কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির নোবেল বক্তৃতা

কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির নোবেল বক্তৃতাটি মূল জাপানী ভাষা থেকে বাংলায় তরজমা করেছেন বিশিষ্ট অধ্যাপক, জাপানী ভাষার শিক্ষক ও অনুবাদক শ্রীযুক্ত অভিজিৎ মুখার্জী। অন্যস্বরের পাঠকদের জন্য তিনি একটি প্রাককথনও লিখে দিয়েছেন আমাদের অনুরোধে। সেটি পড়ে তারপর মূল অনুবাদটি পড়লে পাঠকের সুবিধে হবে বলে মনে হয়।

অনুবাদকের প্রাককথন -

সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকটা থেকে শুরু করে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের একটা সময় পর্যন্ত জাপান সমগ্র বিশ্বের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো। জওহরলাল নেহরু, ওঁর Glimpses of World History বইতেও এই বিচ্ছিন্নতার কথা লিখেছেন।

এই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে ১৮৫৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ কমোডর পেরির অধীনে যুদ্ধজাহাজের এক বাহিনীর শাসানির কাছে নতিস্বীকার করে জাপান পুনরায় বিশ্বের বাণিজ্যিক মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়, সঙ্গে তার রাষ্ট্রনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোরও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। দেশরক্ষার ভার সামুরাইদের পরিবর্তে এবার ন্যস্ত হয় পুরোদস্তুর এক মিলিটারি ব্যবস্থার হাতে। ‘মিলিটারিস্ট’ এই শাসনতন্ত্রের রাষ্ট্রনীতিও দ্রুতই সর্বতোভাবে বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে সম্পদ আহরণে প্রবল উদ্যমী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বন্যার জলের মতো প্রবেশ করতে থাকে সমাজব্যবস্থায়, জীবনযাত্রায়, স্থাপত্যে, শিল্পে-সাহিত্যে পশ্চিমী প্রভাব।

  রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথমবার জাপানভ্রমণে গিয়ে, তাঁর ভাষণে, সেদেশের মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিলেন নিজেদের ঐতিহ্যে অটল থাকার। 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম আপনারা আপনাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট সহকারে উপলব্ধি করেছেন, চিন্তা করেছেন, কর্ম সম্পাদন করেছেন, আনন্দ উপভোগ করেছেন এবং উপাসনা করেছেন; সেসবকে পুরনো বসনের মতো পরিত্যাগ করে যাওয়া সম্ভবই নয়... আপনাদের একটা নিজস্ব জীবনদর্শন ছিলো, এবং জীবনধারণ যে একটা আর্ট, বিকাশের নানা পথে তার একটা পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলেন। এই সবকিছুই বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাদের প্রয়োগের অপেক্ষায় আছে...

মানবসভ্যতার মহাসম্মিলনে যে সমস্ত প্রশ্ন আজ ইউরোপ পেশ করেছে, এশিয়া আপনাদের কণ্ঠে তার উত্তর যোগাবে। আপনাদের এই ভূখণ্ডে সাধিত হবে সেইসব পরীক্ষানিরীক্ষা যার মাধ্যমে প্রাচ্য পালটে দেবে আধুনিক সভ্যতার নানা দিককে, আর তাতে প্রতিষ্ঠা করবে প্রাণ...”

তিনি স্পষ্টতই জাপানকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। জাপানি সাহিত্যে সেই প্রেরণাটির উন্মেষ ঘটান নাৎসুমে সোওসেকি, এবং সেই ইস্তক জুনইচিরো তানিজাকি, তার পরবর্তী কালে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইউকিও মিশিমা ইত্যাদি ক্ষমতাধর সাহিত্যিকেরা সেই পথ অনুসরণ করে সাহিত্যের মাধ্যমে জাতীয় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। এই ধারাটির কথা সম্ভবত খুব পরিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথের গোচরে আনা হয়নি। এটির সমান্তরাল ও প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিটারিস্ট প্রবণতাকেই ‘জাতীয়তাবাদী’ আখ্যা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নানা লেখায় সমালোচনা করেছেন, এবং তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে বৈ কি!

  যাই হোক, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক প্রেরণা ও অনভিপ্রেত পশ্চিমী প্রভাবের শক্তিবৃদ্ধির মধ্যে সংঘাত বিংশ শতকের জাপানি গদ্যসাহিত্যে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ রেখে যায়, তার মুখ্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার সেমবাজুরু (Thousand Cranes, 1952), মেইজিন (The Master of Go, 1954), ইয়ামা-নো-ওতো (The Sound of Mountain, 1954), উৎসুকুশিসা-তো-কানাশিমি-তো (Beauty and Sadness, 1965) ইত্যাদি উপন্যাসগুলোর মধ্যে।

 ১৯৬৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষ্যে সারা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের কাছে চেতনাগতভাবে নিজের অবস্থানটি পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আসে কাওয়াবাতার কাছে। যে গভীর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে সেই সুযোগের উপযুক্ত সদ্ব্যবহারের প্রয়াস পেয়েছিলেন ঋষিপ্রতিম এই সাহিত্যস্রষ্টা, তার পরিচয় নোবেল ভাষণের এই বাংলা অনুবাদটাতে খানিক অন্তত পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করছি। 

 

অপরূপা জাপান ও সেখানকার এই আমি 

কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি  

 

বসন্ত মানেই ফুল, গ্রীষ্মে কোকিল, শরতের চাঁদ, শীতে  তো কেবল তুষার, ঠাণ্ডা হিম

জেন সাধক দোওগেন জেনজি-র(১২০০ – ১২৫৩) ‘হোনরাই মেনমোকু’ নামের এই কবিতাটা, আর সেই সঙ্গে,

মেঘ থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে সঙ্গ দেয় শীতের চাঁদ, শরীরে বাতাস এনে পৌঁছে দেয় তুষারের হিম

বৌদ্ধ যাজক, সন্ত মিয়োউয়ে-র (১১৭৩ – ১২৩২) এই কবিতাটা আমি লিখে দিই, কেউ কখনো আমার নিজের হস্তাক্ষরে কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করলে।

মিয়োউয়ের কবিতাটার এমনই বিশদ ও দীর্ঘ মুখবন্ধ রয়েছে যে সেটাকে ‘উতা-মোনোগাতারি’ অর্থাৎ কবিতা বৃত্তান্তই বলা চলে, আর সেটির মাধ্যমে এর অন্তর্নিহিত অর্থটা পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

১২২৪ সালের দ্বাদশ মাসের দ্বাদশ দিনে, রাত্রিবেলা আকাশে মেঘ করে চাঁদ অন্ধকারে ঢেকে গেছে, আমি পুষ্প-প্রাসাদে ঢুকে ধ্যানে বসলাম। যখন মাঝরাত হয়ে এসেছে, রাতের টহলদারি হয়ে যেতেই আমি সেই শিখরস্থিত কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে নিচের কক্ষে নেমে এসেছি, এই সময়, চাঁদ মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, তুষারের ওপর তার আলো ঠিকরে পড়ছিল। উপত্যকায় নেকড়ের রোল শুনেও এতটুকু ভয় নেই, চাঁদ আমার সঙ্গে আছে না! নিচের কক্ষে ঢুকে পড়ার পরে আবার যখন বেরিয়ে এলাম, দেখি চাঁদ আবার মেঘের পিছনে চলে গেছে। তখনও সে  আড়ালে, শেষরাতের ঘন্টাধ্বনি কানে যেতেই আমি যখন আবার শিখরস্থিত কক্ষে উঠে আসছি, মেঘ থেকে বেরিয়ে চাঁদ আবার উল্টোদিক থেকে এসে দাঁড়ালো। ওপরে পৌঁছে যখন ধ্যানের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, চাঁদ আবার মেঘের পিছনে ধেয়ে গিয়ে ওপাশের চূড়োর আড়ালে লুকোচ্ছিল, দেখে মনে হবে যেন কারুকে জানতে না দিয়ে চাঁদ আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে।  

এরপরেই রয়েছে, যে কবিতাটার কথা একটু আগে বললাম। আর তারপর আসছে,

পাহাড়ের ওধারে চাঁদ হেলে যাচ্ছে দেখে নিয়ে, শিখরের ধ্যানকক্ষে যাওয়ার সময়

পাহাড়ের ওধারে আমিও চলে যাব, চাঁদও যাবে, রাতের পর রাত দুজনে সঙ্গ দেব দুজনকে।

আবার অন্য একদিন, মিয়োউয়ে হয়তো সেই ধ্যানকক্ষে একান্তে কাটিয়েছিলেন, কিংবা ভোর হওয়ার আগেই আবার সেখানে গিয়েছিলেন,

ধ্যানের মধ্যে এক অবকাশে চোখ খুলে দেখি জানালা দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের কিরণ প্রবেশ করে এসেছে। আমার যেখানে যেখানে অন্ধকার সেখানে দৃষ্টিপাত করে, চাঁদের আলো ঢুকে এসে মনে হচ্ছে যেন হৃদয়কে নির্মল করে তুলেছে। যে সেই নির্মল হৃদয়ের আনাচে কানাচে রশ্মিপাত করে আমায় আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে, সে তো নিঃসন্দেহে চাঁদ।

সাইগিয়োকে যেমন বলা হত চেরিফুলের কবি, সেরকমই মিয়োউয়েকে অনেকেই বলত “চাঁদের কবি”।

আলো আলো আর আলো আলো আলো আরও আলো আলো এবং আলো আলো আলো ও আলো আলো এই চাঁদ

এইভাবে স্রেফ আবেগাপ্লুত স্বরে টানা বলে যাওয়া একটি অবোধ কবিতা তৈরি হল বটে, মাঝরাত থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ের তিনটে ‘শীতের চাঁদ’ নিয়ে কবিতা লিখলেও, সেই যে সাইগিয়ো বলেছিলেন, “কবিতা লিখে বসি বটে কিন্তু কবিতা ভেবে নয়”, সেরকমই রুচির দিক দিয়ে শিষ্ট ও সৎ থেকে চাঁদের সঙ্গে আলাপের ভাষা ও কথা, যথারীতি সেই ৩১ সিলেবলে, যেটাকে বলা যেতে পারত ‘চাঁদের সঙ্গে সখ্য’, তারচেয়েও যেন ঘনিষ্ট কেউ হিসেবে চাঁদকে দেখে দেখে নিজেই চাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া, চাঁদেরও যেন আমায় দেখে দেখে আমার সঙ্গে একাত্ম, প্রকৃতিতে নিমগ্ন হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া। ভোরের আলো ফোটার আগের অন্ধকার ধ্যানকক্ষে বসে ভাবুক সাধকের ‘নির্মল হৃদয়ের’ আলো-কে যে উজ্জ্বল চাঁদ নিজেরই আলো বলে ভাববে, সেটাই প্রত্যাশিত। 

“আমরা দুজনেই শীতের চাঁদ” এই কবিতাটাও দীর্ঘ উপক্রমণিকা সহকারে ব্যাখ্যা করার মত করে মিয়োউয়ে যে কবিতায় পাহাড়ে ধ্যানকক্ষে প্রবেশ করে ধর্ম ও দর্শনের ভাবনায় মগ্ন মন, আর চাঁদকে সূক্ষ্মভাবে যুৎসইরকম মিশিয়ে দিয়েছেন, আর আমি যে সেটার সাহায্য নিয়ে এইভাবে লিখতে পারছি সেটা সত্যিই মনে বড় আনন্দ দিচ্ছে। যে কবিতার প্রতি দুর্বলতা আছে সেটা নিয়ে যে লিখতে পেলাম। চাঁদ মেঘের ভেতর একবার ঢুকে যাচ্ছে, একবার বেরিয়ে আসছে, ধ্যানকক্ষের যাওয়া আসার সময় পায়ের নিচের জমি আলোকিত করে তুলছে, নেকড়ের ডাকেও মনে এতটুকু ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে না এমনই “শীতের চাঁদ”, বাতাসও আমাকে বিদ্ধ করছে না, তুষারও বিঁধছে না, চাঁদ, তোমার শীত করছে না? প্রকৃতি আর মানুষকে নিয়ে এমন উষ্ণ, গভীর, অন্তরঙ্গ একখানা অতি প্রিয় কবিতা, একান্তই নম্র ও সদাশয় জাপানিদের হৃদয়ের কবিতা, এটা আমি লোকেদের লিখে দিই। বত্তিচেল্লির ওপর গবেষণা জন্য সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের প্রাচীন ও বর্তমান শিল্পকলার ওপর বিশেষজ্ঞ, ডঃ ইয়াশিরো ইউকিও একটু কাব্যিকভাবে জাপানি শিল্পকলার একটি বিশেষ দিককে মোটের ওপর এই বলে ব্যক্ত করেছেন, “তুষার, চাঁদ আর ফুল, বন্ধুর কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ায় এরাই”। তুষারের সৌন্দর্য দেখে, চাঁদের সৌন্দর্য দেখে, ফুলের সৌন্দর্য দেখে, অর্থাৎ কিনা চারটি ঋতুর বিভিন্ন সময়ের সৌন্দর্য দেখে আমরা নিজেরা অভিভূত হয়ে জেগে উঠি, কপালগুণে সৌন্দর্যের দাক্ষিণ্য পেয়ে কেবল অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কথা মনে পড়ে, সেই আনন্দ তাদের সাহচর্যে উপভোগ করার বাসনা জাগে। সৌন্দর্য যে আবেগ জাগিয়ে তোলে তাতে স্মৃতিতে রেখে দেওয়া পুরনো বন্ধুর প্রতি টান আরো জোরালো হয়ে মাথাচাড়া দেয়। এখানে ‘বন্ধু’ বলতে আরেকটু ব্যাপক অর্থে ‘মানুষ’ বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। ঋতুপ্রবাহের বিভিন্ন সময়ের এইসব সৌন্দর্য, ‘তুষার, চাঁদ, ফুল’, এদের কথা ভাষায় যখন ফুটে উঠেছে, জাপানের ক্ষেত্রে, তার মধ্যেই এসেছে পাহাড়, নদী, ঘাস, বৃক্ষ, সমগ্র সৃষ্টি, প্রকৃতি, সবই। তারসঙ্গে মানুষী আবেগও। সৌন্দর্যকে কথায় ফুটিয়ে তোলার একটা ঐতিহ্য রয়ে গেছে। আর জাপানের যে চা-পান উৎসব, তারও ভিত্তিতে, একেবারে কেন্দ্রেই রয়েছে এই ভাবটা, ‘তুষার, চাঁদ আর ফুল দেখলেই সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে সঙ্গীদের কথা’। ভাল সময়ে ভাল সঙ্গীরা একত্র হয়ে একটা প্রীতিকর মিলনোৎসব, এটাই হল চা-পান উৎসবের ‘সম্মিলিত অনুভূতি’। এখানে বলে রাখি, আমার যে উপন্যাসটা, সেমবাজুরু (সহস্র সারস), সেটা পড়ে জাপানের চা-পান উৎসবের মর্মের ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা ওতে লিখেছি বলে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে, বরং উলটো কথাই বলা হয়েছে লেখাটায়, আজকের সমাজে চা-পান উৎসবের যে রুচিহীন স্থূলরূপ, সেটার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছি, সংশয় ব্যক্ত করেছি, সতর্ক করেছি।

 বসন্ত মানেই ফুল, গ্রীষ্মে কোকিল, শরতের চাঁদ, শীতে তো কেবল তুষার, ঠাণ্ডা হিম

দোওগেনের এই কবিতাটাও চার ঋতুর সৌন্দর্যের কবিতা। চিরটাকাল জাপানিরা বসন্তে, গ্রীষ্মে, শরতে, শীতে, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর প্রতিনিধিস্বরূপ যেগুলোকে সমাদর করে এসেছে, সেই চারটেকেই খুব সাদামাটাভাবে পরপর সাজিয়ে, নেহাতই বহুব্যবহারে গতানুগতিক, বিশেষত্বহীন কিছু বৈ আর কিছু নয় বলে কেউ ভাবলে ভাবতেই পারে, বলতেই পারে যে কবিতাটা মোটেই কবিতা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এরসঙ্গে মিল আছে এমন একটা কবিতা, অন্য একজন প্রাচীন কবি, সাধক রিয়োকান (১৭৫৮ – ১৮৩১)যা মৃত্যুশয্যায় লিখেছিলেন :

স্মরণে রাখার জন্য কিছু রেখে গেলে, সে শুধু বসন্তে ফুল, পাহাড়ি কোকিল আর শরতে রক্তিম বৃক্ষপত্র।  

এই কবিতাটাতেও দোওগেনের কবিতার মতই সাধারণ সব জিনিস, সাধারণ কথায়, কোনও দ্বিধা না করে, বরং বলব স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে একের পর এক যুক্ত করে জাপানের প্রকৃত স্বরূপটিকে পৌঁছে দিচ্ছে। তার ওপর কবিতাটা রিয়োকান মৃত্যুশয্যায় লিখেছিলেন।

 দীর্ঘ কুয়াশাচ্ছন্ন দিন শিশুদের সাথে বল হাতে খেলে কাটালাম
 বাতাস নির্মল, চাঁদ উজ্জ্বল, এসো তবে নেচে ভোর করে দিই রাত, প্রৌঢ়ত্বের বাকিটুকু
 সমাজে মিশি না আমি এমন তো নয়, তবে একাকি আমোদেই যেন স্ফূর্তি আমার।

এরকম সব কবিতা হৃদয়ে ধারণ করে, তৃণাচ্ছাদিত কুটিরে বাস করে, জীর্ণ পোশাক পরিধান করে, মেঠোপথে এদিক ওদিক পায়ে হেঁটে ঘোরাঘুরি করে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে, চাষীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, ধর্ম আর সাহিত্যের গভীর ব্যাপার স্যাপার নিয়ে দুরূহ সব কথা না বলে, কথায় ও আচরণে নিখুঁতভাবে “প্রসন্ন মুখ ও সহৃদয় বাচন” নীতি অনুসরণ করে, তারপরেও কবিতা লিখে এবং ক্যালিগ্রাফি করে আর তার পাশাপাশি এদো-যুগের শেষ পর্যায়ে, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকটা থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকটা পর্যন্ত, জাপানের হালফিলের প্রথার থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে, সাবেক কালের সূক্ষ্মতাকে আমাদের দৃষ্টিগোচর করে তুলে, এমনকি আজকের জাপানেও সেই লিখন প্রণালী ও কাব্যবৈশিষ্টকে বিপুলভাবে সমাদৃত করে তুলেছেন এই রিয়োকান। ওঁর এই মৃত্যুশয্যার কবিতাতে কিন্তু এমন কিছু নেই যার মাধ্যমে নিজের স্মৃতিমূলক কিছু রেখে যাওয়া যেত, কিছু থেকে যাক এমন কথা ওঁর ভাবনাতেই আসেনি। এই কবিতার থেকে মনে হচ্ছে, উনি প্রয়াত হওয়ার পরেও যে প্রকৃতি ততটাই অপরূপ থেকে যাবে, কেবল এটুকুই যেন এই পৃথিবীতে উনি নিজের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়ে যাচ্ছেন। কবিতাটায় যেমন জাপানের সাবেক কালের হৃদয়ানুভূতি সংরক্ষিত হয়ে আছে, সঙ্গে রিয়োকানের ধর্মপ্রাণ মনও যেন বাঙ্‌ময় হয়ে উঠেছে।

 সেই কবে থেকে তার আসার অপেক্ষায় থেকে, এবার দেখা হয়ে গিয়ে আর কিছু ভাবতে পারছি না।

এরকম প্রেমের কবিতাও লিখে, এটা আমার বেশ প্রিয় কবিতাও বটে, ভিমরতিতে ধরার মতো উনষাট বছর বয়েসে, ঠিক যে বয়েসে আমি নোবেল পুরস্কার পাচ্ছি সেই বয়েসে এসে রিয়োকান, উনত্রিশ বছর বয়েসের তরুণী এক যাজিকার সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়ে অতি মধুর প্রেমানুভূতিতে ধন্য হলেন। এক শাশ্বত নারীর সাক্ষাত পাওয়ার আনন্দের কবিতাও বটে, আবার বহু প্রতীক্ষার পর প্রেমাস্পদের আগমনের আনন্দে লেখা কবিতা হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়। “এবারে দেখা হয়ে গিয়ে আর কিছু ভাবতে পারছি না”— কথাটা অকপট সারল্যে পরিপূর্ণ।   

রিয়োকান চুয়াত্তর বছর বয়েসে প্রয়াত হলেন। আমার একটা উপন্যাসের নাম “তুষারের দেশ”, সেরকমই তুষারের দেশ এচিগো, এখনকার যেটা নিইগাতা জেলা, সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাইবেরিয়া থেকে হিমেল বাতাস জাপান সমুদ্র অতিক্রম করে এলে জাপান সমুদ্রের উপকূলবর্তী উত্তুরে যে প্রদেশ সেটার মুখোমুখি হয়, এটা সেই জায়গা। আমৃত্যু সেই তুষারের দেশেই কাটিয়ে দিলেন বটে, বার্দ্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে, বুঝলেন যে মৃত্যু নিকটেই, আর চেতনায় তখন সাতোরি-র (নির্বাণ) স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি, এই সাধক কবির অন্তিম সময়ের দৃষ্টিতে জীবনের শেষ কবিতায় তুষারের দেশের প্রকৃতি আরোই সুন্দর ঠেকেছিল বলেই আমি কল্পনা করি। আমার একটা লেখা আছে “অন্তিম সময়ের দৃষ্টি” নাম দিয়ে, এই “অন্তিম সময়ের দৃষ্টি” কথাটা আমি সংগ্রহ করেছিলাম আকুতাগাওয়া রিউনোসুকে-র (১৮৯২ – ১৯২৭) আত্মহত্যাকালীন লিখিত জবানবন্দী থেকে। সেই লিখিত জবানবন্দীর মধ্যে, আমাকে বিশেষ করে মুগ্ধ করা একটি শব্দবন্ধ এটি। “যাকে বলে বেঁচে থাকার মতো প্রাণশক্তি”, “জান্তব প্রাণশক্তি” “সম্ভবত ক্রমে ক্রমে খুইয়ে ফেলছি”।  

এ একেবারে বরফের মতই স্বচ্ছ যে আমি এখন বাস করছি এমন একটা পৃথিবীতে যা কিনা অস্বাভাবিক রকম স্পর্শকাতর। ... আমি যে কবে সাহস করে আত্মহনন করতে পারব সে নিয়ে সংশয় আছে। স্রেফ প্রকৃতিই এখন আমার কাছে এতটাই সুন্দর যা আগে কখনো মনে হয়নি। একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি এই ভালোবাসা আবার অন্যদিকে আত্মহননের ইচ্ছা, এই বৈপরীত্যে তুমি হয়তো হাসবে। কিন্তু প্রকৃতি্র সৌন্দর্য আমার এই অন্তিম সময়ের দৃষ্টিতে এত অপরূপ লাগছে বলেই এরকম হচ্ছে। 

১৯২৭ সালে পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসে আকুতাগাওয়া আত্মহত্যা করলেন। “অন্তিম সময়ের দৃষ্টিতে” নামে লেখাটায় আমি একথা লিখেছি, “যতই বলি না কেন, এই বর্তমান পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, আত্মহত্যা কখনোই সাতোরির লক্ষণ নয়। যত সদুদ্দেশ্যেই হোক না কেন, আত্মহত্যাকারী সিদ্ধির পর্যায় থেকে অনেক দূরেই”, আকুতাগাওয়া কিংবা দাজাইয়ের আত্মহত্যা প্রশংসা পাওয়ার মতোও নয়, সহানুভূতি পাওয়ার জিনিসও নয়। আমার আরেক বন্ধু, ইনিও অল্পবয়েসে মারা গিয়েছিলেন, জাপানের প্রথম সারির চিত্রকর একজন, যথারীতি ইনিও বহুবছর ধরে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, ‘অন্তিম সময়ের দৃষ্টি’-তে এঁর সম্বন্ধে লিখেছিলাম, “মৃত্যুর চেয়ে বড় আর্ট আর হয় না, মৃত্যুই তো আসল বেঁচে থাকা, এসব কথা তার মুখে লেগেই থাকত বলে শোনা যায়”। বৌদ্ধমন্দিরে জন্মেছিলেন, বৌদ্ধ শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করেছিলেন, মৃত্যু সম্বন্ধে এঁর দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমের মৃত্যু সম্বন্ধিত চিন্তাধারার চেয়ে পৃথক ছিল বলেই আমি ধরে নিয়েছিলাম। সম্ভবত “চিন্তাশীল মানুষমাত্রেই মৃত্যু নিয়ে ভাববেই”, আমার বিবেচনায় সেরকমই একজন হলেন, সেই যে সাধক, ইক্কিয়ু জেনজি (১৩৯৪ – ১৪৮১), ইনি দু’বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।

এখানে ইক্কিয়ুকে “সেই যে” বলে অভিহিত করলাম, কারণ, বাচ্চাদের কাহিনীর হাস্যরসিকতাময় বৌদ্ধ যাজক হিসেবে এই মানুষটিকে শিশুরাও চিনত। প্রাণখোলা অকুন্ঠ পাগলামোর কাহিনী চারিদিকে ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। “বাচ্চারা ওঁর কোলে উঠে দাড়িতে হাত বোলাতো, বনের পাখিরা এসে হাত থেকে খাবার খুঁটে খুঁটে খেয়ে যেত” এমনই ছিল ওঁর ব্যাপার-স্যাপার, অতীব নিষ্পাপ মনের এক ব্যক্তি। সহজেই অন্তরঙ্গ হয়ে পড়তেন, যেন সহৃদয় এক সন্ত, তবে কিনা আসলে কিন্তু সত্যিই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারবোধ ও গভীর চেতনা সম্পন্ন জেন সাধক ছিলেন। ইক্কিয়ু, যিনি সম্রাটের সন্তান বলেও কথিত আছে, মন্দিরে গিয়ে ঢুকেছিলেন ছ’বছর বয়েসে, অলীক প্রতিভাধর বালক কবি হিসেবে চমক লাগিয়ে দেওয়াকালীনই ধর্ম ও মনুষ্যজীবনের মূল ভিত্তি সম্পর্কে সংশয়পীড়িত হয়ে, “ঈশ্বর থাকলে আমাকে উদ্ধার করুন, আর ঈশ্বর না থাকলে আমাকে এই হ্রদের নিচে নিমজ্জিত করে মাছেদের উদরপূর্তি ঘটিয়ে দিন।”, এই বলে নিজের শরীরটাকে হ্রদের জলে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলেন, টেনে ধরে থামানো হয়েছিল। পরে একবার, ইক্কিয়ুর দাইতোকুজি মন্দিরের এক যাজক আত্মহত্যা করেছিলেন বলে বেশ কয়েকজনকে কারারুদ্ধ করা হলে, ইক্কিয়ু, তাঁরও কিছু দায় আছে এতে, এমত অনুভব করে “কাঁধে সেই গুরুভার” হেতু পাহাড়ে গিয়ে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মৃত্যুবরণ করবেন বলে মনস্থ করেন। সেইসব কবিতা একত্র করে নিজেই তার নাম দিয়েছিলেন, “উন্মত্ত মেঘের দল”, আর কবি হিসেবে নামও  নিয়েছিলেন, উন্মত্ত মেঘ। ‘উন্মত্ত মেঘের দল’ ও তার পরবর্তী সংকলনেও, জাপানের মধ্যযুগের চীনা কবিতা, বিশেষ করে জেন যাজকের কবিতার যে চরিত্র, তা বর্জন করে, পিলে চমকে দেওয়া সাহস দেখিয়ে লেখা কামনাজনিত আবেগের কবিতা, শয়নকক্ষের গোপন কেচ্ছা ইত্যাদিকে স্থান দিয়ে লেখা লালসার কবিতা, এইসব পাওয়া গেল। মাছ খেয়ে, সুরাপান করে, নারীসংসর্গ করে, বৌদ্ধ অনুশাসন, নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে, নিজেকে এসবের থেকে মুক্তি দিয়ে, ধর্মের তৎকালীন কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, সেইসময় দেশের ভিতরে যুদ্ধবিগ্রহে জনজীবনে নৈতিকতার যে বিপর্যয়, তার মধ্যে উনি মানুষের অস্তিত্ব, জীবনের যা কিছু সহজাত, প্রকৃতিগত তার পুনরুত্থান ও প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়েছিলেন সম্ভবত।

কিয়োতোর মুরাসাকিনো অঞ্চলের দাইতোকু মন্দির, যেখানে ইক্কিয়ু ছিলেন, এখনও চা-উৎসবের মূল মন্দির সেটি, ইক্কিয়ুর ক্যালিগ্রাফি সেখানে চা-উৎসব কক্ষের ছবি ঝোলানোর খোপে অমূল্য সংগ্রহ হিসেবে শোভা পাচ্ছে। আমার কাছেও ইক্কিয়ুর হস্তাক্ষর সম্বলিত এরকম দু’টি স্ক্রল আছে। 
“বুদ্ধের জগতে প্রবেশ করা সহজ, শয়তানের জগতে প্রবেশ দুরূহ”, এই পংক্তিটি তার একটাতে লেখা আছে। এই কথাটাতে আমি একেবারে মুগ্ধ বলে, নিজেও প্রায়শই কথাটা লিখে দিই। এর নানা অর্থই হতে পারে, তেমন কষ্ট করে ভাবলে সীমাহীন সংখ্যক অর্থ বেরোতে পারে, “বুদ্ধের জগতে প্রবেশ সহজ” কথাটার সঙ্গে “শয়তানের জগতে প্রবেশ দুরূহ” কথাটা জুড়ে দেওয়া হল, জেন সাধক ইক্কিয়ু এইভাবে আমার হৃদয় স্পর্শ করে গেলেন। একজন শিল্পী, যাঁর অভীষ্ট হচ্ছে সত্য, শিব এবং সুন্দর, তাঁরও বাঞ্ছিত হচ্ছে, “শয়তানের জগতে প্রবেশ দুরূহ”, তাঁর এই ভয়, তাঁর প্রার্থনায় সর্বক্ষণ আসা যাওয়া করা এই চিন্তা, একেবারে বাহ্যত প্রকাশ পাওয়া অথবা অধস্তলে লুক্কায়িত থাকা, শেষ অবধি এ একেবারে অনিবার্য নিয়তি। “শয়তানের জগৎ” না থাকলে “বুদ্ধের জগৎ”-ও নেই। দুর্বল মনের পক্ষে এ জিনিস গ্রহণ করা মুশকিল।

বুদ্ধের দেখা পেলে বুদ্ধকে হত্যা কর, পিতৃপুরুষের দেখা পেলে পিতৃপুরুষকে হত্যা কর

এক অতি সুপরিচিত জেন-বাক্য। ধর্মনির্দেশিত পথে নির্বাণের অভিলাষী আর স্বীয় সাধনায় নির্বাণের অভিলাষী, এই অনুযায়ী বৌদ্ধধর্মের নানা শাখাকে বিভাজিত করলে, অবশ্যই স্বীয় সাধনার জেন-শাখাটিতে এই ধরনের ভয়ানক কঠোর সব কথা আছে। ধর্মনির্দেশিত পথে নির্বাণের অভিলাষী ‘শিনশু’ শাখাটির শিনরান (১১৭৩ – ১২৬২) যে বলেছিলেন, “সৎব্যক্তির স্বর্গে পুনরুত্থান হবে। অসৎ-এরও সেটাই হবে, না জানি কত”, সেই কথাটাতে ইক্কিয়ুর এই “বুদ্ধের জগৎ” আর “শয়তানের জগৎ”-এর সঙ্গে ভাবগত মিল আছে, আবার মেলে না এমন ভাবও আছে। সেই শিনরানও বলেছেন, “আমি একজনও শিষ্য গ্রহণ করব না”। “পিতৃপুরুষের দেখা পেলে তাকে হত্যা কর” আর “একজনও শিষ্য গ্রহণ করব না”, এসব আবার আর্টের এক ভয়ানক কঠোর পরিণতি সম্ভবত। জেন সাধনায় মূর্তিপূজা নেই। জেন মন্দিরে বুদ্ধমূর্তি আছে বটে, অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের জায়গায়, উপবিষ্ট হয়ে ধ্যান করার হলঘরে কোনও বুদ্ধমূর্তি বা বুদ্ধের চিত্র নেই, কোনও সূত্রও লেখা থাকে না, মুদিত চক্ষে দীর্ঘ সময় নির্বাক, স্থির বসে থাকতে হয়। তারপর চিন্তা-রহিত ধারণা-রহিত একটা অবস্থায় প্রবেশ করতে হয়। “আমি”-কে খুইয়ে শূন্যতায় পর্যবসিত হতে হয়। এই “শূন্যতা” কিন্তু পশ্চিমী রিক্ততা নয়, বরং তার বিপরীত, যেকোনো অবয়ব বা ফর্ম নির্বিঘ্নে সঞ্চারিত হতে পারে এমন শূন্য পরিসর, দিগন্তহীন অসীম, ভাবটা হচ্ছে অন্তহীন যোগানের মহাবিশ্বের। জেন-এর পথেও শিষ্যকে পথপ্রদর্শন করে, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়ে প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থের পাঠ অবশ্যই দেওয়া হয়, তবু ধ্যানের কর্তাটি শেষ অবধি নিজেই, সাতোরির জন্য নিজে নিজে একার ক্ষমতায় জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটাতে হয়। তত্ত্বের চেয়েও সজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির গুরুত্ব বেশি। অপরের থেকে জ্ঞান লাভ করার চেয়েও অন্তরকে জাগ্রত করাতেই সিদ্ধি। সত্যকে অক্ষরে ধারণ করা যায় না, তার অধিষ্ঠান অব্যক্ত পরিসরে। এতটাই যে এমনকি বিমলাকীর্তির “নিঃশব্দ বজ্রপাত” অবধিও সম্ভব। চীনদেশে জেন সাধনার প্রবর্তক বোধিধর্ম (ষষ্ঠ শতক নাগাদ দক্ষিণ ভারতের রাজপুত্র, যিনি চীনদেশে গিয়েছিলেন), যেটাকে বলা হয় “দেওয়ালের দিকে মুখ করে ন’বছর”, সেভাবে গুহার পাথুরে দেওয়ালের দিকে ফিরে ন’বছর টানা বসে বসে গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটানোর পরে সাতোরি লাভ করেছিলেন বলে বলা হয়। জেন-এর ‘জাজেন’ এসেছেই বোধিধর্মের সেই উপবিষ্ট অবস্থায় ধ্যান থেকে।

প্রশ্ন করলে বলেন, প্রশ্ন না করলে বলেন না, বোধিধর্ম, সে কেমন মন যাতে কোনও কথা থাকে
                                                     --- ইক্কিয়ু

আবার, সেই একই ইক্কিয়ুর একটি নীতিশিক্ষামূলক কবিতা,

মন জিনিসটা কী তা বলতে হলে, কালিতে আঁকা ছবিতে যে পাইনের হাওয়ার শব্দ

এতেই রয়েছে প্রাচ্যের চিত্রকলার স্পিরিট বা আত্মাটা। প্রাচ্যের চিত্রকলায় ফাঁকা জায়গা, মার্জিন,  পরিমিতির প্রয়োজনে যা বাদ রাখা হল, এগুলোর মধ্যেও কালিতে আঁকা ছবির প্রাণটা লুকিয়ে আছে। চৈনিক চিত্রকর চিন নাং-এর কথায়, “মুনশিয়ানা সহকারে আঁকা ছবিতে গাছের ডালে বাতাসের তোলা আওয়াজ অবধি শোনা যায়”। সাধক দোওগেনও এরকম বলেছেন, “এমনটা আর দেখিনি, বেণুর স্বরে পথের সন্ধান মেলা, পীচের ফুলে হৃদয় আলোকিত হয়ে ওঠা”।

জাপানের ফুল সাজানোর বিদ্যা, ইকেবানার খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ইকেনোবো সান’ও (১৫৩২ – ১৫৫৪) তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীতে বলেছেন, “কেবল অল্প একটু জল আর গাছপালা দিয়ে যেমন অসংখ্য নদী ও পাহাড়ের আভাস ফুটিয়ে তোলা হয়, অল্পসময় ঝুঁকে দেখলেই কত অসংখ্য চমৎকারিত্বে ঠাসা, বলা যায়, যেন গণিতবিদ সেংকা-র যাদুর মতো”। জাপানের বাগান কিংবা পার্কও বিশাল প্রকৃতিরই প্রতীক। পশ্চিমের বাগান কিংবা পার্ক অধিকাংশই তৈরি করা হয় প্রতিসাম্য বজায় রেখে, তুলনায় জাপানের বাগান, পার্ক তৈরি করা হয় বিনা প্রতিসাম্যে। প্রতিসাম্যের তুলনায় প্রতিসাম্যের অভাবই যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক বেশি, বিস্তারের প্রতিনিধিত্ব করতে এই দ্বিতীয়টিই বেশি সক্ষম। অবশ্যই এই প্রতিসাম্যহীনতা ততটুকুই যাতে জাপানিদের বিশেষ সূক্ষ্ম চেতনায় জিনিসটাতে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। জাপানের উদ্যান সৃষ্টির পদ্ধতির মত এত জটিল, বহুমুখী ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেইলের প্রতি নজর সমৃদ্ধ উদ্যানসৃষ্টির প্রক্রিয়া আর নেই। ‘বারে-সান-সুই’ (শুকনো পাহাড়, জল) নামে শিলা ও পাথরের সমন্বয়ে যে পদ্ধতি, তাতে একত্রিত পাথরগুলোর মাধ্যমে যে পাহাড় বা নদী সেখানে নেই, সেগুলোকে, এমনকি মহাসমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়া পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা হয়। এহেন সংক্ষিপ্তকরণেরই একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সেটা জাপানেরই যেন ‘বোনসাই’ হয়ে ওঠে, একে বলা হয় ‘বোনসেকি’ (ট্রে-তে ধারণ করা পাথরের ল্যান্ডস্কেপ)।

 ‘সান-সুই’ (পাহাড়-জল) কথাটার মধ্যে পাহাড় এবং জল, অর্থাৎ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, পাহাড় ও নদীর ছবি, অর্থাৎ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর চিত্রাঙ্কণ, উদ্যান ইত্যাদি থেকে শুরু করে, “যা কিছু জীর্ণ হয়ে যায়” কিংবা “পরিত্যক্ত ও চমৎকারিত্বহীন”, এই সমস্ত অর্থই ধরা আছে। তবে, “নম্র বিনয় ও পবিত্র সুষমা” আখ্যায়িত চা-উৎসবের অত্যন্ত মহার্ঘ্য “বাবি, সাবি”, নিশ্চিত করেই বরং হৃদয়ের সম্ভারের এক বিশাল মজুত ভাণ্ডার, আর অপরিসর, অনাড়ম্বর চা-কক্ষও বরং  অবাধ বিস্তার আর নিঃসীম সম্ভ্রম ধারণ করছে। একটি মাত্র ফুলই পারে একশত ফুলের চেয়েও বেশি করে ফুলের সৌন্দর্য অনুভব করাতে। একথা রিকিয়ুও বলে গেছেন যে পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল ব্যবহার করা অনুচিত, সেই থেকে আজও জাপানে চা-উৎসবে চা-কক্ষের দেওয়ালের খোপে কেবল একটি মাত্র ফুল, তাও আবার না ফোটা একটি কুঁড়ি দিয়ে সাজানো হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। শীত এলে, শীত ঋতুর ফুল, যেমন ধরা যাক, ‘শ্বেত-রত্ন’ কিংবা ‘একাকিত্বে সহায়’ নাম দিয়ে ক্যামেলিয়া, নানা ধরণের ক্যামেলিয়ার মধ্যেও ছোট যেটা, সে জিনিস সাদা একটা বেছে নিয়ে, কেবল একটামাত্র কুঁড়ি দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। বর্ণহীন সাদা রঙটাই সবচেয়ে পবিত্র, তদুপরি ওর মধ্যেই আছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রঙ। এছাড়া সেই কুঁড়িতে অবশ্য করেই শিশির থাকতে হবে। কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে ফুলটাকে ভিজিয়ে রাখা হয়। মে মাসে, সেলাডন চিনেমাটির ফুলদানিতে পিওনি সাজানো হচ্ছে চা-উৎসবের পুষ্পসজ্জা হিসেবে সবচেয়ে চমৎকার, তবে যথারীতি সেটি পিওনির একটি সাদা কুঁড়ি এবং তাতে যথারীতি শিশিরও থাকবে। কেবল যে ফুলেই জলের ছিটে দিতে হয় এমন নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাটির বা চিনেমাটির ফুলদানিতে আগে থেকে জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়।

পোড়ামাটি বা চিনেমাটির ফুলদানির মধ্যে উঁচু স্থান এবং উচ্চমূল্য হচ্ছে সাবেক কালের ইগা (মোটামুটি ষষ্ঠদশ কি সপ্তদশ শতকের)। তাকে জল দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে দিনের শুরুতে ঘুম ভেঙে প্রথম চোখ মেলার সময়ের মতই একটা মনোরম প্রাণবন্ত ভাব তার থেকে বিচ্ছুরিত হয়। বেশ জোরালো আগুনে উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় এই ইগা। এর দাহ্যবস্তুর(জ্বালানি)ছাই এবং ধোঁয়া এসে লাগে ফুলদানির গায়ে, গড়িয়ে পড়ে, আঁচের তাপমাত্রা একটু কমে আর তাতে করে ওর ওপর একটা উজ্জ্বল আস্তরণ এনামেলের মত তৈরি হয়। মৃৎশিল্পীর হাতের কৃত্রিম কাজ নয়, চুল্লির ভেতরে স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে যাওয়া একটা প্রণালী, তাই চুল্লির বিচিত্র কেরামতি বললেও চলে এমনই সব নানারকম রঙীন নকশার জন্ম হয়। আঁচে তৈরি সেই ইগার পরিশীলিত, অমসৃণ ও পোক্ত উপরিতল আর্দ্রতা পেলেই বেশ চকচকে ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে। ফুলের শিশিরের সঙ্গে শ্বাস বিনিময় করে। চায়ের পেয়ালাও আগে থেকে জল দিয়ে ভিজিয়ে রেখে আর্দ্রতা প্রদান করে চায়ের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলা হয়। ।

ইকেনোবোর বিবেচনায় (মুখ-নিঃসৃত বাণী), “প্রান্তর, পাহাড়, জল ইত্যাদি অঞ্চলে, ক্ষেতের আলপথ দিয়ে যে অবয়ব সৃষ্টি হয়” তা তাঁর নিজের ঘরানায় (ইকেবানার) সদ্যফোটা ফুলের আভাস ধারণ করে, এমনকি ভেঙে যাওয়া ফুলদানি, শুকনো বৃক্ষশাখাতেও “ফুল” থাকে যেহেতু, এতে পুষ্পসঞ্জাত সাতোরি সম্ভব। “প্রাচীন মানুষেরা ফুল সাজিয়ে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের প্রয়াস পেতেন”। জেনের প্রভাবে জাপানের অপরূপ হৃদয়ের জাগরণ ঘটানো গিয়েছিল। এর ভিতরে জাপানে গৃহযুদ্ধের ধ্বংসকাণ্ডের মধ্যে প্রাণধারণ করা মানুষদের হৃদয়টুকুও লুকিয়ে আছে। জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন কাব্যকাহিনী সংগ্রহ, ছোটগল্প কিংবা নভেলা বলা যায় এমন বহু কাহিনী ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে দশম শতাব্দীতে সৃষ্ট “ইসে মনোগাতারি”-তে। এতে আছে,

এক সহৃদয় ব্যক্তির কাছে মৃৎপাত্রে ছিল এক কেমন যেন অদ্ভুত উইস্টারিয়া ফুল। সেই ফুল নুয়ে পড়েছে সাড়ে তিন ফুটের কিছু বেশিই।

এহেন গল্প। অতিথিদের আপ্যায়ণ করতে হেইয়ান আমলের কবি আরিবারা য়ুকিহিরা নাকি এমনই ফুল সাজিয়েছিলেন। ফুলের গুচ্ছ সাড়ে তিনফুট নুয়ে পড়েছে, এ বেশ অস্বাভাবিকই বটে, সন্দেহ জাগার মতই, তবে আমি এই উইস্টারিয়া ফুলের মধ্যে হেইয়ান সংস্কৃতির একটা প্রতীক যেন অনুভব করি। উইস্টারিয়া খুবই জাপানি, এবং এতে আছে রমনীসুলভ সৌন্দর্য, প্রস্ফুটিত পুষ্পভারে স্তোকনম্রা, তার মধ্যেও যখন দুলতে দেখা যায়, তখন যেমন স্পর্শকাতর, বিনীত, তেমনই কোমল, প্রথম গ্রীষ্মের সবুজের সমারোহে এই আবির্ভূত হচ্ছে, এই যেন হারিয়ে যাচ্ছে, যেন বস্তুজগতের যে বিষাদ ও অসহায়তা, যাকে বলা হয় “মোনো নো আওয়ারে”, তার মধ্যে আসা যাওয়া করছে। এহেন ফুলের গুচ্ছ সাড়ে তিনফুটেরও বেশি হলে সেটা একটু কিম্ভূত চমৎকারিত্বই বটে। চীনের তাং ডাইন্যাস্টির সংস্কৃতি আত্মস্থ করে উপযুক্তভাবে জাপানীকরণের ফলে মোটামুটি হাজার খানেক বছর আগে চমৎকারিত্বে ভরা হেইয়ান সংস্কৃতির জন্ম হয়। জাপানি সৌন্দর্যচেতনার আবির্ভাব আর এই “কেমন যেন অদ্ভুত উইস্টারিয়া ফুল” প্রস্ফুটিত হওয়া মধ্যে যেন কি মিল আছে, আর সেটাও এক অদ্ভুত চমৎকারিত্ব বলে গণ্য করা হয়। কবিতার ক্ষেত্রে, সম্রাটের আদেশানুসারে সৃষ্ট সর্বপ্রথম সংকলন “কোকিনশু” (৯০৫ সাল), গদ্য উপন্যাসে “ইসে মোনোগাতারি”, মুরাসাকি শিকিবু-র (মোটামুটি, ৯৭০ সাল – ১০০২ সাল) “গেনজি মোনোগাতারি”, সেই শোনাগোন-এর (মোটামুটি, ৯৬৬ সাল – ১০১৭ সাল, শেষ যে বছরের নথিপত্র পাওয়া যায়) “মাকুরা নো সোওশি” ইত্যাদি, জাপানের ক্লাসিকাল সাহিত্যের সর্বোচ্চ মাস্টারপিস এগুলোই। এরাই জাপানি নান্দনিকতার ঐতিহ্য সৃষ্টি করে ছ’শো বছর ধরে পরবর্তীকালের সাহিত্যকে, প্রভাবিত করেছে বলার চেয়েও বলা ভাল, নিয়ন্ত্রণ ও পথনির্দেশ করেছে। বিশেষ করে, প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস, “গেনজি মোনোগাতারি”, আধুনিক যুগেও এর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে এমন উপন্যাস নেই, সেই দশম শতাব্দীতে যে এমন আধুনিক ও দীর্ঘ উপন্যাস লেখা হয়েছিল, তা জগতের এক অত্যাশ্চর্য নজির হিসেবে ব্যাপক প্রসিদ্ধি পেয়েছে। ছোটবেলায় পুরনো যুগের ভাষা ভাল করে না বুঝেই পড়তাম, এবং তার মধ্যে ছিল এই হেইয়ান যুগের সাহিত্যের বহু ক্লাসিকস। এদের মধ্যেও আবার “গেনজি মোনোগাতারি” একেবারে আকন্ঠ গোগ্রাসে গিলেছি। “গেনজি মোনোগাতারি” পরবর্তী সময়ে, এই মাস্টারপিসটিতে মুগ্ধ হয়ে, কত শত বছর ধরে যে, হয় এর নকল করে নতুবা সামান্য পরিবর্তন করে জাপানে উপন্যাস লেখা জারি থেকেছে! কবিতা তো বটেই, আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে শুরু করে উদ্যানশিল্প, সবক্ষেত্রেই “গেনজি মোনোগাতারি” ব্যাপকভাবে ও গভীরভাবে এদের নান্দনিক পরিপুষ্টির উৎস হয়ে থেকেছে। 

মুরাসাকি শিকিবু আর সেই শোনাগোন, এছাড়াও ইজুমি শিকিবু (৯৭৯ সাল – মৃত্যুকাল অজ্ঞাত)কিংবা আকাজোমে এমোন (মোটামুটি, ৯৫৭ সাল – ১০৪১ সাল) ইত্যাদি বিখ্যাত কবিরা সকলেই ছিলেন প্রাসাদের পরিচারিকা রমণী। হেইয়ান যুগের সংস্কৃতি সাধারণভাবে রাজসভার সংস্কৃতি, আর তাই একটু রমণীসুলভও বটে। “গেনজি মোনোগাতারি” কিংবা “মাকুরা নো সোওশি”-র সময়কালকে এই সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ বলা যায়, এবং পরিণতি পেয়ে চূড়ায় পৌঁছে যেনবা অস্তাচলগামী।  ততদিনে বর্ণাঢ্যতার চরমসীমায় পৌঁছনোর বিষাদ যেন বা হাওয়ায় টের পাওয়া যাচ্ছে, তাহলেও জাপানের রাজকীয় সংস্কৃতির চরম বিকাশ এই সময়টাতেই পরিলক্ষিত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় রাজসভার অমাত্যদের থেকে সামুরাইদের হাতে, কামাকুরা যুগ (১১৯২ সাল – ১৩৩৩ সাল) থেকে মেইজি যুগের প্রবর্তন (১৮৬৮ সাল) পর্যন্ত মোটামুটি সাতশো বছর ধরে সামুরাইদের সামন্ততান্ত্রিক শাসন চালু ছিল। তবে, সম্রাট-প্রথা কিংবা রাজন্য সংস্কৃতি, কোনওটাই ধ্বংসপ্রাপ্তও হল না, অন্তর্হিতও হল না, কামাকুরা যুগের প্রথম দিকে সম্রাটের নির্দেশে সংকলিত কবিতা সংগ্রহ, “শিনকোকিনশু” (১২০৫ সাল) হেইয়ান যুগের “কোকিনশু”-র পরিশীলিত কাব্যরীতিকে আরও খানিক এগিয়ে নিয়ে গেল, সেখানে শব্দের খেলার প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হওয়াও আছে বটে, আকর্ষণীয়তা, রহস্যময়তা, ইঙ্গিতময়তা বজায় রেখে, ইন্দ্রিয়বাহিত বিভ্রম যোগ করে, আধুনিক প্রতীকধর্মী কবিতায় সে উপনীত হয়েছে। বৌদ্ধ যাজক সাইগিয়ো (১১১৮ সাল – ১১৯০ সাল) ছিলেন এই দুই যুগ, হেইয়ান ও কামাকুরার সংযোগসাধনের প্রতিনিধিস্বরূপ কবি।

যার কথা ভাবতে ভাবতে শয়নে তার দেখা পেলাম, স্বপ্ন জানলে জাগতামই না,
স্বপ্নে তারি কাছে অক্লান্ত চরণে গতায়াত, বাস্তবে তা একমুহূর্তেরও তুল্য নয়

ইত্যাদি “কোকিনশু”তে ওনো ওমাচির কবিতা, স্বপ্ন নিয়ে কবিতা হলেও অকপটভাবে বাস্তবসম্মত। আর তারপর “কোকিনতাইসেই” যুগটা কেটে যাওয়ার পর, আরো সূক্ষ্ম হয়ে পড়া চিত্রায়ণ, 

চড়াইয়ের ঝাঁক কিচিরমিচির করা বাঁশঝাড়ে এসে পড়ল সূর্যের পড়ন্ত আলো শরতের রঙে ধোয়া
মাহাগি ফুল ছড়িয়ে থাকা বাগানে শরতের বাতাস শরীরে এসে বেঁধে আর সাঁঝের সূর্যের আলো দেওয়ালে মিলিয়ে যায়

ইত্যাদি, মুরোমাচি যুগের (চতুর্দশ শতক – ষষ্ঠদশ শতক) ইক্কিয়ু আর সেই সময়েরই সম্রাজ্ঞী এইফুকুর কবিতা, জাপানের সূক্ষ্ম বিষাদের প্রতীক, আর আমার মতে খুবই কাছাকাছি বলেই অনুভূত হয়।

“শীতে তো কেবল তুষার, ঠাণ্ডা হিম” বলে যে নিজের কবিতায় লিখেছিলেন বৌদ্ধ যাজক দোওগেন, কিংবা “আমরা দুজনেই শীতের চাঁদ”, কবিতায় লিখেছিলেন যে মিয়োউয়ে, দুজনেই ছিলেন মোটামুটিভাবে “শিনকোকিনশু” যুগের লোক। মিয়োউয়ে কবিতা বিনিময় করতেন সাইগিয়োর সঙ্গে, এবং কবিতা নিয়ে গল্প করতেন।

যাজক সাইগিয়ো চিরকালই এসে গল্প করে বলতেন, আমার কাছে কবিতা পড়া জিনিসটা, যেমনটা সচরাচর দেখা যায় তার চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম, ফুল, কোকিল, চাঁদ, তুষার, এই সমস্ত হাজারো জিনিসের প্রতি আগ্রহ সত্ত্বেও, মোটামুটি সবগুলোকেই কেমন মেকি, বিভ্রম বলে মনে হয়, দৃষ্টির পথরোধ করে এসে দাঁড়ায়, কানে ঝমঝম করে বেজে ওঠে। আর যখন পাঠ করি তখন কথাগুলো সব ঠিক সেই কথাই থাকে না, ফুল বললে সত্যিই ফুলের কথা মনে হয় না, চাঁদ উচ্চারণ করলে প্রকৃতই চাঁদের কথা মনে হয় না। কেবল যেন ওভাবে চারপাশের থেকে বিযুক্ত অবস্থায়, জিনিসটার প্রতি আকর্ষণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে, স্রেফ পড়ে রাখা হল। রামধনু উঠলে মনে হয় যেন আকাশের শূন্যতাই ঐ বর্ণ ধারণ করেছে। প্রখর সূর্যের দীপ্তিতে মনে হয় যেন আকাশের শূন্যতাই ওইভাবে প্রতিভাত হল। অথচ আকাশের শূন্যতা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। আর বর্ণও ধারণ করে না। এই আকাশের শূন্যতার মতো করে দেখলে, আমরা বলতে পারি যে এই কবিতা অর্থাৎ এটি, নানা রূপ পরিগ্রহ করে, বর্ণ ধারণ করে, যার আর পরে কোনো চিহ্নই থাকে না, এবং এটাই তথাগতের প্রকৃত রূপ।
                       (মিয়োউয়ের অনুগামী, শিষ্য কিকাই কথিত) 

জাপান কিংবা প্রাচ্যের “শূন্য পরিসর”, ‘মু’-র কথা এখানে প্রযোজ্য। আমার লেখায়ও শূন্যতা আছে বলে বলেছেন কোনো কোনো সাহিত্য আলোচক। পশ্চিমী অর্থে যে নিহিলিজম বলে কথাটি, তা কিন্তু এখানে খাটে না। দুটোর ধারণাগত ভিত্তিই পৃথক বলে আমি মনে করি।  দোওগেন-এর চারঋতুর কবিতাকে যে “হোনরাই মেনমোকু” বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী, চারটি ঋতুর সৌন্দর্য বর্ণন করতে গিয়ে তিনি আসলে প্রবলভাবে জেন-এ নিমগ্ন হয়েছিলেন বৈকি!
---              

টীকা - 

১। The Manilla Galleon, which, you may remember, used to go once a year between the Philippines and Spanish America, was driven by a typhoon on to the Japanese coast. The Spanish captain tried to frighten the local Japanese by showing them a map of the world, and especially pointing out the vast possessions of the Spanish King. The captain was asked how Spain had managed to get this huge empire. Nothing so simple, he replied. The missionaries went first, and when there were many converts, soldiers were sent to combine with the converts and overthrow the government. When a report of this reached Hideyoshi, he was not over-pleased and became still more bitter against the missionaries. He allowed the Manilla Galleon to go, but he had some of the missionaries and their converts put to death.

…… At any cost they wanted to keep the foreigners out….

  And now began a unique thing in history. This was the closing up of Japan….

  For over 200 years Japan was almost completely cut off from the world, even from its neighbours, China and Korea.