সুয়োরানীর সাধ : এক রূপকথার বিনির্মাণ

সেসময় কলকাতায় বসে ছটফট করছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ। পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিকামী বিপ্লবীদের দমন-পীড়নের জন্য 'রাওলাট অ্যাক্ট' চালু করেছে ব্রিটিশ সরকার। প্রতিবাদে দেশজুড়ে শুরু হওয়া আন্দোলন দমনের নামে  চলতে থাকে ইংরেজদের হিংস্র তাণ্ডব।  ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র জনতার ওপর বিনা প্ররোচনায় জেনারেল ডায়ার গুলি চালান। কালো কালিতে লেখা হল ইতিহাসের ঘৃণ্যতম 'অন্ধকূপ হত্যা' পর্ব। ১৪ই এপ্রিল, পরের দিন পাঞ্জাবে সামরিক আইন চালু হয়। সেখানকার খবর প্রকাশে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি হল।

রবীন্দ্রনাথের কানে আসছিল এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের টুকরো কিছু খবরাখবর। শরীরটাও তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না সেসময়। বর্বর শাসকের  এই অন্যায় অপরাধের প্রতিবাদ না করেও শান্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন। ভারতবর্ষের এমন সংকটের মুহূর্তে তিরিশে মে-র ভোররাতে লিখলেন সেই ঐতিহাসিক চিঠি। প্রতিবাদী সেই চিঠিতে ইংরেজ সরকারের দেওয়া 'নাইটহুড' উপাধি ত্যাগের সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করলেন তিনি। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তাঁর স্মৃতিকথায়  জানাচ্ছেন, "তারপর যেদিন 'নাইটহুড' ছাড়ার চিঠি পাঠিয়ে দিলেন সেইদিন থেকে নিশ্চিন্ত। সকালবেলা আমি চিঠিখানা নিয়ে গেলাম আর বিকেলে এসে দেখি তেতলার ঘরে চলে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকতেই একটা ছোট্ট লাল খাতা আমায় দিয়ে বললেন, 'এই নাও আর একটা লেখা' দেখি, 'বাপ শ্মশান হতে ফিরছে' ওইটে লিখেছেন। এইটাই 'লিপিকা'র প্রথম লেখা। তারপরে কদিনের মধ্যেই হুড়মুড় করে সমস্ত বইখানা লেখা হয়ে গেল। কবি স্বয়ং লিখেছেন, "বেশ মনে আছে দিনের-পর-দিন 'লিপিকা' লিখছি। কোথায় গেছে জালিয়ানওয়ালাবাগ কোথায় গেছে পলিটিক্স। আমার আর কিছুই মনে নেই, কেবল লেখার মধ্যে ডুবে রয়েছি। ভাষা কী! একেবারে নতুন চেহারা নিয়েছে। আশ্চর্য! কোথা থেকে এলো ওরকম ভাষা? আমি অনেকবার দেখেছি কোন কিছু একটা নিয়ে মনটা বড্ড বেশি নাড়া খেলেই তারপর আমার লেখা বেরোয়।"

আশ্চর্য ভাব আর অপরূপ ভাষার স্বাতন্ত্র্যে 'লিপিকা' রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রদীপ্ত হয়ে আছে। 'লিপিকা'র প্রতিটি রচনাই পাঠককে পৌঁছে দেয় অন্য এক বোধের কাছে। গঠনের দিক থেকেও রচনাগুলি অনন্য, অভিনব। 'লিপিকা'র প্রথম পর্যায়ের লেখাগুলিকে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন 'গীতিগদ্য'। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের 'পুনশ্চ' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাটি স্মর্তব্য, "আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজির মত বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না।... আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, 'লিপিকা'র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে, ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয়নি---- বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ। ড.তপোব্রত ঘোষ তাঁর 'ছোটগল্পের শিল্পরূপ' বইয়ে 'লিপিকা'র দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের রচনাগুলিকে নতুন ধরনের গল্পশিল্প রূপে চিহ্নিত করেছেন. তিনি বলেন 'গল্পগুচ্ছ' যদি ছোটগল্প হয় তবে লিপিকার গল্প হোক 'ছোট্টোগল্প,' ইংরেজিতে যাকে বলা হয় 'শর্ট শর্ট'। রবীন্দ্রনাথ এই গল্পগুলির নামকরণ করতে চেয়েছিলেন 'কথিকা' বা 'গল্পস্বল্প'। এই ছোট্ট গল্পগুলির মধ্যেও কিন্তু একটা অন্তর্লীন গীতিঝংকার স্পষ্ট শুনতে পাই আমরা। তা আমাদের পৌঁছে দেয় এক অন্যরকম উপলব্ধিতে। পাঠকের মর্মে খুব সহজে নাড়া দেয় এই সহজ ভঙ্গিমাতে পরিবেশন করা চিরন্তন মানবদর্শনের অনুলিখন। 'লিপিকা'-র এমনই এক কাব্যসৌরভে আমোদিত ছোট্টগল্প 'সুয়োরানীর সাধ'।

'সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল।' এই 'কাল' বিমর্ষতার, এই 'কাল' হাঁপিয়ে ওঠার, এই 'কাল'  ভালো না লাগার। ভোগের উপচার সুয়োরানীর পায়ে উপচে পড়ে, তাই তার অসুখ সুখহীনতার।এই অসুখ নিরাময়ের কোন ওষুধ নেই, আছে শুধু সুখকে ছুঁয়ে দেখার অর্বাচীন ইচ্ছে। এমন অসুখটি সে বাধিয়েছে সেই 'দোলযাত্রা'র দিন থেকে। 

গল্পের প্রথম দৃশ্যের প্রেক্ষাপট বসন্তকাল। বসন্তের রংয়ের জোয়ারে ভেসে যাওয়া প্রকৃতিতে ফুটে উঠেছে দুয়োরানীর কুটিরের শান্তশ্রী ছবিটি।'পথের পাশে, নদীর ধারে,ঘাটের উপরটিতে...একখানি কুঁড়েঘর, চাঁপা গাছের ছায়ায়। বেড়া বেয়ে অপরাজিতার ফুল ফুটেছে, দুয়োরের সামনে চালের গুঁড়ো দিয়ে শঙ্খ চক্রের আলপনা'। এ বুঝি এক নিবিড় শান্তির আশ্রয়। এই শান্তির সন্ধানেই যেন সুয়োরানীর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে। সে যখনই যেখানেই যায় সেখানেই তার 'আগে লোক', 'পিছে লশকর', 'ডাইনে বাজে বাঁশি, 'বাঁয়ে বাজে মৃদঙ্গ'।তাকে বেষ্টন করে থাকে আড়ম্বরের দম্ভ, মাটির নরম স্পর্শ থেকে বঞ্চিত সে। তার ভ্রমণের জন্য সজ্জিত থাকে ময়ূরপঙ্খী। রাজা কেবলি তাকে কোঠাবাড়ি বানিয়ে দিতে চান গজদন্তের  দেওয়াল দিয়ে মুড়ে। কিন্তু সুয়োরানীর সাধ  প্রকৃতির কোলে ছায়া সুনিবিড় একটা কুঁড়েঘরের। যেমনটা তার চোখে পড়েছে নিজের শোভাযাত্রার সময়ে। কিন্তু সে ঘর বানানো কি মুখের কথা? মাটির আবরণে রাজপ্রাসাদে একটা সুন্দর কুঁড়েঘর বানানো যায়, কিন্তু তা কেবল  বাহ্যিক অনুকরণমাত্র তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। প্রকৃতির অকৃপণ ঐশ্বর্যের প্রশান্তি রাজপ্রাসাদে কখনও জায়গা পেতে পারে না।মণিমুক্তোখচিত রাজপ্রাসাদের বৈভব, সেই জমক মনকে ক্লান্ত করে, স্নিগ্ধ করতে অসমর্থ।
প্রকৃতির স্পর্শ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া এখনকার ভোগবাদী মানুষজন হয়ে আমরাও কি এই ক্লান্তি অনুভব করি না?  একদিন আমরাই ভোগসর্বস্বতা দিয়ে যাপিত জীবনকে আপন করে নিয়েছি। অমূল্য প্রাকৃতিক দানকে অগ্রাহ্য করে জীবনকে জাগতিক মোহবন্ধনে বন্দী করেছি নিজের হাতে আমরাই।  অস্ত্র তুলে নিয়ে সমূলে ধ্বংস করে চলেছি তাকে। নাগরিক জীবনের মোহে ক্রমশ প্রকৃতিকে সরিয়ে দিয়েছি নিজেদের থেকে  অনেক দূরে। আমাদের জীবন ক্রমে জটিল হয়ে উঠেছে জাগতিক চাওয়া পাওয়ার অঙ্কে। অতৃপ্ত কামনা বাসনা চরিতার্থ করাটাই যেন সেই মূঢ় জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে। আরও আরও  চাইতে চাইতে  ঠিক কী চাইছি আমরা সে কথাও বিস্মৃত হচ্ছি। সুয়োরানির মুখে সেই চাওয়ারই  প্রতিধ্বনি কি শুনি আমরা? "আমার সাত মহলা বাড়ির একধারে তিনটে মহল ছিল দুয়োরানীর। তারপরে  হল দুটো, তারপরে হল একটা, তারপরে রাজবাড়ী থেকে সে বের হয়ে গেল"।  আমরাও কি নিজেদের জীবনের অঢেল সমৃদ্ধি চেয়ে  এভাবেই  অন্যকে বঞ্চনা  করি  না? অপরকে ক্রমাগত দৈন্যের খাদে ঠেলে দিয়ে নিজের ভোগের পিপাসা মেটাই না?
দোলযাত্রার দিনে দুয়োরানীর শান্তি কুটিরটি দেখেই সুখক্লান্ত রানীর  মন চেয়ে বসেছে  পরমা প্রকৃতির কোলে নিবিড় আশ্রয়ের। সুখ তো নয়ই সঙ্গে শান্তিও তার জীবনে রয়ে গেছে অধরা।

গল্পের দ্বিতীয় দৃশ্যের প্রেক্ষাপট  বর্ষাঋতু। স্নানযাত্রার পালা। রানীর স্নানযাত্রা, সঙ্গে তার পায়ের অর্গল একশত সাত সঙ্গিনী। শীতল জলের মধ্যে নেমেছে তার পালকি, রানী জলের নিবিড় স্পর্শটুকু পায় নি। সাঙ্গ হয়েছে তার স্নানের প্রহসন। বিলাসবতীর জীবন নিজেকেই নিজে ব্যঙ্গ করেছে। রানীর তৃষিত নয়ন ফেরার পথে চেয়ে চেয়ে দেখেছে স্নানসিক্তা  দুয়োরানীকে, 'যেন নির্মাল্যের ফুল! হাতে শাদা শাঁখা, পরনে লাল-পেড়ে শাড়ি'। স্নানের পর কাঁখের  ঘড়ায় জল  তুলে আনছে দুয়োরানী, সকালের আলো তার ভিজে চুলে আর উপচে পড়া ঘড়ার উপর ঝিকমিকিয়ে উঠছে। অযুত ধন সম্পদের প্রতীক সুয়োরানীর মন ওই রোদের সোনাটুকু স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।'বর্ষাস্নিগ্ধ প্রকৃতির মূর্তিমতী রূপ' দুয়োরানীকে দেখে সুয়োরানীর তৃষিত জীবনে সাধ জাগে, সেও ওইরকম শাদা শাঁখা পরে  লালপেড়ে শাড়ি পরে নদীতে স্নান সেরে ঘড়ায় করে জল তুলে আনবে।কিন্তু এবারেও এই ব্যর্থ অনুকরণ তাকে শান্তি দেয় না, দুয়ারের কাছে এসে মনের দুঃখে আছড়ে ভাঙে সে তার ঘড়া। যা তার প্রাণ চায় তাকে সে কিছুতেই যেন পায় না।বাহ্যিক আড়ম্বর আয়োজন সম্পূর্ণ ভাবে ত্যাগ না করলে বুঝি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়না! আর প্রকৃতির হৃদয়ে আসন পেতে বসবার অধিকার সবাই অর্জন করতে পারে কী? এ লেখা পড়তে পড়তে তাই মনে জাগে এক অনিবার্য প্রশ্ন। আধুনিকতার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন  আমরা কি নিছক মোহের উপাসনা করছি না?  সভ্যতার থাবার নিচে শিকার হয়ে আরও আরও চাইবার হাতছানি এড়াতে না পেরে আমরা কি একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছি না সুখ নামের সেই আপেক্ষিক ধারণাটিকে!

গল্পের শেষ দৃশ্যের প্রেক্ষাপট ঋতু হেমন্ত। রাসযাত্রার দিন। 'জ্যোৎস্নারাত্রে ...নাচ হল, গান হল'। সম্ভোগের অবসাদে ক্লান্ত রানী হাতির হাওদায় বাড়ি ফেরার পথে দেখল শস্য সম্পদে পূর্ণ প্রকৃতির কল্যাণমূর্তি দুয়োরানীর মাতৃবৎসল পুত্রকে। যেন প্রকৃতির পূর্ণতার প্রকাশ। মায়ের জন্য সে নিয়ে চলেছে শালুক ফুল, বনের ফল, খেতের শাক। এই সন্তান যেন দুয়োরাণীর সৃষ্টিসম্পদ। সুয়োরানীও চায়  তার আপন  সন্তান তুলে আনুক শালুক ফুল, বনের ফল, খেতের শাক।একদিন তেমন দৃশ্যের অবতারণা হল।সুয়োরানী সোনার পালঙ্কে বসে থাকে, ছেলে ডালি নিয়ে আসে,"তার সর্বাঙ্গে ঘাম, তার মুখে রাগ"। আরামের জীবনে অভ্যস্ত রাজপুত্র প্রকৃতির সহজিয়া সুরটিকে  স্পর্শ করতে পারে না, সে রাজপুত্রের আভিজাত্যের আড়ালেই থেকে যায়। প্রকৃতি মায়ের সন্তান হয়ে উঠতে পারে না। রানী কেবল বাহ্যিক অনুকরণের লজ্জায় লজ্জিত হয়।  তার মুখে কথা নেই, সে একলা বসে থাকে। তার যে কি চাই তা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। তার তো একটিই মাত্র সাধ, সে সাধের কথা যে কাউকে বলা যায় না। কেউ কি বুঝবে সে কথা? সুয়োরানী তার স্যাঙাৎনিকে ডেকে বলে "ওই দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই"।স্যাঙাৎনি বোঝেনা সে কথার অর্থ। আমরাও কি তা বুঝি?   
     
সম্ভোগের পঞ্চব্যঞ্জনে জীবন যাপন করতে করতে অসাড় হয়ে যায় আমাদের মন। একসময় তা অবসন্ন হয়। ক্লান্তি আসে। সে তখন ফিরে যেতে চায় প্রকৃতির কোলে, চায় সহজ সরল এক প্রশান্তির জীবন। সুখের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা যাকে ফেলে রেখে এসেছি অনেক দূরে। ফিরে যাওয়ার পথরেখাটি আর স্পষ্ট হয় না, অনেক খুঁজেও।

'সুয়োরানীর সাধ' গল্পে রূপকথার রাজা আছে, রানী আছে, রয়েছে সাতমহলা রাজপ্রাসাদ তার ঐশ্বর্যের  গজদন্তমিনার। রানীর শত শত সঙ্গিনী, ছত্রধারিণী, স্যাঙাৎনি, ময়ূরপঙ্খী, হাতি, ঘোড়া, লোকলস্কর। রূপকথায় যেমন থাকে সেসবই আছে। আছে গল্প বলার সেই সহজ সরল লোকায়ত ভঙ্গিটিও। সঙ্গে রয়েছে সুয়োরানীর সুখ খোঁজার অসুখ। যা রূপকথায় ছিল না। এই অসুখই প্রচলিত রূপকথাটিকে ভেঙেচুরে নব রূপকথায় রূপান্তরিত করেছে। মাত্রাতিরিক্ত প্রাপ্তির অন্তর্গত বিষাদ রূপকথার সুয়োরানীকে এক আধুনিক চরিত্র করে তুলেছে। এই বিষন্নতা আধুনিক জীবনের। সুয়োরানী যখন বলে, "ওর ওই বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল, কিন্তু আমার সোনার বাঁশি কেবল বয়েই বেড়ালেম, আগলে বেড়ালেম, বাজাতে পারলেম না।"  তখন বস্তুবাদী ঐশ্বর্যময় নাগরিক জীবনের অন্তরে জমে থাকা কান্নার সুরটি আভাসিত হয়ে সমগ্র রচনাটিতে এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়। প্রাচীন রূপকথার সাজসজ্জার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে নাগরিক জীবনের দীর্ঘশ্বাসটি। সুখ-বৈভব-আরামের জীবনযাপন করতে করতে মানুষের চেতনা যখন অসাড় হয়ে পড়ে তখন দুঃখই পারে তাকে চরম আঘাতে জাগিয়ে তুলতে। তাই সুয়োরানী, দুয়োরানীর দুঃখকে অন্তরে অন্তরে কামনা করেছে। প্রকৃতির মধ্যে নিরন্তর বয়ে চলা সহজ সরল প্রাণের স্পন্দনটিকে নিজের অন্তরে স্পন্দিত করতে চেয়েছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ নাগরিক জীবন এবং প্রথাগত শিক্ষার যাঁতাকল থেকে তরুণ জীবনকে রক্ষা করার জন্য শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।  লিপিকার রচনাগুলি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এই সময়েই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও এর বহু আগে থেকেই কবির এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ১৯০১সালে। প্রকৃতির কাছে থেকে, প্রকৃতির পাঠ নিয়ে, তাকে সঙ্গে নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই সারাজীবন বলেছেন কবি। বিশ্বভারতী তার সেই ভাবনারই এক ফলিত রূপ। এখানেই তিনি তরুণ প্রাণকে প্রকৃতি পাঠের দীক্ষায় দীক্ষিত করে  বাঁশরির সুরে  জীবনের সহজ সরল আনন্দময় সুরটি শেখাতে চেয়েছিলেন। প্রচলিত বস্তুবাদী জীবনের বিপরীত অভিমুখে ছিল তাঁর অভিযাত্রা। দুয়োরানীর আড়ম্বরহীন সহজ প্রাণের আনন্দই যে জীবনের প্রকৃত সুখ, একথা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু আমরা কি তাঁর দেখানো পথে এক পাও অগ্রসর হতে পেরেছি? তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয় কি আজ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার চাপে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া বনফুলে পরিণত হয় নি? সহজ জীবনের উপচে পড়া আনন্দ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আজ আমরাও কি অন্তরে ক্লান্তি অনুভব করি না? অর্থ,ঐশ্বর্য, প্রযুক্তির মত কয়েক গণ্ডা আলেয়ার পেছনে দৌড়তে দৌড়তে ক্লান্ত মন যখন সবুজের বুকে ফিরে আসার জন্য  আকুলি বিকুলি করে, তখন তা নিছকই এক অভিলাষ হয়ে থেকে যায়, পৌঁছানো যায় না সেই অচিনপুরের আনন্দের কাছে। আজ নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় অসুখ নাকি এটাই। এই অসুখ সারে না। পাওয়া না পাওয়ার ভোগসর্বস্ব জীবন মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠে বলে, "ওই দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই"।