ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা : জীবন ও সাহিত্যকথা

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতার ৫৫ বছর আবার এশিয়াতে সাহিত্য রচনার জন্য এই পুরস্কার আসে ১৯৬৮ সালে। সে বছর এই পুরস্কার পান জাপানের লেখক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা। কাওয়াবাতার সাহিত্যকে বুঝতে গেলে জাপানকে বুঝতে হবে, তার ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের নিজস্বতাকে বুঝতে হবে।

কাওয়াবাতার নোবেল পুরস্কার পাবার ঠিক একশো বছর আগে ১৮৬৮ সালে জাপানে শুরু হয়েছিল এক নতুন যুগ, যাকে সে সময়ের শাসকদের নাম অনুসারে মেইজি যুগ নামে সাধারণভাবে ডাকা হয়। মেইজি যুগের আগের দুশো বছরে জাপান বাকী পৃথিবীর থেকে নিজেদের অনেকটাই বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। সেই সময়টা গোটা বিশ্বেই ছিল ইউরোপীয়দের দাপট আর উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার যুগ। জাপানের শাসকেরা ভাবলেন পশ্চিমের সঙ্গে মেলামেশা বাড়ালে তাদের দেশটাও ইউরোপের গ্রাসে গিয়ে পড়বে। তারা জাপানের দরজা বিদেশীদের জন্য একেবারে বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে কচ্চিৎ কদাচিৎ বাণিজ্যপণ্য নিয়ে এক আধটা বিদেশি জাহাজ যাতায়াত করলেও জাপানের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্নই ছিল। জাপানের শিক্ষা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এর ফলে নিজের মতো করে এগোল।

১৮৬৮ সালে মেইজি শাসকেরা এই অবরোধটা তুলে দিলেন। খোলা হাওয়া ঢুকতে শুরু করল জাপানে। এই সময়েই জাপানে জন্মান এক প্রতিভাবান লেখক, যাঁর নাম নাৎসুমে সোসেকি। সোসেকি ইংরাজী ভাষা সাহিত্য নিয়ে পড়লেন, প্রবাসেও গেলেন। তিনিই ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করা প্রথম জাপানী। প্রবাস পাঠ সাঙ্গ করে সোসেকি দেশে ফিরলেন ও প্রথমে শিক্ষকতা, তারপর লেখালিখির জীবন বেছে নিলেন। সোসেকির উপন্যাসগুলোতে জাপানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চিহ্ন আর পশ্চিমী প্রভাবের দ্বন্দ্বের কথা, সেই দ্বন্দ্বের ফলে সমাজ জুড়ে ওঠা আলোড়নের কথা আছে।

সোসেকির পরে একজন ছোটগল্পকার, আকুতাগাওয়া জাপানী সাহিত্যে বেশ সাড়া ফেলেন। তাঁর গল্পের মনস্তত্ত্ব, গভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসা তাঁকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান এক ছোটগল্পকারের মর্যাদা দিয়েছে। ১৯২৭ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আকুতাগাওয়া আত্মহত্যা করলেন। সেই সময়েই লেখালিখির জগতে প্রবেশ করে কিছু সুনাম অর্জন করেন কাওয়াবাতা। 

কাওয়াবাতার ছেলেবেলাটা কাটে বেশ কষ্টে।

১৮৯৯ সালের ১৪ জুন কাওয়াবাতার জন্ম হয়। জাপানের ওসাকা শহরের এক প্রতিষ্ঠিত পরিবারে জন্মালেও পারিবারিক জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ তিনি কিছুমাত্র উপভোগ করতে পারেন নি। তাঁর বয়েস যখন দুই তখন তিনি বাবাকে হারান আর তার বছর দুয়েকের মধ্যেই মাকে। চারবছরের আগেই বাবা মাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে যাওয়া কাওয়াবাতা থাকতে শুরু করলেন ঠাকুরদা ঠাকুমার কাছে। কাওয়াবাতার ঠাকুমাও মারা গেলেন ১৯০৬ সালে, তখন কাওয়াবাতার বয়েস সাত। ঠাকুরদা চলে গেলেন ১৯১৪ সালে, কাওয়াবাতার পনেরো বছর বয়েসে। তার এক দিদি ছিল। তিনি আবার অন্য এক আত্মীয় পরিবারে বড় হন, ফলে তার সঙ্গেও কাওয়াবাতার কোনও যোগাযোগ ছিল না। কাওয়াবাতার বয়েস যখন এগারো তখন সেই দিদিও মারা যান। ষোল বছর বয়স হবার আগেই কাওয়াবাতা পিতৃপরিবারের দিক থেকে অনাথ ও আত্মীয় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কাওয়াবাতা তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে আশ্রয় হিসেবে বেছে নেন সাহিত্যকে এবং মুরাসাকি শিকিবুর 'দ্য টেল অব গেঞ্জি' সহ জাপানের ধ্রুপদী সাহিত্যের অনেক কিছুই খুব মন দিয়ে পড়েন। 

কাওয়াবাতা যদিও তাঁর মাতৃকূলের পরিবার ‘কুরোদা’দের সাথে কিছুদিন থেকেছিলেন তবে সেটা তাঁর কাছে খুব সুখকর হয় নি। ফলে ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি একটি বোর্ডিং হাউসে চলে যান, যা তাঁর জুনিয়র হাই স্কুলের (আধুনিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সমতুল্য) কাছাকাছি ছিল। মার্চ ১৯১৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন করার পর, কাওয়াবাতা তাঁর ১৮তম জন্মদিনের ঠিক আগে চলে এলেন জাপানের রাজধানী টোকিওতে। তাঁর ইচ্ছা ছিল ফার্স্ট হায়ার স্কুলে ভর্তি হবার। এখানে পড়াশুনো করার পর দেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া সুবিধেজনক হত। ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাওয়াবাতা ফার্স্ট হায়ার স্কুলে ভর্তি হন। পরের বছর তিনি ইজু অঞ্চলে আটদিনের জন্য বেড়াতে যান এবং পরবর্তীকালে এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘ইজু নর্তকী’ নামের বিখ্যাত গল্পটি লেখেন।

ফার্স্ট হায়ার স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর, ১৯২০ সালের জুলাই মাসে কাওয়াবাতা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্যাকাল্টি অব লেটার্স’-এ ইংরেজি সাহিত্য পড়ার জন্য ভর্তি হন। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই কাওয়াবাতা খুব মন দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য পড়েন এবং তার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হন। এর কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপান ভ্রমণের সময় গুরুত্ব দিয়েছিলেন নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থাকার ওপর। কাওয়াবাতাকে এই রবীন্দ্রকথা এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি ইংরাজী বিভাগ ছেড়ে জাপানী ভাষা ও সাহিত্যে নতুন করে ভর্তি হন।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই কাওয়বাতার জীবনে এল প্রেম ও বিরহের অভিজ্ঞতা।  হাসুয়ো ইতো (伊藤初代) (১৯০৬-১৯৫১) ছিলেন কাওয়াবাতার প্রথম প্রেম। কাওয়াবাতা যখন ২০ বছর বয়সী, তখন তাঁর সঙ্গে হাসুয়োর দেখা হয় এবং ১৯২১ সালে তাঁদের বাগদান হয়। কিন্তু মাত্র এক মাস পরেই হাসুয়ো কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই এই সম্পর্ক ভেঙে দেন। এই ঘটনার আঘাত থেকে কাওয়াবাতা কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেননি। সাহিত্য সমালচকেরা মনে করেন কাওয়াবাতার বেশ কিছু লেখায় — যেমন ‘দ্য ড্যান্সিং গার্ল অব ইজু বা পাম অব দ্য হ্যান্ড স্টোরিজ’ এর গল্পগুলোতে এই সম্পর্কের প্রভাব পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই কাওয়াবাতা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সাময়িকী শিন-শিচো (新思潮, অর্থাৎ "নতুন চিন্তার জোয়ার") পুনরায় চালু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এটি তখন চার বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল। এই সাময়িকীতেই তিনি ১৯২১ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প "শোকোনসাই ইক্কেই" ("ইয়াসুকুনি উৎসব থেকে দেখা একটি দৃশ্য") প্রকাশ করেন। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে তাঁকে একটি গবেষণাপত্র লিখতে হয়, যার নাম ছিল "জাপানি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস"। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই কাওয়াবাতা কিকুচি কান সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী ‘বুনগেই শুনজু’-তে লিখতে শুরু করেন ও জাপানী সাহিত্য মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কাওয়াবাতা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশুনো পর্ব সাঙ্গ করেন।

এরপর ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে, কাওয়াবাতা, রিইচি ইয়োকোমিৎসু এবং আরও কিছু তরুণ লেখক ‘বুনগেই জিদাই’ (文芸時代, অর্থাৎ "শিল্পের যুগ") নামে একটি নতুন সাহিত্য সাময়িকী শুরু করেন। এই সাময়িকীটি ছিল জাপানি সাহিত্যে তখনো অবধি প্রতিষ্ঠিত ও আধিপত্যকারী ধারা ন্যাচারালিজমের প্রতি একটি প্রতিক্রিয়া। ‘বুনগেই জিদাই’ শুধু ন্যাচারালিজমের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় নি, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বা সোশালিস্ট রিয়ালিজম থেকেও সচেতন দূরত্ব তৈরি করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য "শ্রমিক-সাহিত্য" আন্দোলন তখন জাপানে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল ও নতুন পথে এগনোর জন্য সেই ধারা থেকেও কাওয়াবাতা সরতে চাইলেন।

কাওয়াবাতাদের ‘বুনগেই জিদাই’ আন্দোলনের মূল কথা ছিল "শিল্পের জন্য শিল্প" ‘আর্ট ফর আর্ট সেক” — অর্থাৎ সাহিত্য কেবলমাত্র অভিজ্ঞান, রূপ, এবং অভিজ্ঞতার জন্য। কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণ সাহিত্য রচনার প্রাথমিক লক্ষ্য হতে পারে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কাওয়াবাতাদের ‘বুনগেই জিদাই’ ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী শৈলীনির্ভর নানা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন - কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম, দাদাইজম ইত্যাদির দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল।

কাওয়াবাতা ও ইয়োকোমিৎসু তাঁদের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে শিনকানকাকুহা (新感覚派, অর্থাৎ "নতুন অনুভূতির ধারা") বলে আখ্যা দেন। এই শব্দটি অনেক সময় ইংরেজিতে ভুলভাবে "নিও-ইমপ্রেশনিজম" হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু আসলে শিনকানকাকুহা কোনোভাবে ইমপ্রেশনিজমের পুনরাবিষ্কার নয়; বরং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যে "নতুন অনুভব", "নতুন সংবেদন", বা "নতুন উপলব্ধির" প্রকাশ। কাওয়াবাতাদের ‘বুনগেই জিদাই’ আন্দোলনের উদাহরণ হলো ফেরেঙ্ক মোলনারের নাটক Liliom একটি রূপান্তর - "হোশি ও নুসুন্দা চিচি" (যে পিতা একটি তারা চুরি করেছিল)। 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পরপরই কাওয়াবাতা ছোটগল্প লিখে সাহিত্যখ্যাতি পেতে শুরু করেন। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর অতি বিখ্যাত গল্প ‘The Dancing Girl of Izu’ (‘ইজু নর্তকী’ নামে বাংলায় অনূদিত)। এটি পাঠক সমালোচক মহলে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। এই গল্পে একজন বিষণ্ণ ছাত্রের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। বিষণ্ণ মন নিয়েই সে ইজু উপদ্বীপে বেড়াতে যায়। সেখানে এক নৃত্যশিল্পীকে দেখে সে মুগ্ধ হয়। প্রথমদিকে তার প্রতি প্রথাগত প্রেমের আকর্ষণ থাকলেও একদিন সে তাকে দূর থেকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করতে দেখে। তখন সে বুঝতে পারে মেয়েটি আসলে নিতান্তই বালিকা। এই অনুভব ইন্দ্রিয়জ আকর্ষণের বাইরে এক অতিন্দ্রিয় প্লেটোনিক প্রেমের অনুভূতির জন্ম দেয়। নতুন মন নিয়ে সে টোকিও ফিরে যায়। তার মন তখন অনেকটা হালকা হয়ে গিয়েছে। কেটে গিয়েছে বিষাদ, অবসাদ। গল্পটিতে যৌবনের উদীয়মান প্রেম ও ইন্দ্রিয়জ আকর্ষণ রয়েছে, রয়েছে তা অতিক্রম করা একধরনের ধরণের বিষণ্ণতা ও অতিন্দ্রিয় প্রেমের অনুভূতি। কাওয়াবাতার পরবর্তীকালের নানা গল্পেও এই ধরনের অনুভূতির অনুসন্ধান রয়েছে।

কাওয়াবাতা ১৯২০ র দশক জুড়ে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের সাহিত্যশৈলিতে লেখার পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। এই সময়ে তিনি থাকতেন টোকিওর আসাকুসা নামের একটা জায়গায়। সেটা ছিল নিতান্ত সাধারণ মানুষদের বসতি এলাকা। আসাকুসা কুরেনাইদান (The Scarlet Gang of Asakusa, ১৯২৯-৩০ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত) বইতে এদো যুগের সাহিত্যের ঢঙে কাওয়াবাতা সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবন তুলে ধরেন। এইসময়ে ব্রিটেনে বেরোয় জয়েসের ‘ইউলিসিস’ (১৯২২) নামক বিখ্যাত উপন্যাস এবং গোটা বিশ্বেই এর রচনারীতি ‘স্ট্রিম অব কনসাসনেস’ বা ‘চেতনাপ্রবাহরীতি’ ব্যাপক সাড়া ফেলে। কাওয়াবাতাও এর দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁর ‘সুইশো গেনসো’ (水晶幻想, Crystal Fantasy) স্ট্রিম-অব-কনশাসনেস বা চেতনা প্রবাহধর্মী রীতিতে লেখা। কাওয়াবাতা এইসময়ে পরীক্ষামূলকভাবে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লেখেন। A Page of Madness-চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য কাওয়াবাতার লেখা।

১৯২৫ সালে কাওয়াবাতার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর ভাবী স্ত্রী হিদেকোর। ১৯৩১ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁরা বিয়ে করেন। কাওয়াবাতা বামপন্থী বলে নিজেকে কখনো ঘোষণা করেন নি, তবে ১৯৩৩ সালে তরুণ বামপন্থী লেখক তাকিজি কোবায়াশির গ্রেফতার, নির্যাতন ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৩৪ সালে কাওয়াবাতা ঠিকানা পালটে আসাকুসা থেকে কানাগাওয়া প্রিফেকচারের কামাকুরাতে স্থানান্তরিত হন। প্রথমদিকে বেশ কিছু বছর কাওয়াবাতা সেখানে সামাজিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তবে ক্রমশ তিনি সামাজিক মেলামেশা কমিয়ে দেন ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন।

কামাকুরাতে চলে আসার পর কাওয়াবাতা লিখতে শুরু করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ইকিগুনি বা স্নো কান্ট্রি। 'ইকিগুনি' বা 'তুষারের দেশ' ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার লেখা প্রথম এবং অধিকাংশ পাঠক সমালোচকের মতে তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ১৯৩৪ সালের বসন্তে কাওয়াবাতা ইউকাওয়া উষ্ণ প্রস্রবণে বেড়াতে যান। এই ভ্রমণ তাঁর কাছে এতই উপভোগ্য হয়ে ওঠে যে সেই একই বছরে শরৎকালে আবার তিনি সেখানে যান, এবং সে সময়েই এই উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায় ১৯৩৫ সালের নভেম্বরে একটি পত্রিকায় ছাপা হয় এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলো কাওয়াবাতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ১৯৩৭ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ এ অনেকগুলি অধ্যায় এখানে ওখানে প্রকাশিত হবার পর যখন কিছুদিন আর কিছু প্রকাশিত হল না, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন বইটি লেখা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিরতি ভেঙে ১৯৩৯ ও ১৯৪০ সালে কাওয়াবাতা আবার কিছু নতুন অধ্যায় যোগ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হবার দু বছর পর ১৯৪৭ সালে এই উপন্যাসটির শেষ অধ্যায় লেখেন কাওয়াবাতা এবং পরের বছর ১৯৪৮ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কাওয়াবাতার তথা জাপানী সাহিত্যেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় যে রচনা, স্বয়ং লেখকই যে তার সম্পর্কে ভেবেছিলেন, একক উপন্যাস হিসেবে না পড়ে এর প্রতিটি অধ্যায় আলাদাভাবেও পড়া যেতে পারে, এই তথ্য আমাদের বিস্মিত করে। দেড় দশক ব্যাপী বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত ও প্রকাশিত ‘স্নো কান্ট্রি’ একক বই হিসেবে প্রকাশের পর সমালোচকদের বিপুল প্রশংসা অর্জন করে এবং বেশ ভাল বিক্রি হয়। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প লিখলেও তখনো পর্যন্ত কাওয়াবাতা মূলত তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোর জন্যই বেশি পরিচিত ছিলেন, কিন্তু এই উপন্যাসটি লেখার পর তিনি জাপানী সাহিত্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। 

উপন্যাসটিতে একটা কাহিনী অংশ আছে, যদিও তা এই রচনার মূল আকর্ষণ নয়। বস্তুতপক্ষে এই উপন্যাস কাহিনীভিত্তিক কোনও রচনাই নয়। আমরা উপন্যাসের শুরুতে টোকিও শহরের বুদ্ধিজীবী লেখক গবেষক শিমামুরাকে একটি ট্রেনে চড়ে আসতে দেখি জাপানের মূল দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তের এক অঞ্চলে, যা বছরের বেশ কয়েক মাস বরফে ঢাকা থাকে৷ এখানে রয়েছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। আগেও শিমামুরা একবার এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তখন এখানকার এক নারী, কোমাকোর সঙ্গে তার একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়বার এই অঞ্চলে আবার ভ্রমণ খানিকটা এই নারীর কাছেই শিমামুরার ফেরৎ আসা।

তবে আসার পথে ট্রেনে আর এক সদ্য কৈশোর পেরনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন শিমামুরা। তার নাম ইয়োকো। উপন্যাসে আমরা পাই এক শীতল দিনকালের প্রেক্ষাপট৷ শিমামুরা চরিত্রটিও খানিক শীতল। অন্তত উপন্যাস জুড়ে কোমাকোর যে ধরনের আবেগ উত্তাপ আমরা দেখি, তার তুলনায় তার প্রেমিককে অনেক শীতল মানুষ বলেই আমাদের মনে হয়। মাঝে মাঝে আবেগদীপ্ত শিমামুরাকে আমরা যে একেবারেই পাই না, তা নয়। তবে তা তুলনায় সংক্ষিপ্ত ও সংযত। অবশ্য খানিক শীতল হলেও সে উদাসীন নয়। শিমামুরার রয়েছে এক নিবিড় দৃষ্টি, যা উপন্যাসের একদম শুরুতে ট্রেনের জানলার আরশি দিয়ে ইয়োকোকে পর্যবেক্ষণ সূত্রে আমরা জানতে পারি। এই পর্যবেক্ষণ বর্ণনাটি কাওয়াবাতার উপন্যাসকৃষ্টির অসামান্যতারও পরিচয়বাহী।

কাওয়াবাতা এই উপন্যাসে চরিত্রদের সম্পর্কে বর্ণনা দেন কম, তাঁদের মেলে ধরেন বেশি৷ একারণেই আমরা শিমামুরার টোকিও জীবন সম্পর্কে অল্পবিস্তর খবর পাই মাত্র, কিন্তু তাঁকে বুঝতে হয় এই উষ্ণ প্রস্রবণের হোটেলবাস পর্বটি দিয়েই। শিমামুরা টোকিওর স্থায়ী অধিবাসী আর কোমাকোও একসময়ে গেইশা হিসেবে কাজ করতে টোকিওতে কিছুদিন থাকতে বাধ্য হয়েছিল। তবে সেখান থেকে সে ফিরে আসে তার সঙ্গীত শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে৷ উপন্যাসের আর এক চরিত্র ইয়োকো শেষদিকে টোকিও যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে শিমামুরার কাছে৷ তিনটি চরিত্রের অবস্থানে বা ভাবনায় থাকলেও জাপানের অতি জনবহুল রাজধানী শহরকে পাঠকের চোখের সামনে হাজির করতে কাওয়াবাতা খুব একটা আগ্রহী হন নি এখানে। উষ্ণ প্রস্রবণের ঠান্ডা শীতল ছোট্ট জনপদের মধ্যেই রেখে দিয়েছেন উপন্যাস ও তার চরিত্রদের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ দিনকালে কাওয়াবাতার সাহিত্যপ্রচেষ্টা সম্পর্কিত তেমন কোনও খবরাখবর পাওয়া যায় না। যুদ্ধের প্রথমদিকে জাপান আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে বিরাট বিমানহানা চালায় এবং তার মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামিল হয়। জাপান এবং তার সঙ্গী জার্মানী ও ইতালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পর্যদুস্ত হয়। জাপানের ওপর আঘাত আসে সবচেয়ে বেশি। ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট হিরোসিমাতে এবং ৯ অগস্ট নাগাসাকিতে আমেরিকা পরমাণু বোমা ফেলে। নিমেষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। অনতি পরেই মারা যান আর অনেকে। অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে যান। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব বয়ে বেড়ায় বেশ কয়েকটি প্রজন্ম। বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান কার্যত চলতে থাকে আমেরিকার নীতি নির্দেশ অনুসারে। সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের কিছু পুলিশ সেনা ছাড়া সেনাবাহিনী বা অস্ত্রনির্মাণ জাপানের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। মার্কিন প্রভাবে জাপানের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ সবেতেই আসে ব্যাপক বদল। জাপান তার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কতখানি ধরে রাখতে পারবে সেই আশঙ্কা দেখা দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কাওয়াবাতা যে সব উপন্যাস লেখেন তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল "থাউজ্যান্ড ক্রেইনস" (হাজার সারস নামে বাংলায় অনূদিত), "দ্য সাউন্ড অব দ্য মাউন্টেন",  "বিউটি অ্যান্ড স্যাডনেস", "দ্য ওল্ড ক্যাপিটাল", নিজি (রেইনবো, ইন্দ্রধনু নামে বাংলায় অনূদিত), "দ্য হাউস অব দ্য স্লিপিং বিউটিজ"(সুষুপ্তু নগরী নামে বাংলায় অনূদিত), ইত্যাদি। 

থাউজ্যান্ড ক্রেইনস (১৯৪৯–১৯৫১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত) জাপানি চা-মিলনী অনুষ্ঠান ও নিষ্ফল প্রেমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিকুজি নামের এক সদ্য যুবকের মৃত পিতামাতার স্মৃতি, প্রেম, যৌনতা, অস্থিরতার কথা আছে ইয়ুসুনারি কাওয়াবাতার ‘থাউজেন্ড ক্রেনস’ নামের উপন্যাসটিতে।

কিকুজির বাবা বরিষ্ঠ মিতানী মারা যাবার পর তার মা একা হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য স্বামী বেঁচে থাকার সময়েও তাঁকে তিনি অন্য নারীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে সেই নিয়ে তাঁর কতটা অনুযোগ বা বেদনা ছিল তার বিশদ কোনও পরিচয় এই উপন্যাসে নেই। তবে বরিষ্ঠ মিতানীর সঙ্গে যে দুই নারীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাদের বিস্তারিত উপস্থিতি এই উপন্যাসে আছে। এই দুই নারীর একজন হলেন চিকাকো কুরামতো। খুব অল্পদিনের জন্য তার সঙ্গে বরিষ্ঠ মিতানীর একটি প্রেম সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তবে তার থেকে সরে এরপর শ্রীমতি ওতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন বরিষ্ঠ মিতানী। তার মেয়ে ফুমিকো বালিকা বয়সেই নিজের বাবাকে হারিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মায়ের সঙ্গে বরিষ্ঠ মিতানীর এই সম্পর্ককে কাছ থেকে দেখেছে সে। যুদ্ধের দিনগুলিতে সে বরিষ্ঠ মিতানীকে অনেকটা দূর অবধি বাড়ির পথে এগিয়ে দিত সেই বালিকা বুসেই। একবার বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে নিজে আর ফেরার সুযোগ পায় নি। রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছিল রাস্তার মাঝে থাকা এক যুদ্ধকালীন আশ্রয়গৃহে। কিকুজীর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় বরিষ্ঠ মিতানীর মৃত্যুর প্রায় চার বছর পরে, চিকাকো কুরামতোর বাড়ির এক চা মিলনীতে। সেই চা মিলনীতে চিকাকো, কিকুজি ছাড়াও হাজির ছিলেন শ্রীমতি ওতা, তার মেয়ে ফুমিকো আর য়ুকিকো ইনামুরা নামের এক কিশোরী যার কাছে থাকা এক কাপড়ে রয়েছে সহস্র সারসের ছবি। এই চা মিলনী আর সহস্র সারস প্রসঙ্গ দুটি এই উপন্যাসের দুটি কেন্দ্রীয় বিষয়, প্রধান চরিত্রদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কাওয়াবাতা উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চিকাকোকে অন্ধকারের মানুষ হিসেবে দেখান চা মিলনীকে কেন্দ্র করে।  যে উৎসবটি পবিত্রতা ও ঐতিহ্যের বার্তাবাহী তাকে চিকাকো কলুষিত করে নিজের হীন ও ব্যক্তিগত মনোবাসনা পূরণের মাধ্যম করে তোলার মধ্যে দিয়ে। এমনকী চা মিলনীর রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে সে এমনভাবে চা পরিবেশন করে যে মনে হয় কোনও রেস্তোরাতে যেন কোনও  খদ্দেরকে পানীয় দেওয়া হচ্ছে। চা মিলনীর সূক্ষ্ম নিয়মনীতিকে সে বারবার ভাঙে।

চা মিলনীর এই বিকৃতি শুধু চিকাকোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগৎকে তুলে ধরার জন্যই এই উপন্যাসে আসে নি, এর মধ্যে দিয়ে জাপানের ঐতিহ্য পরম্পরার লঘুত্বের বিপদটি কাওয়াবাতা আভাসিত করতে চান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ পরাজয়ের পর জাপান যখন কার্যত মার্কিন নির্দেশিকার বেড়াজালে বন্দী, তখন সেখানে অন্যান্য নানা বিপদের সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলার সংকটটি দেখা দেয়। প্রায় একশো বছর আগে মেইজি যুগে পশ্চিমের সঙ্গে যে মেলামেশা শুরু হয়েছিল তা অনেকটাই ছিল জাপানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধির নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে পশ্চিমী হাওয়া এল তা হয়ে দাঁড়াল বাধ্যতামূলক ও নিয়ন্ত্রণবিহীন। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্কট কাওয়াবাতা অনুভব করলেন আর দেখালেন চা মিলনীর মতো একটি ঐতিহ্যশালী দার্শনিক রীতিনীতি সম্মত জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক দিকের অবনমনের মধ্যে দিয়ে। এই উপন্যাসের বরিষ্ঠ প্রজন্মটি যত্ন সহকারে চা মিলনীর রীতিনীতি শিখেছে ও নিয়মিত চা মিলনীর আয়োজন করেছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম এই চা মিলনীর নিয়মগুলি শেখে নি ও এই সম্পর্কে যথেষ্ট উৎসাহীও তারা নয়। নবীন প্রজন্মের যে চরিত্রটি যত্ন করে চা মিলনীর রীতিনীতি শেখে সেই য়ুকিকো এই উপন্যাসে আসে প্রায় এক প্রতীকের মতো। তার সঙ্গের বস্ত্রখণ্ডটিতে রয়েছে সহস্র সারসের ছবি, যা জাপানের লোককথায় সমস্যা কাটিয়ে ওঠার শুভ ইঙ্গিৎ। য়ুকিকো তার নীরব উপস্থিতি দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে শুভবোধের সম্পর্কটিকে বাঙ্ময় করে তোলে। 

চা মিলনীর সঙ্কটের কথা আসে হাজার সারস উপন্যাসে আর ইন্দ্রধনু উপন্যাসে আসে জাপানের ঐতিহ্যমন্ডিত নাট্যধারার সঙ্কটের কথা। একদিকে যখন সিনেমা হলের সামনে লম্বা লাইন তখন নাটকের শোয়ে দর্শক হয় না। নাটক শুরুর আগে কর্তাব্যক্তিরা প্রেক্ষাগৃহের সামনে হাজির হয়ে আশেপাশের জনসমাজের কাছে কাতর আবেদন জানান, যেন তাঁরা টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে। কিন্তু সে আবেদন শেষমেষ নিস্ফল প্রতিপন্ন হয়৷ দিনের পর দিন শূন্য প্রেক্ষাগৃহে কোনও রকমে টিঁকে থাকে ঐতিহ্যের ক্ষীণ করুণ ধারাটি। কাওয়াবাতা গোটা উপন্যাসজুড়ে একদিকে যেমন সঙ্কটের নানা ছবি তৈরি করেন, তেমনি তার ফাঁকে ফাঁকেই উঁকি দিয়ে যায় প্রেম ভালোবাসার মায়াবী মুহূর্তগুলি।

পঞ্চম অধ্যায়ের শুরুতেই পাই নাটকের দলের দর্শক সঙ্কটের একটা স্পষ্ট ছবি। -

“রঙ্গালয়ের প্রধান ফটকের মাথায় ছিলো একটা চওড়া কার্নিস। মঞ্চ থেকে চারজন অভিনেতা বেরিয়ে এসে সেই কার্নিসের ওপরে কোনওরকমে উঠে পড়লো। তাদের মধ্যে যাকে বেশ নায়কের মতো দেখাচ্ছিলো, সে সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করে দিলে। তার বক্তব্য, আজও নাটক দেখানর জন্য যথারীতি মঞ্চের পর্দা তোলা হয়েছে, কিন্তু দর্শকের সংখ্যা এতই কম যে, নাটক শুরু করাই সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে অভিনয়ের পোশাকেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনারা যাঁরা নাটক ভালোবাসেন তাঁদের কাছে আমরা কাতরভাবে সহানুভূতি প্রার্থণা করছি। আপনাদের সাহায্য আর সহানুভূতি না পেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের মঞ্চের ভেতরেই বসে বসে মরতে হবে।”

এই সঙ্কটের ছবিটি তুলে ধরার পর গল্পকথক নিজ মন্তব্যে পাঠককে জানান, “শ্রমিক ধর্মঘট বা স্বাধীনতা সংগ্রামে দলের নেতারা যেভাবে বক্তৃতা দিয়ে থাকে, ওদের কথা বলার ধরনধারণও ছিল অনেকটা সেই রকম। বক্তৃতার শেষে রাস্তার লোকজনকে আকৃষ্ট করার জন্য তারা সেই কার্নিসের ওপর দাঁড়িয়েই তাদের নিজেদের কিছু কিছু খেলা দেখালে।

একেবারে চৌরাস্তার মোড়ের ওপর এই রঙ্গালয়। চারটি রাস্তার সব কটিই অবশ্য অত্যন্ত সরু সরু। নাট্যঘরের ফটকের সামনে এই বিনে পয়সার খেলা দেখতে বেশ ভিড় জমে গেছে। ফটকের ঠিক উলটো দিকেই একটা রেস্টুরেন্ট, গরীব লোকেরা এখানে এসে ভাত খায়। এই রেস্টুরেন্টের চাকরানিগুলোও খেলা দেখতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।

গ্রীষ্মকালে এসব পাড়ায় খুব কম লোকই থিয়েটার দেখতে আসে। এ সময় নাটকের বাজারে যে কতখানি মন্দা চলে তারই এক বিষণ্ণ উদাহরণ হিসেবে এই রঙ্গালয়ের ঘটনাটি পরের দিনের খবরের কাগজে রীতিমতো বড়ো আকারে ছাপা হলো। নাটকের লোকেরা বাইরে এসে খেলা দেখিয়েও কিন্তু কোনও দর্শক সংগ্রহ করতে পারলো না। অবস্থা বুঝে দলের লোকেরা আস্তে আস্তে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। কেবল কতকগুলো পুরনো বিজ্ঞাপনের ছবি নাট্যশালার বাইরের দেওয়ালে ঝুলে রইলো। আসাকসা এলাকায় আমোদপ্রমোদের জন্য যেখানে প্রতি দিন বহু লোক জমা হয়, তেমন জায়গায় দাঁড়িয়ে এই পুরনো জীর্ণ বিজ্ঞাপনের ছবিগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই নাট্যশালার দশা কেমন শেষ হয়ে এসেছে।”

রানকো নাটকের সঙ্কটগ্রস্থ দিনকালের প্রতিনিধি। সে এক সময়ে নামকরা অভিনেত্রী ছিল, কিন্তু সেই সব সোনালি দিন অনেককালই অতীত। এখন তাঁর অভিনয় দেখতে কেউ আসে না। সে হঠাৎই একদিন নিসিবায়াসির থিয়েটার ছেড়ে চলে যায় এক ভ্রাম্যমাণ দলের সঙ্গে নাটক করতে। কিন্তু তার উচ্চাশা ব্যর্থ হয়। সে সেই ভ্রাম্যমাণ দল ছেড়ে আবার ফিরে আসতে বাধ্য শহরে, যদিও পুরনো দলে যোগ দেয় না। তিক্ত মনে ও ক্রুর দৃষ্টিতে সে কেবল সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। যে কিমুরাকে সে এই দলে এনেছিল সে এখানে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, তার ঘরেই থাকছে অন্য এক নারী গিনকোর সঙ্গে। তার অতীত আর বর্তমান শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না, থিয়েটারের ওঠাপড়ার কথাও বলে।

এই আসাকসা এলাকাতেই শিল্পী হিসেবে রানকোর একদিন বেশ নামডাক ছিল, সকলেই খাতির যত্ন করতো। কিন্তু দর্শকমহলে আজ আর তার কোনও চাহিদাই নেই। এর ওপর শহরের বাইরে চলে যাওয়ায় তার কথা সকলে প্রায় ভুলেই গেছে। প্রকৃতির ঋতু বদলের মতোই কখন যে জনপ্রিয়তা আসে আর চলে যায় – বোঝবার উপায় নেই। বেশ কিছু দিন পর টোকিওয় ফিরে এসে রানকো যখন পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করতে কিংবা কোনও কাজের সন্ধানে এর ওর কাছে যায়, তখন তাকে নিতান্ত অসহায় মনে হতে থাকে। 

কাওয়াবাতা নিজেই তাঁর "দ্য মাস্টার অব গো" (১৯৫১) উপন্যাসকে নিজের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে মনে করতেন। এটি ১৯৩৮ সালের এক বিখ্যাত গো খেলার প্রতিযোগিতা নিয়ে আধা-কল্পিত বর্ণনা, যেখানে কাওয়াবাতা নিজে Mainichi Shimbun-এর পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে রিপোর্ট করেন। এটি মাস্টার শুসাই-এর শেষ খেলা ছিল, যেখানে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী মিনোরু কিতানির কাছে পরাজিত হন এবং এক বছরের মধ্যেই মারা যান। উপন্যাসটি কেবলমাত্র একটি প্রতিযোগিতার বর্ণনা নয়, বরং অনেকে একে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতীক হিসেবেও ব্যাখ্যা করেন।

কাওয়াবাতা অনেক গল্প অসমাপ্ত রেখেছেন, যা পাঠক বা সমালোচকদের মাঝে হতাশাও তৈরি করেছে। কিন্তু এটিও ছিল তাঁর ইচ্ছাকৃত — অর্থপূর্ণ, সংবেদনশীল বা নৈতিক পরিণতির পরিবর্তে, ঘটনাগুলোর খণ্ডচিত্র উপস্থাপন করাকেই তিনি বেশি মূল্য দিতেন। তিনি তাঁর সাহিত্যশৈলীকে জাপানি ঐতিহ্যবাহী হাইকু কবিতার সঙ্গে তুলনা করতেন আর বিশ্বাস রাখতেন স্বল্পক্ষণের ও অপূর্ণতার নান্দনিকতা দর্শন ‘ওয়াবি-সাবি’র ওপর।

কল্পসাহিত্যের পাশাপাশি কাওয়াবাতা সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেন, বিশেষত Mainichi Shimbun-এ। যদিও তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক উন্মাদনায় অংশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন, তবুও যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি। তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন যে তাঁর শৈশবে পরিবারের সকল সদস্যের মৃত্যু এবং যুদ্ধই তাঁর লেখার প্রধান প্রভাবক ছিল। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে তিনি কেবলমাত্র শোকগাথাই লিখতে পারবেন। অবশ্য অনেক সমালোচক মনে করেন তাঁর যুদ্ধ-পূর্ব ও যুদ্ধ-পরবর্তী লেখায় মূলভাবগত তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। তাঁর ইজু নর্তকী বা ইকিগুনি (বরফের দেশ) ও যে বিষণ্ণতার ছায়ামাখা, তা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই।

১৯৪৮ থেকে ১৯৬৫ - দীর্ঘ সতেরো বছর জাপানের লেখক সংস্থার সভাপতি ছিলেন কাওয়াবাত। এই সময় জাপানের সাহিত্যকে ইংরাজী সহ নানা ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। 

১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন কাওয়াবাতা। অগ্রজ সাহিত্যিক তানিজাকির নাম বেশ কয়েকবার এসেছিল সম্ভাব্য নোবেল প্রাপকের তালিকায়। এসেছিল অনুজ সাহিত্যিক ও বন্ধু মিশিমার নামও। কিন্তু তানিজাকি বা মিশিমা নয়, রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় এশিয়বাসী হিসেবে জাপানে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার এল কাওয়াবাতার হাত ধরে। নোবেল বক্তৃতায় কাওয়াবাতা নিজের সাহিত্য নিয়ে তেমন কিছু  না বলে বললেন জাপানের সাহিত্য ঐতিহ্য, দৃষ্টিকোণ আর দর্শন নিয়ে। 

নোবেল পুরস্কার পাবার চার বছরের মধ্যেই কাওয়াবাতা চলে গেলেন। সেটা ১৯৭২ সাল। গ্যাস ব্যবহার করে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেছেন। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা (তিনি পার্কিনসনের রোগে আক্রান্ত ছিলেন) এবং অনুজ বন্ধু ইউকিও মিশিমার ১৯৭০ সালের আত্মহত্যা জনিত মানসিক ধাক্কা তাঁকে এত পীড়িত করেছিল যে তিনি নাকী বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর জাপানি জীবনীকার তাকেও ওকুনো বলেছেন যে কাওয়াবাতা মিশিমার আত্মহত্যার পর থেকে একটানা দুঃস্বপ্নে ভুগেছেন এবং তাঁর মন থেকে মিশিমার প্রেতচ্ছায়া দূর হয়নি। জীবনের শেষ দিকে মানসিকভাবে গভীর হতাশায় ভোগা কাওয়াবাতা বন্ধুদের প্রায়ই বলতেন তাঁর অনেকসময়েই মনে হয়  দূরযাত্রাকালে তাঁর বিমানটি ভেঙে পড়বে।

তবে মিশিমার মতো কাওয়াবাতা কোনো আত্মহত্যার চিঠি রেখে যাননি। ফলে, তাঁর মৃত্যুর পেছনের আসল উদ্দেশ্য আজও অস্পষ্ট। তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধু, এমনকী তাঁর স্ত্রীও মনে করেন কাওয়াবাতার মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, একটি দুর্ঘটনাই ছিল। কেউ কেউ বলেছেন কাওয়াবাতা সম্ভবত স্নানের সময় ভুলবশত জলের জায়গায় গ্যাসের ট্যাপ খুলে দিয়েছিলেন আর সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়। তবে যাঁরা কাওয়াবাতার নোবেল বক্তৃতা পড়বেন তাঁরা সেখানে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবারই পাবেন। প্রকৃতির কথা, জেন বৌদ্ধধর্মের কথা যেমন কাওয়াবাতার নোবেল বক্তৃতায় এসেছিল, তেমনি এসেছিল আকুতাগাওয়া সহ যে সব বিখ্যাত জাপানী সাহিত্যিকরা আত্মহত্যা করেছিলেন তাঁদের কথা। সন্ত ইক্কিয়ুর কথাও তিনি এখানে এনেছিলেন যিনি শুধু দুবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন তাই নয়, এক বিখ্যাত হয়ে যাওয়া মন্তব্যে বলেছিলেন "যে কোনও চিন্তাশীল মানুষকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে আত্মহত্যার কথা ভাবতেই হবে। 

বন্ধু ও অনুজ লেখক মিশিমার আত্মহত্যা ছিল তাঁর জীবনের মতোই রাজনৈতিক। কাওয়াবাতা যদি আত্মহত্যা করেও থাকেন সেটি তাঁর শীতল একক বিচ্ছিন্ন জীবনের গহন ভাবনা থেকেই এসে থাকবে।