথাসাহিত্যিকেরা নেমে আসতে চাইলেন নগ্ন বাস্তবের মাটিতে। প্রেম ও সৌন্দর্যের ধারণাতেও এই রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রকট হল, জৈবপ্রেমের কামনা-বাসনার চিত্র, কদর্য জীবনের আদিম সৌন্দর্যকে রূপায়িত করলেন কল্লোলের লেখকেরা। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় "যাকে কল্লোলযুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই  বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ।" শুরুর দিকের কল্লোলের অন্যতম রূপকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেন, "ভাবতুম রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তার পরে আর পথ নেই। তিনি সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু 'কল্লোল' এসে আস্তে আস্তে সে ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরও ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনীর হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আর এক পরিচ্ছেদ।"


       দেহ মনের দুরূহ দ্বন্দ্ব, সমাজ কাঠামোর মধ্যে যৌনপ্রবৃত্তির সহজ সুস্থ বিন্যাস কামনায় কল্লোল গোষ্ঠীর সাহসিক পদক্ষেপ বাংলা সাহিত্যে বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিল। মূলত কার্ল মার্কস ও সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের চিন্তাধারার প্রভাবে সাহিত্যে এক নতুন রচনাশৈলী তৈরি হয়। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন মানুষের আচরণ ও কর্মপ্রেরণার মূলে ক্রিয়াশীল যৌন এষণাকে। ফলে রাবীন্দ্রিক দেহাতীত প্রেমের পরিবর্তে দৈহিক কামনার বাস্তবতা স্বীকৃতি পেল তরুণ সাহিত্যিকদের রচনার মধ্যেও। উগ্র বাস্তবতার পথে যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটল কল্লোলগোষ্ঠীর কথাসাহিত্যে। 


             ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এযুগের শিক্ষিত তরুণেরা  ফরাসি, রুশ, জার্মান সাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত হচ্ছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের উগ্র বাস্তবতা সঞ্চারিত হলো কল্লোলের তরুণ লেখকদের মধ্যে। শ্রমিকজীবন, ফুটপাতবাসী, গণিকাপল্লী ও অন্যান্য নিচুতলার নগ্ন আদিম স্থূল জীবনচিত্র উঠে আসতে লাগল কথাসাহিত্যের উপকরণ হিসেবে। কল্লোলের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে এল প্রান্তেবাসী মানুষের জীবন সংগ্রামের চিত্র, মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি  সহানুভূতি, নর-নারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত দৃঢ় প্রকাশভঙ্গি। সেই সঙ্গে যুক্ত হল সাহিত্যে পোয়েটিক জাস্টিসের বিরোধিতা অর্থাৎ প্রচলিত মূল্যবোধ ধর্ম, প্রেম, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতি চূড়ান্ত আস্থাহীনতা।
        পত্রিকার পাতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত 'মহানগর', 'সংসার সীমান্তে', 'পুন্নাম', 'স্টোভ', তারাশঙ্করের 'রসকলি', শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'কয়লাকুঠির দেশ' ইত্যাদি গল্প পড়তে পড়তে এই কথার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হল। 'কল্লোল'-ই বাংলা সাহিত্যের পাঠকের পরিচয় ঘটায় এমিল জোলার ন্যাচারালিজম, বোদলেয়ারের শারীরিক ভাবনা, ইংল্যান্ডের ব্লুমস বেরি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর তির্যক দৃষ্টির সঙ্গে। তৈরি হয় এক নতুন রচনাশৈলী। কল্লোল অভিনবত্ব আনে সাহিত্যের বিষয়, রচনাভঙ্গি এবং লেখকগোষ্ঠীতে। সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখার বিষয় ও স্টাইলের বিরোধিতা পত্রিকাটির অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠল।


       কল্লোলের একদল লেখক রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলতে চেয়েছিলেন এ কথা ঠিক। কিন্তু এই পত্রিকা কবিকে কখনো অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা করেনি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রীতিমতো শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তাঁরা।
          রবীন্দ্রনাথের বারোটি কবিতা প্রকাশিত হয় কল্লোল পত্রিকায়। ১৩৩১ সালের বৈশাখে 'কল্লোল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবির 'শেষ অর্ঘ্য'। সেই বছরেরই চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরসহ 'অন্ধকার' কবিতাটি মুদ্রিত হয়। পরের বছর বৈশাখ সংখ্যায় 'মুক্তি' ও আশ্বিনে 'ওগো শেফালি' গানটি বেরিয়েছে। ১৩৩৩ এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে। ছবির নিচে লেখা শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ৬৫তম জন্মতিথি, ২৫ শে বৈশাখ, ১৩৩৩)।এ বছর ই প্রকাশিত হয়েছে 'কবির কামনা' কবিতাটি। ১৩৩৪ বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত  হয় কবির 'স্বাক্ষর'কবিতা ।১৩৩৫এর বৈশাখে 'নূতন'  এবং এই বছরেই  চৈত্র সংখ্যায় 'নবীন সাধক'  কবিতাটি প্রকাশ পায় কল্লোলের  পাতায়।পরের বছর  বৈশাখে প্রকাশিত হয়  'দুয়ার' কবিতা।কল্লোলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র নাগ তাঁর 'পথিক' উপন্যাসে 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে' রবীন্দ্রসঙ্গীতটি ব্যবহার করেছেন। ১৩৩১ সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে 'কল্লোল' অনুরোধ জানিয়েছে কবিগুরুর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ নিয়ে একটি স্বল্প মূল্যের সুলভ সংস্করণ প্রকাশ করতে উদ্যোগী হতে যাতে সর্বসাধারণ তাঁর রচনা পড়ে তৃপ্ত হতে পারেন। এসব রবীন্দ্র বিদ্বেষের লক্ষণ নয়। কল্লোলের লেখক গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়েই রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে এযাবৎ পরিত্যক্ত বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে স্বাধীনভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দিয়েছিলেন। এই সময়ের অন্য বেশকিছু পত্রিকা মূলত ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা হয়ে উঠেছিল, 'কল্লোল' তার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীন চিন্তাধারা পোষণ করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে অশ্রদ্ধা করে নয় বরং কিছুটা সম্ভ্রম জানিয়ে,তাঁকে সঙ্গে নিয়েই। ১৩৩৪এর পৌষ সংখ্যায় বলা হয়েছে 'কল্লোলের পাঠকবর্গ হয়তো লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন আমরা ক্রমশ কল্লোলের উন্নতির চেষ্টা করিতেছি। রবীন্দ্রনাথের লেখা মাঝে মাঝে পাইয়াছি। আমাদের প্রতি তাঁর এই স্নেহের দানের জন্য আমরা সর্বদাই কৃতজ্ঞ থাকিব'।


           রবীন্দ্রনাথও অন্তর থেকে স্নেহ করতেন কল্লোলের লেখকগোষ্ঠীকে। অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র নজরুল এঁরা সকলেই ছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্য। তিনি কল্লোলের বেশ কিছু সংখ্যায় নিজের লেখা দিয়ে পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন একথাও অসত্য নয়। তবে কল্লোলের  ভাবধারাকে কোন দিনই তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।


            কল্লোলে প্রকাশিত লেখা নিয়ে সজনীকান্ত সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছে নালিশ জানালে সেই দীর্ঘ চিঠি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ কোনো মন্তব্য করতে চান নি সেই প্রসঙ্গে।পরে একসময় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে পত্র বিনিময়ের সময় লেখেন, 'আমার নিজের বিশ্বাস শনিবারের চিঠির শাসনের দ্বারাই অপরপক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্ছে।'


               'কল্লোল' পত্রিকা প্রকাশ হলে বাংলা সাহিত্যে নবযুগ আসার যে একটা রব উঠেছিল এই রবে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়েছিলেন। নব যুগের যাঁরা বার্তা এনেছিলেন বলে মনে করা হত তাঁদের ভাবাদর্শ রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ভঙ্গি সর্বস্ব। রবীন্দ্রনাথের কাছে এটা নিতান্তই 'চাপরাশ পরা সাহিত্য'। একেই তিনি 'সাহিত্যে নবত্ব' (১৩৩১)প্রবন্ধে আখ্যা দিয়েছিলেন 'রিয়ালিটির কারি পাউডার', 'ধার করা ভঙ্গি'।এর সঙ্গে সঙ্গে কল্লোল যুগের সাহিত্যে এসেছিল লালসা। মানুষের এই শরীর ঘেঁষা সংস্কার নিয়ে সাহিত্য রচনা তাঁর মতে ছিল সহজে বাহবা পাওয়ার কৌশল। এমন কথাই রবীন্দ্রনাথ আরো বিস্তারিত ভাবে  বলেছেন ১৩৩৪ সালে প্রকাশিত 'বিচিত্রা' পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায়, 'সাহিত্যের ধর্ম' প্রবন্ধে। সেখানে তিনি বলেন,
"মিলনের যে চরম সার্থকতা মানুষের কাছে তা প্রজননার্থং নয়, কেননা সেখানেই সে পশু; সার্থকতা তার প্রেমে, এইখানে সে মানুষ।... সম্প্রতি আমাদের সাহিত্যে বিদেশের আমদানি যে একটা বে-আব্রুতা  এসেছে সেটাকে এখনকার কেউ কেউ মনে করচেন নিত্য পদার্থ; ভুলে যান, যা নিত্য তা অতীতকে সম্পূর্ণ প্রতিবাদ করে না। মানুষের  রসবোধে যে-আব্রু আছে  সেইটেই নিত্য, যে আভিজাত্য আছে রসের ক্ষেত্রে সেইটেই  রসের নিত্য। এখনকার বিজ্ঞ-মদমত্ত ডিমোক্রাসি তাল ঠুকে  বলচে ওই আব্রুটাই দৌর্বল্য, নির্বিচার অলজ্জতাই আর্টের পৌরুষ।ওই  ল্যাঙট -পরা গুলি পাকানো ধুলোমাখা আধুনিকতারই একটা স্বদেশী দৃষ্টান্ত দেখেছি হোলি খেলার দিনে চিৎপুর রোডে। সেই খেলায় আবির নেই, পিচকারী নেই, গান নেই, লম্বা লম্বা ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে রাস্তার ধুলোকে পাঁক করে তুলে তাই চিৎকার শব্দে পরস্পরের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাগলামি করাকেই জনসাধারণ বসন্ত উৎসব বলে গণ্য করেচে। পরস্পরকে মলিন করাই তার লক্ষ্য, রঙীন করা নয়। মাঝে মাঝে এই অবারিত  মালিন্যের উন্মত্ততা মানুষের মনস্তত্ত্বে মেলে না এমন কথা বলি নে। অতএব সাইকো- এনালিসিসে এর কার্য্য-কারণ বহু যত্নে বিচার্য্য। কিন্তু মানুষের রসবোধই যে উৎসবের মূল প্রেরণা সেখানে যদি সাধারণ মলিনতায় সকল মানুষকে কলঙ্কিত করাকেই আনন্দপ্রকাশ বলা হয়,তবে সেই বর্ব্বরতার মনস্তত্ত্বকে এক্ষেত্রে অসম্ভব বলে আপত্তি করব, অসত্য বলে নয়।...এ পৌরুষ চিৎপুর রাস্তার, অমর পুরীর  সাহিত্য কলার নয়।


        ... উপসংহারে এ কথাও বলা দরকার যে সম্প্রতি যে দেশে বিজ্ঞানের অপ্রতিহত প্রভাবে অলজ্জ কৌতূহল বৃত্তি দূঃশাসন মূর্তি ধরে সাহিত্য লক্ষ্মীর বস্ত্রহরণের অধিকার দাবী করচে, সে দেশের সাহিত্য অন্তত বিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে এই দৌরাত্ম্যের কৈফিয়ৎ দিতে পারে। কিন্তু যে-দেশে অন্তরে- বাহিরে, বুদ্ধিতে-ব্যবহারে বিজ্ঞান কোনোখানেই প্রবেশাধিকার পায় নি, সে দেশের সাহিত্যে ধার করা নকল নির্লজ্জতাকে কার দোহাই দিয়ে চাপা দেবে?"
        কল্লোলের লেখকদের 'বাস্তবতা' ও 'সত্যের' দোহাই দিয়ে সাহিত্যে কিছু বিষয়ের স্থান দেওয়াকে রবীন্দ্রনাথ যে মেনে নিতে পারেননি তা এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। কল্লোলের ১৩৩৪ এর শ্রাবণ সংখ্যায় ভবানী ভট্টাচার্যের 'কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখক বলেন, "কথাসাহিত্যে সবটুকু দান এক করিয়া বিচার করিলেও মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের একটা দিক বাদ দিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সুচিত্রিত চরিত্রগুলির সকলেই যেন শুচিতায় ভরা। এমন কি বিনোদিনীর মধ্যেও পঙ্কিলতা নাই। মানুষ যেখানে সর্বাঙ্গে কাদা মাখিয়া বসিয়া আছে--- হয়তো তাহার অন্তরের গূঢ়তম প্রদেশে সত্যের স্ফুলিঙ্গটুকু  বাঁচিয়া আছে মাত্র--- সেখানে আমরা রবীন্দ্রনাথকে পাই না। জীবনের এই পাপের দিকটার চিত্রণে শরৎচন্দ্রের অসাধারণ শক্তির পরিচয়ে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়।"

            কল্লোলের প্রকাশিত অচিন্ত্যকুমারের 'বেদে'  উপন্যাসটি অশ্লীলতার ঝড় তুলেছিল। এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অচিন্ত্যকুমারকে লেখা একটি চিঠি 'কল্লোল' ১৩৩৬ এর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। "তোমার কল্পনার প্রশস্ত ক্ষেত্র ও অজস্র বৈচিত্র্য দেখে আমি মনে মনে তোমার প্রশংসা করেচি সেই কারণে এই দুঃখবোধ করেচি যে কোনো কোনো বিষয়ে তোমার অত্যন্ত পৌনঃপুন্য আছে-বুঝতে পারি সেখানেই তোমার মনের বন্ধন। সে হচ্ছে মিথুনাসক্তি। সে প্রবৃত্তি মানুষের নেই বা তা প্রবল নয় এমন কথা কেউ বলে না। কিন্তু সাহিত্যে সকল বিষয়েই যেমন সংযম আবশ্যক, এ ক্ষেত্রেও।"


             নরওয়ের সাহিত্যিক ন্যুট হ্যামসুনের দ্বারা কল্লোলের বহু লেখকের মত  অচিন্ত্যকুমারও যে প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল। এ সম্বন্ধে তিনি অচিন্ত্যকুমারকে লেখেন , "যে মানুষ মাটির কাছাকাছি আছে তাকেই তুমি নানা দিক থেকে দেখাতে গিয়েচ। কিন্তু আমার বিশ্বাস মিথুনাসক্তি সম্বন্ধে তারা এত অধিক বুভুক্ষু নয়--- অন্তত আমাদের দেশের হিন্দু জনসাধারণ। এ সম্বন্ধে উগ্রতা নরওয়ে প্রভৃতি দেশের সাহিত্যে দেখেচি দেখে আমি এই মনে করে বিস্মিত হয়েছি যে আমাদের দেশের মানুষের এই ব্যাপারে এমনতর নিত্য জাগ্রত লালসা নেই। আমাদের দেশের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এই প্রবৃত্তির উৎসুকতা অনেকের মধ্যে আজকাল দেখা যায়--- তার প্রধান কারণ মানুষের জীবন ক্ষেত্রে বিচিত্র ব্যাপারে তাদের উৎসাহ নেই।  সেই কারণেই এই এক নেশা নিয়ে তারা নিজেকে ভোলাতে চায়। নরওয়ে প্রভৃতি দেশের লোকের বলিষ্ঠ প্রাণশক্তির মধ্যে প্রবৃত্তির যে সহজ উত্তাপ আছে, এদের তা নেই---এদের আধমরা দেহমনের এই একটিমাত্র উত্তেজনার উপকরণ আছে--- আর কিছুতেই যেন এদের সম্পূর্ণ জাগাতে চায়না। এই কারণেই আমাদের সাহিত্যে যখন এই মিথুনাসক্তির লীলা বর্ণিত হতে দেখি তখন তার সঙ্গে সঙ্গে দুর্দ্দাম বলিষ্ঠতার কোন পরিচয় পাই নে, সেজন্য ওটাকে অশুচি রোগের  মতই বোধ হয়।"
            অবশ্য কল্লোলের সব লেখাতেই যে  অশ্লীলতার আঁচ লেগেছিল এমনটা নয়। তবে মননশীল বা গভীর ভাব সমৃদ্ধ লেখা এ পত্রিকায় তেমন ছিলনা, পত্রিকার উদ্দেশ্যও ছিল ভিন্ন। সে সময়ের তরুণ লেখকদের চিন্তাধারা বা মানসিকতার সঙ্গেও এ ধরনের লেখা সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। 

          শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কল্লোলের এক বিশিষ্ট লেখক। রবীন্দ্রনাথ প্রবাসীর ১৩৩৪-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় লিখলেন, "শৈলজানন্দের গল্প আমি কিছু পড়েছি। দেখেছি, দরিদ্র জীবনের যথার্থ অভিজ্ঞতা এবং সেইসঙ্গে লেখবার শক্তি তাঁর আছে বলেই তাঁর রচনায় দারিদ্র্য ঘোষণার কোন কৃত্রিমতা নেই। তাঁর বিষয়গুলি সাহিত্য সভার মর্য্যাদা অতিক্রম করে নকল দারিদ্র্যের শখের যাত্রার পালায় এসে ঠেকেনি। 'নব যুগের সাহিত্যে নতুন একটা কাণ্ড করছি' জানিয়ে পদভরে ধরণী কম্পমান করবার দাপট আমি তাঁর দেখিনি--- দরিদ্রনারায়ণের পূজারীর মস্ত একটা তিলক তাঁর কপালে কাটা নেই। তাঁর কলমে গ্রামের যে-সব চিত্র দেখেছি তাতে তিনি সহজে ঠিক কথাটি বলেছেন বলেই ঠিক কথা বলবার কারি পাউডার ভঙ্গীটা তাঁর মধ্যে দেখা দেয়নি।"


           আসলে সেকালের সৌখিন আধুনিকতার বিরুদ্ধে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের সত্য আর সাধারণ সত্য নিয়ে তার নির্দিষ্ট ধারণাটি ছিল এই যে, সাধারণ সত্যে বাছবিচার নেই কিন্তু সাহিত্যের সত্যকে হতে হবে বাছাই করা। সাহিত্যের সত্য নিত্যকালের গৌরব পায়। তাঁর মনে হয়েছিল কয়লাখনির বা পানওয়ালিদের কথা অনেকে মিলে লিখলেই সাহিত্যে নবযুগ আসেনা।  ১৩৩৫ সালে লেখা 'সাহিত্যের রূপ' প্রবন্ধে তিনি এই তকমা পরা সাহিত্যকে স্পষ্টভাবে ব্যঙ্গ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল তথাকথিত এই নবযুগের গরিবিয়ানার বা দারিদ্রিয়ানার ভঙ্গি এসেছিল বাংলা সাহিত্যে 'রাশিয়ান হেডমাস্টারের কড়া বিধান জোরে' একেই তিনি বলেন ধার করা ভঙ্গি। তাঁর মতে সহজিয়া সাধন। সহজেই এতে বাহবা পাওয়া যায়। এতে মস্তিষ্কের ও চরিত্রের শক্তির দরকার হয়না। ১৩৩৪ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'সাহিত্যের রীতি ও নীতি' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে লেখেন, ''তাঁহার নিশ্চয়ই বিশ্বাস জন্মিয়াছে আধুনিক সাহিত্যে কেবল সত্যের নাম দিয়া নর-নারীর যৌন মিলনের শরীরী ব্যাপারটাকেই অলংকৃত করা চলিতেছে। তাহাতে লজ্জা নাই, শরম নাই, শ্রী নাই, সৌন্দর্য নাই, রসবোধের বাষ্প নাই--- আছে শুধু ফ্রয়েডের সাইকো এনালাইসিস। অথচ যে- কোন সাহিত্যিককেই যদি তিনি ডাকিয়া পাঠাইয়া জিজ্ঞাসা করিতেন ত শুনিতে পাইতেন তাহারা প্রত্যেকেই জানে যে, সত্য মাত্রেই সাহিত্য হয় না, জগতে এমন অনেক নোংরা সত্য ঘটনা আছে যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া কোন মতেই সাহিত্য রচনা করা চলে না।''  হয়তো কখনো কখনো  কবি সে কালের  সাহিত্যের হৃদস্পন্দনকে সঠিক ভাবে অনুভব করতে পারেন নি ।তিনি সে সময় শারীরিক ও মানসিক ভাবে ছিলেন কিছুটা পরিশ্রান্ত,  বিদেশ যাত্রা থাকছিল ঘন ঘন সঙ্গে মাথাভর্তি তখন সৃজনের মানচিত্র।তার মাঝে একদল নব্য লেখক রবীন্দ্র বিরোধিতার নাম করে , রিয়ালিজমের  ধুয়ো তুলে সাহিত্যে অবাধ যৌনতার পসরা সাজিয়ে   ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল তাঁর চিন্তাভাবনায়। তাই কখনো কখনো সবটাকেই তাঁর ভঙ্গি সর্বস্ব মনে হয়েছিল। সেজন্যই হয়তো জীবনানন্দের মত যুগন্ধর কবি  বা জগদীশ গুপ্তের  মত কথাসাহিত্যিকদের  সম্বন্ধেও দু একটি প্রশংসাবাক্য ছাড়া মূলত নীরব থেকেছেন কবি।


           কল্লোল গোষ্ঠীর লেখক জগদীশ গুপ্ত ১৯৩২ সালে  তাঁর  'লঘুগুরু' উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের হাতে দিয়ে এলে তার এক দীর্ঘ সমালোচনা লিখলেন কবি। জগদীশের লিখন ভঙ্গিমার প্রশংসা করে নকল রিয়ালিজম প্রসঙ্গে বেশ বড়সড় একটি বক্তব্য রাখেন তিনি এখানে। যার সবটা এই উপন্যাস সম্পর্কে খাটে না তবে নবযুগের লেখকদের সম্বন্ধে তাঁর মতামত স্পষ্ট হয়। "যাই হোক একথা মানতে হবে রচনা নৈপুণ্য লেখকের আছে। আধুনিক আসরে রিয়ালিজমের পালা সস্তায় জমাবার প্রলোভন যদি তাঁকে পেয়ে বসে তবে তার ক্ষতি হবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাস্তব প্রবণতা এবং ভাবপ্রবণতা নিয়ে জাতিভেদের মামলা তোলা প্রায় আধুনিক কম্যুনালিজমের মতোই দাঁড়িয়েচে। অথচ সাহিত্যে ওর মধ্যে কোনটারই জাতিগত বিশেষ মর্য্যাদা নেই। সাহিত্যে সম্মানের অধিকার বহিনির্দিষ্ট শ্রেণী নিয়ে নয়, অন্তর্নিহিত চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ পৈতে নিয়ে নয়, গুণ নিয়ে। আধুনিক একদল  লেখক পণ করেচেন তাঁরা পুরাতনের অনুবৃত্তি করবেন না। কোনোকালেই অনুবৃত্তি করাটা ভালো নয় একথা মানতেই হবে। নবসংহিতাসম্মত ফোঁটা- তিলককাটা আধুনিকতাও গতানুগতিক হয়ে ওঠে। সেটার অনুবৃত্তিও দুর্ব্বলতা। চন্দনের তিলক যখন চলতি ছিল তখন অধিকাংশ লেখা চন্দনেরি তিলকধারী হ'য়ে সাহিত্যে মান পেতে  চাইত। পঙ্কের তিলকই যদি সাহিত্যসমাজে ওঠে তাহলে পঙ্কের বাজারও দেখতে দেখতে চড়ে যায়।বঙ্গবিভাগের সময় দেশী চিনির চাহিদা বেড়ে উঠল। ব্যবসায়ীরা বুঝে নিলে বিদেশী চিনিতে মাটি মিশিয়ে দেশী করা সহজ। আগুন জ্বালিয়ে রসে পাক দেওয়া অনাবশ্যক। কেননা রসিকেরা মাটির রং দেখলেই অভিভূত হবে। সাহিত্যেও মাটি মেশালে রিয়ালিজমের রং ধরবে এই সহজ কৌশল বুঝে নিতে বিলম্ব হয়নি। মানুষের এমন সব প্রবৃত্তি আছে যার উত্তেজনার জন্য গুণপনার  দরকার করে না। অত্যন্ত সহজ বলে মানুষ সেগুলোকে নানা শিক্ষায় অভ্যাসে লজ্জায় সঙ্কোচে সরিয়ে রেখে দিতে চায়। নইলে বিনা-চাষেই যে সব আগাছা ক্ষেত ছেয়ে ফেলতে পারে তাদের মতোই এরা মানুষের দুর্মূল্য ফসলকে চেপে দিয়ে জীবনকে জঙ্গল করে তোলে। এই অভিজ্ঞতা মানুষের বহুযুগের।"
        পরবর্তীকালে 'শেষের কবিতা'(১৯২৯) উপন্যাসে এবং 'বাঁশরী(১৯৩৩)' নাটকে মেকি রিয়ালিজম ও রিয়ালিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সংহত হয়েছিল ।


          জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একবার সাহিত্যসভায় কল্লোলের ডাক পড়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় ধরা পড়েছে সে কথা। "জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আধুনিক সাহিত্যের বিচার সভা যেদিন বসেছিল যতদূর মনে পড়ছে তার দু'একদিন বাদেই সকালবেলা ওই বাড়িতেই কল্লোলের ডাক পড়েছিল। কল্লোলের কাছে সেটা আশাতীত সৌভাগ্য। মনে পড়ে দোতালার পূর্ব দিকের একটা লম্বা ঘরে আমরা কজন নিচু কটি আসনে একসারি হয়ে, পশ্চিমমুখো হয়ে বসেছিলাম। গরদের ধুতি চাদরে রবীন্দ্রনাথ এসে আমাদের সামনের একটি নিচু আসনে পূর্ব মুখে বসে ছিলেন। সে আসরে শিশিরকুমার ভাদুড়ীও একটু পরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। মনে আছে মুগ্ধ বিহ্বলতায় রবীন্দ্রনাথকে শুধু দেখেছিলাম। আর তাঁর কথা শুনেছিলাম। একনাগাড়ে প্রায় এক ঘন্টা তিনি সাহিত্য আর তার সাধনার বিষয়ে বলে গিয়েছিলেন। তাঁর সেদিনের একটা কথা বিশেষভাবে মনে আছে। কথায় কথায় তাঁর নিজের লেখার হাত পাকা করবার কথা বলেছিলেন। ছাপার অক্ষরে প্রকাশের আগে শ্লেটে কত কবিতা যে লিখেছেন আর মুছেছেন সে কথা জানিয়ে বলেছিলেন যে "সার্থক কোন সৃষ্টির পেছনে নিরলস দীর্ঘ সাধনা না থেকে পারেনা, হঠাৎ ভুঁইফোড় হঠাৎ অসামান্য স্রষ্টা হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত তাই নেই বললেই হয়। সামনে প্রকাশ পাক বা না পাক-- নীরব নেপথ্যে সাধনা সব সাফল্যের পেছনেই থাকে।" সেদিন যাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এসব কথা বলেছিলেন তারা এটুকু বুঝে কৃতার্থ হয়েছিল যে, তিনি তাদের তখনকার বাজারদর দিয়ে দাম করেননি। নিভৃতে সাহিত্যের কথা শোনাবার উপযুক্ত মনে করে ডেকে স্বজাতি বলে বোঝাবার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছেন।"

              আসলে 'কল্লোল'এর  প্রতি কোন বিরূপতা তাঁর ছিল না। কেবল তিনি তাঁদের সঠিক পথনির্দেশ করতে চেয়েছিলেন অভিভাবকের মত। যাতে আধুনিক যুগের সাহিত্য ধ্যানে, প্রজ্ঞায় প্রকাশে যথার্থ আধুনিক হয়ে উঠতে পারে।  নতুন পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারে। হঠাৎ চলার উদ্দাম আবেগে তা যেন মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে নিজের চলার শক্তিটুকু হারিয়ে না ফেলে। তাই পরম স্নেহে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখককুলকে সাধনার পথে অবিচল থাকতে বলেছেন। এজন্য হয়তো কখনো কখনো তাঁকে কিছুটা কঠিন হয়ে ভর্ৎসনাও করতে হয়েছে, আবার তাঁদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে নতুন যুগকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন।l

            কল্লোল গোষ্ঠীর উত্থান ও তথাকথিত নতুন ধারায় লেখালিখি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কীর্তিকেও প্রভাবিত করেছিল। সাহিত্যে আধুনিকতার যে নবত্ব ও রীতি কল্লোলের লেখকেরা দাবি করতেন রবীন্দ্রনাথ তাকে সরাসরি স্বীকার না করলেও তাঁর শেষ বয়সে লেখা 'তিনসঙ্গী','রবিবার' ও 'ল্যাবরেটরি'র মত নব্যধারার গল্পগুলি যেন ছিল সেই অভিধার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক অবদান। নবীন-প্রবীণ, শ্লীল-অশ্লীল,প্লেটোনিক প্রেম-মার্ক্স-ফ্রয়েডের সম্মিলিত মিলন ও সংঘাতে কল্লোলের কাল, বলাইবাহুল্য, এক অনন্য মাইলস্টোন হিসাবে বাংলা সাহিত্যের পথপরিক্রমায় চির প্রতিষ্ঠিত হয়ে থেকে গেল।

আকর

কল্লোল যুগ - অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
কল্লোলের কাল - জীবেন্দ্র সিংহ রায়